#মৃগতৃষ্ণা–৩৫,৩৬
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
(বন্ধ ঘরের রহস্য ভেদ,দ্বিতীয় অংশ)
৩৫
★স্তম্ভিত হয়ে বসে আছে পঙ্খি। তখন সামছুল মজুমদার আর জাহানারার কথপোকথন শোনার পর থেকে মাথার মধ্যে ঘুরছে তাঁর। তখনকার মতো চলে আসে সে ওখান থেকে। সেই থেকে মাথায় শুধু ওইসব কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে।সে ভেবে পাচ্ছে না কোনো বাবা তাঁর নিজের ছেলেকে কীভাবে মারতে পারে? এতটা ক্রুর কেউ কীভাবে হতে পারে? রাবেয়া নাহয় সৎ মা দেখে ওমন করেছে। কিন্তু নাঈম তো উনার নিজের সন্তান। তাহলে এমন কেন করবেন উনি? সামছুল মজুমদারের মতো একজন ন্যায়পরায়ণ লোক নিজের ছেলেকে কেন মারতে যাবে? সামছুল মজুমদারকে পঙ্খি কতো সৎ লোক ভেবেছিল। অথচ উনি এমন নিকৃষ্ট লোক তা স্বপ্নেও ভাবেনি সে। এই বাড়ির প্রত্যেক টা লোকই যেন মুখোশধারী। উপরে এক আর ভেতরে আরেক। প্রথমে জুবায়েদ তারপর রাবেয়া এখন আবার সামছুল মজুমদার। সত্যিই এই বাড়িটা একটা কালপুরী। নাজানি আরও কতো ঘৃণিত সত্য লুকিয়ে আছে এদের মাঝে। এতো এতো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে পঙ্খির মাথায়। যার উত্তর না জানা পর্যন্ত স্বস্তি পাবেনা পঙ্খি। আর এইসব প্রশ্নের উত্তর শুধু জাহানারাই দিতে পারবে। আর আজ জাহানারার কাছ থেকে সব জেনেই ছাড়বে পঙ্খি।
এই মনোভাব নিয়েই পঙ্খি জাহানারার কক্ষের দিকে এগিয়ে গেল। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখলে জাহানারা আবারও নাঈমের ছবি হাতে নিয়ে গুণগুণ করে কাঁদছে। পঙ্খি জাহানারার কাছে গিয়ে তাঁর হাতের ছবিটা কেড়ে নিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বললো।
–বাচ করেন। আপনার ছেলের জন্য কাঁদা আপনার মানায় না। যেখানে ছেলের খু,নি কে, সেটা জানা সত্বেও চুপ করে আছেন সেখানে এই কান্না বেমানান। বসে বসে কাঁদলে কোনো লাভ হবে না। একটা কথা মনে রাখবেন যে অন্যায় করে আর যে অন্যায় সহে দুজনেই সমান অপরাধী।। তাই আপনিও এই অপরাধের ভাগিদার হচ্ছেন। সবকিছু জানা সত্বেও চুপ করে আছেন। কেন? শুধুমাত্র সে আপনার স্বামী বলে?
জাহানারা আৎকে উঠে বললো।
–তু তুমি কী করে…
–হ্যাঁ জেনে গেছি আমি। তখন আপনাদের সবকথা শুনে ফেলেছি আমি। তাই আজ আর লুকিয়ে লাভ হবে না। সত্যি সত্যি বলুন আসল ঘটনা কী? উনি কেন নিজের ছেলেকে মেরেছেন? আপনি ওমনটা কেন বললেন তখন? দেখুন ভয় পাবেন না। ভরসা করুন আমার ওপর। আমরা চাইলেই অপরাধীকে শাস্তি দিতে পারবো। আমরা একা না। ইন্ধন আছে আমাদের সাথে। ওঁকে সবটা বললে ও নিশ্চয় কোনো পদক্ষেপ নিবে। আপনি শুধু নির্ভয়ে সবকিছু খুলে বলুন আমাকে।
–এতো সহজ না পঙ্খি। তুমি যতটা ভাবছ ততোটা মোটেও সহজ না। উনি খুবই ভয়ংকর পঙ্খি। যতটা তুমি কল্পনাও করতেও পারবেনা ততটা ভয়ংকর উনি। যে লোক শুধুমাত্র বংশের সম্মানের জন্য নিজের ছেলেকে খু,ন করতে পারে। সে কতোটা ভয়ংকর হতে পারে তুমি চিন্তাও করতে পারবেনা।
পঙ্খি চমকে উঠে বললো।
–সম্মানের জন্য মানে? কীসের সম্মান? কী করেছিলো নাঈম যার জন্য সম্মানহানি হতো? দয়া করে সবটা খুলে বলুন আমাকে।আজ আপনাকে সব বলতেই হবে। সত্যিটা না জানা পর্যন্ত কিছুতেই শান্তি পাবোনা আমি। বলুন সবকিছু।
–ঠিক আছে শোনো তাহলে।মজুমদার পরিবারের পূর্ব পুরুষেরা ছিলো জমিদার। তাদের বংশের মর্যাদা ধরে রাখতে তাঁরা সবকিছু করতে রাজি। সামছুল মজুমদারও তাঁর ব্যাতিক্রম নয়। উপর দিয়ে তাঁকে যতটা দয়ালু নীতিবান দেখা যায়, ভেতরে থেকে তাঁর চেয়ে অনেক বেশি ক্রুর আর ভয়ংকর। যা আমি সময়ের সাথে ধীরে ধীরে বুঝতে পারি। জুবায়েদ হওয়ার দুই বছর পর নাঈমের জন্ম হয়।পর পর ছেলে হওয়ায় সামছুল মজুমদার খুশিই ছিলেন। তাঁর বংশ বিস্তার হচ্ছে এইজন্য।তবে সমস্যা শুরু হয় নাঈম কে নিয়ে। জুবায়েদ বাকিসব ছেলেদের মতো স্বাভাবিক ভাবেই বড়ো হচ্ছিল। তবে নাঈম বড়ো হওয়ার সাথে তাঁর মধ্যে কিছু অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ করা যায়।জুবায়েদ সবসময় ওর বাবার সাথে থাকতে পছন্দ করতো। খেলাধুলা আর আড্ডা নিয়ে থাকতো।তবে নাঈম ছোটবেলা থেকেই আমার সাথে বেশি ঘনিষ্ঠ ছিলো। ও সবসময় আমার সাথে সাথেই থাকতো। রান্না করার সময় আমার সাহায্য করতো। আমি যখন শাড়ি পরতাম ও তখন শখ করে আমার শাড়ি পড়তো। আমার চুরি মালা নিয়ে সাজতো। আমিও ওর কান্ড দেখে হাসতাম। আমিও মজা ভেবে ওঁকে কিছু বলতাম না। ওঁকে সাজিয়ে দিতাম। কিন্তু সামছুল মজুমদার এসব দেখে খুব রেগে যেতেন। একদিন নাঈম কে এই কারণে অনেক মারেন তিনি। ছেলেটা আমার ভয়ে কুঁকড়ে যায়। নাঈম ওর বাবাকে অতিরিক্ত ভয় পেত। আর সেদিনের পর থেকে আরও ভয় পায়। তাই সে শুধু আমার সাথেই বেশি থাকতো। আমি যা করতাম ও আমার সাথে তাই করতো। আমি প্রথম প্রথম এসব স্বাভাবিক ভাবেই নিতাম। কিন্তু আমার এই অসচেতনতায় যে একদিন এতবড় সর্বনাশ ডেকে আনবে তা কখনো ভাবতে পারিনি। ছোটবেলায় নাঈমের কাজকর্ম মজা লাগলেও বড়ো হওয়ার পর সেগুলোই অস্বাভাবিক আকার ধারণ করে। যা ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নাঈমের মাঝে কেমন মেয়েলী মেয়েলী একটা ভাব দেখা যায়। আচার আচরণও কেমন অস্বাভাবিক দেখা যায়। বিষয় টা ধীরে ধীরে খুবই স্পষ্ট বোঝা যায়। আমি প্রচুর ভয় পেয়ে যাই। সামছুল মজুমদারও এই নিয়ে আমার সাথে অনেক রাগারাগি করেন। হুমকি দেন আমি যেন ছেলেকে সঠিক পথে আনি, নাহলে আমাদের মা ছেলের জন্য ভালো হবে না। আমি কী করবো ভেবে পাইনা। নাঈম কে আমি বেশি বেশি মেয়েদের সাথে ঘোরাঘুরি করতে দেই। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হয়না। সে মেয়েদের নিয়ে কোনো আগ্রহই দেখায় না। আমার চিন্তা আরও বেড়ে যায়। কী করে ছেলেকে ঠিক করবো বুঝতে পারিনা। এরই মাঝে নাঈম ঘটিয়ে ফেলে আরেক বিপদজনক ঘটনা।সামছুল মজুমদার জানতে পারে নাঈম একজনের সাথে প্রেম করছে।এটা জানতে পেরে সামছুল মজুমদারের ক্রোধের সীমা পেরিয়ে যায়।
একপর্যায়ে পঙ্খি ভ্রু কুঁচকে বললো।
–কেন? নাঈম কারোর সাথে প্রেম করেছে এটা এতে রাগের কী হলো? প্রেমইতো করেছিল। নাকি কোন ছোট জাতির কারোর সাথে প্রেম করেছিল? কারণ আমি শুনেছি ইন্ধনের বোন ঈশিতাও কোনো ছোট জাতির কারোর সাথে প্রেম করেছিল তাই তাঁকে এই বাড়িতে মেনে নেওয়া হয়নি। তাহলে কী নাঈমও তাই করেছিল?
জাহানারা করুণ বেদনার্ত কন্ঠে বললো।
–ছোট জাতির কারোর সাথে প্রেম করলে তাও কোনো দুঃখ ছিলোনা। কমছে কম ছেলেটা আমার বেঁচে তো থাকতো।
–মানে? তাহলে কোন মেয়ের সাথে প্রেম করেছে ও যারজন্য ওর জান দিতে হলো?
–নাঈম কোনো মেয়ের সাথে প্রেম করেনি। ও প্রকৃতির উল্টো চলে গিয়েছিল। নাঈম একটা ছেলের সাথে প্রেম করেছিল। মা হয়ে বলতেও লজ্জা লাগে। তাও বলছি, সহকামী হয়ে গিয়েছিল আমার ছেলে। ছেলে হয়ে ছেলের সাথে সম্পর্ক করেছিল সে।
পঙ্খি যেন হতভম্ব হয়ে গেল এই কথা শুনে। এমন কিছুর জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিলনা। সে কী প্রতিক্রিয়া দিবে বুঝতে পারছে না। মাথা ঘুরছে তাঁর। জাহানারা আরও বলতে লাগলো।
–হ্যাঁ ঠিকই শুনেছ। এটাই ছিল আমার ছেলের সবচেয়ে বড়ো অপরাধ। সামছুল মজুমদার এই কথা জানতে পেরে ক্রোধে ফেটে পড়ে। নাঈমকে প্রচুর মারে। মারধর করে ওঁকে ঘরের মাঝে বন্ধ করে দেয়। তিনি সিদ্ধান্ত নেন যত দ্রুত সম্ভব নাঈমের বিয়ে দিবেন। ভাবেন বিয়ে দিলে হয়তো নাঈম ঠিক হয়ে যাবেন। তাই দ্রুত বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজতে লাগলেন। কোনো গরিব ঘরের সহজ সরল মেয়ে খুঁজতে চাইলেন। যাতে পরবর্তীতে নাঈমের ব্যাপারে জানলেও কোনো ঝামেলা না করতে পারে। আর সেইজন্যই তোমাকে পছন্দ করিছিলেন উনি। এমনকি তোমার ভাইদের টাকাও দিয়েছিলেন যাতে কোনোরকম প্রশ্ন না করে ওরা।
এবার পঙ্খি বুঝতে পারলো কেন সামছুল মজুমদার তাঁর ভাইদের টাকা দিয়েছিল। জাহানারা আরও বললো।
–বাবার ভয়ে নাঈম বিয়ে করতে বাধ্য হলো। তবে নাঈমের অন্য পরিকল্পনা ছিল। সে বিয়ের দিন গাড়ি থেকে নেমে পালিয়ে গেল সেই ছেলেটার সাথে। আর ওর এই পরিকল্পনাও সামছুল মজুমদার জেনে গেলেন। তাই মান সম্মান রক্ষার্থে নিজের ছেলেরই হ,ত্যা,র সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। নাঈম সেই ছেলেটার সাথে যে গাড়িতে যাচ্ছিল, সামছুল মজুমদার তাঁর লোক দিয়ে সেই গাড়ির এক্সিডেন্টে করিয়ে দেয়। গাড়ি গিয়ে নদীতে পরে যায়। নাঈম পানিতে ডুবে যায়। আমরা সবাই ভাবি সে মারা গেছে।
পঙ্খি তখন বললো।
–আর নাঈমের সাথে যে ছেলেটা ছিলো তাঁর কী হলো? সেও কী মারা গেছে?
–তাঁর কী হলো সেটাতো তুমি নিজের চোখেই দেখেছ।
–মানে? আমি কখন দেখলাম তাঁকে? কার কথা বলছেন আপনি?
–তিন তলার ওই বদ্ধ ঘরে যে আছে সেই হলো ওই ছেলেটা।
পঙ্খি বিস্মিত কন্ঠে বললো।
–কিহহ্?? ওই লোকটা??
–হ্যাঁ ওই লোকটা।ওর নাম জাকির। নাঈম আমাকে ওর কথা বলেছিল। নাঈম কে যখন ওর বাবা এক ঘরে আঁটকে রেখেছিল তখন আমি ওর সাথে দেখা করতে গেলে ও জাকিরের কথা বলেছিল আমাকে। মোবাইলে জাকিরের ছবি দেখিয়ে বলেছিল জাকিরকে ও অনেক ভালোবাসে, জাকিরকে ছাড়া থাকতে পারবেনা ও। আমি ওঁকে অনেক বুঝায় যে এটা ঠিক না,এটা হয়না কখনো। কিন্তু ও কোনো কিছুই শুনতে রাজি ছিলোনা। সেদিন ওদের গাড়ির যখন এক্সিডেন্ট তখন নাঈম জাকিরকে বাঁচানোর জন্য গাড়ি নদীতে পড়ার আগেই জাকিরকে গাড়ির দরজা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়। যার ফলে জাকির বেঁচে যায়। তবে মাথায় আঘাত লাগার ফলে বেচারা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। সামছুল মজুমদার তখন জাকিরকে এনে ওই ঘরে বন্দী করে রাখে যাতে জাকির নাঈমের সাথে ওদের সম্পর্কের কথা কাউকে বলে না দেয়। সময় বুঝে হয়তো জাকির কেও মেরে ফেলতো তবে আমার জন্য পারেনি। কারণ আমি সব জেনে যাই। একদিন কাকতালীয় ভাবেই সামছুল মজুমদারের করোর সাথে ফোনের আলাপ শুনে ফেলি আমি। আর জেনে যাই কীভাবে সে নিজের সন্তানকে মারার প্ল্যান করেছিলো। আমি তাঁকে হুমকি দেই, পুলিশকে সব বলে দিতে চাই। আর জাকিরকেউ ছেড়ে দিতে বলি। তখন সামছুল মজুমদার আমাকে বলে আমি যদি মুখ খুলি তাহলে পরিণাম ভয়াবহ হবে। আর জাকিরকেউ মেরে ফেলার হুমকি দেয়। তখন চুপসে যাই আমি। ছেলেকে তো হারিয়েই ফেলেছি তবে ওই নির্দোষ ছেলেটাকে চোখের সামনে মরতে দিতে পারিনি। তাই দমে যাই আমি। সত্যি লুকানোর বদলে ছেলেটার জান ভিক্ষা দেয় সামছুল মজুমদার। ব্যাস সেই থেকে এমনই চলছে। কিন্তু কিছুদিন পর আমার নাঈম আবার ফিরে আসে। কিন্তু আবারও তাঁর খু,ন হয়। ওই সামছুল মজুমদার যতই বলুক আমি জানি এবারও ওই মেরেছে আমার ছেলেকে। ওই মেরেছে…
বলতে বলতে আবারও কান্নায় ভেঙে পড়লো জাহানারা। পঙ্খি জাহানারার মাথাটা নিজের কাঁধে রেখে তাঁকে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করলো।এতক্ষণ ধরে সব কথা শুনে পঙ্খি হতবিহ্বল হয়ে গেছে। ভাবতেই পারছেনা কেউ এতটাও ক্রুর হতে পারে? তবে আর না। এবার আর পঙ্খি চুপ করে থাকবেনা।এমন অন্যায়ের কথা জেনেও সে চুপ করে থাকবেনা। এবার সব খুলে বলবে ইন্ধন কে। তারপর ইন্ধন নিশ্চয় সামছুল মজুমদারকে তাঁর সঠিক শাস্তি দিতে আমাদের সাহায্য করবে। কিন্তু এসবের মাঝে ওরা জানলোও না যে এতক্ষণ ধরে পঙ্খি আর জাহানারার কথপোকথন আরও একজন ব্যাক্তিও শুনেছে। আজও অগোচরে সব শুনে চলে গেল সে।
কিছুক্ষণ পর ইন্ধনের গলা শোনা গেল।ইন্ধন পঙ্খির নাম ধরে ডাকছে। ইন্ধন বাসায় এসেছে বুঝতে পেরে পঙ্খি জাহানারাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বেড়িয়ে গেল। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো এখনি গিয়ে ইন্ধন কে সব বলবে সে। আর লুকাবেনা কিছু। এই মনস্তাপ করে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো সে। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ ডাক দিলো পঙ্খিকে। পঙ্খি থমকে গিয়ে পেছনে ফিরে দেখলে সামছুল মজুমদার দাঁড়িয়ে আছে। তাঁকে দেখে মনে মনে ভয় পেয়ে গেল পঙ্খি। ঢোক গিলে বললো।
–জ্বি বলুন কিছু বলবেন?
সামছুল মজুমদার শক্ত গলায় বললো।
–কোথায় যাচ্ছ তুমি?
–কোথায় আর যাবো, ঘরে যাচ্ছিলাম। উনি এসেছে।
–তো? ইন্ধন কে সবকথা বলতে যাচ্ছিলে তাইনা?
পঙ্খি আরও ঘাবড়ে গেল। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো।
–ব বলতে মানে? কী বলতে যাবো?
–দেখ মেয়ে আমার সামনে নাটক করে লাভ নেই। আমি জানি জাহানারা তোমাকে সব বলে দিয়েছে। তাই ভনিতা না করে সরাসরি বলছি ভালো করে মাথায় গেঁথে নেও। এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছ প্রয়োজনে আমি কতটা ভয়ংকর হতে পারি। তাই আমার ভয়ংকর রুপ দেখতে চেয়ো না। তোমার মোটেও ভালো লাগবে না। তুমি নিশ্চয় দ্বিতীয় বার বিধবা হতে চাওনা তাইনা?
পঙ্খির অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল সামছুল মজুমদারের এমন ভয়ানক কথায়। সে আতঙ্কিত কন্ঠে বললো।
–মা মানে??
–মানে নিজের স্বামীর মঙ্গল চাইলে এসব কথা কাউকে বলবে না। নাহলে জেনে রাখ আমি যদি আমার নিজের সন্তানকে মারতে পারি তাহলে অন্যের ছেলেকে মারা টা আমার জন্য খুব একটা বড়ো ব্যাপার হবে না। তাই নিজের সংসার বাঁচাতে চাইলে আমার পথে কাটা হতে আসবেনা।নিজের সংসারে মন দাও। এসবে পড়তে এসোনা। আশা করি বুঝতে পেরেছ তুমি।না বুঝলে ফল ভোগ করতে তৈরি থেক।
কথাগুলো বলে চলে গেল সামছুল মজুমদার। পঙ্খি স্তব্ধের মতো দাঁড়িয়ে থেকে ওখানে। ভয়ে কাঁপছে তার হৃদয়। উনি যদি সত্যিই ইন্ধন কে কিছু করে দেয় তখন? না না আমি এটা হত দিবোনা, কিছুতেই না। পঙ্খি কোনরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে রুমে ঢুকলো। রুমে ঢুকতেই ইন্ধন আচমকা পঙ্খিকে কোলে নিয়ে গোল গোল ঘুরতে লাগলো। পঙ্খি হকচকিয়ে উঠে বললো।
–আরে আরে কী করছেন? পরে যাবো নামান প্লিজ।
ইন্ধন ঘোরা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে গিয়ে পঙ্খিকে নিজের সাথে আরও চেপে ধরে বললো।
–তোমার কী মনে হয় এই ইন্ধন তাঁর পঙ্খিকে কখনো পড়তে দিবে? কখনোই না।
পঙ্খি মুচকি হেঁসে বললো।
–আচ্ছা বুঝলাম, কিন্তু হঠাৎ এই উল্লাস কিসের জন্য তাতো বলুন।
–বলছি
ইন্ধন পঙ্খিকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে পকেট থেকে একটা চাবির গোছা বের করে বললো।
–টাডা…
পঙ্খি ভ্রু কুঁচকে বললো।
–এটা কীসের চাবি?
–এটা আমাদের ছোট্ট দুনিয়ার চাবি। আমি অনলাইনে রাজশাহীতে একটা ফ্ল্যাট কিনেছি। আজ ব্রোকার এসে চাবি দিয়ে গেল। আমরা এই বাসায়ই আমাদের নতুন জীবন গড়বে। এসব ঝামেলা থেকে অনেক দূর। আমাদের ভালোবাসাময় ছোট্ট দুনিয়া।
পঙ্খি মায়াভরা চোখে তাকিয়ে রইলো ইন্ধনের মুখপানে। কত খুশি দেখাচ্ছে ইন্ধন কে। ইন্ধনের মুখের এই খুশির জন্য পঙ্খি হাজার বার কুরবান হতে পারে। ইন্ধনকে সে কিছু হতে দিবেনা,কিছুনা। ইন্ধনই ওর সব। তাই ইন্ধনের সুরক্ষা আর ওর খুশির জন্য এখান থেকে চলে যাওয়াটাই ঠিক হবে। হ্যাঁ চলে যাবে ও। ইন্ধনের সাথে নতুন দুনিয়া গড়বে। আর কিছু চাইনা ওর কিছু না। ইন্ধনের জন্য নাহয় একটু স্বার্থপর হলো ও। কিন্তু ইন্ধন কে হারাতে পারবেনা কিছুতেই। পঙ্খি হঠাৎ আবেগী হয়ে ইন্ধন কে জড়িয়ে ধরলো। তারপর বললো।
–হ্যাঁ যাবো আমরা। আমরা কালই চলে যাবো এখান থেকে।
ইন্ধনও পঙ্খিকে বুকের মাঝে জড়িয়ে নিয়ে বললো।
–হ্যাঁ পঙ্খি চলে যাবো আমাদের নতুন দুনিয়ায়। যেখানে শুধু তুমি আমি আর আমাদের ভালোবাসা থাকবে। আর কিছু না।
দুজন নতুন দুনিয়ার স্বপ্ন নিয়ে ঘুমের দেশে পাড়ি দিলো। কিন্তু সকাল হতেই ওদের স্বপ্ন যেন মাঝপথেই থেমে গেল। কারণ সকালের সাথে মৃ,ত্যু,পুরীতে ঘটলো আরও একটি মৃ,ত্যু। এবার এলো সামছুল মজুমদারের পালা। বাকিদের মতো সামছুল মজুমদারেরও র,ক্তা,ক্ত লাশ পাওয়া গেল বাড়ির পাশের বাগানে। থমকে গেল আবারও সবকিছু।
চলবে……
#মৃগতৃষ্ণা–৩৬
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★পিটপিট করে চোখের পাতা খুলে নিজেকে অপরিচিত জায়গায় দেখে চমকে গেল পঙ্খি। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে আশেপাশে তাকালো সে। তখনই হাতে টান লেগে ব্যাথা পেল পঙ্খি। বাম হাতটার দিকে তাকিয়ে দেখলো হাতে স্যালাইনের সুচ লাগানো। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারলো এটা একটা হাসপাতালের কেবিন। আরও ভয় পেয়ে পঙ্খি। আ আমি এখানে কী করে এলাম? কী হয়েছে আমার? ই ইন্ধন কোথায়? ইন্ধন…. ইন্ধন…
আতঙ্কিত কন্ঠে জোরে জোরে ইন্ধন কে ডাকতে লাগলো পঙ্খি। কিছুক্ষণ পরেই ইন্ধন হন্যে হয়ে দৌড়ে এলো পঙ্খির কাছে। দুই হাতে মুখটা ধরে উদ্বীগ্ন কন্ঠে বললো।
–কী হয়েছে পঙ্খি? শরীর বেশি খারাপ লাগছে?
পঙ্খি ইন্ধনকে জড়িয়ে ধরে ভয়ার্ত কন্ঠে বললো।
–কোথায় ছিলেন আপনি? আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
ইন্ধন পঙ্খির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আদুরে গলায় বললো।
–ভয় কীসের? এইতো দেখ আমি এখানেই আছি তোমার কাছে।
কিছুক্ষন পর পঙ্খি মাথা তুলে বললো।
–কিন্তু আমি এখানে কী করে এলাম? আর কখন এলাম? কী হয়েছে আমার?
পঙ্খির প্রশ্নে ইন্ধনের চেহারায় কেমন অপ্রস্তুত ভাব দেখা গেল। কেমন নজর এড়াচ্ছে সে। আমতাআমতা করে বললো।
–আরে তেমন কিছু না। সকালে তুমি চাচার লা,শ দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলে। তাই আমি ঘাবড়ে গিয়ে তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। আর কিনা না।
পঙ্খির কেন যেন ইন্ধনের কথা আর ওর চেহারার মনোভাবের সাথে মিল পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে অন্য কোনো কিছু হয়েছে। ইন্ধন কে কেমন বিবর্ণ লাগছে। চোখ দুটোও অসম্ভব লাল হয়ে আছে। কী হয়েছে? আমার বড়ো কোনো অসুখ হয়নিতো,যার কারণে ইন্ধন কে এমন দেখাচ্ছে? নাকি আমিই বেশি ভাবছি? সকাল বেলা এতবড় একটা মর্মান্তিক ঘটনা হয়েছে। হয়তো সে কারণেও এমন হতে পারে। কাল রাতেই কতো খুশি ছিলো সে। আমাদের নতুন জীবনের স্বপ্ন সাজাচ্ছিল। অথচ সকাল হতেই এমন ঘটনা ঘটে গেল। এরজন্য নিশ্চয় সে পেরেশানিতে আছে। সামছুল মজুমদারের কথা ভাবতেই পঙ্খির মনে পড়লো কালকের কথা। কালতো সে সামছুল মজুমদারের ভয়ে ইন্ধন কে কিছু বলেনি। কারণ ইন্ধনের জীবনের ভয় ছিলো। কিন্তু এখন তো সেই ভয় নেই। তাই এখন আর চুপ করে থাকা ঠিক হবে না। ইন্ধন কে আমার সব খুলে বলতেই হবে। সেই ভাবনা অনুযায়ী পঙ্খি নিজেকে প্রস্তুত করে বলে উঠলো।
–শুনুন আপনাকে অনেক জরুরি কথা বলার ছিলো।
–হ্যাঁ বলোনা কী বলবে।
পঙ্খি একে একে সব কথা খুলে বললো ইন্ধন কে। সব শুনে ইন্ধন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো।
–আমি আগেই আন্দাজা করতে পেরেছিলাম এদের মাঝে অনেক ঘৃণিত সত্য লুকিয়ে আছে। তবে আমি ইচ্ছে করেই কখনো এসব ঘাটতে যাইনি। কারণ টা তো তোমাকে আগেই বলেছিলাম। তখন আমি শুধু ওই মহিলার (রাবেয়া) ভালোর কথা ভাবতাম। চাইতাম না আমার কারণে সে কোনো অসুবিধায় পড়ুক। তাই অনেক কিছু দেখেও আনদেখা করে দিতাম। আচ্ছা যাইহোক, এখন চলো বাড়ি ফেরা যাক।
–তার আগে আমাদের পুলিশ স্টেশনে যাওয়া উচিত। শাকিল ভাইকে সব সত্যি খুলে বলা উচিত।
ইন্ধন পঙ্খির হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নরম শান্ত সুরে বললো।
–দেখ পঙ্খি আমি এখন যা বলবো মন দিয়ে শোনো।আমি জানি তোমার মনটা অনেক পবিত্র। তুমি কারোর সাথে অবিচার হতে দেখতে পারোনা। তাদের সাহায্য করতে চাও তুমি। কিন্তু এই স্বার্থপর দুনিয়া তোমার মতো এতো ভালোনা পঙ্খি। আমি একারণেই তোমাকে এসবে পড়তে মানা করেছিলাম। কারণ আমি তোমাকে এসব ভেজাল থেকে দূরে রাখতে চাইছিলাম। তুমি যদি এখন পুলিশ কে এসব বলো তুমি কী ভেবেছ সব ঠিক হয়ে যাবে? না, বরং পুলিশ তোমাকেই উল্টো সন্দেহের ঘেরে নিবে। বারবার জেরা করবে তোমাকে। আদালতে হাজির হতে হবে তোমাকে। এইসব চক্রে পড়ে তোমার জীবন অতিষ্ঠ হয়ে যাবে। আর তুমি ভালো না থাকলে আমি কী করে ভালো থাকবো বলো। তাই বলছি এসব পুলিশকে বলার দরকার নেই। এমনিতেও যে অপরাধী সেই সামছুল মজুমদার তো মারাই গেল। তাহলে এখন আর ওসব ঘেটে কী লাভ? আর রইলো খু,নি,র কথা। সেটার জন্য পুলিশ আছে।তাই পুলিশকে ওদের মতো করে কাজ করতে দাও। আমাদের ওসবের মধ্যে পড়ার দরকার নেই। জানি হয়তো আমি একটু স্বার্থপরের মতো কথা বলছি। কখনো কখনো ভালো থাকতে গেলে একটু স্বার্থপর হতে হয়। তোমার জন্য আমি স্বার্থপর হতেও রাজি পঙ্খি। আমার জীবনে তুমি ছাড়া আর কিচ্ছু নেই পঙ্খি। আমার পৃথিবী বলতে শুধুই তুমি। আর তোমাকে আমি কোনমতেই হারাতে পারবোনা।আমি তোমাকে নিয়ে একটা প্রশান্তির জীবন চাই। তোমাকে নিয়ে এসব দূরে চলে যাবো আমি পঙ্খি। আমরা কালই চলে যাবো। এই কালপুরীতে আর থাকবোনা আমরা।
–কী বলছেন। কাল কী করে যাবো? আজই এতবড় ঘটনা হলো। কালই কীভাবে যাই আমরা? কেমন দেখাবে এটা?
–যেমন দেখাবে দেখাক। ওসব জানতে চাইনা আমি। আমার জন্য শুধু তুমি জরুরি। আর কিছু না। আমরা কালই যাবো মানে কালই যাবো। আমি গতকাল বাবার সাথে কথা বলেছিলাম এই নিয়ে। বাবা বলেছে, এটাই ভালো হবে। আমাদের এসব থেকে দূরে থাকাই ভালো। তাই আমরা কালই যাবো, এই নিয়ে আর কোন কথা শুনতে চাইনা আমি। প্লিজ পঙ্খি বোঝার চেষ্টা করো। এই দূষিত বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়াও কষ্টকর হয়ে গেছে আমার জন্য। প্লিজ পঙ্খি চলোনা দূরে কোথাও আমাদের সুখের একটা জীবন গড়ি।
ইন্ধনের আকুতির সামনে পঙ্খিও দূর্বল হয়ে পড়লো। পঙ্খির জন্যেও যে ইন্ধনই সব। ইন্ধনের চাওয়া-পাওয়া, খুশি পঙ্খির জন্য সর্বোপরি। তাই সেও ইন্ধনকে আস্বস্ত করে বললো।
–ঠিক আছে, তুমি যা বলবে তাই হবে। তোমার খুশিই আমার কাছে সবচেয়ে জরুরি।
–ঠিক আছে চলো তাহলে এখন বাড়ি ফেরা যাক। আজই গিয়ে সব গুছিয়ে নিবো।
একটু পরে ওরা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। বাড়ি আসতে আসতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল ওদের। ততক্ষণে সামছুল মজুমদারের দাফন কাফন সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। নিশ্চুপ বাড়ি টা যেন আরও নিশ্চুপ হয়ে গেছে। যদিও আজ আর তেমন কোন পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। খোদেজা বেগম ছাড়া আর কারোর কোনো আহাজারিও শোনা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে সাধারণ দিনের মতোই সবকিছু চলছে। আসলে একের পর এক মৃ,ত্যু দেখে সবাই যেন অভ্যস্ত হয়ে গেছে। পঙ্খি বাসায় এসে আগে জাহানারার সাথে দেখা করতে গেল। রুমে গিয়ে দেখলো জাহানারা স্বাভাবিক দিনের মতোই বসে আছে। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে না স্বামীর মৃ,ত্যু,র জন্য তাঁর মাঝে কোন শোকের ছায়া আছে। সামছুল মজুমদারের মতো স্বামীর জন্য কেউ শোকই বা করবে কীভাবে? নিকৃষ্ট একটা ব্যাক্তির জন্য মনে শুধু ঘৃণায় আসতে পারে। পঙ্খি এগিয়ে গিয়ে বসলো জাহানারার পাশে। কাঁধে হাত রেখে নরম সুরে বললো।
–ঠিক আছেন আপনি?
জাহানারা স্বাভাবিক সুরে বললো।
–আমার আবার কী হবে? আমি একদম ঠিক আছি। বরং আজ আরও ভালো আছি আমি। আমার ছেলের খু,নী আজ তাঁর যোগ্য শাস্তি পেয়েছে। যেটা তাঁর প্রাপ্য ছিল।
জাহানারার কথায় পঙ্খির মনে হঠাৎ একটা প্রশ্ন জাগলো।উনিই তো সামছুল মজুমদারের খু,ন করেন নি? না না আর ওসব ভাববো না আমি।এসব রহস্যের ধূম্রজালে আর জড়াবনা নিজেকে। ইন্ধন যা বলেছে এখন থেকে সেটাই মানবো আমি। পঙ্খি বলে উঠলো।
–আচ্ছা এখন তাহলে কী করবেন ভেবেছেন? মানে ওই লোকটা…
–জাকিরের কথা বলছ তো? সামছুল মজুমদার মরে যাওয়ায় আর কোন ভয় নেই। জাকির কে আমি রাতেই ওই ঘর থেকে বের করে কোনো হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে আসবো। ছেলেটা অনেক দিন কষ্ট পেয়েছে। এখন একটু শান্তি পাবে।
–তো এখন কী পুলিশ কে সব বলবেন আপনি?
–নাহ্, সামছুল মজুমদার তাঁর শাস্তি পেয়েই গেছে। আর যে ওঁকে মেরেছে সে ভালো কাজই করেছে।তাই সে যেই হোক, পুলিশকে কোনো কিছু বলে তাঁকে ধরিয়ে দিতে সাহায্য করবোনা আমি। তাই আর ওসব ঝামেলায় পড়তে চাইনা আর। কারণ এতে করে আমার সাথে সাথে জাকিরও অসুবিধায় পড়ে যাবে। ছেলেটা এমনিতেই অনেক কষ্ট ভোগ করেছে। আমার ছেলে নাঈম নিজের জান দিয়েও জাকির কে বাঁচিয়েছে। তাই আমার ছেলের আত্মার শান্তির জন্য আমিও জাকির কে সুরক্ষিত রাখবো। তাঁর জন্য যা করা লাগে করবো।
জাহানারার কথায় পঙ্খির মনে পড়লো সেদিন চুমকির বলা কথা। নাঈমকে যেদিন হ,ত্যা করা হয় তার আগের রাতে চুমকি নাঈমকে তিনতলার রুম থেকে নেমে আসতে দেখেছিল। তারমানে সেদিন হয়তো নাঈম জাকিরের সাথেই দেখা করতে গিয়েছিল। ধীরে ধীরে এখন সব পরিস্কার হচ্ছে। শুধু আসল খু,নী কে সেটাই অজানা। পঙ্খি ফোৎ করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো।
–ঠিক আছে, আপনি যেমনটা ভালো মনে করেন। আর হ্যাঁ, আরেকটা কথা বলার ছিলো আপনাকে।
–হ্যাঁ বলো।
পঙ্খি ওদের এবাড়ি থেকে চলে যাওয়ার কথা সব খুলে বললো। সব শুনে জাহানারা বললো।
–একদম ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছ তোমরা। এই কালপুরীতে তোমাদের না থাকাই ভালো। এখানে থাকলে তোমরা কখনো খুশি থাকতে পারবেনা। তাই এখান থেকে চলে যাওয়াই ভালো তোমাদের জন্য। আমি দোয়া করি তোমরা যেন সবসময় ভালো থাকো। তুমি হয়তো আমার ওপর রেগে আছ, কারণ আমি প্রথমে তোমার সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি। আসলে আমি মন থেকে কিছু বলতাম না। আমি চাইতাম খারাপ ব্যাবহার দেখে দেখার তুমি যাতে এই বাড়ি থেকে চলে যাও। এই বাড়ি থেকে চলে গিয়ে তুমি যাতে ভালোভাবে বাঁচতে পারো তাই আমি তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করতাম। তোমাকে সবসময় এবাড়ি থেকে চলে যেতে বলতাম। তবে যেদিন ইন্ধনের সাথে তোমার বিয়ে হয়েছিল সেদিন থেকে আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম। কারণ আমি জানতাম ইন্ধন তোমাকে ভালো রাখবে। তোমাকে একটা সুন্দর জীবন দিবে। তবুও আমার কথায় কখনো কষ্ট পেয়ে থাকলে আমাকে মাফ করে দিও।
–কী বলছেন আম্মা। আপনার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। আর আপনার কথায় কখনো রাগও করিনি আমি। আমি জানতাম ছেলে হারিয়ে আপনি কষ্টে ওসব বলছেন। তাই আপনার কথা কখনো আমি মনে লাগায়নি। তাই মাফ দয়া করে মাফ চাইবেন না প্লিজ। মায়েরা কখনো সন্তানের কাছে ক্ষমা চায়না। শুধু দোয়া করে। দোয়া করুন আমাদের সংসার জীবন যেন সুখের হয়।
–অবশ্যই। আল্লাহ তোমাদের ভালো রাখুক।
–ঠিক আছে, আমি যাই। আমার আবার ব্যাগ পত্রও ঘোছাতে হবে।
–ঠিক আছে যাও।
পঙ্খি রুমে এসে দেখলো ইন্ধন তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যাচ্ছে। পঙ্খিকে দেখে বললো।
–এসেছ তুমি? আমি গোসলে যাচ্ছি। তুমি ততক্ষণে ব্যাগপত্র গোছানো শুরু করে দাও।
–ঠিক আছে
ইন্ধন ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। পঙ্খি আলমারি থেকে কাপড় চোপড় বের করে যা যা নিবে তা গোছাতে লাগলো। বড়ো লাগেজ টা বের করার জন্য আলমারির নিচের পার্টে গিয়ে লাগেজ টা টেনে বের করতে লাগলো। কিন্তু লাগেজ টা কিসের সাথে যেন আঁটকে গেছে, বের হচ্ছে না। পঙ্খি এবার হ্যান্ডেল ধরে জোরে একটা টান মারলো। জোরে টান লাগায় আলমারির ছোট ড্রয়ার টাও ঠাস করে খুলে গেল। আর ড্রয়ার খুলতেই পঙ্খি থমকে গেল। ভালো করে খেয়াল করে ড্রয়ারের মাঝে একটা ধারালো চা,কু আর হাতের এক জোরা কালো গ্লাভস দেখতে পেল। এসব দেখে আৎকে উঠলো পঙ্খি। অন্তর কেঁপে উঠল তাঁর। এগুলো এখানে কি করে এলো? এগুলো কী ইন্ধন রেখেছে? কিন্তু কেন? তবে কী ইন্ধনই সেই খু,নী? না না কী ভাবছি আমি এসব? এটা হতে পারে না। ইন্ধন এমন করতেই পারে না। কখনোই না।
তখনই ইন্ধন ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এলো। পঙ্খি চমকে তাকালো ইন্ধনের দিকে। পঙ্খিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইন্ধন ভ্রু কুঁচকে বললো।
–কী হয়েছে?
পঙ্খি আলমারীর ড্রয়ারের দিকে আঙুল তুলে ইশারা করে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো।
–এ এসব কী?
পঙ্খির ইশারা অনুযায়ী ড্রয়ারের দিকে তাকাতেই ইন্ধন চমকে গেল। তাঁর চোখে মুখে ভীতি ছেয়ে গেল। পঙ্খী আবারও বললো।
–বলুন এগুলো এখানে কী করে এলো?
ইন্ধন নজর এড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। তারপর বলে উঠলো।
–আমি এনেছি।
হৃদয় কেঁপে উঠল পঙ্খির। শরীরের ভার রাখতে না পেরে এক কদম পিছিয়ে গেল সে। ঢোক গিলে কম্পিত কণ্ঠে বললো।
–আ আপনি এনেছেন মানে? কে কেন এনেছেন আপনি?
–তোমার কী মনে হয়?
–তবে কী আপনিই???
–কথা পুরো করো। হ্যাঁ আমিই সেই খু,নী। আমিই মেরেছি সবাইকে।
পঙ্খির মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। স্তদ্ধ পাথর হয়ে গেল সে। নিজের কানকে তাঁর বিশ্বাস হচ্ছে না।
চলবে…..