#মেঘবতীর_শহরে,পর্বঃ২০,২১
নাদিয়া ইসলাম সানজিদা
২০
ধীরে ধীরে মেহমান দের ভীর বাড়ছে।রাফসাদের বাড়ি থেকে অলরেডি সবাই এসে গেছে।
এক পা এক পা করে সেই চেনা মুখ খানি এগিয়ে আসছে মুহতাসনিমের দিকে।অবাক দৃষ্টি নিয়ে এখনও তাকিয়ে আছে মুহতাসনিম!আশেপাশে যে যার মতো ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে।
“আপনাকে এখানে দেখে সত্যিই আমি সারপ্রাইজড!
জড়তা যেন ঘীরে ধরেছে মুহতাসনিম কে।কোনোরকম হাসি টেনে নেয় ঠোঁটে।
” আমাকে চিনতে পেরেছেন তো?
হাসি মুখ নিয়েই এবার বলে মুহতাসনিম,
“হ্যাঁ চিনতে পেরেছি।
” আচ্ছা!না মানে আপনার তাকানোর ভঙ্গিমা বলছিল আমাকে বোধহয় চিনতে পারেননি।যাই হোক কি অবস্থা এখন?
“জ্বী ভালো।
” হুম,বাবার কাছে শুনতে পেয়েছিলাম আপনারা কলোনির রুম ছেড়ে দিয়েছেন।তার আগে আমি আরও একবার গিয়েছিলাম সেখানে কিন্তু আপনাদের পাইনি।
আতিকের কথা শুনে খানিকটা চমকে যায় মুহতাসনিম!
“আসলে বাবা তো এখন সব দেখাশোনা করতে পারে না তাই আমাকেই দেখতে হয়।তা এখানে আজ?
মুহতাসনিম পুনরায় যেন অস্বস্তিতে পরে গেল।যথাসম্ভব হাসি নিয়েই বলল,
” আসলে আমরা এ বাসাতে’ই উঠেছি।
“আচ্ছা!আজ কিন্তু খুব সুন্দর লাগছে আপনাকে।
” ধন্যবাদ।
~~~
মিসেস নবনী মন ভার করে বসে আছেন।তার ছেলে এখন অব্দি একটা কল পর্যন্ত দেয়নি তাকে!কি করে এই ভারাক্রান্ত মন নিয়ে অনুষ্ঠানে সামিল হবে নবনী?ভাবতেই চোখের কোনা জলে চিকচিক করে উঠছে।হঠাৎ ফোনের রিং হতেই চমকে উঠেন নবনী।তৎক্ষনাৎ দৌড়ে গিয়ে ফোন রিসিভ করে কানে ধরেন,
” মা মণি কে মনে পড়লো?আমি ভাবলাম ভুলেই গেলি মনে হয়।
ওপাশ থেকে গম্ভীর কন্ঠে জবাব আসলো,
“আমি তোমার উপর রেগে আছি মামণি।তাই সাময়িক সময় তোমার খোঁজ নেইনি।
অবাক হয়ে জিগ্যেস করলো নবনী,
” মায়ের উপর রেগে আছিস?কি কারণ শুনি?আমার তো মনে হচ্ছে না আমি তোকে রাগিয়ে দেওয়ার মতো কিছু করেছি!
কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলে জাহিন,
“মুহু কে আমার ফোন নম্বর কেন দিয়েছো তুমি?
গলাটা মিনমিনে হয়ে যায় নবনীর।শুকনো একটুখানি ঢোক গিলে নিয়ে বলে,
” মেয়েটার শরীর টা ভাল ছিল না।ভাবলাম কোনো প্রবলেম হলে তোকে জানালে ভালো হবে তাই না?
বড় করে দম ছাড়ে জাহিন।পরক্ষনে বলে,
“বাংলাদেশে ডক্টর আমি একা নই মা মণি।আর তা ছাড়া তুমি যা ভাবছো তা কখনও হবার নয়!এটা সম্ভব নয়।
ধরা কন্ঠে বলে নবনী,
” কেন হবার নয়?
“তুমি বেশ ভাল করেই জানো মামণি।তা ছাড়া মুহু মেয়েটা খুব ভাল আমি চাই না আমার মতো একজনের সাথে উনার জীবন জড়িয়ে যাক।
” এসব কেমন ভাবণা জাহিন?তুমি কি তোমার বাবার মতো’ই হতে চাও?এভাবে দেখতে চাইনি তোমায় আমি।
“বাবার মতো হতে চাই না মামণি তাই তো এ সিদ্ধান্ত আমার।
” একটা মানুষের জীবণ পরিপূর্ণ হয় বিয়ের মাধ্যমে!জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত এটা!আর তুমি সেখানেই গড়িমসি করছো?
ওপাশ থেকে তাচ্ছিল্যের হাসির শব্দ,
“তাহলে তোমার জীবন টা কেন অপরিপূর্ণ মামণি?সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত টা নিয়েই জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল হয়!
ছেলের কথায় বাকরুদ্ধ হয়ে যায় নবনী।চোখ বেয়ে অনর্গল পানি ঝড়তে থাকে।ততক্ষণে ওপাশ থেকে লাইন কেটে যায়।
রিতা বেগম দরজার কাছে আসতেই থমকে দাঁড়ায়।বিধ্বস্ত নববীকে দেখে বড্ড মায়া হয় তার।ছেলেটার শোকে কবে যেন পাগল হয়ে যায় এই মহিলা!
” আপা আপনি এখনও দাড়িয়ে আছেন?সবাই খুঁজছে আপনাকে চলেন।জাহিন হয়তো এখন আসতে পারেনি দেখবেন আনানের বিয়েতে না এসে পারবে না।আমার রিশানটাও যে নেই!কষ্ট আমারও হচ্ছে তবুও হাসিমুখে চলতে হয়।চলেন।
নিশ্চুপ নবনী চোখের জল টুকু মুছে নেয়।মলিন একটা হাসি নিয়ে বলে,
“হুম চলো।
~~~
বাইরে দাঁড়িয়ে আতিকের সাথে কফি খাচ্ছে মুহতাসনিম।আজকের আকাশটা বড্ড সুন্দর লাগছে।তারায় তারায় ছড়িয়ে আছে আকাশ!চাঁদের আলোয় ঝিকঝিক করছে আশপাশ টা!হাতে কফির ওয়ানটাইম কাপ টা নিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে আতিক।মৃদু হেটে কফি খাচ্ছে মুহতাসনিম।
” একটু দাঁড়িয়ে কফিটা খেয়ে নিন।পরেও তো হাটা যাবে।
পিছু ফিরে একটুখানি হেসে বলে মুহতাসনিম,
“এভাবেই ভালো লাগছে।আপনিও আসুন না?
কয়েক কদম হেটে মুহতাসনিমের পাশাপাশি চলে আসে আতিক।হলদেটে নিয়ন আলোয় হাটছে দুজন।কাপটার দিকে দৃষ্টি নিয়ে বলে মুহতাসনিম,
” দেখুন কফির রঙ টা সোডিয়ামের আলো কেমন বদলে দিয়েছে!তবে স্বাদ কিন্তু একই আছে!
বলেই খিলখিল করে হেসে উঠে মুহতাসনিম।প্রান খোলা হাসির দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে আতিক।একদম যেন সরল হাসি!
“আরে আপনার কফি তো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে!এই সোডিয়াম আলো মেখে খেয়ে দেখুন মন্দ লাগছে না!
বলে আবারও একটুখানি হেসে বলে মুহতাসনিম।
” আসলে কফি আমার তেমন ভালো লাগে না।আমি টঙ দোকানের চা’ই খেতে বেশি পছন্দ করি।
“তো চলুন চা খাওয়া যাক।
” আরে নাহ্,আপনি কফি খাবেন বললেন এটাই থাক এখন।
“সেদিন আপনি চা’য়ের অফার করেছিলে আমায় আজ আমি কফির অফার করলাম!
হঠাৎ পকেটে থাকা ফোন বেজে উঠে আতিকের।পরক্ষণে মুহতাসনিমকে তাড়া দিয়ে বলে আতিক,
” আনান কল করেছে চলুন এক্ষুনি যেতে হবে।
~~~
পুরো অনুষ্ঠান জুড়ে মুখ ভার ছিল নবনীর।মুহতাসনিমের দিকে একবারও ফিরে তাকাননি তিনি।বড্ড মায়া জড়ানো মেয়েটির মুখ খানি।জাহিনের জন্য হলেও যদি তিনি মুহতাসনিমকে পেতেন তাহলে সত্যিই জীবণ ধন্য হয়ে যেত!মুহতাসনিমের মতো সরল হাসি মুখ তিনি দ্বিতীয়টি আর দেখেননি!
আতিক অনুষ্ঠানের মাঝে বেশ কয়েকবার মুহতাসনিমের সাথে কথা বলেছে।মিনা বেগমের সাথেও দেখা করে নিয়েছে।
~~~
মধ্যে রাত।ঘুম নেই জাহিনের চোখে।মামণি কে আজ একটু বেশিই কষ্ট দিয়ে ফেলেছে!এ ছাড়া যে উপায় ছিল না আর।জোকের বসে যদি মুহতাসনিম কে নিয়ে কিছু একটা করে বসে?তার দায় তো জাহিন নিতে পারবে না!মামণি কে বুঝিয়ে বলেও কোনো লাভ হবে না!অবশ্য মুহুর ভাবনাটা ইদানিং জেকে বসেছে মাথায় কেমন।না চাইতেও ভাবনা গুলো এসে জড়োসড়ো হয় মস্তিষ্কে!মাথাটা কেমন ধরে আছে জাহিনের।একটুখানি ঘুম না হলে মস্তিষ্কের নিউরন গুলো শান্ত হবে না!সব ভাবনা মস্তিষ্ক থেকে উপরে ফেলতে হবে যে!
~~~
আনানের এংগেইজমেন্টের সময় ঘোষণা হয় বিয়ে আগামী মাসে’ই।ছেলের বিয়ে নিয়ে বিলম্ব করতে চান না জাফর সাহেব।রেহানা বেগম ছেলের সাথে সহমত পোষণ করেন।
মিনা বেগম কাল থেকে’ই খেয়াল করছেন নবনীর মন টা ভার।বিয়ে উপলক্ষে সবার মুখে মুখে হাসি থাকলেও নবনীর বেলায় যথেষ্ট খামতি লাগছে!সবাই একসাথে খেতে বসলেও ভাতের প্লেতে ভাত নিয়ে কেবল নাড়াচাড়া করছে আর সকলের কথা শুনছে নবনী।বিষয়টা মিনার চক্ষু এড়ায় না।
~~~
দুপুর পেরিয়ে কেবল বিকেল হতে চলল।এই পর্যন্ত কিছুটা রুটি আর চা খেয়ে কাটিয়ে দিয়েছে মুহতাসনিম।কোনোদিন বা টিউশনি পড়াতে গিয়ে খানিকটা খাবার মিলে।দিনশেষে বড্ড ক্লান্ত হয়ে আসে শরীর।
রিকশা থেকে নেমে,শেষ বেলার রোদে হেটে চলেছে মুহতাসনিম।কালকে মুহতানিম কল করে জানায় ইমার্জেন্সি টাকা পাঠাতে হবে কিছু।কোথা থেকে ম্যানেজ করবে এই টাকা?ভাবনার মাঝে কেউ ডেকে উঠে,
“মুহতাসনিম?
ঘোর কাটলে ফিরে তাকায় মুহতাসনিম।হাসি মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আতিক।এ সময় এখানে আতিক কে দেখে বেশ খানিকটা চমকে যায় মুহতাসনিম।ততক্ষণে এগিয়ে আসে আতিক।
” আমাকে বোধহয় খেয়াল করেননি আপনি।
শুকনো ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে উত্তর দেয় মুহতাসনিম,
“এই তো সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন।
শব্দ করে হাসে আতিক।পরক্ষণে বলে,
” আপনাকে কেমন আনমনা লাগছে!হাটার সময় মনে হচ্ছিল দিকবেদিক খেয়ালে নেই!
“আমি ঠিক আছি।আপনি এখানে?
” আব্ মানে এদিক দিয়ে’ই যাচ্ছিলাম আর আপনার সাথে দেখা’ও হয়ে গেল কেমন!
“তা বেশ চলুন বাড়িতে।চা খেয়ে যাবেন।
কয়েক সেকেন্ড কিছু একটা ভেবে বলে আতিক,
” বন্ধুর বাসার সামনে এসে এভাবে ওকে ডিঙিয়ে যদি আপনার সাথে যাই চা খাওয়ার জন্য তাহলে বিষয় টা সত্যি বেমানান।কথাটা বন্ধুত্বের খাতিরে বললাম।কিছু মনে করবেন না।অবশ্য চলুন আমরা কোথাও বসে চা খাই।
ক্লান্ত মলিন মুখে যথাসম্ভব হাসি টেনে বলে মুহতাসনিম,
“আজ থাক।অন্য কোনোদিন।
বলে’ই হাটা দেয় মুহতাসনিম তাৎক্ষণিক পিছু ডাকে আতিক,
” মুহতাসনিম?
থমকে দাঁড়ায় মুহতাসনিম।ফিরে তাকায় একটুখানি।
“একটা কথা জিগ্যেস করবো?
” বলুন?
“আমার মনে হচ্ছে আপনি ঠিক নেই!কিছু হয়েছে?দুঃখিত ব্যক্তিগত প্রশ্ন করার জন্যে।
” আমি একদম ঠিক আছি।
বলেই কয়েক কদম পা ফেলে বাড়ির ভেতর চলে যায় মুহতাসনিম।সিড়ি ভেঙে উপরে উঠতেই সম্মুখে মিসেস নবনী কে দেখে।তৈরি হয়ে কোথায় যাওয়ার জন্যে বের হচ্ছেন।মুখে হাসি নিয়ে সালাম জানায় মুহতাসনিম।
চলবে……
#মেঘবতীর_শহরে
পর্বঃ২১
নাদিয়া ইসলাম সানজিদা
,
,
,
মিসেস নবনী একপ্রকার পালিয়ে পাড় পেতে চেয়েছিলেন যেন।মুহতাসনিমের সালামের জবাব দিয়ে ছোট্ট একটা হাসি ছুড়ে পাশ কেটে চলে যায় নবনী।ঘটনাটা যেন খুবই দ্রুত ঘটে!চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখে যায় মুহতাসনিম।লম্বা লম্বা পা ফেলেই যেন নেমে গেলেন ভদ্র মহিলা।পরক্ষণে উপরে চলে যায় মুহতাসনিম।
ঘরের জিনিসপত্র টুকটাক গুটাচ্ছে মিনা বেগম।ক্লান্ত মুহতাসনিম রুমে প্রবেশ করেই খাটে গা এলিয়ে দেয়।একপলক তাকিয়ে মিনা বেগম বলেন,
“আজকে ক্লান্ত বেশি লাগতাছে মনে হয়।
মলিন একটু হাসে মুহতাসনিম।মাথায় কিছুর চিন্তা ভর করলে শরীর এমনিতেই অসার লাগে।কোনোকিছুই যেন ভালো লাগে না।
” কাজ শেষে তো ক্লান্ত লাগবেই খালা।
“তোর শরীর টা তো ভালো না।ক্লান্ত হইবোই।যা হাত মুখ ধুঁইয়া আয় তারপর খাইয়া নে।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে মুহতাসনিম।পরক্ষণে আমতা আমতা করে বলে,
” কিছু টাকার দরকার ছিল খালা।বাসা থেকে কল এসেছিল।আমি কয়দিন পর টাকা পেলেই তোমার টাকা টা দিয়ে দিবো।
হঠাৎ খোলা দরজার সম্মুখে এসে দাড়ায় রিতা বেগম।মিনা বেগমের উদ্দেশ্যে বলে,
“মিনা তোমাকে নিচে ডাকছে শায়লা ভাবী।
ভ্রু কুঁচকে তাকায় মিনা বেগম।সে তো আজ সব কাজ শেষ করে তবেই এসেছে।তাহলে কেন ডাকছে এখন?সামনে আনানের বিয়ে তাই হয়তো বাড়তি কাজ পরেছে।রিতা বেগম ততক্ষণে চলে যায়।মিনা যাওয়ার জন্যে উদ্যত হতেই খপ করে হাত ধরে ফেলে মুহতাসনিম।
” কই যাও খালা?সারাদিন কাজ করেছো একটু তো বিশ্রাম নিবে।টাকা দিয়ে কি তারা কিনে নিয়েছে নাকি তোমায়?রোবট মনে হয় তোমাকে তাদের?
“জরুরি কোনো কাজ থাকতে পারে মুহু,হাত টা ছাইড়া দে।দেরি হইতাছে।
” আমি বলছি তুমি যাবে না ব্যস।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে মিনা বেগম,
“এই শহরে কাম পাওয়া বড্ড কঠিন বুঝলি?বাড়িতে ভাই,বোন গুলা আমার আশায় থাকে কখন টাকা পাঠামু।এ ছাড়া আমার কোনো পিছুটান নাই!নিজেরে নিয়াও না!রক্ত মাংসহীন রোবট তো কবেই হইয়া গেছি!
আলতো করে হাত টা ছেড়ে দেয় মুহতাসনিম।মিনা খালার কথা গুলোর মর্ম সে খুব ভালো ভাবেই উপলব্ধি করতে পারছে।মিনা ততক্ষণে চলে যায়।
~~~
খাটের এক কোণে বসে পান চিবুচ্ছে রেহানা বেগম।ঠোঁট দুটো টকটকে লাল বর্ণ ধারণ করেছে!পাশে মেঝেতে বসে সুপুরি কেটে দিচ্ছে শায়লা বেগম।মিনা দরজায় দাঁড়িয়ে বলে,
” আমারে ডাকছিলেন বড় ম্যাডাম?
দরজার দিকে চোখ পরতেই মুখ ভর্তি পানের পিক নিয়ে বলে রেহানা বেগম,
“আয় মিনা,তোর জন্যি অনেক বড় সুসংবাদ আছে।
শায়লা বেগম বললেন,
” বসো মিনা,আনান আসছে তোমার সাথে জরুরি কথা আছে।
চুপচাপ শায়লা বেগমের পাশেই মেঝেতে বসে মিনা।আনান ফোন চাপতে চাপতে রুমে প্রবেশ করে।
“মিনা আন্টি এসেছো?তোমার সাথে জরুরি কথা আছে।
মিনা শুধু চুপচাপ ভাবছে কি এমন জরুরি কথা বলবে আনান?
নবনী আর রিতা ততক্ষণে রুমে এসে হাজির।রিতা একপ্রকার টেনে নিয়ে এসেছে নবনীকে।
~~~
” আমি তোমার ভাগ্নি মানে মুহতাসনিমের বিয়ের ব্যাপারে বলতে চাচ্ছি।
মিনা বেগম বেশ খানেক অবাক’ই হলেন আনানের মুখে এরূপ কথা শুনে।রিতা হা হয়ে আছে!পাশে নবনীর কানের পাশে ফিসফিস শব্দে বলছে,
“ওই মেয়ের জন্য আনান আবার কোথা থেকে সম্বন্ধ নিয়ে আসলো আপা?
মিনা বেগম বললেন,
” মুহুর বিয়া?সম্মন্ধের কথা কইতাছো?
“হুম,ছেলেটাকে তুমি চেনো।আমার বন্ধু আতিকের কথা বলছিলাম।তোমরা মেবি তাদের কলোনিতেই থাকতে আগে।
অবাকতার রেশ কিছুতেই কাটছে না মিনা বেগমের।মনে মনে তিনি প্রচন্ড খুশী হয়েছেন এ প্রস্তাবে।চোখে মুখে তা প্রজ্জ্বলিত হয়ে ফুটে উঠেছে যেন!
“এখন মুহতাসনিমের আপন বলতে তোমাকেই চিনি।মুহতাসনিম কি বলে আমাকে অবশ্যই জানাবে আন্টি।
রিতা দরজার পাশ থেকে বলে’ই ফেললো,
” কিহ!!তোমার বন্ধু আতিক?ওই ছেলে কি দেখে এমন মেয়েকে পছন্দ করলো আনান?তুমি কিছু বলোনি?তুমি তো দেখছি উল্টো আরো বন্ধুকে কুয়ার মধ্যে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিচ্ছো!
খানিক রাগ উঠে আনানের।নিজেকে দমিয়ে বলে,
“এটা যার যার ব্যাক্তিগত ব্যাপার চাচিমা।আর আতিকের পরিবার যেখানে এ ব্যাপারে অবগত এবং রাজি সেখানে তুমি এসব বলার কে? বা আমি কুয়োর মাঝে ধাক্কা দেওয়ার’ই বা কে?
আনানের কথায় চুপ করে আছে রিতা বেগম।নিস্তব্ধ হয়ে পরিস্থিতি দেখছে নবনী।মনের মাঝে যা’ও একটুখানি ক্ষীন আশার প্রদীপ ছিল সে টুকু আজ ধপ করে নিভে গেল যেন!
~~~
খোলা জানালা গলে মৃদু বাতাস বইছে।পড়ন্ত বিকেলের সূর্য ডোবা দেখতে ব্যস্ত মুহতাসনিম।রক্তিম সূর্য টা আস্তে আস্তে নিভে যাচ্ছে!অন্ধকার যেন গিলে নিচ্ছে সূর্য টাকে!সন্ধ্যার পাখি গুলো কিচিরমিচির ডাকছে!একরাশ খুশি নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে রুমে প্রবেশ করে মিনা বেগম হাপিয়ে বলে,
” মুহু রে?কি যে খুশীর খবর নিয়া আইছি তুই কল্পনা’,ও করতে পারবি না!
হঠাৎ ভয়ে গা কাটা দেয় মুহতাসনিমের!পিছু ফিরে তাকিয়ে বলে,
“এভাবে কেউ বলে খালা?আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম!
“বিয়ার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু কর।
ভ্রু সহ কপাল কুঁচকে আসে মুহতাসনিমের।
“কার বিয়ে?
” কার আবার?তোর!
“মানে?
” আরে আতিক আছেনা?ওই যে কালকে আসলো যে!ওই ছেলে তোরে বিয়া করবো কইছে।আমি যে কি খুশি হইছি রে মুহু!ভাষায় প্রকাশ করতে পারমু না!
এক মুহূর্তের জন্যে মস্তিষ্ক থমকে যায় মুহতাসনিমের।আতিক কে চেনে মাত্র দুইদিন!এর মধ্যেই এই লোক বিয়ের প্রপোজাল পাঠায় কি করে?রাগে কপাল কুঁচকে আসে মুহতাসনিমের।শক্ত গলায় জবাব দেয়,
“এটা কিভাবে সম্ভব খালা?আমি তো তারে ভালো করে চিনিও না!
” আমি তো চিনি নাকি?অনেক ভালা ছেলে!হাজারে মিলে এরকম ছেলে এটা মাথায় রাখিস মুহু।
“কিন্তু খালা আমি তো এখন বিয়ে নিয়ে ভাবছি না।তা ছাড়া বাড়িতে কি ভাবে বলবো?বাবা কে না জানিয়ে এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নেবো?
কপট রাগ দেখায় মিনা বেগম,
” যে বাপ নিজের মাইয়ার অমতে বিয়া দিতে পারে তারউপর কোনো খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করে না!ওইরকম বাপ থাকার চেয়ে না থাকাও ভালো।
চোখ বুজে আসে মুহতাসনিমের।দু গাল ভেসে যায় নোনা জলে।
“শোন মুহু এমন ছেলে পাইতে বিরাট বড় ভাগ্য লাগে বুঝলি!আমি তোর খালা হইয়া কইতাছি তুই অনেক সুখে থাকবি।আমি তো এখনও যেন স্বপ্নের মাঝে আছি!আমি কালকেই গিয়া আনান রে কমু তুই রাজি।
দু কদম হেটে পুনরায় জানালার কাছে চলে আসে মুহতাসনিম।চারিদিক টা ঘোলাটে অন্ধকারে ছেয়ে গেছে!মৃদু বাতাস বইছে!অশ্রুধারা বাধ মানছে না কিছুতেই।সত্যিই কি বড় ভাগ্য করে জন্মেছে মুহতাসনিম?তাহলে জন্মের পর মাকে হারালো কেন?এত কষ্ট সহ্য করে বড় হতে হলো কেন?তবে কি মিনা খালার কথা’ই সঠিক?সুখের মুখ দেখবে কি মুহতাসনিম?আতিক কেন’ই বা মুহতাসনিমের মতো সাধারণ একটি মেয়েকে বিয়ে করতে চাচ্ছে?সেটা যে মুহতাসনিমকে জানতেই হবে।তার জন্যে আতিকের সাথে কথা বলা খুব জরুরি!
~~~
ইমারজেন্সি রোগী দেখায় ব্যস্ত জাহিন।টেবিলের উপর ফোনটা অনবরত বেজে চলেছে।ধরবার সময় নেই!স্ক্রিনে মামণি লেখাটা ভেসে উঠেছে।মায়ের জন্য বড্ড টেনশন হয় জাহিনের।শরীর টা সবসময় ঠিক’ও থাকে না।কল না ধরেও পারে না।প্রায় আরও বিশ মিনিট পর ফ্রি হয়ে কল রিসিভ করে জাহিন।ব্যস্ত কন্ঠেই বলে,
” ঠিক আছো মামণি?
ওপাশ থেকে মলিন কন্ঠে জবাব আসে,
“হ্যাঁ।ডিস্টার্ব করে ফেললাম বাবা?
” একদম না।বলো কি বলবে?
“ডিস্টার্ব তো অবশ্যই হয়েছিস নয়তো ফোনটা এতবার বাজতে হতো না!যাই হোক সাধারণ মানুষের জন্যেই তোমার সব স্বপ্ন আশা আর মায়ের জন্যে বিন্দু মাত্র সময় নেই!খুব বড় ডাক্তার হও দোয়া করি।
” এসব কি বলছো মামণি?আমার সব তুমি!তুমি ছাড়া আর কি আছে আমার?
কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে নবনী,
“আনানের বিয়ের খবর শুনেছিস?
ছোট্ট করে বলে জাহিন,
” হুম।
“আরও একটা বিয়ের সুসংবাদ পাবি অপেক্ষা কর।
” কার বিয়ে মামণি?
“মুহতাসনিমের।খুব শিঘ্রই হয়তো খবর পাবি।
ওপাশ থেকে মৃদু হাসির শব্দ ভেসে আসছে,
” খুব ভালো তো!
“হ্যাঁ ভালোই তো হবে।মেয়েটা যোগ্য কাউকেই পাচ্ছে!যার কাছে সম্পর্কের মূল্য আছে!জীবনটাকে যে সত্যি বোঝে!আতিক ছেলেটা আসলেই খুব ভালো।
” সেটা সময় বলবে মামণি।
~~~
টিউশনি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে দাড়িয়ে আছে মুহতাসনিম।কালকের কথাগুলি তীব্রভাবে মাথায় ঝেকে বসে আছে।এখন আতিকের সাথে কিভাবে কথা বলবে?পাবে কোথায় লোকটাকে?হঠাৎ সামনে এসে দাড়ায় আতিক।বেশ খানিকটা চমকে যায় মুহতাসনিম!
“কাউকে খুঁজছিলেন মনে হচ্ছে!
” ন..না রিকশা খুঁজছিলাম।
“আমি গাড়ি নিয়ে এসেছি,কিছু মনে না করলে ড্রপ করে দিতে পারি।
” আসলে আপনার সাথে আমার কথা ছিল।
“হুম জানি।তা কোথাও বসে বলা যেতে পারে যদি আপনার সময় হয় তবে।
” ঠিকাছে।
~~~
কফিশপে মুখোমুখি বসে আছে আতিক আর মুহতাসনিম।জড়তা কাটিয়ে কথা বলতে পারছে না যেন মুহতাসনিম।বিষয়টা চক্ষুগোচর হয়নি আতিকের।মুহতাসনিমকে ইজি করতে সে’ই আগে কথা শুরু করলো,
“আপনি ভাবছেন তো হুট করে কেন আপনার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালাম?বিরক্ত ধরেছে বেশ আমার উপর?এটা স্বাভাবিক মিস মুহতাসনিম।কারণ আপনার কাছে অনন্ত একবার অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন ছিল তাই না?বা দুজন দুজনকে আরও একটু জানতাম,চিনতাম তারপরে’ই না হয় বিয়ের ভাবনাতে যাওয়া যেত!হয়তো এখন আপনার বাড়ির লোক আপনার উপর প্রেশার ক্রিয়েট করতে পারে আর আপনি একরাশ ঘৃনা নিয়ে আমায় বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলেন!
আতিকের দিকে তাকায় মুহতাসনিম।সত্যিই তার মনে এসব প্রশ্ন গুলো ঝেকে বসেছিল।স্বাভাবিক হয়ে বলে,
” দেখুন আমি শুধু জানতে চাই হঠাৎ আমাকে কেন বিয়ে করতে চাচ্ছেন?
কফিতে চুমুক দিয়ে পুনরায় বলে আতিক,
“একটা প্রশ্নের উত্তর সরাসরি দেওয়া যায় না,আগে আরও কিছু উত্তর খোলাসা করতে হয়।তার আগে আমি আমার মতো করে আগের উত্তর গুলি দেই!
চুপ করে বসে আছে মুহতাসনিম।
” প্রথমত আমি চাইলে দিনের পর দিন আপনার পেছনে পরে থাকতে পারতাম।নানাভাবে ইমপ্রেস করে হয়তো একটা সময় রাজিও করাতে পারতাম!হয়েছে কি এর কোনো টা করার’ই সময়,মানসিকতা,ইচ্ছে কোনোটাই নেই আমার।সবচেয়ে বড় কথা আমার ফ্যামিলিতে আমি আপনার কথা জানাই তারা নির্দিধায় রাজি হয়!বাকি হচ্ছে এখন আপনার পরিবার।মিনা আন্টিকেই চিনি আমি।এবং বিয়ের প্রস্তাব উনার কাছেই পাঠানো হয়েছে।এখানে আপনাকে কেউ জোড় করছে না মুহতাসনিম!যদি আপনার সাথে সারাজীবন থাকা আমার ভাগ্য থাকে তাহলে ভালোবাসা পরে’ও হবে।আর যদি বলতে চান কেন আপনাকে বিয়ে করতে চাই তবে বলবো,আপনার মতো সরল,স্নিগ্ধ হাসির মেয়ে আমার জীবনে দ্বিতীয়টি আমি দেখিনি!আমার মনে হয়েছে আপনার চেয়ে বেশি কেউ ভালোবাসতে পারবে না আমায়!শুনুন মুহতাসনিম আমি কথা দিচ্ছি আমাকে বিয়ে করলে আপনার জীবণে ভালোবাসার অভাব হবে না কখনও!
চুপচাপ আতিকের কথা শুনছে মুহতাসনিম।চমৎকার ভাবে কথার সব প্যাচ যেন খুলে দিয়েছে।তবে এখন মুহতাসনিম কি জবাব দেবে?ওয়েটার কে ডেকে বিল পরিশোধ করে আতিক।দাড়াতে দাড়াতে বলে,
“আজ উঠছি,ভাগ্যে থাকলে হয়তো আবারও কথা হবে।
টেবিলের উপর ছোট্ট কাগজ রাখে আতিক পরক্ষণে বলে,
” আমি অপেক্ষায় থাকবো আপনার উত্তরের।আসি।
আতিক বের হতেই কাগজ টা তৎক্ষনাৎ হাতে নেয় মুহতাসনিম।তাতে ফোন নম্বর লেখা!সেটা ব্যাগে ভরেই বাসার দিকে রওনা হয়।
~~~
আকাশে গুড়ুম গুড়ুম মেঘের শব্দ হচ্ছে!ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে মুহতাসনিম।রাতের আকাশটা মেঘেদের কারণে ধূরস ঘোলাটে রঙ ধারণ করেছে!মুহতাসনিমের আজ মনে হচ্ছে সত্যি কি জীবন কে একটা সুযোগ দেওয়া উচিৎ?আতিক কে নেহায়েত মন্দ লাগেনি!তবে ভালোবাসা টা কোথাও অনুভূত হচ্ছে না!যাই হোক জীবণকে আরও একটা সুযোগ না হয় দিয়েই দেখা যাক।
বড় করে দম ছাড়ে মুহতাসনিম।পরক্ষনে কাগজ থেকে এগারো সংখ্যার ডিজিট টা ফোনে তুলে নেয়।ডায়াল করার মুহূর্তে’ই কল বেজে উঠি!ভয়ানক চমকে উঠে মুহতাসনিম!জাহিন কল করেছে!তড়িঘড়ি করে রিসিভ করে মুহতাসনিম,
“ঘুমাচ্ছিলেন মিস মুহু?
চলবে…….
(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিযোগ্য)