মেঘদিঘির পাড়ে – ১৪,১৫

0
529

মেঘদিঘির পাড়ে – ১৪,১৫
মালিহা খান
পার্ট-১৪
২৯.
ভাতের প্লেট নিয়ে ঘরে এসে বিছানা খালি পেলো ইভা। বাথরুম থেকে ঝপাঝপ পানি ঢালার শব্দ আসছে। সুইচবোর্ড হাতরে আঁধারঘরের আলো জ্বালিয়ে দেয় ইভা। ঘড়িতে সময় দেখে। এগারোটা পঁচিশ। এই রাতেরবেলা, তারউপর ট্যাংকির হিমঠান্ডা পানি। হায় আল্লাহ! আপার যে কবে সুবুদ্ধি হবে।
ঘরের লাইট জ্বলতেই পানির শব্দ একটু থেমে যায়, ভেতর থেকে প্রতিধ্বনির মতো বিভার কন্ঠ ভেসে আসে,

-“খাবার রেখে যা। আমি বেরিয়ে খেয়ে নিব।”

ইভা সামান্য উচুকন্ঠে পাল্টা আওয়াজ দেয়,”আচ্ছা।”

আর কিছু শোনা যায়না। ঝরাঝপ পানি ঢালার শব্দে আবারো ছমছম করে উঠে নিরব কক্ষ। আংশিক কথা পালন করে ইভা। খাবারটা টেবিলে রাখে ঠি ক তবে চলে যায়না। টেবিলের ড্রয়েরটা কিন্চিৎ ফাঁক হয়ে আছে। ইভা হাতে ঠেলে আটকাতে যেয়েও আবার খুলে। লাইটের আলোয় এককোণায় যত্নে রেখে দেয়া স্টি লের ছোট বাক্সটা চকচক করে ওঠে। ইভা ঠোঁট প্রসারিত করে হাসে। পাশের জিনিসগুলো সরিয়ে বাক্সটা বের করে। ঢাকনা খুলে।
ভেতরে একটা বোতাম। সাধারণ বোতাম। গাঢ় নীল রঙ। অন্ধকারে কালোই মনে হচ্ছে। বোতামটা ইউসুফ ভাইয়ের শার্টের। ছিঁড়ে পড়ে গিয়েছিলো। বছরদেড়েক আগে একদিন সকালে নাস্তার টেবিলে ইউসুফের চেয়ারের নিচে পেয়েছিলো বিভা। ফেলেনি, ফেরতও দেয়নি। নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। ইউসুফ ভাই রাতে ফিরে জমিলার মাকে জিজ্ঞেস করেছে,”খালা? আপনি বাড়ি ঝাড়ু দেবার সময় কোনো বোতাম পেয়েছেন? এইযে শার্টের রংয়ের। নতুন পড়লাম মাত্র। মাঝখানের বোতামটা কোথায় যেনো ছিঁড়ে পড়ে গিয়েছে। মাঝের বোতাম না থাকলে শার্ট পরা যায় বলেন?”

জমিলার মা খোঁজ দিতে পারেনি। দিবে কি করে!

ইভা ঢাকনা আটকে রাখে। বাক্সটা জায়গামতো রেখে ড্রয়ের লাগিয়ে দিতেই দরজা খোলার শব্দ হয়।
বিভা বের হলো। তোয়ালে হাতে। চুলের আগা থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। ইভাকে দেখে বলে,

-“যাসনি কেনো? বাহাদুর একা না ঘরে?

ইভা পেছনে ফিরে। বিভা ভেজা তোয়ালে চেয়ারে মেলছে। প্রশ্নের উওর না দিয়ে সে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে,

-“এতোরাতে গোসল করলে কেনো আপা?”

-“মাথা ধরেছিলো। পানি ঢালায় একটু কমেছে।”

-“মাথা কেনো ধরেছিলো?”

-“মাথা ধরতে পারেনা? এমনেই পাগল।”

বিভা হেসে মাথায় বোনের হাল্কা চাপড় মেরে প্লেট হাতে বসে যায়। প্রথম লোকমা তুলতেই ইভা অতিশয় নরম গলায় শুধালো,

-“তুমি কান্না করেছো, তাইনা আপা?”

বিভা খেতে খেতেই হাসলো। চট করে খাবার গিলে বললো,”ধুর!”

-” ‘ধুর’ না আপা। সত্যি বলো। আমি না তোমার জমজ বোন?”

বিভা আবার হাসে। মুখ তুলে বলে,

-“কাঁদলে কি? কাঁদা অপরাধ নাকি?”

-“তুমিতো অকারণে কাঁদো।”

-“কাঁদার কোনো কারণ লাগেনা। কান্না এসেছে। ব্যস! কেঁদে দিবি। অতো কারণ খুঁজতে গেলে পরে আর কান্নাটাই হবেনা। তাই বলে আবার যার তার কাঁদবিনা। কাঁদলেই মানুষ পেয়ে বসে। একা একা কাঁদবি।”

-“ইউসুফ ভাইতো কাঁদছেনা। উনি তো দিব্যি হেসে খেলে বেরাচ্ছে। নিয়ম করে খাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে। আর তুমি কেঁদেকেটে মাথা ব্যাথা করছো। কেনো?”

-“শোন, ভালোবাসা তিন প্রকার। পাওয়া, না পাওয়া, একপাক্ষিক। যারা পেয়ে যায় তারাতো পেয়েই গেলো। আর যারা না পেলো তারা পেলোনা। কিন্তু দুজন দুজনকে ভালোবাসতো ঠি ক। যতকষ্ট এই একপাক্ষিকেই। এটায় এক আছে না পাওয়ার কষ্ট, দুই আছে যাকে পাবোনা তার ভালোবাসা না পাওয়ার কষ্ট। খালি কষ্ট, কষ্ট আর কষ্ট। পৃথিবীটা কষ্টে ভরে গেছে। বুঝলি? কেউ ভালো না। সব স্বার্থপর।”

ইভা মুখ ফসকে তীব্র প্রতিবাদ করে ফেলে,”ভালোবাসা অপ্রকাশিতও হয় আপা।”

বিভা চমকে তাকায়। পরমূহুর্তেই হো হো করে হেসে ফেলে। কোনরকমে বলে,”ইভারে খাবার সময় হাসাসনা বোন। গলায় আটকাবে।”

-“তো তুমি আর ভালোবেসোনা। তাহলেই তো হয়। একটুতো বুঝো।”

-“দেখ, ভালোবাসা জিনিসটাইতো অবুঝ! অত বোঝাপড়া চলে আসলে ওটাকে তখন আর ভালোবাসা বলা যায়না। ভালোবাসা হবে নিঝুম বিলে ফোঁটা একলা নীলপদ্মটার মতোন, ভালোবাসা হবে কাঁক ডাকা ভোরে ঝরে পড়া শিউলিটার মতোন। এদের কোনো বুঝ থাকে না, এদের যখন ফোঁটার কথা, এরা ফোঁটে যায়, এদের যখন ঝরার কথা, এরা ঝরে যায়।
এইযে যেই লোকটা তোকে বিয়ে করতে চাইছে। তাকেই দেখ। একবার এমনে সেমনে মানা করে দিয়েছে।তবু হাল ছাড়েনি। গা ছাড়া ভাব দেখায়নি। কোন অদূর শহরের হয়েও তোকে কিরকম ভাবে চেয়ে ফেলেছে। ভাইজানের সাথে কথা হয়েছে শুনলাম। উনি তোকে বিয়ে করেই ছাড়বে। আমার ধারণা, ভাইজানও বোধহয় আর না করবেন না।”

ইভা ভূত দেখার মতোন চমকে উঠে বলে,”ভাইজানের সাথে কথা হয়েছে মানে? কবে? আমাকে কেউ বলেনি কেনো?”

-“তোকে তো কেউ বিয়ের ব্যাপারেও কিছু বলেনি। তোকে বলে কি হবে? ভাইজান যদি এক্ষুনি কাজি নিয়ে এসে বলে উমুককে কবুল বল। তুই কি মানা করবি? তক্ষুনি মাথা দুলিয়ে তিনকবুল বলে দিবি। একটা টু শব্দও তো করবিনা। তুই ভাইজানের কথার কেমন বাধ্য সবাই জানে।”

ইভা দিরুক্তি করেনা। বিভার চোখগুলো টকটকে হয়ে আছে। সে চিন্তিতস্বরে বলে,

-“এখনো মাথাব্যাথা করছে তোমার?”

-“না না। এখন নেই। তুই ঘরে যা। আমার খেতে সময় লাগবে। বাহাদুর একা ঘুমাবেনা। রাত হয়েছে। ওকে ঘুম পাড়িয়ে দে।”

-“প্লেট রেখে দিও। বাহাদুরকে শুয়ে পড়লে এসে নিয়ে যাবো।”

বাহাদুরকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে ঘড়িতে একটার কাঁটা পেরিয়ে যায়। সে গভীর ঘুমে বিভোর হয়ে পড়লে আস্তেধীরে বিছানা থেকে উঠে যায় ইভা। বিভার ঘরে যায় যখন বিভা তখন ঘুম। গলা পর্যন্ত কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। প্লেটটা টেবিলেই রাখা। ইভা প্লেট নেয়। আবার কি যেনো ভেবে বিভার দিকে ঝুঁকে চুলে হাত রাখে। শুকিয়েছে কিনা? নাকি ভেজা চুলেই শুয়ে পড়েছে এই দু:খময়ী।
না! চুল শুকনো। ইভার খটকা লাগে হঠাৎ। শরীরটা কেমন গরম গরম লাগছেনা? নরমহাতে কপাল ছুঁয়ে দেখে। জ্বর এসেছে হাল্কা। বিভা তার উপস্থিতি টের পায়। জড়ানো গলায় বলে,

-“প্লেট রেখে দিয়েছি। নিয়ে যা।”

-“ও আপা? জ্বর উঠেছেতো। ডাকোনি কেনো?”

বিভা পাশ ফিরে শোয়। ঘুমে নিভে আসা স্বরে বলে,”জ্বর না। এমনেই গা গরম, একটুপর সেরে যাবে। দেরি করে গোসল করেছিতো। চিন্তা করিস না।”

-“ওষুধ খেয়েছো?”

-“লাগবেনা।”

ইভা ড্রয়ের খুলে ওষুধ খুঁজে। এখানে নাপা থাকে সবসময়। মাথাব্যাথা হলে খায় বিভা। আজ নেই কেনো? সে প্রশ্ন করার আগেই বিভা উওর দিয়ে দেয়,

-“নাপা শেষ ইভা। পাবিনা। ঘুমোতে যা। আমি ঠি ক আছি।”

ইভা কথা শোনেনা। তার ঘরে নাপা নেই। চাচীর কাছে সবসময় সব ওষুধ থাকে। সে তড়িৎগতিতে ঘর থেকে বেরিয়ে জাহানারা কে ডাকতে যায়। সরফরাজ, ইউসুফ এই রাতের বেলাতে ড্রইংরুমে হাল্কা আলো জ্বালিয়ে কি যেনো কথা বলছিলো। দোতালায় ইভাকে হন্তদন্ত দৌড়াতে দেখে সরফরাজ ডাক দেয়। জানতে পারে, বিভার জ্বরের কথা। ইউসুফও শোনে। ভেতরে উথালপাথাল লাগলেও বাইরে একেবারেই স্হির সে।

বিভা খাটের মাঝবরাবর সোজা শুয়ে আছে। বা’হাতটা ওপাশে মেলে রাখা। চোখ এই বুজছে, এই খুলছে। ইউসুফ একহাঁটু খাটে রেখে ঝুঁকে, হাতের উল্টোপিঠে বিভার গাল ছুঁয়ে দেয়। উষ্ণতা মেপে দেখে। তার স্পর্শ টের পেতেই মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে কাত করে ফেলে বিভা। ইউসুফ আবার হাত ছোঁয়ায়। গলার পাশে, কপালে। বিভা কাঠ হয়ে চোখ খুলে ওদিকে চেয়ে থাকে। আর কোথায় মাথা সরাবে? গাল লেগে গেছে বালিশের সাথে।
ইউসুফ সোজা হয়ে দাড়ায়। শান্ত গলায় বলে,

-“জ্বর বেশি নেই আম্মা। একটা প্যারাসিটামল খাইয়ে দাও। ঘন্টার মধ্যই নেমে যাবে।”

সরফরাজ মাঝ থেকে বলে,”নামবে তো? নয়তো ডাক্তার ডেকে আনি? চোখগুলো কেমন লাল হয়ে আছে।”

-“আরে না না। আরামে নেমে যাবে। সামান্য জ্বর। দেখি ইভা, ওষুধের পাতাটা দে।”

বিভা মনে মনে হাসে। মনে মনেই স্বগতোক্তি করে বলে,”আপনিতো পারলে বলে দেন আমার জ্বরই নেই। এই উষ্ণতা, টকটকে চোখ সবই মিথ্যে। নাটক করছি। বলছেন না কেনো?”
ওষুধ খেয়ে বিভা নিজ থেকেই বলে,”তুমি যাও চাচী। ভাইজান আপনিও যান, ভাবিকে একা রেখে এসেছেন। ইভা থাকুক। এতেই হবে। জ্বর তো নেমেই গেছে। ঘুমাবো।”

জাহানারা সম্মতি জানায়। সরফরাজও মানা করেনা। ঘুমাতে বলে। ইউসুফ ইভাকে নিচু গলায় বলে,

-“বাহাদুরকে আমার কাছে নিয়ে যাচ্ছি। তুই থাক ওর সাথে।”

৩০.
নীলাভ বাতি জ্বালানো ঘরের দরজা খুলে যায় নিশব্দে। ইভা তখনো প্রায় সজাগ। বিছানার পিছে পিঠ ঠেকিয়ে আধশোয়া হয়ে আছে। বিভা বা’কাত হয়ে ঘুমাচ্ছে। একটা হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে ইভা। ইউসুফের উপস্থিতিতে চমকায় না ইভা। একটু নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসে মাত্র। ইউসুফ অত্যন্ত ক্ষীণ গলায় বলে,

-“ঘুমিয়ে আছে?”

-“হু।”

-“একদম ঘুম? জাগবেনাতো?”

-“উহু।”

ইউসুফ নিশ্চিত হয়। ধীরগতিতে বিছানায় বসে। আলতো করে বিভার মাথায় হাত রাখে। বলে,

-“জ্বর নেমেছে?”

-“সামান্যই তো, নামবেনা কেনো?”

ইভার খোঁচাটা সহজেই ধরতে পারে ইউসুফ। কিছু বলেনা। বিভার জ্বর সামান্য ছিলোনা। সে জানে। খানিকক্ষণ বিভার চুলে হাত বুলায় সে। অত:পর কৃষ্ণকন্যার শুকনো, জ্বরে জর্জরিত, প্রণয়ে পিপাসিত মুখখানার দিকে নিমগ্ন চেয়ে থেকে মৃদুকন্ঠে বলে,”ইভা বাইরে যাতো একটু।”

ইভার লজ্জা লাগে খুব। বিভার হাতটা ছাড়িয়ে সে নিরবে প্রস্হান করে। বাইরে থেকে দরজা ভিড়িয়ে দেয়। ইউসুফ না বেরোনো পর্যন্ত তার ঢোকা নিষেধ।
নিভৃত, একান্ত প্রহরে নিজ কৃষ্ণকন্যার ঘুমন্ত মুখপানে চেয়েই সময় কাটে ইউসুফের। এলোকেশে হাত বুলাতে বুলাতে সে নিষ্প্রাণ হয়ে বলে,

-“বিচ্ছেদ যেখানে নিশ্চিত, সেখানে এক হয়ে কি হবে বলোতো?”

চলবে

মেঘদিঘির পাড়ে – ১৫
মালিহা খান

খোলা জানালার পাল্লায় ভারি বাতাস আঘাত করলো। বিকট আওয়াজটা নির্জন নিশীথে বজ্রপাতের মতোন শোনালো।
বিভার গাঢ় তন্দ্রা বিঘ্নিত হয়। বিকেলের নরম হাওয়ার সান্নিধ্যে এলে তিরতির করে কেঁপে ওঠা কিশলয়ের মতোন মৃদু নড়েচড়ে ওঠে সে। ইউসুফ চকিতে মাথা থেকে হাত উঠিয়ে নেয়।
নিজেরমেলে রাখা হাতটা গুঁটিয়ে গালের নিচে দিয়ে ফের ঘুমিয়ে যায় বিভা।
নিশ্চল রাত। অন্তকরণে টুকরো কয়েক মুগ্ধতা কুঁড়িয়ে উঠে পড়লো ইউসুফ। জানলা আটকে দিলো। বেরিয়ে যাবার আগে আরেকবার এলো বিভার কাছে। বিভা অনবরত ঠোঁট নাড়াচ্ছে। আমতা আমতা করছে। স্বপ্নে কিছু খাচ্ছে হয়তো। ইউসুফের ইচ্ছে হয় একটুখানি আঙুল ছুঁইয়ে ঠোঁটের কম্প স্হির করে দেয়। ইচ্ছের কেবল ইচ্ছেতেই মৃত্যু ঘটে।
ইউসুফ মনে মনে আওড়ায়,”গুচ্ছ গুচ্ছ সাদা গোলাপেরও ক্ষমতা নেই এই একটা কালোগোলাপের সৌন্দর্যের টক্কর দেয়ার।”
পরপরই বিরবির করে বলে,
-“আমি তোমাকে সব বলে দিবো বিভারানী। সব বলে দিবো। আর কষ্ট দিবোনা। এইযে কথা দিচ্ছি।”

কথা দিতে বিভার মাথার থেকে সামান্য উপরে হাত রাখে ইউসুফ। চুল স্পর্শ করেনা। পাছে বিভা চোখ মেলে ফেলে! তার ভয় হয়। খুব ভয়। বুক ঠাসা প্রণয় প্রকাশে তার মতোন ভয় বোধহয় আর কোনো প্রেমিক পায়নি।

৩১.
বাহাদুরকে কোলের উপর বসিয়ে রুটি ভাজি খাইয়ে দিচ্ছিলো ইভা। বাচ্চাটা সকালের নাস্তা করতেই চায়না। স্কুলে যাবে। খালিপেটে গেলে হয়? কতগুলো ঘন্টা।
ভাবতে ভাবতেই আবার তার মুখে রুটি তুলে দিলো ইভা। মুখভর্তি খাবার চিবোতে চিবোতে বাহাদুর কাতর হয়ে বললো,

-“বুবু, আর খাবোনা। হলোতো। এই দেখো। কতবড় পেট হয়ে গেছে। তনা ভাবির থেকেও বড়।” বেচারা তন্দ্রার নাম উচ্চারণ করতে পারেনা। তাই সামান্য সহজ করে তনা ডাকে।

ইভা মনে মনে ফিক করে হেসে ফেললেও বাইরে জোরালো গলায় বলে,”পুরোটা খাওয়া অবধি তোর নিস্তার নেই বাহাদুর। ভাইজান কিন্তু পিছেই বসে আছে। জলদি চিবা।”

বাহাদুর ভয় পেয়ে তাকায়। ডাইনিং টেবিলে তারা যে পাশে বসেছে তার ঠি ক পিছনেই সোফায় বসে কাঁচের টেবিলভর্তি কাগজপত্র ঘাটছে সরফরাজ। বাবা, চাচা, ইউসুফ ভাইও আছে। কিসব গম্ভীর কথাবার্তা চলছে কখন থেকে।
বাহাদুর কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে,

-“বুবু! তুমিও আমাকে ভয় দেখাচ্ছো?”

ইভা অনড় হয়ে বলে,”মুখ খোল দুষ্ট। কেঁদেকেটে লাভ নেই।”

বাইরে বিচ্ছিরি রোদ উঠেছে। রান্নাঘরের ভ্যাপসা গরমে তন্দ্রার ঘেমে উঠা সবুজ ব্লাউজের দিকে বারবার কড়া চোখে তাকাচ্ছে সরফরাজ। আবার চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। হাতের কাগজে চোখ বুলাচ্ছে। বাবার কথায় মনোযোগ দিচ্ছে। আবার দু’তিনসেকেন্ড যেতেই আড়চোখে তাকাচ্ছে রান্নাঘরে এদিকে পিঠ দিয়ে গাঢ় বেগুনি শাড়ি পড়ে দাড়িয়ে থাকা তন্দ্রার দিকে। মেয়েটাকে সে হাজারবার বলেছে টইটই করতে না। ন’মাস চলছে। এখন একটু সাবধানে থাকো। ঘরে থাকো। এই গলাফাঁটা গরমে ওর কি দরকার রান্নাঘরে যাবার? ও কি রান্না করবে? চাচি তো কিছু ধরতেও দিচ্ছেনা। ওর দরকার টা কি দাড়িয়ে দাড়িয়ে রান্না দেখার? যদি মাথা ঘুরে যায়? যদি ক্লান্ত হয়ে সিঁড়ি বাইতে যেয়ে পা পিছলে যায়?
তন্দ্রা একবারো এদিকে তাকাচ্ছেনা। সরফরাজ মনে মনে ঝাঁঝিয়ে ওঠে। তাকাবেনা তো। জানে তাকালেই তার সাথে চোখাচোখি হয়ে যাবে। চোখে চোখে একটা কড়া ধমক দিলেই সুড়সুড় করে ঘরে যেতে বাধ্য।
আরেকবার তাকাতেই জাহানারার দেখে ফেলেন। সরফরাজ দ্রুত মুখ ফিরিয়ে নেয়। জাহানারা মৃদুস্বরে করে তন্দ্রাকে বলেন,

-“তন্দ্রা, ছেলেটা রাগ করবে। উপরে যাও না মা। ঘরে গিয়ে ফ্যানের নিচে বসো গিয়ে। তোমারও তো কষ্ট হচ্ছে। কেমন ঘেমে গেছো দেখেছো একবার?”

তন্দ্রা প্রতিবাদ করে বলে,

-“সারাদিন ঘরে বসে থাকতে আমার ভালোলাগেনা চাচি। আমিতো কাজ করছিনা। চুপ করে দাড়িয়ে আছি শুধু।”

তন্দ্রা মুখে হাসি নিয়ে চুপটি করে থাকে। জাহানারা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে চুপ হয়ে যান। কিছুক্ষণ যেতেই বেখেয়ালিতে একবার ওদিকে তাকিয়ে ফেলে তন্দ্রা। সরফরাজের সাথে চোখাচোখি হয়ে যায়। সরফরাজ চোখ বড় বড়করে করে তাকে উপরে যাবার নির্দেশ দেয়। তন্দ্রা শোনেনা। বরং মৃদুগতিতে এদিক ওদিক মাথা নাড়িয়ে বোঝায়,”আমি যাবোনা।”

বাহাদুরের খাওয়া শেষ তাকে নামাতে নামাতেই এই সুন্দর দৃশ্য চোখে ধরা দেয় ইভার। ভাইজান আর যাই করুক। তন্দ্রা ভাবির কথা এলেই একদম নরম হয়ে যান। তার কঠিন ভাব হাওয়ায় উবে যায়।

তন্দ্রা মুখ ফিরিয়ে আবার এদিকে পিঠ দিয়ে দাড়িয়েছে। মেয়েটা এতো অবাধ্য। সরফরাজ হাঁক ছাড়ে,”ইভা?”

ইভা কাছে যায়। সরফরাজ হাতের ইশারায় কাছে ঝুঁকতে বলে তাকে। ইভা ঝুঁকে। সরফরাজ হিমঠান্ডা গলায় ফিসফিস করে বলে,

-“তোর ভাবিকে যেয়ে বল, ভাইজান এক্ষুনি ঘরে যেতে বলেছে। এক্ষুনি মানে এক্ষুনি।”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here