মৃগতৃষ্ণা-১৭

0
696

#মৃগতৃষ্ণা-১৭
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★ভারী চোখের পলক জোড়া টেনে খোলার প্রচেষ্টা করছে পঙ্খি।মাথাটাও যেন হাজার মন ওজনের হয়ে গেছে। অনেক চেষ্টা করার পর নেত্র পল্লব মেলে তাকাতে সক্ষম হলো সে। ভারী মাথা টা দুই হাতে চেপে ধরে ধীরে ধীরে উঠে বসলো। আশেপাশে তাকিয়ে নিজেকে কোন অজানা অপিরিচিত স্থানে পেল সে। মনে পড়লো তাঁর তখনকার কথা। আতঙ্কিত হয়ে গেল পঙ্খি। এটা কোথায় ও? তারমানে কি ওকে অ,পহরণ করে এনেছে কেউ? ভয়ে হাত পা অসার হয়ে আসলো তাঁর। কে এনেছে তাকে এখানে? কি চায় সে? পঙ্খি ভয়ার্ত চোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে ভালোকরে দেখতে লাগলো জায়গাটা। ছোনের তৈরি ছোট্ট একটা কুঁড়ে ঘরের ভেতর আছে ও। ঘরটা বোধহয় একেবারে নতুন তৈরি করা হয়েছে। দেখে এমনটাই মনে হচ্ছে। দেখতে দেখতে পেছন দিকে ঘুরতেই ছোনের বেড়ার সাথে একটা ছবি ঝুলানো দেখলো। ছবিটা রঙ তুলিতে আঁকা। একটা ছোট মেয়ে আর কিশোর ছেলের ছবি। ছবিটার দিকে ভালো করে লক্ষ্য করতেই বুকের মাঝে মোচড় দিয়ে উঠলো পঙ্খির। হৃৎস্পন্দনের গতি বেড়ে গেল। মনের ভিতী দূর হয়ে সেখানে জন্ম নিলো সমুদ্র সমান অস্থিরতা আর কৌতুহল।

পঙ্খি কাঁপা কাঁপা হাতে ছবিটাতে হাত বোলালো। এই ছবি এখানে কিভাবে? তারমানে কি…… তবে কি সত্যিই তাঁর প্রতীক্ষার অবসান ঘটলো? সেকি এসে গেছে? পঙ্খি অস্থির চোখে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। অধৈর্য হয়ে হৃদয় থমকে খুঁজতে লাগলো কাঙ্খিত ব্যাক্তিকে। উত্তেজনায় যেন জানটাই বের হয়ে যাবে ওর। কিন্তু ওকেতো বাঁচতে হবে। ম,রার আগে যে একবার তাকে দেখতে হবে। নাহলে যে ম,রেও শান্তি পাবেনা। পঙ্খি এবার অস্থির হয়ে কুঁড়ে ঘরের দরজা খুলে বাইরে বেড়িয়ে এলো। বাইরে এসে আরেক দফা বিস্মিত হলো। এটাতো সেই নদীর পারের জায়গাটা। ঘরের সামনে সেই বটগাছ টা। পঙ্খির হাত পা কাঁপছে। কান্নারা গলারা ভেতর এসে ভীড় জমাচ্ছে। শরীরের সব স্নায়ুতন্ত্র অকেজো হয়ে যাচ্ছে। তৃষ্ণার্থ আঁখি যুগল অধীর হয়ে খুঁজে যাচ্ছে কাওকে। বাচ নিঃশ্বাস টা যেন তাঁকে দেখার আগে বন্ধ হয়ে যায়।

হাতের ছবিটা বুকে জড়িয়ে উন্মাদের মতো খুঁজতে লাগলো সেই ব্যাক্তিকে। নদীর কিনারার আরেকটু কাছাকাছি যেতেই,পূর্ণ চাঁদের আলোয় পেছন থেকে একটা পুরুষ অবয়ব দেখতে পেল পঙ্খি।নদীর দিকে মুখ করে প্যান্টের পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। থমকে গেল পঙ্খি। সাথে থমকে গেল তার সর্বাঙ্গ। নিঃশ্বাস টাও বুঝি এবার বের হতে চাইছে না। পুরুষ অবয়ব টি পেছনে না ঘুরে একই অবস্থায় দাঁড়িয়ে থেকে বলে উঠলো।
–এক ছিল রাজকন্যা। ছাগল রুপি পঙ্খিরাজ ঘোড়ায় চড়ে সে আসতো সে রাজপুত্রের খোঁজে। রাজপুত্রকে বলতো সে রুপকথার কতশত কল্পকাহিনি। হাসতো রাজপুত্র। হাসতো তাঁর পৃথিবী। রঙিন হতো তার ভূবন। রাজকন্যাকে নিয়ে ভাসতো সে মেঘের রাজ্যে। পরন্তু একদিন রাজপুত্রকে যেতে হলো দূরদেশে।তবে সেখানে শুধু তাঁর দেহটাই ছিল। তাঁর প্রাণ টা সে এখানেই রেখে গিয়েছিল। প্রতিটা ক্ষণ বিরহে ক্ষুন্ন হতো রাজপুত্র। জ্বলতো,পুড়তো তার মন।ভেঙে চুরমার হতো প্রতিটা মূহুর্ত। ক্ষোভ হতো তার সবকিছুর ওপর। ক্ষোভ হতো রাজকন্যার ওপরও। নিষ্ঠুর তার রাজকন্যা। সে কেন আসে না? সেতো তাঁর ছাগল রুপি পঙ্খিরাজ ঘোড়ায় চড়ে সর্বত্রই যেতে পারে। তাহলে রাজপুত্রের কাছে কেন আসে না? কৃত্রিম এই দুনিয়ার বাস্তবতা বুঝেও মানতে চাইতো না রাজপুত্র। সে রাজকন্যার কাল্পনিক কথাগুলোই মানতে চাইতো। সবকিছুর উর্ধ্বে সেই রাজকন্যাকেই চাইতো সে। আজও চায়।

এতটুকু বলে সেই পুরুষ অবয়ব টি এবার ধীরে ধীরে পেছনে ঘুরে দাঁড়ায়। তাঁর মুখদর্শন হতেই স্তব্ধ হয়ে যায় পঙ্খি। বিস্ফোরণের ন্যায় চমকে ওঠে পঙ্খি।হৃদপিণ্ড থমকে যায় তার। এ কাকে দেখছে সে? ইন্ধন? তারমানে ইন্ধনই ওর রাজপুত্র? পুরো পৃথিবী যেন পঙ্খির চোখের সামনে গোলগোল ঘুরছে। কলিজা কেঁপে উঠছে তাঁর। সামনে থেকে ইন্ধন মুচকি হেঁসে আবার বলতে লাগলো।
–রাজপুত্র আজও হৃদ হস্তে নিয়ে অপেক্ষায় আছে রাজকন্যার।তাঁর ভূবন রাঙানো সেই হৃদহরণীর অপেক্ষায় আজও তৃষ্ণার্ত চোখে পথ চেয়ে আছে সে। রাজকন্যা কি আজও আসে রাজপুত্রকে খুঁজতে? তাঁর ছাগল রুপি পঙ্খিরাজ ঘোড়ায় চড়ে যাদুর মায়ায় অবতীর্ণ হয় সে? নাকি ভুলে গেছে তার রাজপুত্রকে? তাঁর জন্য কি এই গল্পটা শেষ হয়ে গেছে? নাকি সে নতুন কোন রাজপুত্রের খোঁজ পেয়েছে? তাই সে এই পুরাণ রাজপুত্রকে বেমালুম ভুলে গেছে। যে রাজপুত্রের কাছে তাঁর ভূবণ বলতে শুধুই তাঁর রাজকন্যা।

কথাগুলো বলতে বলতে ধীরে ধীরে ইন্ধন পঙ্খির কাছে এগিয়ে এলো।সীমাহীন মায়ার সাগর ভরা চোখে তাকিয়ে রইলো পঙ্খির পানে। পঙ্খির মন মস্তিষ্কের ক্রিয়া শূন্যের কোঠায়। হৃদয়ে পাথর চেপে ধরেছে তার। অনুভূতিরা এলোমেলো হয়ে ছুটছে পাগলের ন্যায়। সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলোনা। দৌড়ে সে কুঁড়ে ঘরটার মাঝে চলে এলো। চৌকির সামনে মেঝেতে বসে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সে। এ কান্না সুখের না দুঃখের তা জানা নেই পঙ্খির । শুধু জানে এখন কাঁদতে হবে তাকে। প্রচুর কাঁদতে হবে। নাহলে সে দম বন্ধ হয়ে ম,রে যাবে। কান্নার গতি ধীরে ধীরে বাড়লো।

একটু পরে ইন্ধন এসে দাঁড়াল পঙ্খির পেছনে। তারপর বলে উঠলো।
–কাঁদতে চাও কাঁদো। আজকের দিনে কান্না এলাউড আছে। মন খুলে কাঁদো। আমি তোমাকে আটকাবো না।আমার জন্য তোমাকে কাঁদতে দেখে ভালোই লাগছে। আমাকে তো র,ক্তের অশ্রু ঝরিয়েছ। আজ না হয় তুমিও একটু কাঁদো। হ্যাঁ তবে শুধু আজকের দিনের জন্যই এলাউড। এরপর ডেডলাইন। কান্না ইজ নট এলাউড ফর ইউ। তো কান্না পুরো করো তারপর নাহয় আসবো আমি।

ইন্ধন চলে যেতে নিলেই পঙ্খি হঠাৎ পেছন থেকে কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠলো।
–দাঁড়ান।

দাঁড়িয়ে গেল ইন্ধন। বাঁকা হাসির রেখা ফুটে উঠলো তাঁর ঠোঁটের কোনে। পঙ্খির দিকে ঘুরে তাকালো সে। অশ্রুসিক্ত নয়নে কম্পিত স্বরে পঙ্খি বলে উঠলো।
–আ আপনি কি স সত্যিই আমার রাজপুত্র??

ইন্ধন এগিয়ে এসে পঙ্খির সামনে বসলো। মুচকি হেঁসে বললো।
–উহুম আমি রাজপুত্র না। আমি রাজপু্ত্র হলে তো আমার রাজকন্যাকে নিজের কাছেই আঁটকে রাখতাম। তাঁকে হারিয়ে যেতে দিতাম না। যে নিজের রাজকন্যাকেই ধরে রাখতে পারে না তাঁর তো নিজেকে রাজপুত্র দাবি করার কোন অধিকারই নেই তাইনা বলো? যাকে ছাড়া জীবনরেখা থেমে যাবে তাঁকেই আঁটকে রাখতে পারলাম না। কতোবড় অপদার্থ আমি।

আবারও হু হু করে কেঁদে উঠলো পঙ্খি। কাঁদতে কাঁদতেই বললো।
–অপদার্থ তো আমি। আপনাকে চোখের সামনে দেখেও আমি চিনতে পারলাম না। এতো কাছে থেকেও বুঝতে পারলাম না একবারও।

–কিভাবে বুঝবে, কখনো কি ভালোভাবে তাকিয়েছ আমার দিকে? কখনো খেয়াল করে আমাকে পর্যবেক্ষণ করেছ? করোনি। করলে হয়তো দেখতে পেতে। দেখতে পেতে ডান হাতে তোমার দেওয়া সেই কামড়ের চিহ্ন। যেটা তুমি দিয়েছিলে আমাকে। কারণ আমি তোমার ছাগল কে ঢিল ছুঁড়েছিলাম বলে। তোমার দেওয়া চিহ্ন টা আমি কখনো মিটতে দেইনি। এটা স্থায়ী করার জন্য এ,সি,ড দিয়ে এই জায়গা টা ক্ষত করে দিয়েছি। দেখো এখনো কেমন স্পষ্ট জ্বলজ্বল করছে তোমার দেওয়া চিহ্ন।

ইন্ধন ডান হাতের হাতা গুটিয়ে সেই চিহ্ন টা দেখালো। মুখে হাত চেপে কাঁদতে লাগলো পঙ্খি। হৃদয়ের ভার যেন ক্রমেই বেড়ে চলেছে তাঁর। ইন্ধন বলতে লাগলো।
–কিংবা খেয়াল করতে তোমার দেওয়া সেই প্লাস্টিকের আংটিটাকে। যেটা আমি অতি মূল্যবান পাথরের মতো আমার হাতের ব্রেসলেটের সাথে লাগিয়ে রেখেছি। এই দেখ।

ইন্ধন বাম হাত টা উঠিয়ে তার ব্রেসলেট টা বের করে দেখালো। লক্ষ টাকা দামের প্লাটিনাম ব্রেসলেটের সাথে ওর দেওয়া আট আনা দামের প্লাস্টিকের আংটি টা শোভা পাচ্ছে। পঙ্খি এসব দেখছে আর কেঁদে কেঁদে উঠছে। ইন্ধন প্যান্টের পকেট থেকে একটা নূপুর বের করে বললো।
–কিংবা তোমার পায়ের এই নুপুর টাকে যেটা তুমি আমাদের শেষ দেখা করার দিন ভুলে রেখে গিয়েছিলে। তোমার মনে আছে একদিন তোমাকে আমার পার্সোনাল জিনিসে হাত দেওয়ার জন্য বকা দিয়েছিলাম? এটার জন্যই সেদিন এতো রেগে গিয়েছিলাম আমি। কারণ রাজকন্যার জিনিসে কেউ হাত দিতে পারে না। কিংবা তোমার দেওয়া সেই পুতুল বউটা। যেটা আমি আমার প্রাণের চাইতেও বেশি সামলিয়ে রেখেছি।

ইন্ধন কুঁড়ে ঘরের মাঝে রাখা টেবিলের ওপর থেকে একটা ভেলভেট কাপড়ে মোড়ানো একটা কাঠের বক্স নিয়ে এলো। পঙ্খির সামনে এসে বক্স খুলে একটা মাটির পুতুল বউ বের করে বললো।
–এই দেখ তোমার দেওয়া সেই পুতুল বউ। তুমি পুতুল বউ আর পুতুল বরের বিয়ে দিয়েছিলে। তারপর পুতুল বউ টা আমাকে দিয়েছিলে। আর পুতুল বরটা তুমি রেখে দিয়েছিলে। বলেছিলে এগুলো আমরা দুজন। দেখো আমি তোমার কথামতো এটাকে কতো যত্ন করে রেখে দিয়েছি।এই পুতুল বউয়ের মতো আমিও আমার রাজকন্যাকে ছাড়া অসম্পূর্ণ। আজ কি আমাদের দুজনেই পূর্ণতা দিবে? পুতুল বউ কে তাঁর পুতুল বর আর আমাকে আমার রাজকন্যা ফিরিয়ে দিবে?

ইন্ধন ওর দুই হাত দিকে ছড়িয়ে দিয়ে আকুলতা ভরা কন্ঠে বললো।
–হাজার জনম সমান তৃষ্ণার্ত এই হৃদয় টাকে এক পশলা বৃষ্টিতে সিক্ত করবে? নতুন করে জীবিত করবে এই নিষ্ক্রিয় মনটাকে?

কান্নার গতি বৃদ্ধি পেল পঙ্খির। ইন্ধনের এই আকুল আবেদনে নুইয়ে পড়লো সে। কাল বিলম্ব না করে সারা দিলো ইন্ধনের আবেদনে। ঝাঁপিয়ে পড়লো ইন্ধনের বুক পিঞ্জরে। দুই হাতে গলা জড়িয়ে ধরে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগলো। ইন্ধনও বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করে নিলো তাঁর রাজকন্যাকে। মিশিয়ে নিলো তাঁকে হৃদবক্ষে। বছরের বছর শুঁকনো খরা জমিনে যেন শ্রাবণ মেঘের ঘনঘটা নামলো।হৃদপিণ্ডের ওপর এই চামড়ার পরদটা যেন আজ বাঁধা মনে হচ্ছে ইন্ধনের কাছে। এটা না থাকলে সে হৃদপিণ্ডের ভেতর সামিয়ে নিতো তাঁর রাজকন্যাকে। দুটি তৃষ্ণার্ত হৃদয়ের সংগম ঘটলো যেন। দুজনেই দুজনাতে নিমজ্জিত থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর পঙ্খি ইন্ধন কে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসে নাক টেনে বলে উঠলো।
–আপনি যখন সব জানতেন তাহলে আমাকে বলেননি কেন? আর এতদিন আমার সাথে এমন খারাপ আচরণ কেন করছিলেন?

–তো কি করবো? তোমার ওপর যে আমার কতো রাগ জমেছিল তা জানো? বাড়ি থেকে আমাকে যখন বিদেশে পাঠানোর কথা বললো। আমি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। তোমার কাছ থেকে দূরে যাওয়ার ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে গিয়েছিলাম আমি। আমি কিছুতেই রাজি হইনি। কিন্তু আমি তখন ছোট। ওই বড়োদের সাথে পেরে ওঠার শক্তি ছিলোনা আমার। বাবা আমাকে বিদেশে পাঠিয়েই ছাড়বেন। আমার রাগারাগি, চেঁচামেচি, কান্নাকাটি কোন কিছুতেই থামাতে পারলাম না। শেষমেশ জোর করে আমাকে পাঠানো হলো। আমি যাওয়ার আগে তোমার সাথে দেখা করে যেতে চেয়েছিলাম। তোমাকে অনেক কথা বলতে চেয়েছিলাম। আমার জন্য অপেক্ষা করতে বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি আসোনি। চারদিন পার হয়ে গেল তাও তুমি আসোনি। আমি তোমার আসল নাম বা পরিচয় কিছুই জানতাম না। তোমাকে খোঁজার কোন উপায় ছিলোনা আমার কাছে। এরই মাঝে আমার যাওয়ার সময় হয়ে গেল। তাই আর উপায় না পেয়ে একটা চিঠি লিখে এই বটগাছের সাথে বেঁধে রেখেছিলাম। এই আশায় যে তুমি ওটা দেখে পড়ে নিবে। তারপর বিদেশ চলে গেলাম আমি। সেখানে প্রাণহীন জীবন কাটালাম কিছু বছর। তারপর আবার দেশে ফিরলাম। খুঁজতে লাগলাম তোমাকে। রোজ এই বটগাছের নিচে গিয়ে এসে থাকতাম তোমার আশায়। কিন্তু তুমি এলে না। এইভাবে দিন কাটতে লাগলো আমার। তারপর একদিন তোমার ভাইকে দেখতে পেলাম। আমি যেদিন বিদেশে যাচ্ছিলাম সেদিন গাড়ির ভেতর থেকে তোমাকে তোমার ভাইয়ার সাথে দেখেছিলাম। তুমি ভাইয়া ভাইয়া বলে ডাকছিলে তাকে। আমি তখন গাড়ি থামিয়ে তোমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলাম কিন্তু বাবা থামান নি। যাইহোক তোমার ভাইকে দেখে আমি চিনেফেলেছিলাম। আর সেদিন যখন তুমি এসে বললে তুমিই ওর বোন তখন পুরো পৃথিবী এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। আমি কখনো ভাবিনি তুমি আমাকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করে নিবে। আমি বোকার মতো ভাবছিলাম তুমিও হয়তো আমার অপেক্ষা করছ। কিন্তু সেদিন আমার ভুল ভেঙে গিয়েছিল। যাকে আমি নিজের চাইতেও বেশি ভালোবাসি সে কিনা আমারই ভাইয়ের বিধবা। এই ভাবনাটাই আমাকে বিষাক্ত সাপের মতো কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। চোখের সামনে যখন তোমাকে ওই বিধবা বেশে দেখতাম তখন সারা শরীর জ্বলে উঠতো। মনে হতো তুমি অন্য কারো। অন্য কারোর জন্য তুমি এই পোশাকে আছো। মনে হতো অন্য কেউ তোমার অঙ্গে জড়িয়ে আছে। ভেতরটা পুড়ে খার খার হয়ে যেতো আমার। সহ্য হতোনা আমার। এতো কাছে থেকেও তোমাকে ছুঁতে পারতাম না। বুকে জড়িয়ে তোমার নিঃশ্বাস উপলব্ধি করতে পারতাম না। আর এই না পাওয়াটাই আমার মনে জন্ম দিচ্ছিল তোমার প্রতি পাহাড় পরিমাণ ক্ষোভ। ক্রোধে ফেটে যেতো মাথা। চিল্লিয়ে বলতে ইচ্ছে করতো। কেন? কেন করলে তুমি আমার সাথে এমন? কেন আরেক জনের ঘরের ঘরনি হলে তুমি? কেন আমার জন্য অপেক্ষা করলেনা তুমি? বলো কেন?

পঙ্খি কাঁদো কাঁদো গলায় বললো।
–আপনি ভুল বুঝছেন আমাকে। তখন আমার দাদী মারা গিয়েছিল। তাই কিছুদিন আমি আপনার সাথে দেখা করতে যেতে পারিনি। কিন্তু পরে আমি এসেছিলাম। কিন্তু আপনাকে পায়নি। আর সত্যি বলছি কোন চিঠিও পায়নি এখানে। হয়তো কোন ছেলেমেয়ে দুষ্টুমি করে ছিঁড়ে ফেলছে সেটা। কিংবা অন্য কিছু হয়েছে। তবে আমি রোজ এখানে একবার করে আসতাম। শুধু এই আশায় যে, একদিন আপনাকে অবশ্যই দেখতে পাবো। দেখতে দেখতে বছর কেটে গেল। কিন্তু আমি তবুও আশায় থাকতাম আপনি আসবেন। আর বিয়েটা আমি করতে চাইনি। অনেক মানা করেছিলাম,আকুতি-মিনুতি, কান্নাকাটি করেছিলাম। কিন্তু মানেনি কেউ। শোনেনি আমার কথা। জোর করে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল। সত্যি বলছি আমার হৃদয় রাজ্যে শুধু একটাই পুরুষ আছে। সে হলো আপনি। আর কেউ না। বরং আপনারই মনে একজন আর মুখে আরেকজন।

ইন্ধন ভ্রু কুঁচকে বললো।
–মানে??

পঙ্খি অভিমানী সুরে বললো।
–এতোই যখন আমাকে ভালোবাসেন তাহলে আপনি অন্য মেয়ের সাথে প্রেম করলেন কিভাবে? আবার তাকে বিয়ে করারও পরিকল্পনা করে ফেলেছিলেন। আবার আমাকে উল্টো বলছেন? এই আপনার ভালোবাসা?

ইন্ধন বাঁকা হেসে বললো।
–কেন জ্বলে নাকি? আজকাল তো এটা ফ্যাশন। ঘরে একটা, বাইরে একটা।

ছলছল চোখে তাকালো পঙ্খি। ইন্ধন মুচকি হেঁসে বললো।
–আরে পাগলি আমার কোন গার্লফ্রেন্ড নেই। ওটাতো এমনি এমনি বলেছিলাম সবাইকে। নাহলে সবাই ধরে বেঁধে আমাকে ওই তুষের সাথে বিয়ে দিয়ে দিতো।

–মিথ্যে কেন বলছেন? আমি দেখেছি আপনি কতবার ওই মেয়ের সাথে ফোনে প্রেমালাপ করছিলেন। আর কাল আপনার বালিশের নিচে ওই মেয়েটার ছবিও দেখেছি।

–হুম মেয়েটাকে ঠিকই দেখেছ। আর আমি তাকে অনেক ভালোও বাসি। তবে প্রেমিকার সম্পর্কে নয় আমার বোনের সম্পর্কে। ও আমার বড়ো বোন ঈশিতা।

পঙ্খি অবাক হয়ে বললো।
–কিহ! বোন? আপনার আবার বোনও আছে? কিন্তু আমার জানামতে তো আপনার বাবা মায়ের শুধু একটাই সন্তান। কই আপনার বোনের কথা কখনো শুনিনি।

–এটারও কারণ আছে। আপা এক ছোট বংশের ছেলের সাথে প্রেম করেছিল। যা আমাদের উচ্চ বংশের বাবা চাচার কাছে ছিল অমাননীয়। আপু তাই ছেলেটার সাথে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে। সেদিন থেকেই আপুকে এই পরিবারের জন্য মৃত ঘোষণা করা হয়েছে। তার নাম নেয়াও নিষেধ। তবে আমি মানি না। চুরি করে আপুর সাথে যোগাযোগ রাখি। দেখাও করি।

ইন্ধনের কথা শুনে বিস্মিত হয়ে গেল পঙ্খি। এতবড় একটা কাহিনি সে জানেই না। ইন্ধন পঙ্খির দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো।
–আমাদের পরিবার এমনই পঙ্খি।চাচার কাছে বংশের মর্যাদাই সর্বোপরি।বংশের মান সম্মানের জন্য তিনি সব করতে পারেন। আর চাচার আদেশই বাবার কাছে শেষ বাক্য। এই নিয়ে আমার খুব রাগ হতো। এই বাড়িতে মা না থাকলে হয়তো আমি এখানে থাকতামই। কিন্তু মা তার সংসার ছেড়ে আমার সাথে যাবেনা। আর মায়ের জন্য আমিও যেতে পারিনা। এইজন্যই আমাকে এতকিছু করতে হলো। রাগ,ক্ষোভ এসব অনুভূতি ক্ষণিকের। তবে ভালোবাসা টা সীমাহীন। তাইতো যতই রাগ দেখাই আবার তোমার একটুখানি কষ্টও আমাকে আহত করে দিতো। দূর থেকে তোমাকে সাহায্য করার চেষ্টা করতাম।তবুও দিনশেষে সেই তোমাকে পাওয়ার জন্য, তোমার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে যায়। কিন্তু আমি জানতাম সরাসরি বললে এই কথা কেওই মানবে না। বরং আরও খারাপ পর্যায়ে যেত। আর তুমিও ওই বাধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে আমার কাছে আসতে পারতে না। তাই আমাকে এইসব পন্থা অবলম্বন করতে হলো। নাহলে যে আমি আমার রাজকন্যাকে ফিরে পেতাম না।

কান্নার মাঝেই হাসি ফুটে উঠলো পঙ্খির ঠোঁটে। আবারও ইন্ধনের বুকে জায়গা করে নিলো। ইন্ধনও মুচকি হেঁসে জড়িয়ে নিলো তার রাজকন্যাকে। আজ যেন পঙ্খির সর্বসুখের দিন। মনে হচ্ছে সকল দুঃখের অবসান ঘটেছে আজ।কালো আঁধার কাটিয়ে ঝলমলে আলোয় উজ্জলীত তার ভূবন। যাকে সে অসুর ভাবছিল। সেতো ওর জীবনের সুখ পায়রা হয়ে এসেছে। ওর রাজপুত্র এসেছে। এতো খুশি ও কোথায় রাখবে ও। হঠাৎ পাওয়া এই সুখে ম,রে গেলেও আপসোস নেই।

হঠাৎ কিছু একটা মনে আসতেই পঙ্খি মাথা তুলে বলে উঠলো।
–কিন্তু আরেকটা কথা।

–শুনবো সব কথাই। তবে এখানে না। অন্য কোথাও।

–কোথায়??

–চলো, গেলেই দেখতে পাবে।

কথাটা বলে ইন্ধন উঠে দাঁড়িয়ে পঙ্খিকে পাঁজা কোলে তুলে নিলো। লজ্জায় নতজানু হয়ে গেল পঙ্খি। লাজুক হেঁসে মুখ লুকালো ইন্ধনের বুকে। ইন্ধন পঙ্খিকে বাইরের দিকে গেল।

চলবে…..
(যাঁরা ভাবছে সব রহস্য তো খোলাসা হয়েই গেল। তাদের বলি,আসল রহস্য কখনো এটা ছিলই না। এটাতো ইন্ধন পঙ্খির প্রেম কাহিনি র কিছু অংশ ছিলো। আসল রহস্য তো সামনে আসবে।

*রিচেক করা হয় না। তাই ভুল ত্রুটি মার্জন করবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here