মেঘদিঘির পাড়ে – ১৮,১৯

0
537

মেঘদিঘির পাড়ে – ১৮,১৯
মালিহা খান
পার্ট-১৮
প্রকান্ড সূর্যটা মেঘদিঘির অতলেই ডুব দিচ্ছে বোধহলো। অর্ধ অস্তয়মান চিত্রভানুর টলমলে জলচ্ছবিতে চোখ রেখেই ইভা বুঝতে পারলো পাশ থেকে একটা প্রবল দৃষ্টি চূড়ান্ত পর্যায়ের স্হির হয়ে তার গা ছুঁয়ে আছে। একবারেই নিরিবিলি থমকানো বাতাসটায়ও ইভা শিরশিরিয়ে উঠলো। গায়ের লোমগুলো এমনভাবে কাঁটা দিলো যেনো আচম্বিতে আশপাশটায় মাঘের শীত পড়ে গেছে। দিঘির ঠান্ডা জলে গোড়ালির উপর অবধি ডুবানো পা দু’টো চটপট উঠিয়ে নিলো সে। সামনেই ভেসে থাকা সাদা নয়নতারার দু’তিনটে ছেঁড়া পাপড়িও লেগে আছে ভেজা পায়ে লেপ্টে।

-“বাড়ি যাবো।”

ক্ষীন অস্প্রাণ মেয়েলি স্বরে পলক পড়ে গেলো ঘনিয়ে আসা চোখে। গহীন আঁকুতি। জানে, অপরপাশের মানুষটা তাকে অগ্রাহ্য করতে পারবেনা। তার সামান্য কথারও পাহাড়সম মূল্য আছে তার কাছে। সায়ন ছোট্ট করে বলে,

-“যেতেই হবে?”

ইভা অনতিবিলম্বে উপরনিচে মাথা নাড়ায়। উওর ‘হ্যাঁ’। মাথা দুলিয়ে বলে,”আসার আগে আম্মা বলে দিয়েছে,”সন্ধ্যার আগে আগে চলে আসবি। ওসময় খারাপ জিনিস থাকে।”
সায়ন সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকে আসে তার দিকে। ভ্রু উঁচিয়ে বলে,”তাই নাকি?”

-“হু।”

ইভা উঠে দাড়ায়। ঢিলে বেণি থেকে গুটিকয়েক ফুল খুলে পড়ে যায় পায়ের কাছে। সে তুমুল অসন্তুষ্টি নিয়ে তাকায়। আশেপাশের গাছগুলো থেকে শুকনো পাতা ঝড়েছে। জোর বাতাসের দুলুনি দিলেই ছোট ছোট প্রপর্ণে সিঁড়ি ভরে যায়। নিজের জামা ওড়না ঝেঁড়ে একবার সায়নের দিকে তাকায় ইভা। শার্টের গুটানো হাতার মোটা ভাঁজে একটা পাতা আটকে আছে। গলার কলারের কাছে দু’টো পাতা। কি ভেবে হাত বাড়িয়ে সেগুলোও সরিয়ে দেয় সে। সায়ন অবাক হয়। একটা তুলতুলে নরম হাসি অচিরেই দৃশ্যমান হয়ে উঠে পুরু ঠোঁট ঘেঁষে।

-“হাসছেন কেনো?”ইভা চোখ ছোট ছোট করে তাকায়।

-“হুম? কই না তো। আসো।”

এড়িয়ে যায় সায়ন। সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে উঠতে বলে,
-“আচ্ছা মনে করো, এইযে আমি তোমাকে নিয়ে উঠছি। হাত ধরে রেখেছি। উঠে হঠাৎই দেখলে তোমার হাতটা আর কেও ধরে নেই। ঘাড় ফিরিয়ে দেখলে পাশে আমিটাও নেই। সামনে আমার গাড়িটাও নেই। এখানে আসলে আমি আসিইনি। ঝুমঝুমে অন্ধকারে তুমি তুমি একা দাড়িয়ে আছো। একদম একা…

একটা পাংশুটে রক্তশূন্য চেহারা আশা করেছিলো সায়ন। তাকে পুরোপুরি নিরাশ করে হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করে ইভা বললো,
-“ধুর! আমি ভূতে ভয় পাই না।”

প্রথম সিঁড়ির এককোণায় পাশাপাশি দু’জোড়া জুতা রাখা। নোংরা জুতো নিয়ে সিঁড়ি নোংরা করা ইভার পছন্দ না। বিধায় সে জুতো খুলে খালি পায়ে বসে। ইভার জুতোগুলো খুলে রাখা দেখে সায়ন নিজেও জুতো খুলেই রেখেই পাশে গিয়ে বসেছিলো।
দু’ফিতের স্যান্ডেলটা পায়ে গলিয়ে নিতে নিতেই ইভা টের পেলো ইতিমধ্যেই গা ছমছমে একটা পরিবেশ নেমে এসেছে চারপাশে। বিশাল গাছগুলো ভয়ংকর দানবের মতোন ঘিরে ধরেছে দুজনকে। আধারিয়া সন্ধ্যা নেমে এসেছে। ইভার হঠাৎই কি যেনো হলো। বুকটা ভারভার লাগলো। কন্ঠনালি শুকিয়ে চৌচির। ওইযে সেদিন।
মইদুল ছেলেটা যেদিন তাকে আটকেছিলো। সেদিনও এমন সন্ধ্যা ছিলো। ঘুটঘুটে আঁধার। তার ফিরতে দেরি হয়েছিলো। বহুদিন আগের কুচকুচে স্বৃতিগুলো আবারো তরতাজা হয়ে ভেসে উঠলো যেনো।

উবু হয়ে জুতোর ফিতে বাঁধছিলো সায়ন। ইভাকে তখনো পাশে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বললো,”তুমি যাও, আমি আছি এখানে। যাও।”

ইভা যায়না। সায়নের পাশ ঘেঁষে দাড়িয়ে থাকে। সায়ন ফিঁতে বেঁধে উঠে দাড়ায়। অদ্ভুত কোমল গলায় বলে,”কি হয়েছে? কিছু বলবে?”

ইভা মিনমিন করে বলে,
-“দরজা পর্যন্ত দিয়ে আসেন। ভয় করছে।”

-“তুমি না ভয় পাও না?”

-“ভূতের ভয় না।” তারপরই একটু চুপ থেকে থেমে থেমে বলে,”আপনি দিয়ে আসেন, আমি একা যাবোনা।”

সায়ন দিরুক্তি করেনা। ঠোঁটের হাসি আগেই নিভে গেছে তার। উপরন্ত ইভা কি কারণে ভয় পাচ্ছে এবং কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভয় পাচ্ছে তাও তার অজানা নয়।
ছোট্ট করে বলে,”আচ্ছা আচ্ছা, আসো। দিয়ে আসছি।”
বলে ছেড়ে দেয়া হাতটা আবারো মুঠোয় টানতে যেয়েই টের পায় তার আগেই কখন যেনো খুব ভরসায় নিজের ছোট্ট মুঠো দিয়ে তার কড়াপড়া আঙুলগুলো আঁকড়ে ধরেছে ইভা।

৩৫.
আগুনের রংটা নীল। টিমটিম করে জ্বলতে থাকা আঁচটা ধুম করে বাড়িয়ে দিলো বিভা। আগুনের নীল রংটা থেকে হলুদ হয়ে গেলো চোখের পলকে। বিভা একমনে হাসলো। পানির পাতিলটা চড়িয়ে দিয়ে অপেক্ষা করলো পাঁচমিনিট।
ঘড়ির কাঁটা বলছে এখন রাত। ক্লান্ত শরীরে বাসায় ঢুকে ইউসুফের চোখজোড়া প্রথমেই যেয়ে আটকালো রান্নাঘরের উল্টোদিকে ফিরে দাড়িয়ে থাকা মেয়েটার দিকে, পিঠে আধখোলা হয়ে থাকা বিশাল খোঁপাটায়। একমূহুর্ত নিরব থেকে ফাঁকা হলরুমটায় চোখ বুলালো ইউসুফ। এদিক ওদিক কাওকে দেখতে না পেয়ে নিশব্দ পা দুটো এগিয়ে গেলো রান্নাঘরের দিকে।
বিভার পিছে যেয়ে দাড়ালো যখন মেয়েটা তখন অবধিও পায়নি। কেবল হাতটা চুলের দিকে বাড়িয়ে দিতেই চকিতে ঘাড় ফিরালো বিভা।
ইউসুফকে বিন্দুমাত্র বিচলিত দেখালো না। হাতের আলগা ছোঁয়ায় অলকবন্ধন মুক্ত হয়ে গেছে ততক্ষণে। রেশমের মতন ছড়িয়ে পড়েছে।
আচমকা এতো নিকটে ইউসুফকে দেখতে হাতে পায়ে খিল ধরে গেলো বিভার। বোকাভম্বের মতোন তব্দা খেয়ে দাড়িয়ে রইলো সে। তার প্রতিক্রিয়াকে বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় ইউসুফ বললো,

-“পানি দিওতো। ঠান্ডা। দু’তিনটে বরফ দিয়ে।”

বিভার হুঁশ ফিরে। এককদম পিছিয়ে যেয়ে আমতাআমতা করে বলে,

-“আপনার না কাঁশি হয়েছে? ঠান্ডা পানি খাবেন কেনো?”

ইউসুফ উওর দিলোনা। চায়ের পাতির কৌটোটা নেড়েচেড়ে একবার ফুটন্ত পানিটায় চোখ রাখলো। অত:পর কৌটোটা সামান্য শব্দ করে রেখে পূর্বের চেয়ে নিচু গলায় বললো,”ঘরে দিয়ে যাবে।”

বিভা প্রত্যুওর করতে পারেনা। রান্নাঘরের দরজায় বাহাদুরের কন্ঠে সন্তর্পণে কাছ থেকে সরে দাড়ায় ইউসুফ। হাতের ইশারায় বাহাদুরকে ডেকে দু’হাতে কোলে তুলে নিতে নিতে বলে,”তাড়াতাড়ি…”বলে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির কাছাকাছি আসতেই শুনতে পায় জাহানারার শাসনভরা কন্ঠ,”তুই আবার চা করতে এলি কেনো? এমনেই একটা ব্যাথা পেয়েছিস পায়ে। জমিলার মাকে ডেকে বললেই তো চা করে দিতো।”

ওপাশের উওরটা আর কর্ণগোচর হলোনা ইউসুফের।

বিভা যখন ঢুকলো, ক্লান্ত ইউসুফ তখন ফ্যানের নিচে বসে শার্টের বোতাম ছাড়াচ্ছে। বিভা যেতেই হাত বাড়িয়ে দিলো সে। গরম পানিভর্তি গ্লাসটা বেশ নির্বিকার গোছেই এগিয়ে রাখা হাতটায় ধরিয়ে দিলো বিভা। ইউসুফ ভ্রু কুঁচকালো একঝলক। গ্লাসে চুমুক দিয়ে গরম পানিটা গলা দিয়ে নামিয়ে বেশ ঠান্ডাস্বরে বললো,” তোমাকে না বললাম ঠান্ডা পানি দিতে।”

-“দিবোনা, এটাই খান।”

ইউসুফ দিরুক্তি করলোনা। ঢকঢক করে পানিটা শেষ করে খালি গ্লাসটা বিছানার উপর রাখলো। অথচ বিভা তখন হাত এগিয়ে রেখেছে গ্লাসটার জন্য। ইউসুফের উদ্ভট কাজে চোখেমুখে অসহ্য প্রশ্ন নিয়ে তাকালো বিভা।চোখ দিয়েই গিলে ফেলবে যেনো। ইউসুফ শার্টের বোতামে হাত দিলো। তার রাগত চোখের মধ্য দৃষ্টি রেখেই দু’টো বোতাম খুলে ফেললো।
তপ্ত শ্বাস ফেলে পাশ থেকে গ্লাসটা নেয়ার জন্য ঝুঁকে যেতেই একহাতে গ্লাসটা ধরে ফেললো ইউসুফ। বিভা ঝড়ের বেগে ধমকে উঠে বললো,”কি সমস্যা আপনার?”

-“ব্যাথা পেয়েছো শুনলাম। কিভাবে?”

বিভা চোখ সরিয়ে নেয়। উওর দেয়,”ঠিক আছি আমি। গ্লাস ছাড়ুন।”

ইউসুফ আরো জোরে চেপে ধরলো গ্লাসটা। বিভা ভ্রু কুঁচকে সোজা হয়ে দাড়ালো। দাঁত কেলিয়ে বললো,

-“দেয়া লাগবেনা, নিজেই রেখে এসেন। কেমন?”

বলে সে চলেই যাচ্ছিলো। ইউসুফ একটানে বিছানায় বসিয়ে দিলে আর যাওনা হলোনা। তালটা ঠিক সামলাতে পারলোনা বিভা। চরম আশ্চর্য হয়ে বললো,”কি হয়েছে?”
ইউসুফ ততক্ষণে বসে পড়েছে তার পায়ের কাছে। পাগুলো কোলের উপর তুলে নিতে নিতে বললো,
-“কোথায় লেগেছে? কোন পায়ে?”

বিভা তুরান্বিত গতিতে পা’দুটো তুলে নেয় বিছানায়। হতভম্ব হয়ে বলে,
-“পাগল হয়েছেন? হাঁটুতে কেটেছে।”

ইউসুফ দুই ভ্রু উঁচায়। চূড়ান্ত বিস্ময় নিয়ে বলে,”কেটেছে!”

বিভা চোখমুখ কুঁচকে তাকায়। অপ্রস্তুত হয়ে বলে,

-“ধুরো, সরুন আপনি।”

-“কিভাবে কাটলো?”

-“পড়ে গিয়েছিলাম।”

-“কোথায় পড়ে গিয়েছিলে?”

এ পর্যায়ে এসে হঠাৎই কেমন নিশ্চুপ হয়ে যায় বিভা। ইউসুফের কাঠকাঠ চোখদুটোয় দিকে চেয়ে মিনমিন করে প্রশ্ন করে,
-“আমার এমন কেনো মনেহয় আপনি আমাকে ভালোবাসেন?”

চলবে

মেঘদিঘির পাড়ে – ১৯
মালিহা খান

ইউসুফ হাসলো। স্মিত হাসি। বিভার মিনমিন করে করা প্রলয়ংকর প্রশ্নটা যে বেশ একটা ঝড় তুলে দিলো, বাহিরে তার লেশমাত্র প্রকাশ পেলো না। জবাবে প্রতীক্ষারত অঙ্গনাকে প্রতিক্ষায় রেখেই উঠে দাড়ালো সে। বিষন্নার মতোন চেয়ে থাকা চোখদুটোকে বেমালুম উপেক্ষা করার মতো ক্ষমতা নেই, তবু করতে হয়। করে যেতে হয়..হচ্ছে।
ধৈর্য্যর পারদমিটারটা যেনো কাঁচফেটে চৌঁচির হয়ে গেলো মূহুর্তেই। খপ করে ইউসুফের কবজির কাছে প্রচন্ড শক্ত করে টেনে ধরলো বিভা। শেষ শ্রাবণের ঘনকালো মেঘটার মতোন অভিমানিনী স্বরে বললো,

-“আপনি উওর দিবেন না?”
নিজের উপর নিয়ন্ত্রনহীন সে বরাবরই। রাগের বসে, ছেলেমানুষী করে কখন কি পাগলামি করে নিজেও জানেনা। আর এই পুরুষের উপর তো আজন্মের আক্রোশ।
অথচ তার দ্বারা কৃত সকল ঝড় যে এই মানুষটা মাথা পেতে সয়ে নেয় সেটাই কেবল চোখের আড়াল হয়ে যায় সবসময়। কেবল মানুষটার নির্লিপ্ততাই দেখে গেলো বোকা মেয়েটা। এই নির্লিপ্ততার পিছনে লুকিয়ে থাকা অগাধ প্রশ্রয় টা দেখতে পেলোনা। কখনোই..।

নখগুলো খুব সম্ভবত মাংস ভেদ করে ঢুকে যাচ্ছে। ইউসুফের ঠিক তেমনটাই মনে হলো। একটা একান্ত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খানিকটা নরম গলায় সে বললো,

-“সারাক্ষণ এসব ঘুরে কেনো মাথায়?”

-“আপনার কি? আমার মাথা। আমি ঘুরাই। আপনার কি?” রাগে থিঁতিয়ে উঠলো বিভা। হাতের চাপ প্রবল হলো। তার ছেলেমানুষী উওরটায় আবারো হেসে ফেললো ইউসুফ। একবার হাতের দিকে তাকালো। চটচটে রন্জিত তরল পদার্থটা বেরিয়ে এসেছে। বললো,

-“নখে ব্যাথা পাবে বিভা। ভেঙে যাবে। ছেড়ে দাও।”

-“হোক, ভাঙুক, ছাড়বোনা।” ব্যস! হাতের দিকে ফিরেও তাকালোনা বিভা। চোখদুটো কি লাল হয়ে গেছে মেয়েটার। গলা দিয়ে নেমে যাওয়া শুকনো ঢোক গুলোও নজর এড়ায়না। কান্না আটকানোর প্রচেষ্টা। চোখের টা নাহয় পারছে, মনেরটা?
ক্লান্ত ইউসুফ আবার বসে পড়লো হাঁটু গেড়ে। এর কাছে তার কন্ঠটাও উঠেনা। তুলোর মতোন নরম হয়ে যায়। এতো চায়। তবু একটু ধমকাতে পারেনা।

-“জেদ করেনা? ছেড়ে দাও?”কি অদ্ভুত নরম পুরুষালী স্বর।
বিভা গোল গোল করে তাকালো। ভ্রু জোড়া সামান্য কুঁচকালো। হাতের বাঁধন আলগা হয়ে আসতেই ঠোঁটের কোঁণ প্রসারিত করে হাসলো ইউসুফ। আস্তেধীরে হাতটা ছাড়িয়ে নিলো।
বিভা বারদুয়েক পলক ফেললো। পুতুলের মতোন ঠেকলো ইউসুফের কাছে। বললো,

-“সবসময় এতো জেদ করো কেনো?”

-“আপনার সাথেই তো করি। আর কারো সাথে তো করিনা। এতেও আপনার সমস্যা?”

ইউসুফ হাঁফ ছাড়ে। উঠে যেতে যেতে বিরবির করে বলে,”সমস্যা নেই। কোনো সমস্যা নেই।”
আর মনে মনে বলে,
-“তোমার প্রদর্পণেই আমার সমর্পণ।”

৩৬.
গ্রামে শীত পড়ে গেছে। অক্টোবরের শুরু কেবল। তবু শেষরাতের দিকে মোটা কাঁথার নিচেও ঠান্ডায় শরীর জমে হিম হয়ে যায়।
বরফের মতোন পা দু’টো সুঁড়সুঁড় করে কাঁথার ভেতর গুঁটিয়ে নিলো তন্দ্রা। আধঘুম চোখদুটো কোনরকমে মেললো। সরফরাজ সোজা হয়ে ঘুমিয়ে আছে। একহাত কপালে উঠানো, আরেকহাতে সে ঘুমিয়েছে। একেতো রক্তজমানো ঠান্ডা। তারউপর কোথ্থেকে যেনো দমকা বাতাস এসে ঘর ছেঁয়ে গেলো। তন্দ্রা হুরহুর করে কেঁপে ওঠে। উওরের জানলাটা বোধহয় খোলা। নিশ্চিত উনি খুলেছে। ঘাড় ফিরিয়ে দেখার নূন্যতম শক্তিটাও পেলোনা সে। নড়েচড়ে সরফরাজে দিকে চেপে আসলো। একহাত উদোম বুকের উপর রাখলো। উষ্ণ বুকটাও কি ঠান্ডা হয়ে আছে!
অস্ফুট স্বর শোনা গেলো সাথেসাথেই,

-“তন্দ্রাবতী? নড়ছো কেনো?”

তন্দ্রা ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই অভিযোগ ছুঁড়ে,
-“শীত করছে। আপনি আমাকে ধরে ঘুমান না কেনো?”

সরফরাজ চোখ মেলে। কপাল থেকে হাতটা সরিয়ে তন্দ্রার গায়ের কাঁথাটা গলা পর্যন্ত টেনে দেয়। কিভাবে জড়িয়ে ধরবে সে মেয়েটাকে? পেটে চাপ লাগবেনা? বুঝতে চায়না।
তার কাছে লেপ্টে থেকেও তন্দ্রার দাঁত কাঁপছে। কিড়কিড় শব্দ হচ্ছে। সরফরাজ বুক থেকে তন্দ্রার হাতটা সরিয়ে দেয়। মাথার নিচ থেকে নিজের হাতের বদলে বালিশ টেনে দিয়ে উঠে বসে। তন্দ্রা শিশুসুলভ কন্ঠে বুলি ছাড়ে,

-“কই যান?”

-“জানলাটা বন্ধ করে দিয়ে আসি। শীত কম লাগবে।”

জানলা বন্ধ করে দিয়ে আলমারি খোলে সরফরাজ। দেখেশুনে আরেকটা কাঁথা বের করে। বেশ ভারি দেখে।আসার আগে ধীরগতিতে চলতে থাকা ফ্যানটাও বন্ধ করে দেয়। ঘরটা নীরব হয়ে যায়। নিশ্বাসের শব্দও প্রতিধ্বনির মতো শোনায়।
তন্দ্রার গায়ের পাতলা কাঁথাটা সরিয়ে হাতের কাঁথাটা দু’ পাল্লা করে ছোট্ট শরীরটার উপর দিয়ে দেয় সে। তারউপর আবার পাতলা কাঁথাটা দিয়ে কপালে হাত রেখে বলে,

-“এখনো শীত করছে তনু?”

-“উহু। শুতে আসেন।”

সরফরাজ নির্ভার শ্বাস ছাড়ে। কাঁথাটা আরেকটু টেনেটুনে তন্দ্রার পেছনে যেয়ে শুতেই তন্দ্রা যারপরনাই অবাক হয়ে বলে,”পেছনে যেয়ে শুচ্ছেন কেনো? এপাশে আসেন।”
সরফরাজ কাঁথার নিচে ঢুকে যায়। তন্দ্রাকে কাছে টেনে পিঠটা চওড়া বুকের সাথে ঠেকিয়ে নিতে নিতে বলে,”এইযে তোমাকে ধরে শুচ্ছি। আর কথা না। ঘুমিয়ে পড়ো।”

তন্দ্রা হাসল। সুখের হাসি। ওপাশ থেকে জড়িয়ে এপাশে আসা শক্তপোক্ত হাতটার উপর হাত রেখে চোখ বুজে বললো,
-“কাল লেপটা নামাতে হবে বুঝলেন?”

সেকেন্ড পাঁচেকও কাটলোনা বোধহয়। গ্রীবার উপর অপ্রস্তুত আদরটায় তীব্র শীতের চেয়েও শিরশির করে কেঁপে উঠলো তন্দ্রা। কোনরকমে বললো,”কি করেন! ঘুমানতো।”

পেছনের থেকে সরফরাজের মৃদুহাস্য কন্ঠ শোনা গেলো,
-“আমি থাকতে তোমার লেপের কি দরকার তনু?”

-“ছিহ্!”

-“ভয় পেলে তো আব্বা আম্মার সামনে জাপটে ধরতেও লজ্জা পাওনা। আর এখন এক কাঁথার নিচে ছিহ্ ছিহ্ করছো। হায় তন্দ্রাবতী!”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here