#মৃত_কাঠগোলাপ -১৪,১৫,১৬
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
১৪
ঘরময় তীব্র নিকোটিনের গন্ধ! ধোঁয়ার গন্ধে পাকস্থলী যেন গুলিয়ে আসে। ওসমান নেহাৎ ভদ্র লোক হওয়ায় নিকোটিন ছুঁয়ে দেখে না। কিন্তু ধ্রুবর কারণে ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও নিকোটিনের ধোঁয়া গিলতে হয়। ধ্রুব ল্যাপটপের সামনে বসে আছে। ঠোঁটে বাঁকা হাস। চোখে উজ্জ্বলতা! গায়ে জড়িয়ে থাকা ফকফকা সাদা বাথরুব, যা হাঁটু অব্দি এসে থেমে গেছে। হাঁটুর নিচে দৃশ্যমান রোমশ ত্বক! ধ্রুব সোফায় হেলান দিয়ে বসল। দু হাত দু দিকে ছড়িয়ে সোফার হাতলে রেখে তাকাল ওসমানের দিকে। ওসমান মাথা নত করে কিছু একটা ভাবছে। ধ্রুব বলল,
‘ কি ব্যাপার ওসমান? কিছু নিয়ে টেন্সড? ‘
ওসমান জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজাল। কিছুটা জড়তা নিয়ে বলল,
‘ আসলে, তেমন কিছু না স্যার। ‘
‘ আরে, বলো বলো। আজ মনটা ভালো। যা চাইবে তাই পাবে। সময় থাকতে সুযোগটা লুফে নাও। ‘
ওসমান এবার খানিক সহজ হল। হাতের উপর হাত রেখে ঘষছে। ওসমান বলল,
‘ স্যার, সামনের সপ্তাহে পর আমার মেয়ের বিয়ে। তাই ছুটি….’
ওসমানের কথা আটকে গেল ধ্রুবর তীক্ষ্ম শকুনি নজরে। ভ্রু দুটি ভাঁজ হয়ে যেন চোখের পাতায় নেমে এসেছে। ওসমানের আর কথা বাড়ানোর সাহস হল না। কথাগুলো গলাধঃকরণ করে নিশ্চুপ চিত্তে মাথা নত করে নিল। ধ্রুব কণ্ঠে তীক্ষ্ণতা ঢেলে ঘোষণা করল,
‘ মেয়ের বিয়ের জন্যে টাকাটাই হল মেইন। টাকা ছাড়া আজকাল ভিখারীও বিয়ে করতে চায়না। তুমি এত বছর ধরে আমার সাথে আছ। তাই তোমায় একটুখানি দয়া করাই যায়। সময়মত টাকা পৌঁছে যাবে তোমার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। ‘
ওসমান ছলছল চোখে মাথা নত করে রইল। টাকাই কি দুনিয়ার সব? তার স্ত্রী কতদিন ধরে বলছে, তাদের একটু সময় দিতে। অন্তত মেয়ের বিয়েতে স্ত্রী, ছেলে মেয়ের সাথে থাকতে। টাকার অভাব সে কখনই করে নি। ধ্রুব তাকে মাসে অনেক টাকা দেয়। কিন্তু প্রিয়জনের সাথে কাটানো মুহূর্ত কি টাকা দিয়ে কেনা যায়? ওসমানের চোখ বেয়ে টপ করে এক ফোঁটা জল গড়াল। ধ্রুব ওসমানের দিকে তাকাল না। বরং ল্যাপটপের স্ক্রিনে ভাসমান আয়েশীর ঘুমন্ত চেহারা দেখে চোখে তৃষ্ণা মেটাচ্ছে। আর কিসের অপেক্ষা? এবার তার আদরের রক্তজবাকে নিজের কাছে বন্দী করার সময় হয়ে গেছে। অনেক তো হলো এই ছল চাতুরী। এবার নাহয় জড়তার সুতো ছিঁড়ে যাক, অনুভূতিগুলো আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে আসুক, সম্পর্ক দড়ি মজবুত হোক!
খোঁচা খোঁচা দাড়ি ভর্তি থুতনিতে আঙ্গুল ঘষে কিছু একটা চিন্তা করল ধ্রুব। অতঃপর ফিক করে হেসে ফেলল। ধ্রুবর আচমকা হাসির শব্দে ওসমান অবাক হল। ধ্রুবর দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাল। ধ্রুব ল্যাপটপে দিকে চেয়ে বলল,
‘ আমার রক্তজবার ভাই কোথায় চাকরি করে, ওসমান? ‘
ওসমান শিউরে উঠল। আতঙ্কে বুক ভেসে গেল। এখন কি তবে আরেকটা ফুলের মত জীবন ঝরতে যাচ্ছে? ওসমান চুপ করে গেল। উত্তর না পেয়ে ধ্রুব বড় বিরক্ত হল। ভ্রুরু কুঁচকে এল। ধমকে বলল,
‘ চুপ কেন? উত্তর দাও? ‘
ওসমান কম্পিত কণ্ঠে বলে,
‘ একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে। ‘
‘ তার বাবা তো রিটায়ার্ড, তাইনা? ‘
‘ আব.. হ-হ্যাঁ স্যার। ‘
‘ দ্যাটস গুড! ‘
ধ্রুব পুনরায় ল্যাপটপে চোখে রাখল। আয়েশীর স্কার্ট বটে হাঁটুর উপরে চলে এসেছে। টপসও কোমড় থেকে সরে গেছে। কাপড় উল্টেপাল্টে বিচ্ছিরি লাগছে দেখতে। এই মুহূর্তে আয়েশীকে ভীষন আবেদনময়ী লাগছে। ধ্রুব ল্যাপটপের উপর দিয়ে আয়েশীর উন্মুক্ত কোমড়ে হাত রাখল। সঙ্গেসঙ্গে তার সারা অঙ্গে কাঁপন ধরল। চোখ বুজে গেল। মেয়েটার শরীরে কি বিদ্যুৎ খেলে? কি ভয়ঙ্কর!
আয়েশীর শরীরের স্পর্শে ধ্রুবর লোম শিহরণে যেন ঝলসে যায়। ধ্রুব চোখ বুজে মিনমিন করে বলে,
‘ দ্য টাইম হ্যাজ কাম, ফ্লাওয়ার ক্যান্ডি। বন্দি হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করো, রক্তজবা! আর মাত্র কয়েকদিন! যত পারো উড়ে নাও। পাখনা কাটার জন্য আমি আসছি। ‘
ওসমান শুধু চেয়ে থাকে এক মানুসিক বিকারগ্রস্থ ভয়ংকর এ লোকের পানে। ক্রমাগত ঢোক গেলে। ভয়ে ঘাম জমে। এই প্রথম কোনো মেয়ের জন্যে ওসমানের করুণা হচ্ছে। ধ্রুব একটা ভালো মেয়ের জীবন তার ভয়ানক থাবায় তছনছ করতে যাচ্ছে। মেয়েটার কি দুর্ভাগ্য! দুঃখে ওসমানের চোখে জল ভরে।
______________________________
‘ ওই আর সরি মিস্টার তুষার মাহবুব! কোম্পানির ইনফরমেশন লিক করার অপরাধে আপনাকে চাকরি থেকে বহিস্কার করা হল। ‘
বসের কথা শুনে তুষারের মাথায় যেন বজ্রপাত হল। চোখে অন্ধকার দেখল। তুষার উত্তেজিত হয়ে বলল,
‘ ইম্পসিবল স্যার। আমি এ ধরনের কাজ করিনি। গত তিন বছর ধরে আমি এ কোম্পানিতে চাকরি করছি। এ কোম্পানিকে নিজের দায়িত্ত্ব বলে ভেবে এসেছি। আমি কেন এ কাজ করব? ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড স্যার। আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। ‘
জিহাদ হোসেন গম্ভীর হয়ে কি বোর্ড হাত চালালেন। তুষারকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বললেন,
‘ দুপুরের মধ্যেই রিজেগনেশন লেটার তোমার কাছে পৌঁছে যাবে। ইউ মে গো নাও। ‘
তুষারের মুখ তেতো হয়ে গেল। দাঁতে দাঁত লেগে গেল ভয়ংকর রাগে। যে অপরাধটি সে করেনি সে অপরাধের সাজা কেন সে পাচ্ছে? তুষার আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু বস চোখ গরম করে তাকালেন তুষারের দিকে। তুষার দমে এল। চোখ দিয়ে আগুন ঝড়িয়ে গটগট করে বেরিয়ে গেল বসের কক্ষ থেকে। তুষার চলে গেলে জিহাদ হোসেন হাফ ছাড়েন। তুষারের উপর মিথ্যা আরোপ লাগাতে তার কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু তিনি নিরুপায়। তার হাত যে পরিবারের মমতা দিয়ে বাঁধা।
‘ কাজ হয়ে গেছে ‘ জিহাদ হোসেন মোবাইলের কিবোর্ড চেপে নির্দিষ্ট নম্বরে মুঠো বার্তা পাঠিয়ে দিলেন। বক্স থেকে টিস্যু নিয়ে কপালের ঘাম মুছে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন। ভীষন অসহ্য লাগছে তার। হার্টের রোগটা কি তবে পুনরায় বৃদ্ধি পেল?
#চলবে
#মৃত_কাঠগোলাপ – ১৫
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
তপ্ত দুপুর। সূর্যের ঝাঁঝালো আলো মেখে বিষন্ন মনে পার্কের বেঞ্চে বসে আছে তুষার। যন্ত্রণায় মাথা বোধহয় ফেঁটে যাচ্ছে। তুষার নখ খুঁটছে। মাথাটা ডানে কিছুটা হেলিয়ে রাখা। চিন্তা হচ্ছে নিজের জন্যে, পরিবারের জন্য, সবার ভবিষ্যৎ জীবনের জন্যে। বাবা রিটায়ার্ড করেছেন আজ প্রায় এক বছর। বেসরকারি বিদ্যালয়ে চাকরি করায় পেনশনের টাকাও পাওয়া হয়নি। বাবা রিটায়ার্ড করার পর সংসারের হাল ধরেছে তুষার। একা হাতে পুরো সংসার সামলেছে। ফসকে যাওয়া চাকরি মোটামুটি ভালো বেতনের ছিল। এখন এমন চাকরি কোথায় পাবে সে? তুষার গলা জ্বলছে। পানি খেতে পেলে ভালো লাগত।
‘ পানি। ‘
চেনা কণ্ঠ শুনে তুষার মাথা তুলে তাকাল। ধ্রুব দাড়িয়ে আছে। ধ্রুবর হাতে মিনারেল ওয়াটার। তুষারের দিকে পানির বোতল এগিয়ে হাস্যোজ্জ্বল মুখে চেয়ে আছে।
‘ তুমি এখানে? ‘
‘ অফিস থেকে ফিরছিলাম। এ রাস্তা দিয়ে যাওয়ার পথে আপনার দিকে চোখ গেল। গোমড়া মুখে বসে আছেন, তাই দেখতে এলাম। ‘
তুষার হাফ ছাড়ল। পানির বোতল হাতে নিয়ে কয়েক ঢোক পানি খেয়ে বোতলের ছিপি আটকাল। ধ্রুব তুষারের পাশে বসল। কিছুক্ষণ দুজনের মধ্যে কোনো কথা হল না। তুষার নিশ্চুপ বসে আছে। ধ্রুব সময় দিচ্ছে তুষারকে। ভেবেছিল, তুষার হয়তো নিজ থেকে বলবে। অথচ তুষার কিছু বলছে না। তাই ধ্রুব নিজ থেকে কথা বাড়াল।
‘ কিছু নিয়ে টেন্সড? ‘
তুষার কিছুক্ষণ চুপ থাকল। অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ধ্রুব বলল,
‘ একটা কথা জানেন। দুঃখ আর দীর্ঘশ্বাস দুজন ভাই ভাই। তারা আমাদের জীবনে সবসময় একসঙ্গে দলবেধে আসে। আমাদের জীবনে যত বেশি দীর্ঘশ্বাস থাকবে, দুঃখও তত বেশি হবে। তাই আমাদের উচিৎ দীর্ঘশ্বাসকে আটকে রাখা। আর দুঃখের সাথে যুদ্ধ করে তাকে হারিয়ে দেওয়া। ‘
ধ্রুব কথার ছলে তুষারকে গুমরাহ করল। ধ্রুবর কথা হয়ত তুষারের মনে ধরল। তুষার কিছুক্ষণ পর নিজে থেকে বলল,
‘ চাকরিটা হাতছাড়া হয়ে গেছে, ধ্রুব। কি হবে এখন? আমি কিছু ভাবতে পারছি না। টেনশন হচ্ছে। ‘
ধ্রুব তুষারের অগোচরে মুচকি হাসল। লাইনে এসে গেছে। ধ্রুব এবার নিজের সাজানো নাটক শুরু করল। তুষারের দিকে চেয়ে বলল,
‘ তো কি হয়েছে? একটা গেলে আরেকটা আসবে। এতে এত চিন্তার কি আছে?’
‘ তুমি বুঝছ না। এই চাকরিটাই আমাদের ভাত দেয়। চাকরি চলে গেলে এত ভালো বেতনের চাকরি পাওয়া আমার জন্যে মুশকিল হয়ে যাবে। আজকাল চাকরি পাওয়া খুব কঠিন। এই চাকরি অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে পেয়েছিলাম। এটাও হাত ফসকে গেল। ধুর! ‘
‘ আর যদি আপনি এর থেকেও ভালো বেতনের চাকরি পান, তবে আফসোস থাকবে? ‘
তুষার ভীষন অবাক হলো। চোখ তুলে চেয়ে রইল ধ্রুবর দিকে। বলল,
‘ কিন্তু এখন হুট করে এমন চাকরি কোথায় পাব? ‘
‘ আমার অফিসের একটা পোস্ট খালি করব। এখনকার ম্যানাজার খুব লোভী। ফাঁকফোঁকর পেলে টাকা চুরি থেকে শুরু করে ইনফরমেশন লিক করে। অনেকদিন ধরে ভাবছি তাকে পাল্টে দেব। তবে ভালো যোগ্যতাসম্পন্ন ম্যানাজার পাচ্ছিলাম না। এখন যেহেতু তুমি আছ, তবে তুমি নাহয় দায়িত্ত্বটা নাও। এক মাস চাকরি কর। তোমার কাজ দেখে তোমার গদি পাকাপোক্ত করা হবে। জানো তো, আমি কাজের ব্যাপারে কখনো কম্প্রোমাইজ করিনা। কি বলো? ‘
‘ না, না। তোমার কষ্ট করতে হবে না। আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেব। ‘
‘ আপনি আমার বড় ভাইয়ের মত। আপনার বিপদে সাহায্য করা আমার কাছে আনন্দের। তবে ভাববেন না দয়া করছি। আমি আসলেই একজন বিশ্বস্ত ম্যানাজারকে খুজছি। আর আমি জানি আপনি আমার কোম্পানিকে নিজের মনে করেই কাজটি করবেন। আমি আপনাকে ভরসা করি। ‘
ধ্রুবর কথা একেবারে ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না। তুষার কিছুক্ষণ ভাবল। চাকরিটা কি তার নেওয়া ঠিক হবে? এই চাকরি গ্রহন করলে ধ্রুবর দয়ার নিচে কি তারা দমে থাকবে? ধ্রুব বেঞ্চে হেলান দিয়ে বসে আছে। ঠোঁটে মুচকি হাস। সে জানে, তুষার রাজি হবে। হাতি কাদায় পড়লে চামচিকাও লাথি মারে। তুষারের বিষয়টা খানিক এমন। রাজি না হয়ে তুষারের হাতে আর কোনো উপায় রাখে নি ধ্রুব।
তুষার কিছুক্ষণ ভাবল। মা বাবা, বোনের চেহারা চোখে ভেসে উঠল। তুষার চাকরি না করলে তারা খাবে কি? বোনেরও এখন অনেক টাকার ঔষধ লাগে। এত টাকা কোথায় পাবে সে? তুষার আর উচিত অনুচিত ভাবতে পারল না। চট করে রাজি হয়ে গেল। ধ্রুব হাসল। তুষারের কাধে হাত রেখে বলল
‘ দ্যাটস গুড ডিসিশন। এখন আমি যাই। এখন আবার সেই ভূতুরে বাড়িতে প্রবেশ করতে হবে। কি আর করার। ‘
তুষার অবাক হল। বলল,
‘ তোমার বাড়ি ত ভালোই সুন্দর। ভুতুড়ে বলছ কেন? ‘
ধ্রুব দুঃখ পাওয়ার ভান করে বলল,
‘ যে বাড়িতে লক্ষ্মী নেই, সেই বাড়ি তো ভুতুড়ে বাড়ীর মতই।’
‘ মানে? তোমার মা নেই? ‘
ধ্রুব মলিন হেসে বলল,
‘ না। কেউ নেই আমার। আমি একা । ‘
‘ তাহলে বিয়ে করছ না কেন? ‘
ধ্রুব এবার মুচকি হাসল। বলল,
‘ যাকে ভালোবাসি, সে তো অন্যের প্রেমে মজে আছে। তাকে ভালবেসে দুঃখ পুষছে। কিন্তু আমার কোনো আফসোস নেই। আমি তাকে দূর থেকেই ভালোবাসব। ‘
তুষার হয়তো কিছু একটা আন্দাজ করতে পারল। বাবার কাছে বিষয়টা শুনেছে সে। সে ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ তুমি কি আয়েশীর কথা বলছ? ‘
ধ্রুব মলিন হেসে, দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তুষার অবাক হল। কি করবে ভেবে পেল না। আয়েশী কি কখনো রাজি হবে ধ্রুবকে বিয়ে করতে? মৃদুলকে আয়েশী এখনো অনেক ভালোবাসে। মৃদুলের জায়গা ধ্রুবকে কি দিয়ে দিতে পারবে আয়েশী? কিন্তু ধ্রুব তাদের পরিবারকে এত সাহায্য করছে। তার একটা আশা কি তারা পূরণ করতে পারবে না? তাছাড়া ধ্রুব আয়েশীকে ভালোবাসে। আয়েশী ধ্রুবর সংস্পর্শে এলে দ্রুত সুস্থ হবে। একসময় মৃদুলকে ভুলতে সক্ষমও হতে পারে। তুষার চিন্তায় পড়ে গেল। ধ্রুবকে বিদায় জানিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে পা বাড়াল। দেখা যাক কি করা যায়?
ধ্রুব পায়ের উপর পা তুলে আরাম করে বসল। দুহাত বেঞ্চের হাতলে ছড়িয়ে দিয়ে বাবু সাজল। রহস্যময় হেসে বলল,
‘ সঠিক জায়গায় ঢিল মে*রে দিয়েছি। বাকি কাজটা এই বোকা কুকুরটাই অপস সরি, শালামশাই-ই করে দেবে। এভাবেই তোদের মত চুনোপুটিদের একে একে হাত করব। তারপর একদিন টুপ করে রাঘব বোয়ালকে খাচায় পুড়ে নেব। তারপর, তারপর…..সব ফিনিশড! হা হা হা! ‘
__________________________
তুষার পড়ার টেবিলে মাথা ঝুঁকে বসে আছে। আজকে বিকেলের কথা চিন্তা করছে। একটু পর তুষারের মা এক কাপ চা এনে তুষারের ঘরে প্রবেশ করেন।
‘ তুষার, তোর চা। বিস্কুট লাগবে? ‘
‘ না, লাগবে না। কাপ টেবিলের উপর রেখে যাও। ‘
তুষারের মা চলে যাওয়ার জন্যে পা বাড়ালেন। তবে পেছন ডাকল তুষার। বলল,
‘ মা, আয়েশী কে ডেকে দাও তো। কথা আছে ওর সঙ্গে। ‘
‘ ডেকে দিচ্ছি। ‘
পাঁচ মিনিট পর, আয়েশী তুষারের ঘরে এল। বলল,
‘ ভাই, ডেকেছিলে? ‘
তুষার চোখ তুলে তাকাল আয়েশীর দিকে। এ কদিনে নিজের এ কি অবস্থা করে ফেলেছে আয়েশী? যে মেয়েটা দুদিন পর পর নিজের ত্বকের যত্ন নিত। তার চোখের নিচে আজ দু ইঞ্চি জুড়ে ডার্ক সার্কেল। হাতে পায়ের নখ কাটেনি কয়দিন হল? শরীরের দিকে বিন্দুমাত্র নজর নেই। বোনের এহেন করুন অবস্থা দেখে চোখে জল ভরে তুষারের। তুষার চেয়ার টেনে বলে,
‘ বস আমার পাশে। ‘
আয়েশী বসে। গোমড়া মুখে চেয়ে রয় মাটির দিকে। তুষার আলতো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
‘ মা বললো দুপুরে ভাত নাকি খাস নি। এমন করলে চলবে, হু? শরীর খারাপ করবে তো। ‘
আয়েশী মৃদ কণ্ঠে জানায়,
‘ ক্ষুধা ছিল না। ‘
‘ ক্ষুধাকে হজম করে বসে থাকলে ক্ষুধা লাগবে কি করে? ‘
আয়েশীর কথা বলতে ভালো লাগছে না। আয়েশী বলে,
‘ কি বলার জন্যে ডেকেছিলে? ‘
তুষার বুঝতে পারল, আয়েশীর খারাপ লাগছে। তুষার সোজা মূল কথায় আসে। বলে,
‘ মৃদুলকে ভোলার চেষ্টা কর, বোন। আর কত এভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরবি? আমার তোকে এভাবে ছন্নছাড়া হয়ে দেখতে ভালো লাগছে না। ভীষন কষ্ট লাগছে। ‘
মৃদুলের নাম শুনে আয়েশীর চোখ ভিজে উঠে। গলা আটকে আসে। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। কথা বলতে পারে না। গলায় পাথর চাপে। আয়েশী কিছুটা কঠোর হয়ে বলে,
‘ মৃদুলকে ভোলার কথা কক্ষনো বলবে না, ভাই। আমার সহ্য হয়না। ‘
তুষার বোনের মাথায় হাত বোলায়। বলে,
‘ ভুলতে হবে, বোন। অতীত আকড়ে কেউ কখনো বাঁচতে পারেনি। অতীতকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে হয় সবার। নাহলে ভালো থাকা যায়না। তুই ভালো থাক, এটা চাওয়া কি আমাদের জন্যে খুব দোষের? ‘
আয়েশী কিঞ্চিৎ হাসল। বলল,
‘ মৃদুল আমার কাছে কোনো কালো কিংবা জঘন্য অতীত নয় ভাই, যে তাকে ভুলে যাব। মৃদুল আমার কাছে আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অতীত। সুন্দর জিনিস কখনো ভুলা যায়না। আমি মৃদুলকে ভুলতে চাইছি না, ভাই।’
তুষার আরো কথা বলতে চায়। কিন্তু আয়েশী চেয়ার ছেড়ে উঠে যায়। তুষারকে আর কথা বলতে না দিয়ে চুপ করে বেরিয়ে যায় তার ঘর থেকে। তুষার চেয়ে রয় শুধু। আয়েশীকে ধ্রুবর কথা বলা যাবে না। ক্ষেপে যাবে। এর চেয়ে ভালো বাবা মা সবাইকে বলে আয়েশীর সাথে কথা বলতে হবে। সবাই মিলে আয়েশীকে বুঝালে নিশ্চয়ই সে মানা করতে পারবে না। আগামীকাল-ই বাবার সাথে তুষার কথা বলবে।
#চলবে –
#মৃত_কাঠগোলাপ – ১৬
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
কামরুল হাসান শোবার ঘরে গুরুত্বপূর্ন সভা ডেকেছেন। বাবার নির্দেশমত ঘরের সবাই কামরুল হাসানের ঘরে এসেছেন। কামরুল আয়েশীকে নিজের পাশে বসতে বললেন। আয়েশী বাধ্য মেয়ের মত বাবার পাশটায় বসল। কামরুল হাসান মেয়ের চুলে হাত বুলিয়ে দিলেন। বাবার আদরে আয়েশী ছোট্ট বিড়াল ছানার ন্যায় বাবার গায়ের সাথে মিশে গেল। কামরুল হাসান মেয়েকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে মাথায় হাত বুলালেন। কিছুক্ষণ থেমে বললেন,
‘ মা, একটা কথা কি জানো? ছোটবেলা থেকে তোমাদের সবার আবদার আমার কাছে ভীষন প্রিয় ছিল। আমাদের মধ্যবিত্তের সংসার। মাস শেষে যা হাতে আসত তাই দিয়েই টেনেটুনে সংসার চলে যেত। কিন্তু আমি কোনোদিনও তোমাদের কোনো আবদার অপূর্ন রাখিনি। আজ আমি তোমার কাছে একটা আবদার করব? রাখবে? ‘
আয়েশী বিস্মিত হল। বাবার কথার অর্থ বোধগম্য হল না। আয়েশী ফ্যালফ্যাল চোখে বাবার দিকে তাকাল। কামরুল আবার সুধালেন,
‘ কি মা? রাখবে বাবার আবদার? ‘
আয়েশী বাবার চোখে চোখ রাখল। বাবার ভরাট চোখে স্পষ্ট কাতরতা। বাবা কি দুঃখ পাচ্ছেন? বাবা দুঃখ পেলে আয়েশীর একটুও ভালো লাগে না। তাই আয়েশী অকপটে বলল,
‘ রাখব, বাবা। ‘
কামরুল হাসান কিছুটা গম্ভীর হলেন। আজ নিজেকেমেয়ের কাছে নিজেকে ছোট মনে হচ্ছে। কিন্তু বাবা হিসেবে তিনি যে বড্ড স্বার্থপর! মেয়ের ভালোর জন্য তিনি সবকিছু করতে পারেন। কামরুল কিছুক্ষণ থেমে, মুখ ভরে নিঃশ্বাস পুড়লেন। অতঃপর, ভরাট কণ্ঠে জানালেন তার আবদার,
‘ তুমি ধ্রুবকে বিয়ে করে নাও। ‘
আয়েশীর মাথায় যেন বজ্রপাত হল। মাথাটা ঘুরে আসতে লাগল। আয়েশী এক হাতে খামছে ধরল বিছানার চাদর। অস্ফুটসুরে বলল,
‘ এ আবদার আমি রাখতে প-পারবো না। আমি মৃদুলের জায়গায় কাউকে বসাতে পারবো না, বাবা। আমায় ক্ষমা করো। ‘
কামরুল হাসান দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তিনি জানতেন, আয়েশী এমন কিছুই বলবে। তবে শেষ চেষ্টা করতে দোষ কোথায়? কামরুল হাসান বলেন,
‘ মা রে…আমরা কেউই অমর নই। আমাদের সবাইকে একদিন মরতে হবে। তাই বলে আমাদের জীবন কি থেমে থাকে? জীবন স্রোতের ন্যায় বয়েই যায়। তোমায় নিজেকে সামলানো শিখতে হবে। এভাবে ঘরকুনো হলে, তুমি বাঁচতে পারবে না। আর মৃত্যু কখনো কোনো সমাধান হতে পারে না। ধ্রুব খুব ভালো ছেলে, মা। আমি জানি ও তোমায় সুখে রাখবে। একবার বাবাকে ভরসা করো। ‘
কামরুল হাসান কথা বলছেন! তার চোখে জল জমেছে। কথার শেষ প্রান্তে এসে এক ফোঁটা জল টপ করে গড়িয়ে পড়ল চোখ বেয়ে। আয়েশী নিশ্চুপ হয়ে চেয়ে দেখছে বাবাকে। বাবাকে কখনো কাদতে দেখেনি আয়েশী। সবসময় বাবার হাসিমুখের সাথেই আয়েশী পরিচিত। দাদী মারা গেলেন, বাবা কাদেনি। দাদু মারা গেলেন, বাবা শুধু মুখ বুজে কঠিন হয়ে বসে ছিল। কিন্তু আজ? আজ বাবা কাদঁছে। আয়েশী নিজে তার বাবার চোখের জলের কারণ হয়েছে! এর থেকে বিশ্রী অনুভূতি আর কিছুই হতে পারে না। কিন্তু আয়েশী কি করবে? সে পারবে না, তার মনে মৃদুল ব্যতীত অন্য কাউকে স্থান দিতে। সে দুনিয়াতে মৃদুলের জন্যে অপেক্ষা করবে, পরকালে মৃদুলকে নিজের জীবন সঙ্গী হিসেবে গ্রহন করবে বলে! না, না। মৃদুলের জায়গায় আয়েশী কাউকে ভাবতে পারছে না। কাউকে না! ধ্রুব আর ও? ছিঃ, ছিঃ!
আয়েশী বাবার চোখের দিকে তাকাল না। বাবার পাশে কর এক মুহুর্ত থাকলে সে দুর্বল হয়ে পড়বে। আয়েশী দুর্বল হতে চায়না। আয়েশী মৃদুলকে হারাতে চায়না! আয়েশী বিছানা ছেড়ে উঠে গেল। বাবার দিকে না তাকিয়ে বলল,
‘ আমায় ক্ষমা করো, বাবা। আমি তোমার এই আবদার রাখতে পারলাম না। আমি খুব খারাপ সন্তান। তুমি আমাকে আর ভালোবেসোও না। তোমার ভালোবাসা, আদর কোনো কিছুর যোগ্য না আমি। আমি খুব খারাপ, খুব খারাপ! ‘
আয়েশী ধপাধপ পা ফেলে নিজের ঘরে চলে এল। ঘরে প্রবেশ করেই দরজা বন্ধ করে দিল। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে বালিশে মুখ গুজে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগল। তার জীবনটা এমন না হলেও পারত। সে আর মৃদুল মিলে তাদের খুব সুন্দর এক সংসার হতে পারত। চড়ুই পাখির সংসার!
আয়েশী হাউমাউ করে কাদতে লাগল। বাবাকে কষ্ট দিয়েছে সে। আয়েশী খুব খারাপ! সন্তান হওয়ার কোনো যোগ্যতাই নেই আয়েশীর। আয়েশী মাথার চুল সব টেনে ছিঁড়ে ফেলতে লাগল। নিজের গায়ে নখ দিয়ে আঁচড় কেটে রক্তাক্ত করে ফেলল। এত কষ্ট কেন হচ্ছে তার? এত যন্ত্রণা, এত মানুষিক চাপ আর সহ্য হচ্ছে না। সবাই মরে, আয়েশী কেন মরে যাচ্ছে না?
_____________________
কান্না করতে করতে, ক্লান্ত আয়েশী সেখানেই ঘুমিয়ে গেল। চোখ খুললো দরজায় করাঘাতের শব্দে। মা বারবার করাঘাত করছেন দরজায়। শব্দ করে আয়েশীকে ডেকে যাচ্ছেন দরজার ওপাশ হতে। আয়েশী দ্রুত উঠে দরজা খুলে দিল। আয়েশীর মা হাউমাউ করে কাদতে কাদতে বললেন,
‘ আয়েশী রে, তোর বাবা কেমন যেন করছেন। হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। আমার খুব ভয় করছে। জলদি তুষারকে একটা ফোন লাগা। মানুষটার হুট করে কি হয়ে গেল। ইয়া আল্লাহ! ‘
আয়েশী হতবম্ব হয়ে গেল। মায়ের কান্না-আহজারি কিছুই মাথায় প্রবেশ করছে না। সদ্য ঘুম থেকে উঠে, এমন নিষ্ঠুর খবর শুনতে পেয়ে তার কান ভনভন করছে। আয়েশী ঢোক গিলে বলল,
‘ শা-শান্ত হও মা। আমি এক্ষুনি ফোন দিচ্ছি ভাইকে। তুমি গিয়ে দ্রুত বোরকা পড়। বাবাকে হসপিটাল নিতে হবে। ‘
#চলবে