মৃগতৃষ্ণা-১৪

0
787

#মৃগতৃষ্ণা-১৪
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★সেদিনের ঘটনার দুদিন পার হয়ে গেছে। পঙ্খি যথাসাধ্য চেষ্টা করে ইন্ধনের সামনে না যাওয়ার। লোকটাকে এখন ওর অসহ্য লাগে। আর সেদিনের ওই কথার পর তো তার সামনে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। ইন্ধনের জন্য তার মনে এখন ক্ষোভ ছাড়া আর কিছুই কাজ করে না।

পঙ্খির ফুপু শাশুড়ীর মেয়ে লুবনা গর্ভবতী ছিল। আট মাস চলছে তার এখন। আজ তাঁকে বাপের বাড়ি সন্তান প্র,সবের জন্য নিয়ে আসা হবে। ফুপু শাশুড়ী এবাড়ির সবাইকে যাওয়ার আদেশ জারি করে দিয়েছে। তাই সকাল সকাল সবাই যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। পঙ্খির যাওয়ার তেমন ইচ্ছে ছিলোনা। তবে লুবনা ফোনে অনেক অনুরোধ করে বলেছে যাওয়ার জন্য। তাই আর পঙ্খি মানা করতে পারেনি। পঙ্খি সবসময়ের মতোই বোরখা পরে সবার আগেই তৈরি হয়ে বসার ঘরে চলে এলো। খোদেজা তৈরি হয়ে সোফায় বসে পান চিবুচ্ছে আর বাকিদের তাগাদা দিচ্ছে।
–নে রে কইলো তোরা ব্যাক?আর কতো আলতা পাউডার লাগাবি? ছোত(দ্রুত) কইরা আয়। দেরি হইয়া যাইত্যাছে। গেদি দেহিস আক(রাগ) হইরা ফ্যালাইবো।

রাবেয়া আর জাহানারাও তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে আসতে আসতে বললো।
–এইতো আম্মা আইছি।
ছায়াও কানের দুলটা ঠিক করতে করতে দৌড়ে এসে বললো।
–কি হইছে দাদী গলা ফাড়ো ক্যা? ঠিকমতো লিপস্টিকও লাগাতে পারলাম না তোমার জন্য। ওদের মাঝে ইন্ধন দরজা দিয়ে ঢুকলো বাসায়। রাবেয়া তাঁকে দেখেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললো।
–কিরে গ্যাদা তুই এখনো তৈরি হোসনি কেন? যাওয়ার সময় হয়ে গেছে তো।

–তোমরা যাও মা। আমার যেতে ইচ্ছে করছে না।এমিনিতেও আমার ওখানে কোনো কাজ নেই।

খোদেজা বলে উঠলো।
–কি কইস গ্যাদা? তোর বিটি(ফুপু) বারবার কইরা কইসে তোক নিয়া যাইব্যার নাইগ্যা। তুই না গেলি আক হইরবো তো। আর লুবনা ছেড়িও মন খারাপ হইরবো।

সামছুল মজুমদারও ওদের মাঝে এসে ইন্ধনের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো।
–মা ঠিকই বলছে ইন্ধন। তুমি ওদের সাথে যাও।এমনিতেও একজন পুরুষ মানুষ যাওয়া দরকার। জুবায়েদ দলের এক কাজে উল্লাপাড়া গেছে। জহিরও বাড়িতে নেই। আর আমিও যেতে পারছিনা। তাই তুমি ওদের সাথে গেলে ভালো হবে।

ইন্ধন চাচার কথা আর ফেলতে পারলোনা। তাই সে রাজি হয়ে গেল। খোদেজা তখন সামছুল মজুমদারের উদ্দেশ্যে বললো।
–তুই আবার কোনে যাবি গ্যাদা?

–তুমিই তো পঙ্খির নতুন কাপড় চোপড় আনার জন্য মাথা খাচ্ছিলে। তাই আমি আজ অন্য শহরে যাবো পঙ্খির জামাকাপড় আনতে।

–ও আচ্ছা আচ্ছা তালি যাও তুমি।

রঙ্গিন কাপড় চোপড়ের মেয়াদ বুঝি আজই শেষ তাহলে। কাল থেকে হয়তো আবারও সেই বেরঙ কাপড়ে মুড়তে হবে নিজেকে। কথাটা ভেবে বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো পঙ্খির। কদিন এই কাপড়ে থেকে নিজের অস্তিত্ব ভুলে গিয়েছিল সে। তবে আজ আবার বাস্তবতার থাপ্পড় ওকে সব মনে করিয়ে দিলো। স্বপ্ন যতই সুন্দর চোখ মেলে তাকাতেই তা মিথ্যে হয়ে যায়। আজ সেটা আবারও বুঝে গেল সে।

তৈরি হয়ে সবাই নদীর ঘাটে এসে দাঁড়াল। লুবনার শশুড় বাড়ি বিল এলাকায়। এই বর্ষার মৌসুমে ওদের বাড়ির চারপাশে শুধুই থৈথৈ পানি। নৌকা ছাড়া আর কোনভাবেই যাওয়ার উপায় নেই। তাই বড়ো একটা শ্যালোর নৌকা ভাড়া করা হয়েছে ওদের যাওয়ার জন্য। সবাই উঠে বসেছে শুধু ইন্ধনের অপেক্ষা। সে এখনো আসেনি। পঙ্খির মনে মনে প্রচুর রাগ হচ্ছে। প্রথমে ভেবেছিল ইন্ধন যাবেনা, তাই সে যেতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু এখন আবার যাচ্ছে। আর কেমন মহারাজের মতো সবাইকে বসিয়ে রেখেছে। যেন আমাদের কোন মূল্য নেই। মহারাজের জন্য সবাই বসে থাকো। সকাল থেকে আকাশ মেঘলা হয়ে। কখন নাজানি বৃষ্টি নেমে পড়ে।এই মৌসুমে বৃষ্টির কোনো ভরসা নেই। যেকোনো সময় নেমে পড়তে পারে।
ওদিকে নৌকার মাঝিও বারবার হাঁক ছেড়ে বলছে।
–জলদি করেন আপনেরা। আকাশের অবস্থা কলাম ভালো না। ম্যাঘ নাইম্যা পড়লে কলাম আর যাওয়া যাবি নানি। পড়ে ভিইজ্যা ভিইজ্যা যাওয়া লাগবেনি।

রাবেয়া বলে উঠলো।
–হ হ ভাই আমাগেরে গ্যাদা আসলেই আমরা রওয়ানা হমু। আরে ঔই দেখেন এসে গেছে।

পঙ্খি একবার সামনে তাকিয়ে দেখলো ইন্ধন পাঞ্জাবির হাতা গোটাতে গোটাতে এদিকে আসছে। নীল পাঞ্জাবি পড়েছে সে। বাতাসে তার ঝুটি বাঁধার মতো উপযুক্ত লম্বা চুলগুলো উড়ছে। নদীর ঘাটে থাকা মেয়েগুলো চোখের মনি খুলে তাকিয়ে আছে ইন্ধনের দিকে। যেন বিনা টিকেটে তারা দুনিয়ার অষ্টম আশ্চর্য দেখছে। ইন্ধন যে মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে সুকৌশলে চোখ টিপ মেরে দিলো সেটাও পঙ্খির চোখ এড়ালো না। মেয়েগুলো লাজুক হেঁসে একেবারে নতজানু হয়ে গেল। ইন্ধনের এহেন কান্ড পঙ্খির মনে তার প্রতি আরও একটা নেতিবাচক ধারণা যুক্ত করলো। সে ভাবছে,লোকটা তো কত্তো লু,চ্চা। নিজের গার্লফ্রেন্ড থাকতে অন্য মেয়েদের সাথে কিসব করছে, ছি ছি। অসভ্য লোক একটা।

ইন্ধনের এই ভক্তদের সংখ্যা শুধু এখানেই সীমাবদ্ধ ছিল না। লুবনার শশুড় বাড়ির সব মেয়েগুলোও তার জন্য হায়হুতাশ করছে।লুবনার ননদ গুলো তাঁর আপ্যায়নে পারলে মাথায় তুলে বসিয়ে রাখে। সে কি খাবে, কোথায় বসবে,গরম লাগছে নাকি আরও নানান আপ্যায়নে নিযুক্ত আছে মেয়েগুলো। যেন সে কোন দেবতা।আর তাকে প্রসন্ন করতে পারলে মেয়েগুলোর জীবন সিদ্ধি হয়ে যাবে। আর উনিও কম না। ইন্ধনও অকৃপণ ভাবে সবার মাঝে প্রেম বিলিয়ে যাচ্ছেন। কখনো সেলফি তো কখনো হাসির ফুলঝুরিতে মেলা জমিয়ে বসেছেন। পঙ্খির এসব দেখে চরম বিরক্ত লাগছে। এই লোকটার কান্ড কারখানা আর দেখতে ইচ্ছে করছে না তাঁর। মন চাচ্ছে একবার ওর গার্লফ্রেন্ড কে এনে এসব দেখাতে। তাহলে বেচারি বুঝতো সে কোন অসৎ লোকের প্রেমে পড়েছে। আহারে বেচারি, তারজন্য পঙ্খির বুকে ভীষণ কষ্টের পাহাড় জমে যাচ্ছে।
__

বিকাল হতেই নৌকার মাঝি বারবার তাগিদ দিচ্ছে ফেরার জন্য। আকাশে কালো মেঘে ভার হয়ে আছে।সকাল থেকে মেঘ মেঘ থাকলেও এখন পর্যন্ত বৃষ্টি নামেনি। তবে যেকোনো সময় ঝোড়ো হাওয়া সহ বৃষ্টি নামতে পারে। তাই বৃষ্টির আগেই যাওয়ার জন্য তাগিদ দিচ্ছে।

ধীরে ধীরে সবাই আবারও নৌকায় উঠতে লাগলো। সবার ওঠার পর যখনই পঙ্খি উঠতে নিবে তখনই হঠাৎ মাঝি বলে উঠলো।
–আর লোক উঠা যাইবো না। লোড বেশি পড়ে গেছে। নাও ডুবে যেতে পারে।

ছায়া বলে উঠলো।
–আসার সময় তো ঠিকই আসলাম।এখন আবার কি হলো?

আসলে আসার সময় যে লোক ছিল, এখন তা বেড়ে গেছে। লুবনা আর ওর স্বামী সহ আরও দুজন লোক এখান থেকে বাড়তি হয়েছে। তারওপর আবার লুবনার শশুড় বাড়ি থেকে অনেক জিনিস পত্র দিয়ে দিয়েছে। তাই এখন লোড বেশি পড়ে গেছে। এতে করে নৌকা ডুবে যাওয়ার ভয় আছে। এমনটাই বুঝালো মাঝি। রাবেয়া চিন্তিত সুরে বললো।
–তাহলে পঙ্খি কিভাবে যাবে? আর ইন্ধনও তো আসেনি। ও কোথায়?

ছায়া বলে উঠলো।
–আরে ওইতো ভাইয়া আসছে।

পঙ্খি পেছনে তাকিয়ে দেখলো ইন্ধন ফোনে কথা বলতে বলতে এদিক আসছে। রাবেয়া আবারও বলে উঠলো।
–তাহলে ওরা যাবে কিভাবে?

তখন লুবনার স্বামী বলে উঠলো।
–এক কাজ করা যায়। আমাদের একটা ডিঙ্গি নৌকা আছে। আমি পঙ্খি ভাবি আর ইন্ধন ভাইকে নিয়ে ওই নৌকায় আসি। আপনারা এই নৌকায় যান।

সবাই তাতে সম্মতি দিলো। পঙ্খি পড়ে গেল বিভ্রান্তিতে। এই বাজে লোকটার সাথে তার যাওয়ার কোন ইচ্ছেই নেই। তবে এই কথা তো আর কাউকে বলাও যাচ্ছে না। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে যেতে হবে। লুবনার স্বামী তাদের ডিঙ্গি নৌকাটা নিয়ে এলো। পঙ্খি ভয়ে ভয়ে সেটাতে উঠে বসলো। ডিঙ্গি নৌকা অল্পতেই নড়েচড়ে উঠে। তাই ভয় লাগছে ওর। ইন্ধন এখনো ফোনালাপে ব্যাস্ত। লুবনার স্বামী ইন্ধন কে ডাক দিয়ে নৌকায় উঠে বসতে বললো। ইন্ধন এবার ফোন কান থেকে সরিয়ে বললো।
–কি ব্যাপার দুটো নৌকা কেন?

লুবনার স্বামী ইন্ধন কে ব্যাপার টা বুঝিয়ে বললো। ইন্ধনও বুঝতে পেরে আর দ্বিমত না করে নৌকায় উঠে বসলো। বড়ো নৌকা এখনো যায়নি। একসাথে রওয়ানা হবে বলে দেরি করছে। লুবনার স্বামী বৈঠা হাতে নিয়ে যেই নৌকা পার দিতে যাবে তখনই হঠাৎ বড়ো নৌকায় বসা লুবনা গরগর করে বমি শুরু করে দিলো। আজ নানান রকম পাকোয়ান খেয়ে তাঁর বদহজম হয়ে গেছে। তাই এমন হচ্ছে। বমি করে সে ক্লান্ত হয়ে গেল। হাতের ইশারায় সে স্বামীকে কাছে ডেকে বললো।
–তুমি এখানে আমার কাছে আসো। আমার খুব খারাপ লাগছে। আমার কাছে থাকো তুমি।

লুবনার স্বামীরও খুব চিন্তা হচ্ছে। ইন্ধন অবস্থা বুঝতে পেরে বললো।
–সমস্যা নেই তুমি লুবনার কাছে যাও। নৌকা আমি চালিয়ে নিবো।

–আপনি পারেন চালাতে?

–হ্যাঁ হ্যাঁ পারি।ছোটবেলায় অনেক চালিয়েছি। তুমি চিন্তা করোনা। তুমি বরং লুবনার কাছে যাও। তোমার এখন ওখানে বেশি প্রয়োজন।

লুবনার স্বামী মাথা নেড়ে লুবনার কাছে চলে গেল। ডিঙ্গি নৌকায় শুধু পঙ্খি আর ইন্ধন থেকে গেল। পঙ্খি হতবুদ্ধি হয়ে বসে রইলো। শেষমেশ কিনা এই অসহ্য লোকটার সাথে ওকে একা যেতে হবে? এরচেয়ে তো একা একা নদী সাতরে যাওয়াও ভালো ছিলো। মনে হাজারো অস্বস্তি থাকলেও মুখ ফুটে বলা আর হলোনা।সবার সামনে যে বেয়াদবি হনে নাহলে।তথাপি চরম বিরক্তি নিয়ে চুপচাপ নৌকার এককোনায় বসে রইলো। একটু পরে নৌকা দুটো বার দিলো। বড়ো নৌকায় মটর থাকায় সেটা ভটভট করে মুহূর্তের মধ্যেই অনেক দূরে চলে গেল। আর পঙ্খিদের ডিঙ্গি নৌকা ইন্ধন কোনরকমে চালিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টায় লেগে পড়লো। ইন্ধনের নৌকা চালানোর ভঙ্গি দেখে তার বলা “আমি চালাতে পারি” কথাটার ওপর যথেষ্ট সন্দেহ হচ্ছে এখন পঙ্খির। নৌকা চলছে কম ঘুরছে বেশি। পঙ্খির খুব করে কিছু কথা শোনাতে ইচ্ছে হলো লোকটাকে। তবে এই অসভ্য লোকের সাথে কথা বলে সে আর অপমানিত হতে চায়না। তাই মনের রাগ মনেই দমিয়ে রেখে চুপচাপ বসে রইলো।

ওভাবেই এলোমেলো ভাবে কোনরকমে নৌকা এগোতে লাগলো। অন্যদিকে আকাশের অবস্থা আরও গুমোট হয়ে আসছে। চারপাশ কালো অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। এখন যেকোনো সময় ঝোড়ো হাওয়া সহ মুষল ধারে বৃষ্টি শুরু হয়ে যেতে পারে। পঙ্খির অনেক চিন্তা হচ্ছে। এই সময় ঝড় বৃষ্টি হলে বিপদ হয়ে যাবে। লুবনার শশুড় বাড়ির গ্রাম থেকে অনেক টা দূরে চলে এসেছে ওরা। তাই আর কোনো সাহায্য চাওয়ারও উপায় নেই। আর এতদূর এসে ফিরে যাওয়া টাও বোকামি হবে। এখন তো শুধু উপর ওয়ালারই ভরসা। পঙ্খি মনে মনে দোয়াদরুদ পড়তে লাগলো। বাচ কোনরকমে বিল পেরিয়ে তীরে গিয়ে উঠতে পারলেই বাঁচা।

তবে শেষ রক্ষা টা আর হলো না। পাঁচ মিনিট পেরুতে না পেরুতেই পূর্ব দিক থেকে তীব্র বেগে ঝোড়ো হাওয়া বইতে লাগলো। সাথে শুরু আকাশ ভেঙে তীব্র বর্ষণ।একদিকে বর্ষণের তোড়ে চারপাশে সব ধোঁয়াশা হয়ে যাচ্ছে। নৌকার মাঝেও পানি জমে যাচ্ছে। আরেকদিকে বাতাসের বেগে ডিঙ্গি নৌকা জোরে জোরে ঢুলতে লাগলো। ভয়ে হৃদয় আড়ষ্ট হয়ে গেল পঙ্খির। এতক্ষণ মনে মনে পড়তে থাকা দোয়াদরুদ গুলো এবার উচ্চস্বরে পড়তে লাগলো সে। তখনই পাশ থেকে ইন্ধন গলা উঁচু করে উচ্চস্বরে বললো।
–পঙ্খি ভয় পেয় না।আমার হাত ধরো।

বৃষ্টির ঘন ফোটার সাথে চোখের পলক যুদ্ধ করে পিটপিট করে তাকালো ইন্ধনের দিকে। লোকটা ওর দিকে হাত বাড়িয়ে আছে। আজ তাঁর চোখ মুখের ভাষা কেমন অন্যরকম। যা বৃষ্টির মাঝেও বুঝতে পারছে পঙ্খি। তার চোখে ভীতি দেখা যাচ্ছে। কোন কিছু হারানোর আতঙ্ক প্রতীয়মান হচ্ছে। পঙ্খি কেমন আনমনেই হাত টা বাড়িয়ে দিলো ওর দিকে। ইন্ধন পঙ্খির হাত টা নিজের হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে বললো।
–ভয় নেই পঙ্খি। আমি আছি না! আমি থাকতে কিছু হবে না তোমার। আচ্ছা বলোতো তুমি সাঁতার জানো? দেখ নৌকার অবস্থা ভালো না।যেকোনো সময় উল্টে যেতে পারে। তাই আমাদের সাঁতরেই কিনারায় যেতে হবে।

পঙ্খি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝালো। বাতাসের গতি প্রবল বেগে আসতে লাগলো। নৌকা প্রচন্ড দোল খাচ্ছে। ইন্ধন বলে উঠলো।
–পঙ্খি আমাদের পানিতে নামতে হবে। নৌকা উল্টে গেলে তখন নৌকার নিচে পড়ে যাবো আমরা। তারচেয়ে আগেই নেমে পড়ি আমরা। তুমি ভয় করোনা। শুধু আমার হাত শক্ত করে ধরে রাখো। কিছুতেই হাত ছেড়ে যাবেনা কিন্তু।

পঙ্খি মাথা ঝাকিয়ে সায় জানালো। প্রথমে ইন্ধন পানিতে নামলো। তারপর পঙ্খির হাত ধরে ওকেও নামালো। দুজন সাঁতরে কিনারায় পৌঁছানোর চেষ্টা চালালো। বৃষ্টির তোড়ে কিছু স্পষ্ট দেখাও যাচ্ছে না। অনেকক্ষণ সাঁতরে পঙ্খি হাঁপিয়ে গেল। সে আর পারছেনা। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে তাঁর। পানির মাঝেই পঙ্খির শরীর নিস্তেজ হয়ে আসলো। ইন্ধনের হাত থেকে তাঁর হাতটা ছুটে যেতে লাগলো। তখন ইন্ধনের কিছু কথা কানে আসলো তাঁর। ইন্ধন পঙ্খির হাত টা শক্ত করে ধরে বললো।
–বলেছিলাম না হাত ছাড়বে না? ছেড়ে যাওয়া টা বুঝি তোমার পেশা হয়ে গেছে। তবে এবার তোমাকে আমি সফল হতে দিবোনা।

নিস্তেজ, ক্লান্ত শরীরে ইন্ধনের কথা কানে আসলেও মস্তিষ্ক পর্যন্ত তা পৌঁছাল না পঙ্খির। শুধু অনুভব করলো ইন্ধন ওকে এক হাতে পেঁচিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। প্রায় ত্রিশ মিনিট পর ওরা কিনারায় আসতে সক্ষম হলো। কিনারায় উঠে পঙ্খিকে বসিয়ে দিয়ে নিজেও বসে জোরে জোরে দম নিলো। এতটা সময় সাঁতরে সেও হাঁপিয়ে উঠেছে। একটু জিরিয়ে নিয়ে ইন্ধন বললো।
–চলো দেখি কোথাও কোন সাহায্য পাওয়া যায় কিনা।

পঙ্খিরও এখন একটু সুস্থ লাগছে। সে মাথা নেড়ে ইন্ধনের পিছু পিছু চললো। এরইমধ্যে মাগরিবের আজানও দিয়ে দিয়েছে। একেতো এমনিতেই সন্ধ্যা। তারওপর এই কালো মেঘের কারণে চারিপাশ একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। কোনকিছু ঠিকমতো দেখাই যাচ্ছে না।মাঝে মধ্যে বজ্রপাতের আলোতে যা একটু দেখা যাচ্ছে। অপরিচিত গ্রামে কোনদিকে যাবে বুঝে উঠতে পারছে না ওরা। অনেকক্ষণ এলোমেলো হাঁটার পর একটা টিনের চৌচালা ঘর দেখতে পেল ওরা। বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় ঘরের সাথে লাগানো সাইনবোর্ড টা যেটুকু দেখা গেল তাতে বোঝা গেল এটা একটা ক্লাব ঘর।হয়তো গ্রামের ছেলেরা আড্ডা দেওয়ার জন্য এই ক্লাবঘর বানিয়েছে। যাক ভালোই হলো এখানে একটু আশ্রয় পাওয়া যাবে। ইন্ধন দরজার ছেঁকল খুলে পঙ্খিকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো।অন্ধকারে ভেতরে তেমন কিছু দেখা গেল না। ইন্ধন দেয়াল হাতড়িয়ে দেখার চেষ্টা করলো কোথাও কোন সুইচ টুইচ আছে কিনা। পেয়েও গেল সুইচ। তবে দূর্ভাগ্যবশত এখন ঝড়ের কারণে বিদুৎ বিচ্ছিন্ন আছে। তখনই পঙ্খি বলে উঠলো।
–এখানে বোধহয় হারিকেন আছে।

পঙ্খির কথামতো ইন্ধন ওখানে হাতড়ে সত্যিই একটা হারিকেন পেল। হারিকেনের পাশেই একটা ম্যাচ বক্সও পেয়ে গেল। দিয়াশলাই জ্বালিয়ে হারিকেন ধরালো ইন্ধন। এতক্ষণে একটু চারপাশ আলোকিত হলো। ঘরের মেঝেতে একটা পাটি বেছানো আছে। পাটির ওপর কয়েকটা তাসের কার্ড ছড়ানো আছে। ইন্ধন পঙ্খিকে পাটিতে বসতে বললো। পঙ্খি মাথা নেড়ে পাটির একপাশে গিয়ে বসে রইলো। গায়ের বোরখা টা ভিজে জুবুথুবু হয়ে আছে। এগুলো পাল্টাতে পারলে ভালো হতো। তবে এখানে আর কাপড়চোপড় কোথায় পাবে। তাই অগত্যা ওভাবেই বসে রইলো। ইন্ধন তখন বলে উঠলো।
–আমি বাইরে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি। তুমি বরং বোরখা খুলে ভালোভাবে চিপে পানি নিংড়ে আবার পরো।তাও একটু ভালো লাগবে।

কথাটা বলে ইন্ধন দরজার বাইরে চলে গেল। পঙ্খি বিস্মিত হলো। আজ যেন ইন্ধন কে সেই আগের ভালো রুপে দেখা যাচ্ছে। লোকটা দিনে দিনে এক গোলক ধাঁধাঁয় পরিণত হচ্ছে। কোনটা তাঁর আসল রুপ বোঝা দায়। তবে একটা অবাক করা বিষয় ঘটছে পঙ্খির সাথে। এই রাতের বেলা নির্জন পরিবেশে একটা যুবক পুরুষের সাথে এভাবে একা থাকলেও কেমন যেন মনে কোন ভয় আসছে না। অদৃশ্য এক বিশ্বাস কাজ করছে তার মাঝে। যে বিশ্বাস পঙ্খিকে আস্বস্ত করছে এই লোক আর যাইহোক ওর কোন ক্ষতি করবেনা। আর না কোন ক্ষতি হতে দিবে। কেন এমন হচ্ছে তা পঙ্খির জানা নেই। সে নিজেও নিজের এই মনোভাব দেখে অবাক হচ্ছে।

পঙ্খি বোরখা খুলে বোরখা আর গায়ের জামাকাপড় ভালো করে চিপে পানি নিংড়ে নিলো। গায়ে জামা থাকাই বোরখার নিচের টুকু আর পড়ল না।ওড়না না থাকাই শুধু মাথার হিজাব টা পড়ে নিলো। কাজ শেষে ইন্ধনের উদ্দেশ্যে বললো।
–হয়ে গেছে।

ভেতরে ঢুকলো ইন্ধন। পঙ্খি পাটিতে চুপচাপ বসে আছে। ইন্ধনও পাটির একপাশে গিয়ে বসলো। পঙ্খি খেয়াল করলো ইন্ধনের শরীর কেমন কাঁপছে। ওর মনে পড়লো রাবেয়ার বলা কথা। ইন্ধনের তো বৃষ্টি গায়ে সয়না। জ্বর বেঁধে যায়। উনার বোধহয় জ্বর আসছে। উনার জামাকাপড়ও ভেজা। এভাবে থাকলে তো আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে। পঙ্খি এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো একটা দড়ির সাথে লুঙ্গি আর গেঞ্জি ঝুলানো আছে। পঙ্খি সেগুলো নিয়ে এসে ইন্ধনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো।
–এগুলো পড়ে ভেজা কাপড় পাল্টে নিন। নাহলে শরীর খারাপ করবে।

–না না আমার লাগবেনা। ঠিক আছি আমি।

–হ্যাঁ কত ঠিক আছেন তাতো দেখতেই পাচ্ছি। দেখুন কথা না বাড়িয়ে এগুলো পড়ে নিন। আপনার কিছু হলে রাবেয়া চাচী কষ্ট পাবে। আর আমি তাকে কষ্টে দেখতে পারিনা। তাই জলদি পড়ে নিন।

ইন্ধন কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো পঙ্খির পানে। তারপর মাথা নেড়ে কাপড় চোপড় গুলো হাতে নিলো। পঙ্খি একটু দূরে গিয়ে উল্টো দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে রইলো। ইন্ধন কাপড় পাল্টানো শেষে বললো।
–হয়ে গেছে এখন এসে বসো।

পঙ্খি এবার হারিকেনটাকে মাঝখানে এনে রাখলো। যাতে হারিকেনের তাপ ওদের শরীরে উঞ্চতা প্রদান করে। পঙ্খি দুই হাত হারিকেনের কাচের ওপর রেখে হাত গরম করে আবার সেই হাত গালে লাগিয়ে গাল গরম করছে। এই পক্রিয়া চললো কিছুক্ষণ। হঠাৎ পাশে ফিরে তাকাতেই দেখলো ইন্ধন পলকহীনভাবে ওর পানে তাকিয়ে আছে। পঙ্খির তাকানো দেখে ইন্ধন অপ্রস্তুত হয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। তারপর আমতাআমতা করে বললো।
–সব তাপ কি তুমিই নিবে নাকি? সরোতো আমাকেও একটু নিতে দাও। অসুস্থ মানুষকে রেখে উনি নিজের সেবা করে যাচ্ছেন। অসামাজিক মেয়ে একটা।

কথাটা বলে ইন্ধন হারিকেন টা নিজের দিকে টেনে নিলো। পঙ্খি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবারও বসে রইলো। বসে থাকতে থাকতে কখন চোখে ঘুম নেমে এসেছে তা নিজেও জানে না।
ঘুম ভাঙলো কানের কাছে মানুষের গুনজনের আওয়াজে। ভ্রু কুঁচকে চোখ মেলে তাকালো পঙ্খি। তাকাতেই চোখের সামনে অপরিচিত মানুষের ভীড় আর উৎসুক কয়েক জোড়া চোখ দেখা গেল। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো পঙ্খি। পাশে তাকিয়ে দেখলো ইন্ধন এখনো ঘুমোচ্ছে। পঙ্খি দ্রুত ওকে ডাক দিলো। এবং ইন্ধন চোখ মেলে এসব দেখে সেও তড়িৎ গতিতে উঠে বসলো। পঙ্খি ঘাবড়ে গিয়ে কাচুমাচু হয়ে বসে রইলো। ইন্ধন লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে বললো।
–আপনারা কারা?

লোকগুলোর মাঝে একজনক বলে উঠলো।
–আমরা কারা? আগে কন আপনেরা কারা? আর এইহানে এইসব কি হরতাছেন? রাত বিরাইতে ন,ষ্টামি করার আর কোন জায়গা পান নাই? এইডা কি ন,ষ্টামি করার জায়গা?

লোকটার কথায় ইন্ধনের মাথায় ধপ করে আগুন জ্বলে উঠলো। সে উঠে দাঁড়িয়ে লোকটার কলার চেপে ধরে কপালের রগ ফুলিয়ে বললো।
–মাইন্ড ইউ ল্যাঙ্গুয়েজ। কথা বলার আগে ভেবে চিন্তে বলিস। নাহলে পরবর্তী কথা বের করার জন্য আর জবান থাকবেনা।

পেছন থেকে আরেকজন বলে উঠলো।
–বাহ্, চোরের মায়ের আবার বড়ো গলা। একেতো এখানে মা* আইনা ন,ষ্টামি করতাছিস আবার আমাগেরেই দেমাক দেহাস?

আরেকজন বললো,
–তা কতো ট্যাহা দিয়া আনছু মা*রে? মা,ল ডা কলাম সেই। ট্যাহা তো আমাগেরেও আছে। আইজ আমাগেরেও খুশি কইরবো নাকি??

কথাটা বলেই লোকটা বিচ্ছিরি ভাবে হাসতে লাগলো। পঙ্খির কানে মনে হচ্ছে গরম লাভা ঢেলে দিয়েছে। এতো নি,কৃষ্ট কথা শোনার চেয়ে তো ম,রে যাওয়া ভালো। ইন্ধন গিয়ে এবার ওই লোকটাকে ধরে নাক বরাবর একের পর এক ঘুষি মারতে লাগলো। চোখে যেন আগুন ঝরছে তাঁর। বেধরম ভাবে মা,রতে লাগলো লোকটাকে। মা,রতে মা,রতে ছেলে টার নাক মুখ দিয়ে র,ক্ত বের হতে লাগলো। তবুও থামছে না ইন্ধন। বাকি লোকজন এসে ইন্ধনকে ধরে টেনে সরিয়ে আনলো। তবুও সে হিংস্র বাঘের মতো পা দিয়েই লাথি মা,রতে লাগলো। সবাই মিলে কোনরকমে ইন্ধন কে টেনেহিঁচড়ে সরিয়ে আনলো। তারপর কয়েক ঘা ইন্ধনকেউ দিলো সবাই মিলে।এসব দেখে পঙ্খির ভয়ে আতঙ্কে আত্মা কেঁপে উঠছে। ধীরে ধীরে গ্রামের আরও লোকজন জড়ো হয়ে গেল। বৃহৎ ভীড় জমা হয়ে গেল। এরই মাঝে একজন বলে উঠলো।
–আরে এটাতো চেয়ারম্যান সামছুল মজুমদারের ভাতিজা।

লোকটার কথা শুনে ওই গ্রামের মাতবর চেয়ারম্যান সাহেব কে ফোন দিয়ে আসতে বললেন।
__

অপরিচিত গ্রামে বিচার বসলো। প্রায় দুই তিন গ্রামের লোকজন ভীড় করে আছে ওখানে। চেয়ারম্যান সামছুল মজুমদার আর জহির মজুমদারও এসেছে।ইন্ধন কে বিচারের মাঝখানে দাঁড় করে রাখা হয়েছে। আর পঙ্খি এক ঘরের মাঝে আতঙ্কে বসে আছে। গ্রামের মাতবর সামছুল মজুমদারের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন।
–দেখেন চেয়ারম্যান সাহেব, আপনি সম্মানীয় ব্যাক্তি। তাই আপনিই বিচার করবেন। আশা করি আপনি সুবিচারি করবেন। আমার গ্রামের ছেলেরা আপনার ভাতিজা আর বউকে সরাসরি হাতে নাতে ধরেছে। তাই এখন ওরা এটার সাফাইয়ে যাই বলুক সেটা কেউ বিশ্বাস করবেনা। তাই আপনিই বলুন এখন কি করা উচিত।

সামছুল মজুমদার কিছুক্ষণ ভাবলেন। তার কাছে সর্বোপরি তার বংশের মর্যাদা আর সম্মান। সেটা সে অক্ষুণ্ণ হতে দিবেনা কোন ক্রমেই। অতঃপর তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন। সবার সেই সিদ্ধান্ত শুনিয়ে দিলেন। তিনি বলে উঠলেন।
–দেখুন আমার ছেলে মেয়ের ওপর আমার যথেষ্ট ভরসা আছে। তবে এখানে আমার ভরসাতে কিছু যায় আসেনা। কারণ আমার কাছে তাদের নিরপরাধ হওয়ার কোন প্রমাণ নেই। এখানে আপনারা আরোপ এনেছেন আমার ভাতিজা আর বৌমা অযাচিত কিছু করেছে তাইতো? ঠিক আছে তাহলে আজই আমি তাদের শরিয়ত মাফিক বিয়ে পড়িয়ে দেবো তাহলে তো আপনাদের কোন অভিযোগ থাকবেনা?

সবাই একসাথে বলে উঠলো, না। অতঃপর ইন্ধন আর পঙ্খির বিয়ে পড়ানোর জন্য মৌলবি ডাকা হলো। মৌলবি এলো পঙ্খির কাছে বিয়ে পড়াতে। পঙ্খির মাঝে আপাতত কোন অনুভূতি কাজ করছে না। নীরব পাথর হয়ে আছে সে। কি হচ্ছে না হচ্ছে সেটা বোঝার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে সে। শুধু আশেপাশের মহিলাদের জোরাজোরিতে সে জ্ঞান শূন্য ভাবেই কবুল বলে দিলো। অতঃপর পঙ্খি আর ইন্ধনের বিয়ে হয়ে গেল।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here