#মেঘবতীর_শহরে,পর্বঃ২৬,২৭
নাদিয়া ইসলাম সানজিদা
২৬
,
সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে মুহতাসনিম কে খুৃজঁছে মিনা বেগম।আনান মিনা বেগমকে দেখতে পেয়েই ছুটে এসেছে।
“মিনা আন্টি আপনি কি মুহতাসনিম কে খুঁজছেন?
বিচলিত মিনা বেগম বলেন,
” তুমি দেখছো তারে?
আমতা আমতা করে বলে আনান,
“আসলে মুহতাসনিম নাকি সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিল।জাহিন একটু আগে কল করে জানালো।চিন্তা করতে নিষেধ করেছে।এদিকে জামেলা না থাকলে আমি আপনাকে নিয়ে যেতাম হসপিটালে।
ভয়ার্ত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে মিনা বেগম।মেয়েটা এমনি একবার জ্ঞান হারিয়েছে।খুব বাজে কিছু যদি হয়ে যায়?ভাবতেই অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল মিনা বেগমের!
~~~
মুহতাসনিমের মাথার কাছে বসে আছে জাহিন।পাশে অজ্ঞাত অবস্থায় শুয়ে আছে মেয়েটা।শরীর প্রচন্ড রকমের দূর্বল তার উপর মেন্টালি চাপ টা নিতে পারেনি।যতক্ষণ পর্যন্ত না মুহুর জ্ঞান ফিরছে টেনশন কিছুতেই মাথা থেকে নামবে না জাহিনের।এদিকে আতিকের জানাজায়ও সামিল হতে পারেনি জাহিন।মুহুর টেনশনে ক্ষনিকের জন্যে পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল যেন।
ঘড়ির কাটা রাত দশটা ছুঁয়েছে।চোখ ভিষণ রকম জ্বালা করছে জাহিনের।কালকে তাকে চলে যেতে হবে আবার ডিউটিতে,সে ভাবনাটাও মাথায় ঘুরছে।খানিক নড়ে পিটপিট করে তাকায় মুহতাসনিম।আশপাশ টা চোখ বুলিয়ে নেয়।দেখতে পেয়েই তৎক্ষনাৎ বিচলিত হয়ে দাড়ায় জাহিন!!
” মুহু এখন কেমন লাগছে?!!
মাথাটা প্রচন্ড ভার হয়ে আছে মুহতাসনিমের।কিছুক্ষণ আগের কথা মনে পড়লো।শরীর সত্যিই ভিষণরকম অসার লাগছে।পাল্টা আবারও জিগ্যেস করে জাহিন,
“মুহু শরীর উইক লাগছে?আর ইউ ওকে?
জাহিনের দিকে পূর্ণদৃষ্টি মেলে তাকায় মুহতাসনিম।মুখ চোখ শুকিয়ে এইটুকুন হয়ে আছে।মলিন মুখে জিগ্যেস করে মুহতাসনিম,
” আতিক সাহেবের কি দাফন হয়ে গেছে?
চোখ বুজে তাকায় জাহিন।দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“অনেক্ক্ষণ আগেই।প্লিজ এ নিয়ে আর টেনশন করবেন না মুহু।আপনার শরীরে মারাত্মক প্রভাব পরবে।
মাথা নিচু করে মেঝেতে তাকিয়ে আছে মুহতাসনিম।জাহিন ভাবছে মানুষ কতটা ভালোবাসলে এতটা অসহায় হতে পারে?মেয়েটার চোখ মুখে তাকানো পর্যন্ত যাচ্ছে না!কষ্টের ভারে আড়াল হয়ে গেছে সেই চঞ্চল মুখখানি!
” মুহু আমি খাবার নিয়ে আসছি বাহির থেকে।আপনি থাকুন।কিছু দরকার হলে নার্সকে ডাকবেন।
শুকনো গলায় জবাব দিলো মুহতাসনিম,
“ক্ষিদে নেই!
” ক্ষিদে না থাকলেও খেতে হবে।নয়তো উঠে দাঁড়াতেই পারবেন না আপনি।
“বললাম তো খাবো না আমি।
কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলে জাহিন,
” আমারও কিন্তু কিছু খাওয়া হয়নি মিস মুহু! আপনি না খেলে আমারও খাওয়া হবে না।
মেঝে থেকে দৃষ্টি তুলে পুনরায় জাহিনের পানে তাকায় মুহতাসনিম।হঠাৎ পকেটে থাকা ফোনটা বেজে উঠে জাহিনের।হাতে নিতেই দেখে
স্ক্রিনে ‘Maa moni’ নাম টা ভেসে উঠেছে।
“হুম মা মণি বলো?
” মুহতাসনিম কেমন আছে এখন?
মুহুর দিকে একবার তাকায় জাহিন।পরক্ষণে বলে,
“বেটার।তুমি কি করে জানলে মিস মুহু যে অসুস্থ?
” মিনা খালা বলল সব আর তোকে কল করতেও বলল।আনান তো মাত্রই বাড়িতে পৌছে দিয়ে তারপর আবার হসপিটালে গেলো।
“এখানে আসছে আনান?কিন্তু আমি তো বলিনি কোন হসপিটালে আছি আমরা!
” না,আসলে আনান তো আতিকের বাবাকে দেখতে হসপিটাল যাচ্ছে।ভদ্রলোক নাকি হার্ট অ্যাটাক করেছেন।কি আর বলবো বাবা,এমনও কঠিন দিন দেখতে হয় মানুষকে!
চুপ করে কেবল মায়ের কথা শুনছে জাহিন।চোখ দুটি আপনাআপনি ঝাপসা হয়ে এসেছে।সন্তান হারানো শোক একটা পিতাকে হৃদয়ে ঠিক কতটা আঘাত করলে এমন হয়!নিশ্চয়ই ভদ্রলোক সন্তান হারানো কষ্ট সইতে পারেননি!নিজের বাবার কথা বড্ড মনে পরছে জাহিনের।কোনোদিন তো একটা খোঁজ পর্যন্ত নেয়নি লোকটা!আদৌ তারা মা,ছেলে বেঁচে আছে কিনা সে খোঁজ টাও নেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না!আশ্চর্য অথচ তিনিও একজন পিতা!আতিকের পিতার সাথে নিজের পিতার বিস্তর তফাত পেলো জাহিন।জগতে নাকি স্বার্থ ছাড়া বাবা,মা’ই ভালোবাসে।যে ভালোবাসা সন্তানের জীবনকে স্বার্থক করে!কই জাহিন তো স্বার্থক হতে পারেনি!
নবনী ফোনের ওপাশ থেকে একনাগাড়ে হ্যালো,হ্যালো বলতে থাকে।
“হ্যালো জাহিন?শুনতে পাচ্ছিস বাবা?তোরা বাসায় ফিরবি কখন?
লাইনটা টুক করে কেটে দেয় জাহিন।ঠায় নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে মুহতাসনিম।আচমকা মুহতাসনিম কে প্রশ্ন করে বসে জাহিন,
” আপনি তো আতিক কে ভালোবাসেন তাই না মুহু?আতিক চলে গেছে তাতে কি?আতিক তো স্বার্থক তাই না?
মুহতাসনিমের কোনো হেলদোল নেই।নিজের মতো করে ভাবণায় ডুবে আছে।এক চোখ থেকে টুপ করে জল গড়িয়ে পরে জাহিনের।কষ্টেরা গলায় আটকে আছে কেমন!পুনরায় আবার বলে জাহিন,
“জানেন মুহু আমার শহরে স্বার্থক বলতে কোনো শব্দ নেই!
বলেই বেরিয়ে যায় জাহিন।জাহিনের যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকে মুহতাসনিম।কেন জানি জাহিনকে বড্ড পাথুরে রক্ত মাংসহীন একটা প্রাণ মনে হয়!
~~~
বাসায় ফেরার পর থেকে জানালার কাছে বসে আছে মুহতাসনিম।জাহিন বার বার করে বলে গেছে পূর্ন বিশ্রাম নিতে।ফেরার সময় দাঁড়ানোর শক্তিটুকুও ছিল না মুহতাসনিমের।ফের কোলে তুলে নিয়ে আসে জাহিন।
মিনা বেগম খাবার প্লেট নিয়ে বসে আছে,
“, একটু খাইয়া নে মাইয়া।শরীর তো আর চলবই না।
” খেতে ইচ্ছে করছে না খালা।
“জাহিন বাবা বার বার কইরা বইলা গেছে তোরে খাওয়াইতে তারপর ওষুধ দিতে।অনেক বার বলছে আমারে।
চুপচাপ আকাশ পানে তাকিয়ে আছে মুহতাসনিম।
~~~
খোলা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে জাহিন।রাতের আকাশে তারাদের ভীড় জমেছে।দূর দৃষ্টি রেখে দাঁড়িয়ে আছে জাহিন।মুহতাসনিমের জন্যে বড্ড মন খারাপ করছে।ইচ্ছে করছে একছুটে চলে যাক তার কাছে।মেয়েটা ঠিকমতো ঔষধ খেয়েছে তো?যত্নটা ঠিকঠাক নিচ্ছে তো?
~~~
সকালে নাস্তার টেবিলে বসে আছে সবাই।জাহিন একেবারে তৈরি হয়ে এসেছে।নবনী অবাক দৃষ্টি নিয়ে বলে,
“কোথাও যাবি বাবা?
” মা মণি আমি হসপিটাল চলে যাবো।ছুটি শেষ আমার।
জাফর সাহেব খাওয়ার মাঝে বললেন,
“সে কি কথা জাহিন?আনানের বিয়ের আর পাঁচদিন বাকি!তুমি আজ চলে যাবে মানে?
” মামা আমি অবশ্যই আসার চেষ্টা করবো।আমার সবকিছুই ধরাবাঁধা নিয়মে!
রেহানা বেগম মুখটা কালো করে বললেন,
“ভাই তোর কাছে কোনোদিন কিছু চাই নাই,এবার চাওয়া তুই আমার আনানের বিয়াতে থাকবি।
মুখে হাসি টেনে বলে জাহিন,
” তোমার কথা কি ফেলতে পারি নানুমণি?আমি অবশ্যই আসবো।
শায়লা বেগম পাশ থেকে বলেন,
“দেখো যেন আবার কথার খেলাফ না হয়।
“হবে না।আনান কই মামি?
রিতা বেগম ফলের ঝুড়ি টেবিলে রাখতে রাখতে বললেন,
” তুমি কিছুই জানো না জাহিন?
জাহিন চমকে বলে,
“কি বিষয়ে মামি?
” আনান তো ফিরেছে সকাল সাতটায়।রুমে ঘুমাচ্ছে এখন।কালকে নাকি আতিকের বাবাও মারা গেছে।
হঠাৎ খাবার গলায় আটকে যায় জাহিনের!এটা শোনার জন্যে মোটেও যেন প্রস্তুত ছিল না!পরক্ষণে আবার রিতা বলে,
“সব দোষ ওই মেয়ের।ভাবো কেমন ভাগ্যে নিয়ে জন্মেছে!একদিনে বাপ ছেলে তিনজন পরপারে!এমন মেয়ের তো মুখও দর্শন করা ঠিক না।
রিতা বেগমের কথা কিঞ্চিৎ রাগ ধরায় জাহিনকে।পাল্টা জবাব দেয় জাহিন,
” এসব কি ধরণের কথা মামি?এর জন্যে ওই মেয়ের দোষ কোথায় যার জন্যে ওর মুখ টাও দেখা নিষেধ?এটা নিয়তি মামি আর এর উপর কারও হাত থাকে না।
বাকি নাস্তাটুকু শেষ না করেই চলে যায় জাহিন।
~~~
টিউশনিতে যাওয়ার জন্যে তৈরি হচ্ছে মুহতাসনিম।মিনা বেগম রাগ দেখিয়ে বললেন,
“এক পাও ও বাহির হবি না।শরীরের অবস্থা দেখছোস তুই?
পেছন ফিরে মিনা বেগমের দিকে একবার তাকায় মুহতাসনিম।পরক্ষণে বলে,
” আমি তোমাকে খুব জ্বালাতন করি তাই না খালা?
“বেশি বুঝবি না একদম।চুপচাপ শুইয়া থাক।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে মুহতাসনিম,
” তুমি তো এখন কাজে চলে যাবে খালা।রুমে একা একা ভালো লাগবে না আমার।
“নবনী আপা ছুটি দিছে আজকে আমারে।
” তবুও খালা বাড়িতে আমার ভালো লাগছে না।দমবন্ধকর অবস্থা লাগছে।
কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলে মিনা বেগম,
“ঠিক আছে মনে যা মর্জি করে তাই কর।আমিও তাইলে কাজে চইলা যাই।
” আচ্ছা।
~~~
আতিকদের বাড়ির গেইটের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে মুহতাসনিম।মস্তবড় একটা তালা ঝুলছে!হতাশ দৃষ্টি নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে মুহতাসনিম।বাড়ির আশেপাশে অনেক কে দেখা যাচ্ছে।এলাকায় পুরো ছড়িয়ে গেছে কথাটা একদিনে পিতাপুত্র তিনজনের মৃত্যু!খবরের কাগজেও নাকি এসেছে।
লোকমুখে সবকিছু শুনছে মুহতাসনিম।আতিকের মায়ের অবস্থা নাকি ভালো নয়।আতিকের নানা বাড়ি থেকে লোক এসে মিসেস ময়না বেগমকে নিয়ে গেছেন।
শরীর ভিষণ রকম অস্থির লাগা শুরু করেছে মুহতানিমের।মাথা ঘুরছে ভঁনভঁন!এলোমেলো পা ফেলে কোনোরকম চলে আসে মুহতাসনিম।
~~~
শহরের এই জ্যাম মানুষের জীবনটা যেন অতিষ্ঠ করে তুলেছে।হাত ঘড়িতে দৃষ্টি ফেলে পরক্ষণে সামনে তাকায় জাহিন।এমনিতে লেইট হয়ে গেছে অনেকটা।তার উপর এই জ্যাম।আচমকা রাস্তার সাইডে দৃষ্টি থমকে যায় জাহিনের!গাঢ় সবুজ রঙের থ্রিপিস পরে দাঁড়িয়ে আছে মুহতাসনিম।মাথায় হিজাব বাঁধা।এই সময় রাস্তায় মুহতাসনিমকে দেখে বেশ অবাক হয় জাহিন!পরক্ষণে দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে যায়।
চারিদিকটা কেমন ঝাপসা লাগছে!পা দুটো চলতে চাইছে না!মাথায় চিকণ ঘামের রেখা!রৌদ্রতাপে সবকিছু ঘোলাটে লাগছে মুহতাসনিমের!
জাহিন এক প্রকার হন্য হয়ে এসেছে মুহতাসনিমের সামনে।
“একি আপনি এখন এখানে?
চোখমুখ কুঞ্চিত করে জাহিনের পানে তাকায় মুহতাসনিম,পরক্ষণেই ঢলে পরে!তৎক্ষনাৎ জড়িয়ে নেয় জাহিন।মৃদু কাঁপছিল মুহতাসনিমের শরীর!রাগ চরম আকার ধারণ করে জাহিনের।মুহুকে কোলে তুলে গাড়ির দিকে ছুটে যায়।রাস্তায় আশেপাশে অনেকে তাকিয়ে ছিল।সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না জাহিনের।
~~~
একহাতে ড্রাইভ করছে আর অপর হাতে ফোন নিয়ে মা মণি কে কল করে জাহিন।দুবার বাজতেই রিসিভ হয় ফোন।
” হ্যালো মামণি?
“হ্যাঁ বাবা বল?
“মামণি আমি আজই বিয়ে করতে চাই মিস মুহু কে।এবং এক্ষুনি।
বলেই লাইনটা কেটে দেয় জাহিন।
চলবে…………..???????????
#মেঘবতীর_শহরে
পর্ব-২৭
নাদিয়া ইসলাম সানজিদা
,
,
মায়ের পাশে চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছে মিসেস নবনী।রেহানা বেগম পান চিবুতে চিবুতে বললেন,
“ছেলের মত যহন পাল্টাইছে তাইলে দেরি করা ঠিক হইবো না।বুঝতাছি না ঝোকের বশে আবার সিদ্ধান্ত নিলো নাকি জাহিন?
চিন্তার ভাজ কপালে নিয়েই বলল নবনী,
” কথা সেটা নয় মা।জাহিন হুট করে এমন সিদ্ধান্ত নিলো মেয়েটা রাজি হবে তো?সবকিছু ঠিকভাবে হবে তো শেষ অব্ধি?
মিনা বেগম দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমারে ডাকছিলেন আপা?
দরজায় তাকাতেই খানিকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল নবনী,
” জাহিন কল করেছিল মিনা আপা।আজই নাকি মুহুকে বিয়ে করতে চায়।ছেলে আমার ডিউটিতে হসপিটাল চলে গিয়েছিল হঠাৎ একটু আগে কল করে জানালো আজই নাকি বিয়ে করবে আর এক্ষুনি!
সবকিছু শুনে তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে মিনা বেগম।একে তো মেয়েটার মানসিক অবস্থা ভালো নয়!তার উপর আজই বিয়ে?
“মুহতাসনিম কোথায়?তাকে ডাকো আমি একটু কথা বলবো।
আমতা আমতা করে বলে মিনা বেগম,
” আসলে মুহু তো ঘরে নাই আপা।টিউশানি তে গেছে সকালেই।
চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলে নবনী,
“টিউশনিতে গেছে মানে?মেয়েটার শরীরের অবস্থা ভালো?তুমি যেতে দিলে কেন?
মুখটা কাচুমাচু করে বলে মিনা বেগম,
” ঘরে থাকলে অযথা টেনশন করতো।নিজ ইচ্ছায় যাইতে চাইছে।আমি আর নিষেধ করতে পারি নাই আপা।ভাবছি বাহির থাইকা আসলে একটু ভালো লাগবো।
কপালে হাত রেখে ফুস করে দম ছাড়ে নবনী।বাহির থেকে গাড়ির শব্দ আসছে।বিচলিত হয়ে উঠে দাড়ায় নবনী।
“ওই তো জাহিন এসেছে।
~~~
সদর দরজা খুলতেই চমকে তাকিয়ে আছে রিতা বেগম।জাহিন দাঁড়িয়ে আছে তার ঠিক পাশেই মুহতাসনিম অনেকটা জাহিনের সাথে হেলে দাঁড়িয়ে!
ততক্ষণে পেছনে নবনী আর মিনা বেগম চলে আসেন।মুহতাসনিম কে এই অবস্থায় দেখে আৎকে উঠে মিনা বেগম।তৎক্ষনাৎ এগিয়ে গিয়ে বলে,
” হায় আল্লাহ! মাইয়াটা তো সুস্থ শরীরেই বাহির হইছিল!অহন আবার কি হইলো?
জাহিনের চোখে,মুখে এখনো রাগের আভা উপচে পরছে।কারও কোনো কথার জবাব না দিয়ে মুহতাসনিম কে ধরে রুমের ভেতরে নিয়ে আসে।
নবনীও খানিক অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।রিতা
ভেতরের রুমে গিয়ে শায়লা বেগমকে ডেকে নিয়ে আসলো।
নিজ হাতে একগ্লাস পানি এনে মুহুর চোখে মুখে ছিটিয়ে দিলো জাহিন।জবুথবু হয়ে সোফায় বসে আছে মেয়েটা।চোখ জোড়া আধো খোলা টিপটিপ করছে।ঠোঁট জোড়া কাঁপছে ভিষণরকম।অতিরিক্ত ভয়ে এরকমটা হয়েছে।জাহিন প্রথমেই মিনা বেগমের উদ্দেশ্যে বলল,
“আপনি কি করে একটা অসুস্থ মেয়েকে বাহিরে যাওয়ার পারমিশন দিলেন?আপাকে কতবার বলে গেছি একটু যত্ন নিন মেয়েটার!না পারলে বলে দিতেন আমায়!
ভয়ে আমতা আমতা করছে মিনা বেগম,
” আ,,,আমি তো মানা করছিলাম বাবা।শো,,,,শোনে নাই মাইয়া….
“ব্যস!দেখা হয়ে গেছে আমার।মেয়েটার বয়স কম!তার উপর কতটা মেন্টালি চাপ নিচ্ছে মাথায় তার কোনো ধারণা আছে আপনাদের?আজকে খুব বাজে কিছুও হয়ে যেতে পারতো!
পরক্ষণে নবনীর দিকে তাকিয়ে বলল জাহিন,
” মা মণি আমি মিস মুহুকে তোমার দায়িত্বে রেখে যেতে চাই!
জাহিনের কথা শুনে শায়লা বেগম আর রিতা অবাকের শেষ পর্যায়ে!কিছুতেই তাদের কোনো হিসাব মিলছে না!সবকিছু গড়মিল লাগছে কেমন!রিতা বেগম প্রশ্ন ছুঁড়েই বসলেন,
“আপার তত্ত্বাবধানে রেখে যাবে মানে?
কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল জাহিন,
” মিসেস জাহিন হিসেবে থাকবে মুহু!
রিতা বেগমের চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়েছে!এসব কি বলছে জাহিন?!এই মেয়েটাকে বিয়ে করে রেখে যাবে তাও তাদের সাথে?
শায়লা বেগম বললেন,
“এ ব্যাপারে তোমার মামার সাথে আগে কথা বলো জাহিন।তিনি কি সিদ্ধান্ত নেন আগে দেখো।তারপর না হয় বিয়ে করো।
জাহিন একবার ঘড়িতে চোখ বুলায় পরক্ষণে বলে,
” কিন্তু আমার হাতে তো সময় বেশি নেই মামি মণি।এমনিতে অনেকটা লেইট হয়ে গেছে।
অবাক হয়ে বলল শায়লা বেগম,
“তুমি কি এক্ষুনি বিয়ে করবে নাকি?
কথা টেনে নিয়ে বলে নবনী,
“ছেলের ইচ্ছে টাই আমার ইচ্ছে ভাবী।এ বিষয়ে আমি পরে ভাইকে বুঝিয়ে বলবো।
পরক্ষণে মিনা বেগমকে বলল,
” মুহতাসনিম কে উপরে নিয়ে যাও মিনা আপা।আমি জাহিনকে নিয়ে আসছি।
মিনা বেগম মুহতাসনিমের কাছে আসতেই জাহিন বাঁধা দিয়ে বলল,
“এখনও যথেষ্ট উইক উনি।আমি দিয়ে আসছি।
বলেই মুহতাসনিমকে পাঁজা কোলে নিলো জাহিন।সবার সম্মুখেই সদর দরজা পেরিয়ে সিড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠে গেল।
~~~
শায়লা বেগম বলেন,
“ঠিক আছে ছেলের জন্যে যেহেতু তুমি একাই যথেষ্ট তাহলে ছেলের বিয়ে নিজেই দাও।আমরা কেউই থাকবো না।
মলিন মুখে এক চিলতে হাসি নিয়ে বলে নবনী,
” ছেলের বিয়ে তো এক্ষুনি আপা।শুধু তোমরা আমার ছেলের জন্যে একটু দোয়া করো।এর বেশি কিছু চাইনা।
রিতা বেগম বললেন,
“আজ না আবার এ বাড়িতে কোন অনর্থ ঘটে যায়!
নিশ্চুপ হেটে চলে যায় নবনী।
~~~
মুহতাসনিম কে রুমের কাছে এসে নামাতেই বলল,
” আমি তো ধীরে ধীরে আসতে পারতাম।কেন এভাবে সবার সামনে নিয়ে আসলেন আমায়?
কথাগুলো এখনও কেমন জড়িয়ে যাচ্ছিলো মুহতাসনিমের।চোখ দুটো হালকা দেবে আছে!তবুও কোথাও একটু স্নিগ্ধতা বিরাজ করছে!কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলে জাহিন,
“আমি আবার ফিরে আপনাকে যেন সুস্থ দেখি মিস মুহু!
~~~
কয়েক মিনিটের ব্যবধানে ঘর টা গুছিয়ে ফেললো মিনা বেগম।জানালার ধারে হেলান রেখে বসে আছে মুহতাসনিম।কোনো অনুভূতিই যেন কাজ করছে না!জীবনের এই পর্যায়ে এসে নিজেকে চরম অপদার্থ মনে হচ্ছে!জন্মটাই যেন দুঃখ দিয়ে শুরু!নিজের জীবনের সাথে যাদের জড়িয়ে নিচ্ছে তারা সবাই দুঃখে ভেসে যাচ্ছে!চোখ বেয়ে অনর্গল পানি পরছে।
মিনা বেগম নতুন দেখে একটা শাড়ি খাটে রেখে মুহতাসনিমের উদ্দেশ্যে বলল,
“যা তারাতাড়ি পইরা আয়।যতই হোক বিয়া তো!শাড়ি না পরলে বেমানান লাগে।
ভাঙা আওয়াজে বলে মুহতাসনিম,
” এই বিয়ে আমি করতে পারবো না খালা!আমার সাথে কারো জীবন জড়ানোর দরকার নেই!আমি এমনিতে ভালো আছি।
নিশ্চুপ হয়ে আছে মিনা বেগম।মেয়েটার মনের অবস্থা বুঝতে পারছেন তবুও এই মুহূর্তে জাহিনের মতো একজনকে মুহুর পাশে ভিষণ প্রয়োজন ভিষণ!
“বিয়া করতে না চাওয়ার কারণ কি?নিজের ভাগ্যে রে ভয় পাস নাকি অন্য কোনো কারণে?
হাটুতে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে মুহতাসনিম।এই মুহূর্তে জাহিনের সাথে হুট করে বিয়ে নামক সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়া টা আদৌ ঠিক কিনা ভাবতে পারছে না মুহতাসনিম।মাথা যেন অকেজো হয়ে আছে।কোনো চিন্তা’ই আর মাথা তে নিতে পারছে না!তবে জাহিন কেন বিয়ে করতে চাইছে মুহুকে?নিজের ভাগ্য নিয়েও চরম সংশয়ে আছে মুহতাসনিম।
ভাবণার মাঝেই ঘরে কয়েক জনের উপস্থিতি টের পায় মুহতাসনিম।তবুও মাথা নিচু করে বসে আছে।মিনা বেগম অপরাধী কন্ঠে নবনীকে বলল,
” মাইয়াটার মন মেজাজ ভালো না।শাড়ি নামাই দিছি তাও পরে নাই।
নবনী হাসি হাসি মুখ নিয়ে বলে,
“মুহতাসনিম এমনিই যথেষ্ট সুন্দর। এর বেশি কিছুর প্রয়োজন নেই!
জাহিন পরনের ড্রেস চেইন্জ করেনি।সাথে রেহানা বেগমও এসেছেন।নাতির বিয়ে বলে কথা।কাজি সাহেব খাটের একপাশে বসে আছেন।মিনা বেগম তড়িঘড়ি করে মুহতাসনিমের মাথায় ঘোমটা টেনে দিলো।
নিষ্পলক মেঝেতে তাকিয়ে আছে মুহতাসনিম।আড় চোখে মুহতাসনিম কে দেখে নেয় জাহিন।চোখ ফুলে লালচে হয়ে আছে!নাকের ডগাটা রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে।হেচকি উঠছে মৃদু।
কিছুক্ষণের মধ্যেই কাজি বিয়ে সম্পন্ন করলেন।মাঝে আর একটা কথাও বলেনি মুহতাসনিম।সবকিছু শেষ হতেই তাড়া নিয়ে মা মণি কে বলে জাহিন,
“মা মণি আমি মিস মুহুকে তোমার হাতে তুলে দিয়ে গেলাম।মুহুকে ভালো রাখার সম্পূর্ণ দায়িত্ব তোমার।
আমি আসি মা মণি এমনিতে দেরি হয়ে গেছে আমার।
” মুহতাসনিম কে একবার বলে যা।
একপলক মুহতাসনিমের দিকে তাকায় জাহিন পরক্ষণে ছোট্ট করে বলে,
“আসি মুহু।
পাল্টা আর কোনো জবাব আসেনি মুহতাসনিমের থেকে।নিশ্চুপ কেবল বসে আছে।
~~~
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে।নবনী অনেক বার বলা শর্তেও জাহিনের রুমে যেতে চায়নি মুহতাসনিম।
চিলেকোঠার রুমটায় জানালার কাছে বসে আছে।মিনা বেগম রুমে প্রবেশ করে বলছেন,
“তোর শাশুড়ি এতবার কইরা বলল!গেলেই পারতি।অবশ্য আমার কাছে ফাঁকা ফাঁকা লাগতো!তোর ভাগ্যে কত ভালো দেখছোস মাইয়া?আর কোনো কষ্ট থাকবো না তোর দেখিস!
আচমকা টকন নড়ে মুহতাসনিমের।পিছু ফিরে মিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে,
” ডাক্তার সাহেব কি চলে গেছে খালা?
“এতক্ষণে হুশ হইছে তোর?সেই কখন গেছে!
শুকনো ঢোক গিলে ভাবে মুহতাসনিম,তাহলে এখন পর্যন্ত একটা কলও করেনি কেন মুহতাসনিম কে?উনি কি ঠিক আছে?ভাবতে ভাবতেই হাতড়ে ফোনটা খুঁজে নেয়।ফোনের স্ক্রিনে ২০ টা মিসড কল!তৎক্ষনাৎ চেইক করে দেখে মুহতানিমের কল ছিল তার মধ্যে একটাও জাহিনের কল নেই!অজানা এক ভয়ে কলিজা শুকিয়ে আসলো মুহতাসনিমের।বিলম্ব না করে জাহিনের নাম্বারে ডায়াল করলো।কয়েক বার বেজেই লাইন কেটে যায়।প্রায় কাঁদো কাঁদো অবস্থা মুহতাসনিমের।রুম থেকে বেরিয়ে ছাদে চলে আসে।মিনা বেগম চুপচাপ মুহতাসনিমের কান্ড দেখছেন।
পর পর আরও দুবার কল করে মুহতাসনিম।তাতেও রিসিভ হয় না কল!চোখ বেয়ে আপনাআপনি জল পরছে মুহতাসনিমের।হাত ভিষণ রকম কাঁপছে!ফোনের স্ক্রিনে চোখের জলের বিন্দু ছড়িয়ে!আচমকা হাতে থাকা ফোনটা ভাইব্রেশন করে উঠে!স্ক্রিনে লেখা ‘ডাক্তার সাহেব’ চোখ বুজে ফোন টা বুকের কাছে জড়িয়ে বড় করে দম নেয় মুহতাসনিম।পরক্ষণে রিসিভ করে কানে জড়ায়,
“বলুন মিসেস মুহু?
কাঁপা কন্ঠে ধীরে বলে মুহতাসনিম,
” কখন থেকে ফোন করছিলাম আপনি কখন পৌছালেন?
“ব্যস্ত ছিলাম।অনেক আগেই পৌঁছেছি।আপনাকে কল করার সময় পাইনি দুঃখিত।
লোকটাকে বরাবরের মতো যান্ত্রিক মনে হয় মুহতাসনিমের।যেন কোনো অনুভূতি নেই!কথাগুলোও কেমন কাট কাট!নিরবতা ভেঙে বলে জাহিন,
“মা মণি কোথায়?
“নিচে।
” আপনি কোথায়?
মৃদু শব্দে বলে মুহতাসনিম,
“চিলেকোঠার রুমে।
” নিচে কেন যাননি?মা মণি নিশ্চয়ই বলেছিল?
“হুম।
” তাহলে কেন যাননি?এখনও তো অনেক টা অসুস্থ আপনি!
চুপচাপ কেবল জাহিনের কথা শুনছে মুহতাসনিম।কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলে জাহিন,
“আপনি অসুস্থ থাকলে আমি কাজে মন বসাতে পারবো না মুহু!আমার পেশা সম্পর্কে ধারণা আছে আপনার।আর আমি কাজে মন বসাতে না পারলে তা অন্যের জীবণের জন্য রিস্কি হয়ে যাবে!একজন ডাক্তার হিসেবে আমি সেটা চাই না।আশা করি আপনি নিজের যত্ন নিবেন আর মা মণির কথা মেনে চলবেন।
চলবে…….