মেঘফুল পরিচ্ছেদ: ৪৬,৪৭

0
497

মেঘফুল
পরিচ্ছেদ: ৪৬,৪৭
লেখনীতে: মিশু মনি
৪৬

সামার একটা চিৎকার দিতে গিয়ে নিজেকে সংবরণ করল। বাড়িভর্তি মেহমানের সামনে চেঁচামেচি করে নিজেকে কুৎসিত প্রমাণের প্রয়োজন নেই। শান্ত গলায় সে পারভীনকে বলল, ‘একটা কথা তোমার জানা দরকার মা। তুমি ভুল করছো।’
‘আমি ভুল করছি মানে কী?’
‘মা, অর্ণবের সঙ্গে আমার কোনো পছন্দের সম্পর্ক নেই। তোমরা যা জানো সেটা ভুল জানো।’

পারভীন যেন আকাশ থেকে পড়লেন। অবিশ্বাসী চোখে তিনি সামারকে দেখছেন। তার মুখচ্ছবি দেখেই অনুমান করা যায়, এ কথাটা শোনার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না তিনি।

সামার বলল, ‘অর্ণবকে আমি কোনোকালেই পছন্দ করতাম না। আমি ওকে ভাইয়ের মতো দেখতাম, বা বলতে পারো বন্ধুর মতো। আমি একজনকে পছন্দ করি। তার ব্যাপারে অর্ণবকে বলেছিলাম যেন সে তোমাদেরকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলে। তুমি আর বাবা দুজনেই অর্ণবকে পছন্দ করো, তাই ও হয়তো তোমাদেরকে সহজে রাজি করাতে পারবে। কিন্তু এখানে একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। অর্ণব আমার কথা বুঝতে পারেনি। সে ভেবেছে আমি ওর সঙ্গে বিয়ের কথা বলতে বলেছি। এবার বুঝতে পেরেছো মা?’

পারভীন কঠিন মুখে তাকিয়ে রইলেন সামারের দিকে। তার পা কাঁপছে থরথর করে। এক্ষুণি হয়তো জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে যাবেন তিনি। সামারকে সামনাসামনি দেখতে পাচ্ছেন না, চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।

সামার মাকে ধরে ফেলল। মায়ের বাহু শক্ত করে ধরে বিনয়ের সুরে সে বলল, ‘মা, অর্ণব আমাকে অনুরোধ করেছিল যেন সত্যিটা কাউকে না বলি। তাহলে ওর বাবা মা কষ্ট পাবে। ও চেয়েছিল কিছুদিন যাওয়ার পর বাসায় জানাবে, আমার সঙ্গে ওর আর বনিবনা হচ্ছে না। এভাবে সবকিছু ম্যানেজ করে নেবে ও। প্লিজ তুমিও বিষয়টাকে চেপে যাও। কাউকে কিছু বলো না আমার লক্ষী মা। শুধু আজকের দিনের মতো বিয়েটা পিছিয়ে দাও। বলো ঢাকায় গিয়ে বিয়ে হবে।’

পারভীন আর কিছু শুনতে পাচ্ছেন না। ওনার মাথা ঘুরছে। ঝাপসা চোখে তিনি সামারকে ধরে রেখেই জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন।
মাকে বিছানার ওপর শুইয়ে দিলো সামার। ওর বুক কাঁপছে। হাই প্রেশারের রোগী পারভীন। আবার হার্ট অ্যাটাক না করে বসে! দ্রুত বাইরে গিয়ে ভায়োলেটকে ডেকে আনলো সে। দুইবোন মিলে মায়ের জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করল।

পারভীন আস্তে আস্তে চোখ মেলে নিষ্পলক চোখে সামারের দিকে তাকালেন। সামার মায়ের হাত চেপে ধরে বলল, ‘মা, ঠিক আছো তুমি?’
অনেক্ষণ পর পারভীন মৃদু স্বরে বললেন, ‘আমাদের মান সম্মান নষ্ট করিস না সামার। তুই বিয়েটা করে ফেল।’
সামার আঁৎকে উঠে বলল, ‘এটা অসম্ভব। আমি তোমাকে সবই বললাম। তবুও এই কথা কীভাবে বলছো তুমি মা!’
পারভীন উত্তেজিত হলেন না। শান্ত গলায় বললেন, ‘তোর চাচা চাচী, নানুবাড়ি, দাদাবাড়ি, সব আত্মীয় স্বজনকে বলা হয়ে গেছে তোর এনগেজমেন্ট হইছে। সবাইকে কি উত্তর দেবো আমি?’
‘তাতে কি হয়েছে মা? বলবে ওই ছেলের সঙ্গে বিয়ে দাওনি।’
‘জাহ্নবীকে নিয়ে কথা শুনতে শুনতে আমি আর পারিনা। তোরা আমাদের সম্মানটা আর নষ্ট করিস না সামার।’
সামার পারভীনের হাত ধরে অনুরোধের সুরে বলল, ‘আমরা তো খারাপ কিছু করছি না মা। বিয়ে করে সারাজীবন সংসার করবো আমরা। কাজেই এই সিদ্ধান্ত টা আমাদেরকেই নিতে দাও।’
পারভীন কিছু বললেন না। ওনার দুচোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। সম্ভবত আত্মসম্মানবোধে আঘাত লেগেছে তার। কিংবা মেয়েকে নিজের পছন্দে বিয়ে দিতে না পারার দুঃখে তীব্র কষ্ট পাচ্ছেন।
তিনি বললেন, ‘তোরা যা ভালো মনে করিস তাই কর। আমি মরলে তোরাই দায়ী থাকবি।’

সামার ও ভায়োলেট বিদ্যুৎ শক খাওয়ার মতো চমকে উঠলো। পারভীন চোখ মুখ শক্ত করে রাখলেন। সারাজীবন অসুখী ছিলেন তিনি। সবকিছু থাকার পরও কখনো নিজেকে নিয়ে সুখী হতে পারেননি। মেয়েদের কাছাকাছি আসতে পারেননি কখনো। এই বয়সে এসে তার সবার প্রতি রাগ হয়, অকারণে অসহ্য লাগে সবাইকে। তিনি আবারও বলে ফেললেন সেই কুৎসিত বাক্যটি, ‘আজ যদি আমি মারা যাই, তুই আর জাহ্নবী দায়ী থাকবি। আমার মৃত্যু তোদের জন্যই হবে।’
এত নোংরা একটা বাক্য সামার হজম করতে পারলো না। মায়ের হাত ছেড়ে দিয়েছে সে অনেক আগেই। এবার পাশ থেকে উঠে পড়ল। ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে গেল বাইরে। পারভীনের সঙ্গে সামারের সম্পর্কটা আর পাঁচটা মা মেয়ের সম্পর্কের মতো নয়। পারভীন কোনোদিনও পারেননি সামারকে বুকে টেনে নিয়ে আদর করতে। সবসময় একটা অদৃশ্য দেয়াল তাদেরকে রেখেছে আলাদা করে। তা সত্ত্বেও সামার মায়ের এই কথাটি মেনে নিতে পারছে না।

কয়েক মুহুর্তের মাঝেই ঘরে প্রবেশ করল সামার। পারভীন অন্যদিকে মুখ করে রেখেছেন। সামারের চেহারায় কাঠিন্য ভর করেছে। ভায়োলেট এগিয়ে গেল তার দিকে। বোনকে কিছু বলার আগেই সামার স্পষ্ট গলায় বলল, ঠিক আছে। আমি অর্ণবকে বিয়ে করবো। কাজি ডাকতে বলো। বিয়ে আজকেই সম্পূর্ণ হবে।
পারভীন সামারের দিকে তাকালেন। ভায়োলেট কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। বোনের হাত ধরতে যাবে, এমন সময় সামার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
রান্নাঘরে অর্ণব তার মা ও বোনের সঙ্গে গল্প করছিল। সামার তার সম্মুখে গিয়ে দাঁড়াল, ‘আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল।’
অর্ণব বিব্রতবোধ করে, মায়ের মুখের দিকে তাকায়। তাদের সামনে সামারের সঙ্গে যেতে লজ্জা করছিল তার। তবুও সে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়াল।

সামার জানতে চাইলো, ‘আপনি কি জানেন আজকে আমাদের কাবিন?’
অর্ণব জানেনা কিছুই। তাকে জানানো হয়নি। কথাটা সামারের মুখে প্রথমবার শুনে যারপরনাই চমকে উঠলো সে, ‘মানে!’
‘মানে আজকে আমাদের বিয়ে।’
‘শান্ত হোন সামার। আমি বিষয়টা দেখছি। আপনি টেনশন করবেন না।’
‘কী দেখবেন? যা দেখার আগেই দেখা প্রয়োজন ছিল। এখন আর কিছু দেখার সময় নেই।’
‘আমি আংকেলকে সবকিছু খুলে বলবো। প্লিজ আপনি রাগ করবেন না।’
‘আপনি বিয়ের সব আয়োজন করতে বলুন। বিয়ে আজকেই সম্পূর্ণ হবে। আত্মীয় স্বজন আরও কাউকে ডাকার প্রয়োজন হলে ডাকতে বলুন। এরপর আর কোনো প্রোগ্রাম হবে না।’

অর্ণব স্তব্ধ হয়ে রইল খানিকক্ষণ। সামারের এই কাঠিন্যভাব দেখতে তার ভালো লাগছে না। সে সামারকে চায়, তবে এভাবে নয়।
অর্ণব বলল, ‘আমি এখনই মাকে সবকিছু খুলে বলবো সামার। আপনি রাগের মাথায় কিছু করবেন না প্লিজ।’
‘আপনাকে কি বলেছি শুনতে পাননি? বিয়ের আয়োজন করতে বলুন।’
‘আংকেল আন্টি আপনাকে কিছু বলেছে?’
‘সেসব আপনার না জানলেও চলবে।’
‘আমি ওনাদের সঙ্গে কথা বলি। আপনি একটু সময় দিন আমাকে।’
‘আমার ফ্যামিলির সঙ্গে আর কোনো কথা বলার প্রয়োজন নেই।’
অর্ণব একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।’
‘আন্টি কিছু বলেছে আপনাকে তাইনা? ওনাদের সঙ্গে রাগ করে আপনি এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।’
‘জীবনের কিছু কিছু সিদ্ধান্ত চাইলেই নিজে নিজে নেয়া যায়না। পরিস্থিতি আপনাকে বাধ্য করবে সেসব সিদ্ধান্ত নিতে।’
‘আপনাকে আমি বাধ্য হতে বলছি না। আপনি দাঁড়ান। আন্টিকে যা বলার আমিই বলছি। আমাকে লাস্ট একটা সুযোগ দিন।’
অর্ণব সামারের আর কোনো কথা শোনার অপেক্ষায় রইলো না। দ্রুতপায়ে হাঁটতে হাঁটতে সে পারভীনের সঙ্গে কথা বলতে চলে গেল। বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সামার। সে এখন কী করবে? অর্ণবের কথা শুনে পারভীনের কেমন প্রতিক্রিয়া হয়, সেটা ভেবেই তার দুশ্চিন্তা হচ্ছে।

দরজায় দাঁড়িয়ে অর্ণব বলল, ‘আন্টি আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল।’
শোয়া অবস্থায় করুণ মুখে পারভীন তাকালেন অর্ণবের দিকে। তার মুখে বিষাদের তীব্র ছায়া। তিনি জানেন ছেলেটা কী বলতে এসেছে।

চলবে..

মেঘফুল
পরিচ্ছেদ: ৪৭
লেখনীতে: মিশু মনি

পারভীনের করুণ দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে অর্ণবের মনে মায়া হলো। তিনি সন্তানের মতো স্নেহের ডোরে বেঁধেছেন অর্ণবকে। পরম মমতায় তাকে আপন করে নিয়েছেন। আজকের পর থেকে হয়তো আর এই সম্পর্কটা থাকবে না। অর্ণব গুটিগুটি পায়ে ঘরে প্রবেশ করে পারভীনের পাশে বসল।

পারভীন মানুষের সঙ্গে মিশতে অভ্যস্ত নন। তবুও অর্ণব পাশে বসামাত্র ওনার হৃদয়ে মায়ার উদ্রেক হলো। এই ছেলেটাকে সবসময়ের জন্য নিজের ছেলে বানিয়ে ফেলার সাধটাকে বুঝি তার মেয়েটা পূরণ হতেই দেবে না। তিনি একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে অর্ণবের দিকে তাকালেন।

অর্ণব মাথা নিচু করে মৃদু স্বরে বলল, ‘আন্টি আমাকে ক্ষমা করবেন। আপনি হয়তো এতক্ষণে সবকিছু শুনেছেন। আসলে সব দোষ আমার। আমি একটা বোকা ছেলে। আপনার মেয়ের কথা বুঝতে পারিনি আমি। সবকিছু গোলমাল পাকিয়ে ফেলেছি। কিন্তু এটা আমাকেই সমাধান করতে হবে। জীবনটা তো আর নাটকের মতো না। আমরা দুজন দুজনকে চাইনা, কেউ কাউকে পছন্দ করিনা, মিছেমিছি আমাদের বিয়ে দিয়ে দুজনের জীবনটা নষ্ট করে দিবেন না আন্টি।’

অর্ণব কথাটা বলতে গিয়ে বুঝতে পারল তার গলা কাঁপছে। কারণ শেষ বাক্যটা মিথ্যে ছিল। সামার তাকে পছন্দ করেনা সত্যি, তবে সে হৃদয়ের গহীন অরণ্যে ছোট্ট কুঁড়েঘর বানিয়েছে সামারের জন্য। গত কয়েকদিনে কাছ থেকে দেখার পর সামারের প্রতি তীব্র প্রেমের বাসনা জেগে উঠেছে তার। সে সামারকে চায়, এমনকি এখনও মনেমনে সে চাইছে, দূর্ঘটনার মতো তাদের বিয়েটা হুট করে হয়ে যেত যদি!

সামারের চোখে নায়ক সাজার জন্য পারভীনের কাছে এসে কথাগুলো স্বীকার করে নিলো অর্ণব। এতে হয়ত তাদের বিয়েটা হবেনা, তবে সামারের মনে নিশ্চয়ই তার জন্য একটা সহানুভূতির জায়গা তৈরি হবে। ভালবাসার তৃষ্ণা মানুষকে বাস্তবতা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। অর্ণবের মাঝেও ভর করেছে সেই তৃষ্ণা। সামারকে পাওয়ার আশা সে ছাড়বে না।

বিনয়ের সুরে অর্ণব বলল, ‘আপনি আমাকে ছেলের মতো আপন করে নিয়েছেন আন্টি। আমি আপনার ছেলে হয়ে থাকবো। আমাদের সম্পর্কটা হাজার বছর স্থায়ী হোক সেই দোয়া করি। কিন্তু সামারের ইচ্ছের বিরুদ্ধে আপনি প্লিজ ওর ওপর কিছু চাপিয়ে দেবেন না।’
পারভীন স্থির চোখে অর্ণবকে দেখছেন। এই বিনয় মুগ্ধ করছে তাকে। তিনি গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘এতদিন কথাগুলো আমাকে বলো নাই কেন তোমরা? আমাদেরকে সহজ সরল পেয়ে এভাবে মিথ্যাচার করে গেছো।’
‘ভুল বুঝবেন না আন্টি। আসলে আমি বিষয়টাকে গোলমেলে পাকিয়ে ফেলেছি। আব্বা আম্মাকে কষ্ট দিতে চাচ্ছিলাম না। পরে কিছু একটা বলে ওনাদেরকে ম্যানেজ করা যাবে সেই আশায়..’

অর্ণব আর কিছু বললো না। সামার এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়। তার উপস্থিতি বুঝতে পেরে মাথাটা আরও নিচু করে ফেললো অর্ণব। ভদ্রতার সঙ্গে বলল, ‘আন্টি আমি সবাইকে ম্যানেজ করবো। আপনারা সামারকে কিছু বলবেন না। ওকে ওর পছন্দের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিবেন। তাতে ও সুখী হবে। মেয়ে সুখী হোক সেটা তো সব বাবা মায়েরাই চান।’

সামার ভেতরে ঢুকে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে পারভীনের দিকে তাকিয়ে রইল। তার মাকে দেখে এখন অসুস্থতায় শয্যাশায়ী মানুষের মতো মনে হচ্ছে। কী অসহায় দেখাচ্ছে ওনাকে! সামার জানেনা এরপর ওনার শারীরিক পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে। অনাকাঙ্ক্ষিত এই পরিস্থিতি যেন খুব দ্রুত সমাধান হয়ে যায়।

অর্ণব বলল, ‘আন্টি, প্লিজ কষ্ট পাবেন না। আমাকে মাফ করে দিন।’
অর্ণব উঠে দাঁড়াল। এরপর পারভীন কী বলবেন তা জানেনা সে। কিছু বললেও সেটাকে সামলে নেয়ার মতো শক্তি তার নেই। তাই যত দ্রুত সম্ভব এখান থেকে সরে যেতে চায় সে। সবকিছু সময়ের ওপর ছেড়ে দেয়াই এখন সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত।

অর্ণব ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে সামার ভায়োলেটকে বলল, ‘আমার সঙ্গেই সবসময় কেন এমন হয় বলতো?’
সামারের হাত ধরল ভায়োলেট। মৃদু স্বরে বলল, ‘সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে আপু।’

পারভীনের দৃষ্টি সিলিংয়ের দিকে। তিনি ভাবছেন কীভাবে আত্মীয় স্বজনদের মুখ দেখাবেন। সবার কাছে তাকে কথা শুনতে হয়। কোনো অনুষ্ঠানে যেতে পারেননা এসবের ভয়ে। মেয়েদের বিয়ে না দিয়ে তিনি যেন জীবনের সবচেয়ে বড় অন্যায়টা করেছেন। কিন্তু তিনি কীইবা করতে পারেন। যার জীবন, সিদ্ধান্তটা তো তারই নেয়া উচিৎ।

সামার বলল, ‘আম্মু, আমাকে দোষারোপ করতে পারবা না। আমি বিয়ে করতে রাজি হইছি। অর্ণবকে বলছি বিয়ের আয়োজন করতে। এখন সেই বিয়ে করতে চাচ্ছে না। এটা কিন্তু আমার দোষ না।’
পারভীন চুপ করে রইলেন। সামার চুপ থাকতে পারল না। সে আবারও বলল, ‘আমি চাইনা আমার জন্য কেউ মরুক। আমাকে নিয়ে কারও না ভাবলেও চলবে।’
ভায়োলেট সামারের হাত চেপে ধরে বলল, ‘চুপ কর আপু।’

সামার মুখে কাঠিন্য এনে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। বাড়িতে মেহমান গিজগিজ করছে। কারও সাথে দেখা হলেও বিরক্ত লাগছে তার। সিঁড়ি বেয়ে সোজা ছাদে চলে গেল সে। মেজাজটা অন্তত ক্ষিপ্ত।

ভায়োলেট অর্ণবের কাছে এসে বলল, ‘আমার আপু একটু অবুঝ। ও হয়তো আপনাকে উল্টাপাল্টা কিছু বলে ফেলবে। হয়তো এতক্ষণে বলেও ফেলেছে। আপনি কিছু মনে করবেন না। তবে আমি বলবো, বিয়েটা আটকান। আপনার বাসায় কিছু জানানোর দরকার নেই। আমার মা বাবা সত্যিটা জেনে গেছেন। আমি ওনাদের চিনি। একটু পরেই সব শান্ত হয়ে যাবে। মা অভিমানী মানুষ, আপুও অভিমানী মেয়ে। তারা একে অপরের সঙ্গে রেগে থাকবে, এতটুকুই। এর বেশী কিচ্ছু হবে না। আপনি যেভাবে প্লান করে আপনার পরিবারকে সামলাচ্ছিলেন, সেভাবেই আগান। অসুবিধা হবেনা। ধীরেসুস্থে ওনাদেরকে ম্যানেজ করে নিলেই হবে।’

শান্ত গলায় এত সুন্দর করে ভায়োলেট কথাগুলো বলে গেল যে, কঠিন হলেও অর্ণবের ভালো লাগল শুনতে। সে ম্লান হেসে বলল, ‘থ্যাংক ইউ ভায়োলেট। আপনি সবকিছু খুব ভালো বোঝেন। আপনার বোনটা যদি বুঝতো!’
ভায়োলেট শুষ্ক হাসি টেনে বলল, ‘আপুর একটু মাথা গরম।’
‘শুধু মাথা না, ওর সবটাই গরম। এত রাগী, বদমেজাজি মেয়ে আমি আর একটাও দেখিনি।’
‘তাও তো আপনি ওকে ভালবাসেন।’
অর্ণব চমকে উঠলো। ভায়োলেটের চোখের দিকে তাকিয়ে এই সত্যটা স্বীকার করতে পারছিল না সে। তাই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখল। কীভাবে বুঝল এই মেয়েটা!

ভায়োলেট বলল, ‘আপনাকে একটা কথা বলবো অর্ণব ভাইয়া। পরিস্থিতি শান্ত হোক। সবকিছু স্বাভাবিক হোক। তারপর বলবো।’

ভায়োলেট চলে গেল সেখান থেকে। অর্ণব একটা নিশ্বাস ফেললো। সে সামারকে ভালোবাসে, এটা ভায়োলেটের মুখে শোনার পর কেমন যেন টনটন করছে বুকের ভেতর। সত্যিই সে ভালবাসে সামারকে। শেষ পর্যন্ত সে সামারকে প্রাপ্তির চেষ্টা অবশ্যই করবে।
অর্ণব রান্নাঘরে ঢুকে তার মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আম্মা, শুনলাম আজ নাকি আমার বিয়ে দিতে চাও?’
‘সবাই বলছিল। আমরা সামারের মাকে জানিয়েছি। দেখি ওনারা কী বলেন।’
‘আম্মা, আমি আপনার একমাত্র ছেলে। ভালো চাকরি পাইছি। এইভাবে আমি বিয়ে করতে চাই না। আগে আমাকে একটু গোছাইতে দাও। দেখবা আমার আম্মাকে আমি রানীর মতো রাখবো। খুব ধুমধাম করে সবাইকে জানিয়ে বিয়ে করবো।’
‘এখন কাবিন করে রাখ। অসুবিধা কী? পরে সময়মত বিয়ে উঠাইয়া নিবো।’
‘না গো আম্মা। কাবিন করলে আমার ওপর প্রেশার আসবে। বিয়ের পর আগের মতো কিছুই হয় না। আমি টাকা পয়সা, চাকরি কিছুই গোছাইতে পারবো না। আগে একটু গোছাইতে দাও আমাকে।’
‘আচ্ছা বাবা, তুই যা ভালো মনে করিস।’
অর্ণব মায়ের মুখখানা ধরে তার মাথায় একটা চুমু খেয়ে বলল, ‘খিদা লাগছে। কিছু খাইতে দাও। আর ওদেরকে একটু নাস্তা দাও। অনেক্ষণ সবাই না খেয়ে আছে।’
‘আচ্ছা দিচ্ছি। তুই বস।’

অর্ণব স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। সামার তাকে ভরসা করেছিল। শেষ পর্যন্ত এই বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পেরেছে সে। আগামীকাল এখান থেকে সসম্মানে চলে গেলেই আর ঝামেলা নেই। বাকিটা নাহয় সময়ই বুঝে নেবে। তার হঠাৎ মনে পড়ল সামারের কথা। রাগে আগুন হয়ে কোথায় গেল মেয়েটা!

নাস্তার টেবিলে বসে জাহ্নবী সারল্যকে বলল, ‘আমাকে এক্ষুনি বের হতে হবে। অফিসে দেরী হয়ে যাচ্ছে।’
‘দেরী হতে দিচ্ছে কে? আপনাকে অফিসে পৌঁছে দেয়ার জন্যই তো এত সকাল সকাল উঠলাম।’

মুচকি হাসলো জাহ্নবী। গত রাতে সারল্য’র বারান্দায় দাঁড়িয়ে কত গল্প করেছে ওরা! জীবনের গল্প, অতীতের গল্প, কত সুখ, ব্যথার গল্প। একটি রাতই দুজনকে এনে দিয়েছে আরও অনেক অনেক কাছে। মনের এত কাছাকাছি থাকা মানুষটাকে বাস্তবতায় কাছাকাছি পেয়ে জাহ্নবীর স্বপ্ন স্বপ্ন লাগে সবকিছু।

সারল্য বলল, ‘আপনি শাড়িটা চেঞ্জ করলেন কেন? ওটা পরেই অফিসে চলে যেতেন।’
‘মাথা খারাপ? আমি শাড়ি পরে অফিসে যাবো?’
‘হ্যাঁ। এখন তো মেয়েরা শাড়ি পরে ইউনিভার্সিটিতে যায়, অফিসে যায়। আমার মায়ের শাড়িটা আপনাকে ভালো মানিয়েছিল। সত্যি বলতে এর আগে মা ছাড়া কাউকে কখনো মায়ের শাড়িতে দেখিনি।’

লাজুক ভঙ্গীতে হাসলো জাহ্নবী। কথাটা শুনতে বড্ড ভালো লেগেছে তার। মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল মুহুর্তেই।
সারল্য তার মাকে ডেকে বলল, ‘আম্মু তোমার শাড়িটায় জাহ্নবীকে ভালো মানিয়েছে। ওটা ওকে দিয়ে দাও।’
জাহ্নবী তৎক্ষনাৎ বলে উঠল, ‘আরে না না। আমি খুব কম শাড়ি পরি। আমার লাগবে না খালা।’

সারল্য বলল, ‘না আম্মু, তুমি ওকে দিয়ে দাও। তোমার তো অনেক শাড়ি।’
সারল্য’র মা মুচকি হেসে জাহ্নবীর পাশে এসে দাঁড়ালেন, ‘নিয়ে যাও মা। সারল্য এত করে বলছে যখন।’
‘খালা, লাগবে না।’
‘আমি দিচ্ছি তুমি নাও। তুমি আমাকে খালা বলে ডাকছো না? খালার তরফ থেকে উপহার মনে করে নাও।’

জাহ্নবী এবার আর না করতে পারলো না। সারল্য’র মা ঘরে গিয়ে একটা কাগজের ব্যাগে শাড়িটা তুলে দিলেন জাহ্নবী’র হাতে। কৃতজ্ঞতায় ওনাকে জড়িয়ে ধরে জাহ্নবী বলল, ‘আমাকে মায়ায় জড়িয়ে ফেললেন খালা।’
‘মাঝেমাঝে আইসো বাসায়। খালাকে দেখতে, কেমন?’
জাহ্নবী লাজুক হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘আসবো খালা।’
আরও একবার মহিলাকে আলিঙ্গন করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল জাহ্নবী। এখন তাকে বের হতে হবে। সারল্য চা শেষ করে অপেক্ষা করছে তার জন্য।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here