#মৃত_কাঠগোলাপ – ২৯,৩০,৩১
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
২৯
থাপ্পড়ের বিকট শব্দে অলস বিকেল তটস্থ হল। অদূরের কৃষ্ণচূড়া গাছে বসে থাকা একটি শালিক পাখি ভয়ে ডানা ঝাপটে পালিয়ে গেল। আয়েশী তখন রাগে থরথর করে কাঁপছে। ইচ্ছে করছে গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বেয়াদব মেয়েটাকে ছুড়ি দিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলতে। রাগে আয়েশীর চোখ জ্বলছে। কান দিয়ে উষ্ণ ধোঁয়া বের হচ্ছে। আয়েশী রেগে বলে,
‘ মৃদুলকে নিয়ে আর একটা বাজে কথা বললে, তোমার জিহ্বা আমি টে’নে ছিঁ’ড়ে ফেলব। ‘
মেয়েটা কান্না করতে থাকে। গালে হাত দিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। হেঁচকি উঠে বেহাল অবস্থা। নাকের পানি, চোখের পানি মিলেমিশে একাকার। তবুও আয়েশীর মেয়েটার প্রতি একবিন্দুও মায়া হচ্ছে না। ইচ্ছে করছে, মেয়েটার সারা গা পিটিয়ে চা’মড়া তুলে ফেলতে। কতবড় সা’হস। যে মানুষটা আয়েশীকে ভালোবেসে মারা গেছে, তাকে নিয়ে এতবড় মিথ্যা অ’পবাদ। রা’গে, অপমানে আয়েশীর চোখে জল ভরে। মৃদুল তাকে ছেড়ে যাওয়ার পর আয়েশী কত ঝড় ঝাপটা সহ্য করেছে। কিন্তু এবারের বিষয় সকল ঝড়কে ছাড়িয়ে গেছে। আর কত? হাঁপিয়ে উঠেছে আয়েশী। আর ভালো লাগছে না। এর শেষ কোথায়?
মেয়েটা কেঁদে অস্থির হয়ে বলল, ‘ আমি সত্যি বলছি। আপনি চাইলে মৃদুল ও আমার বিয়ের ছবি দেখতে পারেন। বিয়ের পরও আমি বাবার বাসায় থাকতাম। মৃদুল মাঝেমধ্যে আমাকে নিয়ে হোটেলে থাকত। সেটুকু সময় শুধু আমি ওকে উপভোগ করতে পারতাম। আমি অনেকবার বলেছি, তার বাসায় আমাকে নিয়ে যেতে। মৃদুলের বাবা মায়ের সাথে পরিচয় করাতে। কিন্তু সে বলেছে, বাবা মা আমায় দেখলে অনেক রাগ করবেন। তার পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করলে, তারপর আমাকে তার বাসায় নিয়ে যাবে। একদিন আমি গর্ভবতী হলাম। মৃদুল এত খা’রাপ লোক ছিল যে, আমার সদ্য অনুভব করা মাতৃত্বকে নিমিষেই চূ’র্ণ’বি’চূর্ণ করে ফেলে। মৃদুল বাধ্য করে, আমাকে এবোরশন করতে। তার নাকি ক্যারিয়ার সবে শুরু। সে এখন বাচ্চা পালতে পারবে না। আমিও ছিলাম তখন মৃদুলের হাতের পুতুল। ভালোবাসায় অন্ধ হয়েছিলাম। মেনে নিয়েছিলাম সব কষ্ট। কিন্তু তখনও জানতাম না, আমার বাচ্চা নষ্ট করার পেছনে ছিলেন আপনি। কিন্তু হঠাৎ একদিন পাড়ার লোকের কাছে শুনি মৃদুল নাকি আরেকটা বিয়ে করছে। বিশ্বাস করুন আপা, আমার মাথায় আস্ত এক আকাশ ভেঙে পড়ে। আমি বিশ্বাস করতে চাইনি। করব কিভাবে? মৃদুল আমাকে এই দু বছরে এত ভালোবাসা দিয়েছে যে আমার কাছে এই দু বছর মনে হয়েছিল আমি স্বর্গে আছি। স্বর্গের সুখ মৃদুল আমার পায়ে ফেলেছিল। মৃদুল এমনই। সে যখন যাকে ভালোবাসে, তাকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। মৃদুলের ভালোবাসা পেয়ে আপনার একসময় মনে হবে, তার চেয়ে শুদ্ধ প্রেমিক এই পৃথিবীতে বোধহয় দুটো নেই। অথচ যখন তার আপনার উপর থেকে মন উঠে যাবে, সে আপনার ভুলে যাবে। ভুলে যাবে, তাকে নিয়ে সাজানো আপনার সমগ্র দুনিয়া!
এমন নয় যে, আমি মৃদুলকে বিয়ে নিয়ে প্রশ্ন করিনি।বিয়ের কথা আমি মৃদুলকে জিজ্ঞেস করি, সে বলে পুরুষদের চারটে নিয়ে জায়েজ আছে। আমি এই নিয়ে তর্ক করলে সে আমায় ডি’ভোর্স দিবে। আপা, আমি কি করতাম তখন? স্বামীকে ছেড়ে দিতে পারিনি। মেনে নিয়েছে। তারপর….আমার ঘরে সতীন আসেনি। বরং প্রাণের চেয়েও প্রিয় মানুষটা লাশ হয়ে ফিরেছে। ওরা আমায় তাকে শেষ দেখা দেখতে দেয়নি, আপা। আমি ওকে শেষবার ছুঁয়ে দেখতে পারিনি। একটাবার ছুঁয়ে বলতে পারিনি, ‘ আমি আপনাকে ভালোবাসি। দয়া করে আর ঠকাবেন না আমায়। একবার ফিরে আসুন।’
আমি পারিনি, আপা। ওরা আমার হাত, পা, মুখ বেঁধে রেখেছিল। আমি শুধু আপনাকে খুঁজছিলাম। আপনিই আমাকে এই মৃত্যু যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে পারবেন। আপা, আমি আপনার পায়ে পড়ি। তার কবরটা আমায় একবার দেখতে দিন। আমার তার কবরে একটাবার মাথা ঠুকতে চাই। দোহায় লাগে আপনার। ‘
মৃদুলকে নিয়ে এতসব জঘন্য কথা শুনে আয়েশীর মস্তিষ্ক স্তব্ধ হয়ে যায়। ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে রয় মেয়েটার দিকে। চোখ ছলছল করছে। ব্যথায় মাথা ফেঁ’টে চৌচির!
আয়েশীর আর সহ্য হয়না। মেয়েটার কথা কানের ভেতর তবলা বাজাতে থাকে। অস্থির হয়ে উঠে আয়েশী। দুহাতে কান চেপে ধরে বলে, ‘ চুপ করো তুমি। আমার সহ্য হচ্ছে না। আমার মৃদুল এত খা’রাপ হতে পারেনা। আমি চিনি তাকে। সে এমন হতেই পারেনা। আমি তাকে বিশ্বাস করি। সে আমার বিশ্বাসের অমর্যাদা করতে পারেনা। কিছুতেই না। ‘
মেয়েটা নিজেও কাঁদে। হাউমাউ করে। কষ্ট জল হয়ে বেরুচ্ছে এ দুজন নারীর। উভয়েই ভালোবাসার কাঙাল। তারা একজীবনে কিছু চায়নি, শুধু ভালোবাসা ছাড়া। অথচ বিধাতার কি নিষ্ঠুর খেল। ভালোবাসা চেয়েও ভালোবাসা পাওয়া হলো না তাদের। মেয়েটা একে একে প্রমাণস্বরূপ আয়েশীকে তাদের নিয়ে সার্টিফিকেট দেখাল। মৃদুলের হাতের স্বাক্ষর নিমিষেই চিনে ফেলল আয়েশী। গাইনোকলোজিস্ট এর প্রেসক্রিপশন, স্বামীর নামের জায়গায় মৃদুলের নাম। এবোরশন রিপোর্ট, মৃদুল এবং মেয়েটার একসঙ্গে হাস্যোজ্বল ছবি।
সব দেখে আয়েশীর মাথা লাটিমের ন্যায় ঘুরতে লাগল। আয়েশীর ডান হাতে পাশে থাকা আম গাছকে আকড়ে ধরল। মাথা ঘুরছে তার। উজ্জ্বল চেহারা রক্তশূন্য হয়ে যাচ্ছে। অতঃপর, আয়েশী ধপ করে বসে পড়ল ময়লা ঘাসের উপর। কাপড় নোংরা হচ্ছে, আয়েশীর সেসবে লক্ষ্য নেই। আপাতত তার মনে একটাই কথা ঘুরপাক খাচ্ছে, তার মৃদুল তার কখনোই ছিল না। সে গোপনে অন্য কারো! আয়েশী শুধুমাত্র তৃতীয় ব্যক্তি ছিল। মৃদুল এতটা জঘন্য কাজ করতে পারে, আয়েশীর এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। মৃদুল এতটা নিচে কি করে নেমে গেল? একটা নিষ্পাপ বাচ্চা পৃথিবীর আলো দেখার আগেই মেরে ফেলল! ছিঃ!
অথচ, আফসোস আয়েশী এখনো মৃদুলকে ঘৃনা করতে পারছে না। এখনো ভালোবেসে যাচ্ছে মৃদুলকে। কিন্তু আয়েশী ঘৃনা করতে চায় মৃদুলকে। অথচ…পারছে না। ভীষন ভীষন ভালোবাসে যে মৃদুলকে। আয়েশী চোখ তুলে মেয়েটার দিকে তাকাল। মেয়েটা তখন কেঁদে যাচ্ছে। একটা নিষ্পাপ নারীর মুখ থেকে হাসি কেড়ে গেছে মৃদুলের জন্য। আয়েশীও তাতে সমান দোষী। সে মৃদুলের জীবনে না এলে,মেয়েটা সুখী হত। অথচ আয়েশী নিজের অজান্তে মেয়েটার জীবন থেকে সকল সুখ কেড়ে নিয়েছে। মেয়েটার জীবনের অহংকার কেড়ে নিল। নিজের প্রতি ঘৃনা অনুভব হচ্ছে আয়েশীর। আজকের পর থেকে আয়েশী বোধহয় আয়নায় নিজের মুখ দেখতে পারবে না। আজকের পর আয়েশী আর নিজের চোখে চোখ মেলাতে পারবে না। কেন এমন হচ্ছে? এই ক মাসের মাথায় সব কেন উল্টে পাল্টে যাচ্ছে? এসব কিছুর মূল হোতা কি?
আয়েশী কোনরকম অস্ফুট সুরে মেয়েটাকে মৃদুলের কবরের ঠিকানা বলে দিল। মেয়েটা কিছুক্ষণ আয়েশীর দিকে নির্নিমেষ চেয়ে রইল। তারপর আয়েশীর পাশে হাঁটু গেরে বসে আয়েশীর চুলে হাত বুলিয়ে বলল,
‘ আমিও ভালোবেসেছি, আপনিও ভালোবেসেছেন। আমাদের দুজনের ভালোবাসায় কোনো খাদ ছিল না। কিন্তু আমরা ঠকেছি। এই ধরায় ভালো মানুষেরাই প্রতি পদে পদে ঠকে। পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে, খা’রাপ হতে হবে। প্রচুর খা’রাপ। আমিও খা’রাপ হয়েছি। এবার আপনার পালা। ‘
মেয়েটা চলে যাচ্ছে। আয়েশী ছলছল চোখে মেয়েটার পথের পানে চেয়ে। মেয়েটা তার অভিযোগ শুনিয়ে চলে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু আয়েশীর মনের মধ্যে যে কষ্টের সূচ ফুটিয়ে গেছে, তা সে বুঝতেই পারল না। আয়েশী কি যে মরণ যন্ত্রণায় ভুগছে, সে তা জানলো না। আয়েশী আর টিকে থাকতে পারল না। আয়েশী চিৎকার করে কেঁদে উঠল। দুহাতে চুল খামচে ধরে চুল ছিঁড়ে ফেলল। সার্ভেন্ট আয়েশীকে সামলানোর চেষ্টা করল, সফল হলো না। আয়েশী গলা ফেঁটে যাচ্ছে, কান্না করতে করতে। কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। এমন কেন হল? আয়েশী এখন কেমন করে বাঁচবে? আর বাঁচতে ইচ্ছে করছে না।তার এত সুন্দর জীবনকে মৃদুল কেন এভাবে নষ্ট করে দিল। কি দোষ ছিল তার? মৃদুলকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসাটা দোষের ছিল। অত্যাধিক কষ্টে, চিন্তায়, আতঙ্কে আয়েশী মৃদুলের নাম দুবার জপ করে সেখানেই জ্ঞ্যান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
সার্ভেন্টসহ সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আয়েশীকে ধরাধরি করে তার কক্ষে নিয়ে যাওয়া হল। ধ্রুবকে জানানো হল। সাধারণত এখন ধ্রুবর এখন সার্ভেন্টদের বকাঝকা করার কথা। কিন্তু সে শান্ত সুরে বলল, ‘ আমি আসছি। ‘
সবাই অবাক, বিস্মিত, হতভম্ব। এমন শান্ত ধ্রুবকে তারা কখনোই দেখে নি। এ যেন এক নতুন ধ্রুবর সত্তা।
#চলবে( শব্দসংখ্যা- ১১০০+ )
#মৃত_কাঠগোলাপ – ৩০
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
________________________________
আয়েশী এখনও বিছানায় শুয়ে আছে। জ্ঞ্যান ফেরে নি। ধ্রুব একবার এসে দেখে গেছে তাকে। আয়েশীর কপালে ছোট্ট চুমু খেয়ে বলেছে, ‘ এবার থেকে শুরু হবে তোমার এবং আমার ভালোবাসার খেলা। দ্রুত সুস্থ হও, রক্তজবা! ‘
ধ্রুব রান্নাঘরে মিল্কশেক বানাচ্ছে। ছাব্বিশ বছরের জীবনে ধ্রুব এই প্রথম রান্নাঘরে এসেছে। ধ্রুবকে রান্নাঘরে দেখে সার্ভেন্ট সবাই হতবাক হয়ে গেছে। মুখে হাত চাপা, চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসছে সবার। প্রধান রাধুনী ধ্রুবর দিকে এগিয়ে এসে বলে,
‘ স্যার, কি বানাবেন আমায় বলুন। আমি বানিয়ে দিচ্ছি। ‘
ধ্রুব কঠিন চোখে তাকায় তার দিকে। বলে, ‘ বেশি কথা বলা আমার পছন্দ নয়, জানোনা ফকরুল? ‘
ফকরুল মাথা নত করে সরে যায়। ধ্রুব মিল্কশেকের গ্লাসে শেষবারের মত চামচ নাড়ে। হঠাৎ উপর থেকে কিছু ভা’ঙার শব্দ পাওয়া যায়। ধ্রুব চামচ নাড়া ছেড়ে ভ্রু কুঁচকে উপরে তাকায়। উপরের ঘর থেকে ক্রমশ কিছু ভা’ঙার শব্দ আসছে, সেই সাথে ধপাধপ পা ফেলার শব্দ। মনে হচ্ছে ছাদটাই বোধহয় ভেঙে গুঁড়িয়ে পড়বে। সার্ভেন্ট বলে,
‘ স্যার আমার মনে হচ্ছে ম্যাডামের জ্ঞান ফিরেছে। ‘
ধ্রুব মাথা নুয়ে মিল্কশেকের গ্লাস হাতে নেয়। সার্ভেন্টদের শাসিয়ে বলে, ‘ আমি না বলা অব্দি কেউ উপরে যাবে না। বুঝেছ? ‘
ধ্রুব হনহন পায়ে সিড়ি ভেঙে উপরে উঠে। আয়েশীর ঘরের দরজা খোলা। ভেতর থেকে একটার পর একটা কাঁচ ভা’ঙার শব্দ আসছে। ম্যাডাম ক্ষেপেছে! ধ্রুব মুচকি হাসে। আজকের মত আয়েশীর ক্ষেপা মনকে শান্ত করতে পারলে, জীবনভর তার আদর সহ্য করতে পারবে। ভাবতেই ধ্রুবর সুখ সুখ অনুভব হচ্ছে। ধ্রুব তার হাসি লুকিয়ে চেহারা করুন করে। তারপর হেঁটে কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করে।
আয়েশী সম্পূর্ণ কক্ষ এলোমেলো করছে। নিজের জামা কাপড় ছিঁড়ে বেহাল অবস্থা। সবসময় বিন্যস্ত চুল এলোমেলো হয়ে মুখের উপর লেপ্টে আছে। আয়েশী একটার পর একটা জিনিস ভাঙছে আর কাঁদতে কাঁদতে বলছে, ‘ কেন ঠকালি আমায়? কেন কেন কেন? এভাবে কেন মেরে ফেললি আমায়? এখন আমি কি নিয়ে বাঁচব, কার জন্যে বাঁচব? ইয়া আল্লাহ! ‘
ধ্রুব দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসে আয়েশীর পানে। আয়েশী উন্মাদের ন্যায় ব্যবহার করছে। ধ্রুব আয়েশীকে শান্ত করতে তাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে, তবে পারে না। আয়েশী সরে যায়। চিৎকার করে বলে, ‘ কেউ ছুঁবে না আমায়। কেউ না! ‘
ধ্রুব সরে আসে। আয়েশীকে শান্ত করতে বলে, ‘ শান্ত হও, আয়েশী। কি হয়েছে তোমার? কাঁদছ কেন? আস্তে, পা কেটে যাবে। ‘
আয়েশী ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে। দুহাতে মাথার চুল খামচে ধরে চিৎকার করে বলে, ‘ মৃদুল কেন এমন করলি? আমি তোকে ভালোবাসি। আমি তোকে ঘৃনা করতে পারছি না। কিন্তু ঘৃনা করা উচিত! কারণ তুই খা’রাপ, নোং’রা, জ’ঘন্য লোক। তুই কারোর ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য না। কারোর না। ‘
আয়েশী কাদঁছে। কাদতে কাদতে নাকের ডগা লাল হয়ে গেছে। চোখ ফুলে গেছে। চোখের নিচে রক্ত জমাট বেঁধেছে। আয়েশী আজ কিছুতেই নিজের কান্না সংবরণ করতে পারছে না। ধ্রুব এতক্ষণ আয়েশীর কান্না নির্নিমেষ দেখছিল। অন্য পুরুষের জন্যে আয়েশীর চোখের জল ফেলা ধ্রুবর সহ্য হচ্ছে না। ধ্রুবর নিজের দুহাতের মুঠো মুষ্টিবদ্ধ করে। দু চোখে বুজে রাগ সামলানোর চেষ্টা করে, লাভ হয়না। আয়েশীর কান্নার শব্দ যত করুন হচ্ছে, ধ্রুবর রা’গের পাল্লা ঠিক ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধ্রুবর মন চাইছে সবকিছু তছ’নছ করে দিতে। আয়েশীর গলা চে”পে ধরে বলতে, ‘ কিরে? আমি এত ভালোবাসছি দেখে ভালো লাগছে না? ভালোবাসা সহ্য হচ্ছে না? রা”গ দেখবি? দেখলে এই কান্না, মাতম সব ফুস করে উড়ে যাবে। বেশি উড়িস না, নাহলে আমার রা’গের আগুনে পুড়ে ধ্বং’স হয়ে যাবি। ‘
অথচ, ধ্রুব বলতে পারল না। কারণ, সে আয়েশীকে ভালোবাসে। পূর্বে ধ্রুব অনেক মেয়েকে ভালোবেসেছে, তবে তাদের সবার ভালোবাসা ধ্রুবকে এতটা মাতাল করতে পারেনি। আয়েশী পেরেছে। আয়েশী যখন ধ্রুবর সামনে আসে, ধ্রুব থমকে যায়। আয়েশীর নরম তুলতুলে গালে চুমু খাওয়ার জন্যে ধ্রুবর পশম দাঁড়িয়ে যায়। আয়েশীর মখমলে হাত স্পর্শ করার জন্যে ধ্রুব ব্যাকুল হয়ে পড়ে। আয়েশী যখন কাঁদে, আয়েশীর নাক লাল হয়। ধ্রুবর তখন ইচ্ছে হয়, আয়েশীর টকটকে লাল নাক কা’মড়ে শেষ করে দিতে। অথচ,ধ্রুব এসব কিছুই করতে পারছে না। কারণ, ওই মৃদুলের বাচ্চা। শালা মরে গিয়েও পিঁছু ছাড়ছে না। আয়েশীকে ঠিকই অর্জন করে গেছে। তার ভালোবাসার এত জোর যে আয়েশীর সামনে বিলাস বহুল জীবন, ধ্রুবর মত সুদর্শন জীবনসঙ্গি থাকার পর আয়েশীর মন শুধু একজনাতে আটকে। সেই একজন হল মৃদুল! স্যালুট তার ভালোবাসাকে।
আয়েশীর কান্নার বিকট শব্দে ধ্রুবর ধ্যান ভাঙে। ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে তাকায় আয়েশীর দিকে। আয়েশী নাকের জলে চোখের জলে একাকার। ধ্রুব চোখ উল্টে ফেলে। ফুস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে আয়েশীর দিকে এগিয়ে যায়।
‘ আয়েশী, তাকাও আমার দিকে। ‘
আয়েশীর গালে হাত রেখে ধ্রুব কোমল কণ্ঠে বলে। আয়েশী তখন দুহাতের মুঠোয় চুল খামচে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। ধ্রুব আবার বলে,
‘ আয়েশী? তাকাও এদিকে। ‘
ধ্রুবর কঠিন কণ্ঠের বাণী শুনে আয়েশী হেঁচকি উঠে। ঘাড় কাত করে তাকায় ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব আঙ্গুল দিয়ে আয়েশীর চোখের জল মুছে দেয়। পরক্ষণেই আয়েশীর চোখ আবার জলে টুইটুম্বর হয়ে উঠে। ধ্রুব আবার চোখ মুছে নরম কণ্ঠে বলে,
‘ ভালোবাসো মৃদুলকে? ‘
আয়েশী কথা বলে না। অন্যসময় হলে আয়েশী কোনোরূপ জড়তা ছাড়া বলত, হ্যাঁ, ভীষন।
অথচ আজ বলতে পারছে না। কারণ আয়েশীর মনে মৃদুলকে নিয়ে ঘৃণার উদ্রেক হয়েছে। ধ্রুব এবার জিজ্ঞেস করল, ‘ মৃদুলের মত শুদ্ধ প্রেমিক এই ধরায় দুটো নেই, কাল অব্দি আমি এটাই জানতাম। তোমার এবং মৃদুলের ভালোবাসা আমাকে অবাক করত। তুমি কখনো জিজ্ঞেস করো নি, আমি তোমাকে কখন থেকে ভালোবাসি। আমি আজ নিজেই বলতে চাই সেসব কথা। মনে আছে, তোমাদের ভার্সিটির সেই বিদায় অনুষ্ঠানের কথা। আমি সেদিন তোমায় প্রথম দেখেছি, প্রথম ভালোবাসেছি। কিন্তু যখন শুনলাম,তুমি এবং মৃদুল একে অন্যকে ভালোবাসো, আমি সরে দাঁড়িয়েছি। আমি চাইনি, আমার জন্যে কারো ভালোবাসা ধ্বং’স হোক। কিন্তু যেদিন মৃদুল মারা গেছে, আমি হতভম্ব হয়েছিলাম। বিশ্বাস করতে চাইনি আমার এত ভালো একজন বন্ধুর এত জঘন্য মৃত্যুর কথা। তোমার কান্না আমি সেদিন দেখেছিলাম। আমার রুহ কেঁপে উঠেছিল। পাগল হয়ে গিয়েছিলাম আমি। তোমাকে নিজের করে নিতে অস্থির হয়ে গিয়েছিলাম। তোমার বাবাকে আমাদের বিয়ে করার কথা বললে, তিনি রাজি হন। আমি জানি, তুমি আমার ঘৃনা করো। আমার দোষ কি আমি জানিনা। কিন্তু আমি কখনোই মৃদুলের জায়গা নিতে চাইনি। বরং নিজের একটা জায়গা করতে চেয়েছিলাম। তবে আমি পারিনি। আমি আমার হার স্বীকার করেছিলাম। আয়েশী, কি প্রয়োজন একজন ধোকাবাজের জন্যে নিজের চোখের জল নষ্ট করার? সে চলে গেছে, তাকে ভুলে যাও। সকল খারাপ অতীত পেছনে ফেলে আগে বাড়ার চেষ্টা করো। আমি জানি তুমি পারবে। কি পারবে না? ‘
আয়েশী এতক্ষণ ধ্রুবর কথা মনযোগ দিয়ে শুনছিল। ধ্রুব প্রশ্নে আয়েশীর মনোযোগ ছিন্ন হয়। আয়েশী মাথা হেলায়। ক্ষীণ কণ্ঠে বলে,’পারবো।’
ধ্রুব গর্বের হাসি হাসে। আয়েশীর মুখের উপর পড়ে থাকা চুল কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে বলে,’ যাও, ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসো। ভূত লাগছে দেখতে। ‘
আয়েশী বাক্য ক্ষয় না করে চুপচাপ ওয়াশরুমে চলে যায়। ওয়াশরুমের ঝর্নার নিচে বসে আরো এক দফা কেঁদে তারপর একদম গোসল করে বের হয়।
ধ্রুব ততক্ষণে সার্ভেন্ট দিয়ে আয়েশীর ঘর পরিষ্কার করে ফেলেছে। আয়েশী টাওয়াল চুলে পেঁচিয়ে বিছানার উপর বসে। ধ্রুব আয়েশীর পাশে এসে বসে। আয়েশী তখন মাথা নত করে নীরবে কাঁদছে। ধ্রুব হাত বাড়িয়ে আয়েশীর চুলের টাওয়াল খুলে দেয়। সঙ্গেসঙ্গে আয়েশীর ভেজা চুলের মাতাল গন্ধ ধ্রুবর বুকে ঝড় তুলে দেয়। ধ্রুবর ইচ্ছে করে, আয়েশীর চুলে মুখ গুঁজে আয়েশীর ভেজা দেহের ঘ্রাণ শুঁকতে। কিন্তু ধ্রুব নিজেকে আটকায়। সবুরে মেওয়া ফলে, প্রবাদ বাক্য মাথায় রেখে ধ্রুব আয়েশীর চুল চিরুনি দিয়ে সুন্দর করে আঁচড়ে দেয়। আয়েশীর চোখে গাঢ় কাজলের রেখা এঁকে দেয়। আয়েশীর পাতলা ঠোঁট গোলাপী শেডের লিপস্টিক দিয়ে রাঙায়। প্রেয়সীকে মনের মাধুরী মিশিয়ে সাজানোর পর, ধ্রুব আয়েশীকে আয়নার সামনে আনে। আয়েশীর ঘাড়ে থুতনি রেখে বলে, ‘ সামনে তাকাও। ‘
আয়েশী চোখ তুলে তাকায়। আয়নায় নিজেকে নতুন রুপে আবিষ্কার করে আয়েশী। নিজের প্রতিচ্ছবির পানে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রয় সে। ধ্রুব বলে,
‘ আজ থেকে নিজেকে বদলে ফেলো। নতুন করে বাঁচতে শেখো। তোমার দুনিয়া গোলাপ দিয়ে সাজাও। গোলাপের সুবাস নিজের মধ্যে ধারণ করে হাসতে থাকো। পুরনো আয়েশীকে জলাঞ্জলি দিয়ে নতুন আয়েশীতে পরিণত হও। ‘
আয়েশী কিছুক্ষণ আয়নার দিকে তাকায়। অন্তরে উন্মাদনার জেদ তৈরি হচ্ছে। জেদের বশে আয়েশী মাথা নাড়ায়। হ্যাঁ, সে পুরনো আয়েশীযে জলাঞ্জলি দিবে। পরিণত হবে দুঃখবিহীন সম্পূর্ন নতুন আয়েশীতে। তবে কিছুদিন পর। আয়েশীকে আগে সেই মেয়েটার কথার সত্যতা যাচাই করতে হবে। আয়েশী যে মৃদুলকে চিনে, সে এমন কাজ করতেই পারে না। মৃদুলের সমগ্র দুনিয়া ঘিরে আয়েশী ছিল, আর সেই দুনিয়ায় অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারে না! শেষবারের মত আয়েশী মৃদুলকে বিশ্বাস করছে। আয়েশী মনেপ্রাণে চাইছে, মেয়েটা যেন মিথ্যা প্রমাণিত হয়, মৃদুল যেন আয়েশীর হয়েই রয়। আগামীকাল মৃদুলের মায়ের সাথে দেখা করতে হবে। দেখা করতে হবে, মৃদুলের বন্ধু বান্ধবের সাথে। আয়েশীর বিশ্বাস, মৃদুলের বিষয়ে তারা আয়েশীকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে।
#চলবে ( শব্দসংখ্যা – ১২০০+)
#মৃত_কাঠগোলাপ – ৩১
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
_____________________________
আপাদমস্তক মন খারাপের নতুন ভোর! সারারাত আয়েশী ঘুমায় নি। শুধু ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদেছে। ধ্রুব সেসময় আয়েশীর পাশে থেকেছে। আয়েশীর মাথাটা নিজের কাঁধে রেখে হরেক রকমের গল্প পেতেছে। দুঃখ গল্প, সুখ গল্প, আবেগ গল্প, রংতুলিতে গল্পের রঙ এঁকে আয়েশীর মন মাতানোর চেষ্টা করেছে। তবে পেরেছে কি?
আয়েশীর নিজেকে খুব দুঃখী মেয়ে মনে হচ্ছিল। সে সব পেয়েও অভাগার ন্যায় সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে।
সেদিন রাতে অন্ধকার যত বৃদ্ধি পাচ্ছিল, আয়েশীর বারবার মৃদুলের কথা মনে পড়ছিল। ছটফট করেছিল মনের পিঞ্জরে আটকে থাকা দুঃখী পঙ্খী। বুকের ভেতরে বারবার ডানা ঝাপটে ঘোষণা করেছিল মনের মধ্যে বহমান তীব্র ঝড়ো হাওয়ার বার্তা!
সকালের নাস্তা খাওয়ার পর ধ্রুব হাতে ব্লেজার নিয়ে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয়। একটি গুরুত্বপূর্ন মিটিং আছে। যেতে যেতে আয়েশীর কপালের মধ্যখানে ক্ষুদ্র চুমু খেয়ে বলেছে, ‘ দ্রুত ফিরব। ভালো থেকো! মন খারাপ করবে না একদম, ঠিক আছে? ‘
আয়েশী কথা বলেনি। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। ভালো লাগছে না কথা বলতে। মুখ-হৃদয়ে কি অসহ্য ব্যথা।
ধ্রুব তুষারের সাথে ফোনে কথা বলতে বলতে ব্যস্ত পায়ে বেরিয়ে পড়ে বাড়ি ছেড়ে।
ধ্রুব চলে যাওয়ার এক ঘন্টা পর, আয়েশী সেই মেয়েকে ডাকে ধ্রুবর বাড়িতে। মেয়েটা আসে। সম্পূর্ন শরীর কালো বোরকা দিয়ে ঢাকা, শুধু চোখ দুটো ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না তার। আয়েশী মেয়েকে সোফায় বসিয়ে, উপর থেকে রেডি হয়ে আসে। নিচে এসে মেয়েটার হাত খপ করে ধরে বলে, ‘ তোমার কথার সত্যতা পরীক্ষা করব আজ। চলো আমার সাথে। ‘
আয়েশী ভেবেছিল, তার কথায় মেয়েটা ভয়ে লুটিয়ে পড়বে। ঘনঘন ঢোক গিলে শান্ত হওয়ার চেষ্টা করবে। আত্মা কাঁপবে, হাত পা কেঁপে অস্থির হবে। অথচ মেয়েটা এমন কিছুই করল না। বরং বলল, ‘ চলুন। ‘
আয়েশী হতভম্ব অনুভব করল। অশান্তি লাগছে তার। ভেতর ভেতর শঙ্কা হচ্ছে। মেয়েটার কথা না সত্যি হয়ে যায়!
আয়েশী আর কথা বাড়ায় না। ধ্রুব আসার আগেই কাজ শেষ করতে হবে। তাই আয়েশী দ্রুত মেয়েটাকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে।
ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে। ধ্রুব পেছন সিটে বসে ল্যাপটপে আয়েশীর বাড়ি থেকে চলে যাওয়া দেখছে। ওসমান পাশে বসে ছিল। ধ্রুবর দৃষ্টি অনুসরণ করে ল্যাপটপে চোখ পড়লে, ওসমান ভয়ে আঁতকে উঠে। আয়েশী ম্যাম ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন! আজ তো ধ্রুব স্যার ম্যাডামের হাড্ডি ভেঙে গুঁড়ো ফেলবেন। ওসমান আতঙ্কভরা চোখ নিয়ে ধ্রুবর দিকে চায়। ধ্রুব তখন শান্ত। ডান হাতের আঙ্গুল দিয়ে খোঁচা দাড়ি চুলকায়। হঠাৎ বুকে হাত চেপে সিটে হেলান দেয়। ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস ছেড়ে চোখ উল্টে বলে,
‘ তোমার ম্যাডাম এত সুন্দর কেন, ওসমান? তাকে দেখলেই কেন আমার বুক ধড়াস ধড়াস করে? আনসার মি, ওসমান।’
ওসমানের মুখ হা হয়ে যায় ধ্রুবর কথা শুনে। আয়েশী ম্যাডাম বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন, অথচ ধ্রুব স্যার এত নিশ্চিন্তে বুক কম্পনের গল্প পাতছেন? কিভাবে? তার তো এখন রাগে রণমূর্তি হয়ে সবকিছু ধ্বং’স করে দেওয়ার কথা। ওসমান বোকার মত চেয়ে থাকে ধ্রুবর দিকে। ওসমানকে চুপ করে থাকতে দেখে ধ্রুব ঘাড় কাত করে তাকায় তার দিকে। ওসমানের মুখ তখনো হা! ধ্রুব হেসে ফেলে। ওসমানের ধ্যান ভাঙে। লজ্জা পেয়ে যায় সে। সঙ্গেসঙ্গে মাথা নত করে বিড়বিড় করে বলে, ‘ সরি স্যার। ‘
ধ্রুব হাসে মিটিমিটি। এই প্রথম ওসমান ধ্রুবকে মন খুলে হাসতে দেখছে। আয়েশী ধ্রুবর জীবনে আসার পর থেকে ধ্রুবর সমগ্র জীবনটাই বদলে গেছে। ধ্রুব আগে ন্যায় সর্বদা মুখ গোমড়া করে থাকে না, হঠাৎ হঠাৎ হাসে। হাসলে তার সুন্দর মুখ আরো বেশি আকর্ষণীয় লাগে। ডান গালে গর্ত লক্ষ্য হয়। ধ্রুব আপাদমস্তক ভয়ংকর সুদর্শন পুরুষ! সকল নারীর স্বপ্ন রাজপুত্রের মত বদনের অধিকারী। ধ্রুব এমন ভয়ংকর সৌন্দর্য্য পেয়েছে তার বাবার থেকে। ধ্রুবর বাবা ছিলেন ঠিক ধ্রুবর মত। সুন্দর তবে ভয়ংকর! ধ্রুবর সৎ মা অনেকেই ছিলেন। তবে ধ্রুবর মা ছিলেন ধ্রুবর বাবার একমাত্র ভালোবাসা। বাকি স্ত্রীরা শুধুমাত্র কামনা মেটানোর জন্যে ছিলেন। ধ্রুবর মা ছিলেন আয়েশীর মত সহজ সরল। ধ্রুব তার মায়ের সরলতা না পেয়ে পেয়েছে বাবার হিং’স্রতা! বিষয়টা হতাশাজনক!
ধ্রুবর এমন ভয়ংকর সৌন্দর্য্য দেখে ওসমানের মাঝেমধ্যে মনে হয়, ওসমান যদি কখনো মেয়ে হত তাহলে সে নিশ্চয়ই ধ্রুবর প্রেমে পড়ত। ধ্রুবর হিংস্র’তা যে মেয়ে জানে না, সে প্রতি প্রার্থনায় ধ্রুবকে চায়। ধ্রুবর সঙ্গে জীবন কাটানোর স্বপ্ন দেখে। যদি তারা ধ্রুবর ধ্বং’সাত্মক আচরন দেখত, তবে তারা কু’ক্ষণেও ধ্রুবর সঙ্গ চাইতো না। বরং মনের ভুলেও ধ্রুবর নাম উচ্চারণ করতে তাদের বুক কাঁপতো। ভয়ে তাদের শরীর বেঁকে যেত।
‘ ওসমান, প্যারিসের দুটো বিজনেস ক্লাস টিকেট কাটবে। বহুদিন হয়েছে কোথাও ঘুরতে যায়নি। তোমার ম্যাডামের মন খারাপ তাড়াতে প্যারিসের শীতল হাওয়া, রোমান্টিক পরিবেশ যথেষ্ট! তোমার জন্যেও একটা নরমাল টিকিট কেটো। তুমিও যাচ্ছ আমাদের সঙ্গে। ‘
ধ্রুবর কথা শুনে ওসমানের মুখের অভিব্যক্তি তখন দেখার মত ছিল। এই প্রথম ধ্রুবর সাথে সে দেশ ভ্রমণ করতে যাচ্ছে। পূর্বেও ধ্রুব অনেকবার নানা দেশে ঘুরেছে, তবে একা। ধ্রুব একা একা ঘুরতে পছন্দ করে। কেউ সাথে থাকলে বরং তার উপভোগ করতে বিরক্ত লাগে। তবে আজ ধ্রুব আয়েশীকে সঙ্গে নিচ্ছে, আশ্চর্যের ব্যাপার ওসমানও যাচ্ছে তাদের সাথে। আজ কি ধ্রুব স্যারের মন খুব ভালো? মন ভালো হওয়ার কারণ কি? আয়েশী ম্যাডাম?
_______________________________
আয়েশী এবং মৃদুলের মা, তাহিয়া বেগম মুখোমুখি বসে আছেন। অনেকদিন পর তাহিয়া বেগম আয়েশীকে দেখে খুশিতে গদগদ হয়ে পড়লেন। মৃদুলের মারা যাবার পর, আয়েশী মাঝেমধ্যে তাহিয়া বেগমকে যোগাযোগ করে খোঁজ খবর নিত। কিন্তু আয়েশীর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর, আয়েশী আগের মত খোঁজ নেয়নি। তিনি ভেবেছেন, নতুন সংসারে মেয়েটা হয়তো ব্যস্ত ভীষন। তাহিয়া বেগম একপলক আয়েশীর পাশে থাকা বোরকা পরিহিত মেয়েটার দিকে তাকালেন। মেয়েটিকে তাহিয়া বেগম চিনতে পারছেন না। আয়েশীকে জিজ্ঞেস করলেন মেয়েটার নাম কি? আয়েশী বলল, ‘ মুনিজ’
আয়েশী সর্বপ্রথম তাহিয়া বেগমের হাল চাল জিজ্ঞেস করল। তাহিয়া বেগম আঁচলের কোণ কর্তৃক চোখের জল মুছে বললেন, ‘ ভালো আছি মা। তুমি কেমন আছ? অনেকদিন পর তোমায় দেখলাম। তোমার স্বামী কেমন আছে? ‘
স্বামীর কথা জিজ্ঞেস করলে, তাহিয়া বেগমের চোখে জল ভরে। আজ মৃদুল বেঁচে থাকলে, আয়েশীর মত লক্ষ্মী মেয়ে তাদের বাড়ির বউ হত। মৃদুল এবং আয়েশীর ভালোবাসায় এ ঘর মুখরিত থাকত। তাদের ছেলে মেয়ে হলে, ফাঁকা ঘরটা পূর্ণতা লাভ করত। তাদের নাতি নাতনি ছোটছোট পা ফেলে ঘরময় ঘুরে বেড়াত। ইশ, তাহিয়া বেগম সারাক্ষণ নাতি নাতনীদের সাথে হেসে খেলে বেড়াতেন। একাকীত্বে ভোগার সময় কোথায় তার? কিন্তু আজ? আজ মৃদুল নেই। আয়েশীও অন্য কারো ঘরের ঘরণী। আজকাল তাহিয়া বেগমের ঘরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। রাত হলে তাহিয়া বেগম ক্লান্ত হয়ে পড়েন একাকীত্বের সাথেই যুদ্ধ করে। একমাত্র ছেলেবিহীন বাড়িটা মৃ’ত মৃ’ত মনে হয়। মৃদুলের বাবার শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না। টাকার সংকট দেখা দিয়েছে। ভালো চিকিৎসা করাবেন, তারও উপায় নেই। কবে যে সব ভালো হবে!
‘ মা? ‘
আয়েশীর মা ডাকে ধ্যান ভাঙে তাহিয়া বেগমের। মৃদুল থাকাকালীন আয়েশী বিয়ের আগেও তাহিয়া বেগমকে মা ডাকত। আজ মৃদুল নেই। তবুও আয়েশী তাকে মা ডাকছে। তাহিয়া বেগম সেই মা ডাক শুনে ক্রমশ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছেন।
‘ মা, আপনাকে আমার কিছু প্রশ্ন করার ছিল। ‘
তাহিয়া বেগম নিজেকে সামলে বললেন, ‘ বলো! ‘
আয়েশী মুনিজকে নিকাব খুলতে বলল। মুনিজ কিছুক্ষণ থেমে নিকাব খুলে তাহিয়া বেগমের দিকে তাকাল।
মুনিজের চেনা চেহারা দেখে তাহিয়া বেগম ধপ করে সোফা ছেড়ে উঠে গেলেন। মৃদু চেঁচিয়ে বললেন, ‘ তুমি? ‘
আয়েশীর বুক ছ্যাঁত করে উঠল। অর্থাৎ, মেয়েটাকে মৃদুলের মা চিনেন। আয়েশী বলল,
‘ মা, আপনি কি তাকে চিনেন? ‘
তাহিয়া বেগম উত্তর দিলেন না। বরং মুনিজের হাত খপ করে ধরে বাড়ির বাইরে টেনে যেতে উদ্যত হলেন। আয়েশী তাকে থামাল। বলল, ‘ মা, থামুন। কি করছেন? শান্ত হোন। ‘
তাহিয়া বেগম শান্ত হলেন না। বরং অশান্ত হয়ে বললেন,
‘ তুমি একে চেনো না আয়েশী। এই মেয়েটা মিথ্যুক। আমার ফুলের মত ছেলেটাকে ফাঁসিয়েছে। আমি কতদিন এই মেয়েকে না করেছি মৃদুলের আশেপাশে না ঘুরতে। কিন্তু নির্লজ্জ মেয়ে মৃদুলের মৃত্যুর দিন এসে বলে আমার মৃদুল নাকি বিয়ে করেছে একে। আমি জানি আমার ছেলে কিছুতেই এসব করতে পারে না। মৃদুল পুরুষ মানুষ, আশেপাশে ঘুরছে তাই হয়তো দু একটা কথা বলেছে। কিন্তু বিয়ে? বিয়ে করতেই পারে না। আয়েশী, আমি চিনি আমার ছেলেকে। সে কি এসব করতে পারে? তুমি বের করে দাও একে আমার ঘর থেকে। আমার ঘর অপবিত্র হচ্ছে এই নোং’রা মেয়ের স্পর্শে। ‘
আয়েশী যা বোঝার বুঝে গেল। অর্থাৎ, তাহিয়া বেগম অনেক আগে থেকেই মুনিজকে চেনেন। মুনিজ মৃদুলের বিয়ের দিন তাহিয়া বেগমের সাথে দেখা করেছে। মৃদুলকে শেষ দেখা দেখতে চেয়েছিল, কিন্তু তাহিয়া বেগম দেননি তাকে দেখতে। আয়েশীর চোখে জল উপচে আসতে চায়। তাহলে মৃদুল সত্যিই মুনিজকে বিয়ে করেছিল। আয়েশী মেয়েটার হাত তাহিয়া বেগমের থেকে ছাড়িয়ে নেয়। তাহিয়া বেগম রাগে ফুসফুস করছেন। মেয়েটা তাহিয়া বেগমকে একে একে মৃদুল এবং তার বিয়ের ছবি, কাবিননামা, এ্যাবোরশন রিপোর্ট, তাদের সকল অন্তরঙ্গ ছবি দেখাল। সব দেখে তাহিয়া বেগম চুপসে গেলেন। হতভম্ব হয়ে বললেন,
‘ আমি বিশ্বাস করি না। আমার মৃদুল এমন নোংরা কাজ করতেই পারে না। ‘
আয়েশী এবার মৃদু কন্ঠে বলে,
‘ যা সত্যি তা কখনো বদলাতে পারবেন না, মা। প্রমাণ আপনার চোখের সামনে। মৃদুল আমাকে, আপনাকে, আমাদের সবাইকে ধোঁকা দিয়েছে, মা। মৃদুল কখনো ভালো প্রেমিক, ভালো ছেলে কিংবা ভালো স্বামী ছিল না। সে ধোঁকাবাজ। সে ঠকেয়েছি আমাদের অনুভূতিকে। ‘
তাহিয়া বেগম ধপ করে সোফায় বসে পড়লেন। মাথা ঘুরছে তার। আয়েশী অনেকসময় নিয়ে তাহিয়া বেগমকে শান্ত করল। তাহিয়া বেগম শান্ত হয়ে, মুনিজকে কাছে ডাকলেন। হাত জোড় করে ক্ষমা চাইলেন মেয়েটার কাছে। আয়েশী, মেয়েটা, তাহিয়া বেগম সবাই কাঁদছেন। এক পুরুষকে এই তিন নারী ভালোবেসে মনে রাখতে চাইছিলেন, অথচ আজ সবাই তাকে ঘৃনা করতে চাইছেন। কিন্তু এই তিন নারীর চোখের মণি ছিল মৃদুল। তাই তারা চেয়েও প্রিয় মানুষকে ঘৃনা করতে পারছেন না। আফসোস,এক সমুদ্দুর আফসোস!
#চলবে ( শব্দসংখ্যা- ১৪০০+)