মৃগতৃষ্ণা-২৯,৩০

0
698

#মৃগতৃষ্ণা-২৯,৩০
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
২৯

★ইন্ধনের বাহুবন্ধনে আতঙ্কে কাঁপছে পঙ্খি।দুই হাতে ইন্ধনের টিশার্ট খামচে ধরে জাপটে ধরে আছে তাঁকে। আজ অজান্তেই নিজের হাতেই ইন্ধনের ক্ষতি করতে যাচ্ছিল ও। কাল যদি ইন্ধন কফিটা খেত তাহলে কি হতে পারতো সেই ভাবনাটাও যেন হাজার বার মৃ,ত্যুর সমান। ভয়ে হৃদপিন্ড জমে যাচ্ছে পঙ্খির। ওর ইন্ধনের কেউ ক্ষতি করতে চায়, কেউ ওর জানের দুশমন হয়ে আছে আর ও কিনা সেটা জানেই না। এখন কি করবে ও? কিভাবে রক্ষা করবে ইন্ধন কে? ঘরের শত্রুকে কিভাবে খুঁজে বার করবে ও? আবারও যদি কেউ ইন্ধনকে কিছু করার চেষ্টা করে কি করবে? মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে যাচ্ছে পঙ্খির। ভীতি যেন ওর সর্বাঙ্গ গ্রাস করে নিচ্ছে। ইন্ধনের কিছু হয়ে গেলে বাঁচবে কি করে ও? ওর দুনিয়াই তো শুধু ইন্ধন।

এদিকে ইন্ধন পঙ্খির এই আচমকা ভীতির কারণ কিছুই বুঝতে পারছে না।তখন ঘুমের মাঝে থাকতেই পঙ্খির চিৎকার শুনে ধড়ফড়িয়ে ওঠে সে। পঙ্খির কাছে ছুটে গিয়ে দেখে আতঙ্কে কেমন স্তম্ভিত হয়ে আছে পঙ্খি। ইন্ধন পঙ্খির কাছে গিয়ে চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে? কিন্তু পঙ্খি যেন বাকশক্তিহীন হয়ে গেছে। কিছুই বলতে পারেনা সে। ইন্ধন তাঁর কাঁধ ধরে আলতো ঝাকিয়ে জানতে চায় কি হয়েছে। পঙ্খি তখন ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আচমকা জাপ্ট ধরে ইন্ধন কে। ছেড়ে দিলেই বুঝি হারিয়ে যাওয়ার ভয় আছে এমনটাই মনে হয় পঙ্খির। ইন্ধন বুঝতে পারে পঙ্খি কোন কিছু নিয়ে ভয় পেয়েছে। ইন্ধন পঙ্খিকে পাঁজা কোলে তুলে নিয়ে রুমের বিছানায় এসে বসে।তখন থেকে ওভাবেই জাপ্টে ধরে আছে ইন্ধন কে। ইন্ধন পঙ্খির মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পঙ্খি একটু শান্ত হয়ে আসলে, ইন্ধন বলে উঠলো।
–কি হয়েছে পঙ্খি? বলোনা আমাকে? চিন্তা হচ্ছে তো আমার। তোমাকে এভাবে দেখতে ভালো লাগছে না আমার। প্লিজ বলোনা।

পঙ্খি এবার ধীরে ধীরে মাথা তুলে ইন্ধনের পানে তাকালো। ভয়ার্ত কন্ঠে বললো।
–ও ওওইখানে বিড়াল মরে আছে।

ইন্ধন ভ্রু কুঁচকে বললো।
–সামান্য বিড়াল মরা দেখেই তুমি এভাবে ভয় পাচ্ছ?

–ওই বিড়াল টা কাল রাতে আপনার জন্য আনা কফি খেয়ে মরেছে। তারমানে বুঝতে পারছেন আপনি?

ইন্ধন কতক্ষণ কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইলো পঙ্খির দিকে। তারপর হঠাৎ হো হো করে হেঁসে উঠে বললো।
–তুমি বোধহয় আজকাল টিভি সিরিয়াল দেখা শুরু করেছ তাই এসব আবোলতাবোল খেয়াল মাথায় আসছে। আরে প্রায় দিনই বাড়ির একোণে ওকোণে বিড়াল মরে থাকে। তাহলে কি সবাই কফি খেয়েই মরে?আরে এমনই হয়তো মরে গেছে ও। আর তুমি তিলকে তাল বানিয়ে শুধু শুধু ভয় পাচ্ছ। আরে পাগলী এমন কিছুই না।

–শুধু শুধু ভয় পাচ্ছিনা আমি। আপনি হয়তো বুঝতে পারছেন না। তবে আপনার ওপর কালো ছায়া ভর করেছে। সেদিন ওই মহিলাও সেটা বলছিলো। কেউ আপনার ক্ষতি করতে চায়। আপনার জানের দুশমন হয়ে আছে কেউ।

–এক মিনিট,মহিলা মানে! কোন মহিলা? কার কথা বলছ তুমি?

পঙ্খি সেই বৃদ্ধ মহিলার কথা খুলে বললো। সব শুনে ইন্ধন বললো।
–তুমি না সত্যিই একেবারে সহজসরল। আরে এইসব পাগল বুড়িদের কথায় কেউ কান দেয়? এরা তো পাগলের মতো এমনই যা খুশি তাই বলে বেড়ায়। আর তুমি কিনা ওই কথা নিয়ে মনে মনে কতো কাহিনি বানিয়ে বসে আছ। ওসব ফালতু কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। শুধু শুধু ভয় পেয়না। ইনশাআল্লাহ কিছু হবে না তোমার রাজকুমারের। আর আজকের পর ওইসব পাগল বুড়িদের সাথে কোন কথা বলার দরকার নেই। দেখা যাবে আমার আধা পাগল বউটাকে শেষমেশ পুরো পাগল বানিয়ে ফেললো। তখন আমার কি হবে? তাই মন থেকে ওসব ঝেড়ে ফেলো। আর তোমার সুন্দর মুখের ওপর থেকে এই কালো বাদল ঝেড়ে ফেলে একটা মিষ্টি হাসি দাও তো।তারপর না সকাল টা সুন্দর হবে।

পঙ্খি জানে ইন্ধন ওর মব ভালো করার জন্য এসব বলছে। তবে ওর মন যে এসব কথায় ভুলছেনা। ইন্ধন ব্যাপার টা হাওয়ায় উড়িয়ে দিলেও, সে বুঝতে পারছে ব্যাপার টা সত্যিই খুব ভয়ানক। ইন্ধনের ওপর সত্যিই কালো ছায়া আছে। আর এই শত্রুকে যেভাবেই হোক খুঁজে বের করতেই হবে। তবেই ইন্ধন বিশ্বাস করবে ওর কথা।
___

শাকিল থানা থেকে ফিরেছে মাত্রই। ঘরে এসে ইউনিফর্ম খুলতে খুলতে মায়ের উদ্দেশ্যে গলা উঁচিয়ে হাক ছেড়ে বললো।
–মা….ঠান্ডা পানি আনো তো। পিপাসায় গলা শুঁকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।

ইউনিফর্ম খুলে রেখে স্যান্ডেল গেঞ্জি টা খোলার জন্য মাথার উপর তুলতেই পরিচিত একটা কন্ঠ ভেসে এলো। কোমল মেয়েলি কন্ঠে কেউ বলে উঠলো।
–আপনার পানি।

শাকিল ভ্রু কুঁচকে মাথার উপর তোলা গেঞ্জি টা আবার চোখের নিচ পর্যন্ত নামিয়ে ঝট করে পেছনে ফিরে তাকালো। পানি হাতে ছায়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বড়সড় একটা ধাক্কা খেল সে। ওই অবস্থায়ই ছায়ার সামনে এগিয়ে এসে অবাক সুরে বললো।
–আমি কি এখনও ঘুমিয়ে আছি?

ছায়া কপাল কুঁচকে বললো।
–জ্বিহ?

শাকিল আস্বস্ত হলো সে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে না। ছায়া সত্যিই এখানে দাঁড়িয়ে আছে। এটাতো মেঘ না চাইতেই সোজা বন্যা হয়ে গেছে। শাকিলের মনে আতসবাজি ফুটছে। সে বাঁকা হেসে বললো।
–তুই তো দেখছি বউয়ের রোলে একেবারে ফিট হয়ে গেছিস। কি সুন্দর স্বামীর জন্য পানি নিয়ে এসেছিস। মনডা এক্কেরে গার্ডেন গার্ডেন হইয়া গেল।

ছায়া ছিটকে উঠে বললো।
–কি আবোলতাবোল বলছেন এসব? মোটেই না। আমি চাচীর কাছে এসেছিলাম একটা দরকারে।চাচী কাজ করছিল তাই আপনার পানি চাওয়ার কথা শুনে চাচী আমাকে বললো একটু পানি নিয়ে আসতে। তাই এনেছি। আর কিছুনা।

–ও আচ্ছা। কিন্তু আমার তো এখন পানি খাওয়ার ইচ্ছে মিটে গেছে। আমার এখন একটু চা খেতে ইচ্ছে করছে।

–হ্যাঁ তো আমাকে কেন বলছেন? চাচীকে গিয়ে বলুন।

–এই তুই কেমন নির্দয় মেয়ে রে? একজন বয়স্ক মানুষকে তুই এইসময় খাটুনি করাবি? তোর কি বিবেক বুদ্ধি সব ভাঙ্গাচুরা ওয়ালার কাছে বিক্রি করে দিয়ে পাপর কিনে খেয়ে ফেলেছিস? তোর মাঝে কি মায়া মমতার সফটওয়্যার নেই? ছিঃ ছিঃ ছিঃ তোর কাছ থেকে অন্তত এমনটা আশা করিনি।

শাকিলের কথায় বোকা ছায়ার মনে আইফেল টাওয়ার সমান অপরাধ বোধের জন্ম হলো। সত্যি তো, এই বয়সে চাচীকে কিভাবে সে কাজের কথা বলতে পারলো। সাথে শাকিলের জন্যেও তাঁর মনে হঠাৎই শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হলো। মায়ের জন্য কতটা ভাবেন উনি। নাহ্ যতটা খারাপ ভেবেছিলাম ততটা খারাপ বলা যায়না উনাকে। ভাবনার ইতি টেনে ছায়া বললো।
–হ্যাঁ আপনি ঠিকই বলেছেন চাচীকে বলা ঠিক হবে না। তাহলে কে আনবে আপনার চা?

–কেন? তুই কি মানুষ না? নাকি মঙ্গলগ্রহের এলিয়েন তুই? তুই বানিয়ে আন চা।

–আমি?

–হ্যাঁ তুই। যা সুন্দর করে এককাপ চা বানিয়ে নিয়ে আয়। আমি ততক্ষণে গোসল সেরে আসি।
ছায়ার চা বানানোর ইচ্ছা না থাকলেও ভদ্রতার খাতিরে এখন রাজি হয়ে চা বানাতে চলে গেল ও। শাকিল মুচকি হেঁসে বিড়বিড় করে বললো।
–আমার বলদি টা..

কিছুক্ষণ পর চা বানিয়ে শাকিলের রুমে এসে দেখলো শাকিল গোসল করে বের হয়েছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঝাড়ছে। হঠাৎ করেই যেন চোখের দৃষ্টি শাকিলে আবদ্ধ হয়ে গেল ছায়ার। শাকিলকে আগে কখনো ও ভালো করে চেয়ে দেখেনি। শ্যামবর্ণ গায়ের রঙ। পুলিশে থাকায় শরীরের গঠনও পেটা। বাড়তি কোন মেদ নেই। লম্বা সরু মুখখানা, নাকটাও একেবারে চোখা। মনে হয় নাক দিয়ে কাউকে খোঁচা দিলে কেটে যাবে। গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। মাথার চুলগুলো কেমন শক্ত খাঁড়া খাঁড়া। গোসল পরও সেগুলো ঘাঁড় তেড়ার মতো দাঁড়িয়েই আছে। যেন নিচু হলে তাঁদের সম্মানে হানি পড়বে। সব মিলিয়ে লোকটাকে সুদর্শনের আওতায় রাখা যায়।

শাকিল পাশে ফিরে তাকাতেই ছায়াকে তাকিয়ে থাকতে দেখলো। বাঁকা হেসে ধীরে ধীরে ছায়ার কাছে এগিয়ে এলো সে। তারপর ছায়ার কানের কাছে ঝুঁকে আস্তে করে বললো।
–তোর নজরের তীর দিয়ে কি আমার ভেতর ছেদ করে ফেলবি?

শাকিলের কথায় থতমত খেয়ে গেল ছায়া। লজ্জাজনক একটা পরিস্থিতিতে পড়ে গেল হঠাৎই।তড়িঘড়ি করে হাতের চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে বললো।
–আ আপনার চা। আমি গেলাম।

বলেই সে যেতে উদ্যোত হলো। তবে শাকিল তার আগেই ছায়ার হাত টেনে ধরলো। টেনে ধরে বললো।
–কোথায় যাচ্ছিস? আমার চা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তুই এখানেই থাকবি।

ছায়া কম্পিত স্বরে বলে উঠলো।
–আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যা হয়ে গেলে বাড়িতে সবাই রাগ করবে।

–ঠিক আছে যাবি তবে একটা শর্ত আছে। শর্ত মানলে তবেই যেতে দিবো। নাহলে কিন্তু রাত পর্যন্ত আটকে রাখবো তোকে।

–কি শর্ত?

–এখন থেকে রোজ এই সময়ে আমাদের বাড়িতে আসবি তুই। বল রাজি?

–কেন?

–কেন জানতে হবে না তোকে।রাজি কিনা বল। তানা হলে আজ বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা ভুলে যা।

–ঠিক আছে।

–সত্যি তো?

–সত্যি।

–আচ্ছা যা তাহলে। কাল কিন্তু তোর অপেক্ষা করবো আমি।

হাতের বাঁধন ঢিলা হতেই দৌড়ে বেড়িয়ে গেল ছায়া। হাসলো শাকিল। তাঁর বলদিটা বোধহয় একটু চালাক হচ্ছে।
__

আতঙ্ক আর অস্থিরতার মাঝে সারা দিন পার করলো পঙ্খি। কোন কিছুতেই মন বসাতে পারছেনা সে। ইন্ধনকে সে কতবার করে অনুরোধ করলো আজ বাইরে না যেতে। কিন্তু সে শুনলোই না ওর কথা। তারমতে পঙ্খি অযথা চিন্তা করছে। আর সেইকারণে কাজ ফেলে ঘরে বসে থাকাটা নেহাৎই বোকামি ছাড়া আর কিছুই না। পঙ্খি তাঁকে কোনমতেই বেঝাতে পারছে না যে,তাঁর ওপর কতবড় বিপদ ঘুরছে। ইন্ধন বাড়ি ফেরা পর্যন্ত সে শান্তি পাচ্ছে না কিছুতেই।

রাত এগারোটার পর পঙ্খির অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ইন্ধন বাড়ি ফিরলো। ডাইনিং টেবিলে বসে ইন্ধনের অপেক্ষা করছিলো পঙ্খি। আজ তাঁর খুব রাগ হচ্ছে ইন্ধনের ওপর। ওঁকে এতো চিন্তায় ফেলে মাত্র ফিরছেন উনি। লোকটার সাথে আজ কথাই বলবেনা পঙ্খি। সেই মনোভাব নিয়েই দরজা খুললো সে। পঙ্খিকে দেখেই অমায়িক হাসলো ইন্ধন। কিন্তু তাঁর এই হাসি আজ পঙ্খির ওপর প্রভাব ফেলতে পারলোনা। পঙ্খি কোন প্রতিক্রিয়া না দিয়ে থমথমে মুখে ওখান থেকে সরে আসলো। রান্নাঘরে ইন্ধনের জন্য খাবার গরম করতে গেল সে। ইন্ধন ফ্রেশ হয়ে এসে খাবার টেবিলে বসলো। পঙ্খি কোনকিছু না বলে চুপচাপ ইন্ধনের খাবার বেড়ে দিতে লাগলো। ইন্ধন বুঝতে পারছে পরিস্থিতি গরম আজ। ম্যাডাম আজ সেই লেভেলের রেগে আছে। পঙ্খি খাবার বেড়ে দিয়েই ওখান থেকে চলে যেতে লাগলো। কিন্তু এগুতে পারলোনা পঙ্খি। ইন্ধন পঙ্খির হাত ধরে টেন মেরে নিজের কোলে বসিয়ে দিলো। পঙ্খি ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করতে লাগলো। ইন্ধন আরও শক্ত করে ধরে বললো।
–কি হয়েছে? এমন কেন করছ? সারাদিন পর কি তোমার এই গোমড়া মুখ দেখবো আমি?

পঙ্খি অভিমানি সুরে বললো।
–আমার হাসি কান্না দিয়ে আপনার কি হবে? আমার কোন কথার কি আপনার কাছে কোন দাম আছে? যা খুশি তাই করুন।

–বাপরে এতো রাগ? তো এই অধমের অপরাধ কি জানতে পারি? তোমার কথামতো ঘরে বসে থাকিনি এটাই কি আমার অপরাধ? আচ্ছা তুমিই বলো কতক্ষণ আমি ঘরে থাকবো। তোমার মনের একটা মিছে ভয়ের জন্য কি আমি কাজকর্ম ফেলে ঘরে বসে থাকবো? প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা করো। আমারও অনেক দায়িত্ব আছে। এভাবে ঘরে বসে থাকলে কি চলবে আমার? আর কতদিনই বা থাকবো বলো? একসময় না একসময় তো আমাকে বের হতেই হবে তাইনা?

পঙ্খি হঠাৎ ঘুরে ইন্ধন কে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো।
–জানি না আমি। কিচ্ছু জানি না। শুধু জানি আপনার কিছু হয়ে গেলে বাঁচবো না আমি। আপনি আমার বেঁচে থাকার উৎস। আপনার একটুখানি ক্ষতিও জান নিয়ে নিবে আমার। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে আমার।

ইন্ধন দুই হাতে পঙ্খির মুখটা আগলে ধরে মাথা ঝুকিয়ে পঙ্খির নোনাজল অধর দ্বারা শুষে নিলো। তারপর ললাটে চুমু এঁকে দিয়ে বললো।
–আমার রাজরাণীর কাছ থেকে তার রাজকুমার কে কেউ আলাদা করতে পারবেনা।মানুষ মরণশীল। একদিন না একদিন সবাইকেই মরতে হবে। সেই মওত যেকোনো সময় আসতে পারে। তাই বলে কি সেই ভয়ে আমরা বেঁচে থাকাই ভুলে যাবো? তবে আল্লাহ না চাওয়া পর্যন্ত কারোর মরণ হয়না।তাই মন থেকে এসব ভয় দূর করে দাও। তুমি কি জানো তোমাকে এভাবে দেখে আমার কতটা খারাপ লাগে? । এসব অযথা চিন্তা করে নিজেও কষ্ট পাচ্ছ আর আমাকেও কষ্ট দিচ্ছ। আমার হাতে থাকলে আমি দুনিয়ার সব নেগেটিভিটি থেকে তোমাকে অনেক দূরে নিয়ে যেতাম। আমার রাজরানীকে আমি সমসময় খুশি দেখতে চাই। প্লিজ না সোনা, একটু হাসো না। নাহলে যে খাবারও গলা দিয়ে নামবে না আমার।

পঙ্খির মন থেকে না আসলেও ইন্ধনের মন রাখতে জোরপূর্বক হাসলো সে। ইন্ধন মুচকি হেঁসে বললো।
–দ্যাটস লাইক মাই গুড গার্ল। চলো এখন খাইয়ে দাও আমাকে।

পঙ্খি ভাত বেড়ে ইন্ধন কে খাইয়ে দিলো। ইন্ধনও নিজের হাতে খাইয়ে দিলো পঙ্খিকে।
___

রাত গভীর মধ্য প্রহর তখন। ঘুমে আচ্ছন্ন ধরনী। পঙ্খিকে জাপ্টে ধরে গলায় মুখ গুঁজে দিয়ে পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে ইন্ধন। পঙ্খির হাত ইন্ধনের চুলের মাঝেই এখনো। চুলে হাত বোলাতে বোলাতেই ঘুমিয়ে গেছে সে। ঘুমের মাঝেই স্বাভাবিক ভাবে একটু ঘুম হালকা হয়ে এলো পঙ্খির। অন্য কাতে শোবার জন্য চোখ মেলে তাকাতেই আতঙ্কে চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল পঙ্খির। ওর চোখের সামনেই কেউ ধারালো ছু,রি তাক করে আছে। এখুনি গেঁথে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছু,রি ধরে থাকা মানবটা। অন্ধকারে কেবল তাঁর হাতটাই দেখা যাচ্ছে। মরণঘাতী আক্রমণ বুঝতে পেরে পঙ্খি উচ্চস্বরে চিৎকার দিয়ে উঠলো।

চলবে…..

#মৃগতৃষ্ণা—৩০
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★পঙ্খির চিৎকার শুনে ধড়ফড়িয়ে উঠলো ইন্ধন। পঙ্খির দিকে তাকিয়ে দেখলো সে চোখ বন্ধ করে ভয়ে কাঁপছে। ইন্ধন ঘাবড়ে গিয়ে পঙ্খির মুখটা ধরে বললো।
–হেই পঙ্খি, কি হয়েছে? চোখ খোল। কি হয়েছে সোনা?

পঙ্খি এবার চোখ খুলে তাকালো। কিন্তু সেই চা,কু বা চা,কুওয়ালা ব্যাক্তি কাউকেই দেখতে পেল না সে। আতঙ্কিত হয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো সে। ইন্ধন আবারও বলে উঠলো।
–কথা বলো পঙ্খি কি হয়েছে তোমার? এমন করছ কেন?

পঙ্খি ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো।
–এ এখানে কেউ চা চাচাকু ধরে ছিলো। তোমাকে মারতে এসেছিল কেউ।

ইন্ধন কপাল কুঁচকে এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো।
–কি বলছ? এখানে তো কেউই নেই। তুমি বোধহয় কোন খারাপ স্বপ্ন দেখেছ।

–না না সত্যিই ছিলো এখানে কেউ। কেউ মারতে এসেছিল আপনাকে।আমার কথা বিশ্বাস করুন।
–আচ্ছা আচ্ছা ওঁকে শান্ত হও আগে। টেক এ ডিপ ব্রিথ।
পঙ্খিকে বুকের মাঝে জড়িয়ে নিলো ইন্ধন। মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করলো তাঁকে। কলিজা পুড়ছে ইন্ধনের। পঙ্খির এমন করুণ অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে কেউ তাঁর হৃদপিণ্ডে সত্যি সত্যিই শ’খানেক ছু,রি চালাচ্ছে।সবতো ভালোই ছিলো। হঠাৎ কি হয়ে গেল আমার প্রাণটার? এমন অস্বাভাবিক আচরণ কেন করছে সে? পঙ্খির এই হাল যে ইন্ধনের সহ্যশক্তির বাইরে। সে কিভাবে স্বাভাবিক করবে পঙ্খিকে?

কিছুক্ষণ পর পঙ্খি একটু স্বাভাবিক হয়ে এলে ইন্ধন এক গ্লাস পানি এনে পঙ্খিকে খাইয়ে দিলো। তারপর মায়াবী কন্ঠে বললো।
–পঙ্খি তুমি সারাদিন মাথার ভেতর শুধু এইসব অযথা চিন্তায় ডুবে ছিলে তাই হয়তো স্বপ্নেও এসব দেখেছ। তাছাড়া আর কিছুই না। প্লিজ জান এসব চিন্তা ছেড়ে দাওনা। আমার সেই আগের লক্ষী হাসিখুশি বউটা হয়ে যাওনা। তোমাকে এভাবে দেখে আমি এমনিতেই মরে যাবো। তোমার এই অবস্থা আমার জান কেঁড়ে নিবে। এমন করোনা প্লিজ। তোমাকে এইভাবে দেখে ভয় হচ্ছে আমার। তোমাকে হারানোর ভয় হচ্ছে আমার। প্লিজ জান ছাড়োনা এসব অযথা চিন্তা। আমার আগের লক্ষীটি হয়ে যাওনা।

পঙ্খির কপালে চুমু দিয়ে বুকের মাঝে আগলে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে তাঁকে ঘুমা পাড়ানোর চেষ্টা করলো ইন্ধন। কিন্তু ইন্ধনের কোন যুক্তিই পঙ্খির গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস সে কোন স্বপ্ন দেখেনি। কেউ ছিলো এখানে। হয়তো আমার চোখ না খুললে এতক্ষণে সে তার কাজে সফলও হয়ে যেত। ভাবতেই কলিজা চিপে ধরছে। যে করেই হোক ওই শত্রুকে খুঁজে বের করতে হবেই। তবেই আমি আমার ইন্ধন কে রক্ষা করতে পারবো।
__

সারারাত আর দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি পঙ্খি। ভোরবেলার দিকে গিয়ে একটু ঘুম নেমেছে চোখে। যার ফলস্বরূপ আজ বেলা করে ঘুম ভেঙেছে পঙ্খির। ঘুম থেকে চোখ মেলে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো আট টা বেজে গেছে। চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল পঙ্খির। এতবেলা হয়ে গেছে? তাও ভালো ওর পিরিয়ডের সময় চলছে নাহলে তো নামাজ কাযা হয়ে যেত আজ। তড়িঘড়ি করে উঠতে নিলেই ইন্ধনের বাহুবন্ধনে বাঁধা পড়লো। ইন্ধন কে এখনো ঘুমাতে দেখে একটু অবাক হলো পঙ্খি। রোজতো ইন্ধন এই সময়ে উঠে যায়। সকাল সকাল তাঁর কতো কাজ থাকে। কিন্তু আজ এখনো ঘুমোচ্ছে? হয়তো কালরাতের কারণে ইন্ধনেরও দেরিতে ঘুম এসেছে। তাই হয়তো এখনও জাগনা পায়নি। কাল রাতের কথা মনে পড়তেই মনটা আবারও ভীত হয়ে গেল।ভারী মনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইন্ধনকে আলতো করে ঠেলে ডাক দিলো তাঁকে। ইন্ধন একটু নড়েচড়ে হাতের বাঁধন আরও শক্ত করে ঘুম জড়ানো গলায় বললো।
–উমমম,, কি হয়েছে? ঘুমুতে দাওনা।

–ঘুমাবেন মানে? আজ আপনার কাজ নেই কোনো? যাবেন না কোথাও?

–উহুম। আজ আমি কোথাও যাবোনা।

–মানে?

ইন্ধন এবার চোখ মেলে তাকিয়ে পঙ্খির মুখের ওপর ঝুঁকে মায়া ভরা কন্ঠে বললো।
–মানে আজ আমি আমার রাজরানীর সাথে থাকবো। আজকের দিনটা আমার বউটার নামে।ব্যাস্ততার কারণে বউটাকে একটু সময় দিতে পারি না আমি । তাই সব সুদে আসলে পুষিয়ে দেব আজ। আজকের পুরো সময়টা আজ তোমার সাথেই কাটাবো আমি।নো কাজ, অনলি রোমাঞ্চ।

বলতে বলতেই ইন্ধন তাঁর কাজ শুরুও করে দিলো। পঙ্খির গলায় মুখ ডুবিয়ে ছোট ছোট শিহরণে ভরিয়ে দিতে লাগলো। পঙ্খি কেঁপে উঠে বললো।
–কি কিকরছেন? ছাড়ুন। সকাল হয়ে গেছে। উঠতে হবে আমাকে।

–হবেনা উঠতে। আজ সারাদিন এই রুমেই বন্দী থাকবো আমরা। ♬ হাম তুম এক কামরে মে বান্ধ হো, অর চাবি খো যায়ে।

পঙ্খি বুঝলো ইন্ধন এভাবে ছাড়বেনা।দুষ্টু ইন্ধনকে ছাড়াতে নিজেও কিছু দুষ্টু পন্থা অবলম্বন করলো। ইন্ধনের কোমড়ে দুই আঙুল দিয়ে শুরশুরি দিলো। সাথে সাথেই ইন্ধন হেঁসে উঠে মোচড়াতে লাগলো। সেই সুযোগে পঙ্খি ফট করে উঠে গেল। ইন্ধন ব্যাপার টা বুঝতে পেরে পঙ্খির দিকে তাকাতেই পঙ্খি জিব বের করে ভেঙালো ইন্ধনকে। ইন্ধনও ছাড়ার পাত্র নয়। সেও প্রতিশোধ নিতে উদ্যোত হলো। উঠে পঙ্খির দিকে যেতে যেতে বললো।
–তবেড়ে,, দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা।
ইন্ধনকে উঠতে দেখে পঙ্খি বাঁচার জন্য দৌড়ালো। ইন্ধনও দৌড়ালো তাঁর পিছে। দুজন হাসতে হাসতে ঘরের মাঝেই গোল গোল ঘুরে দৌড়াতে লাগলো। সোফার কাছে এসে সোফার ছোট বালিশগুলো উঠিয়ে ইন্ধনের দিকে ছুঁড়ে মারলো পঙ্খি। ইন্ধন সেগুলো এক এক করে ক্যাচ করে নিলো। তারপর আবার ছুটতে লাগলো পঙ্খির পেছনে। পঙ্খি সামনে সামনে আর ইন্ধন পেছনে। একসময় ধরে ফেললো পঙ্খিকে।পেছন থেকে পঙ্খির কোমড় পেঁচিয়ে ধরে তাকে তুলে নিয়ে বিছানায় ফেললো। তারপর পঙ্খিকে ইচ্ছেমতো শুরশুরি দিতে লাগলো। পঙ্খি হাসতে হাসতে ছটফট করতে লাগলো। হাসতে হাসতে একসময় দমই প্রায় বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো। ইন্ধন তখন বন্ধ করলো শুরশুরি দেওয়া। হাপাতে লাগলো পঙ্খি । ইন্ধন পঙ্খির কপালে চুমু এঁকে দিলো। এটাই তো ও চাচ্ছিল। পঙ্খিকে হাসিখুশি দেখতে। পঙ্খির এই হাসি মুখটার জন্য সব করতে রাজি ইন্ধন।

ইন্ধনের কথা অনুযায়ী সে আজ সারাদিনই পঙ্খির সাথেই থেকেছে। ইন্ধনের সাথে দুষ্টু মিষ্টি মুহূর্তের মাঝে দিনটা কখন পার হয়ে গেছে বোঝাই যায়নি। হাসি আনন্দে পঙ্খির মনটাও প্রফুল্ল হয়ে গেছে। ইন্ধনের শত্রুর কথাটাও আর মনে আসেনি। এমনকি কাল রাতের ঘটনার কথাও প্রায় ভুলে গেছে সে। যথারীতি রাতের খাবার শেষে নিজেদের রুমে আসে পঙ্খি আর ইন্ধন। রুমে এসে কিছু মেইল চেক করার জন্য ল্যাপটপ নিয়ে বের করে ইন্ধন। পঙ্খির মন ভালো করতে আজ আর কোন কাজে যায়নি ইন্ধন। এমনকি কারোর ফোনও ধরেনি। তাই এখন একটু মেইল চেক করবে, দরকারি কোন মেইল এসেছে কিনা দেখবে । কিন্তু ল্যাপটপ খুলতেই দেখলো ল্যাপটপে চার্জ নেই। ল্যাপটপের চার্জার খুজে চার্জিংয়ে দেওয়ার জন্য প্লাগ লাগাতে গেল সে। ওইমুহূর্তে পঙ্খি কফির মগ হাতে রুমে ঢুকে। ইন্ধন কে কফির মগটা দেওয়ার জন্য এগিয়ে যেতেই দেখলো ইন্ধন যে লাইনে চার্জার লাগাতে যাচ্ছে সেই লাইনের আরেক মাথায় কারেন্টের তার লিক হচ্ছে আছে। আর সেখান থেকে ছিরছির করে হালকা কারেন্ট ফায়ার হচ্ছে। ইন্ধন প্লাগ লাগানোর সাথে সাথেই শক লাগবে তার। এই দৃশ্য দেখেই পঙ্খির হাত থেকে কফির মগ ঠাস করে পড়ে গেল। সে আৎকে উঠে চিল্লিয়ে বললো।
–ইন্ধনননননন……..

ইন্ধনের হাত প্রায় প্লাগের কাছাকাছি। তখনই পঙ্খির চিল্লানিতে ঘাবড়ে গিয়ে পেছনে ফিরে তাকালো সে। পঙ্খি দৌড়ে এলো ইন্ধনের কাছে। হাতের চার্জার টা ছিনিয়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেললো ফ্লোরে। পাগলের মতো ইন্ধনের মুখ মাথা হাত চেক করতে করতে আতঙ্কিত কন্ঠে বললো।
–আ আপনি ঠিক আছেন? কিছু হয়নি তো আপনার? লাগেনি তো কোথাও?

পঙ্খির এমন অস্বাভাবিক আচরণ দেখে ইন্ধন চিন্তিত সুরে বললো।
–কি হয়েছে পঙ্খি? শান্ত হও। আর আমার কি হবে? আমিতো একদম ঠিক আছি?

পঙ্খি কারেন্টের তার দেখিয়ে ভয়ার্ত কন্ঠে বললো।
–ও ওওই দেখুন। আপনি প্লাগে চার্জার লাগালেই শক লাগতো আপনার।

ইন্ধন দেখে বললো।
–ওকে ওকে ঠিক আছে। কিন্তু তুমি ভয় পেয়না। দেখ আমিতো ঠিক আছি। তুমি আমাকে ঠিক সময়ে বাঁচিয়ে দিয়েছ। আর ভয় পেয়না ওকে। এখন একটু শান্ত হও।

পঙ্খিকে বুকের জড়িয়ে নিলো ইন্ধন। কিন্তু পঙ্খির মাথায় অন্য চিন্তা ঘুরছে। ওর জানামতে এই তারটা কিছুক্ষণ আগেও ঠিক ছিলো। তাহলে হঠাৎ এটা লিক হলো কেমন করে? তারমানে আমরা যখন খেতে গিয়েছিলাম ওইসময় কেউ ঘরে এসে এই কাজ করেছে। কিন্তু ইন্ধন কে এই কথা বললে ও হয়তো আবারও আমার ভুল ধারণা বলবে। তাই আর ইন্ধনকে কিছু বললোনা পঙ্খি। আগে শত্রুকে খুঁজে বের করতে হবে। তারপরই ইন্ধন ওর কথা বিশ্বাস করবে।
__

সকাল থেকেই পঙ্খি শত্রুকে খুঁজে বের করার প্রচেষ্টায় লেগে পড়লো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। রান্না করতে এসে চুমকিকে দেখলো পঙ্খি।কিছু একটা ভেবে পঙ্খি চুমকির এমনি নানানরকম কথা বলতে লাগলো। কথার ছলে কৌশলে পঙ্খি জিজ্ঞেস করলো।
–আচ্ছা চুমকি কাল রাতের খাওয়ার সবাই কি ছিলো? নাকি কেউ অনুপস্থিত ছিলো? না মানে কাল সবাই খেয়েছে তো?

চুমকি স্বাভাবিক ভাবেই বললো।
–হ ব্যাহি তো খাইলো ।

পঙ্খি হতাশ হয়ে চলে আসতে নিলে চুমকি আবার বলে উঠলো।
— ও মনে পইরছে, চেয়ারম্যান চাচা খাইছিলো না কাইল। কইলো হ্যার প্যাটে নাহি গ্যাস্টিক হয়ছে। তাই খাইবো না। আর বড়ো চাচীতো হ্যার ঘর থেহে বাড়ায়ই না। তারে তো যাইয়া খাওন দিয়া আসা লাগে। ছোট চাচী গিয়া হ্যারে খাওয়ায় দিয়া আসে। ব্যাস তাছাড়া আর সবাই একসাথেই খাইছিলো।

চুমকির কথায় পঙ্খির প্রথম সন্দেহ গেল সামছুল মজুমদারের ওপর। তবে কি উনিই মারতে চায় ইন্ধন কে। কিন্তু কেন? না না আগেই কোন সিদ্ধান্তে যাওয়া উচিত নয়। আগে সম্পূর্ণ প্রমাণ পেতে হবে। তারপরই কোন ফয়সালায় যাওয়া উচিত হবে। সারাদিন এভাবে আরও কিছু সূত্র খুঁজলো পঙ্খি। যার দ্বারা আসল অপরাধী পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। কিন্তু তেমন কোনো পোক্ত প্রমাণ হাতে এলো না পঙ্খির। সন্দেহের বেড়াজাল স্পষ্ট হলোনা।

অভ্যাসগত ভাবে বিকালে ছাঁদে এসেছিল পঙ্খি। কিছুক্ষণ প্রকৃতির শীতল পবন অনুভব করে আবারও নিচে নেমে এলো সে। করিডর দিয়ে যেতে নিলে জাহানারার রুমের সামনে এসে থেমে গেল পঙ্খি। জাহানারার একটু খোঁজখবর নেওয়ার জন্য তাঁর রুমে প্রবেশ করলো সে। রুমে ঢুকে দেখলো জাহানারা খাটের কোনায় মাথা এলিয়ে দিয়ে মলিন হয়ে আসে। জাহানারাকে এভাবে দেখে মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল পঙ্খির। শোকে শোকে এই মানুষটার কি হাল হয়েছে। বেঁচে থেকেও যেন মরার মতো হয়ে গেছে সে। চুলগুলো কেমন জটলা পাকিয়ে গেছে। মনে হয় কতদিন চিরুনি দেয়নি চুলে। পঙ্খি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ড্রেসিং টেবিলের ওপর থেকে নারিকেল তেলের বোতল আর চিরুনি নিয়ে এলো। তারপর জাহানারার কাছে এসে বললো।
–নিজের কি অবস্থা করেছেন? আসেন আপনার চুলগুলো একটু গুছিয়ে দেই আমি।

জাহানারা মাথা নেড়ে না করলো। কিন্তু পঙ্খি মানলোনা। জাহানারার হাত ধরে তাকে সোজা করে বসিয়ে দিলো। তারপর মাথায় তেল দিয়ে দিতে লাগলো। তেল দিতে দিতে বললো।
–আর কতদিন এভাবে থাকবেন আম্মা? যে যাবার সেতো চলেই গেছে। তাই বলে কি আপনি নিজেও বেঁচে থাকা ভুলে যাবেন? আপনাকে এভাবে দেখে আমাদের সবারই খারাপ লাগে। একবার ছায়ার কথা ভাবুন। মেয়েটির মা থাকতেও সে কেমন অনাথের মতো হয়ে গেছে। তারজন্য হলেও নিজেকে একটু স্বাভাবিক করার চেষ্টা করুন।

জাহানারা ধরা গলায় বলে উঠলো।
–আমার কেন মওত হয়না? আমি কেন বেঁচে আছি? মা নামের কলঙ্ক আমি। মা হওয়ার জোগ্যাতা নেই আমার। এক ছেলেকে বাঁচাতে পারলাম না। সব জানা সত্বেও কিছু করতে পারলাম না। আর আরেক ছেলেকে অমানুষ হতে ঠেকাতে পারলাম না। যার ফল সে এভাবে পেল। তাহলে মরাতো আমার উচিত। আমি কেন বেঁচে আছি এখনো?
কথাগুলো বলে জাহানারা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। পঙ্খি তার মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক কষ্টে তাঁকে অনেকক্ষণ পর একটু শান্ত করলো। চুলগুলো আঁচড়িয়ে দিয়ে তাঁকে বিছানায় শুইয়ে দিলো। তারপর বেড়িয়ে আসতে নিলেই হঠাৎ পঙ্খির নজর গেল টেবিলের ওপর রাখা কারেন্টের কাজ করা টেস্টারের দিকে। থমকে গেল পঙ্খি। টেস্টার এখানে কি করছে? তবে কি এইটা দিয়েই কাল কারেন্টের তারের সাথে কারসাজি করেছিল? কিন্তু কে? সামছুল মজুমদার? ঘরটা যেহেতু তার তাহলে তো অন্য কারোর হওয়ার কথা না। তবে কি আমার সন্দেহই ঠিক? উনিই এসবের পেছনে? না না আমাকে আরও পোক্ত প্রমাণের দরকার। তার আগেই কোন সিদ্ধান্তে যেতে পারছিনা। টেস্টার তো এমনিও থাকতে পারে। এটা দিয়ে পরিস্কার কিছু বোঝা যাচ্ছে না। আমাকে শক্ত পোক্ত একটা প্রমাণ বের করতে হবে।
__

রাতে খাবার পর রোজকার অভ্যাস অনুযায়ী পঙ্খি ইন্ধনের জন্য কফি বানাতে এলো। মাথায় ওর এখনো শুধু ওইসব কথায় ঘুরছে। কিভাবে সে ওই শত্রুকে খুঁজে বের করবে সেটাই ভাবছে। হঠাৎ পঙ্খির মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। সেদিন কেউ ওর কফিতে মিশিয়েছিলো। তারমানে অপরাধী সবসময় ওদের কার্যকলাপের ওপর নজর রাখে। তাহলে নিশ্চয় এখনো দেখছে আমি কি করছি। সে সুযোগ পেলে আজও একই কাজ করতে চাইবে অবশ্যই। আর তখনই জানা যাবে কে সে। পঙ্খি মনে মনে সেই পরিকল্পনা করলো। সে কফির পাতিল চুলোয় রেখেই ধীরে ধীরে বেড়িয়ে এলো। যেতে যেতে একটু উচ্চস্বরে বললো।
–ওহ হো আমিতো ইন্ধন কে কলেজের কাগজে সই করানোর কথাই ভুলে গেছি। যাই আগে সই করিয়ে আসি। তারপর নাহয় কফি নিয়ে যাবো।

পঙ্খি সেই অজানা ব্যাক্তির উদ্দেশ্যে কথাগুলো শুনিয়ে শুনিয়ে বললো। তারপর নিজের রুমের দিকে গিয়ে আবার এক কোণায় লুকিয়ে রইলো। লুকিয়ে থেকে রান্নাঘরের দিকে নজর রাখলো। দেখলো কে যায় ওখানে। যেহেতু এখন সবাই খাওয়া দাওয়া শেষ করে রুমে চলে গিয়েছে তাই এখন আর অন্য কারোর যাওয়ার দরকার পড়বেনা। শুধুমাত্র সেই ব্যাক্তি ছাড়া। তাই এক কোণায় লুকিয়ে সে অপেক্ষা লাগলো। এবং একটু পরে কেউ ঢুকলো রান্নাঘরে। পঙ্খি ধীরে ধীরে পা টিপে টিপে রান্নাঘরের দরজার বাইরে এসে দাঁড়াল। তারপর উঁকি দিলো ভেতরে। আর যা দেখলো তাতে ওর পায়ের নিচের মাটি সরে গেল। নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছে না ওর। পঙ্খি দেখলো সেই কাঙ্ক্ষিত অপরাধীকে। যে আজও কফিতে বিষ মেশাচ্ছে। ইনিই তাহলে সেই ব্যাক্তি? এটা কিভাবে সম্ভব? পঙ্খি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল রান্নাঘরের ভেতর। পেছন থেকে বলে উঠলো।
–আপনি?????

সেই ব্যাক্তি চমকে পেছনে ফিরে তাকালো। পঙ্খিকে দেখে পিলে চমকে গেল তার। সে ভাবেনি এভাবে ধরা পড়ে যেতে হবে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here