#মৃগতৃষ্ণা–৩৩,৩৪
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
৩৩
★সময়ের স্রোতে অতিবাহিত হয়েছে আরও একটি মাস। রাবেয়ার মৃ,ত্যু,র প্রায় দুই মাস হতে চলেছে। সবকিছু ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হলেও অনেক কিছুই যেন পরিবর্তন হয়ে গেছে পঙ্খির জীবনে। কোলাহলে ভরপুর বাড়িটা কেমন নিস্তব্ধ নগরীতে পরিণত হয়েছে। যেখানে নেই কোনো হাসি-আনন্দ বা কোলাহল। প্রয়োজন ছাড়া কেউ কারোর সাথে কথাও বলেনা তেমন। সবার মাঝেই এক অজানা আতঙ্ক কাজ করে। ভাবে হয়তো তাদের সাথেও কোনো অঘটন ঘটে যেতে পারে। গ্রামের মানুষ তো এখন মজুমদার বাড়ি নিয়ে নানান রকম কাহিনি রটিয়ে বেড়ায়। সবাই বলে এই বাড়িতে ভুতের বাস আছে। তাই সবার এমন মৃ,ত্যু হচ্ছে। এই ভয়ে গ্রামের লোকজন এখন এবাড়িতে আসতেও ভয় পায়। অতি প্রয়োজন ছাড়া কেউ এবাড়ির সীমানাও মারায় না। যেন এটা কোনো ভয়ংকর ভুত বাংলো।
তবে পঙ্খির চিন্তার মূল বিষয় এসব না। তাঁর চিন্তা চেতনার অধিকারী শুধুই একজন, “ইন্ধন”।বাকিসব কিছুর সাথে ইন্ধনও বদলে গেছে। এমনটাই মনে হয় পঙ্খির। রাবেয়ার মৃ,ত্যু,র পর থেকে ইন্ধন অনেক বদলে গেছে। কেমন ছাড়া ছাড়া ভাব তাঁর। সবসময় কেমন রুক্ষতা তাঁর মাঝে। আগের মতো পঙ্খির সাথে না ঠিক মতো কথা বলে, না পঙ্খির সাথে তেমন সময় কাটায়। বেশির ভাগ সময়ই বাড়ির বাইরেই থাকে। বাসায় তাঁকে তেমন পাওয়াই যায়না। ইন্ধনের এই পরিবর্তন পঙ্খিকে ভেতরে ভেতরে আহত করে দিচ্ছে। সে যতই ভাবে, ইন্ধন হয়তো ওর মায়ের মৃ,ত্যু,তে এমন হয়ে গেছে। হয়তো শোক কাটিয়ে উঠতে পারছেনা। মনকে এসব বলে বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করলেও, তবুও মন কেন যেন এই শান্তনার বাণী আর মানতে চায়না। না চাইতেও কলিজাটা পুড়ে তাঁর। মনে হয় যেন পঙ্খির রাজপুত্র ওর কাছ থেকে কেমন দূরে চলে যাচ্ছে। একই বাড়িতে থেকেও যেন তাঁদের মাঝে আজ শত মাইলের দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে না চাইতেও অনেক অভিমানের জন্ম হয় পঙ্খির মনে। হৃদয় কাঁদে তাঁর। আগের সেই ইন্ধনকে ফিরে পাওয়ার জন্য আকুল হয় মনটা।
বারান্দার গ্রীলে হেলান দিয়ে বসে বসে এসব ভাবনায় ডুবে ছিলো পঙ্খি। হঠাৎ ফোনের তীব্র আওয়াজে ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটে তাঁর। ফোনের আওয়াজে মলিন মুখে যেন এক চিলতে হাসি ফোটে। ইন্ধনের ফোন ভেবে ছুটে যায় ঘরের মাঝে। তড়িঘড়ি করে ফোনটা হাতে নিতেই হাসিমুখ টা বিলীন হয়ে যায় তাঁর। ইন্ধন ফোন করেনি। আননোন নাম্বার থেকে ফোন এসেছে। আশাহত হয় পঙ্খি। অজান্তেই চোখের কোনে জমে যায় নোনাজল। ফোনটা বাজতে বাজতে একসময় বন্ধ হয়ে যায়। একটু পর আবারও বেজে ওঠে সেটা। পঙ্খি নিজেকে একটু সামলে নিয়ে ফোন টা রিসিভ করলো। জানতে পারলো ওর বড়ো ভাই ফোন করেছে। এতদিন পর হঠাৎ ভাইয়ের ফোন দেখে একটু অবাকই হলো পঙ্খি। মনে পড়লো ইন্ধনের বলা সেই কথা। কীভাবে তাঁর নিজের আপন ভাই ওকে টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দিয়েছিল। ঘৃণায় বিষিয়ে উঠলো পঙ্খির মন। ভাবলো ফোন কেটে দিবে সে। তবে ভাইয়ের একটা কথা শুনে আর কাটতে পারলোনা ফোন। পঙ্খির ভাই ওঁকে জানালো পঙ্খির বাবা নাকি ভীষণ অসুস্থ। শয্যাশায়ী হয়ে গেছে সে। বারবার শুধু পঙ্খির নাম নিচ্ছে। পঙ্খির সাথে দেখা করতে চাচ্ছে। ভাইয়ের কথা শুনে হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠলো পঙ্খির। যেমনই হোক তবুও তো জন্মদাতা পিতা। তাই তাঁর এমন করুন অবস্থার কথা শুনে অস্থির হয়ে ওঠে পঙ্খি। পঙ্খি ওর ভাইকে বলে দেয় সে আজ এখুনি যাবে দেখা করতে। ফোন রেখে তড়িঘড়ি করে বোরখা টা পড়ে নেয় পঙ্খি। ভ্যানিটি ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বের হতে নিলেই মনে পড়লো ইন্ধনের কথা। যাওয়ার কথাটা তাঁকে একবার জানানো দরকার। ফোন বের করে ইন্ধনের নাম্বারে ফোন দিলো। কিন্তু দুই তিনবার কল করার পরও। ফোন রিসিভ হলোনা। আজকাল ফোনেও ইন্ধনকে পাওয়া যেন অসাধ্য হয়ে গেছে। ভীষণ রাগ হলো পঙ্খির। থাক দরকার নেই। তাঁর যখন আমার জন্য সময়ই নেই তাহলে আর তাঁকে আমার কথা জানিয়ে লাভ কী? এমনিতেও সে এখন আমাকে নিয়ে মাথা ঘামায় না। তাই কোথায় আছি না আছি সেটা নিয়েও হয়তো মাথা ঘামাবে না। তাই দরকার নেই। এই ভেবে পঙ্খি আর ফোন করলোনা। বাইরে এসেও তেমন কাউকে দেখতে পেল না যে,বলে যাবে। ছায়া জাহানারাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে। সামছুল আর জহির মজুমদারও বাইরে। বাড়িতে এই মুহূর্তে কেউই নেই। অগত্যা যাওয়ার আগে পঙ্খি শুধু চুমকিকে ডাক দিয়ে বলে গেল তার যাওয়ার কথা। তারপরই বেড়িয়ে পড়লো সে।
__
প্রায় এক বছর পর আজ বাপের বাড়িতে পা রাখলো পঙ্খি। বিয়ের পড়ে আর একদিনও এবাড়িতে আসা হয়নি তাঁর। আসার জন্য কখনো চেষ্টাও করেনি পঙ্খি। কেনই বা করবে, এখানে ওর আপন বলতে আছেই বা কে? যে ছিল সেতো মারা গেছে। আর যাঁরা আছে তারা সবাই শুধু স্বার্থপর। একই র,ক্ত হলেও এ বাড়ির লোক তাঁকে কখনো আপনজনের মতো ভালোবাসা দেয়নি। স্বার্থের জন্য নিজের বোনকে বিক্রি করে দিয়েছে তাঁরা। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো পঙ্খি। উঠোনে ভাইয়ের ছেলেমেয়ে গুলো খেলছিল। বড়ো ভাবি রান্নাঘরে মাছ কুটছে। পঙ্খিকে আসতে দেখে বড়ো ভাইয়ের পাঁচ বছরের ছেলেটা দৌড়ে এসে বললো।
–তুমি কেডো?
পঙ্খি বাচ্চাটির গালে হাত বুলিয়ে মুচকি হেঁসে বললো।
–আমি তোমার ফুপি, পঙ্খি।
বাচ্চা টা তার ফোকলা দাঁত বের করে বললো।
–ওও আপনে আমার পঙ্খি ফুবু(ফুপি)?
–হ্যাঁ। তোমার মা কোথায়?
–ওইযে মাছ কাইটত্যাছে। আব্বা কইছে আইজ নাহি তুমি আইসপ্যা তাই হাট থাইকা বড়ো মাছ আইনছে।
কথার মাঝেই পঙ্খির বড়ো ভাবি হাত ধুয়ে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এসে বললো।
–আরে পঙ্খি! আসু তুই। আয় আয় বয়। কতদিন পর দেইখত্যাছি তোক। ধনী বাড়ি গিয়া আমাগোরে কথা এহারে ভুইলাই গেছস তুই। এল্লা তো আইসপ্যারো পারিস মাঝে মইধ্যে। নাকি গরীব বাড়ি দেইহা আর পছন্দ হয়না তোর?
ভাবির এমন অযৌক্তিক কথায় মনে মনে হাসি পেল পঙ্খির। মুখের কাছে কিছু কথা হেঁটে এলেও তা গিলে নিলো পঙ্খি। জোরপূর্বক মুচকি হেঁসে বললো।
–এমন কিছু না ভাবি। নিজের বাড়ি আবার কখনো অপছন্দ হয়? যাইহোক কেমন আছো তোমরা? বাবা কোথায়?
–ভালো আছি আমরা। আব্বা হ্যার ঘরেই আছে। গিয়া দেখা কর। আমি হাইশেলে (চুলোয়) রান্দা চড়াই। তোর ভাই তোর লাইগা বড়ো মাছ আনছে।
পঙ্খি মাথা নেড়ে ওর বাবার দোচালা ছোট্ট টিনের ঘরটাতে ঢুকলো। পুরাণ চৌকিটার ওপর নির্জীব হয়ে শুয়ে আছে ওর বাবা। শরীরে শুধু হাড্ডি গুলোই দেখা যাচ্ছে। বাবার এমন করুণ অবস্থা দেখে দুচোখের পানি গড়িয়ে পড়লো পঙ্খির। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল সে। চৌকির পাশে টুলে বসে ডাক দিলো বাবাকে। ডাক শুনে দূর্বল চোখ দুটো মেলে তাকালো পঙ্খির বাবা। চোখের দৃষ্টি দূর্বল হওয়ায় স্পষ্ট দেখতে না পেরে দূর্বল ভাঙা গলায় বললো।
–কেডো?
পঙ্খি কান্না জড়িত কন্ঠে বললো।
–বাবা আমি। তোমার মেয়ে পঙ্খি।
মেয়ে এসেছে বুঝতে পেরে পঙ্খির বাবা হু হু করে কেঁদে উঠলেন। পঙ্খির হাত ধরে বললেন।
–তুই আসু মা! তোরে দেখার নাইগা পরাণ কান্তাছিলো আমার। মরার আগে তোরে একবার দেইখপ্যার চাইছিলাম। তুই ক্যাবা আছু মা? ভালো আছু তুই?
–হ্যাঁ বাবা।আমি ভালো আছি । কিন্তু তুমি এতো অসুস্থ হলে কি করে? ডাক্তার দেখায়নি কেউ?
–ডাক্তার আর কি কইরবোরে মা। মরার ডাক আইছে। এহন আর কোনো ঔষধে কিছু হইবো না।
–এভাবে বলোনা বাবা। কিছু হবেনা তোমার। আমি তোমাকে শহরে ভালো হাসপাতালে নিয়ে যাবো। দেখবে একদম ঠিক হয়ে যাবে।
–নারে মা। এহন আর এইসব হইরা কোনো লাভ হইবো না। শেষ সময় চইলা আইছে আমার। যাওয়ার আগে তোর কাছে মাপ চাইবার চাই আমি। আমি তোর সাথে অনেক অন্যায় করছি। এই বুইড়া বাপ টারে পারলে মাফ কইরা দিস মা।
–এসব বলোনা বাবা। বাবা মা কখনো ছেলেমেয়েদের কাছে মাফ চায়না।
–চায়রে মা চায়। যহন বাপ আমার মতো অন্যায় হরে। তহন মাফ চাইয়াও পাপের ভাড় কমে না। তাও পারলে আমারে মাফ কইরা দিস। টেহার বদলে তোর ভাইয়েরা তোরে ওই সামছুল মজুমদারের ছেলের সাথে বিয়া দিয়া দিলো। আমিও তহন কিছু করতে পারলাম না। এই পাপের দায় নিয়া যে আমি মইরাও শান্তি পামুনা।
–থাক বাবা। যা হবার তা হয়ে গেছে। এখন আর ওসব মনে করে লাভ নেই। তোমার ওপর আমার কোনো অভিযোগ নেই। ভুলে যাও ওসব।
আরও কিছুক্ষণ বাবার পাশে বসে নানান কথা বললো পঙ্খি। আসার সময় বাবার জন্য ফল আর খাবার নিয়ে এসেছিল পঙ্খি। সেগুলো কিছুটা খাইয়ে দিলো। আর ভাইয়ের ছেলেমেয়েদেরও দিলো। একটু পর পঙ্খির মেঝ ভাবি এসে বললো।
–আসা থেহে এহেনেই বইসা আছু তুই ।খাওয়া দাওয়া লাগবোনা? এহন আয় কিছু খায়াদায়া নে।ভাবি রান্না করতেছে। ততক্ষণ আমার ঘরে বইসা কিছু মুড়ি চিঁড়া খাইয়া নে। তারপর আবার আসিস।
–না না ভাবি থাক। আমার এখন ক্ষিদে নেই।
–আরে তা কলি হয়? আয় আয়।
পঙ্খিকে এক প্রকার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল ওর ভাবি। মেঝ ভাইয়ের ঘরে নিয়ে কিছু হালকা খাবার খেতে দিলো। এদের এতো আপ্যায়ন দেখে পঙ্খি একটু অবাকই হলো। আজপর্যন্ত এদের কাছে ভালো মুখের একটা কথাও পায়নি পঙ্খি কখনো। অথচ আজ এতো দরদ উতলে পড়ছে কেন? পঙ্খির মেঝ ভাবি খেতে দিয়ে কথায় কথায় বললো।
–হ্যারে পঙ্খি তোর হশুড় বাড়িতো মেলা ধনী, তা তোক বানি(মনে হয়) মেলা কিছু দেয় তাইনা? তোর গয়নাগাটি বানি মেলা তাইন্যা? তোর ভাই তো আমাক একটো কানের দুলও কুনুদিন বানায় দিলোনা।
পঙ্খির কাছে এবার সব পরিস্কার হলো। এদের এতো আদিখ্যেতার কারণও বুঝতে পারলো এবার। মানুষের স্বভাব আসলে কখনো বদলানোর নয়। বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো পঙ্খির। সে প্রসঙ্গ বদলাতে বললো।
–ভাই কোথায়? দেখছিনা যে।
–ওরা দুই ভাই ক্ষ্যাত নিড়ায়তে গেছে। বাড়ির পালানে মরিচ বুনছে। হেই ক্ষ্যাত নিড়াইতে গেছে। এল্লাহানি পরেই আইসা পইরবো।
–ও আচ্ছা।
দুপুরে ভাইয়েরা আসলে প্রথমে পঙ্খির সেই কথাগুলো মনে পড়ে খুব খারাপ লাগে। কিন্তু তবুও নিজেকে সামলে নেয় সে। ওসব কথা আর মনে করতে চায়না সে।তবে একটা কথা সে জানতে চায়। তাই দুপুরে একসাথে সবাই খাওয়া দাওয়া শেষে পঙ্খি ওর বড়ো ভাইয়ের সাথে একা কথা বলে। ভাইকে জিজ্ঞেস করে।
–ভাই একটা কথা জানার ছিলো। দেখ আমি জানি তোমরা টাকার বিনিময়ে আমাকে সামছুল মজুমদারের ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো। সামছুল মজুমদার এমনটা কেন করেছিলো? সেতো চাইলেই এমনিতেই যেকোনো জায়গায় তাঁর ছেলেকে বিয়ে করাতে পারতো। তাহলে এতো টাকা দিয়ে আমাকে কেন ছেলের বউ করলো।
পঙ্খির ভাই বললো।
–মাফ কইরা দিস বোন। জানি টেহা দেইহা অন্ধ হইয়া গেছিলাম। কী করমু গরীব মাইনষের এই একটই দূর্বলতা। তাই স্বার্থপর হইয়া গেছিলাম। আর সামছুল মজুমদার কীহামে (কেন) টেহা দিয়া বিয়া করাইছে তা আমি জানি না। খালি টেহা দিছিল। আর কিছুই কয়নায়।
পঙ্খি হতাশার নিঃশ্বাস ফেলল। আজও সে এই রহস্যের জাল খুলতে পারলোনা।জানতে পারলোনা সামছুল মজুমদার কেন এমন করেছিল।
পঙ্খি দুপুরের আগে এসেছিল, এখন প্রায় সন্ধ্যা হতে চলেছে। এতদিন পর বাবার বাড়ি এসে সময় কখন পার হয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি। ভাইয়ের ছেলেমেয়েগুলো পঙ্খিকে পেয়ে খুব আনন্দিত। আসা থেকে তার পিছু পিছু ঘুরছে। আশেপাশের কিছু লোকজনও এসেছে পঙ্খির সাথে দেখা করতে। এসবের মাঝে কখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে টেরই পাইনি পঙ্খি। তবে চারপাশে অন্ধকার নেমে আসা দেখে পঙ্খির হুঁশ এলো। সে ভাই ভাবিদের উদ্দেশ্যে বললো।
–আমার এখন যেতে হবে। দেরি হয়ে যাচ্ছে।
পঙ্খির বড়ো ভাই বললো।
–সেকি এতদিন পর আলি (আসলি)। এহনই যাবি? আজকের রাইত এহেনে থাক। কাইল নাহয় যাইস।
–না না ভাই, আমি তাড়াহুড়ো করে এসেছি। বাড়িতে কাউকে বলেও আসিনি। সবাই চিন্তা করবে।
–তাতে কি হইছে? তুই জামাইরে ফোন হইরা কয়া দে তালিই তো হয়। এক কাম হর। তারেও আসতে ক। কাইল এই গরিবের বাড়ি একটু আইসা নাহয় তোরে নিয়া যাইবো।
ভাইয়ের কথায় পঙ্খির মনে পড়লো,সে এতক্ষণ ধরে এসেছে অথচ ইন্ধন একবারের জন্যও ওঁকে ফোন করলোনা। তাঁর কি আমার কথা একবারও মনে আসেনি? ভাবতেই অভিমানের পাহাড় যেন আরও বৃহৎ হয়ে গেল। কান্নারা গলায় দলা পাকিয়ে আসলো। পঙ্খি ঢোক গিলে নিয়ে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললো।
–না না ভাই, অন্যদিন আসবো আবার। আজ নাহয় যাই।
পঙ্খি যাওয়ার জন্য উদ্যত হতে নিলে তখনই পঙ্খির ছোটবেলার বান্ধবী জয়া এলো। জয়াকে দেখে পঙ্খি আবারও আবেগপ্রবণ হয়ে গেল। এতদিন পর বান্ধবীকে পেয়ে দুজন সুখ দুঃখের গল্পে মজে উঠলো। কথায় কথায় ইশারের আযানও দিয়ে দিলো। পঙ্খি আবারও যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। রাত হওয়ায় পঙ্খির ভাই ভাবি রাতের খাবার খেয়ে যাওয়ার জন্য খুব জোর দিলো। পঙ্খি তাই না পেরে রাতের খাবার খেল ওদের সাথে। খাবার খেয়ে বের হতে হতে প্রায় রাত ৯ টা বেজে গেল। রাত অনেক হওয়ায় পঙ্খির ভাই বললো সে পঙ্খিকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবে। পঙ্খিও মানা করলো না। এত রাতে একা যাওয়া ঠিক হবে না। গ্রামের বাড়ি হওয়ায় রাতের বেলা রাস্তায় আর কোনো ভ্যান,রিক্সা পাওয়া যাবে না। তাই অগত্যা হেঁটে হেঁটেই রওয়ানা হলো দুই ভাইবোন। বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে ওদের প্রায় দশটার বেশি বেজে গেল। বাড়ির গেটে পৌঁছে দিয়ে পঙ্খির ভাই চলে গেল। পঙ্খি অনেক বার ভেতরে আসতে বললো কিন্তু গেলনা সে। অতঃপর পঙ্খি ওর ভাইকে বিদায় দিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকলো।
অনেক রাত হওয়ায় সবাই যার যার ঘরে চলে গেছে। কাউকে দেখতে পেল না পঙ্খি।।তাই সেও সোজা তার নিজের কক্ষে অগ্রসর হলো। দরজা খুলে রুমে ঢুকতেই হতভম্ব হয়ে গেল পঙ্খি। সারা ঘর কেমন তছনছ হয়ে আছে। মেঝেতে ভাঙা জিনিসপত্রের টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মনে হচ্ছে যেন ঘরের ওপর কোনো ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেছে। পঙ্খি দুই কদম এগুতেই বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে থাকা অগ্নিমূর্তি ধারণকৃত ইন্ধনের কঠিন মুখমণ্ডল দেখে পিলে চমকে উঠলো তাঁর। ইন্ধনের সারা মুখে যেন র,ক্ত জমে গেছে। ঘরের এই ধ্বংসলীলা যে উনার হাতেই হয়েছে তা ভালোই বুঝতে পারছে পঙ্খি। কিন্তু তাঁর এই ভয়ংকর রুপান্তরের কারণ খুঁজে পাচ্ছে না পঙ্খি। কি হয়েছে তার?
চলবে…..
#মৃগতৃষ্ণা–৩৪
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★””কোথায় গিয়েছিলে??
ইন্ধন পঙ্খির দিকে না তাকিয়েই থমথমে ভারী গলায় বলল কথাটি। ইন্ধনের এই সাধারণ কথাটির মাঝেও যেন অদৃশ্য ক্রোধের আভাস পাচ্ছে পঙ্খি। তাঁর শান্ত গলায় বলা এই ছোট্ট কথাটা যেন কোনো তুফানের পূর্বাভাস মনে হচ্ছে।অজানা ভিতীতে পঙ্খির কন্ঠস্বর যেন গলায়ই আঁটকে গেছে। চেয়েও কিছু বলতে পারছেনা সে। পঙ্খির জবাব না পেয়ে ইন্ধন এবার মাথা তুলে পূর্ণদৃষ্টি ফেলল পঙ্খির ওপর। তাঁর চোখের লাল লালিমা দেখে হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠল পঙ্খির। গলার কন্ঠনালী যেন এবার আরও খাদে নেমে গেল। পঙ্খির ভীতির মাত্রা আরও একধাপ বাড়িয়ে দিয়ে, ইন্ধন তেড়ে এলো পঙ্খির দিকে। পঙ্খির দুই বাহু ধরে পেছনের দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো।কপালের রগ ফুলিয়ে, চোয়াল শক্ত করে তীব্র রাগী কন্ঠে বললো।
–কথা বলছিস না কেন? বল কোথায় গিয়েছিলি?
চোখ বুজে কেঁপে উঠল পঙ্খি। কোনরকমে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো।
–বা বাবাকে দেখতে গিয়েছিলাম।
–আমাকে একবার জানানো দরকার মনে করিস নি? আচ্ছা আমার কথা বাদ দিলাম। তুই বাড়িতে কাউকে জানাস নি কেন?
–আপনাকে ফোন করেছিলাম। আপনি ফোন রিসিভ করেন নি। আর বাড়িতে তখন কেউ ছিলোনা। তাও চুমকিকে বলে গিয়েছিলাম আমি।
–চুমকি? কিসের চুমকি? কোথায় সে, দেখা আমাকে। আর তোর ফোন কোথায় বল?
ইন্ধন দেয়ালে ঘুষি মেরে গর্জন করে বললো।
–হোয়ার ইজ ইউর গডড্যাম ফোন??
পঙ্খি কাঁপা কাঁপা হাতে তড়িঘড়ি করে ভ্যানিটি ব্যাগে হাত দিয়ে ফোন খুঁজে বের করলো। ফোন বের করে দেখলো ফোন বন্ধ হয়ে আছে। পঙ্খি আরও ভয় পেয়ে গেল। ফোন কখন বন্ধ হয়ে গেছে সেতো জানতেই পারেনি। পঙ্খি ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে বললো।
–ফ ফফোন কখন বন্ধ হয়ে গেছে বুঝতে পারিনি।
–ওয়াও, হোয়াট আ এক্সপ্লেনেশন। বুঝতে পারিস নি। ফোন বন্ধ হয়ে আছে আর তুই বুঝতেই পারিস নি। তাতে কি হলো তোর এই না বোঝার কারণে কারোর জানই নাহয় বেরিয়ে যাক। তোর এই সামান্য অসাবধানতার কারণে আরেক ব্যাক্তির নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেলেই বা কি এমন ক্ষতি হবে তাইনা? তুই জানিস, তোকে বাড়িতে না দেখে আমার কি অবস্থা হয়েছিল? কেউ বলতে পারেনা তুই কোথায়? আর তোর সেই চুমকি তো সেই বিকেল বেলায়ই বাড়ি চলে গেছে। তাহলে কে বলবে তোর কথা? তারওপর ফোন করলে ম্যাডামের ফোনও বন্ধ। ওয়াও। তো এমত অবস্থায় আমার কি অবস্থা হয়েছিল তা জানিস তুই? সেই সন্ধ্যা থেকে পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছি তোকে। তোকে কোথাও না পেয়ে ভয়ে, দুশ্চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছিল আমার। সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসছিল আমার। পাগল হয়ে গিয়েছিলাম আমি। আর তুই কত সুন্দর করে বলে দিলি বুঝতে পারিস নি তাইনা? এই তোর দায়িত্ববোধ? আমার কথা তোর একবারও মনে হলোনা তোর? একবারও মনে হলোনা আমি এখানে চিন্তায় মরে যাচ্ছি?
ইন্ধনের কথায় পঙ্খির ভেতরের এতদিনের জমে থাকা অভিমান গুলো যেন স্রোতের মতো বাঁধ ভেঙে বেড়িয়ে এলো।ধরা গলায় অভিমান ভরা কন্ঠে বললো।
–কেন? আমার জন্য আবার এত চিন্তা করার সময় হলো কখন আপনার? আমিতো ভেবেছিলাম পঙ্খি নামের কেউ আপনার জীবনে আছে তা আপনি ভুলেই গেছেন। আজ হঠাৎ এত চিন্তা দেখাচ্ছেন কেন এই অপ্রয়োজনীয় ব্যাক্তির জন্য? যেখানে একই ঘরে থেকেও অচেনা ব্যাক্তি হয়ে গেছেন আপনি। আর আমাকে দায়িত্বহীন বলছেন? আমি আপনাকে যাওয়ার আগে ফোন করেছিলাম। একবার না। তিন চারবার করেছিলাম। কিন্তু আমার ফোন ধরা জরুরি মনে করেন নি আপনি। তাহলে দায়িত্বহীন কে হলো বলুন? আজ আপনার আমার জন্য চিন্তা হচ্ছিল। অথচ একই ঘরে থেকেও এতদিন ধরে অপরিচিতের মতো ব্যবহার করছিলেন আমার সাথে। তখন আমার কেমন লাগছিল একবারও ভেবেছেন? ভেতরে ভেতরে গুমরে মরছিলাম আমি সেটা বোঝার চেষ্টা করেছেন একবারও?
ইন্ধন এবার ভ্রু জোরা উঁচু করে বিদ্রুপের সুরে বললো।
–ও……ওকে। নাউ আই গেট ইট। তারমানে তুই আমাকে শায়েস্তা করার জন্য এসব করেছিস তাইতো? আমাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য এসব করেছিস। তাহলে এইটুকু শাস্তিতে কী হবে ? এই সামান্য শাস্তিতে নিশ্চয়ই স্যাটিসফাই হোসনি তুই তাইনা? শাস্তিতো আরও কঠিন হওয়া উচিত।যাতে তুই শান্তি পাস। ইউ নো হোয়াট,আই হ্যাভ এ বেটার আইডিয়া। দেখ তুই নিশ্চয়ই স্যাটিসফাই হবি।
কথা বলতে বলতে ইন্ধন পঙ্খিকে ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে এলো। টেবিলের কাছে এসে টেবিলের ওপর থেকে পেপসির কাচের বোতল টা হাত নিলো। তারপর বোতলের মাথাটা ধরে টেবিলের ওপর সজোরে আছাড় মেরে বোতটা ভেঙে ফেললো। বোতলের ভাঙা মাথা টা ইন্ধনের হাত রয়ে গেল। সেই ভাঙা বোতল সে নিজের বুকের ওপর তাক করে বললো।
–এক কাজ করি বুকটা কেটে কলিজা বের করে তোর চরণে রেখে দেই। তখন নিশ্চয়ই স্যাটিসফাই হবি তুই। আর এটাই হবে সম্পূর্ণ শাস্তি তাইনা?
ভয়ে হৃদপিণ্ড থমকে গেল পঙ্খির। ওর কথায় যে ইন্ধন এমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে তা ভাবতেই পারেনি ও। নাহলে কখনো ও এসব বলতো না৷ কিন্তু এখন কী করবে? এই নিয়ন্ত্রণহীন উন্মাদ ইন্ধনকে কীভাবে থামাবে ও? ও যদি সত্যি সত্যিই কিছু করে বসে? আর ভাবতে পারলোনা পঙ্খি। সব ভাবনা ছেড়ে প্রাণপণে ছুটে গেল ইন্ধনের পানে। দৌড়ে গিয়ে ওর হাত থেকে ভাঙা কাচের বোতলটা টান দিয়ে নিয়ে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেললো। তারপর আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো ইন্ধন কে। কাঁদতে কাঁদতে বললো।
–দয়া করে এমন কিছু করবেন না। ভুল হয়ে গেছে আমার। অনেক বড়ো ভুল হয়ে গেছে। মাফ করে দিন আমাকে। আর কখনো এমন কথা বলবো না।দয়া করে শান্ত হন একটু। প্লিজ শান্ত হন। আপনাকে এভাবে দেখে সহ্য করতে পারছিনা আমি। আপনার কিছু হয়ে গেলে মরে যাবো আমি।আমি সত্যি বলছি আমি ইচ্ছে করে এসব করিনি। বাবার অসুখের কথা শুনে আমি থাকতে পারিনি। তাই তখনই বেড়িয়ে পড়েছিলাম আমি। কিন্তু যাবার আগে আপনাকে ফোন করেছিলাম আমি।কিন্তু আপনি ফোন রিসিভ করেননি। আর বাড়িতেও তখন কেউ ছিলোনা। তাই শুধু চুমকিকেই বলে যেতে পেরেছিলাম। ওবাড়িতে গিয়ে আর ফোন চেক করিনি। তাই বুঝতে পারিনি কখন ফোন বন্ধ হয়ে গেছে। প্লিজ ভুল বুজবেন না আমাকে। আপনি যা বলবেন আমি তাই করবো। কখনো অবাধ্য হবোনা।তাও প্লিজ শান্ত হন। প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ…
পঙ্খির আলিঙ্গনে ইন্ধন যেন একটু শান্ত হলো। সেও দুই হাতে সর্বশক্তি দিয়ে পঙ্খিকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। একটু পরে পঙ্খি ওর কাঁধে উষ্ণ কোনো তরল পদার্থের অনুভব করলো। চমকে উঠলো পঙ্খি। নিজেকে ছাড়াতে নিয়েও পারলোনা। ইন্ধন যেন ওকে সর্বশক্তি দিয়ে আঁকড়ে রেখেছে। মনে হচ্ছে ছেড়ে দিলেই বুঝি হারিয়ে যাবে কোথাও। কাঁধের ওপর তরল পদার্থ যেন আরও বিস্তর হলো। ইন্ধনের শরীরও ইষৎ কাঁপছে। তারমানে ইন্ধন কাঁদছে? পঙ্খির বুকের মাঝে মুচড়ে উঠলো। সে অস্থির কন্ঠে বললো।
–আ আপনি কাঁদছেন কেন? কি হয়েছে বলুন না?
ইন্ধন পঙ্খিকে নিয়েই পায়ের ভর ছেড়ে দিয়ে হাঁটু ভেঙে নিচে বসে পড়লো। পঙ্খি আরও অস্থির হয়ে উঠলো। ভয়ার্ত কন্ঠে বললো।
–প্লিজ বলুন না কি হয়েছে? দেখুন আমার অনেক ভয় করছে? কি হয়েছে আপনার?
ইন্ধন কান্না জড়ানো গলায় বললো।
–আম সরি পঙ্খি। আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি তাইনা? আমি অনেক খারাপ তাইনা পঙ্খি?
–প্লিজ এভাবে বলবেন না। আপনি মোটেও খারাপ না। আমার রাজকুমার একদম খারাপ না। আমি জানি আপনি আমার কথায় কষ্ট পেয়ে এসব বলছেন তাইনা? বললাম তো ভুল হয়ে গেছে। কী করবো, আপনি আমাকে এত ভালোবাসায় অভ্যাস্ত করেছেন যে,আপনার একটুখানি উপেক্ষাও আমাকে ঘাবড়ে দেয়। তাই হয়তো একটু অভিমান জন্মেছে। কিন্তু আপনাকে খারাপ বলার কথা কল্পনাও করতে পারিনা। তাই এসব বলবেন না প্লিজ।
ইন্ধন এবার মাথা তুললো।দুই হাতে পঙ্খির মুখটা ধরে কপালে কপাল ঠেকিয়ে ব্যাথিত কন্ঠে বললো।
–কী করবো পঙ্খি,আমি যে এতদিন নিজের সাথেই যুদ্ধ করছিলাম। নিজের অস্তিত্বের সাথেই লড়াই করছিলাম। এত বছরের জীবন যে হঠাৎ করেই মিথ্যে হয়ে গেল পঙ্খি। এই মিথ্যের গ্লানি যে আমাকে চুরমার করে দিচ্ছে।নিজের জীবন টা হঠাৎ একটা প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে । যার উত্তর থাকলেও সেই উত্তর শান্তির বদলে শুধুই যন্ত্রণা দেয় পঙ্খি। অসহনীয় যন্ত্রণা। আর এই যন্ত্রণার ভাগিদার তোমাকে করতে চাচ্ছিলাম না আমি।
আৎকে উঠলো পঙ্খি। ইন্ধন এভাবে বলছে কেন? তবে কি ইন্ধন সব জেনে গেছে? পঙ্খি কম্পিত স্বরে বললো।
–মা মানে?? আপনি কি…
–হ্যাঁ পঙ্খি আমি আমার জীবনের ঘৃণিত সত্যি টা জেনে গেছি। সেদিন রাতে যখন তুমি রুমে আসতে দেরি করছিলে তখন তোমাকে ডাকতে আমি বাইরে আসি। কিন্তু তোমাকে পাইনা। তখন হঠাৎ ঈশিতা আপুর ঘরের লাইট জ্বালানো দেখি। তাই কৌতূহল বশত আমি এগিয়ে যাই ওদিকে। আর ওখানে গিয়েই তোমাদের সব কথা শুনে ফেলি আমি। শুনে ফেলি আমার জীবনের চরম সত্যি টা। সব শুনে স্তব্ধ, পাথর হয়ে যাই আমি। নিজের জীবনের এতবড় সত্য জেনে আমার ভেতরে যেন সব ধ্বংস হয়ে যায়। নিজেকে কিছুতেই ঠিক রাখতে পারিনা আমি। ওইসময় আমি পুরোপুরি ভেঙে পড়ি। তোমার সামনে নিজেকে ঠিক রাখতে পারতাম না। তাই ঘুমের ঔষধ খেয়ে সেদিন শুয়ে পড়ি আমি। আর পরদিনই ওই ঘটনা ঘটে। সবমিলিয়ে আমার ভেতর তখন তুফান চলতে থাকে। নিজের অস্তিত্বই তখন প্রশ্নবোধক হয়ে যায়। যে মাকে নিজের সব ভেবেছিলাম সেই মা-ই নাকি আমার মা না। আর সে আমাকে খু,ন করতে চায় আমাকে। ভেবে ভেবে ঘৃণা জন্মাতে থাকে আমার নিজের ওপর। সবচেয়ে অসহায় লাগে যখন তোমার সামনে আসি। তোমার চোখে চোখ রাখতে পারিনা আমি। মস্তিষ্ক ধিক্কার জানায় আমাকে। চিল্লিয়ে বলে তুই এই মেয়েটার যোগ্য নস। তোর মতো অযোগ্য ব্যাক্তির এই মেয়েটার সামনে দাঁড়ানোর অধিকার নেই। তখন আমার সব আত্মবিশ্বাস ধুলোয় মিশে যায়। তোমার সামনে থাকতে পারিনা আমি। নিজেকে শেষ করে ফেলতে ইচ্ছে করে তখন। এসব কারণেই তোমাকে এড়িয়ে চলছিলাম আমি। কিন্তু দেহ তাঁর প্রাণ থেকে কতক্ষণই বা দূরে থাকতে পারে? আমিও পারছিলাম না। মস্তিষ্ক দূরে থাকতে বললেও, মন তা মানতে চায়না। সেতো ছুটে আসতে চায় তোমার কাছে। তোমার কোলে মাথা রেখে একটু শান্তি পেতে। কিন্তু বারবারই মন মস্তিষ্কের লড়াইয়ে আমি পরাজিত হই। তবে আজ আমার মন অবাধ্য অনড় হয়ে গিয়েছিল। মস্তিষ্ককে পরাজিত করে সে ছুটে এসেছিল তোমার কাছে। কিন্তু বাড়িতে এসে তোমাকে পাইনা আমি। ফোন বের করে দেখি তোমার মিসকল উঠে আছে।তখন মিটিংয়ে ছিলাম তাই টের পাইনি। সাথে সাথেই কল করি তোমাকে। কিন্তু তোমার ফোন বন্ধ আসে। ভয়ে বুক কাপে আমার। মনে হয় এই বুঝি আবারও হারিয়ে ফেললাম তোমাকে আমি। এই একটা ভাবনাই আমাকে দিশেহারা করার জন্য যথেষ্ট ছিলো। তোমাকে কোথাও না পেয়ে দম বন্ধ হয়ে আসে আমার। আমি আরও একবার বুঝে যাই তোমাকে ছাড়া আমার চলবেনা। তুমি বিনা কিছুতেই হৃৎস্পন্দন চলবে না আমার। আমি কী খুব স্বার্থপর হয়ে যাবো যদি, তোমাকে আমার জীবনে বেঁধে রাখি? একটু স্বার্থপর হলে কী খুব ক্ষতি হয়ে যাবে পঙ্খি?
এতক্ষণ ইন্ধনের করুণ বাণী শুনে হৃদয় টা হু হু করে কেঁদে উঠলো পঙ্খির। ইন্ধনকে এভাবে দেখার চেয়ে পীড়াদায়ক বোধহয় কিছুই নেই পঙ্খির জন্য। পঙ্খি আর সইতে পারলোনা। দুই হাত দিয়ে ইন্ধনের বুকে এলোপাতাড়ি চাপড়াতে চাপড়াতে বলতে লাগলো।
–কী বললেন আপনি? কী বললেন? আপনার সাহস কী করে এসব বলার? আপনি আমার যোগ্য না? এই কথা আপনি ভাবলানেও কীভাবে? আপনি সত্যি খারাপ হয়ে গেছেন।খুব খারাপ। আপনি আমার রাজপুত্র হতেই পারেন না। আমার রাজপুত্র কখনো এমন কথা বলতো না। আপনি আমার থেকে দূরে যেতে চাইছিলেন? ঠিক আছে তাই থাকুন। আমি চলে যাবো আপনার কাছ থেকে। আর কখনো আসবোনা।
পঙ্খি কাঁদতে কাঁদতে উঠে চলে যেতে লাগলো। তবে ইন্ধন যেতে দিলোনা ওকে। পঙ্খির হাত ধরে টান বুকের ভেতর শক্ত করে আবদ্ধ নিলো তাকে। পঙ্খি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলতে লাগলো।
–ছাড়ুন। কেন আটকাচ্ছেন আমাকে? আপনি তো আমার যোগ্য না তাইনা? তাহলে কেন আটকাচ্ছেন? যেতে দিন আমাকে।
ইন্ধন আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো পঙ্খিকে। পঙ্খি এবার ফুঁপিয়ে উঠে বললো
–আপনি আজ আমাকে অনেক আহত করেছেন। অনেক। আপনি কীভাবে বলতে পারলেন এই কথা? কীভাবে? আপনি আমার যোগ্য না হলে পৃথিবীতে কোনে স্বামীই তার স্ত্রীর যোগ্য না। আমার কাছে আপনি আগেও যেমন ছিলেন এখনও তেমন আছেন। আমার চোখে আপনার সম্মান সবচেয়ে উপরে। তাহলে আপনি এমন কথা ভাবলেনও কী করে?
–সরি পঙ্খি। ভুল হয়ে গেছে আমার। এসব টেনশনে মাথা কাজ করছিলো না আমার। কিন্তু আমি এটা জানি যে,তোমাকে ছাড়া আমি কিছুতেই থাকতে পারবোনা। কিছুতেই না। তুমি আমার জীবনের একমাত্র সত্য। আমার একমাত্র বেঁচে থাকার উৎস। তুমি ছাড়া আর কোনো কিছু জরুরি নেই আমার কাছে। তোমাকে হারাতে পারবোনা কিছুতেই।
ইন্ধন পঙ্খির মুখটা সামনে ধরে তাঁর মুখমন্ডলে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিলো। তারপর অধরযুগল মিলিয়ে নিলো। অশান্ত মনকে এভাবেই শান্ত করলো সে। চুম্বন ক্রিয়া শেষে ইন্ধন অধৈর্য কন্ঠে বললো।
–আমরা এখান থেকে চলে যাবো পঙ্খি। অনেক দূরে চলে যাবো। এই অশুভ বাড়িতে আমরা আর এক মুহুর্তও থাকবোনা। নাহলে একসময় আমি তোমাকেও হারিয়ে ফেলবো। আমরা দূরে কোথাও আমাদের নতুন ছোট্ট একটা দুনিয়া গড়বো। এই বাড়িতে এখন আমার দম বন্ধ হয়ে আসে পঙ্খি। আমরা আজ এক্ষুনি চলে যাবো এখান থেকে। তুমি জলদি জলদি ব্যাগ গুছিয়ে নাও।
পঙ্খি অবাক সুরে বললো।
–কি বলছেন? এভাবে হঠাৎ করে কোথায় চলে যাবো?
–কেন, আমার ওপর তোমার ভরসা নেই। আমার হাত ধরে চলতে পারবে না তুমি?
–নিজের থেকেও বেশি ভরসা আছে আপনার ওপর। আর আপনার সাথে খোলা আসমানের নিচেও আমার স্বর্গ।
–তাহলে চলো এক্ষুনি চলে যাবো আমরা।
–আচ্ছা ঠিক আছে যাবো আমরা। আপনি যেখানে বলবেন সেখানেই যাবো। আপনি আগে শান্ত হন। এভাবে হঠাৎ করে যাওয়া টা ভালো দেখায় না। যেমনই হোক আমাদের একটা পরিবার আছে। তাদের কে ভালোভাবে বলে বুঝিয়ে তারপর যাবো আমরা। এইটুকুই শুধু বলতে চাচ্ছি আমি।একের পর ঘটনায় সবাই এমনিতেই চুপসে গেছে। তারপর আমরাও যদি এভাবে হঠাৎ করে চলে যাই সবাই কষ্ট পাবে। তাই একটু সময় নিয়ে সবার সাথে কথা বলে তারপর গেলে জিনিস টা ভালো হবে। প্লিজ বোঝার চেষ্টা করুন।
–ঠিক আছে। কিন্তু বেশিদিন না। কালই সবার সাথে কথা বলতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব তোমাকে নিয়ে আমি এইবাড়ি ত্যাগ করতে চাই। এই কালপুরিতে আমি তোমাকে নিয়ে আর থাকতে চাইনা।
–আচ্ছা ঠিক আছে তাই হবে। এখন শান্ত হোন একটু। আপনি নিশ্চয় খাবার খান নি। আমি খাবার নিয়ে আসছি আপনার জন্য।
ইন্ধন মাথা নেড়ে সায় জানালো। পঙ্খি ইন্ধনের কপালে চুমু একে দিয়ে উঠে গেল খাবার আনতে। রান্নাঘরে এসে খাবার বেড়ে নিয়ে রুমে ফিরে আসতে নিলেই পঙ্খি দেখলো জাহানারা আবারও তিনতলার দিকে যাচ্ছে।আজ আর পঙ্খি তাঁর পেছনে গেল না। না কোন কৌতূহল দেখালো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইন্ধনের জন্য খাবার নিয়ে গেল। পঙ্খির আর এসবের মধ্যে পড়তে ইচ্ছে হয়না। ইন্ধন ঠিকই বলেছে। এই বাড়ি থেকে চলে গেলেই ভালো হবে। এই বাড়িটা একটা রহস্যপুরী। যার গহ্বরে তলিয়ে যায় সবাই। এখান থেকে দূরে গেলেই ওরা একটা নিশ্চিন্ত জীবনযাপন করতে পারবে। যেখানে কোন কালো ছায়া থাকবেনা।
__
পরদিন পঙ্খি জাহানারার জন্য দুপুরের খাবার বেড়ে নিয়ে তাঁর রুমের উদ্দেশ্যে গেল। ভাবলো খাবার দিয়ে তারসাথে ওদের যাওয়ার ব্যাপারে কথা বলবে। কিন্তু দরজার কাছে আসতেই কিছু কথপোকথন কানে এলো। যা শুনে পঙ্খির পা ওখানেই থমকে গেল। আর যা শুনতে পেল তার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিলনা। রুমের মাঝে সামছুল মজুমদার জাহানারাকে বলছে।
–তোমাকে আমি হাজার বার মানা করেছি তিনতলার ওই ঘরে যেতে। তারপরও বারবার কেন যাও তুমি? কেউ দেখে ফেললে কি হবে তা ভেবেছ একবারও? খবরদার আর যাবেনা তুমি।
জাহানারাও তিক্ত কন্ঠে বললো।
–কেন ভয় লাগে বুঝি? এতো জানের ভয় আপনার? কি ভেবেছেন আপনি কখনো মরবেন না? সারাজীবন বেঁচে থাকবেন আপনি? মনে রাখবেন একদিন না একদিন আপনার পাপের মাশুল ঠিকই দিতে হবে আপনাকে।
সামছুল মজুমদার জাহানারার চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে রাগী কন্ঠে বললো।
–কী বলতে চাস তুই হ্যাঁ? আজকাল তোর মুখ বোধহয় বেশিই চলতে শুরু করেছে। একে বন্ধ করার কৌশলও আমার জানা আছে।
–হ্যাঁ করুন না বন্ধ। এই কাজটাই তো আপনি খুব ভালো পারেন।আপনার মতো জালিমের কাছ থেকে আর কী আশা করা যায়? যে বাপ হয়ে নিজের ছেলেকে দুই দুইবার মারতে পারে তাঁর কাছে বউ মারা আর এমন ব্যাপার।
–চুপ মা*, তোকে কতবার বলছি নাঈম কে দ্বিতীয় বার আমি মারিনি। হ্যাঁ প্রথমবার আমিই মারতে চেয়েছিলাম ওঁকে। কিন্তু দ্বিতীয়বার নাঈম কে আমি মারিনি। ওঁকে অন্যকেউ মেরেছে।
–বিশ্বাস করিনা আমি। আপনিই মেরেছেন আমার ছেলেকে। আপনি খু,নি, পাপী, অমানুষ….
বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লো জাহানারা। পঙ্খি এসব শুনে হতবাক হয়ে গেল। এসব কি শুনলো ও? নাঈম কে সামছুল মজুমদার মারতে চেয়েছিল? কিন্তু কেন? কেউ নিজের ছেলেকে কেন মারতে চাইবে? তবে কী দ্বিতীয়বারও উনিই মেরেছেন নাকি অন্য কেউ?
চলবে……