মেঘফুল পরিচ্ছেদ: ৪৩

0
451

উপন্যাস: মেঘফুল
পরিচ্ছেদ: ৪৩

সকালের নাস্তা খেয়ে ঘুরতে বেরিয়েছে তারা তিন জন- অর্ণব, সামার ও ভায়োলেট। পারভীন কঠিন মুখ করে রেখেছেন। নির্লজ্জের মতো মেয়েগুলো অর্ণবের সঙ্গে ঘুরতে চলে গেল, অথচ তাদেরকে সঙ্গে নেয়ার প্রয়োজন মনে করল না। এ ধরনের স্বভাব একদমই পছন্দ করেন না তিনি। অথচ নিজের মেয়েই সেই স্বভাব ধারণ করে বসে আছে।

গাড়ির দ্বিতীয় আসনে বসলো সামার ও ভায়োলেট। ড্রাইভারের পাশের সিটে অর্ণব। সোনালী আলো গাড়ির কাঁচের ওপর এসে পড়ছে। আনন্দে ঝিলমিল করছে সামার। এইমুহুর্তে তাকে দেখে নিঃসন্দেহে সুখী মেয়ে বলে মনে হবে। তথাপি অর্ণব জানে, যেকোনো মুহুর্তে হারিকেনের সলতের মতো দপ করে জ্বলে উঠবে সে।

সামার ফোনে মেসেজিং করতে করতে মিটিমিটি হাসছে। লুকিং গ্লাসে সেই দৃশ্য দেখে বুকে ব্যথা করে অর্ণবের। সামারের প্রতি তার দূর্বলতা পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। এই দৃশ্য হজম করা তার জন্য খুবই কঠিন।
সে চাইলো দৃশ্যে ব্যাঘাত ঘটুক। তাই গাড়ি দাঁড় করাতে বলল রাস্তার পাশে। সামার মুখ তুলে চাইলো, ‘এখানে নামবো কেন?’
‘একটা দারুণ জিনিস দেখাবো, আসুন।’

গাড়ির দরজা খুলে দিলো অর্ণব। সামার ও ভায়োলেট নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। আশেপাশে দু একটা বাড়ি ছাড়া এই ফাঁকা রাস্তায় দারুন হবার মতো আর কিছুই খুঁজে পেলো না তারা। অর্ণব আশেপাশে তাকিয়ে বলল, ‘আরে এখানে একটা দোকান ছিল তো! কোথায় গেল সেটা?’

চোখ ঘুরিয়ে আশেপাশে দেখছে সে। সামার রাস্তায় নেমে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে তার দিকে। অর্ণব অভিনয়টা ঠিকঠাক জানেনা। তবুও তাকে দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই। এখানে কস্মিনকালেও কোনো দোকান ছিল না। অথচ তাকে দেখে মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি এখানে একটা দোকান না থাকাটা অপরাধ।
সামার বলল, ‘কীসের দোকান ছিল?’
‘চায়ের। এত অসাধারণ চা বানায়। আপনি এক কাপ খেয়ে উঠতেই পারবেন না। কমছে কম চার পাঁচ কাপ খাবেনই। কিন্তু দোকানটা দেখছি না কেন!’
‘হয়ত সরিয়ে ফেলেছে। আর নয়তো আপনার কোথাও একটা ভুল হচ্ছে।’
‘আমার ভুল হচ্ছে!’
‘হতে পারে এখানে কোনো দোকান ছিলোই না।’

চমকে উঠলো অর্ণব। ধরা পড়ার ভয়ে মুখ কাচুমাচু করে সে সামারের দিকে তাকালো। সামার বলল, ‘আপনি যে দোকানের কথা বলছেন, সেটা হয়তো অন্য কোথাও। চলুন কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখি।’

অর্ণব হাফ ছেড়ে বাঁচল। মনেমনে নিজেকে গালি দিলো সে। কিসের দুঃখে মিথ্যে বলতে গিয়েছিল, এই ভেবে আক্ষেপ হল তার। সামার একজন পথচারীকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, ‘এখানে একটা চায়ের দোকান ছিল। আপনি জানেন ওটা কোথায়?’

লোকটা খানিক্ষন চুপ করে থেকে উত্তর দিলো, ‘আমি বলতে পারছি না। এ এলাকায় খুব কম এসেছি আমি।’
‘ধন্যবাদ।’

লোকটা চলে গেলে সামার অর্ণবকে বলল, ‘বাদ দিন। চা খেতে হবেনা। গাড়িতে উঠুন।’
অর্ণব গোবেচারার মতো মুখ করে গাড়িতে এসে ওঠে। ভায়োলেট বলল, ‘আমাদেরকে চা খাওয়াতে না পেরে ভাইয়ার খুব মন খারাপ হয়েছে। সামনে কোথাও একটা দোকানে চা খেয়ে নিলেই হবে। আপনি মন খারাপ করবেন না।’

অর্ণব কোনো উত্তর দেয় না। সে জেনেশুনেই গাড়ি দাঁড় করিয়েছে এখানে। এখন তার আনন্দ পাওয়া উচিৎ। কিন্তু অদ্ভুত কারণে সে আনন্দ পাচ্ছে না, বরং মিথ্যে বলার কারণে অনুশোচনা হচ্ছে। সে বেশ বুঝতে পারল, এসব তাকে দিয়ে হবেনা।
আবারও ফোনে মত্ত হয়ে গেল সামার। অর্ণবের কিছু করার নেই বলেই এই দৃশ্যটি হজম করা ছাড়া উপায় রইল না। কিছুদূর আসার পর একটা চায়ের দোকান দেখে গাড়ি থামাতে বলে সামার। গাড়ি থেকে নেমে সে জানতে চাইলো, ‘এটার কথা বলেছিলেন?’

অর্ণব চুপ করে রইল। সে বিভ্রান্ত। কী উত্তর দেবে জানা নেই তার। সামার তাদের সবাইকে চা দিতে বলে রাস্তার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়৷ বেশ খোলামেলা জায়গা। সূর্য অনেক লখানি মাথার ওপর উঠে গেছে। ঝিলমিল করা রোদে দুই হাত মেলে দিয়ে সামার দাঁড়িয়ে রইল। বুক ভরে বিশুদ্ধ বাতাসে শ্বাস নিচ্ছে সে। অর্ণবের বুকের ভেতর কেমন যেন হয়! মন ভালো হয়ে যায় তার। সামারের প্রেমে নিজেকে নব আঙ্গিকে আবিষ্কার করে সে।

চা হয়ে গেছে। সামার চায়ের কাপ হাতে নিয়ে লম্বা করে একটা চুমুক দিয়ে বলল, বাহ!

অর্ণব চমকে ওঠে। চা ভালো হয়েছে! কীভাবে ঘটলো এই কাকতালীয় ঘটনা?
বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল অর্ণব। চায়ে চুমুক দেয় সে নিজেও। সত্যিই অসাধারণ চা হয়েছে। তার মনে দোলা লাগে। প্রেমে পড়লে সবকিছুই ভালো লাগে নাকি সত্যিই চা’টা এতটা ভালো হয়েছে সেটা বোঝার জন্য সামারের দিকে তাকায় সে।
সামার দ্রুত এক কাপ শেষ করে আরও এক কাপ চেয়ে নিলো। বলল, ‘আপনি ঠিকই বলেছিলেন। খুব ভালো হয়েছে। এক কাপে মন ভরেনি। আমি বললাম না আপনারই ভুল হয়েছে জায়গা চিনতে। দোকানটা এখানেই ছিল, আপনি হয়তো ওখানে ভেবে ভুল করেছেন।’

অর্ণব উত্তর না দিয়ে হাসলো। প্রতি একশো বছরে কী এমন কাকতালীয় ঘটনা ঘটে! নিজেকে সুধালো সে। অনেক্ষণ হাসি লেগে রইল তার মুখে। চা শেষ করে তারা উঠে পড়ল গাড়িতে।
সামার এবার আর ফোন বের করল না। মুগ্ধ হয়ে বাইরের প্রকৃতিকে হৃদয়ে ধারণ করছে সে। সবুজে ঘেরা আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছে তাদের গাড়ি। সামার ড্রাইভারকে বলল, ‘গাড়ির গতি কমিয়ে দিন।’

সময়ের মৃদুমন্দ গতিতে এগিয়ে চলল জাহ্নবী’র জীবন। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে ফোন হাতে নিয়েই সে দেখল সারল্য’র মেসেজ, “ধন্যবাদ জাহ্নবী। আজকের সন্ধ্যাটা সুন্দর করে দেবার জন্য।”

রাত সাড়ে বারোটায় মেসেজটি পাঠিয়েছে সারল্য। জাহ্নবী’র দিনের শুরুটা খুব চমৎকারভাবে হল এই মেসেজ দেখে। সে গুণগুণ করে গান গাইতে গাইতে হাতমুখ ধুয়ে এসে বসল। অফিসে যেতে হবে তাকে।
অফিসে পৌঁছে জাহ্নবী কাজে মন দেয়। কাজ করতে খুব ভালো লাগছে তার। ফুরফুরে লাগছে। পাশের ডেস্কের মেয়েটির এলিয়ে দেয়া চুল দেখে জাহ্নবী অনেক্ষণ তাকিয়ে রইল। আগে মেয়েটি ছিল কোঁকড়াচুলো। এখন সব চুল সোজা হয়ে খানিকটা লম্বাও হয়ে গেছে। ওপরে ঝিলিক দিচ্ছে হালকা বাদামী রং। জাহ্নবী’র খুব শখ জাগছে হঠাৎ। চুলগুলোকে লালচে করে ফেলার।
অফিস থেকে বেরিয়ে একটা পার্লারে এসে ঢোকে সে। পছন্দসই একটা ‘হেয়ার কাট’ দিয়ে চুলে লালচে রং করে। আয়নায় তাকিয়ে নিজেকে দেখে সে মুগ্ধ হয়, কতদিন পর চেনা জাহ্নবী’র বাইরে কাউকে দেখল সে!

ঠিক দুদিন পর সারল্য’র নাম্বার থেকে ফোন এলো। জাহ্নবী চমকে ওঠে। হাসিমুখে ফোন কানে ধরতেই সে শুনতে পেলো সারল্য’র উদ্বিগ্ন গলা, ‘জাহ্নবী, আপনার ব্লাড গ্রুপ কি?’
‘বি পজেটিভ।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কি আজকে একজনকে ব্লাড দিতে পারবেন?’
‘জি পারবো। কোথায় আসতে হবে বলুন?’
‘ল্যাবে এইডে চলে আসুন। আমিও আসছি।’
‘কী হয়েছে বলুন তো আমাকে?’

পান্নবাহার একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘ক্লারার নানু মানে আমার শাশুড়ী মায়ের অপারেশন হয়েছে। ইমার্জেন্সি ব্লাড দিতে হবে।’

জাহ্নবী দ্রুত তৈরি হয়ে নিলো। সারল্য’র স্ত্রীও নিশ্চয়ই সেখানে থাকবে। দেখা হবে দুজনের। যে মেয়েটকে একদিন তার হিংসে হয়েছিল, যাকে দেখে নিজেকে ভীষণ তুচ্ছ বলে মনে হয়েছিল তার। আজ আবার তার সঙ্গে দেখা হবে। রক্ত দিতে হবে তার মাকে। প্রকৃতির এই অদ্ভুত খেলা বোঝার সাধ্য তার মতো ক্ষুদ্র প্রাণীর নেই।

জাহ্নবী হাসপাতালে চলে এলো। অপেক্ষা করছিল সারল্য। জাহ্নবীকে নিয়ে ওপরে চলে এলো সে। বলল, ‘ডোনার ম্যানেজ করেই রেখেছিল ওরা। অপারেশনের আগে এখানেই কার যেন জরুরি ভিত্তিতে ব্লাড দরকার হয়েছিল। ক্লারার মা ডোনারকে বলেছে আপনি ওনাকে দিয়ে দিন। আমার মায়েরটা পরে দেখা যাবে। ওরা আশা করেছিল আম্মার ব্লাড লাগবে না।’
সারল্য’র উদ্বিগ্ন মুখখানা দেখে বড্ড মায়া হল জাহ্নবীর। পরিবারের সকলেই ছুটে এলো তাদেরকে দেখে। এদের মধ্যে সারল্য’র স্ত্রীও আছে। এলোমেলো চুলেও মেয়েটাকে কী অপূর্ব লাগছে দেখতে!

মেয়েটা জাহ্নবীকে বলল, ‘আপনি ভালো আছেন?’
‘জি। চিন্তা করবেন না, সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘থ্যাংক ইউ আপু।’

মেয়েটা ডাক্তারের কাছে ছুটে গেল। ক্লারা এসে জাপটে ধরল ওর বাবাকে। মেয়েকে কোলে তুলে নিলো সারল্য। আদর করে দিয়ে বলল, ‘আমার আম্মুটা, মন খারাপ কোরো না।’
‘বাবা, এই আন্টিটা আমাদেরকে পিজ্জা খাইয়েছিল না?’
‘হ্যাঁ মা। এখন এসব বলে না। আম্মু খুব টেনশনে আছে না?’
‘আমিও খুব টেনশনে আছি বাবা।’
‘ওরে আমার সোনা মা রে।’

ক্লারাকে কোলে নিয়ে পায়চারি করতে লাগল সারল্য। ডাক্তার এসে জাহ্নবীকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন। সারল্য ইশারায় বোঝাতে চাইল, ‘আপনি যান, আমি আছি।’

সব আনুষঙ্গিক কাজ শেষ করে জাহ্নবীকে বেডে শুইয়ে দেয়া হল। সারল্য ক্লারাকে নিয়ে এসে বসলো তার পাশে। রক্তদানের পুরোটা সময় বলতে গেলে পাশেই বসে রইল সে। বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলে জাহ্নবীকে ব্যস্ত রাখতে চেষ্টা করলো। এর মাঝে দু’বার তার স্ত্রী এসে জাহ্নবীকে দেখে গেছে। জাহ্নবী অবাক হয়ে খেয়াল করছে সারল্য ও তার স্ত্রী খুব স্বাভাবিকভাবে থাকার চেষ্টা করছে কিন্তু প্রয়োজন ছাড়া কোনো কথা বলছে না।
কাজ শেষ হলে উঠে পড়ল জাহ্নবী। মেয়েটা কিছু খাবার নিয়ে এসেছে তার জন্য। জাহ্নবী বলল, ‘এসবের কী দরকার ছিল আপু?’
‘আপু, আপনি যে আমার কী উপকার করলেন।’

কথাটা বলেই সে সারল্য’র দিকে তাকালো। চোখাচোখি হল তাদের। মেয়েটি সারল্য’কে কী বোঝাতে চাইছে জাহ্নবী তা ধরতে পারল না। হয়তোবা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে। কিন্তু দুজন আলাদা হয়ে গেলেও তাদের এই চোখাচোখি জাহ্নবী’র সহ্য হল না। বুকের ভেতর এক ধরনের সুক্ষ্ম ব্যথা টের পেলো সে।

ক্লারা ঘুমিয়ে পড়েছে সারল্য’র কোলে। এই মায়াবী দৃশ্যের সমাপ্তি ঘটল যখন তার স্ত্রী বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে নেয়। সারল্য বলল, ‘আমি আছি। সমস্যা নেই।’
‘তুমি অনেক টায়ার্ড। বাসায় যাও।’
‘এখানে থাকি…’

কথা শেষ করতে পারল না সারল্য। ক্লারার মা বলল, ‘না। থাকতে হবেনা। আমরা সবাই আছি। তুমি বাসায় গিয়ে রেস্ট নাও।’

ম্লান হাসল মেয়েটি। সারল্য একটা নিশ্বাস ফেলে জাহ্নবীকে বলল, ‘আসুন।’

হাসপাতাল থেকে বের হয়ে জাহ্নবী ভাবতে লাগল, একটা সম্পর্ক শেষ হয়ে যাওয়াকে বলে বিচ্ছেদ। কিন্তু বিচ্ছেদ হলেই সবকিছু শেষ হয় না, সম্পর্ক কিছু একটা রেখে যায়। যা রেখে যায়, তার কোনো নাম হয়না।

সারল্য জানতে চাইলো, ‘অনেক রাত হয়েছে। পাঠাও পাবো কীনা কে জানে। সিএনজি নেবো?’
জাহ্নবী খানিকটা বিব্রত হয়ে বলল, ‘সরি, কীভাবে যে বলি..’
‘কোনো সমস্যা?’
‘আমার বাসার গেট বন্ধ হয়ে যায় এগারোটায়। এখন তো সাড়ে বারোটা বেজে গেছে। এত রাতে দাড়োয়ানকেও মনে হয় পাবো না।’

সারল্য কিছু একটা ভেবে ঝট করে উত্তর দিলো, ‘আমার বাসায় যেতে আপনার আপত্তি আছে? বাড়িতে আম্মু আছে, আমার বোন, ভাগ্নী আছে।’

জাহ্নবী ইতস্তত বোধ করল। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়েই সে ভাবছিল আজকে বাসায় যাবে কীভাবে। বাড়িওয়ালা অনেক কড়া। রাত এগারোটায় গেট বন্ধ হওয়ার পর দাড়োয়ানকে পাওয়া যাবে কী না নিশ্চিত ছিল না সে। এর আগে কখনো সে রাত করে ফেরেনি। আজ রাতটা হাসপাতালেই থেকে যাবে ভাবছিল সে। সারল্য’র প্রস্তাবে ভীষণ চমকে উঠেছে।
সারল্য বলল, ‘চিন্তার কিছু নেই। আমার আম্মু অনেক মিশুক। আপনার অসুবিধা হবে না। কাল সকালে আমি আপনাকে অফিসে রেখে আসবো। আমি তো ভেবেছিলাম রাতটা হাসপাতালেই কাটিয়ে দেবো। ও তো আমাকে থাকতেই দিলো না..’
জাহ্নবী বলল, ‘আপনাকে সত্যিই অনেক ক্লান্ত দেখাচ্ছে।’
‘আপনাকেও। সারাদিন অফিস করে ফিরেছেন, আমি তখনই ফোন দিয়েছি। আপনার প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা।’

জাহ্নবী ম্লান হাসলো। রাস্তার ওপাশে আলো জ্বলতে থাকা ‘আড্ডা’ রেস্টুরেন্টের দিকে চোখ গেল তার। মনে পড়ে গেল সেই রাতের কথা। এখানেই পার্টি হয়েছিল নাদির স্যারের। মখমলি ব্লাউজের সঙ্গে শাড়ি পরে সাজগোজ করে এসেছিল সে। কিন্তু ফিরে গিয়েছিল ব্যথাতুর হৃদয় নিয়ে। সেদিন রাতেই পান্নাবাহারের স্ত্রীকে প্রথম দেখেছিল সে। স্লিভলেস গাউন পরা, গলায় হিরের নেখলেস। অপূর্ব রূপবতী মেয়েটিকে দেখে তার হিংসে হয়েছিল, কষ্ট হয়েছিল। পান্নাবাহারকে মন থেকে সরিয়ে ফেলতে রাতের পর রাত নির্ঘুম বিষাদে কেটেছিল তার।

সারল্য’র ডাকে জাহ্নবী সম্বিত ফিরে পেলো, ‘যাবেন না?’
‘হুম, চলুন।’

রাস্তার পাশে হাঁটতে শুরু করল তারা। একটা রাইড পেয়ে গেছে। গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে করতে সারল্য একজনের সঙ্গে ফোনে কথা বলে নিলো, ‘আমি বলছিলাম ক্লারাকে আজ নিয়ে যাই? কালকে সকালেই নিয়ে আসবো নাহয়?’

ওপাশ থেকে কী উত্তর এলো বোঝা গেল না। তবে নিশ্চয়ই ‘না বোধক’ কিছু। সারল্য একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে জাহ্নবীকে বলল, ‘আসুন, গাড়ি এসে গেছে।’

গাড়িতে উঠে বসলো দুজনে। জাহ্নবী জিজ্ঞেস করল, ‘ক্লারাকে অনেক মিস করেন তাইনা?’
‘হুম, তা তো করবোই। আমার মেয়ে তো।’

সারল্য’র কণ্ঠে স্পষ্ট বিষাদ অনুভব করল জাহ্নবী। সে ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করতে চাইল না। কেবল বলল, ‘কষ্ট পাবেন না। কঠিনকে মেনে নিন সহজে।’
‘হুম, মেনেই তো নিয়েছি।’
‘আন্টি কিছু মনে করবেন না তো আমাকে দেখে?’
‘কী মনে করবে?’
‘এত রাতে অপরিচিত একজন মেয়ে আমি, আমার লজ্জা লাগছে।’
‘ধুর, আপনি তো আমার বন্ধু। সবচেয়ে বড় কথা, আজকে এত বড় একটা উপকার করলেন।’

জাহ্নবী চুপ করে রইল। দ্রুত পৌঁছে গেল তারা। সারল্য’র বাড়িতে এই প্রথম এসেছে সে। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কলিংবেল চাপল সারল্য। মিনিট দুয়েক লাগল দরজা খুলতে। একজন মেয়ে দরজা খুলে জাহ্নবীকে দেখে ভড়কে গেলেন। সারল্য বলল, ‘ও আমার বোন শার্লিন। শার্লি, ও জাহ্নবী, আমার বন্ধু। মা ঘুমিয়েছে রে?’
‘হ্যাঁ, মাত্র ঘুমালো।’

শার্লিন জাহ্নবীকে ভেতরে আসার আমন্ত্রণ জানায়। স্মিত হেসে জাহ্নবী বলল, ‘এত রাতে আপনাদের বিব্রত করলাম। সরি আপু।’
‘ইটস ওকে। আসুন।’

ওদেরকে লিভিংরুমে রেখে শার্লিন ঘরের ভেতরে চলে গেল। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো জাহ্নবী। মৃদু হলুদ আলোয় ঘরটাকে স্বর্গীয় লাগছে। সারল্য বলল, ‘আপু আপনাকে রুমে নিয়ে যাবে। ফ্রেশ হয়ে নিন। খিদেও পেয়েছে বোধহয়। আমি খাবার গরম করে দিতে বলি।’
‘এত ব্যস্ত হবেন না প্লিজ।’

শার্লিন ফিরে এসে বলল, ‘আপু, আপনি ফ্রেশ হবেন, আসুন।’

ঘুম ঘুম চোখে একজন মহিলা বেরিয়ে এলেন। দেখে বোঝাই যাচ্ছে তিনি সারল্য’র মা। বয়সের ভাড়ে নুয়ে পড়া চেহারাটাতেও কী ভীষণ মায়া!

জাহ্নবী উঠে গিয়ে ওনাকে সালাম করলো। চোখ টেনে ভ্রু ওপরে তুলে জাহ্নবীকে দেখলেন তিনি।
সারল্য বলল, ‘আম্মু, উনি জাহ্নবী। উনিই জারার মাকে ব্লাড দিলেন। হসপিটাল থেকে আসলাম।’
‘খুব ভালো কাজ করেছো তুমি মা।’

মহিলা জাহ্নবীকে জড়িয়ে ধরলেন। মায়ের শরীরের পরম সুঘ্রাণ পেলো জাহ্নবী। সে বলল, ‘অনেক রাতে কষ্ট দিলাম খালা আপনাকে।’
‘না গো, কীসের কষ্ট। তুমি হাত মুখ ধুয়ে আসো। আমি খাবারটা গরম করে দেই। তুমি নাহয় গোসলই করে ফেলো, খুব ভালো লাগবে। বাথরুমে গরম পানি আছে।’

জাহ্নবী ভদ্রতাসূচক হাসলো। মহিলা শার্লিনকে বললেন, ‘তোর ঢিলেঢালা একটা ড্রেস থাকলে দে না ওনাকে। কিছু মনে করোনা মা, শার্লিন অনেক শুকনা তো।’
শার্লিন বলল, ‘আমি দেখছি আপু। আমার অনেক টপস আছে, শার্ট আছে, ওগুলো আপনার হবে। কিন্তু প্যান্ট তো হবে না।’
শার্লিনের মা বললেন, ‘স্কার্ট আছে না তোর?’

জাহ্নবী বলল, ‘খালা, আপনি আমাকে আপনার একটা শাড়ি দিন, আমি শাড়ি পরবো।’
‘শাড়ি পরবে!’ বিস্মিত হলেন মহিলা।
‘অসুবিধা নেই, আমি শাড়িতেই কমফোর্ট ফিল করি।’

মহিলা স্মিত হাসলেন। জাহ্নবী কথাটা বলে চুপ করে রইল। তার শাড়ি পরার অভ্যাস নেই। কখনো শাড়ি পরেও না সে। আজ কেন যেন মন থেকে শাড়ি পরার সাধ জাগছে। পান্নাবাহারের মায়ের ব্যবহার করা শাড়ি পরলে তার শান্তি শান্তি লাগবে। সেই অনুভূতিটা পেতে চায় সে।
মহিলা জাহ্নবীকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন। আলমারি থেকে একটা সুন্দর শাড়ি বের করে দিলেন তিনি। সঙ্গে একটা ব্লাউজও দিলেন। জাহ্নবী শাড়ি ও তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে ঢুকল। শাড়িতে হাত বুলিয়ে ঘ্রাণ নেয় সে। মা মা একটা ব্যাপার আছে এই শাড়িতে। সঙ্গে মিশে আছে ন্যাপথলিনের ঘ্রাণ। ওর হৃদয়টা ভরে গেল প্রশান্তিতে। এই সুখটুকু তার জীবনে বড্ড প্রয়োজন ছিল।

গোসল সেরে বেরিয়ে জাহ্নবী চুল মুছে নেয়। একা একা শাড়ি পরার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় সে। সারল্য’র মা ঘুম জড়ানো চোখ নিয়েই তাকে শাড়ি পরিয়ে দেয়। জাহ্নবীর ভীষণ আপন আপন লাগে ওনাকে। জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে। মায়েরা মেয়েদেরকে শাড়ি পরিয়ে দেয়। কিন্তু পারভীন কখনো তার কাছে আসেনা, তাকে শাড়ি পরিয়ে দেয়া তো অলীক স্বপ্ন!

শাড়ি পরে খাবার টেবিলে চলে আসে জাহ্নবী। ওর প্লেটে খাবার তুলে দিতে দিতে মহিলা ছেলেকে ডাক দিলেন, ‘পিকলু, খেতে আয়।’

জাহ্নবী মনেমনে হাসল, ‘সারল্য’র ডাক নাম তাহলে পিকলু!’

সে অপেক্ষা করে পান্নাবাহারের জন্য। গোসলের পর ভীষণ সতেজ লাগছে তার। শাড়ি পরে খুব লজ্জা লজ্জা লাগছে। লজ্জাটাকে আড়াল করে সহজ হওয়ার চেষ্টা করলো সে। আগেই বলেছে শাড়িতে সে আরামবোধ করে। এখন মোটেও অস্বস্তিতে পড়া যাবে না।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here