মেঘদিঘির পাড়ে – ৪,৫
মালিহা খান
পার্ট-৪
৯.
দীর্ঘক্ষণ উশখুশ করে বিভার ঘুম যখন ভাঙলো, ইউসুফ তখনো ড্রাইভ করছে। নিচের ঠোঁট কামড়ে মনোযোগী চোখে সামনের কাঁচে তাকিয়ে আছে। যেনো সেই কাঁচে কেও কোটি টাকার সিনেমা চালিয়ে রেখেছে, বা বিনা পয়সায় সার্কাস দেখাচ্ছে বা কাঁচে কোনো জাদু আছে। তাকালে চোখের দৃষ্টি বাড়ে।
ইউসুফের শার্টের বোতাম সবকটা খোলা। একটু পরপর চুলে চালানো আঙ্গুলের ভঙ্গিটাতেও কেমন ভিন্নতা খুঁজে পায় বিভা।
তার মাথাটা বন্ধ জানলার কাঁচে ঠেকানো, কি ভীষণ অবহেলা তাইনা? বিভা একমনেই হাসলো। কেমন গা ছাড়া হাসি। ছন্নছাড়া- হতাশ হাসি। সেই হাসিতে শব্দ হলোনা। ঠোঁট আলগা হলোনা। ইউসুফ ফিরেও তাকালোনা একবার। বিভা নিজ থেকেই বললো,”আমি উঠেছি।”
-“তো?”
-“কিছুনা।” হাল্কা গলায় উওর দিয়েই চুপ করে গেলো বিভা। কিছুক্ষণ পর আবার বললো,
-“পৌঁছিনি এখনো?”
-“ফিরছি।”
বিভার চোখ কপালে উঠে গেলো। এতোক্ষণে টনক নড়লো। বাইরে রাত। কালো ঘুটঘুটে রাত। এতো রাত কখন হলো? বাজে ক’টা? তারাতো বিকেলে বেরিয়ে ছিলো। তবে? এক পাহাড়সম বিস্ময় নিয়েই বিভা প্রশ্ন ছুঁড়ল,”মানে? আপনি ফোন কিনেননি?”
-“কিনেছিতো, এইযে।” ইউসুফ গাড়ির সামনের ড্রয়ারটা খুলে দিলো। ভেতরে তিনটা চকচকে বাক্স।
বিভার বিস্ময় বিশাল এভারেস্ট ছুলো,
-“কখন কিনেছেন? এতগুলো কেনো?”
ইউসুফ ড্রয়ারটা আটকে উঁচুকন্ঠে বললো,”তুমি ঘুমিয়ে ছিলে।…আবার কখন ভেঙে ফেলো ঠি ক তো নেই কোনো। দু’দিন পরপর এত রাস্তা বয়ে কিনতে আসাও ঝামেলা। তাই বেশি করে কিনে রাখলাম। কথায় না পেরে তো এই এক ফোনের উপরই হাত চলে তোমার। আর কি পারো?”
বিভা চোখমুখ কঠিন করলো। মনে মনে বলল,”আপনি তিনটে ফোন কিনতে পারেন অথচ দু’মিনিট কাছে বসিয়ে আমাকে নরম গলায় একটু মানা করতে পারেন না? আপনি মানা করলে আমি আর কোনোদিন আপনার ফোনে হাত দিবো? আর কোনোদিন আপনাকে বিরক্ত করবো? বিশ্বাস করেন, এই রাস্তার বিশাল লম্বা হেডলাইটটাকে সাক্ষী রেখে প্রতিজ্ঞা করলাম আপনার এই গোটা তিনটে ফোন আর ভীষণ নাকউঁচু স্বভাব আমি একদিনে ভাঙব।”
মইদুলের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেলো পরদিন দুপুরেই। বারান্দার রেলিং ঘেঁষে ইভা ঘন্টাখানেক দাড়িয়ে রইলো মেঘদিঘিতে চেয়ে। এই দিঘির নাম মেঘদিঘি না। গ্রামের লোকজন একে সাধারণ, ঝোপের পাশে থাকা পড়ে থাকা খুব নগন্য একটা দিঘি বলেই জানে। নামকরণ টা সে নিজে করেছে। দিঘির জলে পুরো আকাশটা দেখা যায়। দূর থেকে দেখলে মনে হয় একখন্ড আকাশ এসে এই পৃথিবীতে বিছিয়ে পড়েছে। থইথই করছে মেঘ। নীল সাদা ভীষণ সুন্দর জলমেঘ।
১০.
সাদা মেঘে কৃষ্ণচূড়ার ঝাঁক। দিঘির টলমলে জলে গোধুলীরাঙা আকাশের নিখুঁত প্রতিচ্ছবি ভাসছে। মাঝে দু’একটা বেগুনী শাপলা। বোধহচ্ছে আকাশের গায়েই মাথা উঁচু করে ফুঁটে আছে ওরা। দিঘির একপাশের পরপর পাঁচটে লাল সিঁড়ির পর ষষ্ঠ সিঁড়ি থেকে যেয়ে বাকিগুলো ডুবেছে পানির নিচে। ঠান্ডা পানির নিচে সেই ষষ্ঠ সিঁড়িতেই পা ডুবিয়ে বসে আছে ইভা। আজ বাহাদুর আসেনি। আসার আগে দেখে এসেছে বিভার ঘরে বসে পেন্সিল কামড়ে কামড়ে খাতায় অঙ্ক কষছে। সে যেতেই করুণ চোখে একবার চাইলো, বিভার কড়া চোখ রাঙানীতে আবার মাথা নিচু করে খাতায় মনোযোগ দিলো।
সেই দৃশ্য মনে পড়তেই দিঘির জলে পা নাচিয়ে খিলখিল করে হেসে ফেলল ইভা। নির্জন জা’গাটায় ভারি অদ্ভুত সুন্দর শোনালো সেই ঝলমলে হাসির শব্দ।
ক্যামেরার সাটারের ‘সাঁট’ আওয়াজটাও এলো তখনই। ইভার পিলে চমকে উঠলো। বা’কাঁধের ঠি ক উপরে কারো হাতের অস্তিত্ব টের পেতেই ধরফরিয়ে উঠে দাড়ালো সে। কাঁধের সাথে লেগে সায়নের ক্যামেরাটা
হাত থেকে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলো। দু’হাতে আঁকড়ে কোনরকমে বাঁচিয়ে নিলো সে। মাত্র একধাপ উপরেরর সিঁড়িতে আস্ত এক অপরিচিত পুরুষ দেখে ইভার চোখমুখ ভয়ে চুপসে গেলো নিমিষেই। সমস্ত গা শিঁউরে উঠলো সর্বগ্রাসী আতঙ্কে। সায়ন ক্যামেরা থেকে চোখ তুলে একপলক মেয়েটার পাংশুটে মুখ দেখলো। একধাপ নিচে নামতে নামতে প্রচন্ড বিব্রত কন্ঠে বলল,
-“ভয় পাবেন না, আমি আপনার ছবি তুলিনি…।”
আগন্তককে নামতে দেখে আপনাআপনিই পিছিয়ে গেলো ইভা। সায়ন হঠাৎই চিৎকার করলো,
-“আপনি..। কথা সম্পূর্ণ হলোনা। তার আগেই পানির নিচের পিচ্ছিল সিঁড়িতে পা পিছলে গেলো ইভার। হতভম্ব সায়ন তড়িৎগতিতে হাত ধরার চেষ্টা করলো। লাভ হলোনা। ভয়ে, আতঙ্কে জবুথবু ইভা চিৎকার করতেও বেমালুম ভুলে গেলো যেনো। থইথই পানিতে দু’তিনবার তলিয়ে গিয়ে নাকেমুখে পানি ডুকে গেলো তরতর করে। শ্বাস আটকে এলো মূহুর্তেই। সাতপাঁচ না ভেবে ক্যামেরাটা সিঁড়ির উপর রেখেই পানিতে নেমে গেলো সায়ন। পরপর কতগুলো সিঁড়ি। পা রাখলেই নাগাল পাওয়া যাচ্ছে। আর বোকা মেয়েটা ভাসতে ভাসতে মাঝখানে চলে গেছে। সায়ন পানি হাতড়ে সামনে এগোলো। আশেপাশে একটা কাকপক্ষীও নেই।
ইভা ডুবছে প্রায়। সায়ন দ্রুত একহাতে কব্জি চেপে কাছে টানলো। দ্বিধাগ্রস্থ হাতেই নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে ফেললো ইভার তুলতুলে ছোট্ট শরীরটা। বিব্রতবোধটা যেনো গলার মাঝে শক্ত কাঁটার মতো আটকে গেলো এবার,
-“দেখি ধরুন আমাকে। গলা ধরুন। এই মেয়ে?”
ইভা ধরলোনা। নিশ্চুপ, চৈতন্যহীন লেপ্টে রইলো সায়নের বুকের মধ্যিখানে। তার ক্ষীণ শ্বাস খুব ধীরগতিতে পড়তে থাকলো। খোঁপা খুলে যাওয়া বিশাল দৈর্ঘ্যর লম্বা লম্বা ভেজা চুলগুলো লতাপাতার মতোন পেঁচিয়ে গেলো সায়নের হাতে- বাহুতে।
ইভাকে পাড়ে তুলে বিব্রত সায়ন এবার আরো বিব্রতবোধ করলো। সন্ধ্যে নামার আগমূহুর্তের আবছা আলোতে ইভার দিকে তাকাতেই তার প্রচন্ড লজ্জা লাগলো।
বারকয়েক গালে চাপড় মেরেও লাভ হলোনা। শুধু ইভার মাথাটা এদিক ওদিক হলো মাত্র। অজ্ঞান ইভা সেই অজ্ঞানই রইলো। নিরুপায়, দিশেহারা সায়নকে মাত্র কয়েকমূহুর্তের সিদ্ধান্তে গোটা সাতাশ বছরের জীবনের সবচাইতে অসস্তিকরকাজটাই করতে হলো তখন। ইভার জ্ঞান ফিরলো কিয়ৎক্ষণের জন্য। কয়েকসেকেন্ড নিভু নিভু চেয়ে থেকে, অত্যন্ত দূর্বল গলায় কিছু বলার চেষ্টা করে আবারো অচেতন হয়ে গেলো সে।
সায়ন আবার ডাকল,”এই মেয়ে? এইযে মিস? আপনি..।” ইভার মাথাটা বামদিকে হেলে পড়ল। গালে একদলা মাটি লেপ্টে গেলো রংয়ের মতোন।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সায়ন। এদিক ওদিক চাইলো একবার। তার গাড়িটা একটু দূরেই পার্ক করা। সুন্দর ফিরছিলো রাস্তা দিয়ে, কি করতে যে এই দিঘির ছবি তুলতে এলো কে জানে! না আসত, না মেয়েটার সাথে দেখা হতো, না এইরকম চরম বিদঘুটে পরিস্থিতিতে পড়তে হতো।
গ্রামে সন্ধ্যাে হতেই রাত নামে। মানুষের আনাগোনা কমে যায়। আবার দিঘির পাশের ঝোপ-ঝন্জাল। ভুল করে হলেও আশেপাশের কেও তাদেরকে এমন অবস্থায় দেখলে তিল কে তাল বানাতেও বিন্দুমাত্র ভাববেনা। উল্টো আরো বিরাট ঝামেলায় ফেঁসে যাবে অনায়াসে। এই মেয়ের বাড়ি কোথায় কে জানে! জানার কথাও না অবশ্য!
ইভাকে গাড়ির পিছের সিটে শুঁইয়ে দিয়ে খুব আঁটসাঁট ভঙ্গিতে তার গায়ের চুপচুপে ওড়নাটা টেনে নিলো সায়ন। দু’হাতে চিঁপড়ে পানি ঝড়িয়ে গায়ের উপর মেলতে যেতেই টের পেলো তার হঠাৎ প্রচন্ড লজ্জা লাগছে। লজ্জায় কানের লতি গরম হয়ে যাচ্ছে। হাত কাঁপছে, বুক কাঁপছে, মেয়েটার দিকে তাকানোতে যেনো ঘোরতর, গুরুতর অপরাধ।
পুরুষমানুষের লজ্জা কম থাকে’ কথাটা হঠাৎই প্রচন্ড মিথ্যে মনে হলো সায়নের। নিঝঝুম অদ্ভুত দিঘির পাড়ে সায়ন নিজের ভিতরের সবচেয়ে লজ্জাশীল সত্তাটাকেই খুঁজে পেলো যেনো। নিজের হাঁটুর বয়সি একটা ছোট্ট মেয়েকে দেখে সারা বিশ্বের সমস্ত লজ্জা এসে ভর করলো প্রাপ্তবয়স্ক চোখের পাতায়।
ড্রাইভিং সিটে বসে ফোন করলো সে,
-“ফুপি? আমি ব্যাক করছি বুঝলে? পথে একটু ঝামেলা হয়েছে।”
-“সেকি! তোর না জরুরি কাজ পড়লো? সকালের মধ্যে না ফিরতে হবে?”
-“আজ আর ফেরা হয়েছে!”বিরবির করতে করতেই ফোন কাটলো সায়ন।
মেঘদিঘিকে একলা ফেলে দিঘিকন্যাসমেত গাড়ি কিছুক্ষণের মতোই চোখের আড়াল হয়ে গেলো।
চলবে
মেঘদিঘির পাড়ে – ৫
মালিহা খান
১১.
সোনালী বিকেল সন্ধ্যার চাদরে গা ঢাকা দিলো। নির্বিঘ্ন নিজর্নতায় সবেমাত্র চাঁদের নরম আলো ছড়ালো।বিভা তখনো ছোট্ট বাহাদুরকে অঙ্ক করাতে ব্যস্ত। ছেলেটা খালি পড়ায় ফাঁকি দেয়।
ঘরের বন্ধ দরজায় ঠকঠক শব্দ। ইভা এসেছে ভেবে খাতায় এটা ওটা দেখিয়ে দিতে দিতে বিভা উচুকন্ঠে উওর দিলো,”আয়।”
দরজা খুললো। একঝলক চোখ তুলে দেখলো বিভা। থতমত খেয়ে গেলো সাথেসাথেই। দরজায় ইউসুফ দাড়িয়ে আছে। বিভা আমতাআমতা করলো। মিনমিনে কন্ঠে বলল,”মানে…আসেন।”
ইউসুফকে ব্যস্ত দেখাল। বিভার মিনমিনে কন্ঠটা তার কান অবধিও পৌঁছালোনা। ঘরের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে চোখ বুলিয়ে সে অত্যন্ত অস্হির কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ল,”ইভা কোথায়? তোমার সাথে নেই?”
বিভা কিছুক্ষণ কথাহীন চেয়ে রইলো। ইউসুফের চিন্তিত চোখদুটো তার ভীষণ সুন্দর দেখালো। তারপর বলল,”না, ঘরে আছে হয়তো।”
ইউসুফ দু’বার পলক ফেললো। চিন্তার বদলে সেখানে এসে ভর করলো ভীতি। কন্ঠ স্পষ্টতর,”ঘরে নেই। দেখে এলাম তো মাত্র।”
বিভা ভ্রু কুঁচকালো, বিছানা ছেঁড়ে নামতে নামতে বলল,
-“সেকি! বিকেলে বললো ওই দিঘিরপাড়ে যাচ্ছে। এতক্ষণে তো ফিরে আসার কথা। আসেনি? সন্ধ্যা হয়ে গেছে।”
ইউসুফ মৃদুকন্ঠে শুধালো,”ওখানে গিয়েছে? আচ্ছা, আমি দেখছি।”
ইউসুফ চলে গেলো। দিঘির পাড় তন্নতন্ন করে খুঁজেও ইভাকে পাওয়া গেলোনা। খবর পাওয়া মাত্র সরফরাজ ফিরে এলো ঘন্টাখানেকের মধ্যেই। দিঘির আশপাশে আরো একদফা খোঁজাখোঁজি চললো। সবার থমথমে চেহারার দিকে তাকিয়ে ইউসুফ নিচুস্বরে বলল,”সরফরাজ? পানিতে একবার খুঁজে দেখব?”
সরফরাজ উওর দিলোনা। নিরবে চেয়ে রইলো অন্ধকার দিঘির কুচকুচে পানিতে।
ইউসুফ নামল পানিতে। ডুবকি লাগালো অনেকক্ষণ। শেষ সিঁড়িটায় দাড়িয়ে বুকচেপে রইলো বিভা। ইউসুফ উঠলো খালি হাতে। সিঁড়ির কোঁণে দাড়িয়ে থাকা বিভার টলমলে চোখদুটোতে চেয়ে জীবনে প্রথববারের মতোন বিভাকে জানিয়ে বিভার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-“চিন্তা করোনা।”
বিভা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। সেই রাতে দিঘির পাড়ে দাড়িয়ে পাষাণ ইউসুফ কেনো যেনো খুব নরম হয়ে গেলো। তার নমনীয়তায় বিভার চোখের পানি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলো ইউসুফের ভেজা চুপচুপে শার্টে।
১২.
ফুপির বাসার কাছাকাছি পৌঁছে ব্রেক চাপলো সায়ন। পাশের সিটে মেলে দেয়া প্রায় শুকিয়ে আসা শার্টটা নিয়ে গায়ে চড়াল। বোতাম আটকালো। উপরের লুকিং গ্লাসে চোখ পড়লো হঠাৎই। এবার আর লজ্জা পেয়ে চোখ নামাল না সায়ন। বরং চেয়ে থাকলো অপলক কিছুক্ষণ।
ছোট্ট আয়নায় সেই দু’মিনিটের দেখায়ই বোধহয় কিছু একটা হয়েছিলো। নামবিহীন, শিরোনামহীন কিছু একটা।
সায়ন পেছনে ঝুঁকে গিয়েছিলো। হাতের পিঠে ইভার গালের কাঁদামাটি মুছে দিয়েছিলো।
লিথিশা ফুপি একা মানুষ। গ্রামের বিশাল দোতালা বাড়িটা তার প্রয়াত স্বামীর। বিয়ের দু’বছেরের মাথায় স্বামীর হঠাৎ মৃত্যুর পর তিনি আর বিয়ে করেননি। নি:সন্তান পন্চাশার্ধ মহিলাটাকে নি:সন্দেহে পৃথিবীর সবচাইতে ভালো মানুষগুলোর কাতারে ফেলে দেয়া যায়। বড়ভাইয়ের ছেলেকে এক পৃথিবী সমান ভালোবাসা মানুষটাকে দেখলে কেও বলবেই না মানুষটার জীবনে এত একাকীত্ব, এতো দু:খ, এতো বেদনা।
সায়নের গাড়ির আলো দেখামাত্রই দৌড়ে দৌড়ে বেরিয়ে এলেন তিনি। দারোয়ান ঝিমাচ্ছিলো। লিথিশা ফুপি ধমকে জাগালো তাকে। সায়নের হর্ণ চাপতে হলোনা। দারোয়ান তাড়াহুড়ো করে বিশাল লোহার গেটটা খুলে দিলো। একপাশে গাড়ি থামিয়ে সায়ন যেইনা বেড়ালো, লিথিশা ফুপি জানলার ভেতর দিয়ে ইভার পা’টুকু দেখেই আৎকে উঠলেন,
-“সায়ন? বাবা, কি করেছিস?”
সায়ন উওর দিলোনা। ফুপির উত্তেজিত হবার স্বভাব আছে। ইভাকে পাঁজকোলা করে বের করতেই লিথিশা ফুপি এবার দ্বিগুন জোরে চেঁচালেন,”হায় আল্লাহ! কি হয়েছে ওর? গা ভেজা কেনো? এত ছোট মেয়ে? কোথায় পেলি?”
সায়ন ক্লান্ত কন্ঠে বলল,”ফুপি ভেতরে যাই? উনি অজ্ঞান। ঘরে নিয়ে যাই?
-“আয় আয়, আমার ঘরে নিয়ে চল।”
ইভাকে ঘর পর্যন্ত নিয়ে যেতে যেতেই সবটা বললো সায়ন। লিথিশা ফুপি এবারো চেঁচালেন,”তুই ভয় দেখালো কেনো? বেচারি না জানি কত ভয় পেয়েছে। জ্ঞানটাও ফিরেনি এখনো। আল্লাহ!”
সায়ন চুপ করে রইলো। ফুপির কথায় মনে হলো ভুলটা আসলে তারই হয়েছে।
ইভাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ফুপির কাছে পানি চাইলো সায়ন। ফুপি পানি দিলে ইভার মুখে ছিঁটালো। পরপর কয়েকবার পানির ছিঁটা পেতেই চোখ পিটপিট করলো ইভা। ঝাপসা চোখে সায়নকে মুখের উপর ঝুঁকে থাকতে দেখেই গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে দু’হাত উঠিয়ে বুকে ধাক্কা লাগালো। হতবিহ্বল সায়ন বিমূঢ় চোখে তাকাল। বিরবির করে বলল,
-“ও গড!”
ইভার মাথা টলছে। বারবার চোখ বুজে আবার তাকাচ্ছে সে। ভেজা শরীর ঘেমে যাচ্ছে। লিথিশা ফুপি এগিয়ে এলেন। সায়ন আস্তে করে বলল,”জামা বদলে তোমার কিছু পড়তে দিও ফুপি, ঠান্ডা লেগে যাবে। আমি একটু শাওয়ার নিয়ে আসি। পুকুরের পানিতে নামা লেগেছে।”
ক্রিম কালারের তোয়ালে টা দিয়ে মুছিয়ে দিয়ে ইভার চুলগুলো পিঠময় ছড়িয়ে দিলেন লিথিশা। ইভার গায়ে আকাশী শাড়ি। গোসল করেছে একটু আগে।
-“বুঝলে মা, কামিজ তো এখন পড়া হয়না। শাড়ি ছাড়া কিছু নেই। একটু অপেক্ষা করো, তোমার জামাটা শুকিয়ে গেলেই ওটা পরে নিও।”
ইভা মাথা নাড়ালো। লিথিশা আবার বললেন,”সায়ন এলেই তোমার বাসায় জানাচ্ছি, সকালেই পৌছে দিয়ে আসবে। ভয় পেয়োনা। আসলে ও তো জানেনা তোমার বাসা কাছেই ছিলো। শহর থেকে এসেছে তো! গ্রামের কাওকেই চিনেনা। কাঁপছো কেনো? শীত করছে?”
ইভা দু’দিকে মাথা নাড়ালো। লিথিশা তার হাতদুটো ধরলেন,”শোনো মা, জীবনে সবকিছু কি আর সোজাসাপটা চলে বলো? এইযে আজ তুমি পানিতে না পড়লে কি সায়ন তোমাকে নিয়ে আসতো? তোমার সাথে আমার দেখা হতো? এত সুন্দর ফুটফুটে একটা মেয়ে যে আমার আশেপাশেই কোথাও থাকে আমি জানতে পারতাম? ভাগ্যিস পুকুরে পড়েছিলে।”
ইভা হেসে ফেললো। হাসি নিয়েই গা কাঁপিয়ে একটা হাঁচি দিলো। লিথিশা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন,”ইশ!
সায়ন এলো একটু পরে। ইভা একবার চোখ তুলেই মাথা নুইয়ে রইলো।
-“দেখি! আপনার বাসার কারো নাম্বার দিন। জানিয়ে দেই।”
ইভা সরফরাজের নাম্বার বললো। লিথিশা কথা বললেন। বোনের সাথে কথা বলে সরফরাজের প্রায় থেমে যাওয়া হৃদস্পন্দন আবার প্রান ফিরে পেলো যেনো। বারবার বললো,”আমি এক্ষুনি আসছি।” লিথিশা অনেক করে বলে মানালো তাকে। এতরাতে আসাও বিপদ। শেষমেষ কথা হলো,সকালে সে এসেই নিয়ে যাবে ইভাকে।
ইভা হাঁচি দিচ্ছে বারবার। নাকের ডগা লাল হয়ে গেছে। চোখে পানি চলে আসছে। লিথিশা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন,”ইশ! দাড়াও, গরম পানি নিয়ে আসি।”
লিথিশা ছুটে ছুটে বেরিয়ে গেলেন। এক আকাশ সংকোচ নিয়ে ইভার মাথায় হাত রাখলো সায়ন। বললো,
-“আমি বুঝিনি আপনি এতো ভয় পেয়ে যাবেন ইভা।”
ইভা নিমীলিত ভঙ্গিতে চুপসিয়ে গেলো। গলা দিয়ে কথা বেরোলো না। তবে মাথা ঝাঁকিয়ে দু’তিনটা হাঁচি
ঠি কই বেরোলো। লিথিশা পানি নিয়ে এলেন। সায়ন মাথা থেকে হাত সরিয়ে নিলো। লিথিশা একহাতে ধরে ইভাকে পানি খাওয়াতে খাওয়াতে বললেন,
-“দেখ সুন্দর লাগছে না? আর কিছু ছিলোনা বুঝলি? শাড়িটা মনে আছে? ওইযে গতবছর জন্মদিনে তুই উপহার দিলি যে?”
সায়ন মুখে বললো,”মনে আছে।” আর মনে মনে বললো,
-“মেঘের মতোন সুন্দর লাগছে।”
চলবে