মেঘদিঘির পাড়ে – ২০,২১
মালিহা খান
পার্ট-২০
৩৭.
সকাল হতেও সূর্যের দেখা মিলেনি। দূরের গাছগুলোর উপর পেলব তুলোর মতোন কুয়াশারা ভেসে আছে যেনো। গাছের পাতাগুলো শীঘ্রই পতনোন্মুখ। শীত এসেছে বলে!
ঘড়িতে আটটা দশ কেবল।
নরম বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে বিভা। একহাতে কাঁধ জড়িয়ে ধরে তাকে বুকের পাশে লাগিয়ে রেখেছে সরফরাজ। নিজের মেলে রাখা পায়ের উপর পাহাড়সম বিরক্তি নিয়ে কিন্চিৎ ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে বিভা।
পায়ের ব্যাথায় রাত থেকে কাহিল অবস্থা বেচারীর। একছটাক ঘুমাতে পারেনি। কাল সারাদিন হেঁটেফিরে ঘুরে ব্যাথাটাকে নেহাতই অবহেলা করেছিলো। ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি এই ব্যাথা ধীরে ধীরে এমন তুখর তীব্র হবে। তার উপর পড়েছে শীত। শীতে একটু ব্যাথা পেলেই মানুষের মরি মরি অবস্থা হয়। সে তো বেচারি হোঁচট খেয়ে যেয়ে ইটের উপর পড়েছে। উঠোনে কে কোন অলুক্ষুণে সময়ে যে ইট গুলো রেখেছিলো আল্লাহ জানে।
গরম পানির বোতল কাপড়ে মুঁড়িয়ে হাঁটুর কাছে দিয়ে রেখে দিয়েছেন জাহানারা। বিশেষ লাভ হচ্ছেনা অবশ্য। অনবরত টনটন করেই চলেছে জা’গাটা।
বিভা বিরবির করে বললো,”ভাইজান? আমিই কেনো পড়ে গেলাম বলেনতো?”
উওরে আলতো করে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো সরফরাজ।
-,সেড়ে যাবে।”
-“সাড়ছেনাতো।”
-“সারাদিন উড়নচন্ডীর মতোন টইটই করলে ব্যাথা তো হাওয়ায় সেড়ে যাবে।”
চাপা ভৎসর্নায় ভরপুর কন্ঠটা এলো দরজার কাছ থেকে। বিভা চোখ তুলে তাকায়। ইউসুফের নির্বিকার চেহারাটা একপলক দেখে সরফরাজের বুকে গাল লেপ্টিয়ে মাথা নিচু করে রাখে। সরফরাজ হেসে ফেললো। ইউসুফ ভুল কিছু বলেনি। বিভা সত্যিই ধুরন্ধর চন্চল।
ইউসুফ ঢোকে। জাহানারার সাথে কি কথা বলে।
বিভা মৃদুকন্ঠে সরফরাজকে বলে,”ভাইজান? আপনি কিছু বললেননা?”
-“কি বলবে?”নিজের কথা থামিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে ফিরে তাকায় ইউসুফ।
বিভা চুপ করে গেলো। কড়া চোখে একবার ইউসুফের চোখে চেয়ে দৃষ্টি নামালো। সরফরাজের কাছে গুঁটিয়ে গিয়ে মিষ্টি হাওয়াই মিঠাইয়ের মতোন তুলতুলে কন্ঠে বললো,
-“পানি খাবো ভাইজান, খাইয়ে দিন।”
বিভার বলতে দেরি হলো, সরফরাজের ব্যস্ত হতে দেরি হলোনা। পাশের টেবিল থেকে পানিভর্তি গ্লাসটা তুলে নিলো জলদি। বিভার ঠোঁটে ঠেকিয়ে ধরতেই সেদিকে চেয়ে মলিন হাসলো ইউসুফ। এইযে রুষ্টপুষ্ট প্রচন্ড রাগী মানুষটা যাকে দেখলে গ্রামের নেতা, চেয়ারম্যানরা পর্যন্ত মাথা নুঁইয়ে সালাম ঠুকে তারকাছে একমাত্র এই বিভা, ইভাই এমন আবদার করতে পারে। এতো ভালোবাসে সে বোনদের। আজপর্যন্ত কোনোদিন বকা তো দূর সামান্য উচুকন্ঠে কথাও বলতে শোনেনি। একমূহুর্তের জন্যও না।
ইউসুফ হাসার চেষ্টা করে। একটা দীর্ঘশ্বাসও কি বেরোয় সঙ্গে?
৩৮.
সকালে ঠান্ডার মধ্য আর গোসল করা হয়নি। সূর্যের দেখা মিলতে মিলতে দ্বিপ্রহর গড়িয়ে গেলো। ঘড়ির কাঁটা যখন যখন চারটা ছুঁইছুঁই, ঝলমলে কড়া রোদ ঠি কড়ে পড়লো বারান্দায়। ঝটপট গোসল সেড়ে ভেজা চুলগুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বরফ শরীরটা নিয়ে সেই রোদেই এসে আশ্রয় নিলো ইভা। কাঁপুনি দিচ্ছিলো, রোদ গায়ে পড়তে কিছুটা আরাম হলো। চুল বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। গলার জামা ভিজে যাচ্ছে। স্তব্ধ মধ্যদুপুর। একপাশে এনে বিশাল চুলগুলো বারকয়েক ঝাড়া দিতেই দু’তিনটে পুরুষকন্ঠের হাসির শব্দে হাত থেমে গেলো তার। কন্ঠগুলো চেনে, কিন্তু!
সামান্য ঝুকে উঠোনের ঘাসের উপর বেতের চেয়ার পেতে সরফরাজ, ইউসুফ অত:পর সামনের চেয়ারটায় কালো টি- শার্ট পরিহিত চওড়া কাঁধের ব্যক্তিটাকে দেখেই বারকয়েক বিষম খেলো ইভা। উত্তপ্ত রোদটা বোধহয় হঠাৎই আর কাজ করলো না। রগে রগে কাঁপুনি ধরে গেলো। সায়ন কখন এলো? ভাইয়েরা বাসায় আছে জানে। ছুটির দিন। কিন্তু সায়ন? এরা এতো হাসাহাসি করছে কেনো? এমনে কি হাসি ভাইজানের সাথে, আর তাকে কিসব বলে! অসভ্য পুরুষ!
চুল ঝাড়ার শব্দে দূর থেকেই মিষ্টি রোদে মুড়িয়ে থাকা রমণীর একপাশে এনে রাখা ঝড়ঝড়ে ভেজা চুলগুলোর দিকে চোখ পড়েছিলো সায়নের। রমণী বিস্ময়ে হা হয়ে চেয়ে আছে। টুকটুকে গালদুটো রোদে লাল হয়েছে নাকি লজ্জায় ঠি ক বোঝা গেলোনা।
আশেপাশের পুরুষদুটোর উপস্থিতি লক্ষ্য করে নিভৃতে চোখ নামিয়ে, ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দিলো সায়ন। এরপর আবার চোখ তুললো যখন; ইভা তো দূর, ইভার ছায়াটুকুও নেই সেখানে। ফাঁকা ধুঁ ধুঁ বারান্দার দিকে চেয়ে এবার নিশ্চিত হয়ে গেলো সে, গালদুটো তবে লজ্জায়ই লাল হয়েছিলো।
হাসিঠাট্টায় মশগুল থাকতে থাকতে কখন যে এত সময় গড়িয়েছে বুঝতেই পারলোনা সায়ন। পছন্দের বাদামী বেল্টের হাতঘড়িটার দিকে হঠাৎ চোখ পড়তেই চোখ কপালে উঠলো যেনো। এসেছিলো কেবল আধঘন্টার জন্য। ইভার বাবা- মার সাথে একটু দেখা করেই আবার চলে যাবে। গ্রামে আসার সময় করে উঠতে পারেনা। একদিনের জন্য এসেছে যখন দেখা না করে চলে যাওয়াটাও ভালো লাগছিলোনা। তাছাড়া উনারা ওকে বড্ড স্নেহ করেন।
এসেছ্লিও দুপুরের পর। যেনো খাবার দাবারের ঝামেলা না থাকে। কিন্তু না, সরফরাজ যেতে দিলো কই? হাল্কা চা খাবার কথা বলে এইযে বসলো খোলা আকাশের নিচে। সে নিজেও টের পায়নি কখন সময় গিয়েছে।
-“ভাইয়া? আমার যেতে হবে যে এবার। পাঁচটা বেজে গেছে। শুক্রবার এমনিই জ্যাম থাকে। এখন রওনা দিলেও ফিরতে দশটা এগারোটা বেজে যাবো।”
তার কথা শেষ হলোনা। জমিলার মা খালি কাপের ট্রে টা বদলে দিয়ে গেলো। এতক্ষণে আরো চার- পাঁচবার সে ট্রে বদলেছে। কাপভর্তি গরম চা দিয়ে গিয়েছে।
সরফরাজ চাপা স্বরে বললো,
-“এটা খেয়ে নাও। তারপর আর আটকাবোনা।”
মানা করতে পারলোনা সায়ন। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে চায়ের কাপটা তুলে নিলো। নির্জন পড়ন্ত বিকেলের নিস্পন্দনতা কাটিয়ে সরফরাজের ফোন বাজলো। চোখের ইশারায় অনুমতি নিয়ে ফোন হাতে সে একটু দূরে গিয়ে দাড়াতেই সায়নের দিকে চেপে এলো ইউসুফ। গলা খুশখুশ করে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলো। সায়ন তাকালো।
-“কিছু বলবেন ভাইয়া?”
-“অবশ্যই।”
-“বলুন।”
ইউসুফ চেপে এলো আরো খানিকটা। কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে ফিসফিস করে শুধালো,
-“চায়ে চুমুক দেবার বাহানায় আপনি যার জন্য বারবার ওদিকে তাকাচ্ছেন সে আর আসবেনা সায়নসাহেব।”
আচমকা ধরা খাওয়া অপরাধীর মতো একপলক তাকিয়েই মৃদু শব্দ করে হেসে ফেললো সায়ন। হঠাৎই কি একটা অদ্ভুত সুপ্ত লাজুকতা খেলে গেলো পুরুষ চোখেও। ছোট্ট একটা উওর এলো,
-“জানি।”
-“জানো তবু তাকাচ্ছো কেনো?” বলে চায়ের কাপে লম্বা চুমুক দিলো ইউসুফ। অপরপাশের মানুষটাকে বেশ জব্দ করে ফেলার প্রমানস্বরুপ ঠোঁটের কোঁণে বাঁকানো একটা হাসি বেশ শোভা পাচ্ছে।
-“ওইযে মরীচিকার পিছে ছোঁটা, মানুষের আদিস্বভাব। আমিও মানুষ বটে।”
ইউসুফ সপ্রতিভ হলো। মাথা নাড়ালো। ছেলেটার কথার ধাঁচ আছে।
৩৯.
সন্ধ্যার পরপরই একটু বেরিয়েছিলো ইউসুফ। যাবার আগে একবার বিভার ঘরে দেখে গিয়েছে। মেয়েটা ঘুমাচ্ছিলো চুপ করে। কিন্তু ফিরে আসার পর আর তাকে আর চুপটি করে ঘুমন্ত অবস্থায় পাওয়া গেলোনা। ফাঁকা ঘর, শূন্য বিছানা। আদ্যপান্ত চোখ বুলিয়ে ঘরের দরজাটা নিরবে লাগিয়ে দিলো ইউসুফ।
দ্বিতীয় গেলো ইভার ঘরে। দরজা খোলাই ছিলো। কোলের উপর বই রেখে পড়ছিলো ইভা। দরজায় ইউসুফকে দেখেই চোখ তুলে তাকালো। কিছু বলতেও পারলোনা তার আগেই প্রশ্ন ছুড়লো ইউসুফ,
-“তোর বোন কই?”
আকস্মিক প্রশ্নটায় অপ্রস্তুত হয়ে গেলো ইভা। কিছু বলবে তার আগেই ইউসুফ আবার বললো,
-“টইটই করছে না? কই গিয়েছে? ওকে না আমি দুপুরে বললাম, দু’একটা দিন ছুঁটোছুঁটি করতে না।”
-“না ঘুমিয়েইছিলো, একটু আগে উঠেছে।”বোনের সাফাই গাওয়াটা বিশেষ একটা যুত্সই হলোনা বোধহয়। ইভা নিজেও বুঝলো।
-“এখন কোথায়?”
-“ঘরেও নেই? নিচে গিয়েছে মনেহয়।”
-“আমিতো নিচ থেকেই এলাম।”
-“উঠোনে মনেহয়। ছাদেও হতে পারে।”
-“বেশ।”দরজাটা আলগা করে ভিড়িয়ে দিয়ে চলে গেলো ইউসুফ। ইভা একা একাই আমতা আমতা করলো কিছুক্ষণ। তার বোনটা কেনো যে কথা শোনেনা!
চলবে
মেঘদিঘির পাড়ে – ২১
মালিহা খান
রাতের অমা মলিন করে জোছনা উঠেছে। একলা একা রুপালি চাঁদটা হয়তো আত্নশ্লাঘায় বিভোর। এমন অপরুপ সে!
বাড়ির উঠোনে বিভাকে পাওয়া গেলোনা। ইউসুফের চওড়া কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল।
এই নিঝঝুম রাতেরবেলা মেয়েটা একা একা গিয়ে ছাদে বসে আছে নাকি? এত সাহস যে কই পায়!
অত:পর তার চিন্তার ভাঁজ বাড়িয়ে বিভাকে ছাদেও পাওয়া গেলোনা।
গাছের পাতা কম্পনশূন্য। বাড়ির পিছের এদিকটা গাছগাছালিতে ভর্তি। কাঁঠালীচাপার ঘ্রাণে মাথা ধরে যায়। আঁধারে সামান্য মানব ছায়াও দৃষ্টিগোচর হয় বহুকষ্টে। একটু জোছনার আলোতে…
-“এখানে কি করছো তুমি?”
এত একাগ্র নিরবতা মূহুর্তেই উবে গেলো। শুকনো পাতা পড়ে ছয়লাব হয়ে ছিলো নিচ, মড়মড় শব্দে সেই পাতা ভেঙে কাছে এসে দাড়ালো ইউসুফ।
অথচ তার উপস্থিতিতে নির্বিকারচিত্তে বসে থাকা ছায়ামানবী বিন্দুপরিমানও নড়লোনা। যেনো সেই কন্ঠ তার কর্ণকুহর অবধি পৌঁছাতেই পারেনি এমন একটা ভাব নিয়ে সে খুব নির্লিপ্তভঙ্গিতে একাধারে হাতের ছোট্ট লাকড়ির টুকরোটা দিয়ে উঠোনের মাটিতে খুঁটতে লাগলো। যা সে বিগত অনেকক্ষণ যাবত মনোযোগ সহকারে করেই যাচ্ছিলো। তার মনোযোগের পরিবর্তন ঘটলোনা। তবে মুখের উপর ছেঁয়ে থাকা খোলা এলোকেশের নিচে খুব যন্ত্রনায় একজোড়া আবেগী চোখ বারঁবার পলক ঝাপটাতে লাগলো।
তার মুখ তুলে চাওয়ার অপেক্ষায় ইউসুফ ঠাঁট হয়ে দাড়িয়ে রইলো অনেকক্ষণ। গাছের ফাকফোঁকড় গলিয়ে অল্পআধটু জোছনা আসে। ছায়ামানবীর নির্লিপ্ততার পরিমাণ আঁচ করতে করতেই পাথর কঠোর চোখের চাহনী নরম হয়ে এলো ধীরে ধীরে। সামান্য নিবিড় হয়ে পাশে বসতেই গলার স্বর নেমে গেলো অনেকটা,
-“মন খারাপ কেনো?”
খুব রুক্ষ কন্ঠেও সহস্রাধিক অনুভূতি লুকোনো গেলোনা। প্রতিটা বায়ুকণা অবধি টের পেলো তার হৃদআকুতি। ছায়ামানবী মুখ না তুলেই থমথমে কন্ঠে উওর দেয়,
-“মন খারাপ না।”
-“খারাপ। কেনো?”
উওর এলোনা। প্রশ্নও হলোনা আর। সময় গেলো। হাতের লাকড়িটা পড়ে যাবার মৃদু শব্দ হলো। বিভা মুখ তুলে গাছের ফাঁকে লুকিয়ে থাকা আকাশের বিশাল চাঁদটায় চোখ আটকালো। বিষন্ন, উদাসীন। বারকয়েক পলক পড়লো। কোঁণ ঘেঁষে তপ্ত জল গড়ালো কি? অন্ধকারে বোঝা গেলোনা। হাত বাড়িয়ে চোখের কোঁণ ছুঁয়ে দেখতে পারলোনা ইউসুফ। কি যেনো আটকে দিলো। অবগত পরিণতি?
বিষন্নার মলিনতায় জোছনাও ম্লান হলো যেনো। অদ্ভুত ম্লানিমা গ্রাস করলো চারপাশ।
-“ওঠো। রাত হয়েছে। ঠান্ডা পড়ছে। ঘরে চলো।”
ইউসুফ তাঁড়া দিলো। এবারে উওর এলোনা। তবে শিরা- উপশিরায় রক্তজমিয়ে দিয়ে তার শক্ত বাহুতে কাত করে মাথা ঠেকালো বিভা। নিজের দু’হাত দিয়ে তার একহাত পেঁচিয়ে ধরে বিরবির করে বললো,
-“চুপ করে বসে থাকেন, আমি আর কিচ্ছু বলবোনা।”
ওখানে আর টু শব্দটাও হলোনা। শীত ও কি ভীত হয়ে পড়লো মনের উষ্ণতায়? কাঁঠালীচাপাও কেনো হঠাৎ ওমন ঘ্রান ছড়ালো? খুব তীব্র।
চলবে