#মৃত_কাঠগোলাপ-২,৩
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
০২
সেই অনুষ্ঠানে ধ্রুবর ভীষন মনে ধরেছে আয়েশীকে। সম্পূর্ণ অনুষ্ঠানে ধ্রুবর নয়ন শুধুমাত্র একজনাতে আটকে ছিল। সে হলো, আয়েশী। আয়েশী যখন নৃত্যের তালে কোমড় দুলায়, ধ্রুবের মনে হয় তার মাথা ধরে যাচ্ছে এক অদ্ভুদ ঘোরে। আয়েশীর হাসি তো হাসি নয় যেন আস্ত এক বিষবাণ! ধ্রুবর পাথরের ন্যায় মন চট করে আয়েশীর প্রেমে নাস্তানাবুদ হয়ে গেল।
নাচ শেষ হলো! আয়েশী স্টেজ থেকে নেমে পুনরায় বন্ধুদের পাশে এসে দাঁড়ালো। ধ্রুব মনেমনে উশখুশ করছে এই অতীব সুন্দরী নারীর সঙ্গে কথা বলার জন্য। তার সুন্দর মুখের মত তার কণ্ঠেও কি জাদু আছে? তার শরীরের মেয়েলি বাঁকের ন্যায় আকর্ষণীয় কি তার আচরণও? ধ্রুবর আর তর সইলো না। ধ্রুব চট করে নিজের চেয়ার ছেড়ে স্টেজ ছেড়ে নেমে গেল। অনুষ্ঠানের অন্যান্য অতিথিরা সবাই ধ্রুবর এমন কাণ্ডে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। অনেকেই তাকে পেছন থেকে ডাকতে চাইলেন। তবে ভার্সিটির ভিসি তাদের আটকে দিলেন। চোখের ইশারায় জানালেন, ‘ ধ্রুবকে না আটকাতে। যদি তারা তাকে আটকায়, তবে ধ্রুবের রাগ উঠবে। আর ধ্রুবের রাগ কতটা ধ্বংসাত্মক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ‘ ‘
ভিসি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরো জানান, ‘ ধ্রুব পেছন ডাকা পছন্দ করে না। তিনি এও জানালেন, ধ্রুব কতটা মারাত্বক খারাপ মানুষ!’
ভিসির কথা শুনে সবার থম হয়ে গেল। কপাল বেয়ে ঘাম ছুঁটল। তরুণ টগবগে এক মানুষ, আর সে কি না এতটা ভয়ানক! এতটা মারাত্মক মানুষের পেছনে লাগতে না যাওয়াই ভালো বোধ হল তাদের! তাই তারা সবাই চুপচাপ নিজেদের চেয়ারে বসে ভয়ার্ত চোখে ধ্রুবকে লক্ষ্য করতে লাগল।
ধ্রুব গায়ের কালো ব্লেজার খুলে হাতে নিল। চুলগুলো হাত দিয়ে একটু পেছনে ঠেলে সুদর্শন হওয়ার চেষ্টা করল। তবে তার কোনো বিশেষ প্রয়োজন ছিল না। ভার্সিটির অন্যান্য মেয়েরা এমনিতেও ধ্রুবের আচরণে ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে! তারা নানা ভঙ্গিমায় ধ্রুবের নজরে পড়ার চেষ্টা করছে। হায়, কি অবুঝ তারা!
আর এক কদম এগুলেই আয়েশী! কিন্তু সেই এক কদম আর বাড়ানো হলো না ধ্রুবর। হঠাৎ আয়েশীর এক ছেলে বন্ধু আয়েশীর হাতখানা নিজের মুঠোয় পুড়ে নিল। ধ্রুব স্পষ্ট লক্ষ্য করলো, ছেলেটার স্পর্শে আয়েশীর মুখে লজ্জার আভা। আয়েশী প্রাণখুলে হাসছে। হঠাৎ হঠাৎ সেই ছেলেটার কাধে মাথা রেখে সুখী সুখী নিঃশ্বাস নিচ্ছে। ধ্রুবর বুঝতে বাকি নেই, এই ছেলেটি আয়েশীর প্রেমিক পুরুষ! ছেলেটাকে আয়েশীর কাছাকাছি ভাবতেই ধ্রুবর মাথায় রক্ত উঠে গেল। কপালের রগ ফুলে নীল রঙা আকার ধারণ করল। হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে ধ্রুব দু কদম পিছিয়ে গেল। পকেট থেকে ফোন বের করে কাউকে কল করে টগবগে রাগ নিয়ে জানালো,
‘ আধা ঘন্টার মধ্যে ওই ছেলেটার লাশ আমি আমার পায়ের নিচে চাই! গট ইট? ‘
কোনো কথা শোনার আগেই ধ্রুব ধাম করে ফোন কেটে দিল। ফাঁকা এক স্থানে দাড়িয়ে ধ্রুব পলক ফেলা বিহীন নজরবন্দী করছে আয়েশী ও তার আশপাশের মানুষজনকে। একবার মেয়েটাকে নিজের হাতে এনে ফেলুক, তারপর বুঝাবে অন্যদের সাথে প্রাণখুলে হাসিমজার করার শাস্তি!
হঠাৎ একজন ওয়েটার ধ্রুবর কাছে এগিয়ে আসলো।
‘ স্যার, এনি ড্রিংকস? ‘
ধ্রুবর মনোযোগে বাঁধা পড়ায়, সে আগুন চোখে ওয়েটারের দিকে তাকাল। ধ্রুবর এমন হিংস্র চাওনি দেখে একপ্রকার গুটিয়ে গেল সেই ওয়েটার। মাথা নত করে চুপচাপ চলে যেতে নিলে, ধ্রুব তাকে আটকায়। তার হাতের ট্রে থেকে একটা ড্রিঙ্কস নিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় সেই ওয়েটারকে। ধ্রুবর ধাক্কায় ওয়েটার ট্রে শুদ্ধ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। ট্রেতে থাকা সকল কাচের গ্লাস ফটাফট মাটিতে পড়ে ভেঙে যায়! কয়েকটা কাঁচের টুকরো বিধে যায় ওয়েটারের হাতে পায়ে! ধ্রুবর এসবে লক্ষ নেই। সে হাতে থাকা কাঁচের গ্লাসটা একহাতে শক্ত করে ধরে তখনও চেয়ে আছে আয়েশীর দিকে। ওয়েটার ধ্রুবর এমন নির্লিপ্ততা দেখে হুড়মুড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়। এক মুহুর্ত কাল বিলম্ব না করে দৌঁড়ে পালিয়ে যায় সেখান থেকে।
আয়েশী ও তার প্রেমিক পুরুষের লীলাখেলা ক্রমশ ধ্রুবর কাছে অসহ্য ঠেকছে। রাগ-টা কিছুতেই সামলানো যাচ্ছে না। রাগে ধ্রুবর হাতে থাকা কাঁচের গ্লাসটা এতই শক্ত করে ধরেছে যে একসময় সেই কাঁচের গ্লাস ধ্রুবের হাতেই ভেঙে যায়। ধ্রুব তখনো নির্বিকার। গ্লাসের কাঁচ গুলো সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে ধ্রুবের হাতে বিদ্ধ হয়ে পড়ে। ধ্রুবর হাত বেয়ে রক্তের স্রোত গড়াচ্ছে! ধ্রুব একপল জখম হওয়া হাতের দিকে তাকালো। অতঃপর ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। হাতটা মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়ে হাতের মধ্যে লেপ্টে থাকা সমস্ত রক্ত ঠোঁট দিয়ে শুষে নিয়ে খেয়ে ফেলল। রক্তের নোনতা স্বাদ ধ্রুবর বড়ই পছন্দের!
আয়েশী ও তার প্রেমিক পুরুষ নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে রাস্তা পাড় হচ্ছে। ধ্রুব তাদের পেছনে তার গাড়ির মধ্যে কাঁচ উঠিয়ে বসে আছে। ওই তো সামনে দেখা যাচ্ছে, একটা ট্রাক আয়েশীদের দিকেই এগিয়ে আসছে। ধ্রুব বাঁকা হাসলো। এবার জমবে আসল খেল! পথের কাঁটা তবে দূর হচ্ছে!
কিন্তু হঠাৎ ধ্রুবর কিছু একটা মনে পড়ল। সঙ্গেসঙ্গে সে চাল বদলে ফেলল। গাড়ি থেকে দ্রুত নেমে দৌঁড়ে আয়েশীদের কাছে এসে তাদেরকে একটানে রাস্তার মাঝখান থেকে সরিয়ে ফুটপাথে এনে ফেলল। ঠিক তখনি ট্রাকটা শো করে তাদের শরীর ঘেঁষে চলে গেল। একটু হলেও আয়েশী, মৃদুল ও ধ্রুব একসঙ্গে অ্যাক্সিডেন্ট করতে পারত। মৃত্যুভয়ে আয়েশী ভয়ার্ত চোখে খামচে ধরেছে মৃদুলকে। তার পাঁপড়ি কাপছে, ফোলা গাল দুটোতে ভয়ের স্পষ্ট আভা! ধ্রুবের কাছে আয়েশীকে তখন এক অপ্সরীর ন্যায় মনে হচ্ছিল! কিন্তু পরক্ষণেই আয়েশীকে অন্য পুরুষের সংস্পর্শে দেখে ধ্রুবর পূর্বের রাগ তরতর করে বেড়ে গেল। কিন্তু সে দ্রুত তার রাগ সংবরন করে নিল। এখন রেগে যাওয়া মানে তার সাজানো গোছানো প্ল্যানে পানি ফেলা।
সেই ছেলেটার নাম মৃদুল। সেও মৃত্যুভয়ে কিছুটা গুটিয়েই গেছে। মৃদুল একহাতে আয়েশীকে জরিয়ে ধরে কৃতজ্ঞতার চোখে তাকালো ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব তখন কাপড়ে থাকা ধুলো ঝাড়ছিল। মৃদুল ধ্রুবকে কৃতজ্ঞতা জানাতে বললো,
‘ ধন্যবাদ, ম্যান। আপনি না থাকলে আজ হয়তো আমাদের আর বাড়ি ফেরা হতো না। রাস্তায়ই মরে পড়ে থাকতাম। থ্যাংকস অ্য লট। ‘
ধ্রুব আয়েশীর থেকে চোখ সরালো। মুচকি হেসে মৃদুলকে বললো,
‘ নট এট অল। এটা আমার কর্তব্য ছিল। বাই দ্য ওয়ে, আমি ধ্রুব! ‘
ধ্রুব হ্যান্ডশেক করার জন্যে মৃদুলের দিকে এক হাত বাড়িয়ে দিল। মৃদুল ধ্রুবর সাথে হাত মিলিয়ে বলল,
‘ আমি মৃদুল। ‘
সেইদিন থেকে ধ্রুব ও মৃদুলের একটা ভালো সম্পর্ক হয়ে যায়। তারা একে অপরের খুব ভালো বন্ধু হয়ে যায়। কিন্তু কে জানত, এসবের পেছনে ধ্রুবর এক নির্মম পরিকল্পনা ছিল। ধ্রুবর হাতে অস্ত্র মানায়, কিন্তু বন্ধুত্বের হাত, এ তো অবিশ্বাস্য!
মৃদুলের সাথে বন্ধুত্বের অভিনয় করতে করতে ধ্রুব মনেমনে তাকে খুন করার ভয়ংকর পরিকল্পনা সাজায়। এমন পরিকল্পনা যেখানে, সাপও মরবে আর লাঠিও ভাঙবে না!
#চলবে
#মৃত_কাঠগোলাপ – ৩
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
পায়ের উপর পা তুলে বেশ ভাব নিয়ে বসে আছে ধ্রুব! তার সামনে মৃদুলের একটি আয়তাকার ছবি ঝোলানো। ধ্রুবর হাতে ধারালো ছুরি। সে ছুরিটা সম্পূর্ন ছবিতে বুলিয়ে নিল। হিংস্র হেসে বললো,
‘ সে আমার। আর আমার জিনিসে আমি কারো হস্তক্ষেপ সহ্য করি না। যে কুকুর আমার জিনিসে হাত দেয়, আমি তার দেহ থেকে প্রাণ আলাদা করে ফেলি। ‘
ধ্রুব কথাটা বলে হুট করে হিংস্র হয়ে পড়ল। হাতের ছুরি দিয়ে মৃদুলের সেই ছবিটিতে পরপর আঘাত করে ছবিটি ছিঁড়ে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ফেলল। পেছনে ওসমান ধ্রুবের এমন হিংস্রতা লক্ষ্য করে থরোথরো করে কাপতে লাগল। তার কপাল বেয়ে ঘামের ফোয়ারা বইছে। মনের মধ্যে আন্দোলিত হচ্ছে তীব্র ভয়।
‘ কি ব্যাপার, ওসমান। এভাবে স্থির হয়ে দাড়িয়ে আছো কেন? স্টেচু মানুষ আমার পছন্দ নয়, জানোনা? ‘
ধ্রুব ছুরিটির ধার হাতে পরীক্ষা করে ওসমানের উদ্দেশ্যে কথাটি বললো। ওসমান হাসার ভান করল। আঙুল দিয়ে কপালের ঘামটুকু মুছে নিয়ে বললো,
‘ সরি, স্যার। ‘
ধ্রুব সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ওসমানের কাছে ঘেঁষতেই ওসমানের আত্মা ভয়ে ছলকে উঠল। ওসমান স্থির পায়ে নিজ স্থানে দাড়িয়ে রইল। ধ্রুব ছুরিটি ওসমানের গলায় স্পর্শ করল। যার ফলে, ওসমানের গলায় হালকা আঘাত পেল। ওসমান ব্যথায় কুকড়ে গেল। তথাপি, কোনোরূপ শব্দ করল না। কারণ ধ্রুব অযথা শব্দ করা পছন্দ করে না। ওসমান চোখ খিচে দাড়িয়ে রইল। অপেক্ষা করতে লাগল ধ্রুবের পরবর্তী পদক্ষেপের। ধ্রুব ওসমানের গলা থেকে ছুরিটি সরালো। ছুরিতে ওসমানেরবহালকা রক্ত লেগে আছে। ধ্রুব আঙ্গুল দিয়ে রক্তটুকু নিয়ে নিল। রক্তের ফোঁটা ওসমানের কপাল বরাবর লেপ্টে দিয়ে বললো,
‘ ছুরির ধার আছে! এটা দিয়েই কাজ চালানো যাবে। কি বলো ওসমান? ‘
ওসমান হাসার ভান করে বললো,
‘ জ-জি স্যার। ‘
ধ্রুব আবারও সোফায় বসল। ওসমানের উদ্দেশ্যে বললো,
‘ মেয়েটির খবর পেয়েছ, ওসমান? ‘
‘ মেয়েটির নাম আয়েশী। এবার অনার্স ফাইনাল ইয়ারে স্টুডেন্ট। মেয়েটির একটি বয়ফ্রেন্ড আছে। নাম, মৃদুল। পূর্বে ছেলেটি উনার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল। বেস্ট…’
‘ বেস্ট ফ্রেন্ড থেকে লাভার? উম..বেশ ইন্টারেস্টিং! এরপর বলো। ‘
‘ স্যার, মেয়েটির সাথেও ওই ছেলেটার নিয়ে ঠিক। পড়াশোনা শেষ করে ওদের মৃদুল ছেলেটি চাকরি পেয়ে গেলে ম্যাডামের সাথে উনার বিয়ে হবে। এমনটাই পাকাপোক্ত করেছে ওদের পরিবার। ‘
ধ্রুব মাথা নত করল। দুহাতে কপাল ঘষে কিছু একটা ভেবে বললো,
‘ ছেলেটা কি চাকরি পেয়ে গেছে, ওসমান? ‘
‘ না, স্যার। তবে চেষ্টা করছে। তবে ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট হওয়ায় খুব সহজেই চাকরি পেয়ে যাবে, স্যার। ‘
‘ উমমম….’
ধ্রুব মুখ দ্বারা ভাবনার শব্দ তুললো। অতঃপর তার মুখে হাসি ফুটল। ওসমানের দিকে চোখ তুলে বললো,
‘ ওসমান, এমন হলে কেমন হয়! ছেলেটা কোথায় চাকরিই পেল না। শেষ অব্দি আমার দোরগোড়ায় এসে চাকরির জন্যে ঠকঠকালো। আমি হয়ে যাবো দয়ার সাগর। একটা চাকরি না হয় তাকে ভিক্ষেই দিলাম। কি বলো? ‘
ধ্রুবর কথায় ওসমানের চক্ষু চড়কগাছ হওয়ার জোগাড়! সে ঘাড় কাত করে পাশে থাকা মৃদুলের ছিঁড়ে-ফাঁটা ছবির দিকে তাকাল। ছেলেটি অতীব সুন্দর! আজকালকার জামানায় বলা এক ভদ্রপুরুষ। এই পৃথিবীর হিংস্র নাট্য সম্পর্কে সম্পূর্ন অজ্ঞ! কিন্তু তার ভাগ্য খারাপ! কারণ সে ধ্রুবর চোখে পড়েছে। যে মানুষ একবার ধ্রুবর চোখে পড়ে যায়, তার এই সুন্দর পৃথিবীতে বেঁচে থাকা মুশকিল হয়ে যায়। ওসমানের খুব মায়া লাগল মৃদুল নামক এই ছেলেটির প্রতি। মনে হলো, একটা ম্যাজিক হোক, আর পৃথিবীতে থাকা একটা ভালো মানুষ ধ্রুবর হিংস্রতা থেকে রক্ষা পেয়ে যাক। কিন্তু, তা কি সম্ভব? ধ্রুবর শকুনি চোখ থেকে আজ পর্যন্ত কেই-বা বাঁচতে পেরেছে?
_________________________________
মৃদুল ও আয়েশী একটা বেঞ্চে পাশাপাশি বসে আছে। মৃদুলের মন উদাসী হয়ে আছে। কি যেন চিন্তা করছে সে। তার চিন্তার বিষয়ে আয়েশীকে বলা উচিৎ! কিন্তু সে পারছে না। কোথাও যেন একটা সংকোচ থেকেই যাচ্ছে। আয়েশী মৃদুলের কাধে মাথা রেখে চুপটি করে মৃদুলের এই লুকোচুরি খেলা দেখছে। সে বুঝতে পারছে মৃদুল তাকে কিছু বলতে চায়, কিন্তু বলতে পারছে না। আয়েশী এবার কাধ থেকে মাথা তুলল। মৃদুলের বলিষ্ট হাতখানা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে চোখ রাখল মৃদুলের সরু উদাসী চোখে। মৃদুল নজর লুকাচ্ছে! প্রিয়তমার চোখে চোখ রাখবে কি করে সে? আয়েশী মৃদ কণ্ঠে বলল,
‘ এই মৃদুল, তাকা আমার দিকে। ‘
মৃদুল তাকাল না। বরং তার নজর পাশে হেঁটে যাওয়া একদল চাকরিরত মানুষের দিকে। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। কর্মজীবী মানুষরা সারাদিন পরিশ্রমের চাকরি করে দিনশেষে বাসায় ফিরছে। মৃদুল আফসোসের দৃষ্টিতে তাই দেখে চলেছে। আয়েশী মৃদুলকে অন্যমনস্ক দেখে জোরপূর্বক মৃদুলের মুখটি নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল। মৃদুল তবুও নজর হারাচ্ছে। আয়েশী মৃদুলের গালে তার নরম হাত রাখল। মিহি সুরে বলল,
‘ চাকরি পাস নি বলে মন খারাপ? ‘
মৃদুল যেন চমকে উঠল। আয়েশী কি করে তার মনঘটিত বিষয় বুঝে ফেলল? মেয়েটি জাদু-টাদু জানে নাকি? আয়েশী চট করে মৃদুলের মনের প্রশ্ন বুঝে ফেলল। মেয়েটি হেসে বলল,
‘ গাধা, ভালোবাসি আমি তোকে। তোর মন পড়া আমার বা হাতের খেল। বুঝলি? ‘
মৃদুল আর কথা চেপে রাখতে পারল না। মুখ গোমড়া করে বললো,
‘ যেখানেই চাকরির এপ্লাই করছি, সেখান থেকেই রিজেকশন আসছে। আমি জানি, আমার প্রতিটা ইন্টারভিউ ভালো হচ্ছে। কিন্তু সবাই আমার নাম শুনেই কেমন ভয়ার্ত চোখে আমাকে রিজেক্ট করে দেয়। কিছুই বুঝতে পারছি না কি হচ্ছে। ‘
আয়েশী চিন্তায় পড়ে গেল। মৃদুল আয়েশীর হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
‘ তুই তো কত বছর ধরে আমাদের বিয়ের অপেক্ষা করছিলি। কিন্তু আমি হলাম আস্ত এক লুজার। আমার দ্বারা কিচ্ছু হবে না। ফালতু প্রেমিক আমি। ‘
আয়েশী বুঝতে পারলো মৃদুলের আপসেট হওয়ার কারণ। আয়েশী মনে সাহস দিল মৃদুলকে। বললো,
‘ কে বলেছে, তুই ফালতু প্রেমিক। তুই হলি এই পৃথিবীর সবচেয়ে শুদ্ধতম প্রেমিক। চিন্তা করিস না। চাকরির জন্য চেষ্টা করে যা। আমি তোর জন্যে আজীবন অপেক্ষা করব। ‘
মৃদুল কৃতজ্ঞতার চোখে তাকাল আয়েশীর দিকে। হঠাৎ মৃদুলের মনে পড়ল, ধ্রুব তাকে একটা কার্ড দিয়েছিল। বলেছিল, যেকোনো দরকারে তার কাছে যেতে। এখন তো তার সামনে তার জীবনের সবচেয়ে দরকারী অধ্যায়! ধ্রুবর কাছে কি বলবে, একটা চাকরি দেওয়ার কথা! বললে যদি ফিরিয়ে দেয়? না, না! ফিরিয়ে দেবে কেন? ধ্রুব আর ও তো ভালো বন্ধু! মৃদুল মনেমনে ভেবে নিল, কাল একবার ধ্রুবর কাছে যাবে চাকরির জন্যে। সে নিজের যোগ্যতা দ্বারা চাকরি চাইবে। বন্ধুত্বের অনুগ্রহ দিয়ে নয়!
#চলবে