মেঘফুল ☁ পরিচ্ছেদঃ ২৩,২৪

0
469

উপন্যাসঃ মেঘফুল ☁
পরিচ্ছেদঃ ২৩,২৪
লেখকঃ মিশু মনি
২৩

ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিলো জাহ্নবী। নিজের জীবনের অদ্ভুত পরিবর্তন ওকে অবাক করছে। যে মানুষটা নিজের ঘর থেকে বের হয়ে পরিবারের সঙ্গে অনায়াসে মিশতে সংকোচ করত, সেই মানুষটাই এখন পরিবারের সবার মধ্যমণি! পারভীনের প্রত্যেকটা ফোনকল ওকে আনন্দ দেয়। গতকাল থেকে বেশ কয়েকবার ফোন করেছেন তিনি। শেষ ফোনকলে জাহ্নবীকে বাসায় যেতে বলেছেন। জাহ্নবী অবশ্যই যাবে। আজকে শরীরটা বড্ড ক্লান্ত। কাজের চাপ ছিল অনেক। আগামীকাল সে যাবে ওই বাড়িতে। পারভীনকে জড়িয়ে ধরে মায়ের চিরচেনা ঘ্রাণ অনুভব করবে।

ঘর অন্ধকার করে জানালা খুলে রাখলে বাইরে থেকে আলোকচ্ছটা ঘরে এসে পুরো ঘরের সৌন্দর্য বদলে দেয়। দেয়ালে আলোছায়ার অদ্ভুত খেলা দেখে জাহ্নবী অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। সেদিন ‘পান্নাবাহার’কে দেখার পর সারা রাত অস্থির লেগেছে তার। আগে কখনো এমন হয়নি। আর হবেই বা কী করে! জাহ্নবী জীবনের বেশিরভাগ সময় এসব প্রেমানুভূতিকে অপছন্দ করে এসেছে। কারও প্রেমের প্রস্তাবকে মুখের ওপর ‘না’ বলে দিয়েছে। আঠাশ বছরের পূর্বে কখনো পুরুষ মানুষের প্রতি কোনোরকম আকর্ষণ অনুভব করেনি সে। ধীরেধীরে বয়স যতই বাড়তে লাগল, একাকীত্ব গ্রাস করল তাকে। একটা সময়ে এসে মনে হল, জীবনে নিজের একটা মানুষ বড্ড প্রয়োজন। যে তাকে বুঝবে, ভালোবাসবে। মানুষটা হবে একান্তই তার। এই ভাবনা ধীরেধীরে জাহ্নবীকে প্রেমের প্রতি দুর্বল করে তুলেছে। গত কয়েকটা মাস সে প্রেমে পড়ার জন্য ব্যকুল হয়ে আছে। এই ছেলেটাও হয়তো সেরকমই একটা অনুভূতি বৈ আর কিছুই না। কিন্তু জাহ্নবী ‘পান্নাবাহার’কে যতবারই ভোলার চেষ্টা করেছে, প্রত্যেকবারই তার মনে হচ্ছে, ‘এ অনুভূতি সবার চাইতে আলাদা।’

জাহ্নবী বেলকনিতে এসে দাঁড়াল। গত দুদিন সে একটিবারও ওই চায়ের দোকানের দিকে তাকায় নি। সে বুঝতে চেষ্টা করছে, এটা প্রেম নাকি শুধুই আবেগ। আজ বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সে নিজেকে বলল, ‘আমি ওই দোকানের দিকে তাকাবো না।’

রাস্তা প্রায় ফাঁকা। দু একটা রিকশা মাঝেমাঝে হর্ন বাজিয়ে চলে যাচ্ছে। জাহ্নবী ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ঢাকা শহরটাকে দেখছে। রাস্তাঘাট, ফুটপাত, বড় বড় বিল্ডিং। দূরে দেখা যাচ্ছে একটা দোকান। ওপরে একটা সাইনবোর্ডে জ্বলজ্বল করছে, ‘when tea meet toast’.
জাহ্নবী একটা নিশ্বাস ফেলে দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। তার গাছগুলো বড় হচ্ছে। জাহ্নবী গাছে হাত বুলিয়ে বলল, ‘তোরা কী অনুভব করিস? তোদেরও কি অদ্ভুত অদ্ভুত ব্যথা হয়? আবেগ আছে তোদের?’
জাহ্নবীর মনে হলো গাছ ওর সঙ্গে কথা বলছে। একটা বেবিটিয়ার্সের চারা বেলকনির গ্রিলে ঝুলিয়ে রেখেছে সে। দ্রুত বাড়ছে সেটা। বড্ড আদর করতে ইচ্ছে করে গাছটাকে। জাহ্নবী বলল, ‘তুই সবসময় এত হাসিখুশি থাকিস কেন রে?’
ওর মনে হলো, গাছ উত্তর দিচ্ছে, ‘কারণ আমার কোনো দুঃখ নাই।’
জাহ্নবী হো হো করে হেসে উঠে আপন মনে বলল, ‘আমারও কোনো দুঃখ নাই। আমার একটাই দুঃখ ছিল, বিয়ে হচ্ছে না। এটা আবার কোনো দুঃখ হল? বিয়ে না হলে কী আমার ফাঁসি হবে? হবে না। তাহলে আমিও তোর মত হাসিখুশি মানুষ। হা হা হা।’

জাহ্নবী জোরে জোরে হাসছে। ঘরের দরজা বন্ধ। তার হাসির শব্দ এই ঘরের বাইরে যাবে না। জাহ্নবী আবছা অন্ধকার ঘরে এসে ফ্যান চালিয়ে দিলো। শিরশির করে বাতাস লাগছে গায়। তার খুব উড়তে মন চাইছে। সুখের বাতাসে গা ভাসিয়ে।
জাহ্নবী হেডফোন কানে গুঁজে গান ছেড়ে দিলো। গান শুনতে শুনতে মনে হল বাতাসে ভাসছে সে। সুখের বাতাসে ভেসে যাচ্ছে।
‘তোমাকে জানিনা প্রিয়, জানো না তুমি আমায়…’
গানটা ভীষণ প্রিয় হয়ে উঠেছে জাহ্নবীর। গত তিনদিনে সাতাশ বার গানটা শুনেছে সে। গানটা প্রায় মুখস্থই হয়ে গেছে তার। আজকে সে গুণগুণ করে গানও গাইল।

খাবার টেবিলে পিনপতন নীরবতা। মাঝেমাঝে গ্লাস ও জগের টুংটাং আওয়াজ আর খাবার চিবানোর চাপুতচুপুত শব্দ। বলার মতো কথা কেউই খুঁজে পাচ্ছে না হয়ত।
পারভীন নীরবতা ভাঙলেন। ভায়োলেটকে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘সেদিনের ওই ছেলেটা কে সেটা জানার ইচ্ছা নাই আমার। ওর সঙ্গে আর যোগাযোগ করবি না।’
‘আচ্ছা মা। ও আমার ক্লাসমেট। এর বাইরে কিছুই না।’
‘আমরাও সেটাই মনে করি। এরকম ছেলেদের আমাদের পছন্দ না।’

সামার দুষ্টুমি করে বলল, ‘চুল দাড়ি কেটে আসলে পছন্দ হবে?’
পারভীন কটমট করে তাকালেন সামারের দিকে। দুষ্টুমি হাসি সামারের চেহারায়। সে ঠোঁট টিপে হাসছে।
বলল, ‘না মানে অর্ণব ভাইয়াকে প্রথম প্রথম তোমার ভালো লাগেনি। এখন তো ভালো খাবার রান্না হলেই অর্ণবকে ডাকো, অর্ণবকে ফোন দাও। তাই বলছিলাম। চুল দাড়ি কেটে এলেই হবে?’
সামার হেসে উঠল কথাটা বলেই। জাভেদ আলী ইশারায় সামারকে চুপ করতে বললেন। পারভীন খুব অল্পতেই রেগে যান। কিন্তু আজকে তিনি রাগলেন না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘জাহ্নবী কাল আসবে। তোমরা সবাই মিলে মেয়েটাকে ভালো করে বুঝাও। যেন বিয়েতে অমত না করে।’
ভায়োলেট নিঃশব্দে খাবার খেয়ে উঠে পড়ল। এসব বিষয় নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই তার। প্রত্যেকের জীবনটা তার নিজের, নিজের মতোই গোছাতে দেয়া উচিৎ।

অফিস শেষ করেই জাহ্নবী আজ বাসায় এলো। পারভীন জাহ্নবীকে জড়িয়ে ধরলেন। দীর্ঘসময় পর এতটা আন্তরিকতা নিয়ে জাহ্নবীকে খাওয়ালেন তিনি। আদর স্নেহে ভরিয়ে দিলেন বড় মেয়েকে। তারপর নরম গলায় বললেন, ‘মা জাহ্নবী, মোস্তফা কামাল ছেলেটা ভালো।’
জাহ্নবী মুহুর্তেই বুঝে ফেলল নিশ্চয়ই আবারও বিয়ের সম্বন্ধটা এগিয়েছে। সে জানতে চাইলো, ‘ভায়োলেটের সঙ্গে ওনার বিয়ে দিচ্ছো?’
‘না। উনি তোকেই বিয়ে করতে চাচ্ছে।’

জাহ্নবী চমকে উঠলো। কয়েকদিন আগেও কথাটা শুনে নিশ্চয়ই খুশি হওয়ার মতো অবস্থায় ছিল সে। কিন্তু আজকে সে খুশি হতে পারল না। ভালো লাগছে না লোকটাকে। মনে হচ্ছে আর যাই হোক, ওনাকে সে বিয়ে করতে পারবে না।
জাহ্নবী মায়ের মুখের ওপর কিছু বলতে পারল না। নিঃশব্দে বসে রইল। পারভীন আশাবাদী হলেন। জাহ্নবী শেষ পর্যন্ত বিয়েটা করবেই, এটা নিশ্চিত তিনি। ওনার আনন্দ হচ্ছে এখন।

জাহ্নবী দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় বাসায় ফিরল। মনের শান্তি নষ্ট হয়েছে তার। কঠিন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে সে। মা বলেছেন দ্রুত মোস্তফা কামালকে সিদ্ধান্ত জানাতে হবে। ওনারা স্বপরিবারে জাহ্নবীকে দেখতে আসবেন। কী করবে জাহ্নবী?

জাহ্নবী এক মগ কফি নিয়ে এসে বারান্দায় বসল। অদূরে ‘when tea meet toast’ দোকানটির দিকে তাকিয়ে মনেমনে ভাবল, ‘ওই পান্নাবাহার একটা মরিচীকা। তাকে একদিন দেখেছি মাত্র। আর কখনো দেখা হবে না। দেখা হলেও দেখা যাবে সে বিবাহিত। পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ বছর বয়সে কেউ অবিবাহিত থাকে না। লোকটার কথা ভাবা বন্ধ করা উচিৎ আমার।’

কফির মগে চুমুক দিলো জাহ্নবী। পান্নাবাহারকে নিছক কল্পনা ভেবে ভুলে যেতে পারবে হয়তো। কিন্তু মোস্তফা কামালকে এইমুহুর্তে তার বিয়ে করতে একদমই ইচ্ছে করছে না। তবুও কী বিয়ে করতে হবে তাকে? এদেশের বেশিরভাগ মেয়েই তো ইচ্ছের বাইরে গিয়েই বিয়ে করে। সবাই তো সুখে সংসার করছে৷ সেও নিশ্চয় পারবে। জোরপূর্বক মনকে একজনের দিকে টেনে এনে বেঁধে রাখাটাই তো মেয়েদের জীবন!

মোস্তফা কামালের পরিবার যেদিন জাহ্নবীকে দেখতে এলো, সেদিন বাড়ি জুরে আনন্দের বন্যা। অর্ণব এসেছে, বড় মামা, মামী এসেছেন। দাদু এসেছেন গ্রাম থেকে। কুমিল্লা থেকে এসেছেন দোলন চাচা। সবাইকে দেখে মনে হচ্ছে আজকেই বিয়ে পড়িয়ে দিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচতে চান তারা। জাহ্নবী শাড়ি পরেছে আজ। ভায়োলেট নিজ হাতে তাকে সাজিয়ে দিয়েছে।

মোস্তফা কামালের দুলাভাই বললেন, ‘মেয়ে আমাদের পছন্দ হয়েছে। আমাদের কোনো দাবী দাওয়া নাই। বিয়ে আপনারা কোন ক্লাবে করবেন নাকি ঘরোয়া ভাবে করবেন সেটা নিয়েও আমাদের চিন্তা নাই। তবে বিয়ের পর মেয়েকে কুমিল্লায় গিয়ে থাকতে হবে। শাশুড়ীর দেখাশোনা করতে হবে। উনি একলা মানুষ। ওনাকে দেখাশোনার জন্যই বিয়েটা দেয়া।’

জাহ্নবী মাথা নিচু করে রাখল। সে জানে তার আত্মীয় স্বজন সকলেই এতে রাজী হয়ে যাবে। চাকরি ছেড়ে দিয়ে সংসার করাটাই সবার মতামত হবে। তার একমাত্র আশার কারণ ভায়োলেট। কেবল ভায়োলেটই এই পরিস্থিতিতে তাকে আশার আলো দেখাবে। কিন্তু ভায়োলেট বাসায় নেই!

মোস্তফা কামাল তাকিয়ে আছেন জাহ্নবীর দিকে। সামান্য ভ্রু কুঁচকানো ওনার। খুব সম্ভবত মেয়ের বয়স নিয়ে চিন্তিত তিনি। তবুও মনকে বুঝাতে চাইছেন, বয়স বেশী হওয়াটা কোনো ব্যাপার না। দুলাভাই গ্রামে বেশ কয়েকটা মেয়ে দেখেছে। সবাই অল্পবয়সী, সুন্দরী তরুণী। তারা মোস্তফাকে পছন্দ করেছে বলে বিয়ে করবে না, বিয়ে করবে মোস্তফার টাকার কারণে। এ কারণে সেসব মেয়েগুলোকে মোস্তফার বিয়ে করার ইচ্ছে নেই। তাদেরকে গ্রামে রেখে গেলে যদি পরকীয়া করে? এই দুশ্চিন্তা নিতেই পারবে না সে। জাহ্নবীকে দেখে তার অন্যরকম একটা মেয়ে মনে হয়েছে। এ ধরনের মেয়েরা স্ত্রী হিসেবে অত্যন্ত লক্ষী হয়। আদর্শ স্ত্রী হয়। এখন তার একমাত্র দুঃখ জাহ্নবীর বয়স বেশী।

বিয়ের কথাবার্তা একরকম পাকা হয়েই যাচ্ছে। জাহ্নবী অবস্থা বেগতিক দেখে ভায়োলেটকে ফোন দিলো। ফোনে দুবার রিং হলেও কল রিসিভ হল না। চিন্তা হচ্ছে জাহ্নবীর। তাকে কী অবশেষে চাকরিটা ছাড়তেই হবে! কুমিল্লায় গিয়ে বাধ্য স্ত্রী হয়ে সংসার করতে হবে? কিন্তু জাহ্নবী এখন তার বর্তমান জীবন নিয়েই সুখী। তার এখন মোটেও বাধ্যগত স্ত্রী হতে ইচ্ছে করছে না। আরও কিছুদিন এভাবে একা থাকতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু উপায় নেই। সেদিন জাহ্নবী নিজ মুখেই বাবা মাকে বলেছে পাত্র দেখতে। এখন নিজেই ‘না’ বলার দুঃসাহস করলে বাবা মা কষ্ট পাবেন।

চলবে..

উপন্যাসঃ মেঘফুল
পরিচ্ছেদঃ ২৪
লেখকঃ মিশু মনি

জাহ্নবী বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে রইল। বিয়ের দিন ক্ষণ ঠিক হয়েছে কী না সেটা শোনার জন্য অপেক্ষা করছে সে। অস্থিরতা ক্রমশ ওর মাথা ভারী করে তুলল। ঠিক এমন সময় স্বস্তির বৃষ্টি নামল। ভায়োলেট ফোন করেছে।

জাহ্নবী ফোন রিসিভ করে অস্থির গলায় বলল, ‘তুই কোথায়? আমার এদিকে সব শেষ হয়ে যাচ্ছে।’
‘কিছুই শেষ হবেনা যদি তুমি চাও।’
‘আমি কী চাই সেটাই তো বুঝতে পারছি না।’
‘তাহলে বাবার কাছে যাও। গিয়ে বলো, আমাকে কয়েকদিন সময় দাও। আমি আরও ভেবে দেখি।’
‘আমি পারছি না রে।’ হতাশ গলায় বলল জাহ্নবী।
‘না পারলে চুপচাপ বিয়ে করে ফেলো।’

জাহ্নবী চুপ হয়ে গেল। অন্যপাশে ভায়োলেটও কোনো কথা বলছে না। জাহ্নবী বলল, ‘আমি এখন বিয়ে করতে চাইছি না। মানে এটা আগের গুলোর মতো নয়। আগে তো সত্যিই বিয়ে করতে চাইতাম না। কিন্তু এবার আমার ঠিক মোস্তফা কামালকে.. বুঝাতে পারছি না। আমি পাগল হয়ে যাবো ভায়োলেট।’

ভায়োলেট ধীরগলায় বলল, ‘তাহলে আব্বুর রুমে যাও। গিয়ে বলো, তোমার আরও কিছুদিন সময় লাগবে। তুমি বললে আব্বু অবশ্যই সময় দেবে। জোর করে বিয়ে দেয়ার হলে আগেই দিয়ে দিতো। আমাদের আব্বু সেরকম মানুষ নন।’

জাহ্নবী বলল, ‘আব্বুকেই তো বলতে পারছি না।’
‘যাও, গিয়ে বলো। সময় নাও। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

জাহ্নবী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘আচ্ছা আমি যাচ্ছি। কিন্তু সময় নেয়ার পরও আমার মতামত ‘না’ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী। ওনাদের দাবী, মেয়েকে ওরা চাকরি করতে দেবে না। গ্রামে গিয়ে শাশুড়ীর সঙ্গে থাকতে হবে।’

ভায়োলেট বলল, ‘তাহলে সেরকম মেয়েকেই খুঁজতে বলো। যে মেয়ে চাকরি করেনা, শাশুড়ীর সেবায় নিজেকে সবসময় নিয়োজিত রাখবে। চাকরি করা একটা মেয়েকে ওরা চাকরি ছাড়তে বলবে কেন? তুমি তো মোস্তফা কামালের প্রেমিকা নও। ওনাকে বিয়ে করতেই হবে, এমন মাথার দিব্যি তোমাকে কেউ দিয়ে রাখেনি।’

জাহ্নবী ভরসা পেলো ভায়োলেটের কথায়। লজ্জাকে ভেতর থেকে টেনে বের করে একদিকে সরিয়ে রাখল। তারপর গেল জাভেদ আলীর সঙ্গে কথা বলতে।

পারভীন বিছানায় শুয়ে আছেন। জাভেদ আলী বসে আছেন সোফায়। ওনার সবচেয়ে ভালো গুণ হল, তিনি কখনোই চিন্তিত থাকেন না। বেশ সুখী সুখী মানুষ মনেহয় তাকে।

জাহ্নবীকে দেখে তিনি বললেন, ‘কিছু বলবি মা?’

লজ্জাকে সরাতে চেয়েও সরানো যায়নি বোধহয়। জাহ্নবী কথাটা বলতে গিয়ে মাথা নিচু করে রাখল। মৃদু স্বরে বলল, ‘আব্বু আমার কিছুদিন সময় লাগবে।’
জাভেদ আলী পারভীনের দিকে তাকালেন। স্ত্রী’র প্রতিক্রিয়া দেখে তারপর কথা বলবেন। কিন্তু পারভীন শুয়েই রইলেন, ওনার মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না।

জাহ্নবী বলল, ‘আমি চাকরি ছাড়তে পারবো না আব্বু। তুমি চাও তোমার মেয়েরা মাথা উঁচু করে বাঁচুক। আমি আর মরার মতো বাঁচতে চাই না।’
‘ঠিক আছে। আমি ছেলের সঙ্গে কথা বলবো। তুই চিন্তা করিস না। তোর মতো থাক।’

জাহ্নবী বাবাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পারভীন উঠে বসলেন। ওনার প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে স্বামীর ওপর। কঠিন মুখ করে রেখেছেন তিনি।

জাভেদ আলী বললেন, ‘কী হল? রেগে গেছ মনে হচ্ছে?’
পারভীন বললেন, ‘মেয়েটাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজী করা যেত না? তুমি বুঝালে ও ঠিকই রাজী হতো। এত বছর বিয়ে করতেই চায় নি। এখন যেটুকু হোক রাজী তো হয়েছে। ভালো করে বুঝাতে পারতে।’

জাভেদ আলী উঠে যেতে প্রস্তুত হলেন। ছেলেপক্ষ বাইরে অপেক্ষা করছে। পারভীনের কথাকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করলেন তিনি। অশান্তিতে পড়ে গেলেন পারভীন। এই লোকটা আজীবন নিজের মতো থেকে এসেছে। কখনো তার কথাকে গুরুত্ব দেয় নি। ওনার আহ্লাদেই মেয়েগুলো এমন হয়েছে। বিরক্তমুখে বসে রইলেন পারভীন। রাগ ঝাড়ার মতো সুযোগ পাচ্ছেন না।

জাভেদ আলী মোস্তফা কামালকেই সরাসরি বলে দিলেন, ‘আমার মেয়েটা চাকরি ছাড়বে না। ও কিছুদিন সময় চেয়েছে। আপনারাও ভেবে দেখুন। আমি জোর করে মেয়েদের ওপর কিছু চাপিয়ে দিতে চাই না।’

দোলন চাচা তৎক্ষনাৎ বললেন, ‘আরে এতে চাপিয়ে দেয়ার কী আছে? তুমি ওর বাবা। জোর করার হলে করবা। আমরা মেয়ের ওপর জোর খাটাবো না তো কে খাটাবে? এত ভালো ছেলে আমাদের মোস্তফা, ওর মতো ছেলে দ্বিতীয়টা আমাদের গ্রামে আর পাবা না। মেয়েকে ভালো করে বুঝাইলেই হবে। আমি বুঝেছি ওর মত আছে।’

দোলন চাচা দাঁত বের করে হাসলেন। জাহ্নবীর বড় মামা বললেন, ‘আমিও মা’র সাথে কথা বলবো। মেয়ে আমার বড়ই লক্ষী। আমাকে যথাযথ সম্মান করে। আমার কথা নিশ্চয়ই ফেলবে না।’

জাভেদ আলী বিব্রতবোধ করছেন। সবার সামনে জোর গলায় কিছু বলতেও পারছেন না। কিন্তু জাহ্নবীকে মন খারাপ হতে দিতে পারবেন না তিনি। তার মেয়েটা সদ্য হতাশা থেকে বেঁচে উঠেছে। এই মেয়েকে নিয়ে ওনার দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না।

তিনি বললেন, ‘জাহ্নবী চাকরি করুক। আমিও চাই ও চাকরি করুক। আপনারা ভেবে দেখুন মোস্তফার মাকে ঢাকায় নিয়ে এসে রাখা যায় কী না। মোস্তফা দেশের বাইরে থাকল ওনার স্ত্রীকে ঢাকায় একটা ফ্ল্যাট নিয়ে রাখলে তাতে কোনো অসুবিধা তো দেখি না।’

মোস্তফা কামালের দুলাভাই উত্তর দিলেন, ‘গ্রামে এত টাকা পয়সা করে বাড়িঘর করেছে, ঢাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকার জন্য তো না। আপনারাও নাকি ফ্ল্যাট কিনতেছেন শুনেছি। আপনারা নিজের বাসা রেখে কী ভাড়া বাসায় থাকবেন?’

জাভেদ আলী চুপ করে রইলেন। অতিথির মুখের ওপর তিনি কিছু বলতে চান না। মুচকি হাসলেন তিনি। হেসে বললেন, ‘আপনারা ভেবে দেখেন। আমি আমার মেয়েদের কোনো ইচ্ছাকে অপূর্ণ রাখিনি কখনো।’

মোস্তফা কামালের পরিবার খাওয়াদাওয়া শেষে বিদায় নিলো। বাড়িতে থমথমে পরিবেশ বিরাজমান। পারভীন ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। সামারের ঘরে বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে জাহ্নবী।

কিছুক্ষণপর পারভীন ও তার ভাইয়ের কথোপকথন শোনা গেল, ‘তোর মেয়ের বিয়ে আর দেয়ার দরকার নাই। এত করে ছেলেপক্ষকে ম্যানেজ করলাম। দুলাভাই কী বলল? মেয়ের ইচ্ছে অপূর্ণ রাখবে না। তাতে আমাদের কী? তোমার মেয়ের ইচ্ছে সারাজীবন আইবুড়ো হয়ে থাকবে। রাখো ঘরের খুঁটি বানিয়ে। ছোটবোনদেরকে বিয়ে দিতে হবে না?’

পারভীন কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘আমার কপাল খারাপ। এ জীবনে এত দুঃখ সইতেছি। না পারি সইতে, না পারি কাউকে কিছু বলতে।’
‘তোর দোষ আছে আপা। তুই মেয়ের ওপর জোর করলে আজকে এই দিন দেখা লাগত না। তোমরা মেয়েদেরকে বড় বড় ভার্সিটিতে পড়াও। কত মেধা, কত জ্ঞান। এই জ্ঞান নিয়েই এখন ঘরে বসাই রাখো। চাকরি করুক। কী আর করবে..’

জাহ্নবী একটা নিশ্বাস ফেলে উঠে বসল। প্রায়ই মায়ের মুখে এমন কথা শোনাটা তার অভ্যাস হয়ে গেছে। মাঝেমাঝে বিভিন্ন আত্মীয়রা বাসায় বেড়াতে এলে তখনও নানান কথা শুনতে হয় তার। সে সবসময় মনেমনে চেয়েছিল, যদি আজ কোথাও চলে যেতে পারতাম! এখানে আর থাকতে ইচ্ছে করছে না। আজকে তার চলে যাওয়ার মতো একটা স্থান আছে। তার নিজের বাসা আছে!

শত যন্ত্রণাতেও জাহ্নবীর মুখে জয়ের হাসি ফুটে উঠল। সে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। স্বাভাবিক ভঙ্গীতে মাকে বলল, ‘আম্মু আমি যাই। বাসায় ভাত তরকারি আছে। সেগুলো নষ্ট হয়ে যাবে।’

পারভীন ও তার ভাই অবাক হয়ে জাহ্নবীর চলে যাওয়া দেখলেন। জাহ্নবী জাভেদ আলীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলো। এখন খুব শান্তি শান্তি লাগছে তার। এইমুহুর্তে মনে হচ্ছে, কে কী বলল তাতে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত না করে নিজের মতো বাঁচতে হবে। হঠাৎ ভায়োলেটের কথা মনে পড়ল তার। জাহ্নবী ফোন বের করে ভায়োলেটের নাম্বারে কল দিলো। ফোন ধরল ভায়োলেট। ব্যস্ত গলায় বলল, ‘আপু, বলো?’
‘বাসায় কোনোমত ম্যানেজ করা গেছে। তুই কই?’
‘আমি একটা কাজে আছি।’
‘রাত হচ্ছে। বাসায় আসবি না?’
‘যাবো। তুমি বাসায় আছো?’
‘না। আমি চলে যাচ্ছি।’
‘আচ্ছা আপু। নিজের যত্ন নিও।’
‘তুইও যত্ন নিস।’

ফোন কেটে দিলো জাহ্নবী। ফুটপাত ধরে হাঁটতে ভালো লাগছে। এই উষ্ণ শহরে আর শীতল হাওয়া বইছে। কিছুক্ষণ আগেই বৃষ্টি হয়ে গেছে এক পশলা। মৃদুমন্দ বাতাসে নিজেকে বয়ে নিয়ে চলল জাহ্নবী। বয়ে নিয়ে চলল তার নতুন করে বাঁচার স্বপ্নকে।

বেশ কিছুদিন কেটে গেল। জাহ্নবী নিজের জীবন ও কর্মব্যস্ততাকে সঙ্গে নিয়ে ভালোই আছে। কাল পরশু বেতন পাবে সে। প্রথম স্যালারি। মনে অদ্ভুত আনন্দ হচ্ছে তার। অনেকদিন সে বাবার বাসায় যায় নি। কাল বেতন পেলেই পুরো টাকাটা বাবার হাতে তুলে দেবে৷ তারপর বাবার কাছে চেয়ে নেবে তার বাসার ভাড়া ও হাত খরচের টাকা। নিশ্চয়ই অনেক খুশি হবেন জাভেদ আলী।

জাহ্নবী সন্ধ্যার অন্ধকারে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে কফি খাচ্ছে। মাঝেমাঝে চোখ চলে যাচ্ছে ‘when tea meet toast’ দোকানটির দিকে। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে প্রায়ই জাহ্নবী সেদিকে তাকায়। কাউকে দেখার প্রত্যাশা করে। তবে সেটা কেবলই অবচেতন মনে। সচেতন মনে সে জানে, ওই পান্নাবাহারের সঙ্গে আর কখনো দেখা হবেনা তার। এই ভাললাগার অনুভূতিটুকু কেবল ক্ষণিকের জন্যই ছিল।

জাহ্নবী কফি শেষ করে গাছের সঙ্গে কথা বলল। তার এখানে মোটেও একলা লাগে না। বরং একা থাকার এই চমৎকার জীবনকে সে উপভোগ করছে ভীষণ। এমন সময় দরজায় দাঁড়িয়ে পাশের রুমের একজন মেয়ে বলল, ‘আপু আপনার কাছে একজন গেস্ট এসেছে। আপনি গিয়ে দেখে আসেন।’

চমকে উঠলো জাহ্নবী। তার কাছে আসার মতো তেমন কেউ নেই। সে গেটে এসে দেখল ভায়োলেট এসেছে। জাহ্নবীকে জড়িয়ে ধরল ভায়োলেট। অনেকদিন পর ভায়োলেটের উষ্ণতা ভালো লাগল জাহ্নবীর।

ঘরে এসেই বিছানায় শুয়ে পড়ল ভায়োলেট। জাহ্নবী কফি বানিয়ে আনলো। ভায়োলেট কফির ঘ্রাণ শুঁকে বলল, ‘তোমার বানানো কফিতে একটা আলাদা স্মেল পাই আপু।’

জাহ্নবী হেসে বলল, ‘তাই নাকি? খা। আরও এক কাপ বানিয়ে দিবো। এক কাপ না, এক মগ।’
ভায়োলেট দুষ্টুমি করে বলল, ‘তুমি এক বালতি ই বানিয়ে দিও। হা হা হা।’

জাহ্নবী কফি শেষ করে ভায়োলেটের পাশে শুয়ে পড়ল। ভায়োলেটের ভরা যৌবন। রূপের স্নিগ্ধ মাধুরি মেশানো তনু। দ্রুত বড় হয়ে গেল মেয়েটা। অথচ সেদিনই ছিল ছোট্ট, চুল ঝুটি করে পুরো বাড়ি দৌড়ে বেড়াত!

ভায়োলেট বলল, ‘কী দেখছ আপু?’
‘তোর কথা শুনবো আজ। তুই বলেছিলি সময় হলে বলবি। আজ বলতেই হবে।’
‘আচ্ছা আপু। আজকে বলবো। আজ অনেক কথা বলবো তোমায়।’

জাহ্নবী মনেমনে ভীষণ খুশি হল। কৌতুহল ফুটে উঠল তার চোখেমুখে। বলল, ‘সত্যি! আমি শুনবো। তোকে আমার কেমন যেন রহস্যময়ী লাগে ভায়োলেট।’
ভায়োলেট শব্দ করে হাসলো। ‘কী যে বলো আপু!’
জাহ্নবী বলল, ‘সব কাজ শেষ করে আসি। তারপর শুনবো তোর সব কথা।’

ভায়োলেট একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মুখে লেগে রইল ম্লান হাসি। তার কথাগুলো সে কক্ষনো কাউকে বলেনি!

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here