মৃগতৃষ্ণা-১৮,১৯

0
795

#মৃগতৃষ্ণা-১৮,১৯
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
১৮

★উন্মুক্ত গগনতলে নৌকার ওপর পঙ্খিকে নিয়ে শুয়ে আছে ইন্ধন।রাতের পূর্ণ শশীর চন্দ্রপ্রভা বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছে এই কপোত-কপোতীর উপর। দুটি ভালোবাসাময় মানবিকে দেখে তাঁরাও যেন আশীর্বাদ বর্ষিত করছে।তারাগুলোও ওদের আনন্দে নিত্যদিনের তুলনায় একটু বেশিই ঝলমল করছে। আনন্দে যেন গগনজুড়ে নাচতে চাইছে তাঁরা। নদীর শীতল পবনও সন্তর্পণে ছুঁয়ে দিচ্ছে ওদের। পানির কলকল ধ্বনি আর ঝিঁঝি পোকার ডাকে পরিবেশ আরও মুগ্ধময় হয়ে উঠছে।প্রকৃতির প্রত্যেক উপাদানই ওদের খুশিতে যেন খুশি হচ্ছে। তাঁরা তাদের ক্রিয়াকার্যে এই খুশি জাহির করছো। এক হাতে প্রিয়তমাকে জড়িয়ে নিয়ে গগনমুখি হয়ে শুয়ে আছে ইন্ধন। চন্দ্রবিলাসে মত্ত দুজন। যদিও ইন্ধনের চন্দ্র ওই দূর গগনের টা নয়। ওর চন্দ্র তো ওর পাশেই শায়িত। যে চন্দ্রকে হাজার জনম ভরে দেখলেও সাধ মিটবে না। আরও দুই জোড়া আঁখি থাকলেও হয়তো দেখে শেষ করতে পারবে না ও। এ যে আজন্মের তৃষ্ণা। যা মিটেও মিটবে না।

প্রিয়তমের বাহুতে শুয়ে থেকে চাঁদ দেখছে পঙ্খি।পঙ্খির মনে হচ্ছে ওই চাঁদ টারও বুঝিা আজ ওকে দেখে হিংসে। হিংসে হবেই না বা কেন? ওর কাছে কি এমন অমূল্য ধন আছে নাকি যা আমার কাছে আছে। পঙ্খি চাঁদের দিকে তাকিয়ে মনে মনে অহংকার করে বললো, কিরে হিংসে হচ্ছে তোর? জ্বলছে তাইনা? আমার রাজপুত্র কে দেখে হিংসেই পুড়ে যাচ্ছিস তাইনা? দেখিস জ্বলে পুড়ে কয়লা হয়ে যাসনা। নাহলে আবার লোকজনকে অন্ধকারে থাকতে হবে। আপসোস করিস না। তুইও একদিন তোর রাজপুত্রকে পেয়ে যাবি। কথাগুলো মনে মনে বলে আবার মনে মনেই হাসলো পঙ্খি। খুশিতে বোধহয় ও সত্যিই পাগল হয়ে গেছে।এতো খুশি আঁচলে ধরছে না ওর। সবকিছু কেমন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। এটা যদি সত্যিই কোন স্বপ্ন হয়ে থাকে তাহলে এই স্বপ্ন থেকে কখনো জাগতে চায়না পঙ্খি। এই স্বপ্নের মাঝেই নিজের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চায় সে।

পাশে ফিরে তাকাতেই ইন্ধনের নেশাগ্রস্ত চাহুনি দেখতে পেল পঙ্খি। লাজে রাঙা হয়ে গেল সে। এই প্রথম কোন পুরুষ তাঁর এতো কাছে এসেছে।এই পুরুষ টা যে ওর স্বামী। ওর প্রেমিক পুরুষ।নতুন অনুভূতির বিশাল ঢেউয়ের দোলা উপচে পড়ছে তাঁর মনে। যে অনুভূতিরা ওর নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যাচ্ছে।হৃদয়ে ভীষণ কম্পন জাগছে। চারদিক থেকে লজ্জারা ঘিরে ধরছে ওকে। এতো কেন লজ্জা লাগছে ওর। ইন্ধনের ওই চাহুনি যে জান কেঁড়ে নিচ্ছে ওর। তীরের মতো ওর হৃদয়ের আড়পার হয়ে যাচ্ছে। তাকাতে পারছেনা সে ইন্ধনের দিকে। পঙ্খি মাথা নুইয়ে লাজুক হেঁসে বললো।
–কি দেখছেন এভাবে?

ইন্ধন মুচকি হেঁসে নৌকার পাশে নদীতে হাত নামিয়ে একটা কস্তুরির ফুল ছিঁড়ে আনলো। তারপর সেটা পরম যত্নে পঙ্খির কানে গুঁজে দিলো। পঙ্খির পানে নেশাগ্রস্ত চোখে তাকিয়ে, গালে হাত বুলিয়ে মায়াবী কন্ঠে বলে উঠলো।

“”তোমার ওই মায়াবী চোখে কি ছিলো বলতে পারো
যতো দেখছিলাম মন চাইছিলো দেখতে থাকি আরও
তুমি রাজকন্যারুপী স্নিগ্ধতার শহর
বলো কোন উপমা দিয়ে বোঝাই তোমার রুপের বহর
তোমার হাসির ঝংকারে মনটা উড়াল দিলো
অকপটেই যেন হৃদয় তোমার চিত্র এঁকে নিলো
দীর্ঘকেশে এলোমেলোভাবে চলা এলোকেশী
প্রশান্তি ছড়িয়ে দেওয়া তুমি যে রুপসী
তবে একদিন পাল্টে যায় সবকিছু
ক্ষণিকের বিচ্ছেদে ছাড়তে হয় তোমার পিছু
তৃষ্ণার্ত চোখে খুঁজেছি তোমায়
এই বুঝি প্রাণবন্ত করবে আমায় তোমার ছোঁয়ায়
কিন্তু তুমি আসোনি, এসেছে শুধুই তোমার স্মৃতি
না পাওয়ার আকুল আর্তনাদে অন্তকরণে হয়েছে বিকৃতি
তবুও তোমার দেওয়া জিনিস গুলোর মাঝে তোমায় পেতাম
কল্পনায় হারিয়ে আবেশে তোমায় আগলে নিতাম
এখন যখন পেয়ে গেছি, আর দিবো না হারাতে
মুগ্ধ হয়ে পড়ে থাকব তোমার পাড়াতে”””

ইন্ধন পঙ্খির নাকের সাথে নাক লাগিয়ে নেশাময় কন্ঠে বললো।
–ভেবেছিলাম তুমি আমার জীবনে আসলে আমার সব অশান্তি দূর হয়ে যাবে। তোমাকে পেলে এই পাগল মন শান্ত হয়ে যাবে। কিন্তু এখানে তো উল্টো হচ্ছে। তুমিতো আমাকে আরও ছন্নছাড়া পাগল করে দিচ্ছো। অশান্ত মনটাকে এবার ঘরছাড়া পথিক করে দিচ্ছো তুমি। রোগীর পীড়া নিবারন করার বদলে তাকে তুমি আরও অসুস্থ করে দিচ্ছো।কেমন ডাক্তার তুমি? এ কেমন মহিমা তোমার? কি কালাযাদু জানো তুমি? বলোনা?

পঙ্খি কি বলবে।ইন্ধনের এতো কাছে আসায় তাঁর তো এখন নিঃশ্বাস ছাড়াও দুর্বোধ্য হয়ে যাচ্ছে। হৃদপিণ্ড বুঝি এবার পিঞ্জর ভেঙে বেড়িয়েই আসবে। মৃদু কম্পন এবার তীব্র কম্পনে পরিণত হচ্ছে। পরিস্থিতির মোড় ঘুরাতে পঙ্খি কোনরকমে কম্পিত স্বরে বললো।
–ব বলছিলাম যে আপনি তখন বললেন আমাকে নাকি দূর থেকে সাহায্য করেছেন। কিন্তু কিভাবে সাহায্য করেছেন?

ইন্ধন মাথা তুলে বললো।
–নিজেই ভেবে দেখ। দেখ বুঝতে পারো কিনা। তোমার জীবনে হঠাৎ কি কি পরিবর্তন ঘটলো।

পঙ্খি কিছুক্ষণ ভাবতে লাগলো। তারপর হঠাৎ চোখ বড়বড় করে বললো।
–তারমানে আপনিই আমার আলমারিতে আগুন লাগিয়েছিলেন?

–হুম লাগিয়েছিলাম। কারণ তোমার ওই বেরঙ পোশাক আমাকে তীব্র যন্ত্রণা দিতো। তোমাকে ওই পোশাকে দেখলেই মাথা গরম হয়ে যেত আমার। আর আমি জানতাম হাজার বললেও তাতে কোন পরিবর্তন আসতো না। আমার পরিবারের মুরুব্বিরা এখনো সেই সো কল্ড রীতি রেওয়াজ নিয়েই পড়ে আছে। তাদের কাছে ওটাই বড়ো। তাইতো আমার পন্থা অবলম্বন করেছি। পরশুদিন যখন শুনলাম চাচা আবারও তোমার জন্য ওই বেরঙ পোশাক কিনতে যাচ্ছে। তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি। তোমার জীবন থেকে আমি ওই বেরঙ পোশাক সারাজীবনের জন্য সরিয়ে দিবো। তখনই আমাদের বিয়ের পরিকল্পনা করি আমি।

–আপনি দেখছি ভারী চতুর। এক মিনিট! তারমানে আমাকে ডাক্তার দেখতে আসাটাও কোন কাকতালীয় ছিল না? আপনি ইচ্ছে করেই সেদিন অসুখ বাঁধিয়েছিলেন তাইনা?

–হ্যাঁ সেদিন দরজার বাইরে থেকে তোমাকে যন্ত্রণায় কাতরাতে দেখেছিলাম। তোমাকে ওই অবস্থায় দেখে আৎকে গিয়েছিলাম আমি। শুধু মনে হচ্ছিল যেভাবেই হোক তোমাকে ডাক্তার দেখানো দরকার। কিন্তু সরাসরি তোমার কথা বললে সবাই অন্য নজরে দেখতো বিষয় টা। তাই তখন ওটাই একমাত্র উপায় ছিলো। ছায়াকে চুপ করে সব বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। যদিও মোটা অংকের টাকা খেয়েছে কাজের জন্য।

পঙ্খির আঁখি যুগলে আবারও অশ্রুরা ভীড় করলো। কেউ তাকে আড়াল থেকে এতোটা ভালোবেসে যাচ্ছিল অথচ তার কোন ধারণাই ছিল না ওর। এতোটা ভাগ্যবতী কিভাবে হয়ে গেল ও। একটু সময় নিয়ে পঙ্খি আবারও বলে উঠলো।
–সেদিন খাবার নিয়ে রাগ দেখানোটাও আপনার নাটক ছিলো তাইনা? যাতে আমার রান্না করতে নাহয়?

–রাগটা পুরোপুরিও নাটক ছিলোনা। তোমার হাত কাটা দেখে আমার সত্যি সত্যিই ভীষণ রাগ হয়েছিল। হ্যাঁ তবে খাবার নিয়ে বলা কথাগুলো মিথ্যে ছিলো। তবুও তোমাকে এতগুলো কথা শুনিয়ে আমিও শান্তি পাইনি। শাস্তিও দিয়েছি নিজেকে। দুদিন না খেয়ে থেকেছি। তবুও মনে হচ্ছিল তোমার ওই অপমানের সামনে যেন এটা কিছুই না। তুমি চাইলে এখনো আমাকে যেকোনো শাস্তি দিতে পারো।

পঙ্খি মুচকি হেঁসে বললো।
–হুম দেবো তো শাস্তি। আপনার শাস্তি হলো সারাজীবন আমার হাতের ওই পঁচা খাবারই খেতে হবে।

–মঞ্জুর হে।

–আচ্ছা আপনি বললেন। বিয়েটা আপনার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু আপনি কি করে বুঝলেন যে তখন ঝড় আসবে। আর আমরা ওইখানে যাবো?

ইন্ধন পঙ্খিকে ধরে রাখা হাতের বাঁধন টা আরেকটু চেপে ধরে বললো।
–ভারতের অভিনেতা শাহরুখ খানের একটা ফেমাস ডায়লগ আছে। “কিসি চিজ কো আগার তুম পুরে দিল ছে চাহো, তো পুরি কায়নাত উছে তুম হে মিলানে কি সাজিশ মে লাগ যাতি হে”। যার অর্থঃ-কোন জিনিস যদি তুমি পুরো মন থেকে চাও,তো পুরো পৃথিবী সেটা সফল করার জন্য লেগে পড়ে। আমার ক্ষেত্রেও কিছুটা তেমনই হয়েছে। আমার প্ল্যান ছিলো বাচ কোনভাবে ওই জায়গাটায় পৌঁছানো। কিন্তু কিভাবে যাবো সেটা আমিও বুঝতে পারছিলাম না। তবে ভাগ্য আমাকে ঠিকই পথ দেখিয়ে দিলো। এতেই বোঝা যায়। কুদরতও আমাদের পক্ষে। ভাগ্য আমাদের কে এক করতে চায়। তাইতো এতকিছুর পর তোমাকে আমার করে দিয়েছে। রাজকন্যাকে রাজপুত্রের রাণী করে দিয়েছে।

মুচকি হাসলো পঙ্খি। ইন্ধন পঙ্খির কপালের সাথে কপাল হঠাৎ আবেগী কন্ঠে বললো।
–কিন্তু আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম পঙ্খি। তখন ওই ঝড়ের মাঝে আমার শুধু একটাই কথা মনে হচ্ছিল। তোমাকে আমি আবারও না হারিয়ে ফেলি। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি নিঃশেষ হয়ে যাবো পঙ্খি। একেবারে নিঃশেষ। প্রমিজ করো আমাকে। কখনো আমাকে ছেড়ে যাবে না। কখনো না।

মুষড়ে উঠলো পঙ্খির অন্তর। চোখের অশ্রু আবারও বাঁধ ভেঙে বেড়িয়ে এলো। ইন্ধনের গালে হাত রেখে কান্না মিশ্রিত গলায় বললো।
–কোথায় যাবো? এক আপনাতেই তো আমার অন্ত। আমার সব পথ আপনাতেই শুরু আর আপনাতেই গিয়ে শেষ হয়। আপনি ছাড়া কে আছে আমার।আমার ভূবণ তো শুধুই আপনি।

প্রাপ্তির হাসি ফুটলো ইন্ধনের ঠোঁটে। মুখ নামিয়ে চুমু এঁকে দিলো পঙ্খির ললাটে।প্রিয়তমের প্রথম ভালোবাসার স্পর্শ পেল পঙ্খি। আবেশে চোখ বুজলো সে। ইন্ধনের চাহিদা বাড়লো। নজর গেল তাঁর পঙ্খির অধরে। কাঁপতে থাকা পঙ্খির অধরে অধর মিলিয়ে নিলো ইন্ধন। কম্পন তীব্রতর হলো পঙ্খির। ইন্ধনের শার্ট আঁকড়ে ধরলো সে। চুম্বন ক্রিয়া শেষে পঙ্খিকে আবারও বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করে নিলো ইন্ধন। পঙ্খিও লজ্জায় মুখ লুকালো ইন্ধনের বুকে।

কিছুক্ষণ পর হঠাৎ কিছু একটা মনে আসতেই পঙ্খি মাথা তুলে ইন্ধনের দিকে তাকিয়ে বললো।
–আচ্ছা ভালো কথা। সেদিন আপনি ভাইকে মারছিলেন কেন? কি হয়েছিল?

ইন্ধন ফোৎ করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো।পঙ্খির চুলে বিলি কেটে বললো।
–এই বিষয়ে তোমার না জানাই ভালো পঙ্খি। তোমার মন ক্ষুন্ন হবে।

–এমন করে কেন বলছেন? কি এমন হয়েছে? বলুন না প্লিজ? না জানা পর্যন্ত আমার শান্তি হবে না।

–ঠিক আছে শোন তাহলে। আসলে তোমার ভাইয়াকে দেখে আমি চিনে ফেলি। আমি খুশি হয়ে তার কাছে তোমার কথা জিজ্ঞেস করি।তখন সে বলে তোমার নাকি বিয়ে হয়ে গেছে। তখনই আমার সর্বস্ব যেন মুহূর্তেই প্রাণহীন হয়ে যায়। আমি চলে আসতে নেই ওখান থেকে। আবার কি মনে করে তোমার ভাইয়ের কাছে আবার ফিরে যাই। তখনই দেখি সে কারোর সাথে ফোনে কথা বলছে।উল্টো দিকে ঘুরে থাকায় সে আমাকে দেখতে পায় নি। আর তখন তার কথা শুনে আমি জানতে পারি যে তোমার ভাইয়েরা তোমাকে দশ লাখ টাকার বিনিময় তোমাকে বিয়ে দিয়েছে।

স্তব্ধ হয়ে গেল পঙ্খি। নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছে না ওর।ওর ভাইয়েরা নাহয় একটু স্বার্থপর। তাই বলে এতো নিচে নামবে তারা! টাকার বিনিময়ে তাঁরা নিজের আপন বোনকে এভাবে বিক্রি করে দিবে। ভাবতেই যেন বুক কেঁপে উঠছে ওর। না না এটা হতে পারে না। এতো খারাপ ওর ভাইয়েরা হতে পারে না। পঙ্খির মনের অবস্থা বুঝতে পেরে ইন্ধন পঙ্খিকে বুকের মাঝে আগলে নিয়ে মায়া ভরা কন্ঠে বললো।
–দুঃখ করোনা পঙ্খি। যা হবার তা হয়ে গেছে। ওসব ভুলে যাও। এখম তুমি আমার কাছে আছো এটাই সবচেয়ে বড়ো কথা। আর আমি থাকতে তোমাকে এক বিন্দু দুঃখও ছুঁতে পারবেনা। আর কেউ সেই দুঃসাহস দেখালেও তাঁর পরিণাম চরম ভয়াবহ হবে। যেমনটা ওই মারুফের হয়েছে।

চমকে উঠলো পঙ্খি। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বললো।
–তারমানে আপনিই ওর হাত কেটেছেন??

ইন্ধন চোয়াল শক্ত করে বললো।
–ওকে তো জানে মারতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওর বউ বাচ্চার জন্য ওর জান ভিক্ষা দিয়েছি। শুধু হাত কেটেই শাস্তি দিয়েছি।

ইন্ধনের কথায় বাকরুদ্ধ হয়ে গেল পঙ্খি। ইন্ধনের এই উন্মাদনা দেখে ভালোও লাগছে আবার ভয়ও করছে।পঙ্খির প্রতি এই পাগলামি আবার কোন সর্বনাশ না ডেকে আনে।

কিছুক্ষণ পর পঙ্খি আবার বলে উঠলো।
–ওসব তো ঠিক আছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছিনা আপনার চাচা এতো টাকা দিয়ে কেন ছেলে বিয়ে করালেন। ওনারা চাইলে তো এমনিতেই বড়ো বড়ো ঘরের মেয়েদের উনার ছেলের সাথে খুশি খুশি বিয়ে দিতে চাইতো। তাহলে আমার মতো সামান্য গরীব ঘরের মেয়েকে এতো টাকা দিয়ে কেন বিয়ে করালেন।

–হুমম..সেটাতো আমিও ভাবছি। চাচাকে জিজ্ঞেস করলেও তিনি বলবেন না। তাই আমি উনাকে কিছু বলিনি। তবে এতটুকু বুঝতে কিছু একটা তো ঘটনা আছে। তবে আপাতত ওসব কথা বাদ দাও।ওসব নিয়ে অন্যদিন ভাববো। এখন শুধু এই সুন্দর মুহূর্ত টাকে এনজয় করো। আর তোমার স্বামীর ওপর ফোকাস করো। এতো হট গাই তোমার সাথে আছে। তাঁর ওপর নজর দাও।

পঙ্খি বোকার মতো বলে উঠলো।
–হট গাই?মানে গরম গাই? গাই আবার গরম হয় কিভাবে? গাইয়ের দুধ জাল দিলে তবে না গরম হয়।

পঙ্খির কথা শুনে ইন্ধন কতক্ষন হা করে তাকিয়ে রইলো। তারপর হু হা করে হেঁসে উঠলো। হেঁসে উঠে বললো।
–হট গাই মানে ওই গাই গরু না। হট গাই মানে হ্যান্ডসাম সুদর্শন ছেলে। জানো তুমি কতো লাকি? তোমার সামনে থাকা এই ছেলেটাকে পাওয়ার জন্য সব মেয়েরা হাহাকার করে।রাতে স্বপ্নে কতকিছু করে আমাকে নিয়ে ? তোমার জায়গায় অন্য কেউ হলে এতক্ষণে আমাকে শেষ করে দিতো।কতো কষ্টে যে নিজের ভার্জিনিটি অক্ষত রেখেছি তা শুধু আমওই জানি।

পঙ্খি ইন্ধনের বুকে আলতো করে কিল মেরে বললো।
–ছিহ..কথার কি ছিড়ি।

–ওই দেখ সত্যি কথার মূল্যই দেয়না কেউ।

পঙ্খি হেঁসে দিলো। সাথে হাসলো ইন্ধনও। বুকে মিলিয়ে নিলো পঙ্খিকে। পঙ্খি খুঁজে পেল প্রশান্তির ঠিকানা।

এভাবেই প্রকৃতির নিবিড় মায়ায় হারিয়ে দুজন রাতভর প্রেমালাপে মত্ত থাকে। একসময় নৌকার ওপরেই ঘুমিয়ে পড়ে তাঁরা। ভোরের আযান পড়তেই পঙ্খির ঘুম ভেঙে যায়। চোখ মেলে নিজেকে সে ইন্ধনের বুকে পায়। লজ্জা আর ভালোলাগার মিশ্রণে সুন্দর এক অনুভূতি ছড়ায় তাঁর মাঝে। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে চারপাশে। লোকজন চলে আসতে পারে তাই পঙ্খি আসতে করে ইন্ধন কে ডাক দিলো। ইন্ধনের কোন হেলদোল হলোনা। পঙ্খি এবার একটু হালকা ঠেলা দিয়ে ইন্ধন কে ডাকলো। চোখ মেললো ইন্ধন। ঘুমু ঘুমু কন্ঠে বললো।
–ঘুমাতে দাওনা।

–দেখুন মানুষজন চলে আসবে। উঠুন দয়া করে। বাড়ি যেতে হবে।

বিরক্তি ভাব নিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে বসলো ইন্ধন। পঙ্খির পানে তাকিয়ে বললো।
–ঠিক আছে। কিন্তু বাড়িতে গিয়ে কিন্তু আমি আবার ঘুমাবো। আর তোমাকেও আমার সাথে শুয়ে থাকতে হবে। বলো রাজি? তাহলে আর যাবো।

–এটা কেমন কথা? সবাই কি ভাববে?

–সেসব ভাবার সময় নেই আমার। আগে বলো রাজি?

–আচ্ছা ঠিক আছে আগে চলুন।

অতঃপর পঙ্খির হাত ধরে বাড়ির দিকে রওয়ানা হলো তাঁরা। দুজন প্রসন্ন আর সুখী মনে বাড়িতে আসলো। তবে বাড়ির দরজায় পা রাখতেই তাঁরা যা দেখলো তাঁর জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলনা ওরা। মুহূর্তেই যেন ওদের সব খুশি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। যখন বসার ঘরে পঙ্খির প্রথম স্বামী নাঈম কে দেখতে পেল।

চলবে……

#মৃগতৃষ্ণা-১৯
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★সুখের সময়কাল এতো ক্ষনিকের জন্য কেন হয়? কেন সুখ মায়া ধরিয়ে আবার হারিয়ে যায়? এইতো একটু আগেও জীবনের সবচেয়ে সুখী ব্যাক্তি মনে হচ্ছিল নিজেকে। কিন্তু ভাগ্য আবারও পঙ্খির সাথে এ কেমন পরিহাস করলো? যখনই মনে হচ্ছিল জীবনের এতো দুঃখ,কষ্ট, গ্লানি সব ঘুচিয়ে এবার বোধহয় সুখেরা ওর সাথী হয়েছে, তখনই আবার অতীতের কালো ছায়া এসে ওকে ঘিরে ধরলো।ইন্ধনের সাথে নতুন ভবিষ্যতের স্বপ্ন সাজাতে সাজাতেই হঠাৎ করে তার মৃত ভাবা স্বামী নাঈম মজুমদার কোথাথেকে চলে এলো? এ কেমন অপ্রীতকর পরিস্থিতি? এই পরিস্থিতিতে কেমন মনোভাব হওয়া উচিত তাও জানা নেই পঙ্খির।স্তব্ধ, অলংকারবাহুল হয়ে আছে সে। হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। সামনেই নাঈম মজুমদার সোফায় বসে আছে। জাহানারা ছেলেকে চোখের সামনে জীবিত সহিসালামত দেখে কেঁদে কেঁদে ছেলের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছেন। মৃত মনে করা ছেলেকে ফিরে পেয়ে তিনি খুশিতে কাঁদছেন। বাকিরাও হতবাক হয়ে দেখছে নাইম কে।

পঙ্খির এক হাত ইন্ধনের হাতের মুঠোয় ছিল। হঠাৎ সেই হাতে প্রচন্ড চাপ অনুভব করলো পঙ্খি। চমকে উঠে হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলো ইন্ধন ওর হাত সর্বশক্তি দিয়ে চেপে ধরেছে।যেন এই হাত ছাড়লে হারিয়ে যাবে পঙ্খি। ইন্ধনের হাতের রগগুলোও ফুলে চামড়ার উপর দিয়ে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। পঙ্খি ভীতু চোখে তাকালো ইন্ধনের মুখের দিকে। এতটুকু সময়ের ব্যবধানেই চোখ দুটো লাল আভায় ছেয়ে গেছে। ইন্ধনের মনের অবস্থা বুঝতে পারছে পঙ্খি। কিন্তু তাঁকে কি বলে শান্ত করবে তা পঙ্খির নিজেরও জানা নেই। আচমকা ইন্ধন পঙ্খির হাত ধরে টান দিয়ে ওকে নিয়ে আবার বাইরের দিকে চলে যেতে লাগলো। পঙ্খি চকিত কন্ঠে বললো।
–কোথায় যাচ্ছেন এখন?

ইন্ধন কেমন অস্বাভাবিক সুরে বললো।
–জানিনা। কিন্তু এখান থেকে দূর। বহুদূর। যেখানে কেউ খুঁজে পাবেনা আমাদের।

–কি বলছেন এসব? দেখুন একটু শান্ত হন। আমার কথা টা শুনু…

বাকি কথা শেষ করার আগেই পেছন থেকে ডাক পড়লো। জুবায়েদ ওদের কে ডাক দিয়ে বললো।
–কিরে তোরা এসে গেছিস? আরে দেখনা কে এসেছে? কি বিস্ময়কর ব্যাপার হয়েছে। আমাদের নাঈম যাকে আমরা মৃত ভাবছিলাম সে কিনা বেঁচে আছে। আজ ফিরে এসেছে আমাদের কাছে। দেখনা আয়।

কথাটা বলে জুবায়েদ একপ্রকার জোর দিয়েই ওদের বাড়ির ভেতর নিয়ে এলো। ইন্ধন চেয়েও আর বাইরে যেতে পারলোনা। জুবায়েদের সামনে মুখে জোরপূর্বক হাসির রেখা আনার চেষ্টা করে বাসার ভেতর ঢুকলো। জুবায়েদ মন মনে সয়তানি হাসছে।”এখন ইন্ধন বুঝবে নিজের জিনিসে অন্য কেউ ভাগ বসালে কেমন লাগে”। পঙ্খি ইন্ধনের হাতের মুঠো থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে।সবার সামনে এভাবে হাত ধরে থাকা বেমানান দেখায়। কিন্তু ইন্ধন কিছুতেই ওর হাত ছাড়ছে না। পঙ্খি চোখের ইশারায় মিনতি করলো ইন্ধনের কাছে। তবুও হাত ছাড়লো না ইন্ধন। যা কিছু হয়ে যাক। আজ যেন কিছুতেই হাত ছাড়বেনা সে। বসার ঘরে আসতেই সবাই এবার ওদের দিকে তাকালো। এই পরিস্থিতিতে কি বলা উচিত তা কেউই বুঝতে পারছেনা। তখনই জাহানারা পঙ্খির কাছে এসে বললো।
–দেখনা পঙ্খি আমার ছেলে আমার মানিক ফিরে এসেছে। আমার নাঈম বেঁচে আছে। এসো এসো তুমিও দেখ।
কথাটা বলে জাহানারা পঙ্খির অন্য হাতটা ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। এদিকে ইন্ধন আরেক হাত ধরে আছে। পঙ্খি করুন অসহায় দৃষ্টিতে ইন্ধনকে চোখের ইশারায় হাত ছাড়ার ইশারা করলো। এবারে ইন্ধনের হাত ঢিলা হয়ে এলো। ধীরে ধীরে ইন্ধনের হাতের মাঝ থেকে পঙ্খির হাত ছুটে গেল। দুজনের চোখেই হারানোর ভয় প্রতীয়মান হচ্ছে। জাহানারা পঙ্খিকে নিয়ে নাঈমের পাশে বসিয়ে দিয়ে বললো।
–দেখ সত্যি সত্যিই এটা আমার নাঈম। ও বেঁচে আছে।

নাঈম কেমন চুপচাপ বসে আছে। তেমন কারোর সাথে কোন কথা বলছে না।পঙ্খি যেন দুনিয়ার সবচেয়ে বৃহৎ অস্বস্তিতে পড়ে গেল। এরচেয়ে বড়ো অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতি বুঝি আর একটাও নেই। কি বলবে সে? কি বলা যায় এমত অবস্থায়? কোন কিছুই মাথায় আসছেনা ওর। আরচোখে শুধু ইন্ধনের দিকে তাকাচ্ছে। ইন্ধনের ওই কঠিন মুখমণ্ডল আর ভয়ংকর চোখের চাহুনি দেখে ভয়ে কলিজা কলিজা চিপে আসছে তাঁর। ইন্ধনের ওই চাহুনি যেন সব কিছু ভস্ম করে দিতে প্রস্তুত বসে আছে। তখনই খোদেজা তার মুখ খুললো। পঙ্খির উদ্দেশ্যে বললো।
–কি লো ছেড়ি এহন কি হরবি? দুই নাওয়ে পাও দিয়া কেবো হইরা চলবু? তোরই কপাল। মানুষ একটো পায়না। তুই তো দুই দুইডা পাইয়া গেলু।

ইন্ধন আর দাঁড়াতে পারলোনা ওখানে। ধুপধাপ পা ফেলে বাইরে চলে গেল।ইন্ধন যেতেই সামছুল মজুমদার তাঁর মায়ের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো।
–আহ মা, তুমি কি দিনদিন ছোট হচ্ছো? কোন পরিস্থিতিতে আছ সেটাতো একটু বোঝার চেষ্টা করো। ছেলেটা এতদিন বাদে বেঁচে ফিরল আমাদের মাঝে। কোথায় কিভাবে ছিল এতদিন সেটা না দেখে তুমি কিসব কথা নিয়ে পড়ে আছ।জাহানারা নাঈমকে ওর ঘরে নিয়ে যাও। ভালো করে গোসল করিয়ে ওকে কিছু খাইয়ে দাও। ওকে দেখে কেমন অসুস্থ মনে হচ্ছে।

জাহানারা মাথা নেড়ে নাঈমকে নিয়ে ওর ঘরে গেল। নাঈম চুপচাপ শুধু এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। মনে হচ্ছে কিছু খুঁজছে সে।
এদিকে পঙ্খির মাঝে আতঙ্ক ঘর করলো। নাজানি ইন্ধন রাগের বশে কি করে বসে। ওর রাজপুত্রকে পেতে না পেতেই আবার হারিয়ে না ফেলে ও। এ কেমন মাঝ দরিয়ায় পড়ে গেল ও?
__

সারাদিন আতঙ্কের মাঝেই কাটলো পঙ্খির। ইন্ধন সেই যে গেছে এখন রাত হয়ে গেছে তবুও ফেরেনি। চিন্তায় জান যাচ্ছে পঙ্খির। কতোবার ফোন করলো ফোনও ধরেনি সে। বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে ইন্ধন আশায়। তখনই জাহানারা পঙ্খির কাছে এসে বসলো। পঙ্খির হাত ধরে নরম সুরে বললো।
–দেখ আমি জানি তুমি খুব বড়ো একটা দোটানায় পড়ে গেছ।তবে ভয় পেয় না। তুমি বর্তমানে ইন্ধনের বউ। আর সেটাই থাকবে তুমি। কিন্তু তোমার কাছে শুধু একটা অনুরোধ করবো রাখবে তুমি?

–এভাবে কেন বলছেন? বলুন না কি বলবেন?

–আসলে নাঈমের কাছে শুনলাম ও নাকি এতদিন জ্ঞানহীন অবস্থায় কোন এক গ্রামের জেলেদের বাড়িতে ছিল।ওই জেলেরাই নাকি ওকে পানিতে পেয়েছিল। তারাই ওকে বাঁচিয়ে রেখেছে এতদিন। গত পরশু নাকি ওর জ্ঞান ফেরে। আর ওর বাড়ির কথা মনে হয়। আর ও ফিরে আসে। দেখ ওর জ্ঞান ফিরলেও মানুষিক আর শারীরিক ভাবে এখনও ও অনেক দূর্বল। তাই এখন যদি এই মুহুর্তে ওকে বলি যে ওর বউ মানে তোমার আরেকজনের সাথে বিয়ে হয়ে গেছে তাহলে এই খবর শুনে ওর শারীরিক অবস্থার আরও ক্ষতি হতে পারে। তাই তোমাকে বলছি শুধু কয়টাদিন তুমি ওর বউ হয়েই থাকবে ওর কাছে? একবার ও সুস্থ হয়ে গেলেই ওকে সব খুলে বলে দেবো। জানি এটা অন্যায় দাবি করছি আমি। কিন্তু এক স্বার্থপর মায়ের জন্য এখন তার সন্তানের ভালো হওয়াটা জরুরি। তাই আমি তোমাকে হাত জোর করে অনুরোধ করছি। দয়া করে তুমি কয়টা দিন আমার কথা মেনে নাও।

পঙ্খি হতবিহ্বল হয়ে গেল। এখন কি করবে ও? ওর একপাশে কুয়া তো আরেকপাশে আগুন। এখন কোনদিকে যাবে ও? ওর জীবনে ইন্ধন ছাড়া আর কোন পুরুষের জায়গা নেই। বিন্দুমাত্রও না। কিন্তু এক মায়ের আকুতি কিভাবে অবজ্ঞা করবে ও? এতোটা তো পাষাণ হতে পারে না ও। জাহানারা পঙ্খির সামনে হাত জোর করে অনুরোধ করতে নিলেই পঙ্খি জাহানারার হাত ধরে বললো।
–কি করছেন আম্মা?আপনারা গুরুজন। গুরুজনেরা ছোটদের সামনে কখনো হাত জোর করে না। ঠিক আছে আপনি বলবেন তাই হবে।

জাহানারা খুশি হয়ে বললো।
–বেঁচে থাক মা। তুমি আমার কথা রাখছ আল্লাহ তোমার ভালো করবে।

–কিন্তু আম্মা আমারও শর্ত আছে। আমি রাতে উনার কাছে থাকতে পারবোনা। আমি এখন ইন্ধনের বউ। তাই আমি এখন অন্য কারো ঘরে রাত্রিযাপন করতে পারিনা।

–ঠিক আছে। নাঈম ঘুমিয়ে পড়লে তুমি তোমার ঘরে চলে যেও। তাহলে আর সমস্যা হবে না। আর ইন্ধনের চিন্তা করোনা নাঈমের বাবা ওকে সব বুঝিয়ে বলবে।

–ঠিক আছে।

জাহানারার কথা রাখতে পঙ্খি রাজিতো হয়ে গেল। তবে মনে চলছে তার বিশাল ঝড়। ইন্ধন এমনিতেই রেগে আছে। আর এই কথা শুনলে তো নাজানি কি করবে।
__

পানির জগ হাতে রুমে ঢুকলো পঙ্খি। নাঈম উল্টো দিকে হয়ে শুয়ে আছে। পঙ্খির ইচ্ছে হচ্ছে এখুনি দৌড়ে চলে যেতে এখান থেকে।ইন্ধন ব্যাতিত অন্য কেউ এখন যে ওর কাছে শুধুই পরপুরুষ। কিন্তু জাহানারার ওই আকুল অনুরোধের সামনে সে বাঁধা পড়ে আছে। না চাইতেও হাজার অনিচ্ছা সত্ত্বেও আসতে হলো ওকে। কোনরকমে শুধু লোকটা ঘুমানো পর্যন্তই থাকবে এখানে। তারপরই ও ওর ইন্ধনের কাছে চলে যাবে। পঙ্খি অস্বস্তির পাহাড় নিয়ে ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে গেল। টেবিলের ওপর পানির জগ টা রাখলো। জগ রাখার শব্দে পঙ্খির দিকে তাকালো নাঈম। পঙ্খিকে দেখে কেমন যেন রেগে গেল সে। উঠে দাঁড়িয়ে রাগী কন্ঠে বললো।
–এই তুমি এখানে কি করছ? যাও এখান থেকে।

নাঈমের এমন প্রতিক্রিয়ায় পঙ্খি থতমত খেয়ে গেল। লোকটা কি তাকে চিনছে না? নাকি চিনেই এমন করছে? নাকি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? পঙ্খির ভাবনার মাঝেই নাঈম আবারও ধমকে উঠে বললো।
–কি ব্যাপার এখনো দাঁড়িয়ে আছ কেন? যাও এখান থেকে। তোমার চেহারা দেখলেও রাগ লাগে আমার।

পঙ্খির এবার আত্মসম্মানে লাগলো। এখানে তো ওকে বাধ্য হয়ে আসতে হয়েছে। নাহলে তো এই লোকের ধারে কাছেও আসতো না সে। অথচ এই লোক উল্টো ওকেই রাগ দেখাচ্ছে! জাহান্নামে যাক। পঙ্খি আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না ওখানে। দ্রুত গতিতে বেড়িয়ে এলো ও। যাক ভালোই হয়েছে। এখন আর ওই লোকটার সামনে থাকতে হবে না ওকে। এইটুকু সময়েই যেন ওর দম বন্ধ হয়ে আসছিল।জাহানারার কথা রাখার চেষ্টা করেছি আমি।কিন্তু ওই লোকই যখন চায়না সেখানে আমি আর কি করতে পারি? বাচ আর না। আমি আর কারোও কথা শুনবো না।এখন শুধু আমি আমার ইন্ধনের কাছে থাকবো। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে পঙ্খি নিজের রুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই আৎকে উঠলো। ইন্ধন বেডের পাশে মাথা নিচু করে বসে আছে। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে কি পরিমাণ রেগে অগ্নিমূর্তি হয়ে আছে সে। ভয়ে গলা শুঁকিয়ে আসছে পঙ্খির। আতঙ্কিত ভাবে মৃদু পায়ে ইন্ধনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে কিছু একটা বলতে নিলেই হঠাৎ ইন্ধন বলে উঠলো।
–কেন এসেছিস?

পঙ্খির কন্ঠনালী আঁটকে এলো। ইন্ধনের কথায় আড়ষ্ট হয়ে এলো তার হৃদয়। ইন্ধন লাল হয়ে ওঠা অগ্নি চোখের দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো পঙ্খির পানে। চোখ মুখের ভাব প্রচন্ড কঠিন হয়ে আছে তার। উঠে দাঁড়িয়ে পঙ্খির বাহু শক্ত করে চেপে ধরে চোয়াল শক্ত করে বললো।
–কেন এসেছিস বল? স্বামীর সোহাগ নেওয়া এতো তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে গেল তোর?

আরেক হাতে পঙ্খির চোয়াল চেপে ধরলো ইন্ধন। অতিরিক্ত ক্রোধে হিতাহিত জ্ঞান লোপ পাচ্ছে ইন্ধনের। সে ক্ষুব্ধ কন্ঠে বললো।
–বলনা? কেমন সোহাগ দিলো? কোথায় কোথায় সোহাগ করলো বলনা? এতো তাড়াতাড়ি কিভাবে শেষ হলো? স্বামীর সোহাগ ছেড়ে এখানে কেন এলি? আমার উপর দয়া দেখাতে এসেছিস? লাগবেনা তোর দয়া দীক্ষা। যা, তুই ওর কাছেই যা। আমার কাছে আসা লাগবেনা তোর। যা বেড়িয়ে যা এখান থেকে।

ইন্ধন পঙ্খির হাত ধরে ওকে দরজার দিকে নিয়ে যেতে লাগলো। পঙ্খি অশ্রুসিক্ত চোখে করুন সুরে বললো।
–এমন করবেন না।আমাকে ভুল বুঝছেন আপনি। দয়া করে আমার কথাটা একটু শুনুন।

ইন্ধন থামলো না। পঙ্খিকে টেনে নিয়ে দরজার বাইরে বের করে দিয়ে ঠাস করে দরজা আঁটকে দিলো। পঙ্খি দরজা চাপড়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো।
–এমন করেন না আমার সাথে। দরজাটা খুলুন। আমাকে একবার বলার সুযোগ টা দিন। এভাবে আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবেন না। আমি সইতে পারবো না। আমার জীবনে শুধু আপনি ছাড়া আর কারোর জায়গা নেই। আপনিই আমার সব। আমার প্রেমিক পুরুষ, আমার স্বামী সব একমাত্র আপনিই। আপনি ছাড়া আমার জীবনে না কেউ ছিলো আর না কেউ আসবে। দয়া করে একবার দরজা খুলুন।

কাঁদতে কাঁদতে দরজা ঘেঁষে নিচে বসে পড়লো পঙ্খি। একটু পর দরজা খুলে গেল। পঙ্খি পড়িমরি করে উঠে দ্রুত ভেতরে ঢুকলো। ভেতরে এসে দেখলো রুমের সব জিনিস ভেঙে তছনছ হয়ে আছে পড়ে আছে। ইন্ধন রুমে নেই। বারান্দায় এসে দেখলো গ্রিলের সামনে বাইরের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে ইন্ধন।ইন্ধনের হাতের দিকে নজর যেতেই আৎকে উঠলো পঙ্খি। ইন্ধনের হাত থেকে টপটপ করে র,ক্ত পড়ছে। পঙ্খি ছুটে গিয়ে ইন্ধনের হাত ধরে ভয়ার্ত কন্ঠে বললো।
–এ এসব কি করেছেন আপনি? হাত কেন কেটেছেন?
পঙ্খি দৌড়ে রুমের ভেতরে গিয়ে দ্রুত স্যাভলন আর পরিস্কার একটা সুতির কাপড় নিয়ে এলো।ইন্ধনের হাত ধরে স্যাভলন লাগাতে নিলে ইন্ধন হাত সরিয়ে নিতে লাগলো। কিন্তু পঙ্খি ছাড়লো না। জোর করে ধরেই স্যাভলন লাগিয়ে কাপড় বেঁধে দিতে দিতে বলে উঠলো।
–আজ একটা কথা বলতে চাই আপনাকে। জানি না বিশ্বাস করবেন কিনা,তবে নাঈম মজুমদারের সাথে আমার বিয়ে কখনো হয়ইনি।

ইন্ধন বিস্মিত চোখে পঙ্খির পানে চাইলো। পঙ্খি শান্ত সুরে বলতে লাগলো।
–হ্যাঁ এটাই সত্যি। আমার ধ্যানে জ্ঞানে সর্বদাই আপনার বসবাস। তাহলে অন্য কাউকে কিভাবে আমার জীবনে আসতে দিতাম।বিয়েটা ঠেকানো আমার হাতে ছিলোনা।তবে কবুল বলাটা তো আমার হাতেই ছিলো।তাই সেদিন যখন আমাকে কবুল বলতে বলা হয়েছিল আমি বলিনি। অনেকক্ষণ ধরে আমাকে সবাই কবুল বলার জন্য জোর দিচ্ছিল। আমি মূর্তির মতো শক্ত হয়ে বসে ছিলাম। কিছুতেই বলবো না এই পণ করে বসেছিলাম। তখনই আমার পেছন থেকে আমার জায়গায় কে যেন কবুল বলে দেয়।হয়তো আমার ভাবিই হবে। তাঁরা চালাকি করেই এমনটা করে। ঘোমটা দিয়ে মুখ ঢেকে থাকায় অন্যরা ভাবলো আমিই কবুল বলেছি। ব্যাস এভাবেই সবাই ভাবলো আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে। তাঁরা আমাকে বউ ভেবে নিয়ে আসলো। আমিতো ভেবেই নিয়েছিলাম অন্য লোক আমার কাছে আসার আগে হয় পালিয়ে যাবো নাহয় নিজেকেই কিছু করে বসবো। কিন্তু ভাগ্যের লিখন তো অন্য কিছুই ছিলো। যার সাথে কখনো বিয়েই হয়নি শেষমেশ কিনা তারই বিধবা হয়ে থাকতে হলো এবাড়িতে। এখন তো বুঝলেন আমার জীবনে আপনি ছাড়া আর কেউ নেই? কখনো ছিলো না। তারপরও আমার ওপর বিশ্বাস না হয় তাহলে ঠিক আছে আমি চলে যাব এখান থেকে। আপনাকে আর দেখাবো না আমার চেহারা।

কথাগুলো বলে পঙ্খি ভারাক্রান্ত মনে ওখান থেকে চলে যেতে লাগলো। কিন্তু যেতে সক্ষম হলো না সে। পেছন থেকে হাত টেনে ধরলো ইন্ধন। এক টানে নিজের বুকে টেনে নিলো তাঁর রাজকন্যাকে। সর্বশক্তি দিয়ে বুকের মাঝে মিশিয়ে নিলো তাঁকে। আবেগপ্রবন কন্ঠে বললো।
–ভয় হয় আমার পঙ্খি। তোমাকে হারানোর ভয়। তীব্র ভয়। যে ভয় আমাকে শান্তি দেইনা এক মুহূর্তের জন্যেও। সবাই কেন তোমাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চায়? কেন?

–শান্ত হন। আমাকে কেউ কেঁড়ে নিবে না। আমি আপনার ছিলাম আপনারই থাকবো।

ইন্ধন দুই হাতে পঙ্খির মুখটা আগলে ধরে কপালে চুমু দিয়ে নাকে নাক ঠেকিয়ে বললো।
–তোমাকে আরও নিবিড় ভাবে কাছে চাই পঙ্খি। যতোটা কাছে আসলে দুজন মিলে এক অস্তিত্ব হয়ে যায়। যাতোটা কাছে আসলে দ্বিতীয় কারও আমাদের মাঝে আসার কোন জায়গাই না থাকে। বলো পঙ্খি দেবে কি সেই অনুমতি আমাকে?

পঙ্খি লজ্জায় মিইয়ে গেল। চোখ বুজে মাথা নিচু করে লাজুক হাসলো সে। ইন্ধন তাঁর জবাব পেয়ে গেল। পঙ্খির সাথে অধর যুগল মিলিয়ে নিলো সে। পাঁজা কোলে তুলে নিয়ে ঘরের মাঝে এগুলো সে। ভালোবাসার পূর্ণতায় পরিপূর্ণ হলো দুজন।
__

গগনবিদারী চিৎকারে কেঁপে উঠল পুরো মজুমদার বাড়ি।ঘুম থেকে চমকে উঠে চোখ মেলে তাকালো পঙ্খি। ধড়ফড়িয়ে উঠতে নিলেই বাঁধা পেল। ইন্ধন যে ওকে পেঁচিয়ে ধরে বুকের ওপর মাথা রেখে পরম আরামে ঘুমিয়ে আছে। লজ্জায় আবারও লাল হয়ে গেল সে। কিন্তু তাঁর লজ্জার ভাব মুহূর্তেই কেটে গেল বাইরের চিৎকার চেচামেচি শুনে। এই ভোরবেলা এতো চিৎকার কোথাথেকে আসছে বুঝতে পারলো না সে। উপায় না পেয়ে ইন্ধন কে ডাকলো পঙ্খি। কয়েকবার ঠেলার পর চোখ কপাল কুঁচকে নড়েচড়ে উঠলো ইন্ধন। মাথা তুলে পঙ্খির দিকে তাকিয়ে ঘুম জড়ানো গলায় বললো।
–কি হয়েছে? ঘুমুতে দিচ্ছোনা কেন?

পঙ্খি লজ্জায় ইন্ধনের দিকে তাকাতে পারছেনা। এদিক ওদিক তাকিয়ে আমতাআমতা করে বললো।
–আসলে বাইরে কি যেন হয়েছে। চিৎকার শোনা যাচ্ছে।

পঙ্খির কথা শুনে ইন্ধন খেয়াল করলো আসলেই বাইরে থেকে চিৎকার চেচামেচি শোনা যাচ্ছে। ইন্ধনেরও এবার চিন্তা হলো। সে পঙ্খির দিকে তাকিয়ে বললো।
–আচ্ছা আমি গিয়ে দেখছি।তুমি কাপড় পড়ে আসো।

পঙ্খি মাথা নেড়ে সায় জানালো। ইন্ধন নিজের জামাকাপড় ঠিক করে বাইরে গেল। পঙ্খিও উঠে দ্রুত জামা কাপড় পড়ে বাইরে বেড়িয়ে এলো। কিন্তু বাইরে এসে যা দেখলো তা সে কল্পনাও করেনি। বাইরে বাড়ির বাগানে নাঈমের লা,শ পড়ে আছে। আর সবাই সেটা দেখেই চিৎকার আর আহাজারি করছে। পঙ্খি হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কি থেকে কি হয়ে গেল? আর কিভাবে এসব হলো? কে মারলো লোকটাকে এভাবে?

চলবে…..

(অনেকেই হয়তো বুঝতে পারেননি। আসলে এতদিন অতীত চলছিল। মানে নাঈম মজুমদারের দ্বিতীয় বার মরার আগের সব ঘটনা চলছিল। আজ থেকে অতীত শেষ হলো।কাল থেকে বর্তমান শুরু হবে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here