#মৃগতৃষ্ণা-২০,২১
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
২০
★বর্তমান,
থমথমে শোকাছন্ন হয়ে আছে মজুমদার বাড়ি। সবার মাঝে গুমোট ভারাক্রান্ত ভাব। নাঈমের বডি পুলিশ নিয়ে গেছে পোস্ট মরটাম রিপোর্টের জন্য। বাড়ির সব পুরুষ গুলো সেখানেই গেছে। পোস্ট মরটাম শেষে মাটি দেওয়ার কাজ শেষ করে ফিরবে তাঁরা । জাহানারা ছেলের শোকে পাথর হয়ে আছে। এক ছেলের মৃ,ত্যুর শোক তাঁকে দুই দুইবার পেতে হলো। মায়ের জন্য এরচেয়ে বড়ো শোক আর কি হতে পারে। সকাল থেকে সেই একই স্থানে বসে আছে। পঙ্খিরও তাঁর জন্য খুব খারাপ লাগছে। যত যাই হোক কোন মায়ের বুক খালি হোক এটা কারোরই কাম্য নয়। হঠাৎ কি থেকে কি হয়ে গেল? সব যেন ধ্রম্রজালে ঘেরা। পঙ্খির এখন কি করা উচিত তা বুঝতে পারছে না ও।দুনিয়ার কোন মেয়ের সাথে বুঝি ভাগ্যের এমন পরিহাস ঘটেনি। নাঈমের ফিরে আসায় একটু সংশয়ের মাঝে পড়লেও তাঁর মৃ,ত্যু কখনোই কামনা করেনি পঙ্খি। এতে ওই বেচারার তো আর কোন দোষ নেই। সবই ভাগ্যর খেলা। কিন্তু কিভাবে কি হলো? আর কেইবা তাঁকে এভাবে মারলো এই রহস্য যেন সবকিছু আরও ধোঁয়াশা করে দিচ্ছে।
ছায়া কখন থেকে জাহানারাকে ওঠানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু জাহানারা শক্ত পাথর হয়ে বসে আছে।একেতো ভাইকে হারালো, আবার মায়ের এই অবস্থা দেখে কাঁদছে ছায়া। এবার পঙ্খি ধীরে ধীরে জাহানারার কাছে এগিয়ে গেল। তাঁর কাঁধে হাত রেখে নরম সুরে বললো।
–ওঠেন আম্মা। আর কতক্ষণ এভাবে বসে থাকবেন? যে যাওয়ার সেতো চলে গেছে। এখন কি আর সে ফিরে আসবে? ভেবে নেন আপনার ছেলে কখনো ফিরেই আসেনি।তাঁর ফিরে আসা ওসব একটা স্বপ্ন ছিল।
তখনই খোদেজা পাশ থেকে খলবল করে বললো।
–হ হ তুই তো তাই কবি লো ছেড়ি। তোর মনের ইচ্ছা যে পূরণ হইছে। তুই তো এহন খুশিতে লাপ পাড়বি। তোর রাস্তার কাটা তো সইরা গেল তাইন্যা?
পঙ্খি ভ্রু কুঁচকে বললো।
–কি বলতে চান আপনি?
–কি কইবার চাই তুই জানোস না? তুইই মারছু না আমার নাতিরে? নতুন নাগোরের হাতে ঘর করার নাইগা পুরান জামাই রে মাইরা হালাইলি তাইনা? যাতে কুনু ভেজাল না থাহে। হত্যি হইরা ক তুইই মারছু না?
খোদেজার কথায় স্তম্ভিত হয়ে গেল পঙ্খি। শেষমেশ কিনা খুনের অপবাদ? নাহ এবার আর মুখ বুঁজে থাকবে না পঙ্খি।এতবড় মিথ্যে অপবাদ সে কিছুতেই মেনে নিবে না। তাই সে বলে উঠলো।
–এসব কি বলছেন দাদি? আমি কেন মারতে যাবো তাকে? তার সাথে আমার কিসের শত্রুতা আছে? জানি আমাকে আপনি পছন্দ করেন না। তাই বলে এতবড় একটা মিথ্যে অপবাদ আপনি দিতে পারেন না আমাকে।
–আমি মিছা কতা কইত্যাছি? রাইতে তুইই তো গেছিলি ওই ঘরে। জাহানারা তোক পাঠায়নাই ওই ঘরে? তালি তুই ছাড়া আর কেডো হইরবো এই কাম? আর তাছাড়া নাঈম আসায় তো তোর নতুন সংসারে ঝামেলা হইবো। হেইজন্যই তুই ওক মাইরা ফালালি। পথের কাটা হরাই দিলি।
–হ্যাঁ রাতে গিয়েছিলাম আমি। তাও আম্মা আমাকে অনুরোধ করেছিল তাই। কিন্তু আমি দুই মিনিটও ও ঘরে থাকিনি। নাঈম নিজেই আমাকে দেখে রেগে যায়। আর আমাকে বেড়িয়ে যেতে বলে। তাই আমিও আর দেরি না করে বেড়িয়ে আসি ওখান থেকে।
–হ তুই কলি আর আমরা মাইনা নিলাম। তালি তুই কোনে আছিলি হারারাইত।
–আমার কাছে ছিলো।
পেছন থেকে উক্ত কথাটি ভেসে আসতেই সবাই পেছনে তাকিয়ে দেখলো ইন্ধন। তার সাথে বাকিরাও আছে। ইন্ধনের চেহারায় প্রচন্ড রাগের আভাস স্পষ্টত হয়ে আছে। ইন্ধন পঙ্খির পাশে এসে দাঁড়াল। এক হাতে পঙ্খির কাঁধ জড়িয়ে ধরে, খোদেজার উদ্দেশ্যে শক্ত গলায় বলে উঠলো।
–সারারাত কোথায় ছিল মানে? এটা আবার কেমন প্রশ্ন দাদি? বয়সের সাথে তোমার স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাচ্ছে বোধহয়। তাই তোমার মেমোরি সাফ করার জন্য বলে দেই পঙ্খি আমার বউ। তো আমার বউ তো আমার সাথেই থাকবে তাইনা? পঙ্খিও তাঁর স্বামীর সাথেই ছিলো। আর হ্যাঁ একটা কথা ভালো করে মাথায় ফিট করে নাও। আগে যা খুশি তাই করেছ বা বলেছ পঙ্খিকে কেউ কিছু বলেনি তোমাকে। তবে এরপর থেকে পঙ্খির সাথে কোন ধরনের অযাচিত আচরণ আমি মোটেও মেনে নেবো না। পঙ্খি বড়োদের সম্মান করে বলে ও কিছু বলে না। চুপচাপ শুনে যায়। তবে আমি আমার বউয়ের সাথে কোন ধরনের অশোভন আচরণ সহ্য করবোনা। তাই ওকে কোন কটু কথা শোনানোর আগে কথাটা মনে রাখবে।
খোদেজা যেন আরও ক্ষেপে গেল। হায় হায় করতে করতে বললো।
–তুই কি আমাক ভয় দেহাইত্যাছু? এতবড় বেয়াদপ হচু তুই? দেখ জহির দেখ, তোর ব্যাটা আমাক কেবো হইরা হুমকি দেয় দেখ। এই দিনই দেহা বাদ আছিলো। সব এই ছেড়ির নাইগা হইছে। এই ছেড়িই অর মাথা খাইছে। এই ছেড়ির নাইগা আজ তুই তোর দাদিরে হুমকি দেস? কি হরবি তুই? আমি কি তোক ভয় পাই? মনে রাহিস তোর বাপ আমার পেট থাইকা হইছে। আর তার পোলা তুই।
ইন্ধন বাঁকা হেসে বললো।
–আর তুমিও ভুলোনা আমি সৈয়দ মজুমদার মানে তোমার জামাইর মতোই হইছি। একই র,ক্ত আমার শরীরে। তাই আমাক খোঁচাইতে আইসো না। সৈয়দ মজুমদারের কথা নতুন করে মনে করিয়ে দেবো কিন্তু বুড়ি।
–আমার তো এহন মনে হইতাছে তোর বউ না তুই নিজেই মারছু নাঈমরে। যাতে তোর বউয়ের ওপর দাবি না করতে পারে তাইনা?
–সত্যিই দাদি। কুটনীতি করা কারোর তোমার কাছ থেকে শেখা উচিত। যাইহোক কে কি করছে আর না করছে সেটা বের করার জন্য পুলিশ আছে। তোমাকে সিআইডি সাজতে হবে না। পুলিশ সব খুঁতিয়ে বের করবে। তোমার এতো চাপ নেওয়ার দরকার নেই। এই বয়সে এতো বেশি চাপ নিলে পটল খেতে যেতে হবে।
কথাটা বলে ইন্ধন পঙ্খির হাত ধরে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল। খোদেজা পেছন থেকে ফুঁসতে ফুঁসতে আরও কিছু বলতে লাগলো। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলোনা ইন্ধন। অন্যদিকে খোদেজার কথায় জুবায়েদের মনে সয়তানি বুদ্ধি উৎপাদন হলো।খোদেজার ইন্ধনের ওপর এই সন্দেহকে সবার মনে বীজের মতো বুনে দিলে মন্দ হয়না। এক ঢিলে দুই শিকার হয়ে যাবে।
রুমে এসে নিজের মোবাইল টা ঠাস করে বিছানার উপর ফেলে দিলো ইন্ধন। ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে ঘরিটাও খুলে ঠাস রেখে দিলো। পাঞ্জাবির বোতাম গুলো টেনে খুলতে লাগলো। পঙ্খি বুঝতে পারছে ইন্ধন প্রচুর রেগে। তাঁর চেহারা দেখেই তা বোঝা যাচ্ছে। এতো রাগ কেন লোকটার? রাগ যেন নাকের ডগায় ঝুলে থাকে।পঙ্খি ইন্ধনের সামনে গিয়ে নিজেই ওর পাঞ্জাবির বোতাম খুলে দিতে লাগলো। বোতাম খুলতে খুলতে বললো।
–নিজের রাগে বেচারা বোতাম গুলোকে কেন অত্যাচার করছেন? বেজান জিনিস গুলো কি দোষ করলো?
ইন্ধন পঙ্খির দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে পঙ্খিকে নিজের সাথে চেপে ধরে দাঁত চিবিয়ে বললো।
–ইয়া রাইট। বেজান জিনিস কে না। শাস্তি তো আমার তোমাকে দেওয়া উচিত। ইচ্ছে তো হচ্ছে উঠিয়ে একটা আছাড় মারি। কিন্তু তাতেও খুব একটা প্রতিফলন হবেনা তোমার ওপর।
–বারে আমি আবার কি করলাম?
–কিছু করোই তো না। এটাই তো তোমার সমস্যা। যার যা খুশি তোমাকে বলে যায় আর তুমি চুপচাপ শুনে যাও। কেন? তোমার সাথে কি মুখ নেই? কেন প্রতিত্তোর করোনা?
–শান্ত হন। দাদি আমাদের সবার বড়ো। আর গুরুজনের সাথে তর্ক কি ভালো দেখায়? আপনারও দাদির সাথে ওভাবে কথা বলা ঠিক হয়নি। উনি এখন শোকের মাঝে আছেন। তাই হয়তো ওসব কথা বলে ফেলেছেন।
–শোন তুমি সবাইকে নিজের মতো ভেবোনা। সবাই তোমার মতো এতো সরল মনের না। তোমার এই ভালোমানুষির প্রতিদান সকলেই দিতে জানে না। বরং তারা তোমাকে আরও চেপে ধরবে। মনে রেখো দুনিয়াটা শক্তের ভক্ত, নরমের যম। তুমি যতো ডেবে যাবে দুনিয়া তোমাকে আরও পেয়ে বসবে। তাই রুখে দাঁড়াতে শেখো। সবসময় সবকিছু নিজের মাঝে চেপে রেখোনা।
পঙ্খি মলিন সুরে বললো।
–কি করবো? ছোটবেলা থেকেই যে এটাই অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। নিজের দুঃখ কষ্ট বলার মতো কেউই যে ছিলোনা আমার। জন্ম হতেই মাকে হারালাম। তারপর এক দাদিই ছিলো। যে আমার সব ভালো মন্দের খেয়াল রাখতো। সেও হাত ছাড়িয়ে আমাকে রেখে চলে গেল। তারপর আর কেউ রইলো না আমার ভালো মন্দের খবর রাখার মতো। কেউ ছিলোনা যাকে আমার সুখ দুঃখের কথা বলতে পারি। তাইতো নিজের সব দুঃখ কষ্ট নিজের মাঝেই চেপে রাখা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেল।
কথাগুলো বলতে বলতে গলা ধরে এলো পঙ্খির। চোখের পানি লুকাতে মাথা নিচু করে ফেললো পঙ্খি। তবে ইন্ধনের চোখ ফাঁকি দিতে পারলোনা সে। ইন্ধন দুই হাতে পঙ্খির মুখটা উপরে তুলে ধরলো। বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো।
–তোমাকে না আমি বলেছিলাম যা কাঁদার কেঁদে নাও। এরপর থেকে কান্নার ডেডলাইন। কান্না ইজ নট এলাউড। আর হ্যাঁ,তোমার অতীতের জীবনের কথা ভুলে যাও। এখন আমি আছি। তোমার রাজপুত্র আছে। এখন থেকে তোমার প্রতিটা মূহুর্তের সাথী হবো আমি।
প্রাপ্তির হাসি ফুটলো পঙ্খির ঠোঁটে। পঙ্খি দুই হাতে ইন্ধনের গলা জড়িয়ে ধরে বললো।
–হুম জানিতো। জানেন,আমার দাদি আমাকে ছোটবেলায় রুপকথার গল্প শোনাতো। যেখানে এক দুঃখী রাজকন্যা থাকতো। তারপর এক সুদর্শন রাজপুত্র এসে তাঁর সব দুঃখ দূর করে দিতো। আমি তখন কল্পনার জগতে চলে যেতাম।নিজেকে ওই রাজকন্যা ভাবতাম। ভাবতাম আমার জন্যেও কোন রাজপুত্র আসবে। আর দেখুন, আজ সত্যি সত্যিই আমার রাজপুত্র এসে গেছে। তাই আমার আর কোন চিন্তা নেই। কারণ আমি জানি আমার রাজপুত্র আমাকে কোন দুঃখ কষ্ট পেতে দিবে না। সুরক্ষিত রাখবে আমাকে।
ইন্ধন মুচকি হেঁসে পঙ্খিকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললো।
–তাতো রাখতেই হবে। রুপকথার গল্পে যেমন দৈত্যের জান একটা তোতাপাখির মধ্যে ছিলো। তেমনি আমার জানও তোমার মাঝে আঁটকে আছে। আর নিজের জানের সুরক্ষা তো করতেই হবে। আমার জানের দিকে কেউ হাত বাড়ালে তাকে তো আমি ছেড়ে দিবো না। সে যেই হোক না কেন।
ইন্ধনের কথায় পঙ্খির মনে হঠাৎ এক সংশয় হানা দিলো। রাগের বশে ইন্ধনই নাঈম কে খু,ন করলো নাতো? কাল রাতেও তো প্রচন্ড পরিমাণে রেগে ছিলো। রাগে উনার হুঁশ ছিলো না। রাগের মাথায় আবার……??? না না, ছিঃ ছিঃ কি ভাবছি এসব আমি। ওর নাহয় একটু রাগ বেশি। তাই বলে কি ও খু,নী নাকি।আর নিজের ভাইকে ও কখনো মারবে না। আমার রাজপুত্র এমন কখনোই করবেনা। কখনো না।
__
পরদিন দুপুর বেলা,
বাড়ির সবাই বসার ঘরে বসে আছে। সবার মাঝেই আপাতত ভীতি কাজ করছে। সামনেই শাকিল দুই তিনজন পুলিশ নিয়ে বসে আছে। শাকিল আজ এখানে পুলিশের কাজে এসেছে। সে সবার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো।
–দেখুন নাঈমের মা,র্ডার কেসে আমাকে ইনভেস্টিগেটর হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে। তাই এখন এই কেস আমার হাতে। আর আজ এখানে সেটা নিয়েই কথা বলতে এসেছি। আর একজন পুলিশ হিসেবে আমার কাছে সবাই এক। মা,র্ডার যেহেতু বাড়িতেই হয়েছিল। তাই প্রথমে সন্দেহের ডাইরিতে বাড়ির প্রত্যেক সদস্যই আছে। তাই কেস সলভ করতে সবাইকেই জেরা করতে হবে আমার। আপনারা প্লিজ আমার সাথে সহযোগিতা করবেন।
সবাই মাথা ঝাকিয়ে সায় জানাল। শাকিল আবার বললো।
–তো পোস্ট মরটামে রিপোর্টে প্রাথমিক ভাবে যা এসেছে তা হলো, নাঈম কে চাকু দ্বারা খু,ন করা হয়েছে। আর খু,নের সময় রাত দুই টা থেকে তিনটার ভেতর।
শাকিলের কথায় সবায় হতবাক হয়ে গেল। জাহানারা মুখে আঁচল চেপে কেঁদে উঠলো। সামছুল মজুমদার বললেন।
–কে করেছে তাঁর কোন কিছু বুঝতে পেরেছ?
–না চাচা এখনো তেমন কোন ক্লু পাইনি। তবে ইনভেস্টিগেট করতে করতে অবশ্যই পেয়ে যাবো। আপনি চিন্তা করবেন না।
–আচ্ছা আপনারা কেউ কিছু দেখে থাকেন বা কোন কিছু সন্দেহজনক মনে হয়েছে তাহলে বলুন আমাকে।
সবাই না বললো। তবে পঙ্খি খেয়াল করলো চুমকি কেমন যেন ভয় পাচ্ছে। কপাল বেয়ে ঘাম ছুটছে ওর। পঙ্খির সন্দেহ হলো চুমকির ওপর। ও কি কিছু জানে? শাকিল আবারও বললো।
–ঠিক আছে, আমাদের ফরেনসিক অফিসারের কাছে আপনারা সবাই নিজেদের ফিঙ্গার প্রিন্ট দিন।
তখনই জুবায়েদ আমতাআমতা করে বললো।
–ফি ফিঙ্গার প্রিন্ট কেন?
–কেস ইনভেস্টিগেট করতে কাজে লাগবে। অনেকসময় খু,নির হাতের ছাপ মৃত ব্যাক্তির শরীরে বা তার জিনিসপত্রে লেগে থাকে। তাই ফিঙ্গার প্রিন্ট নিয়ে সেই ছাপের সাথে ম্যাচ করি।ম্যাচ হলে খু,নিকে ধরা তখন সহজ হয়ে যায়।
ফরেনসিক অফিসার সবার কাছ থেকে ফিঙ্গার প্রিন্ট নিয়ে নিলো। শাকিল এবার দুজন পুলিশ নিয়ে নাঈমের রুমে সব চেক করলো। সন্দেহজনক কিছু জিনিস সে তুলে নিলো। তারপর একে একে সবার বয়ান শুনলো। সবার বয়ান শোনা শেষে শাকিল বললো।
–হুম তাহলে আপনাদের কথামত আপাতত জা বুঝলাম তা হলো নাঈমের রুমে সব শেষ পঙ্খি ভাবিই গিয়েছিল তাইতো?
খোদেজা মাঝখান থেকে বলে উঠলো।
–হ হ এই ছেড়িই গেছিল। এই ছেড়িই মারছে ওরে। অক ধইরা নিয়া যা।
ইন্ধন চোয়াল শক্ত করে কিছু কিছু বলতে যাবে তখনই পঙ্খি ওর হাত চেপে ধরলো। চোখের ইশারায় চুপ থাকতে বললো। ইন্ধন হাতের মুঠো শক্ত করে রাগ দমিয়ে নিলো। শাকিল খোদেজার প্রতিত্তোরে বললো।
–এমন হয়না দাদি। বললেই কাওকে ধরে নেওয়া যায় না। আর অপরাধ প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত সন্দেহের তালিকায় সবাই আছে। এমনকি আপনিও দাদি।
এবারে খোদেজা একটু দমে গেল। এসব পুলিশ টুলিশের ঝামেলা সে একটু বেশিই ভয় পায়। শাকিল পঙ্খির উদ্দেশ্যে বললো।
–আচ্ছা ভাবি আপনি নাঈমের রুম থেকে ঠিক কয়টার দিকে বের হন?
পঙ্খি বললো।
–এইতো নয়টা সাড়ে নয়টার আশেপাশে হবে।
–ও আচ্ছা। আচ্ছা ঠিক আছে আজকের মতো তাহলে আমি যাচ্ছি। তবে কেসের খাতিরে আমাকে বারবার আসতে হবে এখানে।
শাকিল চলে গেল। এদিকে একেকজনের মাঝে চলছে একেকরকম মনোভাব। সবার চোখেই অদৃশ্য সন্দেহের সাফ। ভিন্ন চিত্তের চিন্তা চেতনা চলছে সবার মাঝে। জানা নেই সামনে কি হতে চলেছে।
চলবে……
#মৃগতৃষ্ণা—-২১
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★বাড়ির এই গুমোট ভাবটা আর ভালো লাগছে না পঙ্খির। সে রান্না ঘরের উদ্দেশ্যে গেল। দুদিন ধরে কেউ ঠিকমতো খাওয়া দাওয়াই করছে না। তাই কিছু রান্না বান্না করতে চাইলো সে।ইন্ধনও এখন বাসায় নেই। ওর ইলেকশনের কাজে বাইরে গেছে। তাই এটাই ভালো সুযোগ। রান্না ঘরে এসে দেখলো চুমকি বেসিনে থালাবাসন মাজছে। চুমকিকে দেখে তখনকার কথা মনে হলো পঙ্খির। তখনকার থেকেই কেমন যেন চুপচাপ আছে ও। অন্যসময় তো বকবক করতে থাকে। আজ কি হলো? ও কি কিছু জানে নাঈমের ব্যাপারে? প্রশ্নে টা মনে আসতেই চুমকির কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো।
–কি করছিস চুমকি?
–এইতো ভাবি থালবাটি মাইজত্যাছি। আপনের কুনু কাম আছিল?
–হ্যাঁ কাজ তো ছিলো। আচ্ছা বলতো, তুই কি কিছু জানিস নাঈমের খু,নের ব্যাপারে?
পঙ্খির কথা শুনে চুমকির হাত থেকে প্লেট পড়ে গেল। হড়বড়িয়ে গেল কেমন যেন। আমতাআমতা করে বললো।
–কি কি কইতাছেন ভাবি? আমি কেবো হইরা জানমু? কি যে কন্না ভাবি?
চুমকির কথায় আস্বস্ত হলোনা পঙ্খি।বরং তার সন্দেহ আরও বেড়ে গেল। সে চুমকির হাত ধরে নিজের রুমে নিয়ে এলো। রুমের দরজা আটকে দিয়ে চুমকিকে নিয়ে এসে বিছানায় বসালো পঙ্খি। তারপর বলে উঠলো।
–দেখ চুমকি কিছু জেনে থাকলে ভালোই ভালোই বলে দে। নাহলে কিন্তু পুলিশকে বলে দিলে জেলে ঢুকিয়ে দেবে। তারপর দেখিস কি হয়।
ভয়ে কাঁপতে লাগলে চুমকি। হাত জোর করে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো।
–না না ভাবি এবা কইরেন না। আপনের পায়ে পড়ি পুলিশরে কিছু কয়েন না। আমি জেলে যাইব্যার চাইনা।
–আচ্ছা বলবোনা। তবে তোরও বলতে হবে কি জানিস তুই।
–ঠিক আছে ভাবি কইত্যাছি। আসলে হেইদিন কলিম শহরে গেছিলো কুনু কামে। আর আমার হওড়িও(শাশুড়িও) তার ভাইয়ের বাড়ি গেছিলো। বাড়িতে একলা একলা আমার ভয় লাইগত্যাছিলো। হেইজন্যি আমি হেদিন রাইতে এই বাড়িতিই থাকছিলাম। আমার আবার মাঝে মইদ্যে রাইতে খিদা লাগে। হেদিনও খিদা লাগছিলো তাই আন্দুনঘরে (রান্নাঘরে) গেছিলাম কিছু খাইবার। তহনই দেহি নাঈম ভাইজান সিঁড়ি বাইয়া তিন তলার দিকে উঠাতাছিলো। আমি পয়লা ভাবলাম হয়তো হে ছাঁদে যাইতাছে। আমার এল্লা চিন্তা ওইলো। তাই আমি তাঁর পিছে গেলাম। আর যাইতেই দেখলাম নাঈম ভাই তিনতলার ওই বন্ধ থাহা ভুত আলা ঘরে ঢুকলো। ওইতা দেহেই আমার ভয়ে হাত আত্মা উড়ে গেল। আমি তহনই দৌড় দিয়া ঘরে চইলা গেছি। তারপর আর কিছু জানি না আমি। বেয়না(সকালে) যহন নাঈমের ভাইয়ের মরা লা,শ দেইখলাম তহন ভয় পাইয়া গেছিলাম আমি। তাই ভয়ে কাওরে কিছু কইনাই আমি।
–কিন্তু শাকিল ভাই যখন জিজ্ঞেস করলো কেউ কিছু জানেন নাকি তখন বললি না কেন এই কথা?
–ভয় পাইয়া গেছিলাম ভাবি। পড়ে যদি আমারেই খু,নি ভাইবা ধইরা নিয়া যায়। ভাবি কসম লাগে আমি যে এইডা দেখছি এই কথা আপনি কাওরে কইবেন না। আপনের পায়ে পড়ি ভাবি। আমরা গরীব মানুষ। কাম কইরা খাই। এইসব কেস কাহিনির মধ্যে পইড়বার চাইনা।
চুমকি কাঁদতে কাঁদতে পঙ্খির পা জড়িয়ে ধরলো। পঙ্খি চুমকির হাত ধরে বললো।
–আরে আরে কি করছিস এসব? আচ্ছা ঠিক আছে আমি বলবো না কাউকে কিছু। তুই কান্না বন্ধ কর। যা গিয়ে তোর কাজ কর।
চুমকি মাথা ঝাকিয়ে চলে যেতে নিয়ে আবার ফিরে এসে পঙ্খিকে বললো।
–ভাবি একখান কথা কমু?
–হ্যাঁ বল।
–ভাবি আমার মনে হয় ওই বন্ধ ঘরের ভুতই নাঈম ভাইজানরে মারছে।
কথাটা বলেই চুমকি চলে গেল। চুমকির কথা হাস্যকর শোনালেও কিছু একটা তো রহস্য আছেই।ছোটবেলায় ওসব ভুতের কথায় বিশ্বাস করে ভয় পেলেও, পড়াশোনার বদৌলতে এতটুকু জ্ঞান তো হয়েছে যে, ভুত টুত বলতে কিছুই নেই দুনিয়ায়। তাহলে কি আছে ওই বন্ধ ঘরে? আর নাঈমই বা এতরাতে ওখানে কেন গিয়েছিল? ওই ঘরে কি কেউ আছে? সেই কি মেরেছে নাঈম কে? এতো প্রশ্নের ধূম্রজাল। কিন্তু উত্তর কোথায় পাবো। নাঈমের হ,ত্যার রহস্য তো উদঘাটন করতেই হবে। আমার উপর যে মিথ্যে আরোপ লাগিয়েছে দাদি। সেটা যে ভুল প্রমান করতে হবে। নাহলে আজ দাদি বলেছে। কাল হয়তো অন্য কেউ বলবে। একমাত্র আসল খু,নিকে খুঁজে বের করে আনলেই আমার ওপর আঙুল ওঠা বন্ধ হবে। আর সন্দেহকারীর মুখও বন্ধ হবে।
__
খাবার টেবিলে খাবার বাড়ছে পঙ্খি। তবে এখনো খেতে আসেনি কেউ। বাড়ির এমন এ অবস্থা কিভাবে ঠিক হবে সেটায় ভাবছে সে। একটু পরে রাবেয়া এলো ওখানে। পঙ্খির দিকে তাকিয়ে বললো।
–কি ব্যাপার কেউ খেতে আসেনি?
পঙ্খি মলিন সুরে বললো।
–না মা কেউতো এলোনা। এভাবে কতোদিন চলবে? আম্মা তো আজ দুদিন হলো কিচ্ছু মুখে দেয়নি। কিছু না খেলে উনাকেই তো বাঁচানো যাবে না।
রাবেয়া দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন।
–হুম সেটাতো জানি। কিন্তু কি করবো? চেষ্টা তো কম করলাম না। মায়ের শোক যে বড়ো শোক। এত সহজে কমার নয়। এই ব্যাথা আমিও জানি।
পঙ্খি বুঝতে পারলো রাবেয়া নিশ্চয় তাঁর মেয়ে ঈশিতার কথা স্মরণ করছে। উনার মাঝে এতবড় কষ্ট কিভাবে চেপে থাকেন উনি? সন্তান বেঁচে থেকেও তাঁর জন্য মৃ,ত হয়ে গেছে। কিভাবে সহ্য করেন উনি? কি সুন্দর সবার সামনে হাসিমুখে থাকেন।
–আচ্ছা ইন্ধন কোথায়?
রাবেয়ার কথায় ধ্যান এলো পঙ্খির। সে বললো।
–না ফেরেননি। বলেছিলো তো নয়টার আগেই চলে আসবে।
–ও তাহলে হয়তো আসছে। আচ্ছা আমি ভাবির খাবার নিয়ে যাচ্ছি। দেখি বলে কয়ে কিছু খাওয়ান যায় নাকি। তুমি বাকিদের ডেকে খেতে দাও।
–ঠিক আছে মা।
পঙ্খি সবাইকে ডাকলো খাওয়ার জন্য। এক এক করে আসলো সবাই খেতে। ততক্ষণে ইন্ধনও এসে পড়েছে। পঙ্খি ইন্ধনকে ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে আসতে বললো। ইন্ধনও সায় জানিয়ে রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে এলো। খাবার টেবিলে খেতে খেতে জুবায়েদ ইন্ধনের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো।
–কোথায় ছিলি ইন্ধন? মিটিং তো অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল।
ইন্ধন বললো।
–হ্যাঁ বাজারে শাকিলের সাথে দেখা হয়ে গিয়েছিল। তাই ওর সাথে কেসের কোন আপডেট আছে নাকি তাই নিয়ে কথা বলছিলাম। তাই দেরি হয়ে গেছে।
জুবায়েদ খোঁচা মেরে বললো।
–কি ব্যাপার কেস নিয়ে মনে হয় একটু বেশিই টেনশন করছিস? কোন কিছু নিয়ে ভয় পাচ্ছিস নাকি?
জুবায়েদের কথায় ইন্ধন ভ্রু কুঁচকে তাকালো ওর দিকে। বাকিরাও খাওয়া বন্ধ করে ওর দিকে তাকালো। জুবায়েদ তখন হেঁসে উঠে বললো।
–আরে ভাই মজা করছিলাম। এতো সিরিয়াস হচ্ছিস কেন?
ইন্ধন কিছু বলতে গিয়েও আর বললো না। তবে জুবায়েদের এমন কথা পঙ্খির পছন্দ হলো না। এটা আবার কেমন ধরনের ইয়ার্কি?
জুবায়েদ মনে মনে সয়তানি হাসলো। সে যা করতে চেয়েছিল তা কাজে লাগছে। সবার মনে কিছুটা হলেও ইন্ধনের প্রতি সন্দেহ ঢুকেছে।
খাবার শেষে রুমে এসেই পঙ্খির কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লো ইন্ধন। পঙ্খিকে বললো
–মাথাটা মাসাজ করে দাওনা একটু। অনেক মাথাব্যথা করছে।
পঙ্খি মুচকি হেসে ইন্ধনের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো।
–মাথায় মেয়ে মানুষের মতো এতো লম্বা লম্বা চুলের বাহার রাখলে তো মাথাব্যাথা করবেই। চুল কেটে ছোট কেন করেন না?
–খবরদার আমার চুল কাঁটার কথা মুখেও আনবেনা। আরে এমন চুলের জন্য মানুষ কতো তপস্যা করে। আর তুমি বলছ কেটে ফেলতে? ইটস কল্ড স্টাইল।
পঙ্খি বিড়বিড় করে বললো।
–স্টাইল না ঘোড়ারডিম। আমাদের পাড়ার মফিজ পাগলেরও এরচেয়ে বড়ো বড়ো চুল আছে। তাহলে কি তারটাও স্টাইল?
–কি বললে?
–কিছু না।
কিছুক্ষণ পর ইন্ধন চোখ বুজে থেকেই বললো।
–বাহ্ তোমার হাতে তো যাদু আছে। মাথা ব্যাথা একেবারে গায়েব হয়ে গেছে।
পঙ্খি মনে মনে ভাবলো এটাই সঠিক সময়। ও যে কথাটা বলতে চায় এখুনি বললে ভালো হবে। ভাবনা মোতাবেক পঙ্খি বলে উঠলো।
–আচ্ছা কথা জিজ্ঞেস করবো আপনাকে?
–দুটো জিজ্ঞেস করো।
–বলছিলাম যে, আপনি কি তিনতলার ওই বন্ধ রুম সম্পর্কে কিছু জানেন?
ইন্ধন এবার ঠাস করে নেত্রপল্লব মেলে তাকালো। এক ঝটকায় উঠে বসে বললো।
–হঠাৎ এই কথা কোথাথেকে আসলো?
–হঠাৎ না। অনেক আগে থেকেই ওই রুমের কথা আমার মাথায় ঘুরছিলো। কিন্তু ভয় আর দ্বিধায় কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারিনি। বলুন না আপনি কি কিছু জানেন? কি আছে ওই ঘরে?
–দেখ ওই ঘরে কি আছে না আছে সেটা নিয়ে তোমার মাথা ঘামানোর দরকার নেই। এসব খুঁটতে যেওনা তুমি। ওসব থেকে যেতো দূরে থাকো ততই ভালো।
–তারমানে আপনি জানেন ওখানে কি আছে? প্লিজ বলুন না আমাকে। দেখুন যে যতোই বলুক ওখানে ভুত আছে। তবে আমার তা মনে হয় না। আমার মনে হয় ওই ঘরে কেউ আছে। কারণ আমি কয়েক বার কারোর কান্নার আওয়াজ শুনেছি। আসল কথা না জানা পর্যন্ত আমার শান্তি হবে না। দয়া করে বলুন আমাকে কি জানেন আপনি?
ইন্ধন ফোঁৎ করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো।
–হ্যাঁ জানি। আমি যেদিন বিদেশ থেকে এসেছিলাম সেইদিনই আমার ওই বন্ধ রুম দেখে সন্দেহ হয়েছিল।কারণ আমি বিদেশ যাওয়ার আগে ওই রুম সাধারণ রুমের মতোই ছিলো। আর ওই রুম থেকে আওয়াজ আমিও শুনতে পেয়েছিলাম।আমি মাকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে বললো,”সে কিছু জানেনা। ওই ঘর নাকি চাচা বন্ধ করিয়েছে।বলেছিল ওই রুমে নাকি অশুভ ছায়া আছে। যা উনি তন্ত্রমন্ত্র দ্বারা ওই ঘরে আটকে রেখেছে। আর সবাইকে ওই দিকে যেতে মানা করেছে। সেইজন্য কেউ আর ওইদিকে যায়না।” তখন আমার আরও সন্দেহ বাড়লো।কারণ এইসব ভুতটুত সব মিথ্যে কথা। আমি বুঝতে পারলাম এই বিষয়ে শুধু চাচার কাছ থেকেই জানা যাবে। তাই আমি চাচাকে জিজ্ঞেস করলাম ওই ঘরে কি বা কে আছে। চাচা শুধু আমাকে জানালো, “ওই ঘরে যা আছে তা আটকা থাকলেই এই বংশের মর্যাদা অটুট থাকবে। নাহলে বংশের মর্যাদা ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। তাই ওই ঘর বন্ধ থাকাই সবার জন্য ভালো। আর কেউ ওই ঘর খোলার চেষ্টা করবেনা। আর না এই বিষয়ে জানার চেষ্টা করবে”। বাচ এতটুকুই বলেছিল। আমিও তাই আর এই বিষয়ে ঘাটিনি। চাইলে আমি ওই ঘর খুলে সব দেখতে পারতাম। তবে এতে চাচার অসম্মান হবে। আর সবচেয়ে বড়ো কথা তখন বাবা মায়ের সাথে এই নিয়ে অনেক রাগারাগি করবে। যা আমি সহ্য করতে পারবোনা। বাড়িতে তখন বিশাল বড়ো আকারে ক্লেশ শুরু হয়ে যাবে। এসবের মাঝে মা সবচেয়ে বেশি সাফার করবে। তাই আমি আর ওই বিষয়ে ঘাটিনি।
সব শুনে পঙ্খি আরও ভাবনায় পড়ে গেল। এখন তো ওর ধূম্রজাল আরও বেড়ে গেল। কি এমন আসে ওই ঘরে? যার জন্য বংশের মর্যাদা ধূলিসাৎ হয়ে যাবে? ইন্ধন পঙ্খির দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো।
–দেখ পঙ্খি তুমি প্লিজ এসবের মাঝে পড়োনা। এই বাড়িটা একটা রহস্যপুরী। এসব ঘাটতে গেলে তুমি নিজেই এর গহ্বরে তলিয়ে যাবে। আর তোমাকে আমি কিছুতেই হারাতে পারবোনা। আমাকেও এরা কোন এক কারণে জোর করে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছিল। যে কারণ আজপর্যন্ত আমি জানতে পারিনি। এখন আমি চেষ্টা করাও ছেড়ে দিয়েছি। অনেক কিছু সন্দেহজনক হলেও তা আনদেখা করে দেই। সত্যি বলতে আমার এবাড়িতে থাকার মোটেও ইচ্ছে হয়না। তবে শুধু মায়ের জন্য যেতে পারিনা। মা শুধু আমার জন্যই বেঁচে আছে। এক সন্তানকে তো হারিয়েছে। এখন আমিও যদি উনার কাছে না থাকি তাহলে মা বাঁচবে কিভাবে? আর মা তাঁর সংসার ছেড়ে আমার সাথে চলে যেতেও কখনো রাজি হবে না। তাই মাকে ছেড়ে আমিও যেতে পারি না। মা আর তুমিই তো আমার সব।
পঙ্খি আবেগপ্রবণ হয়ে ইন্ধন কে জড়িয়ে ধরে বললো।
–আপনার সন্তান পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। আর আপনার মতো স্বামী পাওয়া তো আমার জন্য সাত জনমের তপস্যার ফলের চেয়েও বেশি কিছু পাওয়া।
ইন্ধন মুচকি হেঁসে বললো।
–হ্যাঁ সেটাতো অবশ্যই। আমার মতো হাসব্যান্ড তো গুগলে সার্চ দিলেও পাওয়া যাবে না।
হেঁসে দিল পঙ্খি। তবে মনে মনে চিন্তাও হচ্ছে তাঁর। ইন্ধন তো ওকে মানা করলো এসব ঘাটতে। কিন্তু ও যে খু,নিকে খোঁজার পণ করেছে সেটাতো আর বলতে পারছেনা ইন্ধন কে। তাই এখন থেকে যা করার নিজেই করতে হবে।
–আচ্ছা তোমার এই মহান স্বামীকে কি এক কাপ কফি খাওয়ানো যাবে রাণী সাহেবা?
পঙ্খি মুচকি হেঁসে বললো।
–জ্বি মহারাজ এখুনি আনছি।
পঙ্খি হাসিমুখে উঠে বাইরে গেল কফি বানাতে। করিডরে আসতেই কারোর কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো। আওয়াজ নাঈমের ঘর থেকে আসছে। পঙ্খি বুঝতে পারলো এটা নিশ্চয় জাহানারার কান্নার আওয়াজ। পঙ্খি চিন্তিত হয়ে সেদিকে এগিয়ে গেল। নাঈমের ঘরের দরজায় এসে দেখলো জাহানারা নাঈমের বিছানা হাতড়াচ্ছে আর কাঁদছে । জাহানারাকে এভাবে দেখে পঙ্খির মনটাও কেমন কেঁদে উঠলো। সে এগিয়ে গেল তাঁর কাছে। মাথায় হাত বুলিয়ে শান্তনা দিয়ে বললো।
–বাচ করেন আম্মা আর কতো কাঁদবেন? এতে যে আপনার ছেলের আত্মা আরও কষ্ট পাবে। আপনি কি চান সে কষ্ট পাক? কবরে আজাব পাক?
জাহানারা এবার পঙ্খিকে জাপ্টে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললো।
–দুনিয়াতেই তো এতো আজাব পাইলো আমার ছেলেটা। ও কেন ফিরে এলো? ও ফিরে না আসলেই তো ভালো থাকতো। এখানে এসেই মরতে হলো ওকে। আমার ছওয়াল ডা কতো কষ্ট পাইয়া মরলো।
জাহানারার আহাজারি শুনে পঙ্খির চোখেও পানি চলে এলো। সে জাহানারার মাথায় হাত বুলিয়ে তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। অনেকসময় পর একটু শান্ত হলেন তিনি। তখনই ছায়া ওখানে এলো। পঙ্খি ছায়াকে বললো জাহানারাকে তাঁর রুমে নিয়ে যেতে। ছায়া মাথা ঝাকিয়ে জাহানারাকে ধরে নিয়ে গেল বাইরে। পঙ্খিও দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠতে নিলেই কিছু একটা তাঁর চোখে পড়লো। জিনিস টা দরজার পর্দার সাথে আঁটকে আছে। পঙ্খি ভ্রু কুঁচকে সেদিকে এগিয়ে গিয়ে জিনিস টা ছাড়িয়ে হাতে নিলো। কিছুক্ষণ অবলোকন করতেই সে জিনিস টা চিনে গেল। আর চিনতে পেরেই চমকে উঠলো সে। এটা এখানে কি করে এলো? তবে কি উনিই এসব করেছে? ভাবনাগুলো মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো পঙ্খির।
রাত ১২ টা। শুনশান নীরব সারাবাড়ি। কালো আধারের মাঝে, কালো চাদরে মুড়ে কেউ একজন মৃদু পায়ে চোরের মতো হেঁটে আসছে। চাদরের নিচ দিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছে কেউ আছে না। পা টিপে টিপে সেই ব্যাক্তি নাঈমের ঘরের দিকে এলো। মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে মেঝেতে কিছু একটা হন্যে হয়ে খুঁজছে সে। তখনই পেছন থেকে আওয়াজ এলো।
–এটা খুঁজছেন ভাবি?
আওয়াজ শুনে পিলে চমকে উঠলো কনিকার। সে ভয়ার্ত চোখে ফিছে ফিরে তাকালো। পেছনে পঙ্খি দাঁড়িয়ে ছিলো। তাঁর হাতে থাকা কানের টপ দেখিয়ে বললো।
–এটাই খুঁজছিলেন না ভাবি?
ভয়ে জমে গেছে কনিকা। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো।
–তু তুতুমি এখানে??
–হ্যাঁ আমি। কারণ আমি জানতাম আপনি আপনার এই দুল খুঁজতে অবশ্যই আসবেন। তাই আমি আপনার অপেক্ষা করছিলাম। তো বলুন এটা এখানে কি করে এলো? তাহলে কি আপনিই মেরেছেন নাঈম কে?
চলবে….