মৃগতৃষ্ণা-১৫,১৬

0
883

#মৃগতৃষ্ণা-১৫,১৬
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
১৫

★পানিতে ডুবতে নিলে যখন কেউ টেনে তুলে কিনারায় আনে। আর কিনারায় এসে দেখে সেখানে ভয়ংকর বাঘ বসে আছে। সেই মুহূর্তে যে অনুভূতি হবে তেমনই একটা অনুভূতি হচ্ছে পঙ্খির এই মুহূর্তে। ইন্ধনও ওকে বাঁচাতে গিয়ে উল্টো আরও ডুবিয়ে দিয়েছে। নিজেকে কেমন খেলার পুতুল মনে হচ্ছে পঙ্খির। এ কেমন জীবন ওর? যেখানে ওর ইচ্ছে বা মতামতের কোনো মূল্য বা প্রয়োজন কোনটাই নেই। বিয়ে নামক এই ক্রিয়া ওর সাথে দুই দুইবার রচিত হলো। অথচ একবারের জন্যও কেউ ওর মতামতের ধার ধারলো না। সেকি আদোও মানুষ নাকি কোন জড়বস্তু? যার যখন মন চায় তাকে কারোর সাথে বেঁধে দেয়। শেষমেশ কিনা ওই অসভ্য লোকটার বউ? ভাবতেই হৃদপিন্ড জমে যাচ্ছে তাঁর। এরচেয়ে তো নদীতে ডুবে ম,রে যাওয়াও হয়তো ভালো ছিলো। এই রঙমহলের রঙিন মঞ্চে ওকে খেলার পুতুল তো হতে হতোনা।

বর্তমানে ইন্ধনের রুমে বিছানায় বসে আছে পঙ্খি।ছায়া তাকে একপ্রকার ঠেলে নিয়ে এসে এখানে বসিয়ে দিয়ে গেল। বিয়ে পড়ানো শেষে ওদের বাড়িতে ফিরতে ফিরতে দুপুর হয়ে যায়। বাড়িতে আসার পর আরেক দফা তামাশা হয়। সামছুল মজুমদারের কথার আগে কেউ তেমন কিছু বলতে না পারলেও, খোদেজা দমে থাকে না। যথারীতি সে সবকিছুর জন্য পঙ্খিকেই দোষারোপ করে। ইচ্ছে মতো কতক্ষণ অকথ্য বাণী শোনায় পঙ্খিকে। তবে আজ জাহানারা কেন যেন কিছু বলেনা পঙ্খিকে। ব্যাপার টায় পঙ্খি একটু অবাক হয়েছিল বৈ কি। তবে রাবেয়া বরাবরের মতোই সবটা ইতিবাচক ভাবেই মেনে নিয়েছে। পঙ্খিকে সে আগে থেকেই স্নেহ করে। তাই সহজেই ওকে পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নিয়েছে। সব তামাশা শেষে পঙ্খি নিজের রুমে যায়। এতক্ষণ সে কেমন অনুভূতি শূন্য হয়ে ছিলো। রুমে এসেই সে বাথরুমের দরজা আটকে হাউমাউ করে কেঁদে দেয়। কেঁদে কেটে নিজের মনকে একটু হলেও হালকা করে সে। তারপর বিছানায় গিয়ে ক্লান্ত শরীরে শুয়ে পড়ে। কতক্ষণ শুয়ে ছিলো সে নিজেও জানে না। ছায়া যখন ডাকতে আসে তখন রাত আট টা। রাতের খাবার খাওয়ার জন্য ডাকতে এসেছিল ও।তবে পঙ্খি বলে দেয় তার ক্ষুধা নেই।সে খাবেনা এখন। ছায়া অনেক বার বললেও লাভ হয়নি। তারপরই হঠাৎ ছায়া পঙ্খিকে টেনে এই ঘরে নিয়ে আসে। এখানে বসিয়ে দিয়ে বলে, এখন থেকে এটাই তোমার ঘর। তারপর ওকে বসিয়ে দিয়ে চলে যায়। এখানে বসে অস্বস্তিতে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে ওর। মন মস্তিষ্ক জুড়ে চলছে অশান্তি আর অস্থিরতার ঘূর্ণিঝড়। জীবন তাকে এ কোন মোড়ে নিয়ে এলো? এখান থেকে ওর ভবিষ্যতই বা কোনদিকে মোড় নিবে? অথচ যার কারণে এতকিছু ঘটলো তার কোন খবরই নেই। সে ওই বিচারের পর থেকেই গায়েব। শুনেছি এখনো নাকি বাড়ি ফিরেনি।হয়তো কোথাও বসে দুঃখের নদী নালা বানাচ্ছে। গার্লফ্রেন্ড কে কি জবাব দেবে তাই ভাবছে। বেশি হিরোগিরি দেখাতে গিয়ে ফেঁসে যে গেছে। যাগ্গে যা খুশি তাই করুক। যতো না আসে ততোই ভালো। তার সাথে এখানে এক ঘরে থাকার কথা ভাবলেই পঙ্খির দম বন্ধ হয়ে আসছে। পঙ্খি ভাবলো লোকটা ফিরে আসার আগেই ও চুপ করে এখান থেকে নিজের রুমে চলে যাবে।

ভাবনা মোতাবেক সে উঠে দাঁড়িয়ে চলে আসতে নিলেই হঠাৎ ওর ওড়না কিছুর সাথে আটকে গেল। পঙ্খি পেছনে ঘুরে ওড়না ধরে জোরে টান দিতেই ওড়নার সাথে আটকে থাকা জিনিস টাও বালিশের নিচ থেকে বেড়িয়ে এলো। পঙ্খি লক্ষ্য করলো এটা একটা ছোট ফটো ফ্রেম।। কৌতূহল বশত পঙ্খি ফটো ফ্রেমটা হাতে নিয়ে দেখলো।ছবিটিতে ইন্ধন সুন্দর একটি মেয়ের গলা জড়িয়ে ধরে তার কাঁধের উপর মাথা দিয়ে আছে। দুজনের ঠোটেই এক অমায়িক হাসি। পঙ্খির মনে পড়লো এই মেয়েটাকেই সেদিন ইন্ধনের ফোনে দেখেছিল। তারমানে এটাই উনার গার্লফ্রেন্ড। ছবিটা দেখে পঙ্খির মন হঠাৎ ভারী হয়ে গেল। নিজেকে কেমন অপরাধী মনে হচ্ছে ওর। না চাইতেও ও এই দুজন ভালোবাসার মানুষের মাঝে ঢুকে পড়েছে। দুজনেই দুপাশে হয়তো কতো কষ্ট পাচ্ছে। লোকটা যেমনই হোক তবে তাঁর ভালোবাসা তো আর মিথ্যে নয়। আর আজ সেই ভালোবাসাকে হয়তো আমার কারণে হারিয়ে ফেলবে। না না এটা ঠিক না। এতবড় অপরাধ বোধ নিয়ে আমি বেঁচে থাকতে পারবোনা। কিছু একটা করতেই হবে। আমার জীবনের এমনিতেও কুল কিনারা নেই। তবে আমার কারণে দুটো সুন্দর ভালোবাসার মানুষকে আলাদা হতে দিবোনা আমি। ভালোবাসা না পাওয়ার কষ্ট কতটা সেটা আমি বুঝি।তাই অন্যকেও এই কষ্ট হতে দিতে পারি না আমি। আমার কারণে তো কখনোই না।

দরজা খোলার শব্দে পঙ্খি ঘাবড়ে গিয়ে তড়িঘড়ি করে ফ্রেমটা আবারও বালিশের নিচে রেখে দেয়। এই ছবির চক্করে ও রুম থেকে বেরুনোর কথা ভুলেই গিয়েছিল। এখন কি করবে ও? ওই লোকটা নিশ্চয় এসে পড়েছে। এখন তার সামনে কিভাবে এখানে থাকবে ও? চরম অস্বস্তির ভান্ডার নিয়ে খাটের এক কোণায় চুপচাপ মাথা নুইয়ে বসে রইলো সে। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলো ইন্ধন। ঘরে ঢুকেই সোজা ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে হাতের ঘড়িটা খুলে রাখলো। তারপর কাবার্ড থেকে টিশার্ট আর ট্রাউজার নিয়ে ওয়াশরুমে গেল ফ্রেশ হতে। তার গতিবিধি একেবারে স্বাভাবিক। যেন সে ব্যাতিত এই কক্ষে দ্বিতীয় কোন মানবী নেই। হতেই পারে না।আর না আজ তাঁর সাথে অন্যরকম কিছু ঘটেছে। সে রোজকার মতোই বাইরে আড্ডা দিয়ে এসেছে। আর এখন মায়ের হাতের খাবার খেয়ে উপুড় হয়ে পড়ে ঘুম দিবে। এই ছাড়া আর কিছুই যেন হয়নি তাঁর সাথে। আমি কি কোনভাবে অদৃশ্য হয়ে গেছি? নাকি অতি শোকে পাগল টাগল হয়ে গেল লোকটা? হতেও পারে। গার্লফ্রেন্ড হারানোর শোকে মাথার নাট বল্টু ঢিলাও হয়ে যাওয়া টা অস্বাভাবিক কিছু না। খাটি প্রেম বলে কথা। প্রেমের মরা জলেও নাকি ডোবে না। তাইলে সে বেচারা কি করে ধুয়ে দিবে?

পঙ্খির ভাবনার মাঝেই ইন্ধন ফ্রেশ হয়ে বের হলো। টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে টেবিলের দিকে তাকিয়ে বললো।
–খাবার এখানে রাখা কেন? তুমি খাওনি?

পঙ্খি এবারে একটু স্বস্তি পেল। যাক কথা যেহেতু বললো তারমানে সে এখনো দৃশ্যমান আছে। খাবার তখন ছায়াই এসে রুমে রেখে গেছে। রেখে যেতে যেতে দাঁত কেলিয়ে বলছিল, তোমাদের দুজনের খাবার রেখে গেলাম। একসাথে খেয়ে নিও। তার হাসির কারণ টা বুঝতে পেরেছিল পঙ্খি। বেচারি ছায়া তো জানে না যে, সে যেটা ভাবছে সেটা কখনোই হবার নয়। তাঁর ভাই যে এখন ব্যার্থ প্রেমিক হয়ে বনবাসে যাওয়ার উপক্রম।

–কি হলো কথা বলছ না কেন? না খেয়ে বসে আছ কেন?

ইন্ধনের উচ্চস্বরের কথায় পঙ্খির মহান ভাবনায় ত্রুটি পড়ে। সে একটু নড়েচড়ে উঠে ধীর গলায় বললো।
–ছায়া রেখে গেছে।

–তো খাওনি কেন? নাকি আমার হাতে খাওয়ার জন্য বসে আছ? বিয়ে হতে হতেই আবদার নিয়ে বসে পড়েছ?

রাগে শরীর জ্বলে উঠলো পঙ্খির। দাঁত কিড়মিড় করে বললো।
–ক্ষুধা নেই।

–কেন ক্ষুধা কি তোমাকে রেখে বেড়াতে গেছে? গিয়ে থাকলে ওকে ধরে নিয়ে আসো। আর ফটাফট খেয়ে নাও। খেয়ে দেয়ে নাও। তারপর কথা আছে তোমার সাথে।

পঙ্খি আগেই ধারণা করে নিলো ইন্ধন কি বলবে। তাই সে নিজেই বলে উঠলো।
–আমি জানি আপনি কি বলবেন। আজ বিয়েটা যে,আপনি বাধ্যতামূলক করেছেন তা আমি জানি। তবে আপনি চিন্তা করবেন না। আমার জন্য আপনাকে আপনার ভালোবাসা হারাতে হবে না। আমি আপনাদের মাঝে দেয়াল হয়ে দাঁড়াব না। আমার জন্য কাওকে কষ্ট পেতে হবেনা। শুধু আপনার কাছে একটা অনুরোধ। আমাকে কোথাও একটা চাকরির ব্যাবস্থা করে দিন। তারপর আমি এখান থেকে চলে যাবো। যদিও আমি কখনো কোন দাবি করবোনা। তবুও নিশ্চিত হওয়ার জন্য আপনি চাইলে ডিভোর্সও নিয়ে নিতে……

হঠাৎ কিছু ভাঙার তীব্র ঝংকারে কেঁপে উঠলো পঙ্খি। কথা বন্ধ হয়ে গেল তার। মেঝের দিকে তাকিয়ে দেখলো কাচের গ্লাস টা ভেঙে চুরমার হয়ে আছে। মাথা তুলে ইন্ধনের পানে দৃষ্টি আরোপ করতেই আরেক দফা আৎকে উঠলো সে। র,ক্তলাল মুখশ্রী আর অগ্নিকুণ্ড চোখ জোড়া দেখে হতবুদ্ধি হয়ে গেল সে। তাঁর আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে দিলো ইন্ধন পরবর্তী কাজটা। আচমকা ইন্ধন তেড়ে এসে এক হাতে পঙ্খির চোয়াল সজোরে চে,পে ধরলো। তীব্র ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠলো পঙ্খি। তাতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে চোয়াল শক্ত করে ইন্ধন বলে উঠলো।
–অন্যায় একবার মেনে নেওয়া যায়, দুইবার বার মেনে নেওয়া যায়,তিনবারও মেনে নেওয়া যায়। তবে এতবারও করা ঠিক না যে, অন্যায় মেনে নেওয়ার জন্য ভুক্তভোগীর অস্তিত্বই না থাকে।

কথাটা বলেই ঝটকা মেরে পঙ্খিকে ছেড়ে দিয়ে হনহন করে চলে যেতে লাগলো। দরজা পর্যন্ত এসেই আবার থেমে গিয়ে পেছনে না ঘুরেই বলে উঠলো।
–খাবার যেন আমি পড়ে থাকতে না দেখি। ঢং করে না খেয়ে থাকা এসব আমার সামনে চলবেনা।খাবার এমনি এমনি আসে না।মেহনতের বিনিময়ে আসে। খাবারের অপচয় আমার একদম পছন্দ না। তাই এসব ঢং অন্য কোথাও গিয়ে দেখাবে। ভালোই ভালোই খেয়ে নিবে নাহলে খারাপ টাও আমার জানা আছে।

বয়ান শেষে দরজা খুলে ধুম করে বেড়িয়ে গেল ইন্ধন। পঙ্খি ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো। চোখ বেয়ে নেমে এলো নোনাজল। তিক্ততায় ভরে উঠলো তার মন। সে কিসের শাস্তি পেল সেটাই বুঝতে পারছে না।মানলো নাহয় সে এই ঘটনার কারণে মানুষিক চাপে আছে।কিন্তু ওতো লোকটার পক্ষেই কথা বলছিল। তাহলে এমন অসৎ আচরণ কেন করলো ওর সাথে? আর কিসব আবোলতাবোল বলে গেল তখন? একবার অন্যায়, দুইবার অন্যায় এসব কি?

এমন সময় কেউ দরজায় নক করলো। পঙ্খি নিজেকে একটু সামলে নিয়ে চোখ মুছে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। কাজের মেয়ে চুমকি ঝাড়ু হাতে ঢুকলো ঘরে। মুখে তার চাপা হাসি। যেন সে খুব মনোরঞ্জনের কিছু দেখছে।পঙ্খি বুঝতে পারছে তার এই হাসির কারণ। ঘরে এসে কাচের টুকরো গুলো ঝাড়ু দিয়ে তুলতে লাগলো। ও জানলো কিভাবে? হয়তো উনিই বলেছেন। পঙ্খি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার গিয়ে বসলো। মনে পড়লো ইন্ধনের হুমকির কথা। খাবার নিয়েও তাকে কতো কথা শুনিয়ে গেল। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও খাবার প্লেট হাতে খাওয়া শুরু করলো। চুমকি ঝাড়ু দিতে দিতে লাজুক হেঁসে বলে উঠলো।
–ভাবিজান খাইয়া দাইয়া গায়ে শক্তি যোগান। নালি আবার ধকল সইতে পারবেন না। ভাইজান যেই তাগড়া যুবক বাবা!!

বেচারি পঙ্খির গলায় ভাত আঁটকে গেল। খুকখুক করে কাশতে লাগলো সে। চুমকি দৌড়ে এসে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলো পঙ্খির দিকে। পঙ্খি পানি খেয়ে কোনরকমে বলে উঠলো।
–কি যাতা বলছিস তুই? আজাইরা প্যাঁচাল বাদ দিয়ে নিজের কাজ কর।

চুমকি বলে উঠলো।
–আরে ভাবি এতে লজ্জার কি আছে। আমরা তো মাইয়া মাইয়াই। কয়দিন আগেই তো আমার বিয়া হইলো কলিমের হাতে (সাথে)। তাই আমি এগুলান জানি। এই মদ্দা মানুষ গুলা মেলা খারাপ। রাতভর ঘুমাইতে দেয়না। আমার তো হারা গাও ব্যাথা কইরা দিছিলো।

পঙ্খির কান দিয়ে যেন গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। সে ধমকের সুরে বলে উঠলো।
–এই ছেড়ি তুই যাতো এখান থেকে। গিয়া তোর কলিমের কোলো বসে থাক। আমাকে তোর কাহিনি শুনতে হবে না। যা এখান থেকে।

বেচারি চুমকি মুখটা কালো করে চলে গেল। তাঁর মহান জ্ঞানের কোম দামই দিলো না। অথচ কতজন ওর কাছে এই জ্ঞান চায়। ভালোর কালই নাই আজকাল।

খেয়ে দেয়ে বসে থাকতে থাকতে একসময় চোখ জোড়ায় ঘুমের পাহাড় নেমে আসে। সে বসে থাকা অবস্থায়ই খাটের সাথে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম ভাঙে রোজকার সময় অনুযায়ী। ঘুম থেকে জেগে নিজেকে বিছানায় শোয়া অবস্থায় দেখে সে। গায়ে চাদর জড়ানো। পঙ্খির যতদূর মনে আছে সেতো চাদর নিয়েছিল না। তাহলে চাদর কোথাথেকে আসলো? রুমেও তো কেউ নেই। উনি কও রাতে আর আসেন নি? বিছানার থেকে নেমে টেবিলের দিকে চোখ যেতেই দেখলো খাবারের প্লেট গুলো একেবারে খালি। কিন্তু ওতো পুরো খাবার খেয়েছিল না। আসলে খেতে পারছিল না। তাই রেখে দিয়েছিল। কিন্তু এখন তো প্লেট খালি দেখছি। তাহলে কে খেলো? নাকি বিড়াল ঢুকেছিল ঘরে?
__

নামাজ শেষে খাবার ঘরের দিকে এলো পঙ্খি। রান্না না করলেও কিছু টুকটাক সাহায্য করার চেষ্টা করে সে। একেবারে বসে থাকাটা শোভনীয় দেখায় না। বসার ঘরের দিকে আসতেই এখানে উপস্থিত লোকজন কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। বিশেষ করে খোদেজা বেগম। মুখটা টক খাওয়া মানুষের মতো চুকা করে রেখেছে। পঙ্খিকে দেখেই বলে উঠলো।
–কিলো ছেড়ি শেষমেশ আমার নাতিডারে বস কইরাই ছাড়লি। কমজম ন* না তুই। এচ্ছি ছি ছি ছি। তয় বেশি খুশি হইস না। এই খুশি বেশিদিন টিকবে না।

সকাল সকাল এই অকথ্য বাণী হজম করে পঙ্খি নিজের কাজ করতে লাগলো। এসব যে এখন ওর নিত্যকার সঙ্গী হয়ে গেছে। পঙ্খি রান্নাঘরে এসে রাবেয়া আর জাহানারা কাজ করছে। জাহানারাকে দেখে একটু অবাক হচ্ছে পঙ্খি।এমিনতেতো সে ছোট ছোট কাজেই ওকে কতো কথা শুনিয়ে দেন। অথচ কালকের ঘটনা নিয়ে উনি কোন কিছুই এখনো বললোনা।খোদেজার মতো খোঁচা মেরে কিছু বললোনা। বিষয় টা কেমন অদ্ভুত। পঙ্খিকে আসতে দেখে রাবেয়া বলে উঠলো।
–আরে আরে তুমি আসলে কেন? গেদা দেখলে আবার রাগ করবো। তুমি বরং গিয়া আরাম করো।

–আপনারা কাজ করবেন আর আমি বসে থাকবো এটা কেমন দেখায়? রান্না না করলাম। আপনাদের সাহায্য তো করতে পারি।

–আচ্ছা ঠিক আছে। এক কাজ করো। তুমি এই ট্রে নিয়ে সবাইকে চা দিয়ে দাও। আর কফির মগটা ইন্ধন কে গিয়ে দাও। ও হয়তো বাইরে আছে। ওখানে দিয়ে আসো।

পঙ্খি আমতাআমতা করে বললো।
–আমি দিবো?

–হ্যাঁ তুমি দিবে নাতো কে দিবে? এননিতেও তুমি এখন ওর বউ। তো তুমিই তো ওর সবকিছুর খেয়াল রাখবে। দেখ বিয়েটা যেভাবেই হোক। এখন তোমরা স্বামী স্ত্রী। এটা দুনিয়ার সবচেয়ে পবিত্র বন্ধন। তাই এই সম্পর্কটাকে মন থেকে মেনে নাও। আর সম্পর্কটাকে সফল করার চেষ্টা করো। এখন যাও কফি দিয়ে এসো।

পঙ্খি জোরপূর্বক হেসে কফির ট্রে টা হাতে নিয়ে বাইরের দিকে গেল। বেচারি রাবেয়াকে আর তো সে বলতে পারছেনা তাঁর ছেলের আসল কহিনি। সেতো এখন প্রেমিকা বিরহে মরছে।

পঙ্খি বাইরে এসে কোথাও ইন্ধনকে দেখতে পেল না। সে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে খুঁজলো তাও পেলনা। না পেয়ে ফিরে আসতে নিলেই হঠাৎ গেটের বাইরে থেকে কিছু আওয়াজ শুনতে পেল। পঙ্খি একটু এগিয়ে গিয়ে গেটের ফাঁক দিয়ে বাইরে উঁকি দিয়ে দেখলো ইন্ধন দুজন লোককে টাকা দিচ্ছে। পঙ্খি ভালো করে লক্ষ্য করলে ওর মনে পড়লো এরাতো সেই লোকগুলোর মাঝে ছিল। যারা কাল ওদের ঘেরাও করেছিল। কিন্তু ইন্ধন এদের টাকা দিচ্ছে কেন? তখনই ইন্ধনের বলা কথা কানে এলো। সে বলছে।
–তোদের এখানে আসতে মানা করেছিলাম না? টাকা তো আমি পৌঁছে দিতাম।

–আরে ভাই সবুজরে যে মাইর দিছেন। সেতো এখন বেশি টাকা চাচ্ছে। তাই আসতে হলো।

–আচ্ছা আচ্ছা টাকা নিয়ে জলদি ফুট এখান থেকে।

এদের কথপোকথন শুনে পঙ্খি স্তব্ধ হয়ে গেল। তারমানে এসব ইন্ধন করিয়েছে? কিন্তু কেন?

চলবে……

#মৃগতৃষ্ণা-১৬
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★পঙ্খির অন্তর্দেশ মুষড়ে উঠছে বারংবার। ভাবনারা মস্তিষ্কের তাঁর গুলো টেনে ছিঁড়ে ফেলছে। রক্তনালির ভেতরের তরল পদার্থ টা যেন জমে যাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। ভীতি আর অস্থিরতার সংমিশ্রণে অনূভুতি গুলো ছন্নছাড়া হয়ে যাচ্ছে। সেকি কি শুনলো তখন? ওটা কি সত্যি ছিল? এইসব কি তাহলে ইন্ধনের রচায়িত ষড়যন্ত্র? কিন্তু কেন? কেন করলো সে এমন? কি চায় সে? নিজের ভাইয়ের বিধবাকে বিয়ে করার জন্য এই নাটক কেন করলেন উনি? সেতো অন্য কাউকে ভালোবাসে। আমাকে তো সে দেখতেই পারে না। কথায় কথায় অপমান করে আমাকে। তাহলে আমাকে বিয়ে করার জন্য এতোসব পরিকল্পনা আর ছল চাতুরী কেন করেছেন উনি? লোকটা যেমনই হোক তবে এতোটা ছলনাকারী হবে সেটা কখনো ভাবেনি পঙ্খি। সে শুধু আমাকে না। আমার সাথে সাথে তার প্রেমিকাকেও ধোঁকা দিয়েছে। কিন্তু কিসের জন্য? এই শরীরের জন্য???

ভাবতেই যেন ঘৃণায় ভেতর বাহির কলুষিত হয়ে গেল পঙ্খির। শেষমেশ ইন্ধনও ওইসব নরপি,শাচ দের মতোই বের হলো। যাঁরা নারীকে শুধুই ভো,গের বস্তু মনে করে। আর তাঁদের মনকামনা পূরণ করতে তাঁরা যেকোনো পন্থা অবলম্বন করতে প্রস্তুত। পঙ্খির হঠাৎ মনে এলো সেদিন রাতের কথা। যেদিন অন্ধকারে কেউ ওর সাথে ঘৃণিত আচরণ করেছিল। তবে কি সেদিনও ইন্ধনই ছিল? কারণ ইন্ধনের আসার পরই ওই ঘটনা ঘটেছিল। তারমানে ইন্ধনই….. আর ভাবতে পারছেনা পঙ্খি। ছিহ্ এতো নি,কৃষ্ট উনি? আর আমি কিনা ওই ব্যাক্তির স্ত্রী হয়ে গেছি? এখন নিজের ওপরই ঘৃণা হচ্ছে পঙ্খির। সেদিন পানিতে ডুবে ম,রে কেন গেলিনা তুই? তাহলে আজ এই জ,ঘন্য লোকটার জালে আটকাতে হতোনা তোকে। কিন্তু এখন আর না। উনার আসল চেহারা এসে গেছে আমার সামনে। এবার আমি আর উনার জালে ফাঁসব না। কিছুতেই না।

পঙ্খির ভাবনার মাঝেই ইন্ধন দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। ইন্ধন কে দেখেই ক্রোধের আগুন জ্বলে উঠলো পঙ্খির সর্বাঙ্গে। ফলশ্রুতি ঘটলো এক অকল্পনীয় ঘটনা। ইন্ধন ঘরের মাঝামাঝি আসতেই পঙ্খি আচমকা উঠে গিয়ে দুই হাতে ইন্ধনের কলার চেপে ধরলো। ঘটনার আকস্মিকতায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল ইন্ধন। বিস্মিত চোখে তাকালো পঙ্খির পানে। পঙ্খি আক্রমনাত্মক রুপ ধারণ করে বললো।
–কেন? কেন করলেন আপনি এসব বলুন?

ইন্ধন কতক্ষণ কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইলো পঙ্খির পানে। তারপর বলে উঠলো।
–আগে কলার ছাড়। তারপর কথা হবে। বিয়ে হতে না হতেই তোমার ভাবভঙ্গি দেখছি পুরাই পাল্টে গেছে। সোজা বরের কলার ধরে ঝুলছ? সাহস তো কম না।

–আপনি আগে আমার কথার জবাব দিন। বলুন কেন করলেন এমন? এতবড় ক্ষতি কেন করলেন আমার?

–মানে? কিসের কথা বলছ তুমি?

–একদম ন্যাকা সাজার চেষ্টা করবেন না। আমি সব জেনে গেছি। ওই লোকগুলোকে টাকা দেওয়া দেখেছি আমি। আপনিই এগুলো করিয়েছেন তাইনা?

ইন্ধন চকিত দৃষ্টিতে তাকালো। তারপর পঙ্খির হাত দুটো ধরে নিজের কলার থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ভাবলেশহীন ভাবে বললো
–আচ্ছা এই কথা? হ্যাঁ আমিই করেছি, তো? এতে এতো আচম্বিত হওয়ার কি আছে?

কথাটা বলে ইন্ধন আয়নার সামনে গিয়ে স্বাভাবিক ভাবে শার্টের বোতাম ঠিক করতে লাগলো। পঙ্খি বিস্মিত কন্ঠে বললো।
–আপনি এতো স্বাভাবিক ভাবে কি করে বলতে পারছেন এই কথা? একটুও লজ্জা করছে না এতবড় একটা অন্যায় করে?

ইন্ধন ঠোঁট বাঁকা করে জিহবা দিয়ে চ এর মতো আওয়াজ বের করে বললো।
–কই নাতো? হওয়া জরুরি বুঝি?

ইন্ধনের এমন দায়সারা ভাব দেখে পঙ্খির গা জ্বলে যাচ্ছে। এতটা নির্লজ্জ কেউ কিভাবে হতে পারে? অতিরিক্ত ক্রোধের বশবর্তী হয়ে পঙ্খি বলে উঠলো।
–ছিহ্ আপনি এতো খারাপ।

ইন্ধন এবার পঙ্খির দিকে ঘুরে দাঁড়াল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে পঙ্খির নিকট এগিয়ে আসলো। বাঁকা হাসির রেখা টেনে বললো।
–তোমার ভাবনার থেকেও বেশি খারাপ। আমার নামের অর্থ জানো? ইন্ধন অর্থ আগুন। আমি শুধু জ্বালাতে জানি।

পঙ্খির ভেতরের ক্রোধ আর ঘৃণা যেন ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সে ক্রোধিত স্বরে বলে উঠলো।
–এতকিছু কিসের জন্য? শুধুমাত্র আমার শরীর ভো,গের জন্য? তো দাঁড়িয়ে আছেন কেন? নিজের মনকামনা পূরণ করুন। জানো,য়ারের মতো খুবলে খান আমাকে? নিজের পুরুষত্বের ঘৃণিত রুপ দেখান।

রাগে দুঃখে মুখমণ্ডল লাল ডগডগ করছে পঙ্খির। তবে ইন্ধনের প্রতিক্রিয়ায় তেমন কোন পরিবর্তন হলে বলে মনে হলো না। সে পূর্বের ন্যায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে রইলো পঙ্খির পানে। যেন সে অতি বিনোদনমূলক কিছু দেখছে। ঠোঁটের বাঁকা হাসিটাও আরও বিস্তর হলো তাঁর। তারপর পঙ্খির আরও কাছে এগিয়ে এসে হঠাৎ এক হাতে পঙ্খির কোমড় জড়িয়ে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। আরেক হাতের আঙুলের সাহায্যে পঙ্খির কপালের চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে বললো।
–দ্যাটস আ গ্রেট আইডিয়া।আরে এটার জন্য এতো মেলোড্রামা করার কি ছিলো? আমাকে বললেই হতো। তুমি তো দেখছি হেব্বি চালু। সরাসরি না বলে এতো নাটক করলে। যাইহোক কালকে তো বাসর টা করতে পারিনি। রাগিয়ে মাথা গরম করে দিয়েছিলে তাই। তো চলো শুভ কাজটা একন সেরে ফেলি।

অন্তর আত্মা ঝনঝনিয়ে উঠলো পঙ্খির। আতঙ্কে কলিজা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল তার। ওতো রাগের মাথায় ওসব বলে ফেলেছে। কিন্তু এই অসভ্য লোকটা সত্যি সত্যিই…। না না এটা সে কিছুতেই হতে দিবে না। এই অসুর কে জিততে দিবেনা কোনমতেই। পঙ্খি সর্বশক্তি দিয়ে ইন্ধনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। ক্ষিপ্ত স্বরে বলে উঠলো।
–খবরদার! একদম আমার কাছে আসার চেষ্টা করবেন না। ভালো হবে না বলে দিলাম।

–ওমা তুমিই তো বললে তোমাকে খু,বলে খেতে। তো কাছে না আসলে খাবো কিভাবে? দূর থেকে খাওয়ার মতো কোন গ্যাজেট এখন পর্যন্ত কোন বৈজ্ঞানিক তৈরি করেনি।এমন কি মোটু পাতলু কার্টুনের ডঃ ঝটকাও এমন কোন গ্যাজেট বানায় নি। তাই কাছে তো আসতেই হবে তাইনা?

–চুপ করুন আপনি। আর একটা ফালতু কথা বলবেন না। সেদিন অন্ধকারে আপনাকে দেখতে পায়নি। তাই অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে আপনি আমাকে সেদিন জ,ঘন্য ভাবে ছুঁয়েছিলেন। তবে আজ না। আজ আপনাকে সেই সুযোগ দেবনা।

এবারে ইন্ধনের চেহারার রুপ বদলালো। বাঁকা হাসিটাও গায়েব হয়ে গেল মুহূর্তেই। কপালে সুক্ষ্ম ভাজ পড়লো। কঠিনত্ব ছেয়ে গেল চেহারায়। পঙ্খির দিকে এগিয়ে এসে শক্ত গলায় বললো।
–হোয়াট? এক মিনিট!! সেদিন রাতে মানে? কোনদিনের কথা বলছ তুমি? তোমার সাথে কেউ কিছু করেছিল?

পঙ্খি তাচ্ছিল্যের সুরে বললো।
–ভাব তো এমন করছেন যেন ভাজা মাছটাও উল্টে খেতে জানেন না। সেদিন আপনিই ছিলেন আমি ভালো করেই বুঝে গেছি। আপনি আসার তিন চারদিন পরই এই ঘটনা হয়েছিল। তাই আর নাটক করে কোন লাভ নেই।

–জাস্ট শাট আপ ইডিয়ট। ঠিক করে বলো কি হয়েছিল? মাথা ফেটে যাচ্ছে আমার। টেল মি ড্যাম ইট।

–আপনি নিজে জানেন না? এত ঢং করছেন কেন? মনে নেই কিভাব অন্ধকারের মাঝে আমাকে পেছন চে,পে ধরে,,,,,

আর বলতে পারলো না পঙ্খি। গলা ধরে আসলো তাঁর। চোখে নেমে এলো অশ্রুধারা। ইন্ধন পঙ্খির দুই কাঁধ ধরে বললো।
–কবে হয়েছে এই ঘটনা? তুমি আগে কখনো বলোনি কেন?

পঙ্খি আবারও ইন্ধন কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বললো।
–বললাম না ছুবেন না আমাকে! সেদিন আপনাকে ধরতে পারিনি। তাই বেঁচে গিয়েছিলেন। তবে আজ খারাপ কিছু করতে চাইলে একেবারে মে,রে ফেলবো বলে দিলাম।

ইন্ধন স্মিথ হেঁসে বললো।
–মরাকে আবার কিভাবে মারবে? আমিতো সেই কবেই মরে গেছি। মরাকে আবার মারা যায় বুঝি? অবশ্য তোমার দ্বারা তাও সম্ভব।একই ব্যাক্তিকে হাজার বার মারার ক্ষমতাও তোমার মাঝে আছে।

কথাটা বলেই ইন্ধন বেড়িয়ে গেল। ইন্ধনের কথা আবারও পঙ্খির মস্তিষ্কে ঢুকলো না। আর না সে তাতে ভ্রুক্ষেপ করার চেষ্টা করলো। অতিরিক্ত ক্রোধে তাঁর মন মস্তিষ্কে জ্যাম বেঁধে আছে।
___

বসার পানি খেতে এসে দেখলো চুমকি খুব খুশি মনে গান গাইছে আর কাজ করছে। পঙ্খি ভ্রু কুঁচকে বললো।
–কিরে এতো খুশি কিসের জন্য? কি হয়েছে?

চুমকি হাসি মুখে বললো।
–আরে খুশিতো হমুই। এত্তগুলা নতুন কাপড় চোপড় পাইছি। এইগুলান বেচলে মেলা টেহা পামু।

–নতুন কাপড় চোপড় কোথায় পেলি? কে দিলো তোকে?

–আরে জাহানারা চাচী দিছে। ওইযে চেয়ারম্যান চাচা আপনের লাইগা যে সাদা পোশাক গুলা আনছিলো না? ওইগুলা সব আমারে দিয়া দিছে। কারণ আপণের তো এহন বিয়া হইয়া গেছে। আপনের তো এহন এই সাদা পোশাকের কোন কাম নাই। আপনে তো এহন রঙিন রঙিন পোশাক পইড়া ঘুইরা বেড়াইবেন। লাল নীল কাপড় পিন্দা জামাইয়ের হামনে দিয়া ঘুরঘুর করবেন। এহারে রঙ্গবতির মতোন।

পঙ্খি বিষন্ন হয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। রঙিন দুনিয়া! সত্যিই কি তাঁর জীবন রঙিন হয়েছে? নাকি কালো আধারে ছেয়ে গেছে? এরচেয়ে তো ওর আগের বেরঙ জীবনও ভালো ছিলো। এই কলুষিত কালো অন্ধকারের চেয়ে তো অবশ্যই ভালো ছিলো।

এতো এতো দুশ্চিন্তায় চারপাশ কেমন যেন গুমোট হয়ে আসছে। তাই বিশুদ্ধ বাতাসে একটু মন খুলে নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য ছাঁদে এলো পঙ্খি। ছাঁদে এসে দেখলো কনিকা ছাঁদের এককোনায় মনমরা হয়ে বসে আছে। আজকাল সে প্রায় এমনই থাকে। সেদিনের পর থেকেই কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে। কারোর সাথে ঠিকমতো কথা বলে না। হাসি আনন্দ বা অন্য কোন মনোভাবই প্রকাশ করে না সে। পঙ্খিও বিষয় টা খেয়াল করেছে। তবে নিজের এসব ঝামেলার মধ্যে কনিকার সাথে ভালোভাবে কথাই বলা হয়নি। পঙ্খি এগিয়ে গিয়ে কনিকার কাছে বসলো। কনিকার কাঁধে হাত রেখে নরম সুরে বললো।
–কি হয়েছে আপনার ভাবি? সবসময় এতো উদাসীন থাকেন কেন? আপনি কি কোন কষ্টে আছেন? আমাকে বলুন। আমিতো আপনার ছোট বোনের মতোই তাইনা? বলুন না কি হয়েছে?

কনিকা ছলছল চোখে তাকালো পঙ্খির পানে। হঠাৎ সে পঙ্খিকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। পঙ্খি ঘাবড়ে গেল। কনিকার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো।
–কি হয়েছে ভাবি খুলে বলুন আমাকে?

অনেকক্ষণ কাঁদার পর একটু শান্ত হলো কনিকা। তারপর বলে উঠলো।
–পঙ্খি তোমাকে একটা কথা বলি শুনে রাখো। কখনো মানুষের উপরের চেহারা দেখে ভুলবে না। সবসময় আমরা যেটা দেখি সেটাই সত্যি হয়না।বরং তাঁর উল্টো পিঠে অন্য কিছুও থাকতে পারে। সেটা কখনো ভাালো আবার কখনো মন্দও হতে পারে। তাই অল্পতেই কারোর উপর কোন রায় বানানে উচিত না। আর না অন্ধভাবে বিশ্বাস করা উচিত। তাই চোখ কান সবসময় খোলা রেখে চলবে। যাতে কেউ তোমার সরলতার সুযোগ নিয়ে তোমাকে ধোঁকা দিতে না পারে।

পঙ্খি মনে মনে ভাবলো, সেটা আমার থেকে ভালো আর কে জানে। কিন্তু ভাবি হঠাৎ এ কথা বলছে কেন? সেকি কিছু জেনে গেছে? পঙ্খি বলে উঠলো।
–ভাবি হঠাৎ এসব কথা বলছেন কেন? কিছু হয়েছে?

–যা হওয়ার তাতো হয়েই গেছে। এখন আর বলে কি সেটা ঠিক হয়ে যাবে? তোমাকে এসব বলছি কারণ তুমিও যাতে আমার মতো একই ভুল না করো।

–মানে কি হয়েছে আপনার সাথে?

–আমি…..

–আরে কনিকা তুমি এখানে? আর আমি তোমাকে সব জায়গায় খুঁজে বেড়াচ্ছি।

ওদের কথার মাঝেই জুবায়েদের গলা শুনে কনিকার বাকি কথা অসম্পূর্ণই থেকে গেল। জুবায়েদ কথা বলতে বলতে কনিকার কাছে এগিয়ে এসে হাসিমুখে বললো।
–আরে তুমি এখানে কি করছ? তোমার তো ঔষধ খাওয়ার সময় হয়েছে। চলো চলো ঔষধ খেয়ে আরাম করো।

জুবায়েদ কনিকার কাঁধ ধরে ওকে উঠিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো। পঙ্খি ওদের দিকে তাকিয়ে রইলো। জুবায়েদ ভাইয়া কতো ভালোবাসেন ভাবিকে। কিন্তু তবুও ভাবির মাঝে এতো কিসের কষ্ট?
জুবায়েদ যেতে যেতে আরচোখে কয়েকবার তাকালো পঙ্খির পানে। কালকে পঙ্খির আর ইন্ধনের বিয়ের খবর শোনার পর থেকেই মেজাজ বিগড়ে আছে তাঁর। এতদিন ভর চেষ্টা করেও সে এই রমনীকে কাছে নিতে পারলোনা। অথচ ওই ইন্ধন এসেই বাজি হাঁকিয়ে দিলো। আমার আগেই পঙ্খিকে নিজের ঘরে নিয়ে নিলো। এই ইন্ধন সব জায়গায় আমাকে টেক্কা দিচ্ছে। এরতো একটা ব্যাবস্থা করতেই হবে। আমার ওপর দিয়ে জিততে দেওয়া যাবে না ওকে। আমার জিনিস তো আমি পেয়েই ছাড়বো।

একটু পরে পঙ্খিও ছাঁদ থেকে নেমে এলো। করিডর দিয়ে যেতে নিলেই হঠাৎ সামছুল মজুমদারের ঘর থেকে হালকা আর্তনাদের আওয়াজ শোনা গেল। পঙ্খি বিষয় টা দেখার জন্য দরজা খুলতেই দেখলো জাহানারা মেঝেতে পড়ে আছে। পঙ্খি দৌড়ে গেল তার কাছে। জাহানারাকে ধরে বিছানায় উঠে বসিয়ে দিয়ে বললো।
–বেশি লাগেনি তো? পড়লেন কিভাবে?

জাহানারা একটু দূর্বল কন্ঠে বললেন।
–কি জানি উঠে খাঁড়া হতেই মাথা ক্যাবা জানি ঘুরে উঠলো।

–তাহলে আপনার পেশার হয়তো লো হয়েছে। ডাক্তার কাকারে আসতে বললেই তো হয়। আপনাকে এসে দেখে যাবে। আপাতত একটা ডিম সিদ্ধ করে দেই আপনাকে। খেলে একটু ভালো লাগবে।

–না না থাক লাগবে না। এমনিই ঠিক হয়ে যাবো।

–এমনি কিভাবে হবেন। আপনি বসুন আমি এখুনি নিয়ে আসছি।

পঙ্খি দ্রুত গিয়ে একটা ডিম সিদ্ধ করে নিয়ে এসে জাহানারাকে খাইয়ে দিলো। তারপর বললো।
–আপনি আরাম করুন।চলাফেরা করার দরকার নেই। আর কোনকিছু লাগলে আমাকে বলুন।

জাহানারা বলে উঠলো।
–শোন আমাদের চিন্তা আর করতে হবে না তোমার। তোমার এখন নতুন সংসার হয়েছে। সেটায় মনোযোগ দাও এখন। সংসার কিন্তু এতো সহজ না। অনেক ঝড় ঝাপটা আসে।তবে নিজেদের ধৈর্য রাখতে হয়। ইন্ধনের একটু রাগ বেশি, তবে ছেলেটা কিন্তু অনেক ভালো। তাই ধৈর্য ধরে নিজের নতুন জীবন টা সাজিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করো।

জাহানারার কথায় পঙ্খি বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেল। তাঁর বিশ্বাসই হচ্ছে না এসব তাকে জাহানারা বলছে। যে আজপর্যন্ত কথায় কথায় তাঁকে গালমন্দ ছাড়া আর কিছুই বলেনি। সে কিনা আজ ওকে এসব কথা বলছে? ওতো ভেবেছিল এই বিয়ের জন্য হয়তো জাহানারা রেগে আছেন। কিন্তু এখানে তো উল্টো হচ্ছে। জাহানারার এই পরিবর্তন পঙ্খিকে ভাবনায় ফেলছে। যদিও জাহানারার এই সদয় আচরণ তাঁর ভালোই লাগছে। তবে একটা কথা ভেবেই খারাপ লাগছে। জাহানারা যাকে ভালো ছেলে ভাবছে, সে যে কতটা খারাপ তাঁর ধারণাও নেই উনার।এমন অসৎ লোকের সাথে কিভাবে সে সুন্দর সংসারের স্বপ্ন সাজাবে?
__

সারাটা দিন পঙ্খির এমন অশান্তি আর দুশ্চিন্তার মাঝেই কাটলো। সে এখন কি করবে সেই ভাবনার কোন কুল কিনারা হাজার খুঁজেও পাচ্ছেনা । এই অনিশ্চিত ভবিষ্যত নিয়ে সে কিভাবে সামনে এগুবে এই ভাবনাই তাঁকে শান্তি দিচ্ছে না। রাত হচ্ছে তাঁর ভয় বাড়ছে। সারাদিন তো ওই অসভ্য লোকটা আর আসেনি বাড়িতে। কিন্তু রাতে ফিরে এসে যদি আবারও ওর সাথে কিছু করতে চায় তখন কি করবে ও? সেই ভাবনায় কলিজা কেঁপে উঠছে পঙ্খির। এই বিষয়ে তো চিৎকার করে কাওকে কিছু বলাও যাবে না। সে যে এখন স্বামী নামক হকটা পেয়ে গেছে।

রাত তখন দশ টা।পঙ্খি ভাবলো লোকটা ফিরে আসার আগেই চুপচাপ আগের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়বো। তাহলে কেউ বুঝতে পারবে না। যেই ভাবা সেই কাজ। পঙ্খি বাইরে একটু উঁকি দিয়ে দেখলো বাইরে কেউ নেই। সবাই নিজ নিজ কক্ষে ঢুকে পড়েছে। পঙ্খি এবার মৃদু পায়ে বাইরে বের হলো। ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে লাগলো ওর রুমের দিকে। তখনই হঠাৎ কেউ পেছন থেকে এসে পঙ্খিকে চেপে ধরলো। পঙ্খি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আগুন্তুক ওর মুখে রুমাল চেপে ধরলো। মুহূর্তের মধ্যেই জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়লো পঙ্খি। আগুন্তকের মুখে সয়তানি হাসির রেখা ফুটে উঠলো।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here