মেঘফুল পরিচ্ছেদঃ ১৯,২০

0
451

উপন্যাসঃ মেঘফুল
পরিচ্ছেদঃ ১৯,২০
লেখকঃ মিশু মনি
১৯

খাবার টেবিলে একসঙ্গে খেতে বসেছে সবাই। জাভেদ আলী সবসময়ই মেয়েদেরকে বলেন, ‘সুখে দুঃখে যাই থাকি, সবাই একসঙ্গে খাবার খাবো, এটাই শান্তি।’ আজকে খেতে বসে বরাবরের মতোই তিনি চাকরি জীবনের গল্প করছেন। গল্পের ফাঁকে ভায়োলেট বলল, ‘আব্বু, তোমাকে একটা কথা বলতে চাই।’
‘হ্যাঁ মা, বল? কিসের ব্যাপারে?’
‘আব্বু, বড় আপুর ব্যাপারে। তুমি রাগ করতে পারবে না।’

জাভেদ আলী পারভীনের দিকে তাকালেন। খাওয়া বন্ধ করে জাহ্নবীর মুখপানে একপলক দৃষ্টি রাখলেন পারভীন। মেয়ে নিশ্চয়ই বলবে সে অর্ণবকে বিয়ে করতে পারবে না। এ ছাড়া আর কিইবা বলার আছে তার। পারভীন মুখ নিচু করে খাবার খেতে লাগলেন।
ভায়োলেট বলল, ‘বড় আপু প্রতিদিন খুব ভোরে বের হয়। তারপরও অফিসে পৌঁছাতে লেট হয়। আর এতদূর থেকে যাতায়াত কষ্টকর, ভাড়াও বেশী পড়ে যায়। এজন্য আপু চাইছিল ওর অফিসের কাছাকাছি একটা বাসা নিয়ে থাকতে।’

জাভেদ আলী জাহ্নবীর দিকে তাকালেন। চুপচাপ বাবার দিকে চেয়ে আছে জাহ্নবী। তিনি বললেন, ‘জাহ্নবী বড় হয়েছে। নিজের ভালোমন্দ সিদ্ধান্ত নেয়ার উপযোগী হয়েছে। ও যদি অফিসের কাছে বাসা নিয়ে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে তাহলে থাকুক। আমি বাঁধা দেবো কেন বল। জাহ্নবী, মা তুমি কি বাসা দেখেছ?’
জাহ্নবী মাথা ঝাঁকালো, ‘একটা বাসার ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছি।’

পারভীন তৎক্ষনাৎ অভিমানী গলায় উত্তর দিলেন, ‘সব যখন ঠিক করেই ফেলছিস আর জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। কেন বাসা নিচ্ছিস আমি জানিনা নাকি। এখন তো মা বুড়ি হইছি। মা’র চেচামেচি আর ভালো লাগে না। বিয়ে করতে বলি, কত কী বলি। সেসব আর শোনা লাগবে না। একা বাসায় থাকলে আত্মীয় স্বজনদের কথাও আর শোনা লাগবে না। সব তো শুনি আমি। বুঝবে কি তোমরা।’
জাহ্নবী কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হল না।

সামার বলল, ‘এত কথা কেন বলছ মা? আপুর ব্যক্তি স্বাধীনতা আছে। সে যেখানে ইচ্ছে থাকুক না। আমরা এখানে কথা বলবো না। আমি তো অনার্সে প্রথম দুই বছর হোস্টেলে ছিলাম, সাবলেট ছিলাম। আমাকে তো এত কথা বলো নি।’
পারভীন রাগত স্বরে বললেন, ‘আমি কাউকে কিছু বলবো না। যার যা ইচ্ছে করো। বিয়েশাদি করার কোনো নাম নাই কারও। যেন জন্ম দিয়া ভুল করছি। পড়াশোনা করতে চাইছো, করাইছি। অনার্স পাশ করে মাস্টার্সে ভর্তি হবা বলছ, ভর্তি করে দিছি। অপরাধ করছি আমরা? জাহ্নবীর এত ভালো ভালো বিয়ের প্রস্তাব আসল, সে বিয়ে করবে না। আত্মীয় স্বজনের কাছে কথা শুনতে শুনতে আমার জান যায়। বিয়ে করবি না সন্ন্যাসে যা। তোর এই সমাজে থাকার দরকার কি?’
সামার হাত ধুয়ে উঠে যেতে যেতে বলল, ‘সন্ন্যাসেই যাচ্ছে। খুশি হও এবার। খুব শীঘ্রই আমি বিয়ে করবো। এবার অন্তত শান্তিতে থাকো। একা একা বিয়ে করবো না। ধুমধাম করেই করবো।’

পারভীন কিছু বললেন না। কয়েক মুহুর্ত বসে থেকে ধরা গলায় বললেন, ‘আমার মেয়েরা আজকে আমার মুখের ওপর কথা বলে। কী মানুষ করলাম..’

কেঁদে ফেললেন তিনি। খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে নিজের ঘরে চলে গেলেন। জাভেদ আলী পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করলেন।
‘তোর মায়ের কথা বাদ দে। ও এখনও বাচ্চাদের মতো গাল ফুলায় থাকে। জাহ্নবী মা, তোমার কোনোকিছু দরকার হলে আমাকে বলবে আমি কিনে দেবো। নতুন বাসায় কি এই মাসেই উঠবে?’

জাহ্নবীর মন খারাপ হয়ে গেছে। মৃদু স্বরে বলল, ‘আমার জন্য পাত্র দেখো আব্বু। আমাকে তোমরা সবাই মাফ করে দিও।’

কাঁদতে কাঁদতে নিজের ঘরে গেল জাহ্নবী। জাভেদ আলী বিব্রতবোধ করছেন। ভায়োলেট হাসিমুখে বলল, ‘আব্বু, এই বাড়িতে আমরা দুইজন ছাড়া সবারই মাথা গরম। তুমি কষ্ট পেও না। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
জাভেদ আলী হেসে ফেললেন, ‘তুই সবার চাইতে ভালো বুঝিস। ওরা বড় হয়েও বাচ্চাদের মতো আচরণ করে। কী আর করবো আমি বল।’
‘আব্বু তুমি খাও। খাবারটা শেষ করো।’
জাভেদ আলী খাওয়া শুরু করলেন। সবাই নিজ নিজ ঘরে চলে গেছে। টেবিলে বসে নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে খাবার খাচ্ছে ভায়োলেট ও তার বাবা। জাগতিক বিষয় নিয়ে তাদের কোনো দুশ্চিন্তা নেই।

খুব সকালেই অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দিল জাহ্নবী। রাতে ভালো ঘুম হয়নি। মাথাব্যথা করছে। আজকে গরমের তীব্রতাও অনেক। ঘামতে অফিসে এসে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। এখন অফিসটাই ওর সবচেয়ে শান্তির জায়গা। আগামীকাল শুক্রবার। দুদিন অফিস বন্ধ থাকবে। এই সময়টা কাটাবে কীভাবে সে!

অফিস শেষ করে বাসায় এসে দেখল জাভেদ আলী ভায়োলেটকে নিয়ে বাসার ছোট ছোট পাতিল, একটা গ্লাস, চামচ, প্লেট সবকিছু বস্তায় তুলে রেখেছেন। জাহ্নবীকে দেখে তিনি বললেন, ‘তোর নতুন জীবনের জন্য আমরা এগুলো গোছাচ্ছি। তুই তো ব্যস্ত মানুষ। গোছানোর সময় আছে?’ হাসলেন তিনি।
জাহ্নবীর ইচ্ছে করল বাবাকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ভায়োলেট একটা একটা করে বিভিন্ন জিনিস এনে জড়ো করছে আর জাভেদ আলী নিজের হাতে সবকিছু গুছিয়ে দিচ্ছেন, যেন এরচেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর হয় না।
জাহ্নবী বলল, ‘আব্বু, আমি যাবো না নতুন বাসায়। এখানেই থাকবো।’
জাভেদ আলী থতমত খেয়ে গেলেন। এত উৎসাহ নিয়ে তিনি সবকিছু গোছগাছ করছেন, আর মেয়ে নাকি যাবে না!
নিজের ঘরে এসে জামাকাপড় বদলে নিলো জাহ্নবী। ভায়োলেট চা নিয়ে এসেছে। জাহ্নবী বলল, ‘বস এখানে।’
বসল ভায়োলেট। ফ্যানের বাতাসের শো শো শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। হঠাৎ করেই চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে উঠেছে।
ভায়োলেট নিস্তব্ধতা ভেঙে বলল, ‘আপু আমি তো ওই বাসায় এডভান্স দিয়ে এসেছি আজ সকালে। আব্বু বলল কাল যেহেতু শুক্রবার। তাই কালকেই তোমার ওই বাসায় ওঠা ভালো হবে। এ কারণেই আর তোমাকে জিজ্ঞেস করিনি। তুমি কি আসলেই উঠতে চাচ্ছ না?’

জাহ্নবী নিরুত্তর তাকিয়ে রইল। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো মুখ থেকে, ‘জানিনা রে। বুঝতে পারছি না আমার কী করা উচিত।’
‘তুমি যাও। কিছুদিন থেকে দেখো ভালো লাগে কী না। এতদূর থেকে অফিসে যাওয়াটাও তোমার জন্য কষ্টকর।’
‘হুম, এটা ঠিক বলেছিস। আজকে বুঝেছি সেটা। এই গরমে অফিসে যেতে জান বের হয়ে যায়। রিকশা ভাড়া এত বেশী চায়, আমি দামাদামি করতে পারিনা। সবসময় ঠকি। হা হা।’

জাহ্নবীর হাসি দেখে হেসে ফেলল ভায়োলেট। বড় আপু এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে সেটা মেনে নিতে আজকে ওর কষ্ট হচ্ছে। অথচ এতটা আবেগ কখনও বড় আপুর জন্য ছিল না। আজকে ভায়োলেটের মনে হচ্ছে, আপুর মতো এতটা সাদামাটা, এত পরিষ্কার মনের মানুষ খুব কমই হয়। আপুকে সত্যিই অনেক ভালবাসে সে।

জাহ্নবী চা শেষ করে শুয়ে পড়ল। ভায়োলেট নিজেও শুয়ে পড়ল বোনের পাশে। মুখোমুখি শুয়ে দুজনে তাকিয়ে রইল একে অপরের দিকে। জাহ্নবী বলল, ‘জানিস আজকে কী হয়েছে? নাদিস স্যার একটা কালো ব্লেজার পরে এসেছে আজকে। ওনার ব্লেজারের ঠিক এই জায়গাটায় সাদা রঙের ময়লা। অনেকটা পাখির গু’য়ের মতো। স্যার হয়তো জানতেন না। সবাই ওনাকে দেখে মুখ টিপে হাসছে। এমন প্রফেশনাল আর সিরিয়াস একটা মানুষের এই দশা। হাসবে না? আমারও হাসি এসেছিল। আগে আমি হেসেছি। পরে আমি স্যারের রুমে গিয়ে ওনাকে বলে এসেছি।’
ভায়োলেট জানতে চাইল, ‘কীভাবে বললে?’
জাহ্নবী হেসে ফেলল, ‘আমি ওনার দরজায় গিয়ে বললাম, স্যার আসবো? তিনি সিরিয়াস ভঙ্গীতে তাকালেন, আসুন। বসুন। কী হয়েছে? আমি তো লজ্জায় মরে যাই। বললাম, স্যার আপনার কোটটার দিকে একবার খেয়াল করতে হবে। মনে হচ্ছে সেখানে কিছু আছে। স্যার বললেন, কী আছে? আমি বললাম, আপনি দেখুন স্যার।’
জাহ্নবী হেসে উঠল। ভায়োলেট ওকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আপুরে, তুমি চলে যাবে কাল?’
‘হুম।’ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল জাহ্নবী।
‘তোমাকে অনেক মিস করবো আপু।’

ভায়োলেট জাহ্নবীকে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরে রইল। অনেক রাত অব্দি আজ গল্প করল ওরা। জাহ্নবী শুধু বলেই গেল। আজ যেন কথার ফুলঝুরি মেলে দিয়েছে সে। ভায়োলেট আজ শুধু শুনলো। বড় আপুর মতো গম্ভীর একজন মানুষ এত কথা বলছে, শুনতে ভালো লাগছিল তার। রাতের খাবার খাওয়ার পর আবারও গল্পে মেতে উঠল ওরা। চলল রাত দুইটা পর্যন্ত। আজকে ভায়োলেটের একটুও ঘুম পায় নি। বড় আপুর সব কথা শুনতে তীব্র আগ্রহ জাগছিল তার।

পরদিন সকাল দশটায় জাভেদ আলী নিজেই জাহ্নবীকে নিয়ে নতুন বাসায় এলেন। সঙ্গে এলো ভায়োলেট। দুই বোন মিলে ঘর পরিষ্কার করে ফেলল। জাভেদ আলী কিনে নিয়ে এলেন একটা ছোটখাটো আকারের খাট। ব্যাচেলর মেয়েদের বাসা। জাহ্নবীর একার জন্য একটা রুম। রুমের একদিকে বিশাল জানালা। সোনালী রোদ জানালা ফুরে ঘরে ঢুকে যাচ্ছে। জানালার পাশে দাঁড়াল জাহ্নবী। ভায়োলেট তার কথা রেখেছে।

বিছানা পেতে একটা ওয়ারড্রবে সমস্ত জামাকাপড় ও জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলো জাহ্নবী। প্লাস্টিকের র‍্যাকে তার থালাবাসন সাজানো হল৷ বাবা একটা আয়নাও কিনে এনেছেন। সঙ্গে বাইরে থেকে দুপুরের খাবার। তিনজন একসঙ্গে খাবার খেয়ে রওনা দিলেন জাভেদ আলী ও ভায়োলেট।

জাহ্নবী নিজের এই নতুন ঘরের চারপাশে তাকাল। বেশ বড় ঘর বলা চলে। ঘরের একদিকে বারান্দা। বেশ বড় পরিসর। বারান্দার সামনে খানিকটা খোলা জায়গা। সম্ভবত এটা দক্ষিণ দিক। অনেক বাতাস আসবে। ভায়োলেটের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মনটা ভরে উঠল। অন্য জানালাটির পাশে দাঁড়ালে বাইরের শহর দেখা যায়। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা অসংখ্য বিল্ডিং। জাহ্নবীর নিজেরও ওরকম মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।

চলবে..

উপন্যাসঃ মেঘফুল
পরিচ্ছেদঃ ২০
লেখকঃ মিশু মনি

জাহ্নবীর ঘুম ভাংলো সকাল আট টায়। আজকে শনিবার, অফিস ছুটি। আজ কোনো তাড়া নেই বলেই অনেক্ষণ আয়েশ করে ঘুমিয়েছে সে। পুরো ঘর সকালের স্নিগ্ধ আলোয় ভরপুর। জাহ্নবী বিছানা ছেড়ে উঠে খালি পায়ে জানালার কাছে এলো। সাদা রঙের জানালার পর্দাটা সরাতেই এক রাশি সূর্যকিরণ ঝিকমিক করতে করতে ঢুকে পড়ল ওর ঘরে। জাহ্নবী চমকালো। মনে হলো সকালের সূর্য স্বাগত জানাচ্ছে তাকে। জাহ্নবী বিছানার ওপর এসে বসলো। সাদা টাইলসের মেঝেতে সূর্যরশ্মি খেলা করছে। বাড়িতে ওর ঘরে রোদ আসতো না কখনোই। আজ মনটাই ভালো হয়ে গেল।

জাহ্নবী দরজা খুলে বেলকনিতে এসে দাঁড়াল। পাশের বিল্ডিংগুলোর গায়ে রোদ ঝিকমিক করছে। এখনো শহরে কোলাহল নামেনি। সবাই ঘরে ঘুমাচ্ছে। কর্মব্যস্ত মানুষেরা কেউ কেউ বেরিয়েছে কাজে। বেলকনিতে দাঁড়ালে বাসার পাশের রাস্তা দেখা যায়। রাস্তার ওপাশে আরও কতগুলো বাসা। ওই বাসাগুলোর বারান্দায় অসংখ্য গাছ সবুজে ঢাকা। জাহ্নবীর ইচ্ছে করছে ওর নিজের বারান্দাটাও ছোট ছোট গাছ ও লতাপাতায় ঝলমল করুক। বেশ বড় পরিসরের বেলকনি। এখানে বসার জন্য একটা চেয়ার কিনে আনতে হবে।

জাহ্নবীর সকালটা আজ দারুণভাবে শুরু হয়েছে। ঘুম থেকে উঠেই বাড়ির কাজকর্ম কিংবা রান্নাবান্না নিয়ে ভাবতে হচ্ছে না, এটা মজার ব্যাপার। জাহ্নবী বেসিনে এসে দাঁত ব্রাশ করতে করতে নিজেকে দেখছিল। আব্বু একটা নতুন ব্রাশও কিনে এনেছে তার জন্য। আয়নায় তাকিয়ে নিজেকে দেখছিল জাহ্নবী। মুচকি হাসি ফুটে উঠল ঠোঁটে। ফেসওয়াশ দিয়ে মুখ ঘষে শীতল পানি দুহাতে ভরে মুখে ছিটিয়ে দিতেই জাহ্নবীর মনটা সতেজতায় ভরে উঠল। মনে হতে লাগল, জীবনটা মন্দ না। অসাধারণ সব ব্যাপার স্যাপার চারদিকে।

এই বাসায় মোট চারটা রুম। লিভিংরুমে পার্টিশন দিয়ে আরও একটা রুম বানানো হয়েছে। সেখানেও কেউ থাকে নিশ্চয়ই। এখনো কারও সঙ্গে পরিচয় হয়নি জাহ্নবীর। গত রাতে চার্লি নামে একটা মেয়ে শুধু জিজ্ঞেস করেছিল, আপনি কোন রুমে উঠেছেন আপু?
জাহ্নবী উত্তরে বলেছে, আমি সিঙেল রুমে উঠেছি।
এর বাইরে আর কথা হয় নি। আজ জাহ্নবী সবার সঙ্গে পরিচিত হবে। কিন্তু জড়তা ওকে জড়িয়ে রেখেছে। হুট করে কারও সাথে মেশার অভ্যাস নেই ওর।

ঘরে এসে ছোট পাতিল ও চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে রান্নাঘরে এলো সে। পাতিলে কিছু পানি দিয়ে চুলার বার্নার জ্বালিয়ে দিলো। রান্নাঘরের জানালার পাশে বড়সড় একটা আম গাছে বসে পাখি ডাকছে। এত বেলা করেও পাখি ডাকে নাকি!
এক কাপ দুধ চা বানিয়ে বেলকনিতে এসে দাঁড়াল জাহ্নবী। বাইরের পরিবেশ দেখতে দেখতে চায়ে চুমুক দিলো। ওর হঠাৎ করেই ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। ভায়োলেটকে ধন্যবাদ জানালেও কম হবে। এত চমৎকার বাসা, আশেপাশের পরিবেশ এত সুন্দর, ইচ্ছে করছে আনন্দে নাচি। জাহ্নবীর এতটা আনন্দ বোধহয় কখনো হয়নি। একা থাকতে তো অন্যরকম মজা। কী দারুণ!

জাহ্নবী ঘরে এসে শুয়ে পড়ল। এইমুহুর্তে কোনো কাজ নেই। কাজ না থেকে ভালোই হয়েছে। এত সুন্দর সকালটাকে উপভোগ করতে পারছে সে। কিন্তু খিদে পেয়ে যাচ্ছে তো। বাবা গতকাল পাউরুটি ও ডিম কিনে দিয়েছেন। একটা ডিমের ওমলেট করে রুটি দিয়ে খাওয়া যেতে পারে।
জাহ্নবী ফোন হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ ইউটিউবে ঢুকে বসে রইল। তারপর নাস্তা বানিয়ে খেয়ে দেয়ে আবারও শুয়ে পড়ল। কাজ না থাকলে এতটা শূন্য শূন্য কখনো লাগেনি। এখন মনে হচ্ছে অফিস থাকলেই ভালো হতো।

জাহ্নবী একটা গল্পের বই নিয়ে বসল। কয়েক পাতা বই পড়ার পর মাত্রই বইটা রেখেছে, এমন সময় বাবার নাম্বার থেকে কল।
জাহ্নবী রিসিভ করে খুশি খুশি গলায় বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম আব্বু। কেমন আছো?’
জাভেদ আলী সালামের উত্তর জানিয়ে বললেন, ‘ভাল আছি মা। তুমি কেমন আছো?’
‘খুব ভালো আছি আব্বু।’
‘তাই? আমার মা খুব ভালো আছে? হা হা। এত আনন্দ কিসের আম্মু?’
‘ওহ আব্বু আমি খুশিতে পাগল হয়ে যাচ্ছি। আজকের সকালটা এত্ত সুন্দর।’
‘তাই নাকি? আমার মা খুশি থাকুক সেটাই তো চাই। কিন্তু মা, পাগল তো হওয়া যাবে না।’
‘হা হা হা। ঠিক আছে আব্বু। পাগল হওয়া যাবে না। পাগল হবো না। মা কই? মা ভালো আছে?’
‘আছে। সে সবসময় যেমন থাকে। রেগে আছে।’
‘মাকে দাও তো।’
‘রান্নাঘরে কাজ করছে। ফ্রি হলে কল দেবো।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে। ভায়োলেটকে ডেকে দিবে?’

জাভেদ আলী ঘর থেকে বের হয়ে ভায়োলেটকে ডাকলেন। ছুটে এসে ফোন ধরল ভায়োলেট, ‘হ্যালো বড় আপু..’
‘ভায়োলেট, থ্যাংক ইউ রে। থ্যাংক ইউ সো মাচ।’
‘হা হা। কী ব্যাপার আপু? আজকে এত খুশি?’
‘খুশি মানে তুই জানিস আমার বাসাটা এত্ত সুন্দর! এত সুন্দর একটা সকাল। আমার খুব আনন্দ হচ্ছে রে ভায়োলেট।’
ভায়োলেট হেসে ফেলল। জাহ্নবীর আনন্দের জন্যই তো সে এত খুঁজে খুঁজে বাসাটা পছন্দ করেছে। যেখান থেকে চমৎকার সব সকাল দেখে দিনটা দারুণভাবে শুরু হবে।
ভায়োলেট বলল, ‘আপু আজ তো তোমার ছুটি। বাসায় আসো। দুপুরে এখানে খেয়ে তুমি আর আমি বের হবো। তারপর তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসবো।’
‘সত্যি! আচ্ছা ঠিক আছে। আমি এক্ষুনি রওনা দিচ্ছি তাহলে।’

জাহ্নবীর গলায় খুশি ঝলমল করছে। ভায়োলেটও ভীষণ খুশি হল ওর সঙ্গে কথা বলে। নিজের ঘরে চলে এলো ভায়োলেট। জাভেদ আলীর মুখে প্রসন্ন হাসি।
পারভীন রান্নাঘর থেকে জাভেদ আলীর কথা শুনতে পেয়েছেন। রাগটা কমে গেল ওনার। স্বাভাবিকভাবে রাগ আরও বেড়ে যাওয়ার কথা। পারভীন বুঝতে পারলেন, তিনি জাহ্নবীকে সত্যিই অনেক ভালবাসেন। জাহ্নবী যাতে ভালো থাকে, তাতেই ওনার আনন্দ। তিনি মনেমনে খুশি হলেন। যদিও মেয়েটা বাসায় নেই, ওর শূন্যতা অনুভব করছেন তিনি। বলতে গেলে সবার চাইতে তিনিই জাহ্নবীকে বারবার স্মরণ করছেন।
জাহ্নবী আসবে শুনে তিনি জাভেদ আলীকে বললেন, ‘বাজারে যাও। ইলিশ মাছ পাও কিনা দেখো।’
‘তুমি নাকি আজ মসুর ডাল আর ভাজি রান্না করবে?’
‘না, মাছ আনো। জাহ্নবী ইলিশ মাছ খেতে পছন্দ করে।’

জাভেদ আলী হাসলেন। পারভীন জাহ্নবীর জন্য ইলিশ মাছ আনতে পাঠাচ্ছে। ভালো লাগল ওনার। তিনি তড়িঘড়ি করে বাজারের জন্য তৈরি হলেন। বের হওয়ার সময় পারভীনকে বললেন, ‘এই শোনো না। অর্ণবকে আসতে বলি? ছেলেটার তো বাবা মা কাছে নেই, বোঝো না? আমরাই তো ওর বাবা মা।’
পারভীন নিস্তব্ধ রইলেন কিছুক্ষণ। মনে হলো তিনি চান না জাহ্নবী ও অর্ণবের দেখা হোক। দেখা হলে জাহ্নবী ভাববে সে বাসা বদলানোর পরও মা অর্ণবের সঙ্গে তাকে বিয়ে দিতে চাচ্ছেন। কিন্তু এইমুহুর্তে তিনি সেটা চাচ্ছেন না। জাহ্নবী একা থাকুক। আগে ওর জীবনকে দেখা উচিৎ। পরে বিয়ে নিয়ে ভাবা যাবে।
পারভীন একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আচ্ছা।’

জাহ্নবী ‘পাঠাও’ থেকে একটা গাড়ি নিয়ে দ্রুত বাসায় চলে এলো। দরজা খুলে দিলো ভায়োলেট। জাহ্নবীকে জড়িয়ে ধরে আনন্দিত গলায় বলল, ‘আপুউউউ! তুমি এসেছ কী যে খুশি হয়েছি।’
‘আমিও খুশি হয়েছি। মা কই?’

রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল জাহ্নবী। পারভীন কাজ করছেন। কোনো এক অজানা কারণে জাহ্নবীর চোখ ভিজে উঠল। রান্নাঘরে ঢুকে মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে রইল ও। খুব ইচ্ছে করছিল মাকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু জড়তার পৃষ্ঠতায় পারল না সেটা করতে।

পারভীন বললেন, ‘বাসা কেমন?’
‘ভালো।’
‘কয়জন থাকে?’
‘এখনও জানিনা। আমার রুমে আমি একা থাকি।’
‘একা? ভাড়া বেশি পড়বে না?’
‘হুম। আমার রুমের ভাড়া ১২ হাজার টাকা।’

পারভীন অবাক হয়ে জাহ্নবীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। চমকে উঠেছেন তিনি। তিনি বিয়ের পর থেকেই যেসব বাসায় ভাড়া থেকেছেন, সব বাসার ভাড়া পনেরো হাজারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ভাড়া কমানোর জন্য তিনি কখনো ভালো এলাকায় থাকেননি। এখন যে ফ্ল্যাটে থাকেন, এটার ভাড়া তেরো হাজার টাকা। অথচ জাহ্নবী একাই কিনা এক রুমে বারো হাজার টাকা ভাড়ায় উঠেছে! তিনি সত্যিই বিস্মিত হলেন।

জাহ্নবী বলল, ‘বাসাটা খুব সুন্দর মা। আর আমার এলাকায় বাসার ভাড়াগুলো বেশি। ত্রিশ হাজারের নিচে ফ্ল্যাটই পাওয়া যায় না ওই এলাকায়।’
‘বুঝেছি। দ্যাখ গিয়ে তোর বাসার মেয়েরা একরুমে তিন চারজন করে থাকে। ওরা তিন/চার হাজার টাকা ভাড়া দেয়। তিনজন মিলে বারো হাজার। আর তুই একাই বারো হাজার। দুই সিটের রুমেও ওঠা যেতো।’
জাহ্নবী চুপ করে রইল। প্রসঙ্গ এড়ানোর জন্য বলল, ‘আব্বু কোথায়?’
‘বাজারে গেছে।’
‘আমি সবজি কুটে দেই?’
‘না। তুই ঘরে যা। এখানে গরম অনেক।’

জাহ্নবী আর কথা বাড়াল না। সামারের ঘরে এসে দেখল ভায়োলেট পড়াশোনা করছে আর সামার ঘুমাচ্ছে। জাহ্নবী বলল, ‘ভায়োলেট, তুই এখন আমার রুমে থাকতে পারবি।’
‘তুমি ছাড়া একা আমি তোমার রুমে থাকবো? আমার খারাপ লাগবে তো। অবশ্য আমিও চাই তোমার রুমে শিফট হতে। মেজোপুর নতুন নতুন প্রেম হয়েছে। তাকে এখন প্রাইভেসি দেয়া দরকার।’

মুখ টিপে হাসল ভায়োলেট। জাহ্নবী জানতে চাইলো, ‘আচ্ছা ভায়োলেট, তুই প্রেম করিস না কেন?’

ভায়োলেট চমকে উঠল। চোখ তুলে এমনভাবে তাকালো যেন জাহ্নবী অদ্ভুত কিছু জানতে চেয়েছে। এর কারণ বুঝতে পারল না জাহ্নবী। ভায়োলেট শুকনো হাসি দিয়ে বলল, ‘প্রেম করতেই হবে নাকি সবার?’
‘সবাই তো করে। তুই বড় হয়েছিস। জানি এটা জিজ্ঞেস করা ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু তারপরও জানতে ইচ্ছে হল। তুই কারও প্রেমে পড়িস নি?’

ভায়োলেট অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে চিন্তায় ডুবে গেল সে। প্রেম! সে তো একটা কঠিন দাবদাহের মতো। তার জীবনে এসেছিল এন্টার্কটিকার শীতল বরফজলের মতো। অথচ বরফ গলে মরুভূমির তীব্র খরায় রূপান্তরিত করে দিয়ে গেছে!

পারভীন প্লেটে করে পাটিসাপটা পিঠা নিয়ে ঘরে এলেন। মেয়েদের সামনে রেখে বললেন, ‘তোর আব্বু খেতে চাইলো তাই বানালাম। লোকটা এখনও বাজার থেকে আসতেছে না। তোরা খেয়ে দ্যাখ তো কেমন হয়েছে।’
পারভীন পিঠা রেখে বেরিয়ে গেলেন। জাহ্নবী বলল, ‘আম্মুর রাগ কমেছে মনে হচ্ছে। আমি তো টেনশনে ছিলাম আমার সঙ্গে কথাই বলবে না।’
‘আম্মুর মনটা খুব নরম। সারাক্ষণ রেগে কথা বললেও মানুষটা খুব ভালো।’

জাহ্নবী একটা পিঠা তুলে নিলো। ইচ্ছেকৃত ভাবেই ভায়োলেটের প্রেমের প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেল সে। তার মনে হচ্ছে ভায়োলেটের জীবনে কোনো গল্প আছে। কিন্তু সেই গল্পটা এখন জানতে চাওয়ার মতো সময় নয়। তাছাড়া ব্যক্তিগত কোনোকিছু জিজ্ঞেস করতেও পারবে না জাহ্নবী। সংকোচ করবে তার।

পিঠা খেতে খেতে জাহ্নবী এমনভাবে অন্যান্য বিষয় নিয়ে কথা বলতে লাগল যেন বিষয়টা ভুলেই গিয়েছে সে। এতে করে ভালোই হয়েছে। ভায়োলেট স্বস্তি অনুভব করল।

জাভেদ আলী বাসায় ফিরলেন দুই কেজি ইলিশ মাছ নিয়ে। মাছ কাটতে বসে গেলেন পারভীন। ভায়োলেট মাকে বলল, ‘কী গো আব্বুর জন্য পাটিসাপটা পিঠা বানিয়েছো না? আব্বুকে পিঠা দিলে না যে?’
পারভীন বললেন, ‘আমার হাতে মাছ। তুই দে তো।’

ভায়োলেট পিঠা নিয়ে বাবার সামনে গেল। জাভেদ আলী ভায়োলেটের কথাটা শুনতে পেয়েছেন। তিনি বললেন, ‘আমার জন্য তোর মা পিঠা বানিয়েছে বললি?’
‘হ্যাঁ আব্বু। তুমি নাকি খেতে চেয়েছো?’
‘আমি! আমি আবার কখন পিঠা খেতে চাইলাম। সে নিজেই তো আমার হাতে ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বলল বাজার থেকে ইলিশ মাছ কিনে আনো। আমি তো কোনো পিঠা খেতে চাই নি।’

মুচকি হাসল ভায়োলেট। হো হো শব্দ করে হেসে উঠলেন জাভেদ আলী। ভায়োলেট ইশারায় বলল, ‘চুপ। আস্তে হাসো। আম্মু শুনলে রাগে কান্নাকাটি শুরু করবে।’
জাভেদ আলী খুশি হলেন। পারভীন জাহ্নবীর জন্য পিঠা বানিয়েছে। ইলিশ মাছ কিনে আনতে বলেছে। মেয়েকে বড্ড ভালবাসে সে, এটা স্বীকার করতেই চায় না। তার আজ মনে অনেক আনন্দ।

ভায়োলেট রুমে এসে জাহ্নবীকে বলল, ‘আপু, আম্মু মিথ্যে বলেছে।’
‘কী মিথ্যে?’
‘সে আব্বুর জন্য পিঠা বানায় নি।’
‘তাহলে? আজকেও অর্ণব আসবে নাকি?’
‘তা জানিনা। তবে পিঠা বানিয়েছে তোমার জন্য। কারণ তুমি এই পিঠা পছন্দ করো। ইলিশ মাছও আনিয়েছে। তুমি খেতে ভালবাসো তাই।’

জাহ্নবীর চোখে পানি চলে এলো। অন্যদিকে তাকিয়ে চোখের পানি আড়াল করল সে। ভায়োলেটকে বলল, ‘ভালো হয়েছে। আম্মু আমাদের জন্য বানাবে না কার জন্য বানাবে?’
কথাটা স্বাভাবিকভাবে বললেও জাহ্নবীর কণ্ঠ শুনে বোঝা গেল সে কাঁদছে। ভায়োলেট জাহ্নবীকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আপু। আম্মু অনেক ভালো। আম্মুর ওপর রেগে থেকো না।’
‘হুম।’

ঘুম ভেঙে গেল সামারের। ঘুম থেকে উঠে দুই বোনকে জড়াজড়ি করে বসে থাকতে দেখে সে জানতে চাইলো, ‘আপু কখন এলে?’
‘এক্ষুণি।’
‘আর যাবা না?’
ভায়োলেট দুষ্টুমি করে বলল, ‘না। আর যাবে না।’
আঁৎকে উঠল সামার। বিছানার ওপর লাফ দিয়ে বসল সে। ‘মানে কী! আমি তো আরও ভাবলাম এখন থেকে এক রুমে একা ঘুমাবো।’

শব্দ করে হেসে উঠল জাহ্নবী ও ভায়োলেট। তাদের হাসির শব্দ পৌঁছে গেল রান্নাঘর অব্দি। ভীষণ ভালো লাগছে পারভীনের। মাছ কুটতে আনন্দ পাচ্ছেন তিনি। ইলিশ মাছের আঁশটের গন্ধটা তার ভালো লাগছে। এমন সময় দরজার কলিং বেল বেজে উঠল। নিশ্চয়ই অর্ণব এসেছে।
জাভেদ আলী দরজা খুলে দিলেন। অর্ণব আসে নি। একটা ছেলে এসেছে ভায়োলেটের খোঁজে!

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here