উপন্যাসঃ মেঘফুল
পরিচ্ছেদঃ ০৮,০৯
লেখক- মিশু মনি
০৮
জাহ্নবী চাকরির ইন্টারভিউতে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ভালো করেছে। ফলাফল কী আসে এখন সেই অপেক্ষার প্রহর গুণতে হবে। জাহ্নবী ইতিমধ্যেই সেই প্রহর গুণতে আরম্ভ করে দিয়েছে। কলিংবেলের আওয়াজ শুনে তার ভ্রম ভাঙলো।
লুকিং গ্লাসে চোখ রেখে রীতিমতো চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল তার। সেদিনের ওই লোকটা এসেছে, কী যেন নাম? অর্ণব! জাহ্নবী দরজা খুলে খানিক্ষণ তাকিয়ে রইল অর্ণবের দিকে। হাতে ব্যাগ, চোখে সানগ্লাস আর ঘর্মাক্ত শার্টে কিম্ভূতকিমাকার দেখাচ্ছে তাকে।
অর্ণব বলল, ‘আসতে পারি?’
‘হ্যাঁ আসুন না। বাবা তো বাসায় নেই।’
অর্ণব অস্বস্তিতে পড়ে গেল। আজকে সে শুধু জাভেদ আলীর কাছেই আসে নি, আজ সে সুখবর জানাতে এসেছে। সুখবরের সঙ্গে এনেছে কুমিল্লার মাতৃভাণ্ডারের রসমালাই। সবাইকে মিষ্টিমুখ করানোই তার নৈতিক ইচ্ছা।
জাহ্নবী অর্ণবকে বসতে বলে পারভীনকে খবরটা দিয়ে এলো। অর্ণবের আবারও আসার পেছনের কারণ জানতে না পারলেও বিরক্ত হয়েছেন তিনি। বিরসমুখে জাহ্নবীকে বলে দিলেন, ‘ তোর বাপকে কল দিয়ে বল। ছেলেটাকে চা নাস্তা খাওয়া। বাপের সমাজসেবার ষোলকলা পূর্ণ কর বাপ মেয়ে মিলে।’
জাহ্নবী অর্ণবের সামনে সোফায় বসল। এদিক সেদিক তাকিয়ে আমতা আমতা করতে লাগল জাহ্নবী। অর্ণব রসমালাইয়ের প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এটা রাখুন।’
জাহ্নবী বলল, ‘এটার কী দরকার ছিল বলুন তো?’
‘দরকার তো অবশ্যই ছিল। একটা সুখবর আছে।’
‘কী! ‘
‘আমার চাকরি হয়েছে।’
‘বাহ, খুব ভালো সংবাদ।’
মিষ্টি করে হাসল জাহ্নবী। অর্ণব বসে রইল শান্ত হয়ে। জাহ্নবীর হঠাৎ মনে হল, আজকে অর্ণবকে অনেক আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছে। গতদিনের তুলনায় সে খুবই স্মার্ট এবং শান্ত। চাকরি হওয়াটাই নিশ্চয়ই এর কারণ! মানুষের মাঝে যখন স্বনির্ভরতা আসে, নিজেও সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।
জাহ্নবী বাটিতে করে রসমালাই ও নাস্তা এনে দিলো অর্ণবের জন্য। অর্ণবকে বলল, ‘আপনি হাতমুখ ধুয়ে আসুন।’
‘ কিছু মনে না করলে আমি একবার ওয়াশরুমে যেতাম। চট্টগ্রাম থেকে এসেছি তো।’
‘ ওহ! সরি। আমারই বলা উচিৎ ছিল।’
অর্ণবকে বাথরুম দেখিয়ে দিলো জাহ্নবী। হাতমুখ ধুয়ে এসে বসল অর্ণব। জাহ্নবী চা নিয়ে বসে আছে। অর্ণব বিভ্রান্তিতে পড়ে গেল, আগে নাস্তা খাবে নাকি চা? চা তো ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
জাহ্নবী হেসে বলল, ‘ চা খেয়ে নিন আগে।’
অর্ণব হাত বাড়িয়ে টেবিল থেকে চায়ের কাপ তুলে নিলো। ধন্যবাদ জানালো চায়ের জন্য। চা খাওয়া শেষ করে নাস্তা খেলো অর্ণব। জাহ্নবী বাবার জন্য অপেক্ষা করছে। অর্ণবকে একাকী বসিয়ে রেখে ভেতরে যেতেও পারছে না সে।
কিছুক্ষণ পর জাহ্নবী বলল, ‘আপনি আমার রুমে গিয়ে বিশ্রাম নিন। আব্বু চলে এলে আসবে একটু পরেই।’
অর্ণব ইতস্তত করতে করতেই ব্যাগ নিয়ে জাহ্নবীর ঘরে চলে গেল। জাহ্নবী বসে রইল শান্ত ভঙ্গীতে। অদ্ভুত ব্যাপার, গত বারের মতো আজ ওর বিরক্ত লাগছে না, অস্বস্তি হচ্ছে না, এমনকি মুহুর্তের জন্যও মনে হচ্ছে না, মেহমান কেন তার রুমে গেল? বরং মেহমানকে আপ্যায়ন করতে পেরে খুশি খুশি লাগছে। নিজের মাঝে আসা অদ্ভুত পরিবর্তন টের পেয়ে ভালো লাগায় ভেতরটা ছেঁয়ে গেল জাহ্নবীর।
অর্ণব দরজায় দাঁড়িয়ে গলা খাকাড়ি দিয়ে জাহ্নবীকে ইশারা করল। জাহ্নবী জানতে চাইল, ‘বলুন?’
‘ফোনের চার্জার হবে? আমার চার্জারটা এখানে লাগছে না। মাল্টিপ্লাগ হলেও হবে।’
জাহ্নবী ঘরে প্রবেশ করল। দরজায় দাঁড়িয়ে রইল অর্ণব। জাহ্নবীর বেশ লজ্জা লজ্জা লাগছে। ড্রয়ার হতে চার্জার বের করে টেবিলে রাখল সে। বের হওয়ার সময় অর্ণব বলল, ‘ থ্যাংকস আপু।’
জাহ্নবী অর্ণবের দিকে এক পলক তাকালো। কোনো উত্তর দিতে পারলো না। অর্ণব চার্জার হাতে নিয়ে দেখল এই চার্জারের পিন দিয়ে তার ফোনে চার্জ দেয়া সম্ভব না। অর্ণব আবারও জাহ্নবীকে বিরক্ত করতে চাইলো না। তাই চুপচাপ বসে রইল জাহ্নবীর বিছানায়। মেয়েদের অসাধারণ করে ঘর গোছানোর ব্যাপারটা ওকে মুগ্ধ করে। চারপাশে চোখ বুলিয়ে সব মেয়েলি জিনিস দেখতে পাচ্ছে সে। অর্ণব চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইল।
ভায়োলেট বাসায় ফিরে জাহ্নবীকে জিজ্ঞেস করল, ‘অর্ণব সাহেব এসেছে নাকি?’
জাহ্নবী অবাক হলো, ‘হ্যাঁ। তুই কিভাবে জানলি?’
‘ ওনার জুতা দেখলাম দরজার সামনে।’
‘বাপরে, তুই মানুষের জুতাও মনে রাখিস?’
‘এটা একটা সাধারণ ব্যাপার আপু। মনে রাখার মতো কিছু না।’
ভায়োলেটকে আজ অনেক বিক্ষিপ্ত দেখাচ্ছে। জাহ্নবী ভায়োলেটের ঘরে বসে আছে। ভায়োলেট গোসল করতে ঢুকে অনেক্ষণ সময় কাটালো। নিশ্চয়ই ওর কিছু হয়েছে। জাহ্নবী অনেক কষ্টে দমিয়ে রাখলো কৌতুহল।
ভায়োলেট ভেজা চুল পিঠের ওপর এলিয়ে দিয়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসল। খাতায় কী যেন লিখল অনেক্ষণ ধরে। জাহ্নবী বসে রইল দূরে। জাভেদ আলী এখনো বাসায় ফেরেননি।
জাহ্নবী অর্ণবের দরজায় শব্দ করে বলল, ‘আপনি খেতে আসুন।’
অর্ণব খাবার টেবিলে এসে জানতে চাইল, ‘আংকেল এসেছেন?’
‘না।’
‘আন্টি কোথায়?’
‘মা ঘুমাচ্ছেন।’
‘আপনাদেরকে আবারও কষ্ট দিচ্ছি। কিছু মনে করবেন না প্লিজ।’
‘ আরে না না, আপনি নির্দ্বিধায় খান।’
অর্ণব জাহ্নবীর দিকে এক পলক তাকিয়ে খাবার খেতে শুরু করল। জাহ্নবী ভায়োলেটকে খাবার খেতে অনুরোধ করলে সে জানালো, ‘পরে খাবো।’
ভায়োলেটকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখাচ্ছে। জাহ্নবীর ভালো লাগছে না কিছুই। খাবার খাওয়ার এক পর্যায়ে অর্ণব বলল, ‘ আপনাকে একটা কথা বলি, কিছু মনে করবেন না তো?’
‘না। বলুন?’
‘ ওই চার্জার দিয়ে ফোনটা চার্জ হয় নি। আমি কী এখানে আমার ফোনটা চার্জে দিতে পারি?’
জাহ্নবী চোখ তুলে তাকালো অর্ণবের দিকে। আচমকা বিদ্যুৎ শক খাওয়ার মতো শরীর কাঁপুনি দিয়ে উঠলো জাহ্নবীর। অর্ণবের সঙ্গে এই চোখাচোখি ওর সত্তাকে নাড়িয়ে দিয়েছে। জাহ্নবী বেশ অনুভব করল কত দ্রুত হৃদস্পন্দিত হচ্ছে তার।
অর্ণব খাবার টেবিলের পাশে চার্জে লাগিয়ে দিলো ফোনটা। জাহ্নবী দ্রুতপদে চলে এলো সেখান থেকে। কখনো কোনো পুরুষের সঙ্গে এত কাছাকাছি থেকে চোখাচোখি হয় নি তার। খুব অন্যরকম লাগছে ওর। একটা আবছা অস্থিরতা ওকে ক্রমশ ভারী করে তুললো।
অর্ণব খাওয়া শেষ করে টেবিলের পাশেই বসে রইল অনেক্ষণ। জাহ্নবী ভায়োলেটের ঘরে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। সে আর একটিবারও অর্ণবের সামনে যায় নি।
জাভেদ আলী বাসায় এলেন সন্ধ্যাবেলা। অর্ণবের চাকরি প্রাপ্তির খবরটা শুনে সবচেয়ে বেশী খুশি হলেন তিনি। সবার আগে পারভীনকে মিষ্টি খাওয়াতে গেলেন। পারভীন চোখ বুজে গম্ভীর মুখে শুয়ে আছেন। জাভেদ আলীর এইসব আধিখ্যেতা ওনার একেবারেই অপছন্দ।
জাভেদ আলী যখন বললেন, ‘ ছেলেটার কষ্ট দূর হলো অবশেষে। বেচারা ঢাকা শহরে এসে থাকার জায়গা পায়নি, বন্ধু মোবাইল নিয়ে সরে পড়েছে। এখন সে নিজের টাকায় বাসা নিয়ে থাকতে পারবে। হা হা হা।’
‘এত খুশির কী আছে? যেন তোমার ছেলে চাকরি পেয়েছে?’
‘ ছেলের মতো তো।’
‘যাও কোলে নিয়ে নাচো।’
‘হা হা হা। ছেলেটা চাকরি পেয়ে আমার জন্য মিষ্টি নিয়ে এসেছে পারভীন। এর চাইতে বড় কৃতজ্ঞতা আর কীভাবে প্রকাশ করে মানুষ?’
পারভীন উত্তর দিলেন না। জাভেদ আলী বললেন, ‘ওর বাবার অনেক টাকা পয়সা। কিন্তু ছেলে ভালো, বাবার টাকায় চলে না। সে নিজে ইনকাম করে নিজের খরচ চালায়। নতুন চাকরি পেয়েছে, বড় কোম্পানিতে বড় পোস্ট। সত্তর হাজার টাকা বেতন।’
পারভীন এখনো অন্যদিকে তাকিয়ে আছেন। যেন এই বেতনের কথা শুনেও তিনি খুশি হতে পারেননি। বিছানা থেকে নামলেন তিনি। জাভেদ আলীর সঙ্গে আর কথা বাড়ালেন না। মিষ্টিও খেলেন না। জাভেদ আলী একাই মিষ্টি মুখে দিয়ে বসে রইলেন।
জাহ্নবী ভায়োলেটকে বলল, ‘ সামারকে ফোন দিয়েছিলি?’
‘না। একটা টেক্সট দিয়েছিলাম সকালে। ওর ওখানে নেটওয়ার্ক নেই সম্ভবত। রিপ্লাই পাইনি।’
‘ওহ আচ্ছা। ভায়োলেট, আমার চাকরিটা হবে তো?’
‘টেনশন কোরো না আপু। বি কনফিডেন্ট। চাকরি না হলে অন্য আরেকটা হবে। হাসিখুশি থাকো।’
জাহ্নবী উদাস গলায় বলল, ‘চাকরি পাওয়ার আনন্দ অনেক জানিস? অর্ণব চাকরি পেয়েছে। ওর চোখেমুখে কী যে আনন্দের ঝিলিক! চেহারাটাই পালটে গেছে বেচারার। আগে ছিল অস্থির প্রকৃতির, পাগল পাগল। অথচ আজকে স্মার্ট, শান্ত শিষ্ট। ভেতর থেকে চেঞ্জ এসে গেছে ওর।’
ভায়োলেট হেসে বলল, ‘তোমারও আসবে আপু। পুরো জীবনটাই চেঞ্জ হয়ে যাবে তোমার।’
‘ দোয়া করিস আমার জন্য। যদিও জীবনটা এখনই চেঞ্জ হতে শুরু করেছে।’
‘কী বলো আপু! প্রেমে পড়েছ নাকি?’
‘আরে ধুর। ওসব না। আমি আর আগের আমি নেই, সেটাই বুঝিয়েছি।’
ভায়োলেট হেসে বলল, ‘ মজা করছিলাম। তোমাকে যেন সবসময় এমনই দেখি আপু। আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে, বোঝাতে পারবো না তোমায়।’
এমন সময় পারভীন এসে জাহ্নবীকে ডাকলেন। জাহ্নবী জবাব দিয়ে বলল, ‘বলো আম্মু।’
‘ বাসায় চিনিগুড়া চাল ছিল না? পাচ্ছি না কেন?’
‘ চাল নেই আম্মু। সেদিন খিচুড়ি রান্না করে খেয়ে ফেলেছি।’
পারভীনের আর কোনো কথা শোনা গেল না। জাহ্নবী জানতে চাইল, ‘চিনিগুড়া চাল দিয়ে কী করবা?’
‘ পায়েস রান্না করতাম একটু। দুইবোন নিচে যা না, মিনাবাজার থেকে কিছু বাজার টাজার করে নিয়ে আয়। পোলাও রান্না করি না অনেকদিন।’
জাহ্নবী ও ভায়োলেট একে অপরের দিকে তাকালো। পায়েস, পোলাও, শব্দ দুটো চমকে দিয়েছে ওদেরকে। চোখ বড়বড় করে ওরা একে অপরের দিকে চেয়ে রইল। ভায়োলেট মুচকি হেসে বলল, ‘আম্মু, আমরা নিচে যাচ্ছি একটু পর। আর কি কি লাগবে বলো?’
পারভীন মেয়েদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। ওনাকে অনেক উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। রোগা রোগা ভাবটা আর নেই। চিন্তা করে বললেন, ‘গরুর গোশত খাবি? না মুরগী?’
‘ তুমি যা রাঁধবা আমরা তাই খাবো আম্মু।’
‘ তাহলে গরুর গোশতই ভালো হবে। দুধ আনবি এক কেজি। কিসমিস, বাদামও নেই বাসায়।’
পারভীন বাজারের লিস্ট বলে যাচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে ভায়োলেট বলল, ‘আম্মু কী অর্ণব সাহেবকে জামাই বানানোর চিন্তা করছো নাকি?’
কথাটা বলেই দুষ্টুমিভরা হাসি দিলো ভায়োলেট। জাহ্নবী চমকে উঠলো। পারভীনের মুখখানা কালো হয়ে উঠল মুহুর্তেই। রেগে বললেন, ‘লাগবে না তোদের বাজারে যাওয়া। রান্নাই করবো না কিছু।’
রাগে আগুন হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন পারভীন। ভায়োলেট মুখ টিপে হাসতে হাসতে বিছানায় শুয়ে পড়ল। হাসি আটকে রাখতে পারছে না সে। এই বয়সেও আম্মুর এমন অভিমানী স্বভাব খুবই আনন্দদায়ক লাগে ওর কাছে। জাহ্নবী বলল, ‘কাজটা ঠিক করলি তুই? মা রেগে গেছে।’
‘আমি মজা করে বলেছি।’
‘মা মজা বোঝে বলে তোর মনে হয়?’
‘ওহ নো। মা এখন ডিপ্রেশনে চলে যাবে। যাই, শান্ত করি গিয়ে।’
ভায়োলেট মাকে ডাকতে ডাকতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। জাহ্নবী বসে রইল স্থবির হয়ে। ওর বুক ধরফর করছে। কোনো এক অজানা কারণে ভায়োলেটের বলা কথাটা ওর দেহে শিরশিরে এক অনুভূতির জন্ম দিয়েছে। শিউরে উঠছে গা। জাহ্নবী চোখ মেলে রাখতে পারল না। আজ এত ছটফট লাগছে কেন!
চলবে..
উপন্যাসঃ মেঘফুল
পরিচ্ছেদঃ ০৯
লেখক- মিশু মনি
রাগ কমেছে পারভীনের। তিনি আনন্দের সঙ্গে রান্নাবান্না করছেন। পোলাওয়ের মিষ্টি সুঘ্রাণ পুরো বাড়ির বাতাসকে সুবাসিত করছে। জাহ্নবী দুয়েক বার রান্নাঘরে যাওয়ার জন্য বের হলেও ভায়োলেট বাঁধা দিয়ে বলেছে, ‘আম্মুকে একা থাকতে দাও।’
অর্ণব জাহ্নবীকে দেখে জানতে চাইলো, ‘আপনারা মিষ্টি খেয়েছেন?’
‘হ্যাঁ খেয়েছি। আপনার কিছু লাগলে বলবেন আমাকে।’
‘অবশ্যই। থ্যাংকস।’
জাহ্নবী জাভেদ আলীর পাশে বসে রইল। তিনি অর্ণবের সঙ্গে গল্পগুজব করছেন। অর্ণব আজ শান্ত, নিশ্চল। সমুদ্র শান্ত হয়ে গেলে যেমন সবকিছু অন্যরকম লাগে, আজ জাহ্নবীরও তেমন লাগছে। তবে অর্ণবের চোখ দেখে মনে হচ্ছে সে কিছু একটার জন্য ছটফট করছে। ওই চোখ জোড়া বড্ড চঞ্চল, মোটেও শান্ত সমুদ্রের মতো নয়। জাহ্নবী উৎসুক চোখে অর্ণবের দিকে তাকিয়ে রইল। অর্ণব চোখ ফেরাতেই আরও একবার চোখাচোখি হল তাদের।
জাভেদ আলী ক্ষণিকের জন্য উঠে যেতেই জাহ্নবী পত্রিকা টেনে নিয়ে বসল। সে জানতে চায় অর্ণব কিছু বলবে কী না!
কিন্তু অর্ণব কিছুই বললো না। কয়েক মিনিট বসে থাকার পর বলল, ‘আমি চলে যাবো। আংকেলকে একটু ডেকে দিন না।’
‘ খাওয়াদাওয়া করে তারপর যাবেন।’
‘ না, না। আমার দেরী হয়ে যাবে।’
‘ দেরী হয়ে যাবে মানে?’
‘ আমাকে বাসা খুঁজতে হবে।’
‘ রাত হয়ে গেছে। এখন আপনি বাসা কোথায় খুঁজবেন?’
অর্ণব উত্তর খুঁজে পেলো না। হতভম্ব চেহারা নিয়েও হাসার চেষ্টা করলো। জাহ্নবী বলল, ‘আপনি একটু দাঁড়ান।’
জাহ্নবী দ্রুত ভেতরে চলে গেল। ফিরে এলো মোবাইল হাতে নিয়ে। অর্ণবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাসতে হাসতে বলল, ‘আপনি দেখি সত্যি সত্যি দাঁড়িয়ে আছেন। এটা কী জোকস ছিল ভাইয়া?’
কথাটা বলে হাসল জাহ্নবী। অর্ণব বলল, ‘ হ্যাঁ জোকস বলা যেতে পারে।’
‘ যে কারণে আপনাকে দাঁড়াতে বলেছিলাম, এখন সেই কারণটা বলব।’
‘ প্লিজ, তারাতাড়ি বলুন। আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।’
জাহ্নবীর হার্ট লাফ দিয়ে উঠল। মনেমনে গর্বিত বোধ করল সে। কারণ এত সুন্দর করে এবং দৃঢ়তার সঙ্গে কখনো কারও সাথে কথা বলতে পারেনি সে। নিজের মাঝে আসা এই অদ্ভুত পরিবর্তন ওকে আন্দোলিত করলো।
জাহ্নবী সামারকে কল দিয়ে ফোনে পেলো না। নাম্বার বন্ধ দেখাচ্ছে। বলল, ‘ ওর ওখানে একেবারেই নেটওয়ার্ক নেই।’
অর্ণব উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে।
জাহ্নবী বলল, ‘আমার ছোটবোন সামারকে তো দেখেছেন। ও এসব ব্যাপারে আপনাকে হেল্প করতে পারবে। আমাদের এই বাসাটাও সামার ঠিক করেছে।’
হাসলো জাহ্নবী। অর্ণব খুশি হয়ে বলল, ‘তাই! তাহলে তো ভালোই হয়। আমি ঢাকা শহরে কিছুই চিনি না।’
‘ টেনশন করবেন না। আমি সামারকে চেষ্টা করছি কিন্তু কল ঢুকছে না। ও বান্দরবানে বেড়াতে গেছে।’
‘ ওহ আচ্ছা।’
অর্ণব অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। জাহ্নবীর হঠাৎ মনে হল, চঞ্চল চোখ জোড়া হঠাৎ করেই হারিকেনের আলোর মতো নিভে গেল। তবে কী চোখ দুটো এতক্ষণ ধরে সামারকেই খুঁজছিল! ভাবনায় পড়ে গেল জাহ্নবী।
অর্ণব বলল, ‘ সমস্যা নেই। আমার হাতে আরও কিছুদিন সময় আছে। উনি কবে ফিরবেন?’
‘ পরশুদিন সকালে।’
‘ ওনাকে বিষয়টা বলে দেখবেন প্লিজ? আমি আজকে চট্টগ্রাম চলে যাবো। আমিও আমার মতো করে খোঁজার চেষ্টা করবো। আংকেল নিজেও বিষয়টা দেখবেন বলেছেন।’
জাহ্নবী মনেমনে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘ ঠিক আছে।’
ভায়োলেটের ঘরে চলে এলো জাহ্নবী। মুখের ওপর বই রেখে ভায়োলেট ঘুমিয়ে পড়েছে। জাহ্নবী খানিক্ষন ঘরে পায়চারি করলো। অর্ণবের জন্য তার ভেতর কোনো অনুভূতির জন্ম হয়েছে কী না, সেটা বুঝতে চেষ্টা করছে জাহ্নবী।
খাবার টেবিলে পারভীন নিজেই খাবার সাজিয়েছেন। হাতমুখ ধুয়ে মেয়েদেরকে ডাকতে এলেন তিনি। ওনাকে আজ নববধূর মতো উৎফুল্ল এবং ব্যস্ত দেখাচ্ছে।
খাবার খেতে খেতে অর্ণব বলল, ‘ আমি এখনই রওনা দেবো। আপনাদেরকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। ক্ষমা করবেন আন্টি।’
পারভীন সবার মুখের দিকে এক পলক তাকালেন তারপর আরেক চামচ গোশত তুলে দিলেন অর্ণবের পাতে। আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন, ‘রান্না ভালো হয়েছে? খেতে পারছো তো?’
‘ জি আন্টি। অনেক ভালো হয়েছে।’
‘ তোমার বাবা মা সবাই ভালো আছেন?’
‘ হ্যাঁ। আপনারা আমার বাসায় বেড়াতে আসুন না একদিন। আমি তো এক তারিখে ঢাকায় চলে আসতেছি আন্টি। তারপর আর কখন সুযোগ হবে.. আপনারা এই ফাঁকেই আমাদের বাড়িতে আসুন।’
পারভীন হাসিমুখে বললেন, ‘ তুমি ভালভাবে চাকরিতে জয়েন করো। যাওয়ার সময় অনেক পাওয়া যাবে। আমি বহুদিন বাড়ির বাইরে যাই না। সংসার ছেড়ে আসলে যাওয়াই হয় না কোথাও।’
‘ আপনারা সবাই মিলে যাবেন। তাহলে আর সংসার নিয়ে টেনশন থাকবে না।’
‘ সেটা দেখা যাবে। যাওয়ার দিন অনেক পড়ে আছে। তুমি মাছ নাও নি কেন? এক পিস দেই?’
জাহ্নবী চোখ বড়বড় করে ভায়োলেটের দিকে তাকালো। ভায়োলেট মুখ টিপে হাসল। জাভেদ আলী মাথা নিচু করে খাচ্ছেন। পুরুষ মানুষ জাগতিক সব বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতে পছন্দ করেন না। কিন্তু জাহ্নবী ও ভায়োলেট ঠিকই বুঝতে পারছে হঠাৎ পারভীনের এই আধিখ্যেতার কারণ কী!
অর্ণব বলল, ‘ আন্টি আর খাবো না। রান্না খুবই সুস্বাদু হয়েছে। আমি জার্নির সময় ভরাপেটে থাকলে সমস্যা হয়।’
‘ তুমি আজকে থেকে যাও। আজকেই তো এসেছ।’
এবার জাভেদ আলী নিজেই অবাক হয়ে এক পলক পারভীনের দিকে তাকালেন। বিষয়টা দৃষ্টি এড়াল না জাহ্নবীর।
অর্ণব বলল, ‘ আমি দুদিন পর আবার আসবো। বাসার ব্যাপারে আংকেল খোঁজ নিয়ে দেখবেন। সামার আপুর নাকি এসব ব্যাপারে ভালো জানাশোনা আছে। উনিও দেখবেন। তারপর আমি আসবো।’
পারভীন তৎক্ষনাৎ উত্তর দিলেন, ‘সামারের কথা বাদ দাও। সে হচ্ছে পাখির মতোন। দুনিয়া নিয়ে ওর কোনো মাথাব্যথা নাই। তুমি এক কাজ করো। কাল সারাদিন বাসা খুঁজে দেখো। চারটা বাসা দেখলে একটা পছন্দ হবেই। বাসা ঠিক করে কাল রাতের বাসে চলে যাইতে পারবা।’
জাহ্নবী ঢোক গিলে ভায়োলেটের দিকে তাকালো। ভায়োলেট নিঃশব্দে খাবার খাচ্ছে। জাহ্নবী ভ্রু নাচালো ভায়োলেটকে লক্ষ করে। ভায়োলেট বলল, ‘ হ্যাঁ সেটাই ভালো হবে। আপনার কোন এলাকায় বাসা লাগবে?’
অর্ণব থতমত খেয়ে বলল, ‘আমি তো এখানকার কিছুই জানিনা, চিনিনা।’
‘ সমস্যা নেই। অফিস কোথায় আপনার?’
‘ ধানমণ্ডি সাতাশ।’
‘ আরে! আপু তো ওখানকার সব এলাকা চেনে। আপু কাল আপনাকে নিয়ে বাসা দেখতে যাবে। টেনশন নেয়ার কিছু নেই। বাসা পেয়ে যাবেন।’
জাহ্নবী খাওয়া বন্ধ করে চোখ বড়বড় করে ভায়োলেটের দিকে তাকিয়ে রইল। ভায়োলেট মুখ টিপে হাসল। সে আসলে কথাটা বলেছে পারভীনের মনে কী আছে সেটা জানার জন্য। মুহুর্তেই তার এই ট্রিকস শতভাগ কার্যকরী হয়ে গেল।
পারভীন বললেন, ‘ হ্যাঁ জাহ্নবী তো লালমাটিয়ার ওদিকে যাতায়াত করতো। চিনিস না তুই ওদিকটা?’ জাহ্নবীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন পারভীন।
জাহ্নবী ঢোক গিলে মাথা নাড়লো, ‘হুম।’
মনেমনে হাসল ভায়োলেট।
খাবার শেষ করে ঘরে এসেই জাহ্নবী রেগে ভায়োলেটকে বলল, ‘তুই কেন বললি আমি ওখানকার সব চিনি?’
‘ আরে আমি একা বলেছি নাকি? আম্মুও তো বলেছে।’
‘ কিন্তু একটা ব্যাপার কিছুতেই বুঝতে পারছি না। আম্মু একটা অপরিচিত ছেলের সঙ্গে আমাকে বাসা দেখতে যেতে বলবে, এটা অবিশ্বাস করার মতো। অন্যকেউ বললে বিশ্বাস হতো। কিন্তু আম্মু! কিভাবে?’
ভায়োলেট হেসে বলল, ‘ সেটা জানার জন্যই তো আমি কথাটা বলেছি। তারমানে বিষয়টা এখন স্বচ্ছ জলের মতো পরিষ্কার।’
‘ কোন বিষয়টা?’
‘ অর্ণব সাহেবকে মা তার বড় মেয়ের জামাই বানাতে চাইছেন।’
জাহ্নবী ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। ভায়োলেট বলল, ‘ আম্মুকে আমি ভালো করে চিনি। নিজের লাভ ছাড়া সে কোনোদিনও কিছু চিন্তাও করে না।’
‘ কিন্তু আরেকটা বিষয় ভাব। যে ছেলেকে আম্মু গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত পছন্দ করতো না। হঠাৎ কেন আম্মুর মনোভাব চেঞ্জ হয়ে গেল!’
ভায়োলেট কিছুক্ষণ ভেবে বলল, ‘ নিশ্চয়ই এখানে কিছু একটা আছে। সেটা কী হতে পারে?’
‘ আব্বু কিছু বলেছে?’
‘ হতে পারে। আব্বু বাসায় আসার পর আম্মু হঠাৎ চিনিগুড়া চাল খুঁজতে এসেছে। আচ্ছা, আব্বু নিজেই এই ব্যাপারটা আম্মুকে বলেনি তো?’
জাহ্নবী চোখ বড়বড় করে জানতে চাইলো, ‘কোন ব্যাপারটা?’
‘ এইযে অর্ণবকে তিনি পছন্দ করেছেন।’
দুই বোন একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল অনেক্ষণ। বাবা মায়ের মনে কী চলছে সেটা জানার জন্য গবেষণা করাটাও একটা আনন্দদায়ক ব্যাপার। ভায়োলেট আনন্দ পাচ্ছে, ভীষণ আনন্দ। সে মনেপ্রাণে চায় জাহ্নবীর সঙ্গে ভালো কিছু হোক। এই খড়কুটোর মতো জীবন জাহ্নবীর উপযোগী নয়, সে আরও ভালো কিছুর জন্য তৈরি। কিন্তু অর্ণব কী আসলেই জাহ্নবীর জন্য সেই ভালো বয়ে আনবে? মুহুর্তেই চিন্তিত হয়ে উঠলো ভায়োলেট।
জাহ্নবী বলল, ‘ অর্ণব সামারের ব্যাপারে আগ্রহী আমার মনে হয়।’
‘ তাতে কিছু আসে যায় না। মেজোপুর নিশ্চয়ই এতক্ষণে ওই ছেলেটার সঙ্গে কিছু হয়ে গেছে।’
‘ছি, নিজের বোনের ব্যাপারে এসব বলতে লজ্জা লাগল না?
‘ লজ্জার কী আছে আপু? ও সারা রাত আমার পাশে শুয়ে ফোনে কথা বলে। ওদের প্রেম হয়ে যাচ্ছে। একসঙ্গে ট্যুরে গেলে প্রেম তো আরও তারাতাড়ি হয়ে যাওয়ার কথা।’
জাহ্নবী গম্ভীর হয়ে গেল। ভায়োলেট জাহ্নবীকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ আপু, অর্ণব হয়তো সামার আপুর প্রতি আগ্রহী নয়। তুমি ভুল জেনেছো। সব বাদ দাও, অর্ণব সাহেবকে কী তোমার ভালো লাগে?’
জাহ্নবী চমকে উঠলো। শিরশির করে উঠলো ওর শরীর। ভায়োলেটের চোখের দিকে তাকালো সে। ভায়োলেট অপেক্ষা করছে জাহ্নবীর উত্তর শোনার জন্য।
রাতের অন্ধকার ছেয়ে এসেছে পুরো পাহাড় জুড়ে। ঝিঁঝি পোকার ডাক সবকিছুকে ছাড়িয়ে ক্রমশ ভারী করে তুলছে কান। সামার তাঁবুতে শুয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। গা ছমছম করছে ওর।
হঠাৎ তাঁবুর বাইরে থেকে মৃদুস্বরে আরজুর গলা শোনা গেল। সামার বলল, ‘ কিছু বলবেন?’
‘ বাইরে আসুন না একটু।’
সামার নিঃশব্দে তাঁবু থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো। পাশেই কাঠখড়িতে আগুন জ্বলছে। আগুনের কমলা রঙের আলোর ছটা লেগে ঝিকঝিক করছে আরজুর মুখ। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে অপূর্ব দেখাচ্ছে ওকে।
সামার বলল, ‘ বাইরে অনেক ঠাণ্ডা।’
‘ আমার চাদরটা নিন।’
আরজু নিজের গা থেকে চাদর খুলে সামারকে দিলো। সামার চাদরটা গায়ে জড়াতে জড়াতে জানতে চাইলো, ‘ কী বলবেন? ঘুম আসছে না?’
আরজু মুচকি হেসে বলল, ‘ তেমন কিছু না।’
‘ তাহলে বাইরে আসতে বললেন কেন?’
‘ আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করছিল, তাই।’
সামার চমকে উঠল ভীষণ। ওর চোখেমুখে, সর্বাঙ্গে এক ধরণের দীপ্তি খেলা করে গেলো। আরজুর চোখের দিকে তাকিয়ে কেঁপে উঠল সামার। আরজুর চাদরে জমে থাকা উষ্ণতা ওর শরীরকে স্পর্শ করছে। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে মুচকি হাসল সে। পৃথিবীতে প্রেমে পড়ার মুহুর্তের চাইতে সুন্দর আর কিচ্ছু নেই!
চলবে..