মৃগতৃষ্ণা-২৫,২৬

0
734

#মৃগতৃষ্ণা-২৫,২৬
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
২৫

★তুশি মারা যাওয়ার আজ দুই সপ্তাহ পার হয়ে গেল। পুলিশ এখনো কোন সাসপেক্ট খুঁজে বার করতে পারেনি। তুশির মা বাবা তো প্রথম প্রথম ইন্ধন আর ওর পরিবারকেই দোষারোপ করছিল। কিন্তু কোন প্রমাণাদি না পাওয়ায় পুলিশ আর তাদের কথায় আমল করেনি। শুধু সবার কাছে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। তাতেও কোন সন্দেহজনক কিছু পাইনি। যারকারণে আর কোন পদক্ষেপ নেয়নি তাঁরা। ওদিকে নাঈমের মা,র্ডার কেসেও এখনো অপরাধীকে খুঁজে বার করতে পারেনি পুলিশ। ওই কেসের কোন ফয়সালা হওয়ার আগেই আবার তুশির মা,র্ডার হয়ে গেল। এখন তো একসাথে দুই কেসেরই ইনভেস্টিগেট করছে পুলিশ।পরপর এসব ঘটনা হওয়ায় সবাই কেমন একটা ভীতির মধ্যে আছে। নাজানি সামনে কি হবে।

ভীতির লেশ পঙ্খির মাঝেও কাজ করছে। তবে তাঁর ভীতির কারণ ভিন্ন। তাঁকে পেরেশান করছে সেদিনের সেই মহিলার কথাগুলো। যা ওর মস্তিষ্ক থেকে কিছুতেই যাচ্ছে না। আর এসব ঘটনার কারণে তাঁর সেই ভীতি যেন আরও বেড়ে যাচ্ছে। তাঁর মনে সবসময় ভয় লেগে থাকে নাজানি ওর ইন্ধনের কখন কি হয়ে যায়। কিন্তু সে ইন্ধন কে সুরক্ষিত রাখবে কিভাবে? সেতো জানেই না তাঁর আসল শত্রু কে। কে ইন্ধনের ক্ষতি করতে পারে। তাহলে কি করবে সে? ভাবনার অকুল কিনারে যেন ডুবছে সে। ইন্ধন তো আর কোন ছোট বাচ্চা না যে,তাঁকে ঘরে আঁটকে রাখবে। সামনে কিছুদিন পরই তাঁর ইলেকশন। এখন বেশির ভাগ সময়ই সে ব্যাস্ত থাকে নির্বাচনের প্রচারে। অনেক রাত করে বাড়ি ফিরে সে।এদিকে পঙ্খি অধীর হয়ে তাঁর পথ চেয়ে বসে থাকে। তাঁকে সহিসালামত না দেখা পর্যন্ত পঙ্খির গলা দিয়ে পানিও নামতে চায়না। যেমন এখনো নামছেনা। রাত এগারোটা বাজতে চললো অথচ ইন্ধন এখনো ফিরছে না।নয়টার দিকে ফোন দিয়ে বললো আসছি। দুই ঘন্টা হতে চললো তবুও তাঁর আসার নাম নেই। এদিকে চিন্তায় কাহিল হয়ে যাচ্ছে পঙ্খি। এতক্ষণে বাকিরা সবাই খেয়েদেয়ে যাঁর যাঁর রুমে শুয়ে পড়েছে। শুধু ও একাই ডাইনিং টেবিলে ইন্ধনের অপেক্ষায় বসে আছে। ইন্ধনের আসতে না দেখে পঙ্খি অস্থির হয়ে ইন্ধন কে আবার ফোন দিলো। কিন্তু ফোন রিসিভ হলোনা। পঙ্খির অস্থিরতা এবার তাঁকে আরও জোড়ালো ভাবে চেপে ধরলো। এলোমেলো খেয়াল গুলো তাঁর মন অশান্ত করে তুলছে। সে আবারও ফোন দিলো।নাহ এবারও রিসিভ হলোনা। হাত পায়ে মৃদু কম্পন শুরু হলো পঙ্খির। ইন্ধন ফোন কেন রিসিভ করছেনা? উনার কোন বিপদ হলো নাতো? এই খেয়াল গুলোই পঙ্খির আত্মা কাঁপিয়ে তোলার জন্য যথেষ্ট ছিলো। নিঃশ্বাস যেন গুনে গুনে বের হচ্ছে তাঁর।

ঠিক তখনই দরজার কলিং বেল বেজে উঠলো। আত্মায় যেন পানি আসলো পঙ্খির। জানপ্রাণে ছুটে গেল সে দরজা খুলতে। দরজা খুলে কাঙ্খিত ব্যাক্তির মুখটা দেখে বুক ভরে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো সে। তারপর একটু শক্ত গলায় বললো।
–ফোন কেন ধরছিলেন না আপনি?

ইন্ধন হাসিমুখে বললো।
–আরে বাসার সামনেই তো ছিলাম, তাই আর ফোন ধরিনি। শুধু শুধু ফোনের টাকা নষ্ট করে কি লাভ? একটু অপচয় রোধ করলাম আরকি।

ইন্ধনের এমন অযৌক্তিক জবাবে ভীষণ রাগ হলো পঙ্খির। সে এখানে চিন্তায় মরছে আর উনি কিনা ফোনের টাকা বাঁচাচ্ছে? সত্যিই? পঙ্খি আর কিছু না বলে দরজার কাছ থেকে সরে আসতে আসতে বললো।
–যান ফ্রেশ হয়ে আসুন। আমি খাবার গরম করছি।

বলতে বলতে পঙ্খি রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। ইন্ধন বুঝতে পারলো তাঁর বউটা অভিমান করেছে। বউকে মানাতে হবে তাঁর। সেও রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল। পঙ্খি চুলায় খাবার গরম করছে। ইন্ধন পেছন থেকে এসে পঙ্খিকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে থুঁতনি ঠেকিয়ে বললো।
–সরি সরি সরি ভুল হয়ে গেছে। নাদান বাচ্চা ভেবে মাফ করে দাও।

পঙ্খি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললো।
–কি করছেন? ছাড়ুন, কেউ এসে পড়বে। আর সরি কেন বলছেন? আপনিতো অপচয় রোধ অভিযানে নেমেছেন। তো যান তাই করুন। আমার মতো তুচ্ছ প্রাণী আপনার চিন্তায় মরে গেলেই বা তাতে কি যায় আসবে। আপনি আপনার অভিযান চালিয়ে যান। আপনার অভিযানে যেন কোন ব্যাঘাত না ঘটে।

–আরে বাপরে, এতবড় অন্যায় করে ফেলেছিস তুই ব্যাটা? এত সুন্দর লক্ষী বউটাকে তুই কষ্ট দিয়ে ফেলেছিস? এতো মহা অন্যায়। তোর তো কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত। বউ,তুমি বলোনা কি শাস্তি হওয়া উচিত আমার? একশবার কান ধরে উঠবস করবো? নাকি একঘন্টা উল্টো ঝুলে থাকবো? বলোনা? তুমি যাহা বলিবে তাহাই এই মানব করিবে। বলো অঙ্কলক্ষ্মী?

ইন্ধনের কথার ধরন শুনে পঙ্খির ভীষণ হাসি পেল। তবে শেষের কথাটা বুঝতে না পেরে ভ্রু কুঁচকে বললো।
–অঙ্কলক্ষ্মী? এটা আবার কি? মানুষ না হাতি? খায় না পড়ে?

ইন্ধন হো হো করে হেঁসে উঠে বললো।
–আরে অঙ্কলক্ষ্মী মানে স্ত্রী,বউ। বাঙালী হয়ে এইটুকু বাংলাই জানো না? ভেরি ব্যাড। তোমার থেকে এটা আশা করিনি। আমাদের ভাষা শহীদরা কি এইদিনের জন্যই তাদের প্রাণ দিয়েছিল? তোমাদের মতো মানুষদের জন্যই আজ বাংলা ভাষা রসাতলে যাচ্ছে। এখুনি হিন্দি গান আর ডায়লগ বলতে বললে ফটাফট বলে দিবে। অথচ শুদ্ধ বাংলা বলতে বললে পারবেনা। হায়,আমার দেশটার ভবিষ্যত কি হবে ভাবতেই মনটা কাঁদে আমার।

পঙ্খি বিরক্তির সুরে বললো।
–তো কাঁদেন। কেঁদে কেটে দেশ সাফ করে দেন। ছাড়ুন আমাকে। কাজ করতে দেন। কেউ এসে পড়লে কেলেংকারী হয়ে যাবে।

–আসুক যার আসার। আমি আমার বিয়ে করা বউয়ের সাথে রোমাঞ্চ করছি। প্রতিবেশীর বউয়ের সাথে তো আর করছিনা।

ইন্ধন দুই হাতে পঙ্খির কোমড় ধরে উঁচু করে রান্নাঘরের সিঙ্কের ওপর বসিয়ে দিলো। পঙ্খি কিছু বলতে নিলে তার ঠোঁটে তর্জনী আঙ্গুল ঠেকিয়ে বললো।
–হুঁশ,কোন কথা না। এতো কথা কেন বলো তুমি? বেশি কথা বলা আমার একদম পছন্দ না। এখন ভদ্র মেয়ের মতো এখানে চুপচাপ বসে থাকো। আর তোমার হট এন্ড হ্যাপেনিং হাসব্যান্ড কে দেখো।

আমি আর বেশি কথা বলি? এটাই শোনা বাদ ছিলো পঙ্খির। দুনিয়ার যতো আজব অপবাদ দেওয়া শুধু এই লোকটার পক্ষেই সম্ভব। পঙ্খিকে বসিয়ে দিয়ে ইন্ধন নিজেই খাবার গরম করতে লাগলো। পঙ্খি বাঁধা দিতে চাইলে ইন্ধন আবারও ধমকে বললো।
–বললাম না চুপচাপ বসে থাকো। স্বামীর হুকুম মানো না কেন তুমি? একদম নড়বে না কিন্তু।

গাল ফুলিয়ে অন্য দিকে মাথা ঘুরিয়ে বসে রইলো পঙ্খি। তবে বেঈমান মন ওর কাজে সহমত হলো না। সে পঙ্খিকে জোর দিলো ইন্ধনের দিকে তাকাতে। মনের কাছে পরাজিত হতে মুহুর্তও লাগলোনা পঙ্খির। আরচোখে তাকিয়ে তাঁর সুদর্শন স্বামীর উপর নজর গাড়লো সে। লোকটা একটা কথা একদম ঠিকই বলে। সে আসলেই অনেক সুন্দর। তাঁর ভাষ্যমতে হট এন্ড হ্যাপেনিং। এইযে খাবার গরম করতে নিয়েও তাঁকে কত্তো সুন্দর লাগছে। কি সুন্দর মনোযোগ সহকারে কাজ করছে সে। কপালের বিন্দু বিন্দু ঘামগুলোও কতো আকর্ষণীয় লাগছে। কেউ ঘামলেও যে সুন্দর লাগতে পারে তা হয়তো উনাকে না দেখলে জানাই যেতো না। মাঝে মাঝে নিজেকে তাঁর সামনে খুবই নগন্য লাগে। সে কেন এতো সুন্দর হতে গেল? তাহলে তো আর এমন মনে হতো না। আর না তাঁকে নিয়ে কোন ভয় থাকতো। নাজানি কতো কু নজর তাঁর উপরে পড়ে আছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে পঙ্খি। কি আর করার? এখন দুনিয়ার নজর থেকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেই না আলু ভর্তা হয়ে যাই।

পঙ্খির ছন্নছাড়া ভাবনার মাঝেই হঠাৎ ইন্ধন আবারও ওকে কোলে তুলে নিল। পঙ্খি হকচকিয়ে উঠে বললো।
–আরে কি করছেন? কেউ দেখে ফেলবে তো? আমার কি পা নেই নাকি?

ইন্ধন ভাবলেশহীন ভাবে বললো।
–না নেই। ধরে নাও আজকের মতো তুমি তোমার পা জোড়াকে খুলে রেখে দিয়েছ। আর আজকে আমি হবো তোমার পা। তোমাকে চিন্তায় রাখার জন্য এটাই আমার শাস্তি।

ইন্ধন পঙ্খিকে নিয়ে এসে ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসিয়ে দিলো। তারপর প্লেটে খাবার নিয়ে, খাবারের লোকমা হাতে নিয়ে পঙ্খির মুখের সামনে ধরলো। পঙ্খিও বিনাবাক্যে মুখ খুলে ইন্ধনের হাত থেকে খাবার খেয়ে নিলো। তারপর নিজেও ইন্ধনকে খাইয়ে দিলো। এভাবেই পুরো খাবার শেষ করলো তাঁরা। খাবার শেষে সব গুছিয়ে রুমে এলো ওরা। রুমে এসে যথারীতি ইন্ধন পঙ্খির কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লো। পঙ্খিও রোজকার ন্যায় তার মাথায় সযত্নে হাত বুলিয়ে দিলো। এটা এখন অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে ওদের। এছাড়া যেন ইন্ধনের ঘুমই আসে না। আজও একই ভাবে মাথায় বোলাতে বোলাতে কিছুক্ষণ পর ইন্ধন ঘুমিয়ে গেল। পঙ্খি ইন্ধনকে ঠিক করে বালিশে শুইয়ে দিলো। শোবার আগে পানি খেতে চাইলে পঙ্খি দেখলো পানির জগ খালি। তাই সে জগ ভরতে আবারও বাইরে এলো।

বাইরে করিডরে আসতেই কিছু দেখতে পেল পঙ্খি। জাহানারা সেদিনের মতোই আঁচলের নিচে কিছু লুকিয়ে নিয়ে চুপিচুপি উপরে তিনতলার দিকে যাচ্ছে। পঙ্খি নিজেকে আজ আটকাতে পারলোনা। ওই ঘরের রহস্য না জানা পর্যন্ত কেন যেন ওর সবকিছু ধোঁয়াসা মনে হয়। তাই আজই সুযোগ। আজকে জাহানারার পিছা করলে হয়তো জানতে পারবে ওই ঘরে কি আছে। যদিও ইন্ধন ওঁকে মানা করেছে এসবে পড়তে। কিন্তু নাজানা পর্যন্ত যে ও শান্তি পাবেনা।তাই দ্বিধাদ্বন্দ্ব ফেলে পঙ্খি চুপিচুপি পা টিপে টিপে নিজেকে আড়াল করে জাহানারার পিছা করলো।বুকের মাঝে তাঁর ঢিবঢিব করছে। কিছুটা ভয়ও করছে তার।তবুও সে আজ দেখেই ছাড়বে। পঙ্খি দেখলো জাহানারা চুপিচুপি একসময় ওই বন্ধ ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। এদিক ওদিক তাকিয়ে কেউ আছে নাকি দেখে নিলো। তারপর কোমড়ে শাড়ির ভাজ থেকে একটা চাবি বের করলো। চাবি দিয়ে ওই বন্ধ ঘরের তালা খুললো সে। তারপর ভেতরে ঢুকে গেল। পঙ্খি অবাক চোখে তাকিয়ে দেখলো সব। বিস্ময় যেন থামছেই না তার। অজানা ভয়ে শিহরণ জাগিয়ে দিচ্ছে বুকে।

ভয়ে ভয়ে সামনে পা বাড়ালো সে। হাত পা ভয়ে মৃদু কাঁপছে তার। লোমকূপ গুলোও দাঁড়িয়ে গেছে। ঢোক গিলে বুকে সাহস জুগিয়ে সে ওই দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। দরজার একপাশে দেয়ালের সাথে লেগে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে মাথাটা এগিয়ে ভেতরে উঁকি দিলো সে। আর যা দেখলো তাঁর জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা সে। বিস্ফোরিত চোখে দেখলো সে এই রহস্যময় ঘরের ভেতরের আসল দৃশ্য।

ভেতরে একটা পুরুষ লোককে লোহার শেকলে আঁটকে রাখা হয়েছে। লোকটাকে চিনতে পারলোনা পঙ্খি। লোকটার বয়স পঁচিশ ছাব্বিশের মতো হবে। দাঁড়ি গোফ দিয়ে সারা মুখ ঢেকে আছে। কাপড় চোপড় কতকালের নোংরা আর ছেঁড়া ফাটা। দেখে মনে হচ্ছে লোকটা পাগল। জাহানারা লোকটাকে নিজের হাতে খাবার খাইয়ে দিচ্ছে। খাওয়াচ্ছে আর হাত দিয়ে নিজের চোখের পানি মুছছে। লোকটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। হাত বুলিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো।
–পারলাম নারে, আমি পারলাম না। আমাদের নাঈম কে বাঁচাতে পারলাম না আমি। ওরা আবারও আমার নাঈমকে মেরে ফেললো। আমি কিছুই করতে পারলাম না।

পঙ্খি আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেল। কি বলছেন উনি? তারমানে কি উনি জানেন কে মেরেছে নাঈম কে? তাহলে কাউকে কিছু বলেনি কেন? চুপ করে থাকে কেন? পঙ্খি দেখলো জাহানারার কথায় ওই লোকটা ভীষণ উত্তেজিত হয়ে গেল। কেমন নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে রাগে গড়গড় করতে লাগলো। হাত পা দাপাদাপি করতে লাগলো। জাহানারা তাকে অনেক কষ্টে নিয়ন্ত্রণে আনলেন। এসব দেখে ভয়ে অন্তর জমে গেল পঙ্খির।এসব কি হচ্ছে কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না তাঁর। ইন্ধন ঠিকই বলেছিল।।এই বাড়ি টা এমন রহস্যপুরী। যতো জাল খুলতে যাচ্ছে ততই যেন ধূম্রজালের মাঝে জড়িয়ে যাচ্ছে সে।

চলবে….

#মৃগতৃষ্ণা—২৬
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★সারারাত এক ফোটাও ঘুমাতে পারেনি পঙ্খি। সেখান থেকে তখন চলে এলেও মস্তিষ্কে সব এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। রহস্যের বেড়াজাল যেন চারদিক দিয়ে ঘিরে ধরেছে তাঁকে। কি ছিলো ওইসব? ওই লোকটাই বা কে ছিলো? তাঁকে কেন ওভাবে আঁটকে রাখা হয়েছে? জাহানারার কি হয় সে? আর জাহানারা নাঈমের হ,ত্যার ব্যাপারে ওভাবে কেন বললো? সে কি জানে কে আছে এসবের পেছনে? জেনে থাকলে তিনি কাউকে সেকথা বলেন না কেন? নিজের ছেলের হ,ত্যাকারীকে তিনি কেন লুকিয়ে রাখছেন? কে সেই খু,নী? সে কি তার আপন কেউ? এমন হাজারো প্রশ্নের বেড়াজালে আঁটকে পড়ছে পঙ্খি। কি করবে না করবে ভেবে পাচ্ছেনা সে। একবার ভাবলো ইন্ধন কে ডাক দিয়ে তাঁকে সবটা খুলে বলবে সে। কিন্তু ভয়ও করছে যদি ওর ওপর রাগ করে তখন? কারণ ইন্ধন ওকে এসবের মাঝে ঢুকতে মানা করেছিল। যখন শুনবে আমি ওর কথা রাখিনি তখন যদি নারাজ হয়ে যায়? এমনিতেও কত শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে ইন্ধন। ওর শান্তির ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে মন চাচ্ছে না। আমাকে আগে জাহানারার সাথে কথা বলতে হবে। আগে উনার কাছে আসল ঘটনা জানতে হবে। তারপর নাহয় ইন্ধন কে বলা যাবে।

সেই মোতাবেক পঙ্খি সকাল সকালেই জাহানারার ঘরের সামনে এলো। দরজার সামনে এসে দেখলো দরজা খোলা। ভেতরে এসে দেখলো জাহানারা নাঈমের ছবি হাতে নিয়ে বসে আছে। ছবিতে হাত বোলাচ্ছে আর নীরবে কাঁদছে। পঙ্খি এগিয়ে গিয়ে তাঁর পাশে বসলো। জাহানারার কাঁধে আলতো করে হাতটা রাখলো সে। জাহানারা পঙ্খিকে দেখে চোখের পানি মুছে নিয়ে বললো।
–আরে পঙ্খি? তুমি হঠাৎ? কিছু কইবা?

–আচ্ছা আম্মা আপনার মনে হয় না আপনি আপনার ছেলের সাথে অন্যায় করছেন? তারজন্য চোখের পানি ফেলানো টাও অযথাই বৃধা যাচ্ছে আপনার?

জাহানারা একটু বিভ্রান্তির সুরে বললো।
–এসব কি বলছ তুমি? এমন প্রশ্নের মানে কি?

–আপনি ভালো করেই জানেন আমি কি বলতে চাচ্ছি। তবুও যদি আমার কাছেই শুনতে চান তাহলে শুনুন। আমি কাল রাতে আপনাকে ওই বন্ধ ঘরে যেতে দেখেছি। আর ওই ঘরে কি আছে সেটাও দেখেছি।এমনকি আপনার বলা কথাগুলোও শুনেছি।

পঙ্খির কথায় পিলে চমকে গেল জাহানারার। আতঙ্কিত চোখে তাকালো সে পঙ্খির পানে। ভয়ার্ত কন্ঠে বললো।
–কি বলছ এসব?আর তোমার ওখানে যাওয়া একদম ঠিক হয়নি।কেন গেলে তুমি ওখানে?

–আগে আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দিন? ওই লোকটা কে? কি হয় আপনার? আর তাঁকে কেন ওভাবে আঁটকে রাখা হয়েছে। আর সবচেয়ে বড়ো কথা, আপনি যদি নাঈমের হ,ত্যাকারীর সম্পর্কে জেনে থাকেন তাহলে সেটা পুলিশের সামনে কেন বলেন না? কেন চুপ করে থাকেন আপনি? কাকে বাঁচাতে চান আপনি? বলুন?

জাহানারা ভয়ে দ্রুত উঠে গিয়ে দরজা টা আঁটকে দিলো। তারপর পঙ্খির সামনে এসে ভয়ার্ত কন্ঠে বললো।
–চুপ করো। আস্তে কও। কেউ শুনে ফেললে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।

–কিসের এতো ভয় আপনার? কাকে ভয় পাচ্ছেন আপনি? দেখুন আমাকে সব খুলে বলুন। হয়তো আমি আপনার কোন সাহায্য করতে পারি।

–দেখ পঙ্খি তুমি এসবের মধ্যে পড়তে এসোনা। যতোটা ভাবছ তার চেয়েও অধিক ভয়ংকর সবকিছু। আমি তোমাকে এসব বিষয়ে কিছু বলতে পারবোনা। আর তুমিও জানার চেষ্টা করোনা। এসব ঘাটতে গেলে তুমিও মুসিবতে পড়ে যাবে। তাই যা দেখেছ তা ভুলে যাও।আর নিজের সংসার জীবনে মন দাও।

–কি বলছেন এসব? আর কিসের এতো ভয় পাচ্ছেন? দেখুন ভয়ের কিছু নেই। দরকার হলে আমরা ইন্ধন কে সবটা জানাবো। ও আমাদের নিশ্চয় সাহায্য করবে। ইন্ধন থাকতে কোনো ভয় নেই আপনার।

–না না এটা ভুলেও করবে না।সর্বনাশ হয়ে যাবে। এতে করে ইন্ধনও বিপদে পড়ে যাবে। তুমি কি চাও তোমার স্বামীকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে? নিজের সুখী জীবন ধ্বংস করতে না চাইলে এই গোপন কথা তুমি দ্বিতীয় কান করবে না। আমাকে কথা দাও তুমি যা জেনেছ তা কাওকে বলবে না। অনুরোধ করছি কথা দাও।

জাহানারার কথায় পঙ্খি দোটানায় পড়ে গেল। কি করবে বুঝতে পারছে না সে। ইন্ধনের কাছ থেকে এতবড় সত্যি টা লুকানো কি ঠিক হবে? কিন্তু জাহানারার কথায় ভয়ও লাগছে। সত্যিই যদি ওর কারণে ইন্ধনের ওপর কোন বিপদ নেমে আসে তখন? না না এটা আমি হতে দিতে পারিনা। এমনিতেই সেদিনের ওই মহিলার কথার জন্য ইন্ধন কে নিয়ে সবসময় আতঙ্কে থাকে পঙ্খি। এখন আবার নতুন কোন বিপদ সে আসতে দিবে না। ইন্ধনের চেয়ে বেশি জরুরি আমার কাছে আর কিছুই না। ওর সুরক্ষাই সবচেয়ে মুখ্যম বিষয়। তাঁর জন্য যদি এই রহস্য নিজের মধ্যে চাপা দিয়ে রাখতে হয় তাও রাখবে সে। পঙ্খি জাহানারাকে আস্বস্ত করে বললো।
–ঠিক আছে আম্মা আপনার কথাই রাখলাম। তবে সবসময়ের জন্য না। যদি কখনো তেমন কোনো পরিস্থিতি আসে তাহলে কিন্তু আমি আর চুপ থাকবো না। ইন্ধন কে আমি সবটা বলে দিবো।

–হুম ঠিক আছে।
__

শাকিল থানায় নিজের কেবিনে বসে কেস ফাইল ঘাঁটছিলো। নাঈমের কেসে এখনো তেমন কোনো কিছু খুঁজে পেলনা সে।অন্যদিকে তুশি হ,ত্যা মামলারও তেমন কোন উন্নতি হয়নি। নিজের এমন ব্যার্থতার জন্য নিজের ওপরই খুবই ক্ষিপ্ত সে। কি আছে যা সে মিস করছে? এটাই বুঝতে পারছে না সে।তবে একটা জিনিস সে ধরতে পেরেছে। পুরো নাহলেও আশি পার্সেন্ট নিশ্চিত যে,এই দুই খু,নের পেছনে একজনেরই হাত আছে। কারণ দুজনের খু,নই চা,কু দ্বারা হয়েছে। দুজনেরই খু,ন রাতের বেলা হয়েছে। আর দুজনেই মজুমদার পরিবারের সাথে সম্পর্কিত। এই কারণ গুলোই যথেষ্ট এটা বুঝতে। এখন শুধু খু,নিকে খুঁজে বার করার দেরি।

হঠাৎ শাকিলের এই গভীর মনোযোগের মাঝে ব্যাঘাত ঘটলো। যখন কেবিনের বাইরে থেকে ক্যাচালের শব্দ এলো। শাকিল বিরক্ত হয়ে কেবিনের বাইরে বেড়িয়ে এলো।বাইরে কিছু মেয়েদের হৈচৈ দেখতে পেল। শাকিল কর্মরত সহকারী পুলিশদের উদ্দেশ্যে উচ্চস্বরে বলে উঠলো।
–কি হচ্ছে এখানে? মাছ বাজার লাগিয়ে রেখেছ কেন?

তখনই ওখানে উপস্থিত মেয়েগুলো শাকিলের দিকে ঘুরে তাকালো। মেয়েগুলোর মাঝে ছায়াকে দেখে ভ্রু কুঁচকে আসলো শাকিলের। কর্মরত সহকারী পুলিশ এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে শাকিলকে স্যালুট দিয়ে বললো।
–সরি স্যার। আসলে এই মেয়েগুলোর মধ্যে একজনের আই ফোন হারিয়ে গিয়েছে। তারজন্য কমপ্লেইন করতে এসেছে। আমি কমপ্লেন লিখেছি। বলেছি আমরা খুঁজবো। কিন্তু উনাদের কথা এখুনি খুঁজে দিতে হবে। বলুন এটা কোনো কথা?

শাকিলের ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটলো।যেন অনাঙ্ক্ষিত কোন কিছু হাত লেগেছে তাঁর। সে ছায়াদের কাছে এগিয়ে এসে বললো।
–কার মোবাইল হারিয়েছে?

ছায়ার বান্ধবী ডালিয়া কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠলো।
–স্যার আমার মোমাইল হারিয়েছে। ফোনটা আমার ভাইয়ের। আজ স্কুলের বিদায় অনুষ্ঠানের ছবি তোলার জন্য ভাইয়ার কাছ থেকে অনেক রিকুয়েষ্ট করে নিয়ে এসেছিলাম। এখন যদি ভাইয়া জানতে পারে আমি মোবাইল হারিয়ে ফেলেছি তাহলে জানে মেরে ফেলবে আমাকে। প্লিজ আমার মোবাইল টা খুঁজে দিন।

শাকিল গম্ভীর কন্ঠে বললো।
–আচ্ছা আমি দেখছি বিষয় টা। তোমরা আমার সাথে আসো।

শাকি
–হুমম,দেখ এসব পুলিশের কাজে সময় লাগে বুঝেছ? এইযে তুমি কমপ্লেইন করলে। এখন এটার ওপর আগে চিন্তা ভাবনা হবে। এটা খুঁজতে কাকে পাঠানো হবে সেটা নিয়েও বিবেচনা হবে। তারপর দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করবেন। আশেপাশে জিজ্ঞাসা বাদ করবেন। তারপরও না পেলে আরও উপায় অবলম্বন করবেন। মোটকথা এসবে দীর্ঘ সময় যাবে। তাড়াতাড়ি বললেই তো আর হয়না। সবকিছুর একটা প্রসেস আছে। প্রটোকল অনুসরণ করতে হয়।

এবারে ছায়া বলে উঠলো।
–আরে এভাবে বলছেন কেন? বেচারি এমনিতেই ভয়ে কেঁদে কেটে অস্থির। একটু হেল্প করুন না? আমরা তো আপনার বোনের মতো।

শাকিল ধমক দিয়ে বললো।
–এই তোকে না বলেছি ভাই বললে একদম জেলে ভরে দেবো। পুলিশের কাছে সব এক। এখানে আত্মীয়তা চলেনা। হ্যাঁ তবে শুধু একটা সম্পর্ক কাজে লাগে।

সবাই কৌতুহলী হয়ে বললো।
–কোন সম্পর্ক স্যার?

–স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক। তোমাদের মধ্যে কেউ যদি আমার বউ হতো তাহলে নাহয় আলাদা ব্যাপার ছিলো। বউয়ের জন্য দরকার হলে সাতপরদ পাতাল থেকেও মোবাইল খুঁজে বের করতাম। কিন্তু তোমাদের কেউ তো আর আমার বউ না তাইনা?

ডালিয়া বলে উঠলো।
–তাহলে কি আর কোন উপায় নেই স্যার? প্লিজ দয়া করে কিছু করুন। নাহলে আমি আজ বাড়ি ফিরলে মৃ,ত্যু নির্ধারিত। প্লিজ বাঁচান আমাকে।

–হুমমম, তোমরা তো আমাকে মুশকিলে ফেলে দিলে। আমি আবার কারোর কান্না সহ্য করতে পারি না। অনেক সফট মন আমার। তাই তোমাদের জন্য একটা উপায় আছে।

–কি উপায় স্যার?

–তোমাদের মধ্যে কেউ যদি আজকের দিনের জন্য আমার বউ হতে রাজি হও তাহলে কিছু হতে পারে। দেখো অন্য মাইন্ডে নিও না। শুধু বউ হওয়ার নাটক করতে হবে আর কিছুই না। আসলে আমাদেরও তো কিছু রুলস আছে তাইনা? রুলস মোতাবেক চলতে গেলে এটুকু করতেই হবে।এতে কিন্তু আমার বিন্দুমাত্র স্বার্থ নেই। তোমাদের জন্য নাহয় নিজেকে আজ উৎসর্গ করে দিলাম। পুলিশের কাজই জনগণের সেবা করা তাইনা? তো বলো কে হবে আমার বউ।

শাকিলের মতো সুদর্শন পুলিশের বউ হওয়ার সুযোগ যেন মেয়েগুলোর কাছে মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি । ছায়া বাদে আর সবগুলোই হাত তুললো। ছায়াকে হাত তুলতে না দেখে রাগে কটমট করছে শাকিল। যার জন্য এতো পরিকল্পনা তারই প্রতিক্রিয়া নেই। শা,লি বলদির বলদিই থেকে গেল। শাকিল এবার এক এক করে সব মেয়ে গুলোকে বলতে লাগলো।
–ডালিয়া তুমিতো আমার ফুপাতো ভাইয়ের শালার মামাতো ভাইয়ের ধর্ম ভাইয়ের মেয়ে। সেই হিসেবে তুমি আমার ভাতিজি হও। আর ভাতিজি তো মেয়ের মতোই। তাই তোমাকে বউ করা যাবে না। যদিও নাটক তাও একটা সম্পর্কের ব্যাপার তো আছে। আর জিনিয়া, তুমিতো আমগো দাদীর ফুপুর নাতীর সুমুন্দির ভাইয়ের মেয়ে তাই তুমিও বাদ। এভাবে এক এক করে সবাইকে কোনো না কোনো আত্মীয় বানিয়ে বাদ দিয়ে দিলো শাকিল। থাকলো শুধু ছায়া। ডালিয়া বলে উঠলো।
–তাহলে কে বউ হবে স্যার?

শাকিল ইনোসেন্ট ভাব ধরে বললো।
–দেখো আর কেউ আছে নাকি??

–এখন তো শুধু ছায়া বাদ আছে।

শাকিল তো এই কথারই অপেক্ষায় ছিলো। মনে মনে খুশি হলেও মুখে গাম্ভীর্য ধারণ করে বললো।
–হ্যাঁ ওকে করা যেতে পারে। কারণ ও আমার কোন আত্মীয় হয়না।

ছায়া ভ্রু কুঁচকে বললো।
–হইনা মানে? আরে আমি তো আপনার চাচাতো বোন হই।

শাকিল দাঁতে দাঁত চেপে বললো।
–হ্যাঁ তো কি হয়েছে? কাজিনদের মধ্যে কি বিয়ে হয়না? শতশত কাজিনদের বিয়ে হচ্ছে। আবার প্রেমও হচ্ছে। বরং এখন তো কাজিন লাভ স্টোরিই বেশি হিট খাচ্ছে। লেখক লেখিকা কাজিন লাভ স্টোরি লিখে ফেমাস বনে যাচ্ছে। খালি তুইই বুঝছ না গর্দভ।

শেষের কথাটা একটু বিড়বিড় করে বললো শাকিল। তারপর অন্য মেয়েদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো।
–দেখো তোমাদের কাছে এখন একটাই পথ খোলা আছে। যেহেতু তোমাদের মাঝে শুধু ছায়াকেই বউ বানানো যাবে। তাই ও যদি আমার বউ হতে রাজি হয়। তাহলেই আমি তোমাদের কাজ করে দিতে পারবো।

ছায়া তেতে উঠে বললো।
–মোটেই না। আমি কেন আপনার বউ হতে যাবো?

–ঠিক আছে। তাহলে আমিও আর কিছু করতে পারলাম না।

ডালিয়া কাঁদো কাঁদো গলায় আকুতি মিনুতি করে ছায়াকে বললো।
–রাজি হয়ে জানা ছায়া। দেখ আমি না তোর বেস্ট ফ্রেন্ড।আমার জন্য এটা কর। প্লিজ প্লিজ প্লিজ রাজি হয়ে যা। নাহলে কিন্তু আমি তোর সাথে জীবনেও কথা বলবোনা। তোর আমার বন্ধুত্ব আজই শেষ হয়ে যাবে। আমিও গিয়ে পানিতে ডুবে ম,রে যাবো। কারণ বাড়িতে গিয়ে ভাইয়ের হাতে মরার চেয়ে নিজে নিজেই ম,রা ভালো।

ছায়া পড়ে গেল বিড়ম্বনায়। বান্ধবীকেও হারাতে চায়না আবার এই লোকটার বউও হতে চায়না ও। কিন্তু এখন তো কোন উপায়ও নেই। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছায়া রাজি হয়ে গেল।
–ঠিক আছে আমি রাজি।

শাকিল বিশ্ব জয়ের হাসি দিলো। তারপর ছায়ার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো।
–তাহলে তুই আমার বউ ঠিক আছে। হ্যাঁ তো বল কি হয়েছে আমার সোনা বউটার?

–এমন ঢং করে কথা বলছেন কেন? আর কি হয়েছে তাতো জানেনই আপনি।

শাকিল রাগ দেখিয়ে বললো।
–ঢং এর কি দেখলি তুই? তুই এখন আমার বউ। আর বউদের সাথে এভাবেই কথা বলতে হয়। আর তুইও সুন্দর করে বউয়ের মতো করে বল কি হয়েছে ঘটনা। তবেই কাজ হবে। নাহলে হবে না।

ছায়া দাঁত কিড়মিড় করছে। ডালিয়া অনুনয়ের চোখে তাকিয়ে ইশারায় ওকে শাকিলের সব কথা মানতে বললো। অগত্যা ছায়াও দাঁতে দাঁত চেপে বললো।
–ওগো শুনছেন? আমার বান্ধবীর মোবাইল টা হারিয়ে গিয়েছে। একটু খুঁজে দিন না।

শাকিল পুলকিত হয়ে বললো।
–আয় হায় কি সুন্দর করে কয় আমার বউটা।পরাণ ডা জুড়ায় গেল। এমন কইরা কইলে তো আলী বাবার চল্লিশ চোরও খুঁইজ্যা বের করমু। মোবাইল কি জিনিস। এটাতো পাঁচ মিনিটের ব্যাপার। চলো চলো এক্ষুনি খুঁজে দিচ্ছি।

কথাটা বলে শাকিল ছায়ার গাল টেনে দিলো। ছায়া চোখ কটমট করে তাকালো। শাকিল মনে মনে বললো, এই একদিনের বউকে আমি পার্মানেন্ট করেই ছাড়বো।
__

বেলা তখন পড়ন্ত দুপুর।রোদের তপ্ততা কমতে শুরু করেছে। পুকুরের সিঁড়িতে হাঁটু ভাজ করে হাঁটুর ওপর থুতনি ঠেকিয়ে বসে আছে পঙ্খি। রাজ্যের চিন্তা তার মাথায়ই এসে হামলে পড়েছে। একেতো এতসব রহস্যের বেড়াজাল। যার সবই ধোঁয়াশা। কোনটাই স্পষ্ট না। তারওপর আবার ইন্ধনের থেকে এতবড় সত্যি টা লুকিয়ে রাখার অপরাধ বোধ ওকে নির্জীব করে দিচ্ছে। জাহানারার সামনে তখন বাধ্য হয়ে কথা দিলেও এখন যে আর ভালো লাগছে না তাঁর। ইন্ধনের কাছে এসব লুকিয়ে খুব খারাপ লাগছে ওর। মনটা ভারী হয়ে আসছে ওর। ইন্ধন ঠিকই বলেছিল। আমার এসবের মাঝে পড়াই উচিত হয়নি। না পারছি গিলতে, না পারছি উগ্রে দিতে। কিচ্ছু ভালো লাগছে না। মন চাচ্ছে একটু ইন্ধনের বুকে মাথা রেখে শান্তির নিঃশ্বাস নিতে। কিন্তু উনিও নেই। নেতা সাহেব ব্যাস্ত তাঁর নির্বাচন নিয়ে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো পঙ্খি। এছাড়া তো আর কিছু করার নেই এখন।

ভাবনার মাঝে মৌন থাকা পঙ্খির গালে হঠাৎ কারোর অধরযুগল এসে ঠেকলো। হকচকিয়ে উঠে পাশে তাকালো পঙ্খি। ওর সম্মুখে ইন্ধন কে দেখে সে একটু অবাক হয়ে বললো।
–আপনি?

ইন্ধন এক হাতে পঙ্খিকে জড়িয়ে নিয়ে বললো।
–হ্যাঁ তো? আর কারোর সাহস আছে নাকি তোমার সাথে এই কাজ করার? তোমাকে ছোঁয়া তো দূরের কথা তোমার দিকে কেউ তাকানোর স্পর্ধা দেখালেও সে আর পৃথিবীর আলো দেখার যোগ্য থাকবেনা।

পঙ্খি মায়াভরা চোখে তাকিয়ে রইলো ইন্ধনের দিকে। লোকটা আমাকে কতো ভালোবাসে। অথচ আমি কিনা তাঁর কাছ থেকে এসব লুকিয়ে রাখছি। কখনো জানতে পারলে কি আমাকে মাফ করবে সে? পঙ্খিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইন্ধন দুষ্টু সুরে বললো।
–আমাকে আজ একটু বেশিই হট লাগছে তাইনা? দাঁড়াও আরেকটু ভালো করে দেখার ব্যাবস্থা করে দিচ্ছি ।

কথাটা বলে ইন্ধন ওর শার্টের বোতাম গুলো খুলতে লাগলো। পঙ্খি চোখ বড়সড় করে বললো।
–আরে আরে কি করছেন? পাগল হয়ে গেলেন নাকি? কেউ দেখে ফেললে কি ভাববে?

–কি আর ভাববে? ভাববে পঙ্খির জামাইটা কি হট, পঙ্খি কতো ভাগ্যবতী।

বলতে বলতে একসময় পুরো শার্টই খুলে ফেললো ইন্ধন। তারপর বললো।
–আজ বোধহয় একটু বেশিই হট হয়ে গেছি। আমার নিজেরই কেমন গরম লাগছে। তোমারও লাগছে তাইনা? চলো দুজনেই একটু ঠান্ডা হই।

কথা শেষ করেই পঙ্খিকে পাঁজা কোলে তুলে নিলো ইন্ধন। পঙ্খি ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললো।
–কি করছেন আপনি? কেউ এসে পড়বে। নামিয়ে দিন প্লিজ।

পঙ্খির কথায় ইন্ধনের ওপর কোন প্রভাব পড়লো হলো বলে মনে হলোনা।সে ভাবলেশহীন ভাবে পঙ্খিকে কোলে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে পুকুরের পানির মাঝে থাকা সিড়ির ওপর এলো। তারপর কোলে রাখা পঙ্খিকে ছুঁড়ে দিলো পানির মাঝে। এরপর নিজেও ঝাপ দিলো পানির গভীরে। পুকুরের পানিতে পঙ্খিকে নিয়ে নানান প্রেমলীলায় মত্তো হলো সে। পঙ্খিরও মন খারাপ টা কোথায় গায়েব হয়ে গেল। ইন্ধনের আবহে ভাসলো তার মন।

এদিকে কেউ যে ওদের এই প্রেমলীলা দেখে জ্বলে পুড়ে খাঁড় খাঁড় হচ্ছে তা জানলো না পানিতে নিজেদের মাঝে মজে থাকা এই প্রেমিক যুগল।
__

একের পর এক ম,দের গ্লাস খালি করছে জুবায়েদ। চোখ দুটো লালবর্ণ ধারণ করেছে। চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে ইন্ধন আর পঙ্খির সেই প্রেমলিলার মুহুর্ত। তখন জুবায়েদ হাঁটতে হাঁটতে পুকুরের দিকে গিয়েছিল। আর তখনই সে ইন্ধন আর পঙ্খিকে দেখতে পায়। ইন্ধন তখন পঙ্খির অধরে ডুবে ছিলো। পঙ্খির কোমল অ,ঙ্গ নিয়ে খেলছিল সে। এই দৃশ্য দেখেই যেন কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো জ্বলে ওঠে জুবায়েদের। যে নারীকে সে নিজে পেতে চেয়েছিল তাঁকে ওই ইন্ধন পেয়ে গেল। সবকিছুতেই হারিয়ে দিচ্ছে ওই ইন্ধন। এতকিছু করেও ওকে আমি পরাজিত করতে পারছিনা। ঘরে বাইরে সব জায়গায় আমাকে পরাজিত করছে ও। পঙ্খির ওপর আমার কতদিন ধরে নজর ছিলো। কিন্তু তাঁকেও আমার আগে নিয়ে নিলো ও। না না এভাবে হারবোনা আমি। পঙ্খিকে তো আমি ভো,গ করেই ছাড়বো। আর এটাই হবে ওর সবচেয়ে বড়ো হার। যখন নিজের বউকে অন্য কেউ ভো,গ করবে তখনই দূর্বল। এক লাঠিতে দুই শিকার। পঙ্খি বেবি আম কামিং।
__

রোজকার মতোই ঘুমাবার আগে পানির জগ ভরতে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিল পঙ্খি। হঠাৎ কেউ পেছন থেকে এসে মুখে রুমাল চেপে ধরলো। মুহুর্তেই চোখের সামনে অন্ধকার ছেয়ে গেল। শরীর অবশ হয়ে ঢলে পড়লো সে।
__

–পঙ্খি, পঙ্খি, চোখ খোল প্লিজ। পঙ্খি শুনতে পাচ্ছ আমাকে? চোখ খুলে তাকাও। দেখো আমি এসে গেছি। উঠোনা প্লিজ।

চোখ বন্ধ অবস্থাতেই কারোর আকুল ভরা কন্ঠে নিজের নাম শুনতে পেল পঙ্খি। ভারী চোখের পলক জোড়া অতিকষ্টে টেনে টেনে মেলে তাকালো সে। আর তাকাতেই ইন্ধনের ব্যাকুল লাল আখিজোড়া দেখতে পেল সে। পঙ্খির চোখ মেলে তাকানোই যেন তাঁর আঁটকে থাকা হৃৎস্পন্দনে প্রাণর সঞ্চালন হলো। পঙ্খি কোনকিছু বুঝে ওঠার আগেই ইন্ধন তাঁকে সর্বশক্তি দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো। পঙ্খি কিছুই বুঝতে পারছে না। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো ও একটা জঙ্গলের মাঝে আছে সে। কিছু লোকজনও দেখতে পাচ্ছে ও। কিন্তু আমি এখানে কিভাবে এলাম? সেটাই ভাবছে পঙ্খি। ইন্ধন এবার পঙ্খির মুখটা সামনে এনে অস্থির কন্ঠে বললো।
— তুমি ঠিক আছ? কিছু হয়নিতো তোমার?

–কিন্তু হয়েছে টা কি? আর আমি এখানে কিভাবে এলাম?

কথা বলতে বলতে পঙ্খি পাশে ফিরে তাকালো। আর যা দেখলো তাতে তাঁর আত্মা কেঁপে উঠল। ওর সামনেই কিছুটা দূরে জুবায়েদের র,ক্তাত্ত লা,শ পড়ে আছে। আর তাঁর পাশেই কনিকা ভাবি চা,কু হাতে নিয়ে নির্লিপ্ত ভাবে বসে আছে। চা,কু থেকে এখনো টপটপ করে র,ক্ত পড়ছে। এসব দেখে শিউরে উঠলো পঙ্খি। তুশির মতো জুবায়েদের লা,শ টাও ভয়ংকর বিভৎস। আর দেখতে পারলোনা পঙ্খি। একটা চিৎকার দিয়ে আবারও জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লো ইন্ধনের বাহুতে।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here