উপন্যাসঃ মেঘফুল ☁
পরিচ্ছেদঃ ২৫
লেখাঃ মিশু মনি
প্রেম ঈশ্বরপ্রদত্ত এক অদ্ভুত শক্তি। কারও কারও জীবনে প্রেম আসে বৃষ্টির মতো, ঝমঝমিয়ে। আকাশ কাঁপিয়ে, ভূধর কাঁপানো গর্জন সাথে নিয়ে। ভায়োলেটের জীবনে প্রেম এভাবে আসেনি, এসেছিল জানালা গলে ঘরে ঢোকা প্রজাপতির মতো, নিঃশব্দে। টেরই পায়নি সে, অথচ ভালো লেগেছিল, যার প্রবল রেশ এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে ভায়োলেট।
রুশো’কে যেদিন প্রথম দেখেছিল সে, সেদিন খুব বৃষ্টি ছিল। ছিপছিপে বৃষ্টি নয়, একেবারে বড় বড় ফোঁটা নিয়ে তুমুল বর্ষণ। বাড়িতে কেউ ছিল না। তখন ওরা যে বাড়িতে থাকত, তার সামনে ছিল বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা। আর ছিল একটা উঠোন, যেখানে বড় গাছে একটা দোলনা বাঁধা ছিল। ওইদিন বাবা মা কেউ ছিলেন না বাড়িতে। কোনো কারণে বাড়ির সবাই সেদিন বাইরে। কিশোরী ভায়োলেটও তাই সুযোগ পেয়ে হয়ে উঠেছিল ভয়ংকর দুঃসাহসী। বয়স আর কতই হবে, বারো কিংবা তেরো। দুঃসাহস দেখানোর মতোই বয়স। ভায়োলেট প্রবল বৃষ্টির ভেতর দোলনায় দোল খাচ্ছিল। মনের আনন্দে সেদিন জোয়ার নেমেছিল তার। কোমর সমান চুলগুলোকে পিঠের ওপর এলিয়ে দিয়ে মাথা নিচু করে দোলনার রশিটা ধরে ছিল দুহাতে। পাগলের মতো দোল খাচ্ছিল ভায়োলেট। উঠোনে বৃষ্টি পড়ছিল পাথরের মতো।
হঠাৎ একটা দৃশ্যে তার চোখ আটকে যায়। বাড়ির গেটের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছেলে। মাথায় ঝাকড়া চুল, গায়ে চেক শার্ট। ছেলেটার মাথায় ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির স্রোত তার চিবুক বেয়ে নেমে যাচ্ছে ঠোঁটে। ভায়োলেটের থেকে কয়েক হাত দুরত্বে দাঁড়িয়ে আছে সে। মুহুর্তের জন্য ভায়োলেট খেই হারিয়ে ফেলল। ছেলেটার অপূর্ব মায়াভরা মুখটা ওর হৃদয়ে তোলপাড় শুরু করে দিয়েছে মুহুর্তেই। ভায়োলেট জানেনা প্রেম মানে কী, এটা কীভাবে আসে। তবে সেদিন এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল সে। বর্ষণের প্রবলতা তাদের কাউকেই চিন্তিত করে নি। ছেলেটা বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে ভায়োলেটকে দেখেছে, অনেক্ষণ ধরে। বিশ বছর বয়সী সেই ছেলেটা ভায়োলেটের মনে নতুন সুর তোলে। দোলনার রশি ধরে থাকা ভায়োলেটের গলা শুকিয়ে কাঠ। মাত্র দু থেকে তিন মিনিট দাঁড়িয়ে ছিল সেই অদ্ভুত ছেলেটা। তারপর দৌড়ে গেট দিয়ে বেরিয়ে যায়।
কিন্তু ফেলে যায় মোহ। তার ফেলে যাওয়া মোহের আচ্ছনতায় ভায়োলেটের সবকিছু ওলট পালট করে রেখে যায়। তেরো বছর বয়সের সেই গভীর আবেগে প্রায় রাতেই ভায়োলেট ছেলেটাকে নিয়ে স্বপ্ন বুনত। সে বুঝতে পেরেছিল, এটাই তার জীবনে আসা প্রথম প্রেম। ভ্রমরের মতো গুণগুনিয়ে না এলেও, সে এসেছে নিরবে, নিভৃতে। তারপর অনেকদিন ভায়োলেট ঘুমাতে পারেনি রাতে। সামান্য দুই মিনিটের চোখাচোখি আর সেই দর্শন, তার কাছে দুই যুগের মতোই স্মৃতিমধুর হয়ে ছিল।
তারপর! কতগুলো বছর কেটে গেছে। কই, রুশোর সঙ্গে আর দেখা হয়নি তার। রুশোর চেহারাটা তো কয়েকদিন বাদেই ভুলে গিয়েছিল ভায়োলেট। একদিন হঠাৎ…
জাহ্নবীর ধাক্কায় ভাবনা থেকে ফিরে এলো ভায়োলেট। তাকে অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে। চিন্তিত মুখে জাহ্নবী জানতে চাইলো, ‘কী হল রে? মন খারাপ?’
ভায়োলেট একটা নিশ্বাস ছেড়ে শুকনো হাসি হেসে বলল, ‘আমাদের প্রথম দেখার কথা মনে পড়ে গেছে। অনেক বছর আগের কথা। অথচ আমার মনে হচ্ছে যেন সেদিনই। এই মধুর ঘটনাটা আমি এতবার স্মরণ করেছি, এতবার ভেবেছি! সবকিছু স্পষ্ট মনে আছে।’
জাহ্নবী অবাক হল। ভায়োলেটের চোখে লেগে থাকা অপূর্ব এই আবেশ ওর ভীষণ ভালো লাগল। এতটা মায়াভরা কখনোই লাগেনি ভায়োলেটকে। প্রথম দেখা হওয়ার সেই দৃশ্যটা শোনার জন্য আর অপেক্ষা করতে পারছিল না জাহ্নবী।
সব কাজ শেষ করে দু বোন পাশাপাশি শুয়ে পড়ল। জাহ্নবী বলল, ‘কী ভাবছিস? এখনো সেই প্রথম দেখা হওয়ার কথা?’
‘না আপু৷ একটা উপকার করবে আমার?’
‘বল। আমি যদি তোর উপকার করতে পারি, সেটা আমার জন্য ভীষণ আনন্দের একটা ব্যাপার হবে।’
‘আপু, তোমার স্যালারি কত পাবে?’
‘সাতচল্লিশ হাজার। কেন রে?’
‘আপু, আমি একটা বিপদের মধ্যে আছি। তোমার বাসা ভাড়া দেয়ার পর বাকিটা আমাকে ধার দেবে? প্লিজ?’
জাহ্নবী ভীষণ অবাক হলেও বিস্ময় লুকিয়ে রাখল সে। ভায়োলেটের হাত ধরে বলল, ‘অবশ্যই দেবো৷ তুই পুরোটাই নিয়ে নিস। আমার কাছে বাড়তি কিছু আছে। আমি সেটা দিয়ে চালিয়ে নেবো।’
‘সত্যি আপু?’
‘হুম। কী হয়েছে? কিসের বিপদ আমাকে বলবি না?’
ভায়োলেট একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘বলবো আপু। এখন না। সময় হলে বলবো। আমি একটা ঝামেলায় পড়ে একজনের কাছে টাকা ধার নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। এখন সে টাকার জন্য চাপ দিচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি না কীভাবে দেবো। আমার টাকা আসার মতো কোনো পথ নেই।’
জাহ্নবী ভায়োলেটকে আশ্বস্ত করে বলল, ‘আপু আছি না? একদম টেনশন করবি না। আমার লক্ষী বোন। কত টাকা লাগবে?’
‘পঞ্চাশ হাজার।’
‘আচ্ছা। আমি ম্যানেজ করে তোকে পঞ্চাশ হাজারই দেবো।’
‘তুমি কোথ থেকে ম্যানেজ করবে আপু?’
‘সেটা আমার ওপর ছেড়ে দে। তুই নিশ্চিন্তে থাক।’
ভায়োলেট জাহ্নবীকে জড়িয়ে ধরল। হঠাৎ করেই ভীষণ চিন্তামুক্ত লাগছে ওর।
জাহ্নবী বলল, ‘আচ্ছা একদিন বাসায় যে ছেলেটা এসেছিল, তুই কী ওর কাছেই টাকা ধার নিয়েছিলি?’
ভায়োলেট মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘হুম আপু। তুমি কীভাবে বুঝলে?’
‘আমার মনে হল। ওরকম ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার মত মেয়ে তুই না। এখন বুঝতে পারছি আসলে সে কেন এসেছিল। যাইহোক, তুই একদম চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
ভায়োলেট জাহ্নবীকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। বহুদিন পর তার নিজেকে আর একা মনে হচ্ছে না৷ ভাললাগা ও খারাপ লাগার মিশ্র অনুভূতিতে ভায়োলেট বিমোহিত হয়ে পড়ল।
জাহ্নবী তখন তার মাথায় হাত বুলিয়ে জানতে চাইলো, ‘তোদের প্রথম দেখা কীভাবে হয়েছিল রে?’
ভায়োলেট কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দিলো, ‘বাড়ির উঠোনে আপু। সে অনেক আগের কথা। আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি। তুমি তখন একটা প্রজেক্টে চাকরি করতে। আব্বুও কাজে ছিল। মেজোপু আমি আর মা থাকতাম বাসায়। মাঝেমাঝে আম্মু মেজোপুকে নিয়ে বাইরে যেতেন। তখন আমি থাকতাম একদম একা। আমি পুরো বাড়ি নেচে বেড়াতাম। আপন মনে গান গাইতাম, একা একা নিজের সঙ্গে কথা বলতাম। সে এক আনন্দময় সময় কাটত আমার। আব্বু বাড়িতে থাকলে বৃষ্টিতে ভিজতে দেয় না সেটা তো তুমি জানোই। আম্মুও বকা দেয়। সেদিন কেউই বাড়িতে ছিল না আপু। আকাশ কাঁপিয়ে কী যে বৃষ্টি! আমাদের বাড়ির উঠোনে গাছে একটা দোলনা ছিল আমার। মনে আছে আপু? অনেক কান্নাকাটি করে তোমার কাছে বেঁধে নিয়েছিলাম। বাজার থেকে রশি কিনে এনেছিল মেজোপু। তুমি তক্তা দিয়ে খুব সুন্দর করে একটা দোলনা বানিয়ে দিয়েছিলে?’
জাহ্নবী নস্টালজিক হয়ে পড়ল। এমনিতে ভায়োলেট খুব একটা ওর কাছে আসত না। সেদিন দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে বারবার উঁকি মারছিল। যেন কিছু বলতে চায়। জাহ্নবী ইশারায় ডেকে নেয় ভায়োলেটকে। নিজের চেয়ে বয়সে বারো/তের বছরের ছোট বোনটাকে সে কখনোই কাছে ডেকে আদর করে নি। সে সবার থেকে সবসময় নিজেকে আড়াল করে রেখেছে। কারও সাথে মিশতে পারেনি জাহ্নবী। ভায়োলেট জাহ্নবীর কাছে দাঁড়িয়ে মুখে আঙুল দিয়ে লাজুক হাসছিল। একসময় আদুরে ভঙ্গীতে বলল, ‘আপু আমাকে একটা দোলনা টাঙিয়ে দিবা?’
জাহ্নবী চমকে উঠেছিল। এ কেমন আবদার! সে জানে না কীভাবে দোলনা বানাতে হয়। তাছাড়া আব্বু প্রায়ই বাড়িতে আসেন। দোলনা দেখলে ভয়ংকর রেগে যাবে আব্বু। মা’র সাথে জাহ্নবী কথা বলে খুবই কম। মাকে রাজী করাতে পারবেই না সে। কিন্তু ছোটবোন প্রথমবারের মতো তার কাছে কিছু আবদার করেছে। জাহ্নবী অনেক চিন্তাভাবনা করে ভায়োলেটের হাতে একশ টাকা দিয়ে বলল, ‘রশি কিনে আনো। আমি দেখি আম্মুকে ম্যানেজ করা যায় কি না। রাজী না হলে লুকিয়ে লুকিয়ে দোল খেতে হবে তোমাকে।’
ভায়োলেট এক দৌড়ে সামারকে সঙ্গে নিয়ে রশি কিনতে গিয়েছিল বাজারে। পারভীন দুই মেয়েকে না বলে বাজারে যাওয়ার কারণে সেদিন প্রচণ্ড বকা দিয়েছিলেন। জাহ্নবীর মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। পারভীন তখনও বেশিরভাগ সময় নিজের ঘরেই কাটাতেন। বোনদেরকে পাহারায় রেখে লুকিয়ে লুকিয়ে গাছের ডালে দোলনা ঝুলিয়ে দিয়েছিল জাহ্নবী। পরে জানতে পেরেছিল, পারভীন দোলনা নিয়েও ভায়োলেটকে অনেক বকা দিয়েছিলেন।
হেসে উঠল জাহ্নবী। সবকিছু যেন চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ভেসে আছে। তার জীবনে তখনও সবকিছু ছিল, অথচ সে নিজেকে জীবন্ত ভাবতে পারতো না!
জাহ্নবী বলল, ‘হ্যাঁ আমার সব মনে আছে। সব।’
ভায়োলেটকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল জাহ্নবী।
ভায়োলেট আবারও বলতে শুরু করল, ‘আমি মাঝেমাঝে লুকিয়ে লুকিয়ে দোলনায় বসে থাকতাম। আবার দোলনা উঠিয়ে রাখতাম গাছের ডালে। আব্বু বলেছিল একটা বড় দোলনা এনে দিবেন, কিন্তু দেন নি। আম্মু ও আপু সেদিন বাসায় নেই। আমি বাসার গেট ভালোভাবে বন্ধ আছে কিনা খেয়ালই করিনি। দোলনায় বসে দোল খাচ্ছিলাম। আমাদের বাড়িটাতে গেট থেকে বাসার মেইন দরজা অবধি অনেকটা ফাঁকা জায়গা ছিল। ওই জায়গাটাতেই আপু। ওই জায়গাটাতেই…’
‘কী!’ বিস্ময় লুকাতে পারল না জাহ্নবী।
ভায়োলেট বলল, ‘রুশো। সেদিন আমার বাঁধ ভাঙা আনন্দের দিন ছিল। একদিকে দোলনায় চড়া নিষেধ, অন্যদিকে বৃষ্টিতে ভেজাও নিষেধ। বাসায় কেউ নেই। তাই আমি মুক্ত পাখির মতো দোল খাচ্ছিলাম। আর বৃষ্টিতে ভিজছিলাম। শুয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দোল খাচ্ছি, মনে হচ্ছে বাতাসে ভেসে যাচ্ছি। এত্ত আনন্দে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। তখনই দেখি সেই ফাঁকা জায়গাটায় একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। আপু, বিশ্বাস করো। ওকে অসম্ভব পরিমাণে মায়াবী লাগছিল। বড় বড় চুল থেকে কপাল ভিজে পানি গড়াচ্ছিল মুখে। ছেলেটা কপাল থেকে চুল সরাচ্ছিল না। আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। দু থেকে তিন মিনিট। আমরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। অথচ এই দু মিনিটই আমার কাছে দুই যুগের সমান। ছেলেটা তারপর দৌড়ে গেট দিয়ে বেরিয়ে যায়। পরে বুঝলাম, সে গেট খোলা পেয়ে এসেছিল বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্য। কিন্তু আমাকে দেখার পর আর আমার হাত থেকেই বাঁচতে পারেনি।’
হেসে ফেলল ভায়োলেট। জাহ্নবীর বুকে দ্রুত স্পন্দন অনুভূত হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন এই ঘটনা তার নিজের। তার জীবনে ঘটে যাওয়া এক অদ্ভুত আবেশ। সে ভায়োলেটের কানের কাছে মুখ রেখে জানতে চাইল, ‘প্রথম দেখার পরই তুই প্রেমে পড়েছিলি?’
ভায়োলেট হেসে বলল, ‘জানি না। তখন প্রেম টেম বুঝতাম না। কিন্তু একটা কিছুতে আচ্ছন্ন হয়ে ছিলাম। আমার ডায়েরিতে ওর কথা লিখেছিলাম। এক সপ্তাহের মতো ওর ছবি আমার মন থেকে সরছিল না। তারপর আস্তে আস্তে ওর চেহারা ভুলে গেছি। শুধু ঘটনাটা আমার স্মরণ ছিল। প্রায়ই রাতে ঘুম না এলে আমি এই ঘটনাটা মনে করতাম। ভালো লাগত, খারাপ লাগত। কিন্তু রুশোর চেহারা মনে করতে পারতাম না।’
জাহ্নবীর কৌতুহল বেড়ে গেল। যদি মনে না-ই করতে পারে, তবে কী করে জানলো ছেলেটার নাম রুশো! জানার তীব্র আকাঙ্খা নিয়ে জাহ্নবী বলল, ‘তারপর তোদের আর দেখা হল না?’
‘হুম। দেখা না হলে তো ভালোই হতো। আমি আর ওকে মনে করতে পারতাম না। কিন্তু দেখা হল। হয়তো এটা হবার ছিল।’
‘কীভাবে দেখা হল? তোর ওইটুকুন বয়সেই?’
‘না আপু। আমি বড় হবার পর। ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তির সময়। আমার ভিকারুননিসায় চান্স হল। আমরা ওই বাসাটা বদল করলাম। কিন্তু কতটা ভাগ্যবান হলে রুশো সেদিনই আমাদের বাড়িতে এসে পৌঁছাল, যেদিন আমরা বাসার জিনিসপত্র সব ট্রাকে তুলছি। ভাবো?’
জাহ্নবী’র গা শিউরে উঠল। এমনটা আবার হয় নাকি! চার বছর আগে হওয়া ছোট্ট একটা দেখা। তারপর কেউ আবার সেই বাড়ি খুঁজে খুঁজে এখানে এসে হাজির হবে। এ তো অকল্পনীয় ব্যাপার!
ভায়োলেট বলল, ‘জানিনা কেন এই অকল্পনীয় ব্যাপারটাই আমার সঙ্গে ঘটল। আমি বাসার সাধারণ জামা পরে আছি, চুল দুই বেণী করা। গেটে দাঁড়িয়ে আমাদের জিনিসপত্র ট্রাকে তোলা পর্যবেক্ষণ করছি। যাতে কোনোকিছু চুরি না হয়ে যায়। এজন্য আম্মু আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। বিশ্বাস করো আপু, রুশো এসে আমার সামনে দাঁড়াল। আমার কলিজাটা ছ্যাৎ করে উঠেছে। আমি ওকে চিনতে পারিনি প্রথমে, চার বছর আগে দেখা হওয়ার কথা আমার মনেই নেই। তবুও কেন যেন ওকে আমার চিরচেনা মনে হল, বুক ধক করে উঠল আমার। এখনো রুশোর চুল বড় বড়। ও যখন বলল, আপনি কি ভায়োলেট? আমি উত্তর দিলাম, হ্যাঁ। আপনি কে? রুশো উত্তর দিলো না। অনেক্ষণ আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। ট্রাকে জিনিসপত্র তোলা হচ্ছে, আমি সেদিকে তাকালাম। কিন্তু আমার বুকের ভেতর কেমন যেন করছে। ছেলেটাকে এত আপন মনে হচ্ছিল আমার। তারপর রুশো একটা সাল ও তারিখ বলল। জানতে চাইল, আপনার কী মনে আছে এই দিনে কী হয়েছিল? হয়তো মনে নেই। আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি। তার আগে আমাকে ভেতরে ঢুকতে দিন।’
জাহ্নবী ভায়োলেটের কথার স্মৃতিতে প্রবেশ করেছে। সদ্য তারুণ্যে পা দেয়া, চুলে দুই বেণী করা সেই ভায়োলেটের স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠল তার চোখে। আর রুশো? নিশ্চয়ই চব্বিশ বছর বয়সী একজন যুবক। কী অসম্ভব অনুভূতিই না হচ্ছিল দুজনের!
ভায়োলেট বলল, ‘রুশো গেটের ভেতর ঢুকল। আমিও এলাম ওর পিছুপিছু। বাসার সামনে থাকা গাছটা দেখিয়ে বলল, এই গাছে একটা দোলনা ছিল। খুব বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন.. এরপর রুশো কী বলেছে আমি শুনতে পাইনি। দোলনা ও বৃষ্টি শব্দটা শুনেই আমি অন্যরকম হয়ে যাই। মনে হচ্ছিল আমার পা মাটির ভেতর প্রথিত। কিশোরী বয়সের আবেগ, এতটা তীব্র ছিল। আমি নিষ্পলক চোখে ওই গাছটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সেই কিশোরী বেলার স্মৃতি আমার মনে জেগে উঠল। ইচ্ছে করছিল ছেলেটাকে বলি, আমি আপনার কথা অনেকদিন ভেবেছি। অনেক রাত ঘটনাটাকে মনে মনে আওড়েছি। কিন্তু আপনি আসেননি। আপনি এমন দিনে এলেন, আজকেই আমরা এই বাসা ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আপনি ভাগ্যবান। আর এক ঘন্টা পর এলেই আমাকে আর দেখতে পেতেন না। সৌভাগ্যবান ছেলেটাকে আমার মনের কোঠরে এঁকে নিলাম। আমি জানতে চাইলাম, হ্যাঁ আমার মনে আছে। কিন্তু কেন?’
রুশো বলল, ‘আপনার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে। সেদিনের ওই ছেলেটার কথা আপনার মনে আছে? ভুলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার মনে আছে। আমিই সেই ছেলে।’
রুশোর সঙ্গে আর কথাই হয়নি আমার। মা এসে রাগারাগি করল আমাকে। রুশোর সামনেই খুব বকল। জিনিসপত্র ট্রাকে তোলা শেষ আর আমি এখানে কার সঙ্গে কথা বলছি? আম্মু রুশোকে একটা কথাও বলেনি। কিন্তু আমাকে খুব বকল। আমার দুচোখ বেয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে। রুশো ভেতরে ভেতরে খুব রেগে যাচ্ছে। ওর সামনে আমাকে বকা দেয়ার অপমান সহ্য হচ্ছিল না আমার। আমি রাগ করে বাড়ির ভেতর চলে আসি। তার প্রায় ঘন্টা দেড়েক পরে আব্বু গাড়িতে করে আমাদেরকে নতুন বাসায় নিয়ে যান। আমি বের হওয়ার সময় দেখি রুশো গেটের বাইরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে।’
প্রসন্ন হাসি ভায়োলেটের মুখে। রুশো এত বছর পর তার কাছে এসেছে, তার জন্য বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে, এই আনন্দ নিশ্চয়ই সেইমুহুর্তে ওর কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা আনন্দ হয়ে উঠেছিল। জাহ্নবী চোখ বন্ধ করে রইল।
ভায়োলেট বলল, ‘আমি সেই ছোট্টবেলার অনুভূতি ভুলে গিয়েছিলাম সত্য। ভুলে গিয়েছিলাম আগের রুশোকেও। কিন্তু নতুন করে সে এসেছিল যেদিন, সেদিনই ওর প্রেমে পড়েছি। তীব্র প্রেমে।’
জাহ্নবী ভায়োলেটের হাত চেপে ধরে জানতে চাইলো, ‘রুশোকে এরপর খুঁজে পেলি কীভাবে?’
ভায়োলেট হেসে বলল, ‘সে একটা লম্বা ইতিহাস। সারা রাত বললেও এই গল্প ফুরাবে না আপু।’
‘না ফুরাক। তুই বল। আমি শুনবো। এখনই বল।’
ভায়োলেট আবারও ফিরে গেল তার স্মৃতিতে। নতুন বাসায় ওঠার দিনকয়েক পর…
চলবে..