উপন্যাসঃ মেঘফুল
পরিচ্ছেদঃ ০৬,০৭
লেখক- মিশু মনি
০৬
ভায়োলেট একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে জাহ্নবীর দিকে। অপ্রস্তুত ভঙ্গীতে জাহ্নবী পায়চারি করছে। কিছু একটা বলবে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু কীভাবে বলবে সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছে না। ভায়োলেট বিষয়টাকে সহজ করার জন্য নিজে থেকেই বলল, ‘আপু, কী হয়েছে?’
জাহ্নবী মুখ কাচুমাচু করে বলল, ‘তেমন কিছু না। তুই মোবাইল দেখেছিস?’
‘না তো। কেন? কী হয়েছে?’
‘শোন, তুই আর লাইব্রেরিতে যাবি না।’
‘আমি নিজেও ভেবেছি অনেকদিন আর যাবো না। কেন বলোতো আপু?’
জাহ্নবী মনেমনে স্বস্তিবোধ করল। ওর এখনো সংকোচ লাগছে কথাটা বলতে। ভায়োলেটের উত্তর শুনে হঠাৎ কথার মোড় ঘুরিয়ে ফেলল জাহ্নবী। বলল, ‘ কাল রাতে একজন কল দিয়েছিল। যার সাথে তোর লাইব্রেরিতে দেখা হয়েছে।’
‘মানে! সে আমার নাম্বার কোথ থেকে পেলো?’ অবাক হয়ে জানতে চাইলো ভায়োলেট।
জাহ্নবী উত্তর দিলো, ‘ছেলেটাকে তুই নাকি কী বলেছিস? কম্পিউটারে সবার তথ্য ছিল। সেখান থেকে জোগাড় করে ফোন দিয়েছে।’
‘অদ্ভুত ব্যাপার। ওখানকার সবাই আমাকে চেনে। ছেলেটা বলতেই তারা আমার নাম্বার দিয়ে দিলো? ইচ্ছে করছে গিয়ে সবগুলোকে ঝাড়ি দিয়ে আসি।’
জাহ্নবী খানিকটা চমকালেও সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘না না। তোর আর ওখানে যাওয়ার দরকার নেই। ছেলেটা সরি বলতে ফোন করেছে। কিন্তু ওর কথাবার্তার ধরণ আমার ভালো লাগে নি। মনে হচ্ছে লোকটা তোকে বিরক্ত করবে।’
‘আমারও ওনার চাহনি ভালো লাগে নি। আমার নাম্বার সংগ্রহ করে ফেলেছে, ছি ছি।’
জাহ্নবী বলল, ‘হুম। ছেলেটার মতলব ভালো না। তোকে বিরক্ত করতে বারবার ফোন করবে। আমার মোটেও ভালো লাগে নি কথা বলে।’
‘আচ্ছা আপু। আমি ওর নাম্বারটা ব্লক করে দিচ্ছি। তুমি এটা নিয়েই টেনশন করছো? আহারে আমার আপুরে, এসব ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে এত ভাবতে হবেনা।’
জাহ্নবী চুপ করে রইল। ভায়োলেট জড়িয়ে ধরে রইল ওকে৷ খানিকটা সময় এভাবেই কেটে যায়। সামার দরজা খুলে উঁকি দিয়ে বলল, ‘এখানে কী হচ্ছে? আমার হিংসে হচ্ছে কিন্তু।’
জাহ্নবী হেসে বলল, ‘আয়, তুইও এসে আমাকে ধর। এমনভাবে বলছিস যেন আমরা হাতিঘোড়া খাচ্ছি?’
সামার হাসতে হাসতে বলল, ‘হাতিঘোড়া খায় নাকি মানুষ? তোমরা কী নিয়ে শলাপরামর্শ করছো আমাকেও বলো?’
ভায়োলেট বলল, ‘খুবই সিরিয়াস বিষয়। আপুকে বুদ্ধি দিচ্ছিলাম দ্রুত একটা চাকরি জোগাড় করে এই বাড়ি থেকে বের হওয়ার জন্য।’
‘কেন?’
ভায়োলেট বিছানার ওপর শুয়ে পড়ল। এক হাত মাথায় হেলান দিয়ে বলল, ‘আমি জানি কীভাবে সুখী হতে হয়।’
ভায়োলেট অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। জাহ্নবী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। সামারও ভায়োলেটের পাশে শুয়ে পড়ল। বলল, ‘কীভাবে সুখী হতে হয়? বল না আমাকে?’
‘নিজেকে ভাবতে হবে অনেক সুখী। সব দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দিতে হবে। তারপর চোখ বন্ধ করে একটা সুন্দর কল্পনায় হারিয়ে যেতে হবে। যেমন জীবন তুমি চাও, সেরকম জীবন কল্পনা করবে। অনেক্ষণ পর চোখ খুলে বাস্তবে ফিরে আসবে। এরপর দেখবে বাস্তব তোমার স্বপ্নের জীবনের মতো নয়। কিন্তু কেন নয়? কারণ স্বপ্নের জীবনটা পাওয়ার জন্য আমাকে অভাবনীয় কিছু কাজ করতে হবে, যেটা আমি করিনি। তাই আমি এই জীবনে আছি। তখন তুমি বুঝতে পারবে, আসলেই তোমার কী করা উচিৎ। যেটা করলে তুমি ওই স্বপ্নের মতো জীবন পাবে।’
ভায়োলেট সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে গেল। জাহ্নবী মুগ্ধ হয়ে ওর কথা শুনছিল। সামারের পলক পড়ছে না। ভায়োলেট মাঝেমাঝে কী সব কঠিন কঠিন কথা বলে, ওর মাথাতেই ঢোকে না।
সামার বলল, ‘আমি তো অনেক সুখী। আমার তো মনেহয় যেমন জীবন আমি চেয়েছিলাম, আমি ঠিক তেমন একটা জীবনই পেয়েছি।’
ভায়োলেট এই কথার উত্তরে কোনো জবাব দিলো না। সে এখনো সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। জাহ্নবী লক্ষ করছে ভায়োলেটকে।
সামার বলল, ‘আমি এরচেয়ে সুখী হতে চাই না। একটা ভালো চাকরি করবো, তারপর পাখির মতো স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াবো। যখন যা মন চায়, তাই করবো। যা পরতে ইচ্ছে করবে, পরবো। যা খেতে ইচ্ছে করবে, খাবো। উড়ে বেড়াবো, আজ এখানে, কাল ওখানে। আজ এর বাসায় পার্টি হবে, কাল ওর বাসায় পার্টি হবে। তারপর দু চার বছর এভাবে এনজয় করার পর আমার মতো স্বাধীনচেতা একটা ছেলেকে বিয়ে করবো। দুজন মিলে রাত বিরেতে চা খেতে বের হবো। মুভি দেখতে সিনেমাহলে যাবো, বন্ধুবান্ধব নিয়ে হৈ চৈ করবো। ব্যস, বিন্দাস লাইফ। এরচেয়ে সুন্দর জীবন কে কখন কল্পনা করেছে? হা হা হা।’
জাহ্নবীও হেসে উঠলো। ভায়োলেটের মুখে মুচকি হাসি। সামার জাহ্নবীকে বলল, ‘এই আপু, তুমি কেমন লাইফ চাও?’
চমকে উঠলো জাহ্নবী। একটা গভীর নিশ্বাস নিয়ে উত্তর দিলো, ‘আমি এমন একটা জীবন চাই, যেখানে…’ আর কিছু বলতে পারল না জাহ্নবী। কারণ সে কেমন জীবন চায়, জানে না। সে শুধু জানে, তার জীবন থেকে যেন দুঃখ আর একাকীত্ব চিরতরে ঘুচে যায়। যেন কেউ একজন তার জীবনে আসে, তাকে ভালবেসে অনেক সুখী রাখে। তার জীবনে খুব বেশী চাওয়া পাওয়া নেই। একটা মানুষই তো। তারা এমন একটা বাড়িতে থাকবে, যেই বাড়ির দোতলায় খুব সুন্দর একটা খোলা বারান্দা থাকবে। বারান্দায় একটা ইজি চেয়ার, যার হাতলে রাখা থাকবে এক কাপ চা। পাঞ্জাবী পরা প্রিয় মানুষটাকে নিয়ে জাহ্নবী ওই বারান্দায় বসে চা খাবে। ঝুম বৃষ্টি নামলে দুহাত মেলে বৃষ্টিতে ভিজবে। জীবনে এতটুকুই তো ওর স্বপ্ন। এর বাইরে আর কোনো স্বপ্ন আছে কীনা, জানেনা জাহ্নবী।
সামার বলল, ‘কী ভাবছো আপু? কেমন জীবন চাও?’
‘জানিনা।’ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল জাহ্নবী।
সামার বলল, ‘ধুর। এজন্যই তোমার ওপর রাগ লাগে জানো? বেঁচে আছো কেন তুমি? কীভাবে বাঁচতে চাও সেটাই যদি না জানো তাহলে মরে যাওয়াই ভালো না?’
ভায়োলেট সামারের হাত চেপে ধরল। চোখ ভিজে উঠলো জাহ্নবীর। বলল, ‘মরেই তো গেছি। আমি বেঁচে আছি কে বললো তোদের।’
অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো জাহ্নবী। সামার জাহ্নবীর হাত ধরে বলল, ‘আমার লক্ষী আপু, রাগ কোরো না প্লিজ। আমি তোমাকে হার্ট করতে চাইনি। সরি আপু। আসলে আমি জাস্ট বলতে চাইছি, তুমি একটু জেগে ওঠো। এভাবে আর কতদিন?’
জাহ্নবী চোখ মুছল। ভায়োলেট বলল, ‘আপু, আমি তোমাকে বলেছিলাম একটা চাকরি নাও তারপর এই বাসা থেকে বের হও। তুমি কি ভাবছো বিয়ে করতে বলেছি?’
জাহ্নবী ভায়োলেটের দিকে তাকাল। ভায়োলেট বলল, ‘শোনো আপু। আমি ও মেজোপু তোমার ভালোর জন্যই এগুলো বলছি। মন খারাপ কোরো না। আমরা বুঝতে শেখার পর থেকেই দেখছি তুমি একা সব কাজ করো। কখনো আমাদেরকেও কাজে হাত লাগাতে দাওনি। এমনভাবে সবকিছু সামলাও যেন এই সংসারটা তোমার। মা এজন্যই তোমাকে পছন্দ করে না। তুমি কী সেটা জানো?’
জাহ্নবী মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ। আমি জানি। মা আমাকে একটু পছন্দ করে না।’
সামার বলল, ‘মা আসলে রেগে গেছে। আমরা পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াবো বলে কখনো আমাদের ওপর বিয়ের চাপ দেয়নি। কিন্তু তাই বলে এই না যে, তুমি বিয়ে করবে না অথচ মা সেটা সহ্য করতে পারবে।’
জাহ্নবী বলল, ‘আমি কী করবো বল? আমার বিয়ে না হলে আমার কি করার আছে?’
‘অনেক কিছুই করার ছিল আপু। তুমি কখনো কোনো ছেলেকে তোমার কাছে ঘেঁষতে দাও নি। কখনো কোনো বিয়ের প্রস্তাব এলে সোজা না করে দিয়েছ, তোমার নাকি বিয়েশাদির ব্যাপারে আগ্রহ নেই। এখন যখন বয়স অনেক হয়ে গেছে, নিঃসঙ্গ জীবন ভালো লাগছে না, নিশ্চয় তুমিও চাও তোমার বিয়ে হোক?’
ভায়োলেট রেগে বলল, ‘তুই বড্ড বেশি কথা বলিস মেজোপু। একটা মানুষের জীবনে বিয়েটাই সবকিছু না। বিয়ে করে আজীবন গাধার মতো খাটবে, নিজের শখ কিংবা ইচ্ছে কোনোটাই পূরণ করবে না, সেটাও তো জীবনে আসল সুখ নয়। আপু যেটাতে সুখী হবে, সেটাই করুক না।’
সামার নিজেও পালটা জবাব দিলো, ‘আপু কী চায় সেটা তো নিজেই জানেনা। বিয়ে ভালো না লাগলে লাইফে অন্যকিছু থাকুক ভাললাগার মতো। আপু তো সারাক্ষণ রান্নাঘর, রুটি, ভাত, তরকারি, থালাবাসন নিয়েই পড়ে থাকে। সে অনেক ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিল। একটা ভালো ক্যারিয়ার বেছে নিয়ে নিজের খেয়াল খুশিমত জীবনযাপন করতে পারতো। যা যা করতে ইচ্ছে করতো, সেটাই করে নিজের মতো লাইফ লিড করতে পারতো। সে বিয়েও করলো না, কোনো ক্যারিয়ারও বেছে নিলো না। এভাবে ঘরে বসে বসে ডিপ্রেসড থাকার কোনো মানে হয়?’
জাহ্নবী মাথা নিচু করে আছে। ভীষণ মন খারাপ হয়েছে ওর। ছোট বোনদের সঙ্গে কখনো হাসি আড্ডায় যোগ দেয়নি সে। কারণ কীভাবে আড্ডা দিতে হয়, জাহ্নবী সেটাই জানেনা। সে সবসময় এ বাড়িতে থেকেছে ঠিকই, কিন্তু সবার থেকে দূরে, সবার থেকে আলাদা হয়ে। আজ যখন তিনবোন মিলে একসঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছে, তখন তার দোষ ত্রুটি গুলোই যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হচ্ছে।
ভায়োলেট জাহ্নবীকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আপু তুমি কষ্ট পেও না। মেজোপুর মাথা গরম, উলটা পালটা কথা বলে। মেজোপু, তুমি না বাইরে যাবে? এখন যাও তো। আমি আপুর সঙ্গে কথা বলি।’
জাহ্নবী বলল, ‘না, তোরা থাক। আমি যাই, রান্না বসাতে হবে।’
ভায়োলেট জাহ্নবীর হাত টেনে ধরে বলল, ‘কোথাও যাবে না তুমি। এখানে বসো। আমরা তোমার সাথে বড় হওয়ার সুযোগ পাইনি ঠিকই কিন্তু তোমাকে অনেক ভালবাসি আপু।’
জাহ্নবী কেঁদে ফেলল। মুখ তুলে তাকাতে পারল না সে। ভায়োলেট বলল, ‘আপু, আমাদের জীবনটা ছোট এটা সবাই বলে। কিন্তু তুমি নিশ্চয়ই জানো, এই জীবনটা আসলে ছোট না। ৩৬৫ দিনের একেকটা বছর মোটেও কম নয়। আমরা চাইলেই জীবনকে খেয়াল খুশিমতো ছেড়ে দিতে পারিনা আপু। আমাদের এটাকে গুছিয়ে নেয়া উচিত।’
জাহ্নবীর চোখ মুছে দিয়ে সামার বলল, ‘সে এখন মোটিভেশন দিবে। আমি যাই, বের হবো। থাকো আপু, রাগ করে থেকো না।’
জাহ্নবীর গালে একটা চুমু দিয়ে সামার বেরিয়ে গেল। ভায়োলেট জাহ্নবীর মুখখানা ধরে বলল, ‘আপু। দেখি আমার দিকে তাকাও। মন খারাপ করছো কেন? হাসো তো দেখি। আমার সুন্দর আপু।’
জাহ্নবী মাথা তুলে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল। ভায়োলেট বলল, ‘তুমি তোমার জগতটাকে অনেক ছোট করে ফেলেছ আপু। এই ছোট্ট গণ্ডি থেকে বের হও। একটা চাকরি হলে আলাদা বাসা নিয়ে থাকো। জীবনকে দেখো, একটা অন্যরকম জীবন উপভোগ করো। মা’র চিল্লাচিল্লি নেই, সবার জন্য রান্না করার প্রেশার নেই, থালাবাসন ধোয়ার পেরেশানি নেই। শুধু খাবে, ঘুমাবে, বই পড়বে, অফিস করবে আর নিজের মতো জীবনকে উপভোগ করবে। বিশ্বাস করো, তুমি এই হতাশার জীবন থেকে বের হয়ে আসতে পারবে। আমার কথাটা একবার শুনে দেখো।’
জাহ্নবী ভায়োলেটের হাত মুঠো করে ধরে বলল, ‘হুম। দোয়া কর যেন একটা চাকরি পেয়ে যাই।’
‘অবশ্যই। তুমি অনেক মেধাবী। প্রস্তুতি নাও শুধু।’
‘হ্যাঁ, আজ থেকে প্রস্তুতি নিবো। আমি যাই, কাজগুলো শেষ করে আসি।’
ভায়োলেট বলল, ‘উহু, তুমি এখানেই থাকো। কাজের জন্য আমি আছি, মা আছে, বুয়া আসবে। তোমার এত মাথাব্যথা নিতে হবে না। তুমি পড়াশোনা করো আর সুন্দর একটা চাকরি পেয়ে আমাকে ভালো একটা রেস্টুরেন্টে খাওয়াও ‘
জাহ্নবীর বুক ফেটে কান্না আসতে চাইছে। ভায়োলেটকে জড়িয়ে ধরল জাহ্নবী। ওর হঠাৎ মুক্তির স্বাদ অনুভূত হচ্ছে। যেন এত বছর ধরে নিজেই নিজের তৈরিকৃত খাঁচায় আবদ্ধ ছিল সে। আজ যেন তার ঘুম ভেঙেছে। উত্তেজনায় কাঁপছে পুরো শরীর।
ভায়োলেট যখন ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো, জাহ্নবী ভায়োলেটের ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ওই নাম্বারটা ব্লক করে দিস। আমি সরি যে, তোর কলটা আমি রিসিভ করেছিলাম।
ভায়োলেট মুচকি হেসে বলল, ‘কোনো সমস্যা নেই আপু। আমি নাম্বারটা এক্ষুণি ব্লক করে দিবো।’
ভায়োলেট ঘর হতে বের হওয়ামাত্রই দেখল পারভীন খাবার টেবিলে গম্ভীরমুখে বসে আছেন। ভায়োলেট বলল, ‘মা, কী হয়েছে?’
‘কিছু না। জাহ্নবীকে বলতো মাছটা কেটে ধুয়ে নিতে। ইলিশ মাছ আনছে। তোর বাপকে জিজ্ঞেস কর ইলিশ পোলাও খাবে নাকি সরষে ইলিশ করতে বলে।’
ভায়োলেট বলল, ‘কোনোটাই না। সাদা ভাত দিয়ে মচমচে মাছ ভাজি, আর বেগুন দিয়ে ইলিশ মাছের তরকারি। তুমি খুব সুন্দর করে এটা রান্না করতে। অনেকদিন খাইনা। আজকে তুমি রান্না করো মা।’
পারভীন নিরুত্তর মুখে ভায়োলেটের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এমন সময় ঘর থেকে বের হল জাহ্নবী। ভায়োলেটের কাছে এসে দাঁড়াতেই ভায়োলেট বলল, ‘আপু, তোমাকে কী বলেছি?’
জাহ্নবী মৃদু স্বরে বলল, ‘আমি রান্নাঘরে যাবো না। তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে এসেছি।’
‘কী কথা বলো?’
জাহ্নবী গলার স্বর আরও নীচু করে বলল, ‘তুই কেমন জীবন চাস এটা শোনা হয় নি।’
ভায়োলেট মুচকি হেসে বলল, ‘পরে বলবো।’
চলবে..
উপন্যাসঃ মেঘফুল
পরিচ্ছেদঃ ০৭
লেখক- মিশু মনি
রাত সাড়ে এগারো টা।
জাহ্নবী বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে বই পড়ছে। বারবার চোখ বুজে আসছে ঘুমে। ভায়োলেট দরজায় ঠকঠক শব্দ করে বলল, ‘আসবো আপু?’
জাহ্নবী দরজা খুলে দেখল ভায়োলেট বালিশ নিয়ে এসেছে। আজকেও ভায়োলেট ওর সঙ্গে ঘুমাবে। জাহ্নবী বলল, ‘এসেছিস ভালো হয়েছে। আমার খুব ঘুম পাচ্ছিল।’
ভায়োলেট ঝলমলে গলায় বলল, ‘তাহলে এক কাজ করি চলো। গল্প করি। ঘুম পালিয়ে গেলে আবার পড়তে বসবে।’
জাহ্নবী হাসল। তখন চোখ গেল ভায়োলেটের হাতে থাকা মোবাইলটার দিকে। অর্জন নামের ছেলেটার সঙ্গে কথা বলার ব্যাপারটা ভাবতেই ওর গা ঝমঝম করে উঠল।
ভায়োলেট শুয়ে পড়ল। সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে হাস্যজ্জ্বল মুখে বলতে লাগল, ‘মেজোপু কাল বেড়াতে যাবে।’
‘বেড়াতে যাবে? কোথায়?’
‘জানিনা। চট্টগ্রাম বা ওদিকে কোথাও। আমি ভালো করে শুনিনি।’
‘ একা যাচ্ছে?’
‘না। ওরা বন্ধুবান্ধব মিলে।’
জাহ্নবী ভায়োলেটের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর দুজনেই চোখে চোখে কিছু একটা বলতে পেরে হেসে উঠল একইসঙ্গে। সামারের প্রেমিকও নিশ্চয়ই সঙ্গে যাবে। সামারের সৌভাগ্যবান প্রেমিক পুরুষটি কে, সেটা আজও জানা হয়নি জাহ্নবীর।
জাহ্নবী ভায়োলেটকে স্পর্শ করে ফিসফিস স্বরে বলল, ‘আচ্ছা, ও কার সঙ্গে প্রেম করে রে?’
‘একটা ছেলের সঙ্গে। এখনো প্রেম হয় নি সেভাবে।’
‘সেভাবে মানে? প্রেমের আবার সেভাবে এভাবে আছে নাকি?’
‘আছে না আবার? সবেমাত্র ফোনে কথা বলছে, মাঝেমাঝে দেখাসাক্ষাৎ হয়। এরপর প্রেম হতেও পারে, নাও হতে পারে।’
জাহ্নবী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উত্তর দিলো, ‘প্রেম হলে ওরা বিয়ে করে ফেলবে তাই না?’
ভায়োলেট নিঃশব্দে জাহ্নবীর চোখের দিকে তাকালো। অনেক্ষণ কেউ কোনো কথা বলতে পারল না। জাহ্নবী বই খুলে পড়তে আরম্ভ করলো।
রাত বেড়ে গেল অনেক। জাহ্নবী বেশ কয়েকবার ভায়োলেটকে ডেকে কোনো সাড়া পেলো না। খানিক্ষণ পর ভায়োলেটের মোবাইলটা হাতে তুলে নিলো জাহ্নবী। ডায়াল লিস্টে ঢুকে দেখল অর্জন আরও ফোন করেছিল কী না। অর্জনের নাম্বার থেকে কোনো কল কিংবা মেসেজ আসে নি। স্বস্তিবোধ করল জাহ্নবী। ইচ্ছে করছিল একবার কল আসুক, সে কল কেটে দেবে। কিংবা রিসিভ করে খুব করে বকা দিয়ে দেবে। পরক্ষণেই ভায়োলেটের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবল, ‘ও অনেক নিষ্পাপ। আমার ওর সঙ্গে সৎ থাকা উচিৎ।
কথাটা ভাবামাত্রই ভায়োলেটের মোবাইল রেখে দিলো জাহ্নবী। এক ধরণের শান্তি অনুভব করল মনে।
সামার আজ ঘুরতে যাচ্ছে বন্ধুদের সঙ্গে। সকাল সকাল বাবার কাছে টাকা নিয়ে তৈরি হচ্ছে কেনাকাটা করতে যাওয়ার জন্য। জাহ্নবী ওর রুমে চা দিতে এলে সামার জিজ্ঞেস করল, ‘আপু, যাবি?’
জাহ্নবীর ইচ্ছে করছিল সামারের সঙ্গে মার্কেটে যেতে। গত দু বছরে ওর মার্কেটে ঘুরে ঘুরে কেনাকাটা করা হয়নি। দুই ঈদে জামাকাপড় কেনার সময় সামার ও ভায়োলেট ওর জামা কিনে এনেছে। নিজের জন্য কখনো শপিংয়ে যাওয়ার ইচ্ছে বা সুযোগ কোনোটাই হয়নি জাহ্নবীর। কয়েকদিন ধরে দুই বোনের সঙ্গে মিশতে শুরু করেছে সে। বিশেষ করে ভায়োলেটের সঙ্গে দারুণ গল্প হয়, ভায়োলেট ওর রুমেই শুতে আসে রোজ। জীবনটাকে আজকাল অতটাও খারাপ লাগছে না। সামারের সঙ্গে শপিংয়ে যাওয়ার সুযোগটাকে একদমই মিস করতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু আসল ব্যাপার হচ্ছে জাহ্নবীর হাত ফাঁকা। ছোটবোন নিজের টাকায় কেনাকাটা করবে আর সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে, বিষয়টা লজ্জাজনক দেখাবে। নিজে থেকে ‘আমি পেমেন্ট করে দিচ্ছি’ বলতে না পারলেও অন্তত ‘এটা আমার পক্ষ থেকে তোর জন্য’ বলার মাঝেও একটা শান্তি শান্তি ব্যাপার আছে।
জাহ্নবী বলল, ‘ না রে যাবো না। তুই ভায়োলেটকে নিয়ে যা।’
‘ ও কোথায় যেন আটকে গেছে। আর ও বড্ড তারাহুরো করে। ওর সঙ্গে শপিংয়ে গিয়ে মজা নেই। শপিং মানেই তো সব মার্কেট ঘুরবো, রং বেরঙেত জিনিস দেখবো, দামাদামি করবো। সময় লাগে না বলো?’
জাহ্নবী মুচকি হেসে বলল, ‘তাহলে একাই যা।’
‘আপু, কথা না বাড়িয়ে রেডি হয়ে নাও। আজকে আমরা একসঙ্গে শপিংয়ে যাবো।’
জাহ্নবী চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। রীতিমতো ধমকের সুরে সামার ওকে প্রস্তুত হতে বললে দ্রুত তৈরি হয়ে নিলো জাহ্নবী। বের হওয়ার পূর্বে জাহ্নবী বাবার কাছে বিদায় নেয়ার কালে তিনি জাহ্নবীকে কাছে নিয়ে বললেন, ‘মা, এই টাকাটা রাখ।’
জাহ্নবী অনেক্ষণ অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে রইল। বুকের ভেতর জমে থাকা শূন্যতা ভরাট হতে শুরু করেছে। মাথার ওপর বাবা থাকা মানেই যেন একটা ছাদ। রোদ হোক, বৃষ্টি হোক, বাবা আছে মানে আমি ভিজবো না। জাহ্নবী বাবাকে জড়িয়ে ধরার ইচ্ছেটাকে সামলে নিয়ে প্রফুল্ল মুখে শুধু বলল, ‘ধন্যবাদ বাবা।’
রিকশায় উঠে জাহ্নবীর দারুণ ফুরফুরে লাগতে শুরু করেছে। বাতাসে চুল উড়ছে, সামারের গা থেকে ভেসে আসা সুগন্ধে ওর সবকিছুই অন্যরকম লাগছে। সামার এরই ফাঁকে দুজন বান্ধবীর সঙ্গে ফোনে কথা বলে ট্যুরের ব্যাপারে আলাপ করল। জাহ্নবী জিজ্ঞেস করলো, ‘ কোথায় যাচ্ছিস ঘুরতে?’
‘বান্দরবান। আজকে রাতে বাস। অথচ এখনো ওরা ব্যাগ গোছায় নাই। পরে এটা ওটা ফেলে রেখে যাবে আর আমাকেই গুতাবে, সামার তোর এইটা দে না, সামার তোর ওইটা দে না।’
জাহ্নবী শব্দ করে হেসে বলল, ‘তোরা অনেক মজা করিস তাই না?’
‘তা তো করি ই। আমার ফ্রেন্ডস রা সবাই অনেক জোস। আজকে দুইজন আসবে, পরিচয় হলে দেখো।’
জাহ্নবী ইতস্তত বোধ করল। সে কারও সঙ্গে অত সহজে মিশে যেতে পারে না। অপরিচিত কারও সাথে কথা বলতে সংকোচ বোধ করে। চুপচাপ বসে থাকতে খুবই লজ্জা লাগে ওর। সামার ও ভায়োলেটের বান্ধবীরা প্রায়ই বাসায় আসে। জাহ্নবী প্রয়োজন ছাড়া তাদের সামনে যেতেও দ্বিধাবোধ করে। আজ ওদের সঙ্গে কীভাবে আলাপ করবে সেটা ভেবেই মনেমনে প্রস্তুতি নিতে লাগল।
‘হ্যালো আপু, কেমন আছেন আপনি?’
‘আমি ভালো আছি। তোমরা কেমন আছো?’
‘ভাল।’
‘আজকে তো ঘুরতে যাবে। কেমন লাগছে তোমাদের?’
‘অনেক আনন্দ হচ্ছে আপি। আমরা তো খুবই এক্সাইটেড। অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গা দেখব, বন্ধুরা মিলে হৈ চৈ করবো। খুব মজা হবে।’
‘ বাহ। বেশ ভাল। সামারের দিকে খেয়াল রেখো কিন্তু। ও একটু উদাসীন নিজের ব্যাপারে।’
‘আমাদের খেয়াল রাখতে হবে না আপু। ওর খেয়াল রাখার জন্য লোক আছে।’
জাহ্নবী কথাগুলো ভেবেই ফিক করে হেসে উঠল। ওদের সঙ্গে এভাবেই আলাপ করবে সে। একটু দ্বিধা কিংবা সংকোচ করবে না। আজ সে অনেক আত্মবিশ্বাস ধরে রাখবে। হাসিমুখে কথা বলার চেষ্টা করবে।
সামার জানতে চাইল, ‘কি দেখে হাসছো?’
‘কিছু না।’
‘কার কথা মনে হয়েছে?’
জাহ্নবী মনেমনে বলল, ‘তোর প্রেমিকের কথা।’ কিন্তু এক কথা কখনোই সে মুখে বলতে পারবে না। সামার ও ভায়োলেট যতটা ফ্রি, তার পক্ষে এমন হওয়া সম্ভব হবেনা কখনো। একটা নিশ্বাস ফেলল জাহ্নবী।
নিউমার্কেট ও চাঁদনী চক ঘুরেঘুরে জিন্স, টপস কিনল সামার। প্রচণ্ড ভীড় ঠেলে দিব্যি হেঁটে হেঁটে কেনাকাটা করছে সে। এদিকে জাহ্নবীর অবস্থা ত্রাহি ত্রাহি। ভীড়ের ভেতর মানুষ তাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে অথচ সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বারবার হাসিতে ফেটে পড়ছে সামার।
জাহ্নবী বলল, ‘এই মিছিলের ভেতর মানুষ কেনাকাটা করে কীভাবে?’
‘এভাবেই করতে হয় আপু।’
‘আমি অনেক আগে একবার এসেছিলাম। তখন এত ভীড় ছিল না।’
‘নিউমার্কেটে ভীড় ছিল না? বিশ্বাস হল না কথাটা।’
সামার জাহ্নবীর হাত ধরে ভীড়ের মধ্য থেকে বেরিয়ে এলো। জাহ্নবীর ধারণা ছিল রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বড় বড় শপিংমল গুলোতে যাবে সামার। যেখানে কাঁচের ভেতর ম্যানিকুইনগুলো চমৎকার জামাকাপড় পরে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু হাজার হাজার লোকের ভীড় ঠেলে কেনাকাটা করতে হবে এমনটা ভাবেনি সে।
সামার আবারও রিকশা নিলো। জাহ্নবীর জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছিল ‘আমরা কী বাসায় যাচ্ছি? তোর বান্ধবীরা কি আসবে না?’
কিন্তু জিজ্ঞেস করতে পারল না। রিকশা থেকে নেমে ওরা দোতলায় উঠতে লাগল। জাহ্নবী অবাক হয়ে দেখল, সে এতক্ষণ যেমন শপিংমলের কথা ভাবছিল, এবার তেমনই একটা মলে এসেছে ওরা। দারুণ দারুণ জামাকাপড় চারপাশে।
সামার জাহ্নবীকে নিয়ে হাঁটতে লাগল। জাহ্নবী চোখ ঘুরিয়ে জামাকাপড় দেখছে। সামার একটা ছেলেকে দেখে রীতিমতো ধমকের সুরে বলল, ‘আমাকে এতক্ষণ অপেক্ষা করাইছস ক্যান?’
‘সরি দোস্ত। রাস্তায় জ্যাম ছিল।’
‘রাস্তায় জ্যাম ছিল নাকি তোর সুন্দরী স্নিগ্ধা ছিল?’
‘স্নিগ্ধা এত সকালে ঘুম থেকে উঠে না।’
‘তুইও কি ওর সঙ্গে ঘুমাচ্ছিলি নাকি?’
‘ঘুমাতে পারলে তো ভালোই হইতো। ঘুমাতে দেয় আর কই?’
ছেলেটা দাঁত বের করে হাসছে। সামার একটা মাইর দিল ওর বন্ধুর কাঁধে। জাহ্নবী লজ্জা পাচ্ছে। বড়বোনের সামনে এভাবে দুষ্টুমি করছে ওরা। এত ফ্রি কীভাবে হয় মানুষ!
ছেলেটা জাহ্নবীকে বলল, ‘হ্যালো। আমি সোহান।’
জাহ্নবী বলল, ‘আমি জাহ্নবী।’
‘মাই গড! আপনি বড় আপু? সামার তুই আগে বলবি না উনি তোর বড় আপু? আপু আসসালামু আলাইকুম। বেয়াদবি মাফ করবেন।’
আবারও হাসল ছেলেটা। জাহ্নবী মুচকি হেসে বলল, ‘ইটস ওকে।’
সোহান বলল, ‘আমি ভেবেছিলাম আপনি ওর জুনিয়র মানে ছোটবোন। নিজের বোন না, ওর আবার বোনের অভাব নাই। প্রত্যেকদিন নতুন নতুন বোন নিয়ে আসে।’
জাহ্নবী মনেমনে খুশি হল। হঠাৎ মনে হল, ‘আমাকে দেখেই তো মানুষ ভাবে আমার বয়স চল্লিশ। আমাকে দেখতে কী আজকে ছোটবোনের মতো লাগছে? নাকি ছেলেটা কথার কথা বলল?’
জাহ্নবী উৎসুক চোখে ভাবতে লাগল কথাগুলো। সোহান বলল, ‘কি কিনছোস?’
‘তেমন কিছু না। তোর শার্ট দেখছোস? রুবাইয়া কতদূর? ওরে ফোন দে তো ‘
‘রুবাইয়া বলসে সামারের টাকায় যা যা কেনার কিইনা ল। আমি সামারের কাছে টাকা পাই ‘
‘টাকা পায় মানে? কিসের টাকা?’
‘আরে আমি কি জানি? ও বলসে।’
‘ঢপ মারাস না? আমি কোনোদিনও ওর কাছে টাকা নেই নাই। তুই বানাই বানাই বলছস।’
সামার আবারও মাইর দিল সোহানকে। জাহ্নবী দাঁড়িয়ে রদাঁড়িয়ে ওদের খুনসুটি দেখতে লাগল। সোহানের চোখে চশমা, গালে ছোট ছোট দাড়ি। হলুদ কালো ডোরাকাটা টি শার্টে ভীষণ ভদ্র দেখাচ্ছে সোহানকে। ওরা দুজন কথা বলতে বলতেই জামাকাপড় দেখতে লাগল। জাহ্নবী দাঁড়িয়ে রইলো একদিকে। দোতলার কাঁচ দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির পূর্বে আবহাওয়া যেমন মেঘাচ্ছন্ন অন্ধকারে ছেয়ে যায়। হঠাৎ করেই সবকিছু ভালো লাগছে জাহ্নবীর, ভীষণ ভালো লাগছে।
সামার এসে বলল, ‘আপু এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? আসো। আমাদের হয়ে গেছে।’
মার্কেটের অন্য এক দিকে একটা কফিশপে এসে বসল ওরা। রুবাইয়া নামের মেয়েটা এসে পড়ল। জাহ্নবীকে আগেই দেখেছে রুবাইয়া। এসেই আগে জাহ্নবীকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘হাই আপু। কেমন আছো?’
জাহ্নবী মনেমনে খুব অবাক হল। ও যা ভেবে রেখেছিল, সেটাকে এখন একেবারেই সেকেলে মনে হচ্ছে ওর। সামার ও তার বন্ধুরা ওর ভাবনার চাইতেও অনেক গুণ এগিয়ে। রুবাইয়ার গা থেকে আসা সুবাসে জাহ্নবীর মনে হল, রুবাইয়া যেন ওরই বন্ধু।
কফি খেতে খেতে ওরা বিভিন্ন প্লান নিয়ে কথা বলছিল। জাহ্নবী বুঝতে পারল না সেসব। তবে মুগ্ধ হয়ে শুনছিল। রুবাইয়া গাড়ির টিকেট বের করে টেবিলে রাখল, নোটপ্যাডে ট্যুরের যাবতীয় হিসাব নিকাশ দেখাতে লাগল ওদেরকে। সোহান মাঝেমাঝে হাস্যকর কথা বলে সবাইকে হাসাচ্ছিল। বাস ছাড়বে রাত এগারোটায়। সবার সিট সামনে পড়েছে, কেবল একটা সিট পিছনের দিকে। সেখানে কাকে বসতে হবে এটা নিয়েও তিনজনের এক পশলা তর্ক হয়ে গেল। গাড়ি থেকে নেমে তারা আগে নাস্তা করবে তারপর অন্য একটা গাড়ি তাদের নিয়ে যাবে। পথে বিভিন্ন জায়গায় সাইটসিয়িং করানো হবে। সবকিছু শুনতে শুনতে জাহ্নবীর মনে হচ্ছিল সে একটা স্বপ্নের জগতে আছে। সামার এজন্যই হয়তো বলেছিল, সে যেমন লাইফ চায় ; এখন সেই লাইফটাই এনজয় করছে। এরচেয়ে বেশী কিছু চাইনা তার।
এক পর্যায়ে রুবাইয়া জাহ্নবীকে বলল, ‘আপু, সরি আমরা আসলে ট্যুর নিয়ে আলাপ করছিলাম। আপনাকে বিরক্ত হতে হচ্ছে তাইনা?’
‘আরে না না, আমি ভালোই মজা পাচ্ছি। সমস্যা নেই।’
‘আপু, আপনিও চলুন না আমাদের সঙ্গে। অনেক মজা হবে।’
বুকটা ধক করে উঠলো জাহ্নবীর। সত্যিই কী তা কখনো সম্ভব! সে যাবে ওদের সঙ্গে? এটা তো স্বপ্ন স্বপ্ন ব্যাপার। কিন্তু আগামীকাল ওর ইন্টারভিউ আছে। যেটা সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ এই মুহুর্তে।
সোহান ও সামার জাহ্নবীকে যেতে অনুরোধ করল। জাহ্নবী বলল, ‘অন্য একদিন যাবো। এবার তোমরা ঘুরে আসো।’
তিন বন্ধু আবারও মেতে উঠল আড্ডায়। কফির কড়া সুঘ্রাণে জাহ্নবী ওদের খুনসুটি শুনতে শুনতে বাইরে তাকিয়ে রইল। তার যদি চাকরিটা হয়ে যায়, পরের বার সে-ও যাবে সামারের সঙ্গে। নিজের উপার্জনের টাকা দিয়ে ঘুরতে যাবে সে। ভাবতেই প্রশান্তিতে বুক ভরে গেল। জীবনটা হঠাৎ ই দারুণ ভালো লাগছে জাহ্নবীর।
হঠাৎ জাহ্নবী বলল, ‘আমি একটু আসছি।’
বন্ধুদের মাঝে এ নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। ওদের মাঝখান থেকে উঠে এসে রেস্টুরেন্টের বিল পরিশোধ করে দিলো জাহ্নবী। বড় বোন হিসেবে এটা করাটা আনন্দের ব্যাপার। জাহ্নবী আরও কিছু খাবার অর্ডার দিয়ে বলল ওদের টেবিলে দিয়ে আসতে। খাবার দেখে অবাক হয়ে গেল ওরা। জাহ্নবী মনেমনে হাসলো। জাহ্নবীর মনে হচ্ছে, ধীরেধীরে ঘুম ভাংছে ওর। এত বছরের জটিল ঘুম শেষে মুক্তির স্বাদ পেতে শুরু করেছে জাহ্নবী।
চলবে..