মেঘবতীর_শহরে,পর্বঃ২২,২৩

0
507

#মেঘবতীর_শহরে,পর্বঃ২২,২৩
নাদিয়া ইসলাম সানজিদা
২২
,
,
শুনশান বাতাস বইছে।রেলিং ঘেষে ছাদে বসে আছে মুহতাসনিম।কানে এখনও ফোনটা জড়িয়ে ধরে আছে।ওপাশ থেকে আবার বলে উঠে জাহিন,

” ডিস্টার্ব করলাম মিস মুহু?

হৃদপৃন্ড প্রচন্ড গতিতে উঠানামা করছে।গলায় সব শব্দ যেন আটকে আছে।তবুও ছোট্ট করে জবাব দেয় মুহতাসনিম,

“না,

” ওহ,তাহলে আপনি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?

“বলুন।

” বলার জন্যে’ই তো কল করা।আমার হাতে এমনিতেও অতিরিক্ত সময় নেই!যা বলবো সোজাসুজি’ই।আচ্ছা মিস মুহু আমি যদি আপনাকে বলি বিয়েটা আপনি করবেন না!তাহলে আপনার মতামত কি হবে?

জাহিনের কথা শুনে ভিষণ আশ্চর্য হয়ে গেল মুহতাসনিম!কি বলতে চাইছে জাহিন?বিয়েতে রাজি হতে বারণ করছে সোজা?
কিন্তু কেন? মুহূর্তেই নানা প্রশ্নে মাথা ঝেঁকে বসেছে!কোনোদিক দিয়েই কোনোকিছুর হিসাব মিলাতে পারছে না মুহতাসনিম।আতিক কি মানুষ হিসেবে ভালো নয়?নাকি জাহিনের অন্য কোনো উদ্দেশ্য?নিজেকে সামলে বলল মুহতাসনিম,

“বিয়ে অব্ধি কথা এখনো এগোয়নি।তবে আপনি মত দিতে বারণ করছেন কেন আমায়?

ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে জাহিন,

” জীবন নিয়ে আরও একটাবার ভাবুন মিস মুহু।হতে পারে এ সিদ্ধান্ত’ই আপনার জীবন টা ভেঙে চুড়মার করে দিলো!জীবন টা সস্তা নয় মুহু!নিজের মতো করে’ও বাঁচা যায়!

মুহতাসনিমের এবার ভয় লাগতে শুরু করেছে!কিসের ইঙ্গিত দিতে চাচ্ছে জাহিন।এ বিয়েটা তার জীবনে ভয়ানক পরিনতি ডেকে আনবে না তো?!!শুকনো ঢোক গিলে বলে মুহতাসনিম,

“দেখুন যা বলার সোজাসাপটা বলুন?এভাবে কথার প্যাচে রেখে দিবেন না।

” আমি তো প্যাচ রাখছি না মুহ!সোজা’ই বললাম আপনাকে।জীবন আপনার আর সিদ্ধান্তও আপনার!আমি শুধু পথ দেখিয়ে দিতে পারি।

মুহতাসনিম এবার খানিক বিরক্তি নিয়েই বলল,

“কি বলতে চাইছেন?আতিক সাহেব ভালো নয়?নাকি অন্য কোনো কারণ?

” আতিক ছেলে হিসেবে যথেষ্ট ভালো এবং ভদ্র!তবে হয়েছি কি মুহু মানুষের মন বদলাতে সময় নেয় না।

মুহতাসনিমের রাগ এবার চরম পর্যায়ে!

“দেখুন এভাবে ঘোলাটে কথার মানে কি?আতিক যদি ভালোই হয় তবে বিয়ে করতে আপত্তি কোথায়?খুব সুখেই থাকবো আমি!

“হুম,কিন্তু বিয়ে ছাড়াও জীবন পাড় করা যায় মুহু।আপনি বিয়ে করলেন দেখা গেল আপনি যেমন টা চেয়েছিলেন তেমন টা হলো না আপনার সাথে!মানুষকে বাইরে থেকে বোঝার কোনো উপায় নেই মুহু!ভেতরে কঠিন এক অন্য রূপ থাকে!

” দেখুন একটা পবিত্র সম্পর্ক নিয়ে আপনার এভাবে বলা উচিৎ নয়।আর আমি যে বিয়ে করলে সুখি হবো না কে বলল আপনায়?

কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল জাহিন,

“তাহলে আপনার মিনা খালা আজ সুখি নয় কেন?সে কেন সংসার করতে পারলো না?তার পরিবার নিশ্চয়ই ভালো দেখে’,ই কারো হাতে তুলে দিয়েছিল!

” তা’ই বলে সবা’ই কে এক ভাবে দেখবেন নাকি আপনি?আর যারা দিব্যি সংসার করছে তারা?তাদের কে চোখে পরে না আপনার?আর মিনা খালা সত্যিকারের ভালোবাসার সম্মান রেখেছে ডাক্তার সাহেব।চাইলে মিনা খালা অন্য জায়গায় বিয়ে করে সংসার করতে পারতো!সে কিন্তু তা করেনি।বরং যে মিনা খালাকে বিয়ে করেছিল সে তো খালার যোগ্য’ই ছিল না!তবুও ওই অযোগ্য মানুষটাকে এক তরফা ভালোবেসে যাচ্ছে এখন অব্ধি!আর ভালোবাসা কে সম্মান দেওয়া বা ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের মতো করে সারাজীবন ভালোবাসা,জীবন কে অসম্পূর্ণ রাখে না ডাক্তার সাহেব!বরং তাতেই এক তৃপ্তিকর সুখ নিহিত!আমার ভাগ্যে যদি এমন টাই লেখা থাকে তবে আমিও ধন্য।এতে কোনো কষ্ট, লাঞ্চনা বা আফসোস নেই!

জাহিন নিশ্চুপ হয়ে মুহতাসনিমের কথা শুনে যাচ্ছে।

“যার কাছে সম্পর্ক,ভালোবাসার মূল্য আছে তাদের কাছে জীবন অন্যরকম!এতকিছুর পরোয়া করে জীবনকে ভালো কিছু দিতে পারবেন না।আপনি জানেন কি ডাক্তার সাহেব, আপনি একজন স্বার্থপর ব্যাক্তি!যে শুধু নিজের দিকটা বিবেচনা করে!অপরের ভালোবাসা আর সম্পর্কের কোনো মূল্য নেই আপনার কাছে!দিনশেষে আপনার মতো ব্যাক্তিরা’,ই অপরকে কষ্ট দিয়ে দিব্যি ভালো থাকে! আপনার চোখে যারা ঠকে গিয়েও অসম্পূর্ণ জীবন নিয়ে একা কাটিয়ে দেয় আসলে তারা’ই হচ্ছে প্রকৃত স্বার্থহীন ব্যাক্তি!তাদের জন্যেই ভালোবাসা এখনও টিকে আছে এবং ভালোবাসা এত সুন্দর!

মুহতাসনিমের কথা শেষ হতেই জাহিন বলল,

” নিজে ঠকে গিয়ে এমন ভালোবাসার কি দরকার?অপরপাশের মানুষটা তো দিব্যি ভালো থাকে!স্বার্থলোভী কি তারা নয়?দিনশেষে আপনি ভালোবেসে কি পাবেন?আমার তো মনে হয় দরকার নেই এমন ভালোবাসার মুহু!

জাহিনের কথা সত্যি’ই বিরক্ত ধরাচ্ছে মুহতাসনিমকে।সম্পর্ক টাকে সহজ করে দেখতে চাইছে না জাহিন।যেখানে একটা মানুষের জীবটা সম্পূর্ণ হয় একটা মিষ্টি সুন্দর সম্পর্কেের মাধ্যমে!হয়তো দু একজন ঠকে যায় দিনশেষে তবে এটাকে কখনই ঠকে যাওয়া বলে না!বরং ঠকে গিয়েও ভালোবাসা জিতে যায়!

“আপনার দরকার না’ও পরতে পারে এমন ভালোবাসার।নিজের ভাবনার জগৎ টা নিজের কাছে’ই রাখুন।তবে একদিন আপনাদের এই ভ্রান্ত ধারণা বদলাবে।

ওপাশ থেকে তাচ্ছিল্যের হাসি শোনা যাচ্ছে।

” কখনও কখনও বহুবছর পাড় হয়ে যায় তবুও অনেক কিছু বদলায় না মিস মুহু।বরং দিনের পর দিন কষ্ট বেড়ে চলে!আর তাতে নতুন করে কষ্ট যোগ করতে হয় না!

মুহতাসনিম আর একটাও কথা শুনলো না।চট করেই লাইন টা কেটে দিলো।এমন মানুষের কথা না শোনা’ই ভালো।হুট করেই জাহিনের লাগানো গাছগুলোর দিকে দৃষ্টি থমকে যায় মুহতাসনিমের।কয়েকটা গাছে মাত্রই ফুল ফুটেছে!মৃদু বাতাসে নেতিয়ে পরা ফুল গুলো গাছ সমেত নড়ছে কেমন!গভীর দৃষ্টি নিয়ে মগ্ন হয়ে থাকে মুহতাসনিম!পরক্ষণে ভাবে ওমন পাথুরে মনের মানুষটা ফুল কে ভালোবাসলো কি করে?তারপর মিনমিনে বলে,এই ফুল গুলো আজ থেকে আমার!জগতে পাথুরে মানুষদের জন্য কঠোরতা ছাড়া আর কিচ্ছু নেই!সব কিছুর অযোগ্য তারা।

~~~

ফোন টা অন করতেই খেয়াল করে রাত প্রায় দুটো বাজতে চলেছে!আতিককে তো ফোন’ই করা হয়নি।এত রাতে ফোন করা উচিৎ হবে? কি মনে করে কল করে বসলো মুহতাসনিম।দুবার রিং বাজতেই কল রিসিভ করলো আতিক।ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল,

“এতক্ষণ যাবৎ অপেক্ষা করিয়ে এখন তাহলে কল করার সময় হলো?

মুহতাসনিম স্পষ্ট বুঝতে পারছে আতিক ঘুমিয়ে ছিল।কাঁচা ঘুমটা ভেঙে দিয়ে নেহাৎ অপরাধই করেছে।তারচেয়ে অবাক হয়েছে আতিক কিভাবে বুঝলো মুহতাসনিম কল করেছিল?আমতা আমতা করে বলল,

” আমি বোধহয় আপনার ঘুমটা নষ্ট করে দিলাম আতিক সাহেব।

“ও কিছু না।তা কেমন আছেন?

” আলহামদুলিল্লাহ ভালো।আপনি?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল আতিক,

“এতক্ষণ একটুখানিও ভালো ছিলাম না!বিশ্বাস করুন এখন অনেকটা ভালো আছি।

আতিকের কথায় খানিক লজ্জা পেল মুহতাসনিম।কথা ঘুরাতে বলল,

” আচ্ছা আপনার পরিবারে কে কে আছে?আমি আসলে কিছুই জানি না তাই জিগ্যেস করছি।

মৃদু হেসে বলে আতিক,

“আচ্ছা এতরাতে তবে আমার বায়োডাটা জানতে কল করা?আমি অবশ্যই বলছি আমার কোনো আপত্তি নেই!আমার পরিবার টা বাবা,মা আর ভাইকে নিয়ে।ভাই টা ছোট এবার ক্লাস টেনে পড়ছে।আর আমার সম্পর্কে তো আপনি জানেনই।

” আমি তো আপনাকে সেভাবে জানি না।

“বুঝতে পেরেছি আমার পেশা সম্পর্কে জানতে চাচ্ছেন।সময় কত পরে আছে মুহতাসনিম পরেও তো ধীরে ধীরে জানা যাবে।তা কি করছেন এখন?

” কিছু বিষয় মূখ্য থাকে আতিক সাহেব।যেটা জানা আবশ্যক।

“যদি বলি আপনাকে তিন বেলা খাওয়ানো আর পরানোর মতো সামর্থ্য আমার আছে?

” কথা সেটা নয়।আপনি তো আমার ব্যাপারে কিছুই জানেন না!আমার উচিৎ আপনাকে জানানো এটা আবশ্যক।

“আমি কিছুই জানতে চাই না মুহতাসনিম।তবে শেষ অব্দি আমার সাথে থেকে যাক এমন একজন হলে’ই হবে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে মুহতাসনিম,

” তবে আপনার ব্যাপার গুলিও অজানা রাখতে চাইছেন?

চট করেই বলে আতিক,

“এমা একদম নয়!ভুল বুঝছেন আপনি।আমি পেশায় এডভোকেট।দেখুন মুহতাসনিম আপনি আর একটা কথাও ভাববেন না।আমি ইচ্ছে করেই বলতে চাইনি।প্লিজ এ নিয়ে আর কথা না বাড়াই আমরা।

মুহতাসনিম একদম নিস্তব্ধ হয়ে আছে।আতিক এত উচ্চপদের ভাবতে পারেনি!তার সাথে নিতান্তই বেমানান মুহতাসনিম।শুধু বেমানান নয় ববং বড্ড বেশিই বেমানান!যে কোনো ভালো ঘরের মেয়ে পাওয়া আতিকের জন্য পান্তভাত!তবে মুহতাসনিমের জন্যে পরে আছে কেন লোকটা?মুহতাসনিম কে চুপ থাকতে দেখে বলল আতিক,

” বলেছি না অন্য কিছু ভাববার দরকার নেই মুহতাসনিম।দেখুন আমি মানুষ চিনতে খুবই কম ভুল করি।তবে আপনাকে যে পূর্ণরূপে চিনবে মুহতাসনিম সে আপনার থেকে কখনই দূরে যেতে চাইবে না।আপনার মধ্যে আলাদা এক মায়াশক্তি আছে।আমি সেটা আরও কাছ থেকে জানতে চাই।আর যেদিন আপনার ভালোবাসা আমি পেয়ে যাবো সেদিনই আমার জীবন সার্থক হবে।

আনমনা মুহতাসনিম বলল,

“আপনি ভালোবাসা,সম্পর্ক বলতে কি বোঝেন আতিক সাহেব?

কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল আতিক,

” দেখুন যেখানে ভালোবাসা থাকে না সেখানে সম্পর্কের প্রশ্ন’ই আসে না।আপনি একতরফা ভাবে কোনো সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখতে পারবেন না।কিন্তু একতরফা শুধু ভালোবেসে যাওয়া যায়।আর ভালোবাসা বলে বোঝানোর মতো কিছু নয়।তবে ভালোবাসা কে পূর্ণতা দেয় সম্পর্ক।

“তাহলে জগতে বিচ্ছেদ হয় কেন আতিক সাহেব?দুজন মানুষ একত্রে ভালোবাসা না নিয়ে একটা সম্পর্কে কেন যায়?

” বললাম না এক তরফা কোনোকিছু টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।আর যারা একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তুলেও বিচ্ছেদে যায় তাদের মাঝে কখনই প্রকৃত ভালোবাসা ছিল না।তবে একটা মজার বিষয় কি জানেন মুহতাসনিম?দুজনের বিচ্ছেদ হলেও একজনের মনে অপরজনের প্রতি ঠিক’ই গভীর ভালোবাসা থাকে।তবুও বিচ্ছেদ হয়!কারণ সেই মানুষটা একটা সময় ব্যর্থ হয় অপরপাশের ব্যক্তিকে বোঝাতে!সবকিছু জোড় করে হলেও ভালোবাসা কখনও জোড় করে হয় না,আর যেখানে ভালোবাসা থাকে না সেখানে সম্পর্ক টা কিভাবে টিকবে বলুন?আর একটা ভুল মানুষকে অঢেল ভালোবাসা দিয়ে একটা সম্পর্কের মাঝে টেনে আনা বোকামি।আর জগতে সেই বোকা মানুষগুলই ঠকে যায় একসময় আর তার পরিণাম হয় বিচ্ছেদ!

“আপনি যে আমায় বিয়ে করতে চাচ্ছেন যদি একটা সময় আপনিও ব্যর্থদের তালিকাভুক্ত হোন?আমি যদি আপনাকে ভালোবাসতে না পারি?তাহলে কি এই মুহূর্তে আমাদের সম্পর্কে যাওয়া ঠিক হবে?

চলবে…………

#মেঘবতীর_শহরে
পর্ব-২৩
নাদিয়া ইসলাম সানজিদা
,
,

টুকটুকে লাল পাড়ের হলুদ বর্ণের শাড়ি গায়ে জড়িয়ে বসে আছে মুহতাসনিম!আশেপাশে কত লোক,অবশ্য তাদের মধ্যে মুহতাসনিমের অতি আপন আর চেনা মুখ বলতে মিনা খালাই আছে।আরও কয়েকটা মুখ অবশ্য চোখের দেখায় চেনা যাকে বলে।

হাত দুটো একবার চোখের সামনে মেলে ধরে মুহতাসনিম।মেহেদী রাঙ্গা হাত দুটোর মাঝে কি সুন্দর করে ইংরেজিতে আতিক লেখা!লেখাটার জন্যে যেন আরও বেশি চমৎকার লাগছে হাতজোড়া!এই মানুষটার জন্যেই কি তবে মুহতাসনিমের জন্ম?অনুভূতি গুলো আজ অন্যরকম মনে হচ্ছে!শত কষ্ট আর অবহেলিত জীবনে এবার বুঝি একটুকরো সুখের সন্ধান পেল মুহতাসনিম।আনন্দে চোখ জোড়া সিক্ত হয়ে গেল!

সেদিন রাতে আতিকের বলা কথাগুলো মনে পড়লো,

“ধরে নিন কখনও কখনও মানুষ ব্যর্থদের তালিকায় থাকাটাও স্বার্থক মনে করে।আচ্ছা মুহতাসনিম এবার বলুন তো,আমাকে ব্যর্থদের তালিকায় রেখে আপনি স্বার্থকতা কোথায় খুঁজতে যাবেন?একটা ভাঙা চোরা মন টাকে নিপুণ হাতে যে গড়ে তোলে তার তো ব্যর্থ হবার প্রশ্নই আসে না!আপনার চোখে অনেক অব্যক্ত তিক্তযুক্ত গল্প লুকিয়ে আছে!আমি সেগুলো শুনতে চাই মুহতাসনিম তবে এখন নয় সময় হোক!

বাকরুদ্ধ হয়ে আতিকের কথা শুনছে মুহতাসনিম।মানুষকে চেনার এক আশ্চর্য ক্ষমতা নিয়ে মনে হয় জন্মেছে লোকটা!চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে মুহতাসনিমের।ধরা গলায় কিছু বলতে যাবে তার আগেই আতিক পুনরায় বলে,

“আমার অনুমান কি ভুল হয়েছে?আসলে কি জানেন মুহতাসনিম যে যাকে মন থেকে চায় বা ভালোবাসে তার ভেতর বাহির খুব সহজেই পড়া যায়!আপনার মুখে হাসি থাকলেও আপনার চোখ দুটো নিষ্প্রাণ থাকে সবসময়!আর হাসির মাঝেও যার চোখ হাসে না সেটাকে হাসি বলে গন্য করা যায় না।সেদিন সোডিয়াম আলোয় আপনার প্রানখোলা হাসি আমি দেখেছি তবে চোখ দুটো নিশ্চুপ ছিল!

ধরা কন্ঠে বলে মুহতাসনিম,

” আমার পরিবার……

কথা মাঝপথে থামিয়ে দেয় আতিক,

“আহা!বলেছিতো শুনবো তবে এখন নয়!আবেগ কে ধরে রাখতে শিখুন।এভাবে প্রকাশ করে ফেলবেন না।

মুহতাসনিম ভাবছে আতিক কে অবিশ্বাস করার কোনো মানেই হয় না!এই লোকটাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেওয়া যায় না!লোকটা একদিন ঠিক তার ভালোবাসা আদায় করে নিবে!

” চুপ করে আছেন যে?

মৃদু কন্ঠে বলল মুহতাসনিম,

“এবার কোনো সংশয় নেই আমার।আমার জীবন থেকে ব্যর্থ শব্দটাই মুছে দিবো আমি।

শব্দ করে হাসে আতিক।টুক করে ফোনটা কেটে দেয় মুহতাসনিম।বিশাল আকাশ টা আজ বড্ড সুন্দর লাগছে বড্ড!

মিনা বেগমের ডাকে ঘোর কাটে মুহতাসনিমের।

” তোর শশুড় বাড়ি থিকা তোর দেবর আসছে মুহু।

ততক্ষণে একটা ছেলে এগিয়ে আসে।হাস্যজ্জোল মুখ নিয়ে মুহতাসনিম কে বলে,

“কেমন আছেন হবু ভাবী?

পাল্টা ঠোঁটে একটুখানি হাসি নিয়ে জবাব দেয় মুহতাসনিম,

” ভালো।আপনি ভালো আছেন?

“উফফ ভাবী আমি আপনার জুনিয়র প্লিজ তুমি করে বলবেন।

” আচ্ছা।

“ভাইয়ার জোরাজুরিতে আসতে হলো।এখন ফটাফট আপনার কয়েকটা ছবি তুলে নিয়ে যাবো।ভাইয়া দেখতে চেয়েছে।অবশ্য এই কথাটা আপনাকে বলতে নিষেধ করেছে!আর দেখুন কেমন রাজাকারের মতো কাজ করলাম আমি!

বলেই শব্দ করে হাসে আতিফ।লজ্জায় চুপ করে আছে মুহতাসনিম।পকেট থেকে ফোন বের করে স্ক্রিন অন করে মুহতাসনিমের চোখের সামনে ধরে আতিফ।চোখ পড়তেই মুহূর্তেই চোখ নামিয়ে নেয় মুহতাসনিম।

” ভাইয়াকে সুন্দর লাগছে না ভাবী?

কথার প্রসঙ্গ পাল্টায় মুহতাসনিম,

“বাসার সবাই ভালো আছে?

আতিফ দাঁড়িয়ে মুহতাসনিমের ছবি তুলতে তুলতে জবাব দিলো,

” হ্যাঁ ভালো আছে।আমাদের বাসায়ও ছোট করেই হলুদের অনুষ্ঠান হচ্ছে।

মুহতাসনিমের কপালে খানিকটা হলুদ লেগে আছে। মুছার জন্যে হাত উদ্যত করতেই,আতিফ বলে,

“মোছার দরকার নেই ভাবী।এভাবেই একদম বউ বউ লাগছে!

হঠাৎ মুহতাসনিমের ফোনটায় ম্যাসেজ টোন বেজে উঠে!ম্যাসেজ ওপেন করে দেখে আতিকের ম্যাসেজ।

” আমি কিন্তু আতিফকে পাঠায়নি মুহতাসনিম।বিচ্ছুটা নিশ্চয় উল্টাপাল্টা কিছু বলেছে?ওসব কথা কানে নিবেন না।আর হ্যাঁ আজকে ছবিতে যেন আপনার চোখদুটো হাসে!”

ফোনটা রাখতেই মুচকি হাসে মুহতাসনিম।আতিক তো নিজের কথায় নিজেই ফেঁসে গেল!

~~~

বাড়ির মেইন গেইটে আসতেই থমকে দাঁড়ায় জাহিন!বাড়িটা সামান্য লাইটিং করে সাজানো হয়েছে!জাহিন যতদূর জানে আনানের বিয়ে আরও পাঁচদিন পর!তবে বাড়ির পরিবেশ এমন কেন?হুট করেই আজকে ফিরেছে জাহিন ছুটি পেয়েছে সবে মাত্র দুটোদিন আর তাতেই বাড়িতে চলে এসেছে।

তড়িঘড়ি করে বাড়ির ভেতর চলে আসে জাহিন।উপর থেকে শায়লা বেগম আর রিতা একসাথে নামছেন।তাদের সাজসজ্জাও পরিবর্তন!জাহিনকে দেখে তারাও বেশ অবাক হয়!শায়লা বেগম প্রশ্ন করে বসেন,

“আরে জাহিন!কখন এলে?নবনী তো কিছু বলল না তুমি যে আসবে?

কোনো কথা কর্ণপাত না করে পাল্টা প্রশ্ন ছোড়ে জাহিন,

“বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠান আছে মামী?

রিতা খানিকটা মুখ ব্যাকা করে বলে,

“আরে আমাদের মিনা খালার ভাগ্নির বিয়ে।খুবই সামান্য আয়োজন হয়েছে বুঝলে?আমাদের বাড়ির অনুষ্ঠান এখানে হবে নাকি?আনানের বিয়ে হবে নামিদামী কমিউনিটি সেন্টারে!

বাকি আর কোনো কথা শোনে না জাহিন হেটে চলে যায়।

জানালার ধারে বসে আছে নবনী।পেছন থেকে ডেকে উঠে জাহিন,

” মামণি?

চকিতে ফিরে তাকায় নবনী!জাহিনকে দেখে তিনি অনেক চমেকেছেন!তবে কি মুহতাসনিমের বিয়ের খবর পেয়ে এসেছে জাহিন?মুহূর্তে নানা প্রশ্ন ঘুরতে থাকে মাথায়!

“তুই?!হুট করে আসলি যে?কোনো খবরও তো দিসনি!

” সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম মামণি।

ছোট্ট করে ‘ওহ’ বলে নবনী।মনটা আজ তার বড্ড ভার হয়ে আছে।মিনা অনেক জোর করার পর একটুখানি হলুদ লাগিয়ে এসেছিল মুহতাসনিমকে।ভেতরটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছিল যেন!মেয়েটা বড্ড মায়াবী!চোখে মুখে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না!মায়াজালে আটকে নেয় কেমন!

“আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি মামণি।

” হুম।

দরজার সামনে থেকে পুনরায় ফিরে আসে জাহিন।কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলে,

“মিস মুহুর যে আজ বিয়ে আমাকে তো বললে না মামণি?

ছেলের দিকে তাকায় নবনী।খানিকটা রাগ নিয়ে বলে,

” বললে কি হতো?দাওয়াত খেতে আসতে?এখন তো এসেই গেছো খেয়ে নিও।

পাল্টা আর কথা বাড়ায় না জাহিন।চলে যায়।

~~~

আসতে আসতে মানুষ কমতে থাকে।মিনা খালা কোমড়ে আঁচল গুজে আজ কাজে নেমেছেন।যেন তার নিজের মেয়ের বিয়ে।

শাড়ি পরেই ছাদের কোণ ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে মুহতাসনিম।আজকে বোধহয় ভরা পূর্নিমা!হাতদুটোর মেহেদী কেমন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে!ফ্রী হয়ে মুহতানিমকে কল দেয় মুহতাসনিম।
তার বিয়ের ব্যাপার টা শুধু মুহতানিম জানে।ফোন একবার বাজতেই রিসিভ হয়ে যায়!

“এতক্ষণে কল দেওয়ার সময় হলো আপু?আমি কখন থেকে অপেক্ষা করছিলাম!ইশশ আমারও না থাকতে ইচ্ছে করছিল জানিস আপু!কি রঙের শাড়ি পড়েছিস রে আপু?

ঝাপসা চোখদুটো শাড়িতে বুলায় মুহতাসনিম।ভাঙা কন্ঠে বলে,

“লাল পাড়ের হলুদ শাড়ি।

” কাঁদছিস কেন আপু?আজকের দিনে কেউ কাঁদে?একদম কাঁদবি না!জানিস আমার কত আনন্দ হচ্ছে?আজকে রাতে তো ঘুমই হবে না!আপু,আপু দেখতে আকাশে তারা দেখা যাচ্ছে কিনা?

আকাশে তাকায় মুহতাসনিম।ঝলঝল করছে একটি তারা!তারও পাশে অজস্র তারা!

“হুম তারা আছে।

” তুই ভাববি আমি তারা হয়ে দেখছি তোকে!আচ্ছা আপু তুই তো জিজুর একটা ছবিও দিলি না!

“দেবো তো!একসাথে ছবি তুলে দিবো।
” আচ্ছা আচ্ছা।আমি অপেক্ষায় রইলাম!আচ্ছা তোর শশুড় বাড়িতে কে কে আছে?

“এখনও বিয়ে হয়নি মুনা!শশুড় বাড়ি বলা বন্ধ কর।উনার মা,বাবা,আর ছোট একটা ভাই আছে।

” তাদের দেখেছিস তুই?

“হুম।আমাকে আংটি পরিয়ে দিয়ে গিয়েছিল আতিকের বাবা মা।কি অমায়িক ব্যবহার!আমাকে অযথা কোনো প্রশ্নই করেনি জানিস।শুধু বলেছে এবার আমার একটা মেয়ে হবে!আগে শুধু দুটো ছেলে ছিল!

” আমাদের কথা জানে তারা?

“না,তবে আমি বলতে চেয়েছিলাম আতিক শোনেনি।তাই তো অনুষ্ঠান খুব ছোট করেই হচ্ছে।একদম ঘরোয়া।যেহেতু আমার পরিবারের কেউ নেই!

” তোর ভাগ্য খুব ভালো রে আপু!

“শোন না বলছি বাবা ব্যবসাটা সামলাতে পারে তো?আমার কথা কিছু বলে?

মিনমিনে কন্ঠে বলে মুহতানিম,

“না আপু।তোর কথা বাড়িতে উঠেই না।

টুক করে লাইনটা কেটে দেয় মুহতাসনিম।আর একটুখানি কথা বললে কষ্ট গুলো বাধ মানবে না।অশ্রু হয়ে নেমে আসবে!

দূর থেকে ডেকে উঠে মিনা বেগম,

” আরে মাইয়া ঘরে আইসা হাতমুখ ধুইয়া একটু ঘুমা।কালকেই তো বিয়ে এত রাইত জাগিস না।

কোনো কথা’ই কর্নপাত হয় না মুহতাসনিমের।হঠাৎ পাশ থেকে কেউ ডেকে উঠে,

“মিস মুহু?

চমকে তাকায় মুহতাসনিম!জাহিন দাঁড়িয়ে আছে।আবছা আলোয় পকেটে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে জাহিন।চুল গুলো বাতাসে দোল খেয়ে কপালে ঠেকেছে!চোখদুটো ভিষণ বিষন্ন লাগছে!ঠোঁটের কোণে একটুখানি হাসি!তবুও কোথাও যেন মনে হচ্ছে চোখ দুটো হাসছে না!

” কংগ্রাচুলেশন মুহু!

ছোট্ট করে উত্তর দেয় মুহতাসনিম,

“ধন্যবাদ।

ধ্যানমগ্নে তাকিয়ে থাকে জাহিন।হলদা বর্ণের শাড়িটা যেন মুহুর গায়ের হলুদ বর্ণের সাথে মিশে গেছে!মাথায় বড়সড় খোপা!হাতভর্তি চুড়ি!অসম্ভব সুন্দর লাগছে মুহতাসনিমকে!

সেদিন মুহতাসনিমের বলা কথা মনে পড়ছে জাহিনের।মুহুর তর্কের কাছে কিছুটা দমে গিয়েছিল সেদিন! ‘

‘সত্যিই কি একতরফা ভালোবেসে স্বার্থক হওয়া যায়?’

” আতিক কে খুব ভালোবাসেন তাই না মুহু?

চলবে………

(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিযোগ্য)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here