মৃত_কাঠগোলাপ – ৪১,৪২,৪৩

0
687

#মৃত_কাঠগোলাপ – ৪১,৪২,৪৩
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
৪১

ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁই ছুঁই! রাতের আঁধারের সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধ্রুব এখনো বাড়ি ফেরেনি। আয়েশী ধ্রুবর জন্যে অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত! সারা গা আজ কেন যেন ম্যাজম্যাজ করছে। আয়েশী শাড়ির আঁচল টেনে বিছানা ছাড়ল। আলমারি খুলে কিছু একটা খুঁজল। আলমারির ভেতরের একদম কর্নারে কাঙ্ক্ষিত বস্তু পেয়েও গেল। আয়েশী আলমারি বন্ধ করে দিল। হাতে থাকা জিনিসটাকে যত্ন করে মুঠোয় পুড়ে বিছানায় এসে বসে। আয়েশী হাতের মুঠো খুলে জিনিসটার দিকে চায়। মৃদুলের একটু সুন্দর ছবি! এই এক বছরে আয়েশীর কাছে মৃদুলের যত স্মৃতি ছিল, সব ধ্রুব নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। শুধুমাত্র এই ছবি আয়েশী অনেক লুকিয়ে নিজের কাছে রেখেছে। ছবিতে মৃদুল কি সুন্দর করে হাসছে। আয়েশী যখন মৃদুলের এই হাসিমাখা ছবি দেখে, আয়েশীর চোখ ভিজে উঠে। মৃদুলের ছবিতে কতশত চুমু আঁকে। মৃদুলকে আয়েশী ভুলতে চেয়েছিল। অথচ কী দুর্ভাগ্যের কথা! আয়েশীর মনে এক বছর পরও মৃদুলের স্মৃতি এখনো পূর্বের ন্যায় তাজা, ফকফকা! আয়েশীর চোখ থেকে টুপ করে একফোঁটা জল গড়িয়ে ছবি ফ্রেমের উপর পড়ে। আয়েশী মৃদুলের ছবিতে আলতো হাত বুলায়। আঁখিতে অশ্রুর আগমন! কণ্ঠনালী কাঁপছে। আয়েশী বিড়বিড় করে শুধায়, ‘ কেন এমন করলি মৃদুল? ‘
হঠাৎ টুপ করে কোথা হতে ধ্রুব এসে আয়েশীর কোলে মাথা রাখে। আয়েশী হকচকিয়ে যায়। ছবিটি দ্রুত শাড়ির আঁচলের নিচে লুকিয়ে ফেলে। ততক্ষণে ধ্রুবর চোখে ছবিটি পড়ে যায়। ধ্রুব পাত্তা দেয়না। মৃদু হেসে আয়েশীর গাল টেনে বলে, ‘ মন খারাপ? ‘
আয়েশী হাতের পিঠ দিয়ে ভেজা চোখ মুছে হাসার অভিনয় করে বলে, ‘ না! ‘
ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে আঙ্গুল উচুঁ করে আয়েশীর গাল থেকে অশ্রু বিন্দু ফেলে দেয়। আয়েশী বুঝে যায়, সে আবারও ধরা পড়ে গেছে। আয়েশী ইতি-অতি চেয়ে মুখশ্রী আড়াল করতে চায়। পারে না। ধ্রুব ততক্ষনে আয়েশীর থুতনি চেপে মুখ নিজের দিকে করে নিয়েছে। আয়েশী ব্যথা পায়। বলে, ‘ ছাড়ো, ব্যথা পাচ্ছি। ‘
ধ্রুব ছাড়ে না। বরং গমগমে সুরে বলে, ‘ মৃদুলকে আবারও মনে করেছ? ‘
আয়েশী কথা বলে না! ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ধ্রুব চোখ বুজে নেয়। ক্লান্ত সুরে বলে, ‘ চুল টেনে দাও। বড্ড মাথা ধরেছে। ‘
আয়েশী হাত গলিয়ে দেয় ধ্রুবর চুলে। কি সিল্কি ধ্রুবর চুল! হাত যেন ফস্কে যায় বারবার! আয়েশী মনের সুখে ধ্রুবর চুলে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। ধ্রুব চোখ বুজে বলল, ‘ খেয়েছ কিছু? ‘
আয়েশী বলল, ‘ না! তুমি না এলে তো আবার খাওয়া যাবে না। ‘
ধ্রুব আয়েশীর কোল থেকে উঠে বসে। টিশার্ট টেনেটুনে ঠিক করে বলে, ‘ চলো। খেয়ে নেই। ‘
আয়েশী উঠে দাঁড়ায় বিছানা থেকে। আঁচল টেনে ঠিক করে ধ্রুবর সাথে বেরিয়ে যায়।
ধ্রুবর খাওয়া শেষ! আয়েশী তখনও খাচ্ছে। ধ্রুব সব কাজ অত্যন্ত দ্রুত করে। হাতের সাথে তার মস্তিষ্কের গতি যেন আস্ত চিতাবাঘ! ধ্রুব ঠিক বলে! সে আসলেই একটা চিতাবাঘ! যার লাগাম আয়েশী কখনোই স্পর্শ করতে পারে না। ধ্রুব দৌঁড় আয়েশী থেকে পাঁচ কদম এগিয়ে।
আয়েশী খাবার গুছিয়ে কক্ষে আসে। কক্ষের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলে, আয়েশীর চোখ কপালে উঠে। ধ্রুবর হতে মৃদুলের সেই ছবিখানা! আয়েশীর বুক ধরাশ করে উঠে। দ্রুতপদে এগিয়ে যায় ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব ততক্ষণে রাগে কাঁপছে। আয়েশী ধ্রুবর থেকে ছবির ফ্রেম ছিনিয়ে নিতে চায়। পারে না। ধ্রুব আগুন চোখে আয়েশীর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। আয়েশী ভয়ে সেঁটিয়ে যায়। ধ্রুবর রাগকে আয়েশীর ভীষন ভয় পায়। রাগ হলে ধ্রুব তখন মানুষ থাকে না। বনমানুষে পরিণত হয়। যা ইচ্ছে হয়, তাই করে। নিজেকে র’ক্তাক্ত করে, ঘরের জিনিসপত্র ভা’ঙচুর করে! তবে আয়েশীকে রা’গের বশে ধ্রুব এখন পর্যন্ত আঘাত করে নি। তবে ধ্রুব নিজেকে যখন আঘাত করে, আয়েশীর মনে হয় ধ্রুব যেন স্বয়ং আয়েশীকে আঘাত করেছে। ধ্রুবর শরীর থেকে যখন রক্ত ঝড়ে, আয়েশীর মনে যেন কেউ ছু’রি দিয়ে রক্তাক্ত করে ফেলে। আয়েশী অনুভব করে, ধ্রুবর ব্যথা, ধ্রুবর যন্ত্রণা! এ যেন এক আত্মা, দুই দেহ!

কাঁচ ভাঙার শব্দ আয়েশীর ধ্যান ভাঙে। আয়েশী চকিতে মাটিতে তাকায়। মৃদুলের শেষ চিন্হটুকুও ধ্রুব নিঃশেষ করে দিয়েছে। আয়েশীর চোখ ভিজে। ধ্রুব আয়েশীর হাত চেপে ধরে। আয়েশী চোখ মেলে ধ্রুবর দিকে চায়। ধ্রুব রাগে গড়গড় করে বলে, ‘ মৃদুলকে ভুলতে পারছ না, আমাকে আপন করতে পারছ না! কি, চাইছটা কি তুমি? ‘
আয়েশী কেঁদে বলে, ‘ আমি ব্যথা পাচ্ছি, ধ্রুব। ‘
‘ ওহ, ড্যাম! একটু ছুঁলেই ব্যথায় শেষ হয়ে যাও। অথচ আমার বুকে প্রতিনিয়ত ব্যথা দিচ্ছ, সেসব? ‘
ধ্রুব আয়েশীর হাত ছেড়ে দেয়। আয়েশী হাত ঘষে ধ্রুবর দিকে চায়। ধ্রুব তখন রাগে হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েছে। ধ্রুব মাটিতে থাকা ভাঙা কাঁচের উপর হেঁটে বারান্দায় চলে যায়। ধ্রুবর পায়ের কাঁচ ফুটে র’ক্ত ঝড়ছে। তরল র’ক্তে মাটির কার্পেট ভিজে গেছে। কার্পেটে লাল ছোপ ছোপ র’ক্ত দেখে আয়েশী আঁতকে উঠে। দৌঁড়ে বারান্দায় যায় সে। ধ্রুব ইজি চেয়ারে বসে দুলছে। দু চোখ বুজে চেয়ারে হেলান দিয়ে রাগ সামলানোর চেষ্টা করছে।
আয়েশী ধ্রুবর পায়ের কাছে বসে। ধ্রুবর পা হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিয়ে অস্থির চিত্তে বলে, ‘ ধ্রুব, চলো। ব্যান্ডেজ করবে। তোমার পা অনেক কেটে গেছে। ‘
ধ্রুব তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, ‘ ওহ, আমার কষ্ট তোমার চোখে পড়ে তাহলে? ‘
আয়েশী অবাক কণ্ঠে বলে, ‘ ধ্রুব, আমি তোমাকে ভালোবাসি। এমন কথা কেন বলছ তুমি? ‘
ধ্রুব এবার আয়েশীর দিকে ঝুঁকে, আয়েশীর থুতনি দু আঙ্গুল দিয়ে চেপে ধরে। হিড়হিড় করে বলে,
‘ আমাকে ভালবাসো? তবে মৃদুলের জন্যে এখনো কেন চোখের জল ফেলছ? তোমার আর মৃদুলের মাঝখানে আমি কোথায় আয়েশী? বলো, কোথায় আমি? আয়েশী, আমি কি করে মেনে নিব, যাকে আমি ভালোবাসি, সে অন্য পুরুষের জন্য চোখের পানি ফেলছে। আ’ম হেল্পলেস আয়েশী! প্লিজ, আমাকে এভাবে তিলে তিলে মেরে ফেলো না। ‘
আয়েশী ভেজা চোখে ধ্রুবর দিকে চেয়ে থাকে। ধ্রুব কষ্ট দেখে আয়েশীর বুক ফেঁটে চৌঁচির হয়ে যাচ্ছে। সত্যিই কি আয়েশী ধ্রুবকে তার আচরণ দিয়ে প্রতিনিয়ত কষ্ট দিচ্ছে?
ধ্রুব এবার উন্মাদের ন্যায় চেয়ার উঠে উঠে। আবার কাঁচের উপর হেঁটে ড্রয়ার থেকে ছু’রি নিয়ে আয়েশীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, ‘ নাও, নিজের হাতে আমায় একেবারে মে’রে ফেলো। তারপর মৃদুলকে মনে করে যত ইচ্ছে কেঁদো। কিন্তু প্লিজ, আয়েশী! আমার সামনে অন্য পুরুষের জন্য চোখের জল ফেল না। আমার বুকে কষ্ট হয়। ভীষন কষ্ট! ‘

আয়েশী ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে ধ্রুবর দিকে চেয়ে রয়। ধ্রুব আবার বলে, ‘ মা’রো আমাকে! ‘
ধ্রুবর চিৎকারে আয়েশী দেহ কম্পিত হয়। আয়েশী ধপ করে হাত থেকে ছু’রি ফেলে দেয়। তারপর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ধ্রুবকে। ধ্রুব আয়েশীর পিঠে হাত গলিয়ে আয়েশীর ঘাড়ে মুখ ডুবায়। আয়েশী ধ্রুবর পিঠ খামচে ধরে কেঁদে বলে,
‘ এমন করে বলো না, ধ্রুব। আমি তোমাকে মারতে পারবো না। একজনকে হারিয়েছি। অপরজনকে হারানোর শক্তি আমার নেই। তোমাকে হারানোর কথা ভাবলেও আমার বুক কাঁপে, ধ্রুব। ‘
ধ্রুব মিহি হাসে। আয়েশীর পিঠে হাত বুলিয়ে মন খারাপের অভিনয় করে বলে, ‘ মৃদুলকে সম্পূর্ণরূপে ভুলে যাও, আয়েশী। ‘
আয়েশী ধ্রুবর পিঠের শার্ট মুচড়ে ধরে। কেঁদে বলে, ‘ আজ থেকে মৃদুলকে আমি ভুলে গেছি। ভুলে গেছি আমি মৃদুলের সকল স্মৃতি! ‘
ধ্রুব মুচকি হাসে। বিড়বিড় করে শুধায়, ‘ আহারে, ইমোশনাল ফুল গার্ল! ‘
ধ্রুব আয়েশীর কানের পিঠে ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়। আয়েশী কেঁপে উঠে। ধ্রুব আয়েশীর কানে ঠোঁট ঠেসে রেখে হিড়হিড় কণ্ঠে আবদার করে,
‘ আজ রাতে আমার আবার তোমাকে চাই, রক্তজবা! আবার তোমার শরীরে উষ্ণ চুম্বন এঁকে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে চাই। তোমার ঠোঁটের ভাজে ঠোঁট রেখে ভুলে যেতে চাই সকল কষ্ট! কাঠগোলাপ হয়ে নামতে চাই তোমার মনের বাগানে! ‘
ধ্রুবর কথা শুনে আয়েশীর বুক ভয়ংকরভাবে কেঁপে উঠে। আয়েশী ধ্রুবর ঘাড় থেকে মুখ সরায়। মৃদু স্বরে বলে, ‘ কিন্তু ধ্রুব! তোমার পা? ‘
ধ্রুব আয়েশীকে কোলে তুলে নেয়। আয়েশী নাকে নাক ঘষে হুইস্কি কণ্ঠে বলে, ‘ তোমার ছোঁয়ায় আমার সকল ব্যথা সুখ হয়ে যায়। তুমি আমার সুখ হবে, রক্তজবা? কথা দিচ্ছি, আমার সুখের রাজ্যে রানী করে রাখব তোমায়! ‘
আয়েশী মৃদু হাসে। পূর্বের সমস্ত মন খারাপ হু হু করে পালিয়ে যায়। ঠোঁট টেনে হেসে বলে, ‘ পাগল! ‘
ধ্রুব আয়েশীকে বিছানায় শুইয়ে দেয়। আয়েশীর গলায় মুখ গুঁজে মৃদু স্বরে বলে ‘ তোমার জন্যে! ‘
আয়েশী ধ্রুবর চুলে হাত গুঁজে দেয়। ধ্রুব তখন আয়েশীর গলায় মুখ গুঁজে উষ্ণ ঠোঁটের স্পর্শ দিতে ব্যস্ত! আয়েশীর কথা তার কানে প্রবেশ করেনি। আয়েশী অনুভব করছে, ধ্রুবর অস্থির আচরণ, বেপরোয়া ভালোবাসা, বেহায়া হাতের স্পর্শ! ইশ, আয়েশী যে সুখে আজ ম’রেই যাবে। প্রতিবার এমন কেন হয়? যতবার ধ্রুব আয়েশীকে ছুঁয়ে দেয়, আয়েশীর ততবার ধ্রুবর স্পর্শ নতুন মনে হয়। ধ্রুবর অস্থিরতা আয়েশীকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় মাদকতার অন্যন্য পর্যায়ে! ধ্রুব যখন ভালোবেসে, আয়েশীর কি যে সুখ লাগে। ইশ, ভালোবাসা কি ভীষন সুখের! তবে এই সুখ একদিন দুঃখে পরিণত হবে। আফসোস, সুখের নেশায় ডুবে থাকা আয়েশী সে সম্পর্কে অজ্ঞতই থেকে গেল!

#চলবে

#মৃত_কাঠগোলাপ – ৪২
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
___________________________
কদিন ধরে আয়েশীর মন খারাপ! আকাশ বাতাস মিথ্যা করার মত তীব্র এক মন খারাপ ঝেঁকে বসেছে তার ছোট্ট হৃদয়ে। সেই মন খারাপের রেশ ধরে মনের ভেতর গুমড়ে কেঁদে কেঁদে উঠছে। নিজেকে ধ্রুবর এই বিশাল বাড়িতে ভীষন একা একা লাগে। দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। একলা মনে বিবশ হয়ে চেয়ে রয় জানালার দিকে। জানলার ওপারে পিচঢালা সড়ক। সড়কের উপর হেঁটে যাচ্ছে শত পথিক। ব্যস্ত গাড়ির চাকা। সবাই খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে মন খুলে নিঃশ্বাস নিতে পারছে। অথচ আয়েশী পারছে না। আয়েশীর যে সে সাহস নেই। ধ্রুব আয়েশীকে একপ্রকার বন্দী করে রেখেছে এই বিশাল বাড়িটিতে। ধ্রুবর বাড়ি কেউ বাইরে থেকে দেখে অবশ্যই বলবে, বাড়িটির ভেতরে থাকা মনুষ্যরা কি ভীষন সুখী। অথচ আয়েশী জানে, এই চার দেয়ালের মধ্যে আটকে থেকে আয়েশী ক্লান্ত। শিকলে আটকে থাকা চড়ুইপাখির ন্যায় ছটফট করে আয়েশী। দিনশেষে হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে হয়। অথচ কাঁদাও যে তার নিষেধ। আয়েশী চাইলেও চোখের জল ফেলতে পারে না। চাইলেও ঘর ছেড়ে দু পা ফেলে দেখতে পারে না, পৃথিবীর সৌন্দর্য্য, বসন্তের রঙ, বর্ষার থইথই জল, গ্রীষ্মের দাবানল। আয়েশী পারে না, কিছুই পারে না। কারণ ধ্রুবর কথা অমান্য করে আপন মর্জি মত চললে ধ্রুব নিজেকে আ’ঘাত করে বসে। র’ক্তাক্ত করে নিজের দেহ। আয়েশী তখন কষ্টে শেষ হয়ে যায়। বুকের ভেতর র’ক্তক্ষরণ হয়। ধ্রুবকে ভালো রাখতে আয়েশী নিজের সমস্ত শখ আহ্লাদ নদীর অতলে ভাসিয়ে দিয়েছে। আয়েশী ভুলে গেছে, নিজের মধ্যে থাকা এক স্বয়ংসম্পূর্ণ সত্তাকে!

মন খারাপকে পুঁজি করে আয়েশী বাগানে এসে দাঁড়ায়। কাঁধের শাল দুহাতে গায়ের সাথে চেপে ধরে দূরে চোখ রাখে। অদূরের একটা খাঁচা রাখা। খাঁচার ভেতর দুটো বাঘ আরামে শুয়ে আছে। বৈকালিক ঘুম বোধহয়! আয়েশী ধ্রুবর বাড়ি আসার পর থেকে এই বাঘদের দেখে এসেছে। ধ্রুব অবসর সময় এই বাঘদের সাথে কাটায়। সাধারণ মানুষ যেমন বিড়াল, কুকুর পুষে, মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে। ঠিক তেমন ধ্রুব এই বাঘদের নিজের সন্তানের মত আদর করে। ধ্রুবর মধ্যে আদৌ কি কোনো ভয়-ডর আছে? না, নেই। তাই দুটো বন্য বাঘকে পুষছে। ধ্রুব অনেকবার চেয়েছে, আয়েশীও ধ্রুবর মত তার পোষা বাঘদের আদর করুক। আয়েশী করে নি। বাঘদের দেখলে আয়েশী ভ’য়ে চেঁচিয়ে উঠে। আয়েশীর পশম কেঁপে উঠে। মনে হয় বাঘেরা আয়েশী আস্ত চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে। আয়েশীর ভয় নিয়ে ধ্রুবর সে কি টিটকারী! সারাক্ষণ আয়েশীকে এ নিয়ে ক্ষেপায়। ধ্রুবও না? আস্ত এক খারাপ লোক। অকারণে আয়েশীকে শুধু ক্ষেপায়।
আয়েশী চোখ সরায়। বাগানে নতুন কালো গোলাপ ফুটেছে। বাগানের একপাশ কালো রঙের গোলাপে কি সুন্দর করে সেজে উঠেছে। সম্পূর্ন বাগান গোলাপের ঘ্রাণে ম-ম করছে। আয়েশী একটা ফুল হাতে ধরে নাক দিয়ে ঘ্রাণ শুঁকে। ইশ, কি আদুরে ঘ্রাণ! নাকের মধ্যে প্রবেশ করে মস্তিষ্ক অব্দি শীতল করে দিচ্ছে। আয়েশী চোখ বুজে ফেলে। ফুলের পবিত্র সুঘ্রাণে আয়েশীর সমস্ত মন খারাপ হু হু করে পালিয়েছে।
‘ কি করছ এখানে? ‘
ধ্রুব এসে আয়েশীর পাশে দাঁড়ায়। আয়েশী হাতে ধরা ফুলটির দিকে ধ্রুবকে ইশারা করে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে,
‘দেখো ধ্রুব, গোলাপ ফুলটা কত সুন্দর!ঘ্রাণ শুঁকে দেখো। ভীষন সুন্দর। ‘
আয়েশী ফুলের কাছে ঝুঁকে এল। চোখ বন্ধ করে ঘ্রাণ শুষে নিল নিজের ভেতর। সঙ্গেসঙ্গে শরীর যেন কাঁপুনি দিয়ে উঠলো তার। মনে হলো, একঝাঁক ঠান্ডা বাতাস তার গলার কাছে সুরসুরি দিয়ে গেল। আয়েশী উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
‘ আমায় এই ফুল ছিঁড়ে কানে গুঁজে দেবে , ধ্রুব? ‘
ধ্রুব এতক্ষণ আয়েশীর কারণে রাগে অঙ্গার হচ্ছিল। একটা সামান্য গোলাপ ফুলের প্রতি আয়েশীর এত মুগ্ধতা ধ্রুবের সহ্য হচ্ছে না। আয়েশীর চোখে শুধুমাত্র একজনই মুগ্ধ হয়ে রবে! সে হলো, ধ্রুব স্বয়ং! অন্যকিছু আয়েশীকে মুগ্ধ কেন করবে? ধ্রুব সবকিছু ভে’ঙে গু’ড়িয়ে দেবে তবে!
‘ কথা বলছ না কেন, ধ্রুব? দেবে কালো গোলাপ নিজ হাতে কানে গুঁজে?’
ধ্রুব এবার হাসার ভান করল। আয়েশীকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে থুতনি রাখলো তার ঘাড়ের ভাঁজে। ঠোঁট উল্টে বললো,
‘ ক্ষুধা লেগেছে খুব। খাবার কি পাওয়া যাবে আজ, রক্তজবা?’
ধ্রুবের কথায় আয়েশী সব ভুলে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ধ্রুবকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
‘ আমি তো ভুলেই গেছি দুপুরের খাবারের কথা। তুমি পাঁচ মিনিট বস, আমি টেবিলে খাবার বাড়ছি। ‘
আয়েশী চলে গেল। ধ্রুব এবার আগুন চোখে গোলাপ ফুলের দিকে তাকাল। আয়েশীর ছুঁয়ে দেওয়া গোলাপ ফুল একটানে ছিঁ’ড়ে ফেলল গাছ থেকে। অতঃপর সেই সুন্দর গোলাপ ফুলটা অত্যন্ত হিং’স্র ভাবে পায়ের তলায় জুতো দ্বারা পি’ষে ফেলল। গোলাপ ফুলের বোধহয় অনেক কষ্ট হলো! মন ভাঙার ন্যায়, ক্যাক ক্যাক আওয়াজ হল যেন। অভিশাপ দিল কি, ধ্রুব নামক এই পা’ষন্ডকে? কেমন নি’ষ্ঠুর ভাবে পবিত্র এক ফুলকে খু’ন করে ফেলল! হায়, ধ্রুবর হৃদয় যে পাথরের তৈরি!

‘ ধ্রুব, আমি আজ বাবার বাসায় যাব। ওদের খুব মনে পড়ছে। ‘
ধ্রুব খাবার খাওয়ার ফাঁকে চোখ তুলে আয়েশীর দিকে তাকাল। আয়েশী একবুক আশা নিয়ে ধ্রুবর দিকে চেয়ে আছে। বাবার বাসায় যেতে নিশ্চয়ই ধ্রুব আপত্তি করবে না। ধ্রুব নিশ্চয়ই অতটা নি’ষ্ঠুর হবে না! ধ্রুব মাথা নত করে খাবার খেতে শুরু করে। আয়েশীর সমস্ত আশ্বাসকে দু’মড়ে মু’চড়ে দিয়ে বলে, ‘ প্রয়োজন নেই। বেশি দেখতে ইচ্ছে হলে, ওদের এখানে আসতে বল। ‘
আয়েশী কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়। বলে, ‘ এটা কেমন কথা, ধ্রুব। ওরা কেন এখানে আসবে? বাবা কখনো এ বাড়ি আসতে রাজি হবেন না। ‘
‘ তাহলে যাওয়ার দরকার নেই। বাড়িতে বসে থাকো। ‘
আয়েশী এবার জেদের সুরে বলে, ‘ আমি যেতে চাইছি। ‘
ধ্রুব কঠিন চোখে আয়েশীর পানে চোখ রাখে। রাগ প্রকাশ করে বলে, ‘ আমি মানা করেছি। ‘
আয়েশী একটু থেমে বলে,’ তুমি কি আমাকে বন্দী করতে চাইছ? ‘
ধ্রুব মিহি হেসে মাথা নিচু করে খেতে খেতে বলে, ‘ খানিকটা তাই। ‘
আয়েশী থমকে যায়। চারপাশে যেন ভূ’মিকম্প অনুভব করে। মাথার উপর আস্ত এক পাহাড় ধ্ব’সে পড়ে। ধ্রুব কি তবে….আয়েশী বলে, ‘ কেন? ‘
ধ্রুবর স্পষ্ট উত্তর,
‘ কারণ তোমার সম্পূর্ন দুনিয়া জুড়ে শুধু আমার বসবাস হবে। তোমার দিবস শুরু হবে আমায় ঘিরে, রাতের অন্ধকার কাটবে আমার বুকের উষ্ণ ছোঁয়ার স্পর্শে! তোমার সবটা হবে আমিময়! আমায় ভালো রাখতে যদি তোমার প্রিয়জন বি’সর্জন দিতে হয়, তবে তাই করবে। ‘
ধ্রুব চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে। আয়েশী শুধু চেয়ে থাকে ধ্রুবর দিকে। এ কোন ধ্রুবকে দেখছে সে? এই ধ্রুবকে কি আদৌ আয়েশী চেনে? না, চেনে না! এ ধ্রুব তো কোনো অন্য। এই ধ্রুব আয়েশীর থেকে সবকিছু কে’ড়ে নিতে জানে। আদৌ ভালোবাসতে জানে কি? ভালোবাসার অর্থ কি কেড়ে নেওয়া নাকি প্রিয় মানুষের জন্যে নিজের সমস্ত স্বার্থকে ছেড়ে যাওয়া?

#চলবে

#মৃত_কাঠগোলাপ – ৪৩
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
__________________________
আয়েশী বেশ কয়েকবার তার মায়ের সেলফোনে কল করল। অথচ বারবার ওপাশ থেকে এক মিষ্টি কণ্ঠী বলে,
‘ আপনার এই নাম্বারটি এই মুহূর্তে ব্যস্ত আছে। ‘
আয়েশী অবাক হয়! বিমূঢ় দৃষ্টিত চেয়ে থাকে ফোনের দিকে। বাবা মায়ের কোনো অসুখ হলো না তো? আয়েশী চিন্তায় চিন্তায় সে রাত আর ঘুমাতে পারল না। সারারাত বিছানায় শুয়ে ছটফট করে গেল। ধ্রুব দেখল। সে নির্বিকার হয়ে আয়েশীকে বুকে জড়িয়ে ঘুমে তলিয়ে গেল। অথচ আয়েশী জেগে রইল সারাটা রাত। আজ ধ্রুবর বুক আয়েশীর সহ্য হচ্ছে না। মাথা যন্ত্রণা করছে। আয়েশী মনস্থির করল, সকাল হলে সে বাবার বাসায় যাবে। ধ্রুব যা বলুক, তবুও যাবে। বাবা নিশ্চয়ই আয়েশীকে মনে করছেন? মা পথপানে আয়েশীর অপেক্ষায় চেয়ে আছেন।

ধ্রুব অফিসে চলে গেলে, আয়েশী বোরকা পড়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যায়। বাবার বাসায় এসে কলিং বেল বাজায়। দরজা খুলে দেয় তুষার। কতদিন পর ভাইকে দেখে আয়েশীর চোখ ভরে আসে। আয়েশী ঝাঁপিয়ে পড়ে ভাইয়ের বুকে। তুষার ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে নিজ স্থানে। আয়েশী ভাইয়ের বুকে লেপ্টে কেঁদে-কুটে একাকার হয়। তুষার ঠোঁট টিপে নিজেকে শান্ত করে শান্ত স্বরে শুধায়, ‘ কেন এসেছিস তুই? ‘
আয়েশী হতভম্ব হয়ে সরে দাড়ায়। মাথা তুলে ভাইয়ের দিকে চায়। আশ্চর্য্য হয় আয়েশী। এ কোন তুষার ভাইকে দেখছে আয়েশী। এই তুষার ভাইকে তো আয়েশী চেনে না। এ তুষার তো কোনো অন্য। আপদমস্তক কাঠিন্যের চাদরে মোড়ানো। আয়েশী ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে থাকে। বলে, ‘ ভাই, এটা আমার বাবার বাসা। আমি আসতে পারি না? ‘
‘ না। ‘
‘ তুমি কি আমার উপর রেগে আছো, ভাই? ‘
‘ পর লোকের সাথে রাগ করে কি ফায়দা? ‘
‘ আমি পর? ‘
আয়েশী আহত ভঙ্গিতে বলে। তুষার কাটছাট কণ্ঠে বলে,
‘ হ্যাঁ। পর। যে বোনকে ভাইয়ের দুর্দিনে পাওয়া যায় না, সে বোন পর’ই। যে মেয়েকে বাবা মায়ের ম’রন কালে খুঁজে পাওয়া যায় না, সে মেয়ে পর না তো কি? ‘
তুষারের বাক্যে আয়েশীর চারপাশ ঝরঝর করে ভে’ঙে পড়ে। চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে হয়। মাথা ঘুরে উঠে। আয়েশী ভেজা পলক ঝাপটে, কম্পিত কণ্ঠে বলে,
‘ বাবা মা? ‘
‘ হ্যাঁ, তারা আর নেই। ‘
আয়েশী বিস্ময়, বিমূঢ়, হতভম্ব হয়ে বা দিকে হেলে পড়ে। সঙ্গেসঙ্গে হাত দিয়ে আটকে ধরে সিড়ির হাতল। বিশ্বাস হচ্ছে না। সব কেমন দুঃস্বপ্ন মনে হচ্ছে। বাবা মা নেই, মারা গেছেন? অথচ আয়েশী জানে না! কেউ তাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করে নি? আয়েশী কি তাদের মেয়ে না? আয়েশী কি তবে আর কাউকে বাবা বলে আহ্লাদ করতে পারবে না। মায়ের কাছে আদরের বায়না ধরতে পারবে না। ইন্নালিল্লাহ! আয়েশী কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকে। মাটিতে ধপ করে বসে ঘোলা দৃষ্টিতে মাটিতে চেয়ে থাকে।
‘ কেন কষ্ট পাওয়ার নাটক করছিস? তুই নিজে আমার বাবা মাকে মেরেছিস। ”
তুষারের চোখেও জল। আয়েশী মাথা তুলে আহত কণ্ঠে প্রশ্ন করে, ‘ আমি মেরেছি ওদের? ‘
‘ হ্যাঁ, তুই ওদের মেরেছিস। খু’নি তুই, খু’নি! ‘
আয়েশী দুহাতে কান চেপে ধরে চিৎকার করে,
‘ চুপ করো তুমি। আমি ওদের মারি নি। আমি ওদের কিভাবে মারব। আমি আমার বাবা মাকে প্রচন্ড ভালোবাসি, ভাই। দোহাই লাগে, আমাকে এমন কথা বলো না। দোহাই তোমার।’
তুষার চুপ করে থাকে। তার বুকটাও যে ফেঁটে যাচ্ছে। নিজের প্রাণের চেয়ে প্রিয় বোনকে কঠিন মৃত্যুতুল্য কথা বলতে সে চায়না। অথচ মনে যে ক্ষোভ জমে আছে। তা নিবারণ করতে এটুকু যে বলতেই হত।

তুষার এবং আয়েশী মুখোমুখি বসে আছে। তুষার আয়েশীর দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়।
‘ নে,পানি খা। ‘
আয়েশী পানি নেয় না। স্থির দৃষ্টিতে দেয়ালে টাঙানো বাবা মায়ের ছবির দিকে চেয়ে বলে,
‘ বাবা মা চলে গেলেন, অথচ তুমি একবারও আমায় জানালে না। আমি কি ওদের মেয়ে ছিলাম না? ‘
তুষার বলে, ‘ তোর বিয়ের এক মাসের মাথায় ধ্রুব হঠাৎ তার অফিসে আমার বিপরীতে অন্য একজন ম্যানেজার রাখে। আমি ভেবেছি, হয়তো আমার কাজের প্রেসার যাচ্ছে বলে, ধ্রুব আরেকজন ম্যানেজার নিযুক্ত করেছে। আমি ভুল ছিলাম। ধ্রুব আমার সব কাজ ওই নতুন ম্যানাজেরকে দিয়ে করাত। আমি ভাবি, হয়তো ধ্রুবর আমার কাজ পছন্দ হয়নি। আমি চাকরী ছেড়ে দেই। ধ্রুব সেদিন আমার একবারও আটকায় নি।
তারপর, বাবা মা মরার আগের দিন আমি তোকে ফোন দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, বাবা তোর কথা খুব মনে করছেন। অসুস্থ তিনি। একবার এসে দেখে যা। তুই কি বলেছিলি, তুই ব্যস্ত। আসতে পারবি না। বাবা এই মেসেজ দেখে খুব কষ্ট পেয়েছিল। তবুও হাসিমুখে সব সহ্য করে বলেছে, মেয়ে আমার স্বামীর ঘরে সুখে আছে। ওকে বিরক্ত করিস না। বাবা যেদিন মা’রা যায়, সেদিন তোকে একনজর দেখার জন্যে ছটফট করেছিল। তোকে নিজে কল করেছিল। তুই কি করলি? বাবাসহ আমাদের সবার নাম্বার ব্লক করে দিলি। বাবা মা’রা ফেলেন। মা এক বুক য’ন্ত্রণা দিয়ে বললেন, তোকে যেন তাদের কারো ম’রার খবর না দেয়া হয়। তুই তাদের ভুলে গেছিস। তারাও তোকে ভুলে যাবে। বাবা মরার শোক মা সহ্য করতে পারেনি। কিছুদিনের মধ্যে মা হার্ট অ্যাটাক করেন। মায়ের দেয়া সেই কসম মানতে তোকে জানানো হয়নি।
আয়েশী, তুই বোন নামের কলঙ্ক, মেয়ে নামের কলঙ্ক! শুধু স্ত্রীর সম্পর্কে তুই জিতে গেছিস। একজন আদর্শ স্ত্রী হিসেবে তোকে মোবারকবাদ। বাকি সম্পর্ক যেহেতু ভুলে গেছিস, সেহেতু তোর ভুলে থাকাই উত্তম। ‘

তুষার কি বলছে আয়েশী কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। সবকিছু ধোঁয়াশা লাগছে। কি হয়েছে, কোথা থেকে শুরু হয়েছে, কোথায় শেষ হয়েছে, আয়েশী কিছুই বুঝতে পারছে না। আয়েশী বলে, ‘ আমি তোমাদের ব্লক দিয়েছি? কখন? আর আমি কখনই বা বললাম, আমি ব্যাস্ত আছি, কথা বলতে পারব না? বিয়ে হওয়ার এক মাস পর তোমাদের সাথে আমার আর যোগযোগ হয়নি। আমি মৃদুলের বিষয় নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে ছিলাম যে, আমি নিজের খেয়াল অব্দি রাখতে ভুলে গিয়েছিলাম। এর পরের দুমাস আমি তোমাদের সাথে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু তারপর কি হল? আমি এ বাড়ি আসতে পারছিলাম না। ফোন করেও তোমাদের খোঁজ পাচ্ছিলাম না। সেখানে, এসব……’
তুষার রেগে উঠে। ধপ করে সোফা ছেড়ে উঠে বলে,
‘ অনেক মিথ্যা বলেছিস। এখন বের হ। তোর মুখ দেখাও আমার পাপ। আমি মায়ের কসম ভাঙতে পারব না। যে আমাদের দুঃখের সময় ছিল না, তাকে আমাদের জীবনে কোনো প্রয়োজন নেই। ‘

আয়েশীর হেলদুল হয়না। থম হয়ে সোফায় বসে থাকে। ভাবে, এসব কিছু আয়েশী করেনি। তবে কে করেছে? যে করেছে সে নিশ্চয়ই আয়েশীর আশেপাশে থাকে। আয়েশীর নিজস্ব সেলফোন ধরার সাহস বাড়িতে আর কার হতে পারে? কারো না। তাহলে কি……ধ্রুব?

তুষার এগিয়ে আসে। আয়েশীর হাত ধরে জোরপূর্বক বের করে দেয় ঘর থেকে। আয়েশী অনেক অনুরোধ করে। তুষার শুনে না। আয়েশী শেষবারের মত অনুরোধ করে,
‘ আমায় একবার মা-বাবার কবরের কাছে নিয়ে যাবে, ভাই। শুধু একবার। একবার চোখের দেখা দেখব। ‘
তুষার অনুরোধ রক্ষা করে না। আয়েশীর মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেয়। ক্লান্ত আয়েশী সিড়িতে পা ভেঙে বসে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। তার জীবনটা এমন এলোমেলো কেন হয়ে গেল? সে কি পাপ করেছিল যে আল্লাহ তাকে এতবড় শাস্তি দিচ্ছেন?
ধ্রুব! এই সব কিছু হয়েছে ধ্রুবর জন্যে। আয়েশী আজ ধ্রুবকে প্রশ্ন করবে। আজ ধ্রুবর সকল প্রশ্নের উত্তর দিতেই হবে। ধ্রুব আজ কিছুতেই আয়েশীর থেকে ছাড়া পাবে না।
_________________________________
‘ তুমি আমার ফোন থেকে বাবা মা আর ভাইয়ের নাম্বার ব্লক করেছ? ‘
ধ্রুব থমকে যায়। কফির কাপ হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ থেমে রয়। অতঃপর কাপে চুমুক দিয়ে বলে, ‘ হ্যাঁ। ‘
আয়েশী থমকে যায়। বিশ্বাস হয় না। তবে কি আরও একবার সে ধোঁকা খেতে যাচ্ছে? না, না। আয়েশী বিশ্বাস করে না। ধ্রুব এতটা খারাপ হবে না। কখনোই না। আয়েশী নিজের সন্দেহকে ধামাচাপা দিয়ে বলে, ‘ কেন করেছ এসব?’
‘ কারণ ওরা তোমায় বিরক্ত করছিল। ‘
আয়েশী অবাক হয়ে যায়। প্রশ্ন করে, ‘ বিরক্ত? ওরা আমাকে বাবা মা হয়, ধ্রুব। ‘
‘ হোক। আমি ছাড়া তোমায় বিরক্ত করার সাধ্য কারো নেই।’
‘ তুমি ছাড়া আমার মরে যাওয়ার সাধ্যও কি নেই, ধ্রুব? ‘
আয়েশীর কণ্ঠ টলমলে। ছলছল আঁখি। পলক ঝাপটালে যেকোনো মুহূর্তে টুপ করে সে আঁখিদ্বয় থেকে জল গড়াবে। ধ্রুব আয়েশীর চোখে চোখ রাখে। ভ্রু কুচকে স্বীকার করে,
‘ না, নেই। তোমার বেঁচে থাকার ক্ষণ যেমন আমি নির্ধারণ করি, তেমনি তোমার মরে যাওয়ার দিবসও হবে আমার পরিকল্পনা অনুসারে। আমার আদেশ ছাড়া তোমার মরে যাওয়ার অধিকারটুকুও নেই। ‘

আয়েশীর চোখে জল ভরে। ধ্রুব এতটা নিষ্ঠুর, তা আয়েশী পূর্বে জানে নি। কেন জানলো না? হয়তো আগে জেনে গেলে, আয়েশী কখনোই ধ্রুবকে ভালোবাসতো না। মৃদুলকে ঘৃনা করলেও না।
‘ ধ্রুব, আমাকে মুক্তি দাও! পায়ে পড়ি তোমার। তুমি যা চাইবে আমি তোমায় তাই দেবো। তার বদলে মুক্তি দাও আমায়। দয়া করো। ‘

আয়েশীর কাতর কণ্ঠের আবদার ধ্রুবর হৃদয় ছুঁতে পারল না। ধ্রুব ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। আয়েশীর দিকে ঝুঁকে এসে ঠোঁট ছোঁয়ালো আয়েশীর নাকের ডগায়। আয়েশীর কপালে কপাল ঠেকিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
‘ যা চাই তাই দেবে? মুক্তি দেবো তোমায়, তার বদলে তোলার প্রাণটা চাই আমার। দিয়ে দেবে নিজের প্রাণ আমায়? ‘

আয়েশী ভয়ে সিটিয়ে গেল দেয়ালের সাথে। বুকটা অস্বাভাবিক ভাবে লাফাচ্ছে। যার দরুন আয়েশীর বুকের ক্রমশ উঠানামা ধ্রুবের মাথায় নেশা ছড়িয়ে দিচ্ছে। ধ্রুব ঠোঁট কামড়ে হেসে উঠলো।
নেশা ছড়ানো কণ্ঠে বলে, ‘ আজ আরো একবার তোমার দেহ ছুঁয়ে মন ছুঁতে চাই। যে ছোঁয়ায় তুমি জগৎ ভুলে যাবে। শুধু আমাতেই নিজের সুখ খুঁজে নেবে। ‘
ধ্রুব আয়েশীকে কোলে তুলে নেয়। আয়েশীর হাজারবার বারন সত্বেও ধ্রুব আয়েশীর সাথে মিলিত হয়। আয়েশী শুধু চোখের জল ফেলে। ধ্রুবকে এখন একজন ধর্ষক ব্যতীত আয়েশীর আর কিছুই মনে হচ্ছে না। নিজেরে স্ত্রীর সম্মতি ব্যতীত শারিরীক সম্পর্ক স্থাপন করা, এ তো ধর্ষনের’ই এক নমুনা!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here