মেঘদিঘির পাড়ে – ১

0
1209

মেঘদিঘির পাড়ে – ১
মালিহা খান

১.
ভোরের দিকে বাড়ি ফিরল সরফরাজ। গায়ের শুভ্র পান্জাবির এখানে ওখানে লোহিত রক্তের ছিঁটা। তাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। সারারাত্রীর নিষুপ্তিহীনতা ভর করেছে টকটকে চোখে। সরফরাজ সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠে। বাড়ি নিঝঝুম।
দোতলার লম্বা বারান্দার মাঝবরাবর বিষন্নাচিত্তে দাড়িয়ে থাকা মেয়েকে দেখে ত্বরান্বিত বেগে পান্জাবির হাতা গোটায় সরফরাজ। কব্জির দিকে বেশ অনেকটা রক্ত শুকিয়ে খড়খড়ে হয়ে আছে।
ইভা বিভোর ছিলো। নিমগাছের শুদ্ধ ,অবিমিশ্র বাতাসে ভরপুর নির্জন অলিন্দ। প্রাণভরে শ্বাস নিলেই অন্তকরণের দীর্ঘ অস্হিরতায় দৈবাৎ স্হিরতা অনুভব হয়। সে চোখ বন্ধ করে ছিলো। মাথার কাপড় ঘাড়ে পড়ে রয়েছে।
সরফরাজ হাল্কা কাঁশে। ইভা চকিতে চোখ মেলে তাকাল। দু’কদম সামনে সরফরাজকে দেখে দ্রুত মাথায় কাপড় টানে। নতমুখে দাড়ায়। হাল্কা গলায় ডাকে,”ভাইজান!”
সরফরাজের শান্তি লাগে। সেই ডাকে হিস্রতা ধ্বংস্ব হয়, রক্তিম চোখ নম্য হয়। দরাজ গলার স্বর নেমে যায়,

“এই সকালে উঠেছিস যে? আযান ও তো পড়েনি।”

ইভা মৃদু গলায় উওর দেয়,”ঘুম ভেঙে গেছে ভাইজান।”বলতে বলতেই সরফরাজের গায়ে চোখ পড়ে ইভার।
রূহ কেঁপে উঠে।

-“হায় আল্লাহ! রক্ত কিসের? আপনি ঠি ক আছেন?” শান্ত, নিবৃত্ত ইভা মূহুর্তেই উত্তেজিত, আকুল হয়ে পড়ে। ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে আসে। এতক্ষনের বিষয়তৃষ্ণা শূন্য চোখদুটিতে পলকে উৎকন্ঠা ছেঁয়ে যায়। হাত দিয়ে সেই পান্জাবি স্পর্শ করতেও প্রবল হৃদকম্প টের পায়।
সরফরাজ হাসল, হাত উঠিয়ে ইভার মাথায় বুলিয়ে দেয়। আস্তে করে বলে,

-“আমার রক্ত না।”

ইভা ভয় পায়। ভয়ে তটস্থ হয়। তবে প্রকাশ করেনা। ঘাবড়ানি লুকোতে দ্রুত দৃষ্টি নত করে। নিমগাছের হাওয়া জোরে জোরে বইছে। তার ভীতি সরফরাজ বুঝতে পারে সহজেই। প্রসঙ্গ পাল্টে বলে,”তোর ভাবি ঠি ক আছে?” তার কন্ঠ এবার অতিনরম শোনায়।
ইভা একবার ভাইয়ের চোখের দিকে তাকাল। সুন্দর চোখদুটিতে কোনো ব্যস্ততা নেই, শীঘ্রতা নেই, অতল সিন্ধুর হিমঠান্ডা নীলজলের মতোন শান্ত দৃষ্টি, ভয় পাওয়ার প্রশ্নই আসেনা। ইভার ভয় কেটে যায়। সে মাথা নাড়িয়ে বলে,

-“ভাবি ঠি ক আছে ভাইজান। ঘুমাছে।”

-“রাতে তোর সাথে শুয়েছে?” কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন করে সরফরাজ।

-“না, আমি আপনাদের ঘরে যেয়ে দেখে এসেছি একটু আগে।”

ইভার উত্তরে ধাতস্থ হয় সরফরাজ। ততক্ষণে আজান পড়ে গিয়েছে। ইভাকে ঘরে যেতে বলে সামনে এগোয় সরফরাজ। পান্জাবির হাতা নেমে গেছে। রক্তের দাগ স্পষ্ট। ইভা খিঁচে চোখ বুজে ফেলে। মনে পড়ে,
তালুকদার বাড়ির ছোট ছেলে সপ্তাহখানেক আগে তার সাথে অসভ্য আচরণ করেছিলো। যেটা শুধু ভাইজান জানে।

২.
তন্দ্রার ঘুম গাঢ়। আযানের শব্দ তার কানে পৌঁছোয়নি। সরফরাজ শব্দ করেনা। তন্দ্রা তার জন্য পাশে জায়গা রেখে শুয়েছে। হায়রে!
গায়ের পান্জাবি ছাড়িয়ে, আলমিরা থেকে নতুন স্যান্ডোগেন্জি বের করে নেয়। নোংরা গায়ে তন্দ্রার কাছে যাবেনা সে। স্বল্পসময়ে গোসল সেড়ে আসে। চুল ভেজা। পানি ঝরছে। সরফরাজ ধীরগতিতে তন্দ্রার পাশে যেয়ে বসে। এতই আস্তে বসে সে শোয়ার খাটটা বিন্দুপরিমানও নড়েনা। তন্দ্রার ঘুম ভাঙেনা। সরফরাজ দু’হাতে তন্দ্রার হাত ধরে নিজের গালে চেপে রাখে অনেকক্ষণ। তারপর ডাকে,

-“তনু? এই তনু?”

আদুরে গলার ডাকে পিটপিট করে তাকাল তন্দ্রা। সামনের মানুষটাকে দেখে তার চোখের নিদ হারিয়ে যায়। সরফরাজ হাসে। এই এক রমনী, যার কাছে এলে তার সমস্ত বোধবুদ্ধি লোপ পায়, সমস্ত নির্বোধ অনুভূতির আরম্ভ হয়।
তন্দ্রার মায়াচোখে চেয়ে সরফরাজ পূর্বের ন্যায় মোলায়েম কন্ঠেই বলে,

-“আযান দিয়েছে তন্দ্রাবতী, উঠবেনা?”

তন্দ্রা চোখ বুজে, আবার খোলে। তার মুখ মলিন। বাইরে ভোরের দোয়েল ডাকছে। সরফরাজের কপালে পড়ে থাকা ভেজা চুল আঙুলের ছোঁয়ায় আঁচরে দিতে দিতে দূবর্ল গলায় আওড়ায় সে,”আপনি কখন এসেছেন?”
সরফরাজকে উওর দেয়ার সময় দেয়না তন্দ্রা, তার আগেই দূর্বলতা দমিয়ে বিরক্তিকর ঝাঁঝালো স্বরে বলে,”চুল মুছেননি কেনো? সব ভিজে যাচ্ছে। ইশ!”

-“সে এমনিই শুকিয়ে যাবে, ওঠো দেখি। সময় চলে যাচ্ছে।” সরফরাজ তাঁড়া দেয়। দু’হাতে জাপটে তন্দ্রাকে উঠিয়ে বসায়। ধরে ধরে গোসলখানায় নিয়ে ওযু করিয়ে নিয়ে আসে। মাটিতে বসে হাত- পা মুছিয়ে দেয়।বিরবির করে বলে,”তোমার পায়ে এত পানি কেনো এসেছে তনু ? এজন্যেই তো হাঁটতে কষ্ট হয়। রোববার সদরে নিয়ে যাব। ঠিকাছে?” সরফরাজ আঙুলের ডগা দিয়ে পা টিপে টিপে দেখে। তার চোখে দুশ্চিন্তা।

তন্দ্রা কপাল কুঁচকে চেয়ে থাকে। খানিকবাদে ক্লান্ত হয়ে বলে,

-“আপনি যে এসব করেন, কেউ দেখলে কি বলবে?”

-“এখানে আমি-তুমি ছাড়া আর কাওকে দেখতে পাচ্ছো তুমি?”

সরফরাজ উঠে দাড়ায়। তন্দ্রা বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে থাকে। পশ্চিমের জানালার দুয়ার মেলে দেয় সরফরাজ। বাড়ির পিছের কাঁঠালীচাপার সুঘ্রানে ঘর মৌ মৌ করে ওঠে। জানলার সামনে পাশাপাশি দু’টো জায়নামাজ বিছায় সে। একটায় তন্দ্রার চেয়ার রাখে।
তন্দ্রা মাটিতে বসে সিজদা দিতে পারেনা। সে অন্ত:সত্ত্বা। উবু হয়ে সিজদায় গেলে তলপেটে চাপ পড়ে।

নামাজ শেষ হতেই সটান হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে সরফরাজ। বাইরে সকাল হচ্ছে, অথচ তার চোখে ঘুম। সরফরাজ কপালে হাত ঠেকায়। ঘুম ঘুম গলায় বলে,

-“তন্দ্রাবতী, মাথায় বিলি কেটে দাও। ঘুমোবো।”

৩.
বিভার হাত জ্বলছে। একটু আগে শিলপাটায় একগাদা শুকনো মরিচের ভর্তা বেঁটে এসেছে সে। হাতের তালু জ্বলে ছাড়খাড়। ইভা স্টি লের ছোট্ট বোলে ঠান্ডা পানিতে ঠান্ডা দুধ মিশিয়ে নিয়ে আসে। পানিতে চারটে বরফের টুকরো ভাসছে। দরজা দিকে ঢোকামাত্র বিভা করুণ গলায় তাঁড়া দেয়,

-“তাড়াতাড়ি আননা!”

ইভা তাড়াতাড়িই এগোয়, ধপ করে বোলটা বিছানার উপর রাখে। ঝাঁড়ি মেরে বলে,”তুমি বাঁটতে গেছো কেনো? কোনো দরকার ছিল?”

-“শখে গেছি, শখ লেগেছিলো।”

-“খামোখা কাজকর্ম!”ইভার কন্ঠে রাগ ঝরে। বিভা তোয়াক্কা না করে পানিতে হাত ডুবিয়ে দেয়। কিছু সময় যেতেই একটু স্বস্তি মেলে।
উঠোনে কড়া রোদ্দুর। ইভা জানলার শিক ধরে দাড়িয়ে আছে। উঠোনে বাহাদুর ছুটোছুটি করছে। তার হাতে লাটিম। বাড়ির সবচেয়ে ছোট সদস্য। নামে বাহাদুর হলেও স্বভাবে সে মোটেও নামের মর্যাদা রাখেনি। ভীষণ ভীতু গোছের। সরফরাজ ভাইজান চোখরাঙিয়ে দু’টো ধমক লাগালেই ভয়ে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলে। কোনোকিছুতে ছাড় না পেলে দৌড়ে এসে ইভার আচঁলের পিছে লুকোয়। জানে, এখানে এলেই আর কেউ কিচ্ছুটি করতে পারবে না। সরফরাজ ভাইজানও না। ইভা হাসল। তার চোখের উপর রোদের বিচরণ। তাকাতে সমস্যা হচ্ছে। ইভা কপালের উপর হাত দিকে চোখ আড়াল করার চেষ্টা করে।
বিভা তন্ময় হয়ে দেখে বোনকে। ইভার রং ধবধবে ফর্সা, সে শ্যামলা। বাকি সব একই। একই নাক, একই চোখ, একই চেহারা। সে ইভার থেকে বড়। কতমিনিটের বড় তা অবশ্য সঠিক জানা নেই। জন্মের সময় তাকে বের করার পর ইভার মাথা নাকি মায়ের বুকের দিকে উঠে যাচ্ছিলো। ধাত্রী নিশ্চিতকন্ঠে বলেছিলো, মরা বাচ্চা হবে। সবাই বলছিলো, মরা হোক, তবু বের হোক। মায়ের অবস্থা তখন খুব খারাপ। কিন্তু না, আল্লাহর ইচ্ছায় ইভা জীবিতই হয়েছিলো।
ইভার গাল লালচে হয়ে গেছে। নাকের ডগা জমাটবাধা রক্তের ন্যায় বর্ণ।

বিভা নরম গলায় শাসন করে,

-“রোদ থেকে আয়, লাল হয়ে গেছিস। কতদিন বলেছি রোদে যাসনা, রং নষ্ট হবে।”

ইভা তাকাল, ওড়না টেনে মুখের ঘাম মুছে। জানলা থেকে সরে আসে। বিভার হাতের দিকে ইশারা করে বলে,”জ্বলন কমেছে?”

বিভা পানি থেকে হাত তুলে নেয়। দু’বার ঝাড়া দিয়ে আলগা পানি ঝরায়। ওড়নায় হাত মুছতে মুছতে বলে,”হয়েছে, নিয়ে যা।”

ইভা বাধ্য মেয়ের মতো এগিয়ে আসে। সাবধানে হাতে বাটি তুলে নেয়। চলে যাবার জন্য ফিরতেই বিভা পিছু ডাকে,

-“শোন?”

-“কি?”

-“ভাইজান কোথায়?”

-“খাচ্ছে, কেনো?”

বিভা উওর দেয়না। ইভা চলে গেলে ঝুপ করে উঠে দাড়ায় সে। চুলের খোঁপা খুলে। কোমড় ছাড়ানো ঘন মেঘের মতো ঝরঝরে চুল তার। বিভা যত্ন করে আঁচড়ায়।

ইউসুফ বুকে ভর দিয়ে ঘুমাচ্ছে। ঘরে ঝলমলে আলো। পিঠের উপর রোদ পড়েছে, ঘেমে গেছে সে। বিভা দ্রুত ঢোকে। ঢুকেই ছিঁটকিনি তুলে দেয়, দরজায় কান পেতে থাকে কতক্ষণ। কারো শব্দ শোনা যায়না। যাক! বুকের ধুকপুক কমে।
হাতে খাবারের প্লেট। প্লেটে খুদের ভাত, তিন রকমের ভর্তা। কালোজিরা, শুঁটকি, মরিচ। মরিচ ভর্তার পরিমাণ বেশি। ইউসুফের মরিচ ভর্তা খুব পছন্দ। সে জানে। জানে বলেই অতকষ্ট করে নিজহাতে বেঁটেছে। কাওকে ছুঁতে দেয়নি।
বিভা পেছনে ঘোরে। বিছানায় চোখ পড়তেই কমে যাওয়া ধরফরানি টা ধুপ করে বেড়ে যায়। হৃদ কাঁপিয়ে ধরাম ধরাম বাজ পরতে থাকে।
ইউসুফ উদোম গায়ে শুয়ে আছে। গতকাল খুব গরম পড়েছিলো। গায়ে জামা দিয়ে বেচারা ঘুমোবেও কিকরে!
ধীরপায়ে খাটের পাশে যেয়ে দাড়ায় বিভা। রোদ আড়াল হয়ে যায়। ইউসুফের পিঠে ছায়া পড়ে। বিভার ইচ্ছে হয় ওড়নার আচঁলে সেই পিঠের ঘাম মুছে দিতে। কিন্তু পারেনা। সংকোচ হয়। নিস্পৃহ চেয়ে থাকে বিভা। পুরুষ মানুষের এতো রুপ থেকে লাভ কি?
ইউসুফ হঠাৎই চোখ মেলে। অনেকক্ষন পিঠে গরম লাগছেনা। রোদের বিপরীতে পরিচিত নারীর ছায়া। চিনতে অসুবিধা হয়না। ইউসুফ উঠে বসে। একবার বিভার দিকে তাকাল, চোখে চোখ পড়ে। ইউসুফ চোখ নামিয়ে নেয়। ঘুমভাঙা জড়ানো গলায় বলে,

-“কি হয়েছে?”

বিভা চটপট হাতের প্লেটটা পাশের টেবিলে রাখতে রাখতে উওর দেয়,

-“চাচি পাঠিয়েছে, আপনার নাস্তা।”

ইউসুফ হঠাৎই বিব্রত বোধ করে। তার গায়ে শার্ট নেই। আশেপাশে শার্ট খোঁজে। পায়না। রাতে গোসল থেকে বের হয়ে আর পড়া হয়নি। দক্ষিনের জানালা দিয়ে সুন্দর বাতাস এসেছে। খালি গায়ে আরাম করে শুয়েছিলো সে। বিভা হা করে চেয়ে আছে। সে চোখ সরাতে পারেনা। ইউসুফের লজ্জা বাড়ে। বিভাকে পাশ কাটিয়ে আলমারি থেকে শার্ট বের করে দ্রুত গায়ে চড়ায়। বোতাম আটকাতে আটকাতে বলল,

-“যাও, আমি খেয়ে নিব।”

বিভা যায়না। ধুপ করে বিছানায় বসে ভারি নির্বিকার গলায় বলে,”পরে যাব।” কথাটা বলে আড়চোখে ইউসুফের দিকে তাকাল। ইউসুফের প্রতিক্রিয়া নেই। গলায় তোয়ালে ঝুলিয়ে গোসলখানায় ঢুকে গেলো সে।
বিভা ঠাঁয় বসে থাকে।
ইউসুফ বের হয়ে দেখে ঘর গোছানো, বিছানা ঝাড়া, নতুন চাদর দেয়া হয়েছে, মশারি ভাঁজ করে রাখা। যদিও টাঙানো ছিলো না। বিছানার এককোঁণে মুঁচরিয়ে রেখে দিয়েছিলো। চেয়ারের এলোমেলো কাপড়গুলো নেই। বোধহয় আলমারিতে রাখা হয়েছে। নতুন নয়, ইউসুফ অবাক হয়না। বিভা বিছানায় পা তুলে বসেছে, ইউসুফ যেখানে ঘুমিয়েছিলো।
ইউসুফ ঘড়ির দিকে তাকাল। বিভা এসেছে কুঁড়িমিনিট পার হয়ে গেছে।

-“যাওনি কেনো?”ইউসুফের ভারি গলা।

-“বললাম তো পরে যাব।”বিভা পূর্বের ন্যায় নির্বিকার।

-” ‘পরে’ হয়নি এখনো?”

-“না।”

ইউসুফ প্রত্যুত্তর করেনা। টেবিল থেকে কি একটা কাগজ তুলে নেয়। মনোযোগ দিয়ে দেখে। বিভা অধৈর্য হয়ে পড়ে,

-“খাবার খাচ্ছেন না কেনো? ঠান্ডা হচ্ছে তো।”

ইউসুফ না তাকিয়েই উওর দেয়,”পরে খাবো।”

বিভা দিরুক্তি করেনা। আস্তে আস্তে পায়ে ঝিম ধরে যায়। ইউসুফ আরো সময় কাগজ নিয়ে থাকে। তারপর উঠে যায়। প্লেট নিয়ে আবার চেয়ারে এসে বসে। বিভা বিছানা ছেড়ে দাড়াতে নেয়। বলে,

-“এখানে বসেন। ওখানে কষ্ট হবে খেতে।”

ইউসুফ মৃদুকন্ঠে তাকে থামিয়ে দেয়,”না, বসো তুমি। সমস্যা নেই।” বলতে বলতেই মুখে খাবার তুলে সে।
বেচারি বিভা উৎসুক হয়ে চেয়ে থাকে। ইউসুফ নিশব্দে খেয়ে যায়। মুখ দেখে বোঝা যায়না তার ভালো লেগেছে নাকি।
লাজলজ্জার মাথা খেয়ে বিভা-ই আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,”ভর্তা কেমন হয়েছে?”

-“ভর্তার মতোই হয়েছে।”

-“মজা হয়েছে?”

ইউসুফ একটু সময় নেয়। তারপর বলে,”মরিচেরটায় ঝাঁল বেশি।”

বিভা দপ করে নিভে,”মরিচের ভর্তা তো ঝাঁলই হবে।”

-“ঝাঁল হয় জানি। এটা বেশি ঝাঁল।”

-“আর অন্যগুলো?”

-“অন্যগুলো ঠিক আছে।”

-“শুধু মরিচের টাই খারাপ?”

-“খারাপ বলিনি, ঝাঁল বলেছি।”ইউসুফের নিচু স্বর। বিভার প্রশ্নে সে আগ্রহ দেখায় না।

বিভা ক্রুদ্ধ চোখে চেয়ে থাকে। সেই অভিমানী দৃষ্টিতে ফিরেও তাকায়না ইউসুফ। কিশোরী, আবেগী বিভা আচমকাই ফেটে পড়ে। বালিশের পাশে রাখা ইউসুফের মুঠোফোনটা নিয়ে সজোরে ছুঁড়ে মারে মেঝেতে। ডিসপ্লের কাঁচ চুরমার হয়ে ছড়িয়ে যায়, ব্যাটারী দূরে যেয়ে পড়ে।
ইউসুফ খাওয়া থামায়। শান্তচোখে পায়ের কাছে দেখে একবার। ফোনের আর কিছু বাকি নেই। বিভার রাগ কমেনা। খাটের পাশের টেবিলটার ওপর রাখা জগ থেকে গ্লাসভর্তি করে পানি ডালে সে। অত:পর গ্লাসটা নিয়ে ইউসুফের কাগজপত্রে ঠাঁসা টেবিলের উপর রেখে গম্ভীর গলায় বলে,”বেশি ঝাঁল লাগলে খেয়েননা, প্লেট রেখে দিয়েন। জমিলার মা এসে নিয়ে যাবে। আসি।” তার কন্ঠ ভারি ভার ভার শোনায়। ইউসুফ নিরবে লোকমা তোলে, ধীরগতিতে ডানপায়ের বৃদ্ধাঙ্গুল বাড়িয়ে বিভার পায়ের কাছের কাঁচের টুকরোটা নিজের দিকে নিয়ে আসে।
পেছনে ঘুরলেই মেয়েটার পায়ে বিঁধতো। বিভা তার উওরের অপেক্ষা করেনা। শেষবারের মতোন ইউসুফের মুখে অনুরাগী বেদনার দৃষ্টি বুলিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

৪.
বিকেলের দিকে শোরগোল পড়ে যায় গ্রামের শান্ত বাতাসে। মুখে মুখে কথা ঘুরে বেড়ায়, তালুকদার বাড়ির ছোট ছেলে মইদুল কে বড়দিঘির ঝোঁপের পাশে পাওয়া গেছে। মৃতপ্রায় শরীর। অবস্থা ভালো না, বাঁচবে কিনা সন্দেহ। সদরের হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছে শোনা যায়।
জমিলার মা রসিয়ে রসিয়ে ছোটচাচীকে বলে,”খালাম্মা! পোলায় মনেহয় বাঁছবোনা। তয় ভালোই হইছে। পোলার চরিত্র ভালানাতো। অসভ্যের ঘরে অসভ্য একটা। দুনিয়ায় নষ্ট। মাইয়া মানুষ দেখলেই জিভ লকলক করে। ছোট ছোট পোলাপানগুলা শান্তিতে মকতবেও যাইতে পারেনা। শালা নিমোখারাপ। কেও জানেনা মনে করছেন? এইযে অর এই অবস্তা! গেরামের প্রত্যিকটা মানুষ খুশি। বাইরে তো দেহাইবোনা কিন্তু ভিতরে ভিতরে…”

-“আহা জমিলা! যেমনই হোক, মানুষ তো। দোয়া কর যেনো বেঁচে ফিরে।”

-“ধুরো, রাখেন আফনার দোয়া! যা করছে না আপা! হাত- পা নাকি কিছু রাখে নাই। মুখ বাইড়ায় ছেইচ্চা ফেলছে। হাতের আঙ্গুলডি কাইট্টা থোয়নাই। বজ্জাত ব্যাডার এক্কেরে উচিত শাস্তি।”

-“ধ্যাত! চুপ কর।”

জমিলা মুখ বাঁকা করে। আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো, জাহানারা পুনরায় ধমক লাগান। জমিলার রাজ্যের যত অকর্মের কথা। কাজে দেরি হচ্ছে।
ইভা রান্নাঘরের দরজা ঘেঁষে চুপ করে দাড়িয়ে থাকে। তার গা শিঁউরে শিঁউরে উঠে। বাহাদুর কোথ্থেকে উদয় হয়ে ঝুপ করে হাত টেনে ধরে। ইভা চমকে যায়, মৃদু চিৎকার করে উঠে। জাহানারা ফিরে তাকান।
বাহাদুর অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে ধরে রাখা হাত নাড়িয়ে বলে,

-“কি হলো বুবু?”

ইভা বাহাদুরের মুখের দিকে তাকাল। চোরাকন্ঠে বলে,”না কিছুনা, হঠাৎ ধরলি তো।”
ইভা স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে। আদুরে হাতে বাহাদুরের ছোট্ট ছোট্ট চুল এলোমেলো করে দেয়। বাইরে সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
জাহানারা উঠে লবনগোলা পানি খাইয়ে দেয় ইভাকে। মনে মনে দোয়া পড়ে সারাগায়ে ফুঁ দিয়ে দেয়। স্নেহের গলায় বলে,”দিনদুপুরে ভয় পায় কেও! যা, বৌমার কাছে যা। গল্প কর গিয়ে, ভালো লাগবে। বিভা কোথায়?”

-“আপা তো সেই যে দুপুরে শুলো, আর দরজা খোলেনি।”

-“আচ্ছা, ও ঘুমাক। তোরাই যা।”

বাহাদুর ইভার হাত ধরে রেখেছে। তার বুবুর হাতগুলো তুলোর মতোন নরম। শক্ত করে ধরলে মনেহয় হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো মিঁইয়ে যাবে। বাহাদুরের মনে ভয় হয়। সে কক্ষণো বুবুর হাত চাপ দিয়ে ধরেনা। যদি বুবু ব্যাথা পায়? যদি সত্যিই হাত মিঁইয়ে যায়?
আজগুবি চিন্তা ভাবতে ভাবতেই পা ফসকে যায় বাহাদুরের। ইভা তাড়াহুড়ো করে সামলায়।

-“আস্তে! সিঁড়ি দেখে উঠ। চোখ কই থাকে?”

বাহাদুর হাসলো। একটুপর বললো,
-মেঘদিঘীতে কি সুন্দর শাপলা ফুটেছে বুবু। গায়ে বেগুনী রং। আজ তো যেতে পারলাম না, ওদিকে বেজায় ভীড়। কাল তোমাকে নিয়ে যাবো, আচ্ছা?”

মেঘদিঘীর নাম শুনে খুশি হবার বদলে আজ শরীরে গা কাঁটা দেয় ইভার। গলা শুকিয়ে আসে। বাহাদুর আবার প্রশ্ন করে। এবার হেসে ফেলে ইভা। বাহাদুরের মাথায় আলতো চাঁটি মেরে বলে,

-“এ্যাই অসভ্য! তুই আমাকে নিয়ে যাস নাকি আমি তোকে নিয়ে যাই?”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here