#মেঘবতীর_শহরে,পর্বঃ১৩,১৪
নাদিয়া ইসলাম সানজিদা
১৩
‘
‘
বিকেলে বাড়িতে ফিরে রান্না সেরে সেই যে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছে মুহতাসনিম,এখনও উঠেনি।মিনা খালা ঘরের টুকিটাকি কাজ করছেন।মাঝে কয়েকবার মুহতাসনিম এর সাথে কথা বলেছেন।বেশি কোনো কথার’ই উত্তর দেয়নি মুহতাসনিম।
হঠাৎ দরজায় ঠ্ক ঠ্ক শব্দ হয়।কপাল কুঞ্চিত করে জিগ্যেস করে মিনা খালা,
“কে?
এ সময় সচরাচর কারো আসার কথা নয়।কলোনি তে পরিচিত যারা আছে ভোর ভেলায় তাদের সাথে যদিও দেখা হয়, রাতে দেখা হবার সম্ভাবনা খুবই কম!সবাই কম বেশি কর্মজীবি।খোশগল্প করার সময় কারো’রই নেই।
দরজার ওপাশ থেকে যুবক বয়সের এক পুরুষালি কন্ঠ জবাব দিলো,
” আমি আতিক মোল্লা।আরমান মোল্লার ছেলে।দরজাটা একটু খুলুন দয়া করে।
মিনা বেগম হন্তদন্ত হয়ে দরজা খুলতে চলে যায়।শোয়া থেকে উঠে বসে গায়ে উড়না জড়িয়ে নেয় মুহতাসনিম।বিষন্ন মুখটা শুকনো হয়ে আছে এখনও,আসার পর মুখে খানিকটা পানি ঝাপটা দিয়েছে কিনা সন্দেহ।
দরজার সামনে মিনা বেগমের কন্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে,খুব বিনয়ের স্বরে বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার সাথে কথা বলছে,’বাবা ভিতরে আইসা বসো,বাহিরে দাঁড়ায় থাকলে কেমন দেখায়?
ওপাশের কথা কানে আসে না মুহতাসনিম এর।ঘড়িতে একবার চোখ বুলায়।রাত দশটা বেজে পনের মিনিট!ঘড়ি থেকে সামনে চোখ পড়তেই ঘরে এক যুবক ছেলে কে প্রবেশ করতে দেখে মুহতাসনিম।পেছনে মিনা খালা দাঁড়িয়ে,ঠোঁটে তার হাসি।
ছেলেটি মুহতাসনিম কে দেখে অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে পরে যেন!মাথা নিচু করে পুনরায় মিনা বেগমের সাথে কথা বলে,
“গেছে মাসের ভাড়া নিতে এসেছি আন্টি।এবার বাবা আসতে পারেনি একটু অসুস্থ।দোয়া করবেন আমার বাবার জন্যে।
” অবশ্যই দোয়া করি বাবা।মোল্লা সাহেব কত ভালা মানুষ।তুমি বসো আমি টাকা টা নিয়া আসি।
“আন্টি আমি ঠিক আছি সমস্যা হবে না।
মুহতাসনিম মিনিট এক ছেলেটাকে দেখছিল,লম্বাচওড়া গড়নের,চোখে চশমা আটা,উজ্জ্বল ফর্সা গাত্রবর্ণ।দেখে যতেষ্ট ভদ্র ঘরের সন্তান মনে হচ্ছে।কথাবার্তা বেশ নম্র!বয়স বড়জোর পঁচিশ,ছাব্বিশ হবে।
মিনা বেগম টাকা দিতেই ছেলেটি বলল,
” ভাড়াটিয়া দের হিসেব আর তালিকা অনুযায়ী এ রুমে আপনি একা থাকতেন যতটা আমি জানি।তবে এখন মনে হচ্ছে দুজন থাকেন আপনারা।
মিনা বেগম হাসার চেষ্টা করে বললেন,
“আমি তোমার বাবারে বলতাম মুহুর কথা।মাইয়া টা কিছুদিন হইবো আসছে এখানেই থাকবো।আমার ভাগ্নি।
মুহু হুট করে জবাব দিল,
” তার জন্য অতিরিক্ত টাকা আমি দিয়ে দিবো খালা।উনাকে জিগ্যেস করেন কত টাকা দিতে হবে?
মুহতাসনিম এর কথায় ওকে বেশ রগচটা আর বেয়াদপ মনে হয়েছে আতিকের।পাল্টা মিনাকে জবাব দিল আতিক,
“আন্টি সঠিক হিসেব টা বাবাকে গিয়ে দিতে হবে আমায়।অতিরিক্ত চার্জ ধার্য করলে সেটা বাবা জানিয়ে দিবে।এখন আসি, আসসালামু আলাইকুম।
আতিক চলে যেতেই খানিকটা রাগি কন্ঠে বলল মিনা বেগম,
” এইভাবে বললি ক্যান?ছেলেটা শুধু ভদ্রতার খাতিরে জিগ্যেস করলো।অন্য জায়গায় হইলে তো এই রাতের বেলাতেই তোরে বাহির কইরা দিতো!মানুষ অহনো চিনস নাই।ছেলের বাপ টাও কি যে ভালা!অমায়িক ব্যবহার!
চুপচাপ খালার কথা শুনছে মুহতাসনিম।এতটা উগ্র স্বভাবের তো ছিল না মুহু!মেজাজ কেমন বিগড়ে যাচ্ছে।এমন হলে তো সৎ মায়ের সাথে একদিনও থাকা দায় হয়ে যেত মুহুর।নাকি শহরে এসে এই শহুরে মানুষের স্বভাব,চরিত্র রক্তের সাথে মিশে যাচ্ছে?!মানুষ কি স্বভাবেই পাল্টায়?নাকি জন্মগত শিক্ষা’ই থাকে চিরকাল?ভেবে পায়না মুহতাসনিম।
~~~
ঘড়িতে তাকায় জাহিন,কাঁটায় কাঁটায় একদম এগারো টা বাজে!হাতে সময় আর নেই।এক্ষুনি বেড়িয়ে পরতে হবে।মা মণিকে এতক্ষণ যাবৎ বোঝালো,দরকার নেই মুহতাসনিম এর সাথে দেখা করার।তার বিষয় সে নিজে সামলাবে।পাছে যদি মুহু তার মা মণি কে উল্টো পাল্টা কিছু বলে ফেলে?কিন্তু কে শোনে কার কথা?মা মণি নাছোড়বান্দার মতো একই কথা,তিনি যাবেন’ই।অবশ্য মায়ের উপর ভরসা আছে জাহিনের।দেখা যাক শেষে মেয়েটার রাগ গলে পানি হয় কিনা?অবশ্য লাভ তাতে জাহিনের’ই!
~~~
আজকে মুহতাসনিম এর ছুটির দিন হলেও মিনা খালা কোনো সাপ্তাহিক ছুটি পান না।রোজ রোজ কাজে যেতে হয়।সকাল সকাল উঠে খাবার তৈরি করে মুহতাসনিম।অবশ্য মিনা বেগম কাজের গন্তব্য স্থানে গিয়ে সকালের নাস্তা সারেন।
সকাল থেকে মুহতাসনিম কে বেশ ফুরফুরে মেজাজের লাগছে।কাল রাতে নিজেকে অনেক বুঝিয়েছে মুহু। অন্য কোনো লোকের জন্যে নিজের স্বভাব চরিত্র কেন পাল্টাবে মুহু?অযথা অন্যের কথা ধরে মন খারাপ করে থাকার কোনো মানে হয় না।
মিনা খালা সকাল নয়টার মধ্যেই কাজে চলে গেলেন।
~~~
নবনী যেন মিনা বেগমের আশাতেই ছিলেন। রান্নার কাজ করছেন শায়লা বেগম,সাথে রিতা বেগম টুকিটাকি এগিয়ে দিচ্ছেন।সবার সামনে মিনার সাথে কথা বলা যাবে না।নবনী একবার মিনার উদ্দেশ্যে বললেন,
“মায়ের জন্য এক কাপ লাল চা’ নিয়ে এসো তো মিনা আপা।
শায়লা বেগম চা কাপে ঢালতে ঢালতে বললেন,
” এই তো চা রেডি নবনী তুমি নিয়ে যাবে?
নবনী হাসি নিয়ে বলল,
“আমার কাজ আছে মিনাকে দিয়ে পাঠিয়ে দাও ভাবী।
” আচ্ছা।
রুমে গিয়ে তৈরি হচ্ছে নবনী।মিনা বেগম চা’ টা রেহানা বেগমের রুমে রেখে, টিপটিপ পায়ে নবনীর রুমে এলেন।এতক্ষণ মিনা’ও যেন ফাঁকফোকর খুঁজছিল কখন একটু নবনীকে একা পাবে।আয়নায় দাঁড়িয়ে মিনাকে দেখে ডেকে উঠলো নবনী,
“কিছু বলবে মিনা আপা?
দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসে মিনা।আশপাশ টা তাকিয়ে বলে,
” জাহিন সাহেব কে কালকে জিগ্যেস করেছিলেন কেন গেছিল কলোনিতে?
নবনী জানতো ঠিক এই প্রশ্ন টা মিনা করবেই আজকে।মুহতাসনিম কে নিশ্চয়ই এ ব্যাপারে কিছু জিগ্যেস করেনি মিনা।
“হ্যাঁ জিগ্যেস করেছিলাম তো,মুহতাসনিম যে জাহিনের জামাকাপড় গুলো কেঁচে দিয়েছে তার জন্য এক্সট্রা টাকা দেওয়ার ছিল মনে হয়।তেমন টাই বলল।বললাম আমার কাছেও তো দিতে পারতি,তখন টাকা টা আমার হাতে দিয়ে বলল’ঠিক আছে মা মণি তুমি’,ই দিয়ে দিও’
” ওহ! তা জাহিন সাহেব রে দেখতাছি না যে?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে নবনী বলে,
“জান’ই তো তার ব্যাপারে।মাসের দুটোদিন বাড়িতে থাকে ভালো করে?আচ্ছা তোমার কলোনিতে গেলে মুহতাসনিম কে পাওয়া যাবে না?টাকা টা বরং দিয়ে আসি।
“মনে হয় না মুহু টাকা টা নিবো।নয়ত বলতাম আপনার কষ্ট কইরা যাওয়ার দরকার নাই আমার হাতেই দেন।আপনি গেলেই বরং ভালা হইবো।
হুম।
~~~
ছুটি পাওয়াতে আজ ঘরদোর পরিষ্কার করছে মুহতাসনিম।অপরিষ্কার বরাবরই অপছন্দ।আর চারদিন পরেই মুহতাসনিম প্রথম বেতন পাবে,তখন আসতে আসতে ঘরটা নিজের মতো করে সাজিয়ে নিবে।মুহতানিম কে কিছু টাকা পাঠাতে হবে আর বাকিটা মিনা খালার হাতে তুলে দিবে।
মুহতাসনিম এর ভাবনার মাঝে হঠাৎ বাইরে থেকে কেউ বলছে,
” বাসায় কেউ আছে?
ঘুরে তাকাতেই মুহতাসনিম দেখে কালকে রাতে আসা আতিক নামের সেই ছেলেটি দরজার বাইরে দাড়িয়ে।মুহতাসনিম কে দেখে কিছুটা বিরক্তি যেন কপাল জুড়ে।কোনোমতে জিগ্যেস করলো,
“আন্টি কোথায়?
মুহতাসনিম বেশ বুঝতে পেরেছে রেগে আছে ছেলেটি।কালকে রাতের ঘটনার জন্যে।মুখে হাসি নিয়ে এগিয়ে গেল মুহতাসনিম।
“খালা তো বাসায় নেই।কি দরকার আমাকে বলুন?
অন্যপাশ তাকিয়ে ছেলেটি বলল,
” বাবা পাঠিয়েছেন আমাকে।বলেছে এই মাসে যা ভাড়া দিয়েছেন তাতেই হবে।আর সামনের মাস থেকে অতিরিক্ত ১০০০ টাকা যোগ হবে।
টাকাটা মুহতাসনিম এর কাছে একটু বেশিই মনে হলো।তবুও কিছু বলেনি।এমনিতে অযথা বাজে ব্যবহার করে ফেলেছে।নয়তো দর দাম করা যেত একটু।
“আচ্ছা ঠিক আছে আমি খালাকে জানিয়ে দিবো।আসুন না বসুন আমি চা’ করে দিই খেয়ে যাবেন।
মুহতাসনিম এর ব্যবহারে বেশ অবাক হয় আতিক।পরক্ষণে একবার পাকঘরে উঁকি দেয়।আজ ছুটির দিন হওয়ায় বেশ ভিড় লেগে আছে।চুলা মাত্র ৬ টা।চা বানাতে মুহতাসনিম এর সিরিয়াল পেতে কমপক্ষে আরও এক ঘন্টা দেরি করতে হবে।আতিকের উঁকিঝুঁকি দেখে মুহতাসনিম বলল,
” সমস্যা নেই আমি চাঁ কিনে নিয়ে আসবো।বসুন আপনি।
“ধন্যবাদ,তার দরকার নেই।
আতিক পিছু ফিরে হাটা দিলো,কি মনে করে আবার ঘুরে তাকালো মুহতাসনিম এর উদ্দেশ্যে বলল,
” সামনে টং দোকানে বসে চা’ খাবেন?
মুহতাসনিম এর মনে হলো এই প্রথম আতিক একটু তাকিয়ে কথা বলেছে তাও সেটা স্বল্প সময় মাত্র কয়েক সেকেন্ড হবে।
বিনাবাক্য রাজি হয়ে গেল মুহতাসনিম।
“আমি দরজায় তালা ঝুলিয়ে আসছি আপনি হাঁটুন।
আতিক সোজা হেটে গেইট থেকে বেরিয়ে এলো।সামনে চায়ের দোকানে বসে দু কাপ চা’ অর্ডার করলো।কালকে অব্ধি মেয়েটাকে বিরক্ত মনে হয়েছে আজ কি বুঝে হটাৎ চা’য়ের অফার করলো আতিক নিজেও জানে না।কিছু কিছু ঘটনা বুঝি নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হয় তা’ও সেটা নিজেকে দিয়ে’ই!আসলেই খুব অদ্ভুত!
আতিকের থেকে প্রায় দুই,তিন হাত দূরে বসেছে মুহতাসনিম।একপলক কেবল তাকায় আতিক।সূর্যের আলো পড়ছে ঘটা করে,মেয়েটি যেন সূর্য রশ্মির মতো কিরণ ছড়াচ্ছে!গায়ের হলদা ভাবের জন্য মনে হয় এমন মনে হচ্ছে।মাথায় গোমটা টানা।সাধারণ ভাবে বসে আছে।চাঁ খাওয়ার মাঝে আতিক তেমন কথা বলেনি যা বলেছে টুকটাক মুহতাসনিম’ই বলেছে।
~~~
মিনা বেগমের রুমের সামনে এসে মস্তবড় তালা ঝুলতে দেখে নবনী।তার জানা মতে মুহতাসনিম এখন বাসায় থাকার কথা!তবে মেয়েটাকে পাবে না আজকে?হতাশ হয়ে কিছুক্ষণ তালার দিকে তাকিয়ে থাকলো নবনী।
পরক্ষণে চলে যাওয়ার জন্য ফিরে তাকাতেই মুহতাসনিম কে দেখলো হেটে আসছে।মুহূর্তেই মুখে হাসি ফুটে উঠলো নবনীর।
সামনে নবনীকে দেখে বেশ চমকে উঠে মুহতাসনিম!মিনা খালার বিপদ হয়েছে ভেবে কলিজা কেমন শুকিয়ে আসলো!দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসে মুহতাসনিম।
” আ,,,,আপনি?মি,,,,মিনা খালা কই?খালার কিছু হয়েছে?
চলবে
[ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিযোগ্য]
#মেঘবতীর_শহরে
পর্বঃ১৪
নাদিয়া ইসলাম সানজিদা
‘
‘
বিচলিত মুহুর দিকে তাকিয়ে আছে নবনী।মেয়েটা কেমন উদ্ধিগ্ন হয়ে জিগ্যেস করছে ‘যেন মিনা ছাড়া পৃথিবীতে তার কেউ নেই’!
আশ্বাস দিয়ে নবনী বলে,
“না,না মিনার কিছু হয়নি।এমনি তোমার সাথে কথা বলতে এসেছি আমি।
চিন্তা কাটিয়ে বড় করে দম ছাড়ে মুহতাসনিম।তবে খানিকটা চমকে যায় নবনীকে দেখে।মনে এতক্ষণে হাজার টা প্রশ্ন উঁকি দেয়।কেন এসেছে মি.জাহিন সাহেবের মা?তাও মুহুর সাথে কথা বলতে!হাসার চেষ্টা করে বলে মুহতাসনিম,
” হ্যাঁ আসুন আমি ঘরের দরজা খুলে দিচ্ছি।
ব্যস্ত পায়ে তড়িঘড়ি করে এসে রুমের তালা খুলে দেয় মুহতাসনিম।হাসি মুখ নিয়ে প্রবেশ করে নবনী।ঘরটায় একবার চোখ বুলায় বেশ পরিপাটি রুম।গোছানো টাও দারুণ।এবার নিয়ে মাত্র দুইবার মিনার বাসায় এসেছে নবনী।
মুহতাসনিম ইতস্তত ভাবে বলছে,
“চুলার কাছেও যাওয়া যাবে না এখন নয়ত চটপট কিছু একটা বানিয়ে দিতাম।আমি বরং দোকান থেকে চা নিয়ে আসি?চা খাবেন তো ম্যাডাম?
মিষ্টি হাসি ছুড়ে বলল নবনী,
” আমি খেয়ে এসেছি।তুমি আমার পাশে এসে একটু বসো তো।
মুহতাসনিম ভাবছে, বড় লোকের ব্যাপার স্যাপার তারা কি আর এই নোংরা পরিবেশের খাবার খাবে?তারচেয়ে বরং চুপচাপ কথা শুনে নেওয়াই ভাল।
নবনীর পাশে বসে পরে মুহতাসনিম।খানিকক্ষণ মুহুর দিকে তাকিয়ে থাকে নবনী’হলদে বর্ণের গায়ের রঙ মেয়েটির,চোখ জোড়ায় যেন মায়া ঠাসা করা!মাথায় মস্তবড় একটা খোপা করা!চুল বেশ বড় হবে তা এমনিতেই আন্দাজ করা যাচ্ছে।নবনীর তাকানো দেখে নিজেকে কেমন অপ্রস্তুত লাগছে মুহতাসনিম এর।
নবনী চট করেই যেন বলল,
“আমার ছেলের উপর রেগে আছো?
প্রশ্ন টা শুনে বেশ চমকে যায় মুহতাসনিম!কি জবাব দিবে?এ কেমন প্রশ্ন ছুঁড়েছেন উনি?
নবনী আবারও বলল,
“সেদিন তোমাকে যা নয় তাই বলল না?আমি বুঝতে পেরেছি তুমি রাগ করেছো।আমি জাহিন কে ইচ্ছে মতো বকে দিয়েছি।হাঁদারাম টা তোমার কাছেও এসেছিল ক্ষমা চাইতে তাই না?এত সহজে অপমান ভুলে ক্ষমা করা যায় নাকি?
নবনীর কথা যত শুনছে ততই অবাক হচ্ছে মুহতাসনিম।ভদ্র মহিলার কথার প্রতিউত্তরে কি জবাব দেবে মুহতাসনিম ভেবে পায় না।তবে জাহিনের উপর চরম বিরক্ত!নিজের ভুল নিজে স্বীকার না করে মাকে পাঠিয়েছে!
” আসলে জাহিন একটু এরকমই,আমি তো ওর মা তাই আমার চেয়ে ভাল কেউ বুঝে না ওকে।সহজে রাগে না আর রাগ করলে খুব ভয়ানক পর্যায়ে চলে যায়।আমি তো আর সবটা জানি না হয়ত কোনো কারণে জাহিনের মনে রাগ ছিল নয়ত অযথা তোমার সাথে অমন ব্যবহার করার ছেলে আমার জাহিন নয়।
মুহতাসনিম এর মুখটা চুপসে যায়।হন্য হয়ে মনে মনে খুঁজতে থাকে কি ভুল,অন্যায় ছিল তার যার কারনে লোকটা এত রাগ দেখালো সেদিন!মুহু হসপিটাল থেকে না বলে চলে আাসায়?বাকি টা আর মুহুর ছোট্ট মাথায় প্রবেশ করে না।মাথা কেমন ভঁনভঁন করতে থাকে!
“আমি বলছি না আমার ছেলেকে তুমি ক্ষমা করে দাও,শুধু বলবো জাহিন তোমায় কি বলতে চায় সেটা একবার শুনে দেখো।তারপর তোমার যা মনে হয় তাই করো।
মুহতাসনিম ভাবছে তার মতো একটা মেয়ের রাগে এই মা,ছেলের কি আসে যায়?এত কেন উঠে পরে লেগেছে তারা?
“শুনো মুহতাসনিম রাগ,অভিমান মনে পুষে রাখা ঠিক নয়।এই অভিজ্ঞতা তোমায় ভবিষ্যতে ভাল কিছু করতে উৎসাহ দিবে এমন নয়!এখনও অনেক ছোট তুমি।আমি চাই না অযথা একটা তিক্ত অনুভূতি মনে পুষে রাখো।তোমার কাছে আমি আজ নাও আসতে পারতাম তাতে আমার কিন্তু কিছুই যায় আসতো না যা প্রভাব পরতো তা তোমার মনে।
একমুহূর্তের জন্য মুহুর মনে হলো মিস নবনী তার মনের কথা গুলো শুনতে পাচ্ছেন!বেশ অদ্ভুত লাগলো!
“না,,মানে আসলে আমি এসব কিছুই মনে রাখিনি।
একটুখানি হেসে মিসেস নবনী বলে,
” যদি মনে না’ই রাখতে তাহলে আমার জাহিনের কথা তুমি শুনতে।কি বলতে চেয়েছিল একটাবার না হয় শুনেই নিতে!যে যেমন ব্যবহার করবে তাকে তেমন টাই ফিরিয়ে দেওয়া বোকামি।তাহলে তো তার বৈশিষ্ট্যও তোমার মাঝে বিদ্যমান!সবসময় ভাল টা ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে!খারাপের বিনিময়ে হলেও ভাল টাই দিবে তবেই না তোমার শিক্ষা,বংশের পরিচয় বলে দিবে!
মুহতাসনিম চুপচাপ নবনীর কথা শুনছে।এমন একজন মহিলার ছেলে নিশ্চয়ই খারাপ শিক্ষা পাবে না!তবে মুহু কোথাও ভুল করলো?মুহু তো এমন ছিল না!শত কষ্ট জ্বলে,পুড়ে বড় হয়েছে মুহু তবুও তার শিক্ষার নড়চড় হয়নি একটুও!এখন তবে এমন হলো কেন?
কথার প্রসঙ্গ পাল্টায় নবনী,
“পরিবারে কে কে আছে তোমার?
হঠাৎ আৎকে উঠে মুহতাসনিম।মিনমিনে গলায় উত্তর দেয়,
” বাবা,মা,বোন।
“কাজের জন্যই এসেছো ঢাকায়?পড়াশোনা করো না?
মুহতাসনিম মাথা নাড়িয়ে ‘না’ বলে।
উঠে দাঁড়ায় নবনী পরক্ষণে বলে,
” আমি মিনাকে বলেছি তুমি সেদিন জাহিনের কাপড় ধুয়ে দিয়েছো তার জন্য এক্সট্রা কিছু টাকা দিতে এসেছি তোমায়।এটা বলা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।তুমি কষ্ট পেও না মুহতাসনিম।মিনা এসেই তোমাকে হয়ত এই কথাটা জিগ্যেস করবে।
মুহতাসনিম চট করেই বলল,
“সমস্যা নেই খালাকে কিছু একটা বুঝিয়ে বলবো আমি।
” টাকা নয় তবে তোমার জন্য ভাল কিছু অপেক্ষা করছে।আজ আসি ভাল থেকো।
~~~~
আলতাফ মিয়া এখন যেন মুহতাসনিম এর অনুপস্থিতি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন।সংসার যে অচল হওয়ার পথে!তবুও কোনোরকম দিন পাড় হচ্ছে।মুহতানিম এত কষ্টের মাঝেও এ কথা একবারও মুহতাসনিম কে জানায় না।মুনা জানে সে এই খবর মুহুর কানে পৌছাতে দেরি হবে না মুহু ঠিক এখানে এসে হাজির হবে!
~~~
দুপুর নাগাদ বাড়ি ফিরেছে নবনী।ততক্ষণে মিনার কাজ প্রায় শেষের দিকে।বারান্দায় বসে পান চিবুচ্ছে রেহানা বেগম।নবনী রুমে এসে বসতেই প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“সকাল সকাল কই গেছিলি?
নবনীকে আজ বেশ ফুরফুরে মেজাজের লাগছে।মেয়েকে অনেক বছর পর এত হাসিখুশি দেখছে রেহানা বেগম।ক্রমেই তার আগ্রহ বাড়ছে মেয়ের এমন হাসির কারণ জানার।মিনা ততক্ষণে কাজ সেরে এসেছে,
” আপা আমি গেলাম।
নবনী বলল,
“দাড়াও মিনা আপা।
মিনা দাড়াতেই বলে,
“তুমি ঠিকই বলেছো মিনা,মুহতাসনিম টাকা টা নেয়নি।বেশ আত্মসম্মান আছে মেয়েটার বলতেই হয়।আমি বরং এর চেয়ে ভাল কিছু উপহার দিতে চাই তোমার ভাগ্নিকে!
রেহানা বেগম সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে নবনীর কথা শুনছেন।
“এই মাসের ভাড়া চুকিয়ে তোমরা আমাদের বাড়িতে এসে উঠবে।ছাদের চিলেকোঠার রুমটা অযত্নে পরে আছে।আমি চাই তাতে মুহতাসনিম এর ছোঁয়া লাগুক!
মিনা মনে মনে অনেক খুশি হলেও তা আড়াল করে বলে,
” কিন্তু আপা আমরা এখানে আসমু ভাবী…..
রেহানা বেগম পাশ থেকে বলেন,
“নবনী যখন কইতাছে আইসা পর।আর কারও কথা ভাবতে হইবো না।পরশুই আয়।
মিনা ছোট্ট করে “আচ্ছা” বলে চলে গেল।
নবনী মায়ের কাছে এসে বসে।চোখ জোড়া চিকচিক করছে কেমন।সব কথা মায়ের সাথে শেয়ার করে নবনী।অবশ্য দুই ভাবীর সাথে তেমন একটা ফ্রী নয়।
“মা এবার বোধহয় জাহিন কে বিয়ে করাতে পারবো।
ভ্রু কুঁচকে বলে রেহানা বেগম,
” কি আবল তাবল বকতাছত তুই,?
“এই প্রথম কোনো মেয়েকে নিয়ে এতটা ভাবছে জাহিন।মেয়েটা নিশ্চয়ই স্পেশাল হবে!তুমি শুধু আমার ছেলেটার জন্য একটু দোয়া করো মা।
” যা করবি ভাইবা চিন্তা করিস।মাইয়াটার জীবন টা যেন শেষ না হয়।
মায়ের কাছ থেকে উঠে দাড়ায় নবনী।ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।ছেলেকে যে যোগ্য শিক্ষা দিয়েছেন তা খুব শীঘ্রই প্রমান করবেন।এক পাল্লায় সবাইকে মাপা যায় না সেটা কেন জগতের বোকা মানুষ গুলো বোঝে না!
~~~~
চিলেকোঠার রুমটা এখন অসম্ভব সুন্দর লাগছে!কি সুন্দর করে নিজের হাতে গুছিয়েছে মুহতাসনিম।মিনা খালা যখন এই চিলেকোঠার কথা বলল বিনা বাক্যে রাজি হয়ে যায় মুহতাসনিম।এই কোলোনির থেকে তো ঢের ভাল!অন্তত লাইন ধরে আর কিছু করতে হবে না!তবে বাড়ির বাকি সদস্য রা শর্ত ছুঁড়েছে মিনার বেতন এক তৃতীয়াংশ কাটা যাবে।মিনা তাতে হাসিমুখে রাজি হয়ে যায়।
দুদিন পর রিশান চলে যাবে জাপানে।বাড়িতে মোটামুটি মেহমানে ভরপুর।মুহতাসনিম সচরাচর নিচে ওদের রুমে একেবারেই যায় না।সকালে কাজে বেরোলে সেই বিকেলে ফেরে।
বাড়িতে জাহিন নেই এই জন্য সবারই মন ভার হয়ে আছে।রিশান চলে যাবে দুদিন পর আর ঠিক তার পরদিনই জাহিন ফিরবে!অবশ্য সবাই অনেকবার জাহিন কে কল করেছে প্রতিবার তার একই উওর “ম্যানেজ করতে পারলে আসবে”
~~~~
ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে আছে মুহতাসনিম।পুরো ছাদ জুড়ে তাদের ছোট্ট চিলেকোঠার আলো ছাড়া আর অবশিষ্ট কোনো আলো নেই!ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাস বইছে বাহিরে।ছাদ থেকে ব্যস্ত নগরী বেশ ভাল ভাবেই উপভোগ করা যায়।জীবন আজ তাকে কোথায় দাড় করিয়েছে তার হিসেব করছে মনে মনে।বেতন পেয়েছে আরও দুদিন আগে কিছি্ুটা টাকা মুহতানিম কে পাঠিয়েছে আর কিছুটা নিজের কাছে রেখেছে জাহিনের টাকা টা যে শোধ করতে বাকি এখনও!
“আপনি এখানে?
চেনা কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে কেমন কেঁপে উঠে মুহতাসনিম।ভাবনার জগত থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসে।ঘুরে তাকাবার আগেই বুঝে ফেলে তার পেছনে ঠিক কে দাঁড়িয়ে আছে!মুহু ভাবছে এটা আবার তার মনের ভ্রম নয় তো?
” মিস মুহু?এত রাতে আমাদের বাসার ছাঁদে আপনি কি করছেন?
মুহুর্তেই ঘুরে তাকায় মুহতাসনিম।অফ হোয়াইট রঙের শার্ট পরে দাড়িয়ে আছে জাহিন।আবছা অন্ধকারে চোখ দুটো কেমন জ্বলছে!পকেটে এক হাত পুরে নিয়েছে।চোখে,মুখে প্রশ্নের ছাপ!
মুহতাসনিম একবার শুধু চিলেকোঠার দিকে আঙুল তাক করে দেখালো।মুহূর্তেই ওপাশে তাকায় জাহিন।
মিনমিনে গলায় বলে মুহতাসনিম,
“আমি আর খালা ওই চিলেকোঠায় থাকি।
রিশান আর আনান তক্ষুনি পিছু ডাকে জাহিনকে।
চলবে………
(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিযোগ্য)