মৃগতৃষ্ণা-৩

0
1085

#মৃগতৃষ্ণা—৩
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় মোমবাতি জ্বালানোর জন্য দিয়াশলাই নিতে রান্না ঘরে এসেছিল ইন্ধন।নিজের কাজ নিজেই করতে পছন্দ করে সে। তাই নিজেই এসেছিল। দিয়াশলাই নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই কারোর সাথে টক্কর লাগে তার।অপরিচিত এক মেয়েলী কন্ঠ শুনতে পেয়ে তাকে দেখার মনকামনায় দিয়াশলাই জ্বালিয়ে সামনে ধরে সে। আগুনের আলোয় সামনের মেয়েটির মুখাবয়ব দৃশ্যমান হয়। জ্বলন্ত আগুনের চেয়েও বেশি জ্বলজ্বল করছে মেয়েটার মুখ। আর তার চোখদুটো যেন আগুনের ফুলকি। আনমনেই ইন্ধনের মুখ থেকে বেড়িয়ে আসে।
–সুনয়না।

–জিহহ???

পঙ্খির কথায় ঘোর কাটে ইন্ধনের। দুই আঙুলের মাঝে রাখা কাঠির আগুন টাও জ্বলে ফুরিয়ে আসে। হালকা ছ্যাঁকা লাগে আঙুলে। ছিটকে নিচে ফেলে দেয় কাঠি টা। তৎক্ষনাৎ বিদ্যুৎ ফিরে আসে। আলোকিত হয় চারপাশ। পঙ্খি এবার পুরোপুরি ভাবে ইন্ধন কে দেখতে পায়। ছেলেটাকে যথার্থ একজন সুদর্শন যুবক বলা চলে। বিদেশে থাকায় কেমন ফরেনার দের মতো লাগে দেখতে। ইন্ধন পঙ্খির দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বললো।
–এই পিচ্চি কে তুমি? তোমাকে তো চিনতে পারলাম না।

পিচ্চি সম্বোধনে পঙ্খি একটু থতমত খেয়ে গেল। মাথার ওড়নাটা ভালো করে টেনে নিয়ে মৃদু স্বরে বললো।
–আ আমি পঙ্খি।

ইন্ধন মজা করে বললো।
–পঙ্খি? ওই গানের পঙ্খি তাহলে তুমি?

পঙ্খি ভ্রু কুঁচকে বললো।
–গান? কোন গান?

–আরে ওইযে ♬ ও আমার উড়াল পঙ্খিরে যা যা তুই উড়াল দিয়ে যা।

কথাটা বলে ইন্ধন হেঁসে উঠলো। পঙ্খি বুঝতে পারলো লোকটা তার নাম নিয়ে মজা করছে। ব্যাপার টা মোটেও ভালো লাগলো না পঙ্খির। সে কন্ঠে দৃঢ়তা এনে বললো।
–মোটেও না। আমি কারো গানের পঙ্খি না। আমার নাম পঙ্খি। আর এই নাম আমাকে আমার মা দিয়েছে। তাই দয়া করে নাম নিয়ে মজা করবেন না।

–উরে বাপরে পিচ্চির দেখছি হেব্বি তেজও আছে। ভয় লাগছে আমার। দেখ আবার যেন ভস্ম করে দিওনা আমাকে। আচ্ছা বায়দা ওয়ে তুমি কে সেটা কিন্তু এখনো বললে না? আর এখানে কি করছ? কানামাছি খেলতে খেলতে হারিয়ে গেছ বুঝি?

নিজের ওপর এভাবে পরিহাস করতে দেখে পঙ্খির খুব রাগ হচ্ছে। সে কিছু না বলে ওখান থেকে চলে যেতে নিলো। ইন্ধন আবারও পেছন থেকে বলে উঠলো।
–আরে পরিচয় না দিয়ে কোথায় যাচ্ছো?

পঙ্খি দাঁড়ালো। পেছনে না ঘুরে উল্টো দাঁড়ান অবস্থায়ই বললো।
–আমি আপনার মরহুম ভাইয়ের বিধবা।
এতটুকু বলেই আর দাঁড়াল না পঙ্খি। দ্রুত হেঁটে প্রস্থান করলো ওখান থেকে। ইন্ধন অবাক চোখে পঙ্খির যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না এতটুকু একটা পিচ্চি মেয়ে কিনা কারোর বিধবা।

রাতে ডিনার টেবিলে বসেছে সবাই।লেখিকা-মেহরুমা নূর। রাবেয়া তার ছেলের পছন্দের সব পাকোয়ান এনে টেবিল ভর্তি করে দিয়েছে। নিজ হাতে এক এক করে সব তার মুখে তুলে দিচ্ছে। ইন্ধন মায়ের পানে তাকিয়ে করুন সুরে বললো।
–বাচ করো মা। আর খেলে বেলুনের মতো ফটাস করে ফেটে যাবো। চৌদ্দ বছরের সব খাবার কি একদিনেই খাওয়াবে নাকি?

–আরে কি কইস গেদা (সিরাজগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষায় ছেলেমেয়েদের আদর করে গেদা গেদি ডাকে) ? কিছুই তো খাসনি এখনো। না খেয়ে খেয়ে কেমন শুঁকিয়ে কাঠ হয়ে গেছিস৷ আহারে আমার গেদাডো এতবছর মাও ছাড়া কিভাবে থাকছে।

পঙ্খি পাশেই দাঁড়িয়ে খাবার সার্ভ করছিল। এতবড় ছেলেকে এভাবে গেদা গেদা করতে দেখে তার প্রচুর হাসি পাঁচ্ছে। সে নাকি শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। কই সেতো কাঠখড়ির মতো কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। বরং তার সু বলিষ্ঠ দেহ তো আমাদের গ্রামের পালোয়ানকেও হার মানবে। অনেক কষ্টে সে নিজের হাসি চেপে রেখেছে। তবে ছায়া নিজের ইমোশন মোটেও চেপে রাখলো না। গরুর মাংস চিবুতে চিবুতে দাঁত বের করে বললো।
–হ্যাঁ হ্যাঁ গেদা খাও খাও বেশি করে খাও। আহারে গেদা কতো শুঁকিয়ে গেছে। একেবারে শুঁকিয়ে বাহুবালি হয়ে গেছে।

ইন্ধন ছায়ার দিকে তাকিয়ে বললো।
–বড়ো ভাইয়ের সাথে মজা নিচ্ছিস? দাঁড়া দেখাচ্ছি তোর ওপর দয়া দীক্ষা করে যে গিফট আনছিলাম সেটাও আর পাবিনা তুই।

–আরে না না কি বলো ভাই, এমন করোনা। তুমি না আমার ভালো ভাই।

–যা ভাগ।

খোদেজা বলে উঠলো।
–ক্যারে দাদাভাই আমকও কি ভুইলা গেলি নাহি? তা আমার লাইগা কি কিছু আনছু?

–আরে কিযে বলো দাদী। তোমাকে কি আমি ভুলতে পারি নাকি? তুমকি আমার ফাস্ট লাভ।মাই ডার্লিং। তোমার জন্য স্পেশাল গিফট আছে। তোমারে পার্সোনালী দিবোনে।

কথাবার্তার মাঝে ইন্ধন খেয়াল করলো ওর চাচী জাহানারার মুখটা কেমন মলিন। ইন্ধন বিষয় টা বুঝতে পারলো। সে হঠাৎ সামছুল মজুমদারের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো।
–আচ্ছা চাচা আমিতো দেশে ছিলাম না। নাঈমের খবর পেয়ে আমি খুব ভেঙে পড়েছিলাম। আমার বিশ্বাসই হচ্ছিল না। আসলে এসব হলো কিভাবে? আচমকা ওর মৃত্যু ঘটলো কিভাবে?

ইন্ধনের কথায় পরিবেশ টা হঠাৎ থমথমে হয়ে গেল। সবাই খাওয়া বন্ধ করে ইন্ধনের দিকে তাকালো। সামছুল মজুমদার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন।
–জানি না বাবা কি থেকে কি হয়ে গেল। ধুমধাম করে ছেলের বিয়ে করালাম। অথচ বাড়িতে আসতেই হঠাৎ জানতে পারলাম নাঈমের গাড়ি এক্সিডেন্ট করে নাকি নদীতে পড়ে গেছে। অনেক দিন খুঁজে লাশটাও পর্যন্ত পেলাম না।

জাহানারা বেগম আঁচলের কোনা দিয়ে চোখ মুছে নিলো। ছেলের শোক সে ভুলতে পারে না। ইন্ধন বলে উঠলো।
–কিন্তু বিয়ের দিন ও হঠাৎ কোথায় গিয়েছিল? আপনাদের কাওকে বলে গিয়েছিল না? কেউ জানতো না?

এবারে খোদেজা ঝাঁঝাল সুরে বলে উঠলো।
–জানতো তো। এইযে এই অপয়া ছেড়ি জানতো। ওর হামনেই নাঈম গাড়ি থাইকা নাইমা গেছিল। কিন্তু এই ছেড়ি কিচ্ছু কয়নায়। এই অপয়ার জন্যই আমার নাতীডা মইরা গেল। ওর অশুভ কদম ঘরে পড়তেই আমার নাতীডারে খাইয়া ফেললো।

–আহ্ দাদী কি বলছ এসব? এইসব শুভ অশুভ বলতে কিছু নেই। এগুলো সব কুসংস্কার। হায়াত মওত সব আল্লাহর হাতে। এতে কারোর কোন হাত নেই।

–ঠিকই কইত্যাছি। আমাক শিখাইব্যার আসিস না। আমার চুল রোদে পাহে নাই।

খোদেজার কথায় সায় দিয়ে জাহানারাও বলে উঠলো।
–ঠিকই তো বলছে আম্মা। সব এই অশুভ মাইয়াডার জন্যই হইছে। এই মাইয়ার কদম ঘরে পড়তেই আমার ছেলেটা চলে গেল।

ইন্ধন ওর পরিবারের চিন্তাধারা দেখে অবাক হচ্ছে। এই যুগেও এমন চিন্তাধারার লোক আছে? তাও আবার ওরই পরিবারে। ব্যাপার টা যেন হতাশাজনক। এদের কিছু বলে কোন কিছু বলে কোন লাভ হবেনা এতটুকু ভালোই বুঝতে পারলো ইন্ধন। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে একবার তাকালো পঙ্খির দিকে। মেয়েটা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। যেন সত্যি সত্যিই সে কোন অপরাধী।

এতক্ষনে জুবায়েদ প্রসঙ্গ পাল্টে বলে উঠলো।
–তা ইন্ধন এখন সামনে কি করবি ভেবেছিস? পড়ালেখা তো শেষ করলি। এখন কি করার ইচ্ছে তোর?

–মাত্রই তো এলাম ভাইয়া। কিছুদিন একটু রিলাক্স করবো। গ্রামে একটু ঘুরাঘুরি করবো। তারপর যা করি।

–তবুও কিছু তো একটা ভেবেছিস তাইনা?

–ভাবার কি আছে। বংশের সবাই যা করছে আমিও তাই করবো?

–মানে রাজনীতিতে যোগ দিবি?

–হ্যাঁ ভাইয়া। রাজনীতিতে যোগ দিতে চাই। ইউথ জেনারেশনের জন্য কিছু করতে চাই আমি। যারজন্য পাওয়ারের দরকার। আর রাজনীতিই আমাকে সেই পাওয়ার দিতে পারবে। রাজনীতিবিদ দের প্রতি মানুষের একটা নেগেটিভ ধারণা আছে। আমি সেই ধারণা টা পাল্টাতে চাই। মানুষকে দেখাতে চাই রাজনীতি আর রাজনীতিবিদরা সবসময় খারাপ হয় না।হ্যাঁ প্রয়োজনে অনেক সময় মারপিট সংঘর্ষ করতে হয়। তাই বলে সবাই খারাপ না। গ্রামের উন্নয়ন করতে চাই আমি।

সামছুল মজুমদার বললো।
–এটাতো অনেক ভালো কথা। বংশের পরম্পরা আগে বাড়াতে চাও এটা অনেক ভালো কথা।

এবারে জহির মজুমদার বলে উঠলো।
–হ্যাঁ রাজনীতি করতে চাও ভালো কথা। তাহলে তুমি বরং সিরাজগঞ্জ শহরে মেয়র পদে নমিনেশন দাও। ওখানে আমাদের বাংলোতে থাকবে তুমি।

আসার পর এপর্যন্ত জহির মজুমদারের সাথে একবারও কথা বলেনি ইন্ধন। তবে এবার না বলে থাকতে পারলোনা। ইন্ধন হাতের মুঠো শক্ত করে জহির মজুমদারের দিকে না তাকিয়েই কঠিন গলায় বললো।
–আপনার সমস্যা টা কি বলুন তো? সবসময় আমাকে বাড়ি থেকে তাড়ানোর ধান্দায় কেন থাকেন আপনি। এতবছর দূরে রেখেও আপনার সাধ মেটেনি? আবারও সরিয়ে দিতে চাচ্ছেন? আমাকে নিয়ে সমস্যা টা কি? আমাকে কি আপনি সহ্য করতে পারেন না নাকি?

–ইন্ধন!! বাপের সাথে কথা বলার তমিজ ভুলে গেছ তুমি? এসব কি ধরনের কথা?

ইন্ধনের রাগ বাড়তে লাগলো। সে আবারও কিছু বলতে যাবে তার আগেই রাবেয়া তার হাত চেপে ধরলো। মায়ের বাঁধা দেওয়ায় আর কিছু বলতে পারলোনা সে। রাগ ভেতরে দমিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হনহন করে চলে গেল ওখান থেকে। ইন্ধনের এমন রাগ দেখে পঙ্খি একটু অবাক হলো। লোকটা যে সেই লেভেলের রাগী তার হালকা আভাস পাচ্ছে সে। তবে নিজের বাবার সাথে এমন ব্যবহার তার পছন্দ হলো না। তারমতে বাবার সাথে এমন ব্যবহার করাটা তার অনুচিত হয়েছে।লেখিকা-মেহরুমা নূর।
__

রজনীর মধ্যভাগ তখন। গভীর তন্দ্রায় আচ্ছন্ন পঙ্খি। অতি সাবধানে দরজার নব ঘুরিয়ে অতি সাবধানে পা ফেলে নিঃশব্দে কেউ ভেতরে ঢুকলো। পা টিপে টিপে ধীরে ধীরে পঙ্খির বেডের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। আস্তে করে বিছানায় পঙ্খির পাশে বসলো। নেশাতুর চোখের ধারালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পঙ্খির দিকে। ঘুমের মাঝে পঙ্খির বুকের ওড়নাটা সরে গেছে। গলার নিচের কালো তিলটা দৃশ্যমান হয়ে আছে। তা দেখে শুঁকনো ঢোক গিললো আগন্তুক। হাত বাড়িয়ে ছুতে মন চাইলো তার। সাহস যুগিয়ে ধীরে ধীরে হাতটা এগিয়ে নিলো পঙ্খির দিকে। তখনই পঙ্খি একটু নড়েচড়ে উঠলো। আগন্তুক ঘাবড়ে গিয়ে দ্রুত উঠে বেড়িয়ে গেল। পঙ্খি কিছু একটার আভাস পেয়ে চোখ খুলে তাকালো। তার মনে হলো এখানে যেন কেউ ছিলো। ভয়ে গলা শুঁকিয়ে এলো তার। গায়ের ওপর কাঁথা টেনে জুবুথুবু হয়ে শুয়ে রইলো সে।কেমন যেন কান্না পাচ্ছে তার। সত্যিই কি এখানে কেউ এসেছিল? কিন্তু কে হতে পারে? নাকি আমিই ভুল ভাবছি?

রোজকার অভ্যাস অনুযায়ী প্রাতঃকালেই ঘুম থেকে উঠে পড়ে পঙ্খি।লেখিকা-মেহরুমা নূর। সালাত আদায় করে কিছুক্ষণ কোরআন তেলওয়াত করে সে। তারপর ঘরের মেঝে ঝাড়ু দিয়ে বাহিরে বের হয়। রান্না করার জন্য ফ্রেশ সবজি আনতে যায়। বাড়ির একপাশেই নানান রকমের সবজির বাগান আছে। পঙ্খি রোজ নিজ হাতে সবজি বাগানের যত্নে নেয়। এসব করতে তার অনেক ভালো লাগে। পঙ্খি প্রকৃতি প্রেমি মেয়ে। ছোট বেলায় বাবার সাথে খেতে গিয়ে বাবার সাথে কাজ করতো পঙ্খি। এখানেও বেশির সবজির বীজ সেই রোপণ করেছে। আজ সে নিজের গাছ লাউ শাক তুলতে এসেছে। সকাল সকাল লাউশাক ভর্তা দিয়ে গরম ভাত খাওয়ার মজাই আলাদা। লাউ গাছের ঝাড়ের নিচে গিয়ে লাউ গাছের কচি পাতাগুলো তুলছে। গাছে কয়েকটা লাউয়ের জালা এসেছে। পঙ্খির সেগুলো দেখে ভীষণ খুশি লাগছে। পঙ্খি খুশি হয়ে বলতে লাগলো।
–ইশশ কি সুন্দর লাগছে। আমার লাউগাছের প্রথম লাউ। এইগুলা বড়ো হলে বোয়াল মাছ দিয়ে রান্না করবো। কিরে তোরা কিসের সাথে যেতে চাস? বোয়াল নাকি টাকি?

–চিংড়ী মাছের সাথে।

পঙ্খি অবাক হয়ে বোকার মতো বললো।
–আরে? তোরা কথাও বলতে পারিস?

–শুধু কথা কেন? আমরা লুঙ্গি ডান্সও করতে পারি। করে দেখাবো?

পঙ্খির মনে হলো আওয়াজ টা ওর পেছন থেকে আসছে। পেছনে ঘুরে তাকাতেই ইন্ধনকে দেখে কিছুটা চমকে গিয়ে দুকদম পিছিয়ে গেল পঙ্খি। পঙ্খির এমন বোকার মতো চেহারা দেখে ইন্ধন হো হো করে হেসে দিলো। রোজকার অভ্যাস অনুযায়ী সকাল সকাল জগিং করতে গিয়েছিল সে। জগিং করে ফিরে আসতে নিলে পঙ্খিকে এভাবে একা একা কথা বলতে দেখে সে। কৌতুহল বশত সেদিকে এগিয়ে যায়। লাউয়ের সাথে কথা বলতে দেখে ইন্ধনও একটু মজা নেওয়ার চেষ্টা করে।পঙ্খি মাথার ওড়নাটা ভালো করে টেনে নিয়ে বললো।
–কি হয়েছে? এতো হাসার কি হলো?

ইন্ধন হাসি দমিয়ে বললো।
–কি আবার হবে? কিছুই না। আই মিন এভাবে লাউয়ের সাথে কথা বলাটা তো নেহাৎই সাধারণ ব্যাপার। এটাতো অহরহই ঘটছে। তাহলে আমার এতো হাসি পাচ্ছে কেন বুঝতে পারছিনা? তুমি কি বলতে পারো আমার কেন হাসি পাচ্ছে? বোধহয় আমিই পাগল হয়ে গেছি তাইনা?

লোকটা যে তাকে নিয়েই পরিহাস করছে তা ভালোই বুঝতে পারছে পঙ্খি। পঙ্খি আর এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে লাউয়ের শাক গুলো হাতে নিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে চলে এলো ওখান থেকে। ইন্ধন পেছন থেকে শুধু হাসতে লাগলো।

সকলে খাবার টেবিলে সকালের খাবার খাচ্ছে। লাউশাক ভর্তা দেখে ইন্ধনের তখনকার কথা মনে পড়ে গেল। ইন্ধন মৃদু হেসে একবার তাকালো পঙ্খির দিকে। সবাইকে খাবার পরিবেশন করছে সে। আসার পর থেকে মেয়েটাকে শুধু এই সাদা পোশাকেই দেখছে ইন্ধন। বিষয় টা কেমন যেন লাগলো ওর।সে সবার সামনেই পঙ্খির উদ্দেশ্যে বলে উঠলো।
–আচ্ছা তুমি সবসময় এই সাদা পোশাক কেন পড়ে থাকো? আর কোন জামাকাপড় নেই তোমার?

হঠাৎ এমন প্রশ্নে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো পঙ্খি। সে কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। লোকটা কি সত্যিই বোঝে না? নাকি ইচ্ছে করেই ওকে এমন পরিস্থিতিতে ফেলে? ইন্ধনের কথার প্রতিত্তোরে খোদেজা বেগম দাম্ভিকতার সহিত বলে উঠলো।
–এডো আবার ক্যাবা কথা কস তুই? বিধবা সাদা পোশাক পইরবোনা তো আবার কি পইরবো? বিধবা গো কোন রঙ চঙের পোশাক পড়তে নাই।

ইন্ধন অবিশ্বাস্য কন্ঠে বললো।
–লাইক সিরিয়াসলি? এই যুগে এসেও তোমরা এসব প্রথা মানো? আরে এসব পুরান প্রথা অনেক আগেই উঠে গেছে। ওর স্বামী মারা গেছে এতে ওর কি দোষ? এতটুকু একটা মেয়ে। ওরতো সামনে পুরো জীবন পরে রয়েছে। ও কেন সারাটা জীবন বেরঙ কাটাবে? এতে করে কি নাঈম ফিরে আসবে?

খোদেজা তেতে উঠে বললো।
–এহন কি তোর কাছ থেকে আমগো শেখা লাইগবো? দেখ তুই বিদেশে থাকছু। দেশের রীতিনীতির কথা তুই কি বুঝবি? মাইনষে কি হরলো না হরলো তা জানার দরকার নাই। আমরা আমাদের পূর্বের সব রীতিনীতি মাইনা চলি। আর তোর এতে কি সমস্যা? ও যা খুশি তাই পড়ুক। ওর জন্য এতো দরদ উথলায় উঠতাছে ক্যা তোর? তোর ভাবসাব সুবিধার মনে হইতাছে না আমার। কচি মাইয়া মানুষ দেইখা মন ছটফট করতাছে নাকি? হাজার হইলেও ব্যাটা মানুষ তো।

দাদীর এমন কুরুচিপূর্ণ বাক্য শুনে ইন্ধনের মেজাজ টাই গরম হয়ে গেল। ওর বাড়ির মানুষ যে এতো নিচু মনমানসিকতা বহন করে তা দেখে চরম হতাশ হলো সে। ইন্ধন ওর দাদীর উদ্দেশ্যে কিছু কঠিন বাক্য বলতে চাইলো। তবে তার আগেই সামছুল মজুমদার বলে উঠলো।
–ইন্ধন বাদ দাও এসব। বাড়ির মেয়েদের বিষয়ে নাক না গলানয় ভালো। মা এবাড়িতে সবার বড়ো। তাই তার কথা অমান্য করতে পারিনা আমরা। বাড়ির বউ ঝিয়ের বিষয় টা তাকেই দেখতে দাও।

সামছুল মজুমদারের যুক্তি মোটেও পছন্দ হলো না ইন্ধনের। তবুও চাচার মান রাখতে সে আর কিছু বললো না। আধা খাওয়া প্লেট রেখেই উঠে গেল। ইন্ধন যেতেই খোদেজা পঙ্খির ওপর দৃষ্টিপাত করলো। তাচ্ছিল্যের সুরে বললো।
–কিরে ছেড়ি, ভালোই তো জাল ফালাইছোস। রুপের মায়া দেখাইয়া আমার নাতীডারে হাত করার ধান্দায় আসোছ তাইনা? তয় আমি থাকতে তোর এই চাল চলবার দিমুনা।

–আহ্ মা কি বলছো এসব? বাদ দাও না।

সামছুল মজুমদারের কথায় খোদেজা একটু চুপ হলেন।লেখিকা-মেহরুমা নূর। পঙ্খি ধীর পায়ে ওখান থেকে সরে রান্নাঘরে চলে গেল। ইন্ধনের ওর জন্য কথা বলতে দেখে ওর ভালোই লেগেছে। কেউ তো তাও ওর কথা একটু ভাবলো। এই বেরঙ জীবন যে ওর নিজেরও ভালো লাগে না। রঙহীন জীবন কার কাছেই বা ভালো লাগবে। তবে আবার ভয়ও হচ্ছে। ইন্ধনের এই সহানুভূতি ওকে আবার কোন বিপদে না ফেলে দেয়।

সবাই চুপ হয়ে গেলেও, খোদেজার কথায় আরেকজনের মন মস্তিষ্কে ঠিকই শঙ্কারা এসে ঘর বাঁধলো। খোদেজার কথা যেন কোন ভাবেই বাস্তবে রুপান্তর না হয়। নাহলে যে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here