#মৃগতৃষ্ণা-৯
#লেখিকা-মেহররুমা নূর
★পূর্ব দিগন্তে সূর্যের আলো প্রতীয়মান হয়ে প্রদোষকাল কে ধীরে ধীরে বিদায় জানিয়ে দিলো। অভ্যাসের বশীভূত পঙ্খি নিত্যকার ন্যায় আজও প্রাতঃকালেই নিদ্রা ছেড়েছে। সালাত আদায় আর কোরআন তেলওয়াত শেষে একটু বেলকনিতে এসে দাঁড়াল সে। রাতে যে বৃষ্টি হয়েছে এই ভেজা গাছের পাতা তার সাক্ষী দিচ্ছে। এক শীতল স্নিগ্ধ বাতাস ছুঁয়ে গেল তার সর্বাঙ্গে। বর্ষাকাল পঙ্খির প্রিয় মৌসুম। ঝুম বরষা তার অনেক ভালো লাগে। রাতের বেলা যখন টিনের চালায় বৃষ্টির ফোটা রিনিঝিনি শব্দ তুলে বর্ষে তখন ঘুমটা যেন আরও শান্তির হয়। যদিও এইবাড়িতে টিনের চালা নেই।(লেখিকা-মেহরুমা নূর)। তবুও যেটুকু শোনা যায় সেটুকুই উপভোগ করার চেষ্টা করে। বৃষ্টিতে ভিজতেও তার খুব ভালো লাগে। আগে কতো বৃষ্টিতে ভিজেছে সে। বৃষ্টিতে ভিজে ক্ষেতে খামারে কাদার ভেতর লাফিয়ে বেড়িয়েছে।ওর সাথে থাকতো কিছু বিচ্ছুর দল। তবে এখন তো ওসব শুধুই অতীত। এবাড়িতে আসার পর আর বৃষ্টির সান্নিধ্যে পাবার সৌভাগ্য হয়নি তার। শুধু এই বেলকনি থেকেই দেখতে হয়েছে।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বেলকনি ত্যাগ করলো পঙ্খি। ছায়া আর ওর ফুপু শাশুড়ীর মেয়েগুলো এখনোও তন্দ্রাঘোরে। নামাজের জন্য কতবার করে ডাকলো তাদের। কিন্তু কেউই উঠলো না। নড়েচড়ে আবারও ঘুমিয়ে পড়েছে তারা। পঙ্খি হতাশার নিঃশ্বাস ছেড়ে তার কাজে লেগে পড়লো। ঘড়ের মেঝে ঝাড়ু দিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগুলো সে। রান্নাঘরে এসে সকালের খাবারের আয়োজনে লেগে পড়লো। একটু পরে কনিকা এলো রান্নাঘরে। সেও রান্নার কাজে হাত লাগালো। কনিকার মুখে কাপড় বাঁধা দেখে পঙ্খি ভ্রু কুঁচকে বলল,
–কি হয়েছে ভাবি? এভাবে মুখ বেঁধে রেখেছেন কেন? মুখে কিছু হয়েছে?
কনিকা আমতাআমতা করে বললো।
–না তেমন কিছু না। আসলে গ্যাসের গন্ধ সহ্য হচ্ছে না আমার। তাই নাক ঢেকে আছি।
কনিকার এই ব্যাপার টাও পঙ্খির মনে আবারও গর্ভবতীর দিকেই ইশারা করলো। তবুও কিছু বললো না সে। আবারও যদি কনিকা রেগে যায় এই ভেবে।ঠিকমতো কোনকিছু না জেনে শুধু সন্দেহের বসে কারোর ব্যাক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানো ঠিক হবে না। একটু পরে রাবেয়া আর জাহানারাও এলো রান্নাঘরে। জাহানারা কি কি খাবার রান্না হবে তার বর্ননা দিয়ে দিলো। এবং রাবেয়া আর জাহানারাও ওদের সাথে কাজে হাত লাগাচ্ছে।পঙ্খি খেয়াল করলো জাহানারা বেগমের চোখ মুখ কেমন ফ্যাকাসে হয়ে আছে। পঙ্খি চিন্তিত সুরে বললো।
–আম্মা আপনার কি শরীর খারাপ? কেমন যেন দেখাচ্ছে আপনাকে।
জাহানারা সবসময়ের মতোই ঝাঁঝাল সুরে বলে উঠলো।
–এতো আদেখ্যেতা দেখাতে হইবো না। নিজের কাজ করো।
পঙ্খি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দ্রুত হাত চালনোর চেষ্টা করছে।মেহমান থাকায় রান্নার চাপ বেশি। ওর আবার পরিক্ষাও দিতে যেতে হবে। এতো কাজের চাপে ঠিকমতো পড়ার সময় পাইনি। যাই বা পড়েছে এখন আবার সময়মত পরিক্ষায় উপস্থিত থাকতে পারলে হয়।
রান্না শেষে টেবিলে খাবার পরিবেশন করছে পঙ্খি। ধীরে ধীরে সবাই এসে বসলো খাবার টেবিলে। একটু পরে ইন্ধনও এলো। ইন্ধনকে দেখে কাল রাতের কথা মনে পরে গেল পঙ্খির। মনে মনে ভীষণ ক্ষোভ হলো তার লোকটার প্রতি। ওই দূর্ব্যবহারের কারণ জানতে ইচ্ছে হলো। তবে সবার সামনে এখন সেটা সম্ভব না। তাই চুপ করে রইল সে। ইন্ধন চেয়ার টেনে বসতেই রাবেয়া ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে বললো।
–কি হয়েছে বাবা চেহারার এমন বেহাল দশা কেন? তোর কি শরীর খারাপ করেছে?
বলতে বলতে ইন্ধনের মাথা কপালে হাত বোলাতে লাগলো। ছেলের চিন্তায় রাবেয়ার মন অস্থির। পঙ্খি একবার আরচোখে তাকিয়ে দেখলো ইন্ধনের চোখ মুখ সত্যিই কেমন যেন হয়ে আছে। চোখ দুটো তো অসম্ভব লাল হয়ে আছে। রাতভর নেশা করলে আর কি হবে।
ইন্ধন খিটখিটে কন্ঠে বললো।
–আরে কিছুই হয়নি মা। তুমি শুধু অস্থির হইও না। রাতে ঘুম ঠিকমতো হয়নি। তাই এমন দেখাচ্ছে।
–সত্যি তো? আচ্ছা এখন খেয়ে নে। খেয়ে দেয়ে একটু আরাম কর ভালো লাগবে।
–মা আমার খেতে ইচ্ছে করছে না এখন। আমি একটু উল্লাপাড়া যাবো। এমপির সাথে মিটিং আছে। ওখানেই কিছু খেয়ে নিবো।
–না না আমি তোকে খালি মুখে যেতে দিবোনা। কিছু খেয়ে যা। পঙ্খি, ইন্ধনের জন্য একটা পরোটা আর পায়েস নিয়ে এসোতো।
পঙ্খি মাথা ঝাকিয়ে একটা প্লেটে পরোটা আর পায়েস নিয়ে এসে ইন্ধনের সামনে রাখলো। ইন্ধন খেতে না চাইলেও রাবেয়া মানলো না।তিনি নিজের হাতেই খাইয়ে দিতে লাগলেন। ইন্ধন একবারের জন্যও পঙ্খির দিকে চোখ তুলে তাকাইনি। বিষয় টা প্রথমে তেমন লক্ষ্য না করলেও। অনেক টা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর পঙ্খির নজরে আসলো বিষয় টা। সে খেয়াল করলো ইন্ধন সবদিকে তাকাচ্ছে। শুধু ওর দিকেই তাকাচ্ছে না। আর না কোনো কথা বলছে ওর সাথে।(লেখিকা-মেহরুমা নূর) ইন্ধনের মতিগতি কিছুই ঠাওর করতে পারছে না সে। একেতো কাল রাতে ওমন দুর্ব্যবহার করলো।তবু্ও পঙ্খি ভেবেছিল হয়তো নেশার ঘোরে হুঁশ না থাকায় ওমন করেছি। হয়তো সকালে নিজের কাজে লজ্জিত হবে, সরি বলবে। কিন্তু এখানে তো সেসবের কোনো বালাই দেখা যাচ্ছে না। হয়েছে কি লোকটার? যাক, যা খুশি হোক। এসব ভাবার অযথা সময় নেই পঙ্খির। তার এখন জলদি পরিক্ষার জন্য বের হতে হবে। খাবার পরিবেশনের কাজ শেষ করে পঙ্খি শাশুড়ীর উদ্দেশ্যে বললো।
–আম্মা আমি এখন তাহলে বের হই। নাহলে পরিক্ষায় দেরি হয়ে যাবে।
জাহানারা কিছু না বলে শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। পাশ থেকে তখন পঙ্খির ফুপু শাশুড়ী জুলেখা বলে উঠলো।
–ভাবি তোমাদের মনে হয়না তোমরা ওকে একটু বেশিই ছুট দিচ্ছো? বিয়ে হয়ে গেছে এখন আবার কিসের পড়াশোনা? পড়া লেখা করে কি উনি ব্যারিস্টার হয়ে যাবে নাকি?ওকে দিয়ে কি আমরা চাকরি করে খাওয়াবো নাকি?
জাহানারা বলে উঠলেন।
–আমি কি জানি। এসব তোমার ভাইয়ের সিদ্ধান্ত।
খোদেজাও মেয়ের সাথে সায় দিয়ে বললেন।
–আমারও তো হেই কথা। কিন্তু হোনে কেডো এই বুড়ির কথা। সামছুই ছেড়িরে এহেবারে মাথায় তুইলা রাইখছে। আমি কতবার না কইরল্যাম, হুনলই না।
–হ্যাঁ ভাই, মাতো ঠিকই বলেছে। আর তাছাড়া একটা যুবতী বিধবা নারীকে এভাবে বাইরে ছেড়ে দেওয়া ঠিক হচ্ছে? পড়ে না আবার বংশের মুখে চুনকালি লাগায়।
পঙ্খি মাথা নিচু করে শুধু এদের কথা শুনে যাচ্ছে। মন তার অনেক কথাই বলতে চাইছে। তবে চাইলেও যে অনেক কিছু করা যায় না। তবে ওদের কথার মাঝেই হঠাৎ ইন্ধন ঠাস করে উঠে দাঁড়াল। এতটাই জোরে দাঁড়াল যে, চেয়ারটাও পেছনে উল্টে পড়ে গেল। চোখ মুখের ভাব কেমন কঠিনত্ব হয়ে উঠেছে। ইন্ধনের এভাবে হঠাৎ উঠে দাঁড়ানোয় সবাই ওর দিকে তাকালো। তবে ইন্ধন শুধু ওর মায়ের দিকে থমথমে গলায় বললো।
–আমি বাইরে যাচ্ছি মা।
কথাটা বলেই হনহন করে চলে গেল সে। ইন্ধন যাওয়ার পর সামছুল মজুমদার বলে উঠলেন।
–এসব কথা বাদ দাও তোমরা। আমি যখন কিছু করেছি তখন ভেবে চিন্তেই করেছি। তোমরা আর এই নিয়ে কথা বাড়িও না। পঙ্খি মা তুমি যাও, তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।
পঙ্খি মাথা নেড়ে ওখান থেকে চলে গেল।
__
পরিক্ষা দিয়ে ফেরার পথে রাস্তার মধ্যে এসে হঠাৎ সিএনজি থেমে গেল। পঙ্খি ভ্রু কুঁচকে বললো।
–কি হয়েছে চাচা থামালেন কেন?
–রাস্তায় কি জানি হইছে। দেহনা সব ভ্যান রিকশা আইটকা আছে। যামু কেবো হইরা?
পঙ্খি মাথা বের করে সামনে উঁকি দিয়ে দেখলো সত্যি সব আটকা পড়ে আছে। এটা গ্রামের সরু রাস্তা। এখানে বড় বাস ট্রাক তেমন আসে না। তাহলে এতো জ্যাম পড়লো কিসের জন্য? বিষয় টা দেখার জন্য পঙ্খি সিএনজি থেকে নেমে একটু এগিয়ে গেল। কিছুদূর যেতেই দেখতে পেল এক বিশাল ভীড়। কোনরকমে ফাঁক ফোকর দিয়ে ভেতরে কি চলছে তা দেখার চেষ্টা করলো সে। অতঃপর সে যা দেখলো তাতে সে চমকে উঠলো। ভীড়ের মাঝে ইন্ধনকে মারপিট করতে দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেল সে। ইন্ধন একটা ছেলেকে বেধরম মারছে। মারতে মারতে তাকে প্রায় আধামরা করে ফেলেছে। ছেলেটার নাক মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। তবুও উনি বেরহম ভাবে মেরেই যাচ্ছেন।কয়েকজন উনাকে টেনে সরানোর চেষ্টা করেও ব্যার্থ হচ্ছেন। মুখমন্ডলে যেন রক্ত টগবগ করছে তার। ইন্ধনের এমন ভয়ানক রুপ দেখে পঙ্খির গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে । এমন নির্মমতা আর দেখতে পারলোনা সে। সরে এলো ওখান থেকে। আসার সময় কিছু লোকের কথা কানে এলো ওর। তারা বলছে,
–আরে ইন্ধন ভাইয়ের আজ কি হয়েছে? এতো রেগে গেছেন কেন? এমনিতে তো এতো রাগেন না উনি।
–কি জানি কি হইছে। আজ উনার মেজাজ এমনিই খারাপ ছিল। তারওপর এই ছ্যাড়া কি জানি কইছে ভাইরে। ব্যাস ভাইতো ব্লাস্ট হয়ে গেছে। এহন এই ছ্যাড়ার কপালে না জানি কি আছে।
–আরে এই ছ্যাড়া আবার বিরোধী দলের লোক নাকি?
–কি জানি হইতে পারে।
পঙ্খি দ্রুত পায়ে সোজা সিএনজিতে এসে বসলো। লোকটাকে সে ভালো ভেবেছিল। কিন্তু এখন তো সেই ভাবনার ওপর যথেষ্ট সন্দেহ হচ্ছে ওর। ইন্ধনের প্রতি ওর মনে যে ইতিবাচক মনোভাব হয়েছিল, তা এখন নেতিবাচক মনোভাবে পরিবর্তন হচ্ছে। অদৃশ্য এক ক্ষোভ জন্ম নিচ্ছে তার প্রতি। এমন নির্মম ভাবে কেউ কাউকে মারতে পারে?
__
বাড়ি আসতেই দেখলো পঙ্খির ফুপু শাশুড়ীর মেয়ে, মেয়ে জামাইরা মিলে সবাই নৌকা ভ্রমণে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে। বাড়ির বড়োরা ছাড়া বাকি সবাই যাবে। পঙ্খিকেও নিয়ে যেতে চাইছে তাঁরা। ফুপু শাশুড়ীর মেয়ে লুবনা আর শাপলা সেই কখন থেকে পঙ্খিকে রেডি হওয়ার জন্য তাগাদা দিচ্ছে। পঙ্খিরও অনেক ইচ্ছে হচ্ছে ওদের সাথে যাওয়ার। কতদিন হলে সে বাইরের প্রকৃতির সাথে মিশে কথা বলে না। কিন্তু ওর পরিক্ষা চলছে। তাই মন চাইলেও যেতে পারছেনা সে। কিন্তু লুবনা আর শাপলা কোনকিছু শুনতে নারাজ। তারা পঙ্খিকে নিয়েই যাবে। অগত্যা ওদের জোরাজুরিতে রাজি হয়ে গেল পঙ্খি।(লেখিকা-মেহরুমা নূর)। নিত্যকার ন্যায় বোরখা পরিধান করে তৈরি হয়ে গেল সে। বিকেল চার টার দিকে বের হলো ওরা। ওদের সাথে বাড়ির কাজের মেয়ে চুমকি আর কলিমও যাচ্ছে। সবাই যাচ্ছে, শুধু ইন্ধন বাদে। কারণ তার কোন হদিস নেই। ফোন করেও নাকি তাকে পাওয়া যায় নি। পাবে কি করে? সে যে মারপিট করতে ব্যাস্ত।যাক ভালোই হয়েছে। লোকটা যত দূরে থাকে ততই ভালো। মনে মনে এসব বললো পঙ্খি।
নদীর ঘাটে আসলো সবাই। বড়ো একটা মটর লাগানো নৌকা ভাড়া করা হয়েছে। সবাই খুবই উচ্ছ্বসিত হচ্ছে। আসলেই নৌকা ভ্রমণের আনন্দ টাই আলাদা।রাস্তায় চালিত কোন যান্ত্রিক বাহনের সাথে এর তুলনাই হয়না। সবাই একে একে উঠে গেল নৌকায়। জুবায়েদ প্রথমে ওর বউ কনিকাকে হাত ধরে উঠালো। তারপর একে একে বাকিদেরও হাত ধরে উঠাতে সাহায্য করছে। একসময় পঙ্খির দিকেও একইভাবে হাত বাড়িয়ে দিলো সে। তার আসল লক্ষ্য টাই তো পঙ্খির হাত ধরা। এজন্যই তো সে সবাইকে এই সেবাদান করছে। অধীর আগ্রহে পঙ্খির দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো জুবায়েদ। পঙ্খিও সরল মনে তার হাত বাড়িয়ে জুবায়েদের হাত ধরার জন্য। তবে হঠাৎ কাঁদায় পা পিছলে গিয়ে পেছন দিকে পড়ে যেতে লাগলো পঙ্খি। তবে শেষ মুহূর্তে কারোর শক্ত হাত তার ডান হাতটা ধরে ফেললো। পঙ্খি পড়া থেকে বেঁচে গিয়ে পেছন দিকে কাত হয়ে রইলো। পাশে তাকিয়ে দেখলো ইন্ধন ওর হাত ধরে আছে। তবে ওর দিকে একবারের জন্যও ওর দিকে তাকাইনি। ইন্ধন অন্য দিকে তাকিয়ে থেকেই পঙ্খির হাত ধরে এক টান মেরে ওকে সোজা নৌকায় তুলে দিলো। তারপর নিজেও নৌকায় উঠে একেবারে নৌকার মাথায় গিয়ে উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে রইলো। ইন্ধনের এহেন আচরণে পঙ্খির একটু রাগ হলো বৈকি। তবুও যথারীতি চুপ রইলো সে।চুপচাপ একপাশে গিয়ে বসে রইলো।
অন্যদিকে জুবায়েদের মনকামনা আবারও বিফল হওয়ায় মেজাজ টাই খারাপ হয়ে গেল তার। কবে যে সে তার মনকামনা পূরণ করতে পারবে কে জানে। এই ইন্ধন টা মাঝখান থেকে এসে আমার কাজ বিগড়ে দিলো।
ইন্ধনের সাথে শাকিলও এসেছে। সেও উঠলো নৌকায়। শাকিল কে দেখে ছায়া মনে মনে একটু ভয় পেয়ে গেল। শাকিল তাকে রোজ নদীর ঘাটে দেখা করতে বলেছিল। কিন্তু আজতো এই নৌকা ভ্রমণের চক্করে যাওয়াই হয়নি। নাজানি এই চ্যাকা পুলিশ আবার কি করে? শাকিল ছায়ার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি দিল। তারপর একপাশে গিয়ে বসলো সে।
ইন্ধন নৌকার একেবারে মাথায় গিয়ে উল্টো দিকে দুই পা দুই দিকে ঝুলিয়ে বসলো। (লেখিকা-মেহরুমা নূর)। পকেট থেকে সিগারেট বের করে জ্বালালো সেটা। সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া ছুড়তে লাগলো সে। ইন্ধনের এই কাজটা পঙ্খির মনে তার প্রতি নেতিবাচক মনোভাব টা আরও একধাপ এগিয়ে গেল। দিনেদিনে যেন ইন্ধনের সব খারাপ দিকটা ওর সামনে আসছে। এমনটাই ধারণা পঙ্খির। তবে সে এখন ওসবে মাথা ঘামাতে চায়না। এতদিন পর ও প্রকৃতির এতো কাছে এসেছে। আজ শুধু মন খুলে সেটা উপভোগ করবে ও। পঙ্খি নিজেকে প্রকৃতির মায়ায় হারালো। এক হাত নামিয়ে হালকা করে পানির মাঝে ছুঁইয়ে দিচ্ছে।
ইন্ধনের ফুপুর বড়ো মেয়ে লুবনা ইন্ধনকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো।
–কি ব্যাপার ভাইয়া? তুমিতো একেবারে নিরুদ্দেশই হয়ে গেছিলা? যাও বা ফোন ধরলে, তখন তো বললে যে আসবেনা। তা আবার এলে যে?
ইন্ধন নিকোটিনের ধোঁয়া ছেড়ে, উল্টো ঘুরে থাকা অবস্থায়ই বলে উঠলো।
–হ্যাঁ আসতে তো চেয়েছিলাম না। কিন্তু কি করবো? তোরা যদি আবার নদীতে পড়ে টরে যাস তাই বাঁচাতে আসলাম।
শাপলা আমোদিত কন্ঠে বললো।
–সত্যি ভাইয়া তুমি আমাদের বাঁচানোর জন্য এখানে এসেছ?
–আরে না, তোদের কেন বাঁচাতে আসবো? তোদের মতো ধরনীর বোঝা দুই চারটা কমে গেলে তাতে বরং দুনিয়ার উপকারই হবে। আমিতো এখানে আমার নদীর মাছগুলো বাঁচাতে এসেছি। তোদের মতো এমন চর্বি যুক্ত মাংস তাদের পেটে গেলে মাছগুলোর তো হাই কোলেস্টেরল হওয়ার ভয় আছে তাইনা? শুধু মানুষের ভালো মন্দ দেখলে হবে? এসব পশুপাখির খেয়ালও রাখতে হবে।
শাকিলও ইন্ধনের সাথে সায় দিয়ে বললো।
–এক্কেরে হত্যি কথা কসু ভাই। মাইয়া মানুষ বলতেই হলো আস্ত একটা বোঝা। মাথায় তো বুদ্ধি নামের কোন গোবরই নাই। মানে তাদের গর্দভ বলাটাও গাধার ইনসাল্ট। কতগুলো উদাহরণ তো আশেপাশেই আছে।
কথাটা বলে শাকিল আরচোখে ছায়ার দিকে তাকালো। ছায়া মুখে কিছু বললো না। তবে চোখের আগুন দিয়ে ভস্ম করে দিলো শাকিলকে।
ওদের এরুপ তিরস্কারে শাপলা তেতে উঠে বললো।
–ভাইয়া তুমি এমন বলতে পারলে? আমরা কি এতো মোটা নাকি?
–সেটা আমাকে জিজ্ঞেস না করে তোদের হাসব্যান্ড দের জিজ্ঞেস কর। বেচারাদের চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে তারা কতো প্যারায় আছে। তোদের বোঝা উঠাইতে উঠাইতে কবে না নিজেরাই উঠে যায়।
ইন্ধনের কথায় লুবনা আর শাপলা দুজনেই তাদের স্বামীদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। বেচারারা ইন্ধনের উদ্দেশ্যে অসহায় কন্ঠে বললো।
–ভাই আপনাদের ভাই বোনের কথার মাঝে আমাদের কেন বলির পাঠা বানাচ্ছেন? আপনি তো বাড়ি গিয়ে আরামে জীবনযাপন করবেন। আমাদের তো বাড়ি যেতে হবে তাইনা? এই অল্প বয়সে কেন পটল তোলাতে চাচ্ছেন?
ওদের করুন বাণীতে হেঁসে উঠলো সবাই। পঙ্খিও হালকা হাসলো। পঙ্খি শুনতে পেল তার থেকে এক হাত দূরে বশা কলিম আর চুমকির কথপোকথন। এসবের মাঝে সবচেয়ে খুশি যেন ওদেরই দেখাচ্ছে। কলিম চুমকিকে বলছে,
–মেলা সুন্দর লাইগতাছে তোমারে।
চুমকি লজ্জায় নতজানু হয়ে বলছে,
–তোমার দেওয়া ঠোটপালিশ আর নকপালিশ লাগাছি। কেবা হইছে?
–হত্যিই? তাই তো এতো সুন্দর লাইগতাছে তোমাক। ওই যে ভারতের লায়িকা(নায়িকা) মতোন।
–হত্যি কও? কোন লায়িকা?
–আরে ওইযে গান কয়না চিকন চাউল,চিকন চাউল (চিকনি চামেলি) ওই লায়িকার মতোন।
–তোমারেও মেলা সুন্দর লাইগতাছে। ওইযে সলেমান খানের মতো।
চুমকির তারিফ শুনে তেরাভ্যারা দু পাটি দাঁত বের করে বিস্তর এক হাসি দিল কলিম। তার কালো মুখখানা রোদে যেন আরও চিকচিক করে উঠলো। কলিমকে হাসতে দেখে শাকিল কন্ঠণালী একটু উঁচু করে বললো।
–কি ব্যাপার কলিম ভাই, এতো খুশি কি কামে? ঘটনা কি?
কলিম কিছুটা লাজুক ভঙ্গিতে হেঁসে বললো।
–আসলে আমার আর চুমকির বিয়া ঠিক হইয়া গেছে। কয়দিন পরেই বিয়া। তাই আরকি..
–আরিব্বাস, তুমিতো মিয়া দেহি ছক্কা হাঁকাই দিছো। সাবাস কলিম ভাই। তুমিই আমগো মরদ জাতির গর্ব।
কলিম যেন আরও গদগদ হয়ে গেল। ইন্ধনও কলিমের দিকে তাকিয়ে বললো।
–তুমি সত্যিই অনেক লাকি কলিম ভাই। ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পাবার সৌভাগ্য কয়জনের হয়। আজতো অনেক হিংসা হচ্ছে তোমাকে দেখে।
লুবনার স্বামী বলে উঠলো।
–কেন ভাই এতো হিংসার কি আছে? শুনেছি গার্লফ্রেন্ড নাকি আপনারও আছে। তা আপনিও করে ফেলুন বিয়ে। এভাবে বেশিদিন ফেলে রাখা ঠিক না। তারওপর নাকি পরদেশে থাকে। দেখা গেল আপনারে রাইখা আরেকজনকে বিয়ে করে ফেললো। তখন তো খালি পস্তাতে হবে।
কথার প্রতিত্তোরে ইন্ধনের পক্ষ থেকে কোন জবাব এলোনা। উল্টো ঘুরে থাকায় তার মুখশ্রীর মনোভাবও দেখতে পেলনা কেউ। দেখতে পেল না তার হাতে চেপে ধরা জ্বলন্ত সিগারেট টাকে।
চলবে…..