মেঘদিঘির পাড়ে – ১৬,১৭

0
503

মেঘদিঘির পাড়ে – ১৬,১৭
মালিহা খান
পার্ট-১৬
৩২.
বিভাসিত নীলিমা ম্লান হয়েছে অনেকক্ষণ। ঘন তমসাচ্ছন্ন ঘুটঘুটে রুপ ছেঁয়ে আছে সর্বত্র। মোমবাতির নিভু নিভু শিখাটা হাতের আড়াল করে ধীরলয়ে এগিয়ে চলেছে বিভা। সন্ধ্যার পর থেকেই বাইরে ঝড়ো বাতাস বইছে। অথচ ঝড় নামার নামগন্ধ নেই। খুব সম্ভবত কোথাও তুমুল বৃষ্টিপাত হচ্ছে সেই আভাসই একটু আধটু এদিকে আসছে।
বাতাসটা হঠাৎ একটু বেশিই তেজী হলো বোধহয়। শিরশিরে ঝাপটায় এঁকেবেঁকে কাঁপতে থাকা আগুনটা একেবারেই নিভিয়ে এলো এবার। বিভা তাড়াহুড়ো করে হাত দিয়ে গড়া ছাউনিটা উত্তপ্ত অনলের খুব কাছে এনে নিলো। হাল্কা একটু আঁচ লাগলো তালুতে। তবে আগুনটা নিভলোনা, হুরহুর করে পূর্বের ন্যায় জ্বলে উঠলো।
বাড়ির বিশাল সিঁড়ির মাঝখানে দাড়িয়ে আছে সে। বাতাসটা আসছে খোলা বারান্দা থেকে। বিদ্যুৎ চলে গিয়েছে। এমন দূর্বল বিদ্যুৎ এই গ্রামে। বৃষ্টি হলেতো কথাই নেই, বৃষ্টির আগের বাতাস শুরু হলেই আর আলোর দেখা পাওয়া যায়না। ক’দিন আগে তো শুরু হয়েছিলো আরেক জ্বালা। রোজ নিয়ম করে সন্ধ্যার আগে আগে চলে যেতো। দু’তিনঘন্টা টানা থাকতো না। এখন অবশ্য ঠি ক হয়েছে।
বিভা উপরে উঠে আসে। বারান্দার রেলিং ঘেঁষে ইভা দাড়িয়ে আছে। মেয়েটা যে কোন আনন্দ পায় এই একলাএকা বারান্দায় দাড়িয়ে থাকতে! বিভার বুঝে আসেনা। তার বোনটা আপাগমস্তক তার বিপরীত। আচার আচরণে সামান্যতম মিলটিও নেই। বিভা হতাশা নিয়ে দু’পাশে মাথা দুলিয়ে ডানদিকে পা বাড়ায়। উদ্দেশ্য ইউসুফের ঘর। ইউসুফ মোমবাতি চেয়েছে। ভাবি, মা, ছোটচাচি রান্নাঘরে ছিলো। বাইরে শীত শীত লাগছিলো তাই সেও যেয়ে দাড়িয়ে ছিলো ভেতরে। চুলার আগুনেই সব দেখা যায় তাই কৃত্রিম আলোর দরকার পড়েনি। ইউসুফ চেঁচালো উপর থেকে,”আম্মা? মোমবাতি দিয়ে যাও আমার ঘরে।”
ছোটচাচি তাড়াতাড়ি মোমবাতি জ্বালিয়ে তার হাতে দিয়ে বললো,”মা, একটু দিয়ে আয় তো তাড়াতাড়ি। রাগের তো মতিগতি নেই ওর।”
চার্জার লাইট আছে, ফোন আছে। তার কি দরকার মোমবাতির? বিভা মনে মনে শাসিয়ে উঠে।
তবে মা, ভাবির সামনে ছোটচাচীর কথা ফেলতে পারেনা। মানা করলে কি উওর দিবে?

ইউসুফের দরজার কাছে দাড়িয়েও রাজ্যেসম দ্বিধায় কুঁকরিয়ে গেলো বিভা। শেষমেষ নিজের সাথে যুদ্ধ করে আঙুলের টোঁকা দিয়ে আবছা কন্ঠে বলে,

-“আসতে পারি?”

বিভার কন্ঠ কানে যেতেই ইউসুফ চকিতে ঘাড় ফেরালো। চেয়ারে বসা ছিলো সে। টেবিলে কাগজপত্র ছড়ানো। মোমবাতির অপেক্ষাই করছিলো।
বিভার গায়ে কালো রংয়ের জামা। একপাশে লম্বা বিনুনি। গলায় জর্জেটের ওরনা। কাঁধের ছেড়ে দেয়া অংশটা অনবরত উড়ছে। আগুনের তপ্ত আভায় নতমুখটা কি অন্যরকম দেখাচ্ছে।
বিভা কখনো অনুমতি চায়না তারকাছে। আজ চাইলো কেনো?
ইউসুফ উওর দেয়,”আসো।”

বিভা কেমন করে যেনো আসে। শব্দ হয়না। এদিক ওদিক চেয়ে মিহি স্বরে বলে,

-“চাচি দিয়ে যেতে বললো। কোথায় রাখবো?”

ইউসুফ ব্যাথিত হয়। এই নির্লিপ্ত স্বভাব সে মেনে নিতে পারছেনা। ঘরে মোমবাতির আলো ছড়িয়ে পড়েছে।
দোদুল্যমান টি মটিমে তপ্তকিরণে ইউসুফ অদৃশ্য দেয়ালের গাঢ়ছায়া দেখতে পায়। বিভা একবারো মুখ তুলেনি। তার চোখে তাকায়নি। নিষ্টুরতার মৌন জবাব দিচ্ছে নাকি? কাল যখন গাল- কপাল ছুঁয়ে জ্বর মাপলো, তখনো কি অসন্তুষ্টি ছিলো মুখে।

টেবিলের রাখা কাগজগুলোর উপর হাতের আঘাতে শব্দ তুলে ইউসুফ ছোট্ট করে বলে,”এখানে রাখো।”

বিভা এগিয়ে আসে। টেবিলের উপর ছড়ানো ছিঁটানো কাগজপত্রে চেয়ে ইততস্ত কন্ঠে বলে,”এগুলো..”

ইউসুফ ভরাট গলায় শুধায়,”সরিয়ে নাও।”

বিভা হাল্কাহাতে কাগজ গুছিয়ে পাশে সরিয়ে রাখে। মোমবাতিটা রাখছে মাত্র, ইউসুফ জ্বলজ্বলে অগ্নিশিখায় চোখ রেখে ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করে,
-“অনুমতি চাইলে যে?”

-“জি?”বিভা বুঝে উঠতে পারেনা।

-“আসার জন্য অনুমতি চাইলে কেনো বিভা?”

বিভা নির্বিকার হয়ে উওর দেয়,
-“না চাওয়াটাই অস্বাভাবিক না? একজনের ঘরে ঢুকছি অনুমতি নিয়েই তো ঢুকবো।”তার কন্ঠে অনুভূতির রেশ নেই। উচ্ছলতা নেই।

ইউসুফ অবাক হয়ে বিভার মুখের দিকে তাকায়। হাল্কা একটু চোখাচোখি হয়। বিভা দৃষ্টি লুকিয়ে নিতেই ইউসুফ বিস্মিত হয়ে বলে,
-“আমি তোমার কাছে ‘একজন’?”

বিভা উওর দেয়না। মোমটা রেখেই চলে দ্রুত যাবার জন্য উদ্যত হয়। ইউসুফ আকস্মিক এক অদ্ভুত কাজ করে বসে। খপ করে বিভার হাত চেপে ধরে। টানটান গলায় বলে,”বলে যাও।”

বিভা স্তব্ধ হয়ে যায়। সেই সংক্ষিপ্ত স্পর্শে, পুরুষালী ভারি কন্ঠে। বিভা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে। ইউসুফ ছাড়েনা। জোর করে ধরে রাখে। বিভা পারেনা ছাড়াতে। ইউসুফ গমগমে কন্ঠে বলে,

-“উওর দাও। যখন ছাড়ার আমি ছেড়ে দিবো।”

বিভার চোয়াল ভারি হয়ে আছে। কন্ঠ ধরে আসে। ক্ষিপ্ত হয়ে বলে,
-“আমিতো আসিনা আর। বিরক্ত করিনা আপনাকে। ঝামেলা করিনা। রাতবিরাতে সমস্যা করিনা। পাগলামি করিনা। কিচ্ছু করিনা। আপনার সামনেও আসিনা। তাও কেনো এসব প্রশ্ন করছেন?”

-“শান্ত হও।”

বিভা বিশাল বিশাল শ্বাস ফেলে শান্ত হয়। কিছুসময় কেটে যায় সেভাবেই। মোমবাতিটা গলে গলে পড়ছে। কতকগুলো চুঁইয়ে পড়তে পড়তেই জমে যাচ্ছে। বিভা ধীর গলায় বলে,”হাতটা কেনো ধরে রেখেছেন?”

ইউসুফ ছেড়ে দেয়। বলে,”যাও।”

বিভা চলে যায়। ইউসুফ হাসে। খানিকবাদে জলন্ত শিখায় তর্জনী চেপে নিভিয়ে দেয় মোমটা। অন্ধকারেই স্বস্তি!

৩৩.
সকাল সকাল সরফরাজ আসে ইভার ঘরে। ইভা তখন বিছানা ঝাড়ছে। চোখমুখ ফোলা ফোলা। বেচারী মাত্র উঠেছে ঘুম থেকে। ভাইজানকে দেখে হাত থেকে ঝাড়ু নামিয়ে রাখে জলদি। নম্রস্বরে বলে,”বসেন ভাইজান। কিছু বলবেন?”

সরফরাজ বসে। ইভাকে তার পাশে বসার ইশারা দেয়। ইভা বসতে বসতে বলে,”কিছু হয়েছে ভাইজান?”

-“বিকেলে তোকে দেখতে আসবে। ঠিক দেখতে আসবে বলা যায়না। সেদিনও এসেছিলো। জানিস তো? আজকে উনারাই আংটি পরিয়ে যাবেন। বিয়ের তারিখ ঠিক হয়নি। ছেলেকে তো তুই দেখেছিস। উনারা ভালো মানুষ। আমি যা খোঁজ নিয়েছি, কিছু খারাপ মনে হয়নি। তবু তুই ছেলের সাথে আলাদা কথা বলতে চাইলে আমি তখন বলে দিবো।”

ইভা কিৎকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে চেয়ে থাকে। উনি এতো জলদি রাজি করিয়ে ফেললো ভাইজানকে? কিভাবে? জাদু জানে নাকি?
সে লজ্জায় দ্রুত দু’পাশে মাথা নাড়ায়। সরফরাজ বুঝতে পারে সে আলাদা কথা বলতে চায়না। তার বোনটা এতো স্বল্পভাষী। মাঝেমধ্য মনেহয় মেয়েটার বোধহয় কথা বলতে কষ্ট হয়।
সরফরাজ হাসল। ইভার মাথায় হাত রেখে বলল,

-“তোর কোনো আপত্তি আছে? থাকলে শুধু বল। আমি এখনি মানা করে দিবো। তোকে দ্বিতীয়বার এই ব্যাপারে কিছু বলবেনা কেউ।”

ইভা মৃদুগতিতে এদিক ওদিক মাথা দুলিয়ে বলে,
-“আপনি যা বলবেন ভাইজান। আমার আপত্তি নেই।”

বিকেলের দিকে সায়নরা আসে। ইভা নামে তারা আসার আধঘন্টা বাদে। পরণে পরিপাটি থ্রিপিস। সাধারণ করে বাঁধা চুল। মাথায় ঘোমটা। মুখে প্রসাধনী নেই। যা আছে তা নামমাত্র। সে নামলে তেমন কোনো কথা হয়না। লিথিশা বিশাল এক হাসি দিয়ে শুধু বলে,”ওকে আর কি দেখবো। দেখেছিই তো। আংটিটা পড়িয়ে দিক তবে?

সবাই সম্মতি দিলে স্বলজ্জায় সামান্য দুরত্ব নিয়ে সায়নের পাশে বসে ইভা। পাশ থেকে সায়ন ফিসফিস করে বলে,
-“তোমার ভাই যে কি! ব্যাটা কাল বলছে আজ প্রস্তুতি নিয়ে আসতে। আরে তোমার আঙুলের মাপই তো আমি জানিনা। হাতই তো ধরলামনা। মধ্যরাতে এলেও তো সমস্যা করে ব্যাটা। আংটি কিনবো কোথ্থেকে? তারউপর আমি ছিলাম ঢাকায়। বিয়ের আগেই এমন হয়রানি করাচ্ছে। বিয়ের পর তো আল্লাহ জানে! ব্যাটার নির্ঘাত ছিঁট আছে ইভা। ট্রিটমেন্ট দরকার।।”

ইভা সেদিনের মতোই বড় বড় করে তাকায়। মিনমিন করে বলে,
-“ভাইজানকে নিয়ে উল্টোপাল্টা বলবেন না।”

চলবে

মেঘদিঘির পাড়ে – ১৭
মালিহা খান

৩৪.
আচ্ছন্ন বিকেল। সূর্যের তেজী আলোও মোলায়েম হয়ে আসে এসময়টায়। ক্রমে ক্রমে সন্ধ্যা নামার ঘ্রান তীব্রতা পায়। একটাসময় হারিয়ে যায় বিকেল। সূর্যের কঠিনতা নমনীয়তায় ডুবতে ডুবতে শেষমেষ অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। অথচ লালচে সুন্দরী আকাশটায় তখন গোটা একটা দিনের স্মৃতি। একটা দিন!
ইটরঙা সিঁড়ি ঘাটে বসে থাকা যুবতীর শুভ্র ওড়নার আচঁলে কতকগুলো সাদা নয়নতারা ঠাঁই পেয়েছে। নিজের দীর্ঘ বিঁনুনির ভাঁজে ভাঁজে সেই নয়নতারাদের গেঁথে দিতেই খুব মগ্ন হয়ে রয়েছে যুবতী। নিশব্দ পাড় ঘিরে রাখা সবুজ গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে একটু পর পর চড়ুই পাখির কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে বা কাঁকের দলের একটু পরপর ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাওয়া, নরম বাতাসে দুলে ওঠা গাছের পাতা।
তার ঠি ক পাশেই সামান্য দুরত্বে ধবধবে শার্ট গায়ের চোখা নজরের পুরুষটি একাগ্র নয়নে তাকেই দেখে চলেছে কখন থেকে। দৈবাৎ হাওয়া ওড়নায় আচঁল উড়িয়ে দিলো। নয়নতারারা গিয়ে ভেসে গেলো দিঘির জলে। মগ্ন যুবতী চকিতে ধ্যান ভাঙলো। অস্ফুটস্বরে ‘আ..আ…’ করতে করতে কোনরকম হাতের থাবায় দু’টো ফুল বাঁচাতে পারলো সে। শান্তনিরব নিশ্চুপ হয়ে ফুলদুটো গেঁথে নিলো বিঁনুনির শেষপ্রান্তে।
এরপর পাশে বসা পুরুষটির দিকে চেয়ে মিষ্টি কন্ঠে বললো,”

-“কেমন লাগছে?” কি রিনরিনে কন্ঠ। প্রিয়র চোখে একটু প্রশংসা শোনার অভিপ্রায়ে কাতর হচ্ছে গোপনে।

সায়নের তন্ময় মুখের অভিব্যক্তি পরিবর্তন হলোনা বিন্দুমাত্র। সে চেয়ে রইলো, যেভাবে সে চেয়ে ছিলো এতক্ষণ, অনেকক্ষণ। যেনো কতদিন দেখেনি। কতকাল, কতমূহুর্ত, কতদিবস।
তখন ঝুঁকে যাওয়ায় ইভার সামনের কাঁটা চুল কানের পিছ থেকে খুলে গেছে। সায়ন হাত বারিয়ে পালকের চেয়েও নরম স্পর্শে চুলগুলো জায়গামতো গুঁজে দিতে দিতে বললো,

-“বলতে পারবোনা, তুমি লজ্জা পাবে।”

ইভা বহুকষ্টে যতটুকু লজ্জা চেপে প্রশ্ন করেছিলো, বিধ্বংসী উওরে তাও আর দীর্ঘস্হায়ী হলোনা। চোখের পলক বারবার পড়লো। মসৃন গাল অদ্ভুত লাজুকতায় ভরে উঠলো। সায়ন চুল গুঁজেই হাত সরিয়ে নিলো। দিঘির জলে চাইলো। বর্ষা শেষ। শাপলাও নেই। সচ্ছ পানি।
আংটি পরানোর মাস পেরিয়েছে। ইভার পরিবার আদরের মেয়ের বিয়েটা তারা অতো সাদামাটা করে দিতে চান না। আরো প্রায় দু’সপ্তাহ পর নির্ধারণ হয়েছে বিয়ের তারিখ। সেই অপেক্ষাতেই কাটছিলো দিন। কাজের চাপে তারও অবসর হয়না গ্রামে আসার। তবু সে যে আসেনি এমন না! মেয়েটাকে যে কবে একবারে নিজের কাছে নিয়ে যাবে। কবে?
সে একা মানুষ। মা, বাবাহীন জীবন। ছোট থেকে একাকীত্ব চিরসঙ্গী হলেও আজকাল কেবল সেই অভ্যস্ত জীবন থেকে অন্যভস্ত হতে ইচ্ছে করে।
সায়ন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর হঠাৎই নিজের বা’হাতের তালু মেলে ধরে অদ্ভুত নরম স্বরে বলল,

-“তোমার হাতটা দাও..”

ইভা প্রশ্নচোখে তাকায়। সায়নের মেলে রাখা হাতের দিকে একবার দেখে আবার সায়নের মুখের দিকে তাকালো। হাতের উপর সময়মতো হাতটা না পেয়ে সহসাই ভ্রু কুঁচকালো সে। হাল্কা স্বরেই খানিক জোর দিয়ে বললো,”দাও?”

-“কেনো?”

-“দাওনা।”

অধৈর্য শোনায় সায়নের কন্ঠ। উপেক্ষা করবার মতন আবদার নয়। ইভা এদিক ওদিক তাকায়। যদিও এদিকে কেউ আসবেনা। এই ঝোপজঙ্গলের দিকে কেউ আসেনা। তারউপর সন্ধ্যা নামবে একটুপর। গ্রামের ভৌতিক বিশ্বাসগুলোর জন্য হলেও এদিকে কেও পা মাড়াবেনা। লাজুকগোছে সে হাত এগিয়ে দেয়।

-“কেউ দেখলে?”

নিজের পুরুষালি রুক্ষ হাতের মধ্যে পেলব হাতটা জড়িয়ে নিতে নিতে সায়ন বললো,

-“কে দেখবে? তোমার ভাই না বাড়িতে নেই? সে ছাড়া আর কেও সমস্যা করতে আসবেনা। নিশ্চিত থাকো।”

ইভার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেলো। আঙুলের ভাঁজে আঙুল ডুবিয়ে হাতের পিঠে মাথা ঝুঁকিয়ে নিজের কপাল ঠেকালো সায়ন। কি উষ্ণতায় ভরা শীতল স্পর্শ। কন্ঠ দিয়ে শব্দ বেরোতে চায়না। তবু একটু স্বাভাবিক হবার জন্য কোনরকমে উচ্চারণ করলো,

-“আপনি সারাক্ষণ ভাইজানের সাথে লেগে থাকেন কেনো?”

সায়ন তাকায়না। ক্ষীণ, জড়ানো কন্ঠে উওর দেয়,
-“আমি না, তোমার ভাইজান লেগে থাকে।”

ইভা আর টু’শব্দটি করলো না। সূর্যের আলো বেশ ঢলে পড়লো। হলদে আভা ক্রমশ লালচে হয়ে উঠলো।মাথা ঝুঁকিয়ে হাতে কি আদরে কপাল ঠেকিয়ে রাখা সায়নের দিকে নরম চোখে চেয়ে রইলো ইভা। প্রচন্ড লজ্জায় হাত পা কাঁটা দিয়ে উঠলেও সে একবারের জন্যও হাত ছাড়তে বললোনা।
সেভাবে কতোসময় কাটলো জানেনা সায়ন। যখন সম্ভিৎ ফিরলো তখন বেশ অবাক হয়ে বললো,

-“তোমার দেখি পশম দাড়িয়ে গেছে। ভয় পাচ্ছো? আমি হাত ধরেছি বলে?”

ইভা লজ্জায় মাথা নামিয়ে নেয়। মিনমিন করে বলে,”না..নাহ্।”

সায়ন কি যেনো দেখে তার লাজুক মুখে। অত:পর খুব ধীরগতিতে হাতটা ঠোঁটের কাছে নিয়ে যেতেই চমকে তাকায় ইভা। সায়ন এক ভ্রু উঁচিয়ে গাঢ় কন্ঠে বলে,

-“দিবো?”

ইভা আৎকে উঠে। প্রায় চিৎকার করে উঠে,”না..নাহ্।”

সায়ন সরবে হেসে ফেললো।

-“আস্তে! মজা করছিলাম। শান্ত হও।”

রসিকতা বুঝে ফেলতেই ভ্রু কুঁচকিয়ে দিঘির জলে দৃষ্টি আটকায় ইভা। বিশাল সূর্যটা বোধহয় দিঘিতেই ডুবে যাচ্ছে। একটু একটু করে প্রায়ান্ধকার হয়ে আসছে আশপাশ। ইভা জলে ডুবিয়ে রাখা পা নাড়িয়ে মোহাচ্ছন্ন বলে,

-“মেঘদিঘিকে দেখুন, ও এতে সুন্দর কেনো? আকাশ এতো সুন্দর কেনো?”

-“কিহ্? কি বললে?”

সায়নের তাড়াহুড়োর প্রশ্নে তাল কেটে যায় ইভার। ঘাড় বাঁকিয়ে শূন্য কন্ঠে বলে ,”কি বললাম?”

সায়ন আবার প্রশ্ন ছুঁড়ে?
-“কি যেনো নাম বললে?”

-“মেঘদিঘি।”

-“মেঘদিঘি? এটার নাম? শুনিনি তো।”

ইভা ঈষৎ জড়োসড়ো হয়ে উওর দেয়,”আমি রেখেছি।”

-“তাই নাকি?”

-“হু।”

সায়ন কথা বাড়ায়না। সূর্য ডোবার আগমূহুর্তের অদ্ভুত সুন্দর আলোটা ছেঁয়ে আছে ইভার গায়ে। মুখের একপাশে। সায়ন মন ভরে দেখছিলো। ইভা হঠাৎ বলে,”বাড়ি ফিরতে হবে, আম্মা চিন্তা করবে।”কন্ঠে জড়তা। সায়নকে হাত ছেড়ে দেবার ইঙ্গিত। সায়ন হাত ছাড়েনা। ফিসফিসালো কন্ঠে বলে,

-“এই আলোর কি নাম জানো?”

ইভা একপলক তাকায় সায়নের দিকে। চোখে চোখ পড়ে যায়। সায়ন অন্যকন্ঠে বলে,

-“জানোনা?”

ভীষণ লজ্জায় জর্জরিত হয়ে ইভা বলে,
-“কনে দেখা আলো।”

ওপাশ থেকে উওর আসে,
-“তবে দেখতে দাও। তাড়া কিসের!”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here