মেঘফুল পরিচ্ছেদঃ ২৬

0
488

উপন্যাসঃ মেঘফুল
পরিচ্ছেদঃ ২৬
লেখাঃ মিশু মনি

নতুন বাসায় ওঠার কয়েকদিন পর, সেদিন রাতে মোটেই ঘুমাতে পারছিল না ভায়োলেট। গত কয়েকটা দিন রুশো তার মনের ভেতর তুমুল এক্কাদোক্কা খেলেছে। মুহুর্তের জন্যও রুশোকে মন থেকে টেনে বের করা যাচ্ছিল না। তার প্রথম কলেজ জীবন শুরু, কোথায় উত্তেজনা ও আনন্দ নিয়ে ক্লাস করতে যাবে সে। কিন্তু না, রুশো মাথার ভেতর জেঁকে বসে আছে। কোনোকিছুই ভালো লাগছে না ভায়োলেটের। বারবার রুশোর চাহনি মনে পড়ে যাওয়ার যন্ত্রণা ওকে ক্রমশ ব্যথাতুর করে তুলতে লাগল।

সারা রাত জেগে ভোরবেলা ভায়োলেট সিদ্ধান্ত নিল, আগামীকাল সকালেই সে ওই পুরনো বাড়িতে যাবে।
খুব সকালে অস্থিরতাকে সঙ্গে নিয়ে ভায়োলেট পুরনো বাড়িতে এলো। বাড়ির প্রবেশদ্বারের সামনে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে রইল সে। মাথার ওপর খা খা করছে রোদ। এই তীব্র রোদ মাথায় নিয়েই দাঁড়িয়ে রইল ভায়োলেট। কিশোরী বয়সের আবেগ কোনো কিছুই বুঝতে চায় না, ভায়োলেট এটা ভালো করেই বোঝে। তবুও সে আবেগকে রুখতে পারছে না। তার কান্না পাচ্ছে। এত কষ্ট নিয়ে অপেক্ষা করতে হবে, আগে জানলে সে রুশোর প্রেমেই পড়ত না।
ধীরেধীরে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এলো। ভায়োলেট সকাল থেকে এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বেশ কয়েকবার এদিক সেদিক হাঁটাহাঁটিও করেছে। প্রত্যেকটা মুহুর্ত সে মনেমনে প্রার্থনা করেছে যেন আজ একবার রুশো এখানে আসে। ভায়োলেটের মন বলছিল, এখানে এলেই রুশোর সঙ্গে তার দেখা হবে। কিন্তু মন সবসময় সঠিক বলে না। মাঝেমাঝে ভুল নির্দেশনাও দেয়। সেটা এখন বুঝতে পারছে ভায়োলেট।

কথাগুলো স্মরণ করে বড় বোন জাহ্নবীকে শোনাচ্ছিল সে। জাহ্নবী বুঁদ হয়ে শুনছে তার কথা। এমনও হয় নাকি! সেই কিশোরী বয়সে ভায়োলেট সারাদিন প্রখর রোদে দাঁড়িয়ে একটা ছেলের জন্য অপেক্ষা করেছে! তাও অনিশ্চিত অপেক্ষা। ছেলেটা আসবে না জেনেও অপেক্ষা। প্রেম বোধহয় এমনই হয়।

ভায়োলেটকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে জাহ্নবী জিজ্ঞেস করল, ‘তারপর? তারপর কী হল?’

একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ভায়োলেট। তারপর আর কী হবে! সেদিন রুশো আসেনি। আসবেই বা কেন? এত বছর পর একদিন যে এসেছিল, সে রোজ রোজ আসবে এমন তো নয়। মরিচিকার প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল ভায়োলেট। শেষ মুহুর্তে বিকেল গড়িয়ে এলো, চোখ মুছতে মুছতে সেখান থেকে চলে এলো ভায়োলেট। পুরোটা পথ রিকশায় বসে ওড়নায় চোখ মুছেছে সে। এত কষ্ট কখনোই হয়নি তার। কেমন যেন পাগল পাগল লাগছিল। কষ্টে বুক ফেটে যায়, আর্তনাদ করতে ইচ্ছে করছিল তার।

রাত্রিবেলা ভায়োলেটের শরীরে প্রবল জ্বর এলো। সে কী তাপমাত্রা, যেন জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। সেই জ্বরের ঘোরে ভায়োলেট বারবার রুশোর মুখচ্ছবি দেখতে লাগল। পারভীন মাথায় জলপট্টি দিয়ে দিচ্ছেন। পাশেই বসে আছে বড় আপা জাহ্নবী। বাবা অস্থির হয়ে এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছেন। ভায়োলেট কয়েকবার চোখ মেলে সেই দৃশ্য দেখতে পেয়েছে। তারপর আবার চোখ বুজে আসত। জ্বরে শরীরে খুব ঠাণ্ডা অনুভূত হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল চার বছর আগে সেই বৃষ্টিদিনের কথা। এই ঠাণ্ডা যেন সেই ঠাণ্ডা। যেন অতীতে বাস করছে ভায়োলেট। ওর গায়ে বৃষ্টি পড়ছে ঝমঝম করে। ভিজতে ভিজতে দোলনার রশি ধরে বসে ছিল সে। আর সামনে দাঁড়িয়ে ছিল একটা ছেলে। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। কী মায়া তার দুচোখে!

টানা পাঁচদিন পর ভায়োলেটের জ্বর ছেড়ে গেল। শরীর দুর্বল বোধ হচ্ছিল। বিশ্রামে থাকতে হল আরও কিছুদিন। অসুস্থতার কারণে কলেজের প্রথম দিনের ওরিয়েন্টেশন ক্লাস মিস হয়ে গেল তার। একদিন শরীর বেশ চনমনে মনে হচ্ছিল। ভায়োলেট প্রস্তুত হলো কলেজে যাওয়ার জন্য।

বাবা ওকে কলেজে রেখে গেলেন। প্রথমদিন কলেজে ক্লাস করার আনন্দটাই ছিল অন্যরকম। এভাবে আরও কিছুদিন, তারপর আরও কিছুদিন। রুশোর চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে মন দিয়ে পড়াশোনা করতে লাগল ভায়োলেট। ক্লাস করে প্রত্যেকটা নোট করত একাত্মতার সাথে। ক্লাসে ফার্স্ট গার্ল হওয়ার রেকর্ড ধরে রাখতে হবে তাকে।

সেদিন ক্লাস শেষ করে বাগানে আসতেই বান্ধবীরা ভায়োলেটকে ক্ষেপাতে লাগল, ‘ভাই তুই কী এত পড়িস? সারাক্ষণ বইতে মুখ গুঁজে থাকিস।

আমাদেরকেও একটু দ্যাখ। আমাদের মতো সুন্দরী, যৌবনরসে ভরা যুবতী পাবি নাকি কোথাও?’
সিঁথির এই অশ্লীল রসিকতায় সব মেয়ে হেসে উঠেছিল। ভায়োলেটের হাসি পায়নি। এসব নোংরা কথায় সে মোটেও আনন্দিত হয় না। তার সবসময় সুন্দর কথা শুনতে ভালো লাগে।
রুবাইয়া নামে এক ক্লাসমেট বলল, ‘ভায়োলেট, আজকে আমরা ঘুরতে যাচ্ছি। তুমি যাবে আমাদের সঙ্গে?’
‘না। তোমরা যাও। আমাকে তারাতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে।’
‘কেন রে? বাসায় কি নবজাতক শিশু রেখে এসেছো?’
সিঁথির এই দুষ্টুমিতে আবারও হেসে উঠল সবাই। ভায়োলেট এবার আর মুখ গোমড়া করে রাখতে পারল না। বলল, ‘আমি বাবা মাকে না বলে কখনো কোথাও যাই না।’
‘আরে একটু আধটু ঘোরাঘুরি করবো, কফি টফি, ফুচকা টুচকা খাবো। দেন বাসায় চলে যাবো। ঘন্টাখানেক লাগবে। বাসায় যেতে জ্যামেই তো সময় লাগে তিন ঘন্টা। হে হে।’

মাইশা চশমা ঠেলতে ঠেলতে বলল কথাটা। ভায়োলেট হাসল। হাসির সঙ্গেই বলল, ‘তোমরা যাও। আমি অন্য একদিন যাবো।’

সাত আটজন মেয়ে ইউনিফর্ম পরেই ব্যাগের ফিতা দুলাতে দুলাতে একসঙ্গে বেরিয়ে গেল। ওদের হৈ হৈ কানে বাজছিল অনেক্ষণ। নিশ্চয়ই ওরা অনেক মজা করবে। সিঁথির দুষ্টুমিতে সবাই হো হো করে হাসবে। ওদের মধ্যে সিপ্রা সবচেয়ে মেধাবী। সেও তো গেল, মাইশাও তো গেল। তবে সে কেন যেতে পারল না? নিজেকে প্রশ্ন করল ভায়োলেট নিজেই।

গেট থেকে বেরিয়ে কিছুদূর হেঁটে এসে রিকশা নেয়ার কথা ভাবছিল ভায়োলেট। রিকশা না পেয়ে আরও কিছুদূর হেঁটে এলো সে। হঠাৎ একটা গাড়ি এসে তার সামনে দাঁড়াল। বড়সড় একটা পাজেরো। গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে মেয়েরা হইহই করে বলতে লাগল, ‘এই ভায়োলেট, চল না আমাদের সঙ্গে। খুব মজা হবে।’

ভায়োলেট আর কিছু ভাবার অবকাশ পেলো না। ওদের মুখরিত চেহারা দেখে উঠে পড়ল গাড়িতে। গাড়িটা ছিল সিপ্রার বাবার। উনি সিপ্রাকে নিতে রোজ গাড়ি পাঠিয়ে দেন। ওদের তিন/চারটা গাড়ি। সিপ্রা আজকে এই বড় গাড়িটা পাঠাতে বলেছিল বাবাকে। তার মানে ওরা আগে থেকেই প্লান করে রেখেছিল?

ভায়োলেট সেদিন অনেক মজা করল। সবাই মিলে পার্কে ঘোরাঘুরি, বেঞ্চে বসে আইসক্রিম খাওয়া, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঘাসের ওপর বসে বাদাম খাওয়া, হাসাহাসি কত কী! হুট করেই একটা চেনা মুখ অস্পষ্ট দেখতে পেয়ে ভায়োলেটের শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। ছেলেটা এদিকেই আসছে। রুশোর সঙ্গে এভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবতেই পারেনি সে!

রুশো সামনে এগিয়ে এলে মেয়েরা কৌতুহলী হয়ে তাকালো। রুশো এসে সবাইকে হাই বলতেই সবাই দারুণ আনন্দে উৎসাহের সঙ্গে বলল, ‘হ্যালো।’
রুশো নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, ‘আমি রুশো। তোমাদের বান্ধবী ভায়োলেটের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। তোমরা কী অনুমতি দেবে?’

সবাই একবাক্যে বলল, ‘নায়ায়ায়া। অনুমতি দেয়া যাবে না। ভায়োলেট, তুই ওনাকে চিনিস?’
সিঁথির প্রশ্নে ভায়োলেটের কান ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগল। রুশোকে সে চেনে। এই ছেলেটার সঙ্গে তার জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক। আত্মার সঙ্গে আত্মার, হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়ের। তাকে চিনবে না কেন সে? ভায়োলেট উত্তর দিতে পারল না। ওর হাত পা সমস্ত শরীর কাঁপছে।

মাইশা বলল, ‘আপনি কী ভায়োলেটকে লাইন মারছেন?’
সবাই হেসে উঠল। ভায়োলেটের কেন যেন এই হাস্য রসিকতা মোটেও ভালো লাগছে না। লাইন মারা আবার কেমন শব্দ? রুশো তার সমস্ত সত্তা দখল করে বসে আছে। এই নোংরা শব্দ তার সঙ্গে বেমানান।
রুশোকে অবাক করে দিয়ে ভায়োলেট বলল, ‘তোমরা সবাই ওদিকে যাও। আমি ওর সঙ্গে কথা বলবো। ও আমার পরিচিত।’

মেয়েরা আর দলবেঁধে দাঁড়িয়ে রইল না। সবাই মুখ টিপে হাসতে হাসতে দূরে চলে গেল। একটা বেঞ্চিতে পাশাপাশি এসে বসল ভায়োলেট ও রুশো। ভায়োলেটের শরীরের কাঁপুনি থেমেছে। এখন ভীষণ অভিমান হচ্ছে রুশোর ওপর। সেদিন রোদে দাঁড় করিয়ে রেখে কঠিন শাস্তি দিয়েছিল সে। এই শাস্তি এখন রুশোকে দিতে ইচ্ছে করছে।

রুশো প্রথমে কথা বলল, ‘তুমি আমাকে খারাপ ভাবছো না তো?’
ভায়োলেট মাথা নাড়ল, ‘না।’
‘ভাবলে ভাবো। কিন্তু আজকে ফোন নাম্বার না দিয়ে যাবে না।’
‘ফোন নাম্বার কেন দেবো আপনাকে?’
‘কারণ তোমার সঙ্গে আমার কথা বলতে হবে। অনেক কথা। এতগুলো দিন, এতগুলো মাস এভাবে অপেক্ষা করে আমি আর পারছি না। এটার শেষ হওয়া উচিৎ।’

ভায়োলেটের হৃদয়ে একটা সুখের দোলা দোল দিয়ে গেল। রোদ ঝলমলে এমন একটা দিনে, কাকের কা কা ধ্বনি, দূর থেকে আসা গাড়ির হর্ন সবকিছু মিলেমিশে একাকার। তার সঙ্গে বসে আছে তার প্রিয় মানুষ, একই বেঞ্চিতে। আচ্ছা, মাঝখানে কি অনেক দূরত্ব?
ভায়োলেট কিঞ্চিৎ মাথা ঘুরিয়ে পাশে তাকালো। রুশো বলল, ‘কী দেখছো?’
‘ কিছুই না।’
‘কেন? আমাকে দেখো। তাকাও আমার দিকে। আমি যে এতগুলো বছর তোমাকে দেখতে না পারার কষ্টে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম, আমাকে দেখার জন্য তোমার এমন হয়নি? কেন হয়নি? আর হবেই বা কেন। তুমি তো অতকিছু বুঝতেই না তখন।’
‘কিসের কথা বলছেন আপনি?’

সবকিছু বুঝেও না বোঝার ভান করে রইল ভায়োলেট। রুশো বলল, ‘সব বলবো। কতক্ষণ আছো তোমরা এখানে?’
‘আর মিনিট দশেক। আপনি না ডাকলে এতক্ষণে আমরা বেরিয়ে যেতাম। বাসায় যেতে হবে।’
‘প্লিজ থাকো না আর কিছুক্ষণ। তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে। অনেক কথা।’
‘দ্রুত বলুন। আমার সময় নেই।’

রুশোকে অস্থির দেখাল। ঝাঁকড়া চুল এখনও আছে তার। কপাল ঢেকে গেছে চুলে। সে মাথা নাড়লেই চুলগুলো দোলে। ভীষণ ভালো লাগছে ভায়োলেটের। কিন্তু লজ্জা ও সংকোচে বারবার রুশোর দিকে তাকাতে পারছে না।
ভায়োলেট বলল, ‘চিঠি দিতে পারবেন? চিঠিতে সবকিছু লিখে আগামীকাল আমার কলেজের গেটে এসে অপেক্ষা করবেন।’
‘না। আমি পারবো না।’
‘কেন?’
‘আর অপেক্ষা করাইয়ো না প্লিজ। তুমি জানো না তোমার বাসা বদলানোর দিন আমি কত কষ্ট পেয়েছি। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম তাও হয়তো জানো না। তোমাদের গাড়ি বেরিয়ে যাওয়ার পর আমার বুক ভেঙে গিয়েছিল। তারপরও পরপর তিনদিন আমি ওই বাড়ির সামনে গিয়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করেছি। যদি একবার আসো আমার জন্য.. কিন্তু না, আসোনি।’

ভায়োলেট চমকে উঠল। সে গিয়েছিল। কিন্তু অনেক দেরীতে। তাই হয়তো একই অভিমানে অভিমানী হয়েছিল সে নিজেও।
অনেক্ষণ পর ভীষণ আবেগ নিয়ে রুশোর দিকে তাকালো ভায়োলেট। রুশো বলল, ‘বিশ্বাস হচ্ছে না? বিশ্বাস না হলে ওই বাড়ির দাড়োয়ানকে জিজ্ঞেস করে দেখো। সে সবকিছু জানে। আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল বাসার সামনে থেকে। বেচারাকে পাঁচশো টাকা ঘুষ দিয়েছি। বলেছি তুমি যদি কখনো ওই বাড়িতে আসো, সে যেন তোমাকে আমার কথা বলে।’
ভায়োলেট একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। নিশ্চয় যেদিন সে গিয়েছিল, সেদিন দাড়োয়ান দেখতেই পায়নি তাকে। ভায়োলেট একটাবারও বাড়ির ভেতরে গেল না কেন!

রুশো বলল, ‘এভাবে দেখা হয়ে যাবে আমি কখনো ভাবি নি। ভেবেছিলাম হয়তো আর দেখাই হবে না। চার বছর ধরে বুকে জমিয়ে রাখা প্রেমটা অধরাই রয়ে যাবে। জানানোও হবেনা তোমাকে।’
ভায়োলেটের ভীষণ ভালো লাগছে কথাগুলো শুনতে। মনে হচ্ছে এরচেয়ে সুন্দর মুহুর্ত আর কখনোই আসেনি তার জীবনে। এত ভাললাগা, এত অস্থিরতা, এত আনন্দ, সবকিছু তাকে জড়িয়ে রেখেছে।
কাঁপা কণ্ঠে ভায়োলেট জানতে চাইলো, ‘মাত্র দু এক মিনিটের দেখায় আপনি এতকিছু ভেবে ফেললেন কিভাবে?’
রুশো লাজুক হেসে ভায়োলেটের চোখের দিকে তাকালো। চোখাচোখি হল তীব্রভাবে। ভায়োলেট কেঁপে উঠল। ওর মনে হলো এই একইভাবে চোখাচোখি হয়েছিল ঠিক সেই বৃষ্টির দিনে। একই মাদকতাময়। তবে কী আবারও সেই নেশায় ব্যকুল হয়ে যাবে ভায়োলেট? ভয় করছে তার। যদি আবার হারিয়ে যায় রুশো?

বান্ধবীরা ডাকছে ভায়োলেটকে। তাকে এখনই উঠতে হবে। যেতে হবে বাসায়। সিঁথিদের গাড়ি ওকে বাসার কাছাকাছি পৌঁছে দিয়ে আসবে। কিন্তু কিছুতেই রুশোকে ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে পায়ের নিচে শিকড় গজিয়েছে তার। রুশো বলল, ‘খাতা কলম বের করো। প্লিজ তারাতাড়ি করো।’

ভায়োলেট ব্যাগ থেকে খাতা কলম বের করল। রুশো ঝটপট লিখে দিলো তার মোবাইল নাম্বারটা। হাতের ইশারায় বলল, ‘কল দিও প্লিজ।’
ভায়োলেট কিছু না বলে খাতা ব্যাগে ঢুকাতে যাবে এমন সময় রুশো বলল, ‘দাঁড়াও নাম্বারটা আরেকবার দেখে নেই। ভুল হয়ে যায় যদি।’

রুশো ভায়োলেটের খাতা টেনে ধরে নাম্বারটা আরও একবার দেখে নিলো। খুব মন দিয়ে তাকিয়ে রইল সেদিকে। আর ভায়োলেট অবাক চোখে, চরম মুগ্ধতায় মিশে তাকিয়ে রইল রুশোর দিকে। এমনও হয় নাকি? এমন সুন্দর করে বুঝি জীবনে প্রেম আসে? একটু কষ্ট সাথে নিয়ে? আর কষ্টের বিনিময়ে অপার সুখ ও আনন্দ। এতটা ভালো কখনোই লাগেনি তার।
ভায়োলেট মুগ্ধ চোখে রুশোর দিকে তাকিয়েই আছে। ঝাঁকড়া চুলগুলো কপাল ঢেকে ফেলেছে। রুশোর মাথা ঝাঁকুনির তালে তালে দুলছে তারা। চোখের পাতা পিটপিট করছে রুশো। ভায়োলেটের ইচ্ছে করছে রুশোকে তীব্রভাবে জড়িয়ে ধরতে। ইচ্ছে করছে এই খাতার মতো করে রুশোকে ব্যাগের ভেতর ঢুকিয়ে বাসায় নিয়ে যেতে। ভাবতে ভাবতে খাতাটা ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলল ভায়োলেট। তার দৃষ্টি তখনও রুশোর দিকে। আর মুখে প্রশান্তির হাসি। এই হাসি রুশোকে সারাজীবনের মতো একান্তই আপন করে পাবার।

মেয়েরা হইচই করতে করতে ভায়োলেটকে নিয়ে গাড়িতে উঠল। রুশো ইশারায় বলল, ‘ফোন দিও, প্লিজ।’
তারপর বুকে হাত দিয়ে এমন একটা ভাব করল, যেন তার কলিজা ছিঁড়ে খানখান হয়ে যাচ্ছে। বিষয়টা প্রচণ্ড ভালো লাগল ভায়োলেটের। ওই বয়সের মেয়েদের কাছে এরচেয়ে ভাললাগার আর কিছুই হতে পারে না।

গাড়িতে উঠে বান্ধবীরা ভায়োলেটের খাতায় রুশো কী লিখে দিয়েছে সেটা দেখতে চাইল। ভায়োলেট লজ্জায় মরে যাচ্ছে। সে কিছুতেই খাতা বের করবে না। চাপের মুখে বলল, ‘ফোন নাম্বার দিয়েছে।’

মেয়েরা বলল, ‘আমরা ফোন নাম্বারই দেখবো। আমরা দেখবো, আমরা দেখবো।’

এ যেন একটা মিছিল। হইহই রব। রীতিমতো ব্যাগ নিয়ে টানাটানি। ভায়োলেট নিশ্চিত অন্য কোনো মুহুর্তে হলে এই আচরণে রেগে যেত। কিন্তু আজ রাগ করতে পারল না। তার মনে হচ্ছে আজ এই বান্ধবীদের জন্যই রুশোর সঙ্গে দেখা হল তার। ভাগ্যিস ওদের সঙ্গে এসেছিল সে!
মেয়েরা ব্যাগ থেকে খাতা বের করে মেলে ধরল। তারপর হা হয়ে গেল সবাই। ভায়োলেট সবার মুখের দিকে তাকাল। মোবাইল নাম্বার দেখে এভাবে হা হওয়ার কী আছে?
কিন্তু তারপর সে যা দেখল, তাতে নিজেরই দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। চোখ বন্ধ করে ফেলল ভায়োলেট। সব মেয়েরা একসঙ্গে বলে উঠল, ‘আই লাভ ইউ ভায়োলেট।’
ভায়োলেটের চোখ ভিজে উঠেছে। আবেগে, আনন্দে। সিঁথি বলল, ‘লাইলি, ওয়ে লাইলি। আই লাভ ইউ লাইলি।’

সবাই উচ্চ স্বরে হাসছে। কিন্তু ভায়োলেটের হাসি পাচ্ছে না। সে খাতাটা কোলের ওপর নিয়ে মুগ্ধ চোখে রুশোর লেখাটার দিকে তাকিয়ে আছে। কী চমৎকার লেখা। ওপরে ফোন নাম্বার আর নিচে বড় বড় অক্ষরে অটোগ্রাফ স্টাইলে লিখেছে, ‘ I Love You Violet’

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here