#মেঘবতীর_শহরে,পর্ব-৪৫,৪৬,৪৭
নাদিয়া ইসলাম সানজিদা
৪৫
,
কাঠের জানালার ধারে হাঁটু মুড়ে বসে আছে মুহতাসনিম।ঘুমের ঔষধের কোনো কাজ হয়নি।এক ফোটা ঘুম এখনও ধরা দেয়নি চোখে।ফুপিয়ে কেঁদেই যাচ্ছে।মনে হচ্ছে কলিজা টা কেউ ছিড়ে নিয়ে গেছে!সব কষ্ট সইবার মতো ক্ষমতা থাকলেও এই কষ্ট টা সইবার ধৈর্য্য নেই!পাঁজর ভাঙ্গা কষ্ট!ভাবতেই হুহু করে কেঁদে উঠে মুহতাসনিম।দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ডেকে উঠে নবনী।
“মুহতাসনিম?
মুখ তুলে তাকায় মুহতাসনিম।চোখ দুটো ফেটে যেন এক্ষুনি রক্ত বয়ে যাবে!লালচে নাকের ডগা!নিষ্প্রাণ চাহনি!তিরতির করে কাঁপছে ঠোঁট জোড়া!কলিজা কেঁপে উঠে নবনীর।ছুটে চলে আসে মুহতাসনিমের সম্মুখে!চেপে ধরে বুকে।কান্নায় চোখ ভিজে উঠে নবনীর।পাশে নিঃশব্দে কাঁদছে মিনা।মায়ের বুক পেয়ে শব্দ করে কেঁদে উঠে মুহতাসনিম।
দরজার সামনে হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে জাহিন।বক্ষদেশ ভার হয়ে আছে তার!বাবা হারানোর শোকে বুঝি কেউ এত কাতর হয়!বাবাদের ভালোবাসা কেমন হয় জানা নেই জাহিনের।মুহুর কষ্ট টা কোনোদিক দিয়েই উপলব্ধি করতে পারছে না সে!তবে এই যে শোকে কাতর মেয়েটা ছটফট করছে!বুক ভাঙ্গা কষ্টে কাঁদছে এটা সহ্য হচ্ছে না কেমন!দু কদম হেটে সম্মুখে আসে জাহিন।
মুহতাসনিমের মাথায় হাত বুলিয়ে শান্তনা দেয় নবনী।চোখ মুছে বলছে মুহতাসনিম,
” শেষ বারের মতো কেন দেখতে পারলাম না বাবার মুখ টা?কি পাপ ছিল আমার?আমার সাথেই কেন খারাপ হয় সবসময়?
পেছন থেকে মুনা বলে উঠে,
“কোনো পাপ নয় আপু।মৃত্যুসজ্জায় থেকেও বার বার তোকে খুঁজেছে বাবা।বার বার বলছিল’ আমার মা মরা মেয়েটারে আমি একটু শান্তি,সুখ দিতে পারি নাই!শেষ বেলায় তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য ছটফট করেছিল বাবা।আমি তোমাকে কল দেই তখনি।কিন্তু তার কতক্ষণ পরেই বাবা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে।আর তুমি আসতে আসতে তড়িঘড়ি করে দাফনের ব্যবস্থা করতে বলে মা।
বাকরুদ্ধ হয়ে মুনার কথা শুনছে মুহতাসনিম।শেষ বেলায় বাবা তাকেই খুঁজেছিল!অথচ অপদার্থের মতো শেষ বেলায় আসতে পারলো না মুহু?মা কি একটু পারতো না তারজন্য অপেক্ষা করতে?
পুনরায় হাটুতে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকে মুহতাসনিম।নবনী ভেবে পায়না মায়ের জাত এত নিষ্ঠুর হয় কি করে?পারুল বেগম নিজে একজন মা!সে কি করে অন্যের সন্তানের সাথে এমন করতে পারে?অবশ্য মুনা মেয়েটাকে ভালই মনে হচ্ছে।মিনা কান্না চেপে ভাঙ্গা কন্ঠে বলছে,
” পারুলের জন্যে কোনোদিন শান্তি পায়নাই মুহু।আলতাফ তো বউয়ের কথায় উঠতো বসতো!মেয়েটার সাথে কোনোদিন ভালা ব্যবহারটাও করে নাই।তবুও এই মাইয়াটারে দেখো বাপের জন্যে কেমন জীবন যায় যায়!
পরিস্থিতি বেহালে চলে যাচ্ছে।এই মুহুর্তে ব্রেইনে এত চাপ নেওয়াটা মোটেও উচিৎ হবে না মুহুর।শান্ত কন্ঠে মায়ের উদ্দেশ্যে বলল জাহিন,
“মা মণি এই নিয়ে পরেও কথা বলা যাবে।এমনিতে মুহুর অবস্থা ভালো না।ঘুমের মেডিসিনেও কাজ হয়নি।
নবনী বুঝতে পেরে সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে যায়।কেবল জাহিন দাঁড়িয়ে থাকে।কেন জানি মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে মুহুর পাশে থাকাটা খুব জরুরি তার।নিস্তব্ধ বন্ধ রুমে কেবল মুহতাসনিমের কান্নার ফ্যাচফ্যাচ শব্দ হচ্ছে।যথাসম্ভব শান্ত কন্ঠে বলে জাহিন,
” নিজেকে এভাবে কষ্ট দেওয়ার কোনো মানে হয় না মুহু।এটাই হয় এবং হয়ে আসছে।মানুষ চিরঞ্জীব নয়।সবাইকেই একদিন চলে যেতে হয়।এই কঠিন সত্য টা মানতে হবে।
কেঁদেই যাচ্ছে মুহতাসনিম।ভেতরে একপ্রকার ছটফটানি কাজ করে জাহিনের।এভাবে আর দেখতে পারছে না মুহতাসনিম কে।পাশে থাকা টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিয়ে মুহতাসনিমের মুখের সামনে ধরে জাহিন।
“একটু পানি খেয়ে নিন মুহু।প্রচন্ড রকমের শরীর খারাপ করবে এভাবে চলতে থাকলে।
কোনোকিছুতে হেলদোল নেই মুহুর।রাগ ফুটে ওঠে জাহিনের কপালের ভাঝে ভাঝে।তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে জাহিন,
” আপনার আরও একটা বোন আছে এবং মা’ও আছে। কই তারা তো আপনার মতো এত কাঁদছে না।যতেষ্ট স্বাভাবিক আছে।
করুন চোখে জাহিনের পানে তাকায় মুহতাসনিম।ললাট বেয়ে অশ্রুকণা থুতনিতে এসে ঠাঁই জমিয়েছে।ঘন আঁখি পল্লব ভিজে চুপচুপ!হলদাভাব গায়ের রঙ টুকু ফ্যাকাশে লাগছে!বুকের বা পাশে চিনচিন করে উঠে জাহিনের।
দুপদাপ উঠে এগিয়ে আসে মুহতাসনিম।জড়িয়ে ধরে জাহিনকে।টাল সামলাতে কষ্ট হয় জাহিনের।মানুষটা এত পাথুরে কেন ভেবে পায়না মুহতাসনিম।একটুখানি শান্তনা দেওয়ার পরিবর্তে কঠিন দুনিয়ার সত্যতা বোঝাচ্ছে!মানুষ তো চিরকাল বেঁচে থাকে না সেটা সবারই অবগত।তবে ক্ষনকালের এই সময়ে যে বিশাল ভালোবাসা,সম্পর্ক আর অনুভূতি রেখে যায় সেটা শতজন্মেও শেষ হবার নয়!কম্পন সৃষ্টি হয় শরীরে।কান্নারত কন্ঠেই বলে মুহতাসনিম,
“আপনি এত অনুভূতিহীন কেন ডাক্তার সাহেব?নাকি এই পৃথিবীর কারও ভালোবাসার যোগ্য আমি নই?
ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা জাহিন ভাবতে থাকে এই পৃথিবীতে সবার ভালোবাসা এক পাল্লায় মাপা অনুচিত।যে ভুলটা এতদিন জাহিন করে এসেছে।পুনরায় কেঁদে বলে মুহতাসনিম,
” কারও ভালোবাসা পাইনি আমি।আদৌ কপালে আছে কিনা জানা নেই!এই যে আপনাকে শক্তপোক্ত ভাবে জড়িয়ে ধরে কাঁদছি এতে আমার ভেতরটা একটুও হাল্কা হচ্ছে না ডাক্তার সাহেব।
কথা বাড়ায় না জাহিন।আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে মুহতাসনিম কে।নিথরের মতো বুকে পরে রয় মুহতাসনিম।হাতের বাধন হয় আলগা।শার্টের খানিকটা অংশ মুহুর অশ্রুপাতে ভিজে গেছে!
আলগোছে মুহতাসনিম কে বুকের মধ্যিখানে নিয়ে শুয়ে পরে জাহিন।নিশ্চুপ মুহতাসনিম হেচকি তোলে ক্ষন পরপর।হুট করে চোখ জোড়া ভিষণ রকম জ্বলতে থাকে জাহিনের।কে জানে কান্নার পূর্বাভাস নাকি!অবশেষে পাথুরে এ মনটা গলিয়ে দিলো মুহু?জাহিনের গলদেশে উত্তপ্ত শ্বাস আছড়ে পরে।গুটিশুটি হয়ে চোখ বুজে আছে মুহতাসনিম।মনে হচ্ছে শতজনম পর শান্তির ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে!এইটুকুই তো চাওয়া ছিল!
চোখেরা বুঝি আপনাআপনি লেগে আসছে!ঘুম ধরা দিচ্ছে চোখে!শরীর,মন সবকিছুই শক্তিশূন্য!মুহুর দেহের পুরোটা ভার গায়ে নিয়ে চুপচাপ শুয়ে আছে জাহিন।ইচ্ছে করছে আজন্মকাল এভাবে থাকুক!
মেয়েটাকে একটুখানি স্বস্তি দিতে খাবার,ঔষধ কোনোকিছুই বাদ রাখেনি জাহিন।অথচ একটুখানি আলিঙ্গনেই সবটাই কেমন শান্ত নিবিড় হয়ে গেছে!ভারী নিশ্বাসের শব্দ হতেই বুঝতে পারে মুহতাসনিম বেঘোরে ঘুমাচ্ছে!বক্ষদেশে অজানা এক সুখকর অনুভূতি হচ্ছে জাহিনের!
~~~
নবনী থাকার কোনো বন্দোবস্ত করে আসেনি।এখানে আসার পর যা বুঝতে পেরেছে থাকা মোটেও সমীচীন হবে না।পারলে মুহতাসনিম কে ও নিয়ে চলে যেতেন। কিন্তু নিয়মানুসারে চারদিন থাকতে হবে।এমনিতে মেয়েটার মনের অবস্থা ভালো নয়।এর মধ্যে যাওয়ার কথা বলাটা শোভা পায়না।ছেলেকে এখানে রেখে যাবেন এটা ভাবতেই কোনো চিন্তা নেই।মিনা জানায় আজই ঢাকা চলে যাবে।তার প্রাক্তন স্বামী শরিফ যদি জানতে পারে মিনা এখানে ঠিক হাঙ্গামা করতে আসবে।সবমিলিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো নবনী।অবশ্য মুহতাসনিম আর জাহিনকে বলে যেতে হবে।
~~~
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে সেই কখন।ঘুমের রাজ্যে ডুবে আছে মুহতাসনিম।তিল পরিমাণ ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে দেয়নি জাহিন।মুনা অবশ্য ডাকতে এসেছিল জাহিনকে।ইশারায় চলে যেতে বলে মুনাকে।
হাতের বা দিকটা অবশের মতো হয়ে আছে জাহিনের।অবশ্য ঘুমের মধ্যে খানিকটা নড়ে গিয়ে সরে পরেছে মুহতাসনিম।ঘড়িতে চোখ পরতেই উঠে বসে জাহিন।তৎক্ষনাৎ বাইরে বেরিয়ে আসে।নবনী এখনও বসে আছে জাহিনের থেকে বিদায় নেওয়ার আশায়।জাহিনকে দেখা মাত্র উঠে আসে নবনী,
“সন্ধ্যা হয়ে গেছে বাবা এখনি ঢাকা রওনা দিতে হবে।তোর অপেক্ষায় ছিলাম।
” আজকেই চলে যাবে মা মণি?
“আজকে থাকলে চারদিন থাকতে হবে বাবা।থাকার মতো পরিস্থিতি দেখছি না।বাসায় তোর নানুমণি অসুস্থ!
” মুহুকে নিয়ে যাবে না?
“পাগল হয়ে গেছিস!সদ্য বাবা মরা মেয়েকে নিয়ে যাবো কিভাবে?
কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলে জাহিন,
” কিভাবে যাবে?বাসার গাড়ি এনেছো?
“হুম।
সবটাই নিশ্চুপ শুনলেন পারুল বেগম।পরক্ষণে তেতে উঠে বললেন,
” ঘরের বউ যে ফেলে যাচ্ছেন তার খাওয়া খরচ আসবে কোথা থেকে শুনি?বাপটাও তো নাই যে তার খরচ বহন করবে!
চলবে……..
#মেঘবতীর_শহরে
পর্ব-৪৬
নাদিয়া ইসলাম সানজিদা
,
,
আকস্মিক পারুলের এমন কথায় স্তব্ধতা বিরাজ করছে চারিদিকে।এই মুহুর্তে এমন একটি নিচু ধরনের কথা মোটেও আশা করেনি কেউ।পারুল বেগমের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা হয়ে গেছে সবার।লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে মিনা।দু হাত পকেটে পুরে নেয় জাহিন।শান্ত গলায় মায়ের উদ্দেশ্যে বলে,
“তোমরা যাও মা মণি।নয়তো ফিরতে ফিরতে রাত বেশি গভীর হয়ে যাবে।
এক পলক পারুল বেগমের দিকে তাকায় নবনী।কাঠিন্য রূপ বিরাজ করছে ভদ্রমহিলার মুখে।ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে নবনীর।মুহতাসনিমের শৈশব,কৈশোর যে কতটা ভয়ানক ছিল তা ভাবতেই গাঁ শিউরে উঠে! এই মহিলার জন্যে যে দু দন্ড শান্তি পায়নি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
ছেলে যখন নবনীকে এই মুহূর্তে চলে যেতে বলছে তাহলে এর সমাধান জাহিন ঠিক করবে।পরক্ষণে মিনাকে নিয়ে চলে যায় নবনী।
মা ছেলের ভাবভঙ্গি তুষ্ট করতে পারলো না পারুলকে।ভেবেছে বড় লোক শশুড় বাড়ি মুহুর।এভাবে বললে নেহাৎ আত্মসম্মানের ভয়েও দু চার হাজার টাকা বেরিয়ে যাবে।কিন্তু বিনিময়ে একরাশ হতাশা পেল কেবল!তবে মনস্থির করে নিলেন কালকেই এই অভাগিনী কে বিদেয় করবে বাড়ি থেকে।যে করেই হোক!
জাহিনের ফোনের রিংটোনে নিরবতা ভঙ্গ হলো।স্ক্রিনে তাকাতেই মুখটা বিষাদে ছেয়ে গেল!হসপিটাল থেকে ফোন এসেছে।জরুরি ফোন তা আর বুঝতে বাকি নেই।পরক্ষনে কথা বলে নেয় জাহিন।অতিসত্বর বিদায় নিতে হবে বুঝতেই মুহতাসনিমের ঘরের দিকে এগোয়।যাওয়ার আগে ঘুমন্ত মুহুর মুখ দর্শনের তীব্র ইচ্ছা জাগে মনে।ও ঘুম ভাঙ্গবার মতো কলিজা নিয়ে জন্মায়নি জাহিন।মায়াবতীর ঘুম কখনও ভাঙ্গতে নেই! মুহতাসনিমের মাথার কাছে বসে আছে মুনা।পাশেই বেঘোরে ঘুমাচ্ছে মুহতাসনিম।দরজার কাছে দাঁড়িয়েই মৃদু শব্দে মুনাকে ডেকে উঠে জাহিন।সম্ভিৎ ফিরে পাওয়ার মতো তাকায় মুনা।তড়িৎ গতিতে বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াতেই পুনরায় ডেকে উঠে জাহিন,
“যাবেন না।
থমকে দাঁড়ায় মুনা।চোখ তুলে একবার তাকায় জাহিনের পানে।
” আমি চলে যাচ্ছি এখন।আপনি দয়া করে মুহুর খেয়াল রাখবেন।মুহুর সাথে কোনো অযত্ন বা কিছু খারাপ হলে আমি কিন্তু তা হজম করবো না।
জাহিনের কথায় আশ্চর্য দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে মুনা।এই অবস্থায় কি করে তার বোনকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবলো লোকটা?এতটা নির্দয় কি করে হয় মানুষ?একবার তো মনে হচ্ছে প্রচন্ড ভালোবাসে আরেকবার মনে হচ্ছে কেবলি তার দায়িত্ব পালনে অধিনস্ত!ততক্ষণে চলে গেল জাহিন।হাতে তার সময় সীমিত!
জীবনের এই পর্যায় এসে জাহিন খুব বাজে ভাবে উপলব্ধি হলো ডাক্তারি পেশা টা আসলেই ভালো নয়!যে পেশা কিনা মানুষকে তার ব্যাক্তিগত জীবণ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে দেয়!পরিপূর্ণ জীবণ দিতে পারে না।ইচ্ছে করছে ছেড়ে দিক এই অভিশপ্ত পেশা!
~~~
ঘড়িতে রাত দুটো বাজে।সারাদিন পেরিয়ে রাতের দিকে ঘুম ভাঙ্গলো মুহতাসনিমের।মাথার ভার টা খানিক কম মনে হলেও মস্তিষ্ক তার ফাঁকা লাগছে!পাশে খেয়াল হতেই দেখে ঘুমাচ্ছে মুনা।জাহিনের কথা মনে হতেই আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো।পরক্ষণে তড়াৎ করে খাট থেকে নেমে বাইরে চলে আসলো।দুপদাপ শব্দ পেতেই ঘুম ছুটে যায় মুনার।বোনকে ছুটতে দেখেই পিছু ডাকে,
“মুহুপু?
চলন্ত পা দুটি থেমে যায় মুহতাসনিমের।ঘার ঘুরিয়ে প্রথমেই জিগ্যেস করে,
” ডাক্তার কই?
ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে আসে মুনার।এই রাতবিরেতে তার মুহুপু ডাক্তার খুঁজছে কেন?শরীর কি খারাপ লাগছে তার?নাকি বাবার শোকে পাগল হয়ে গেল!ভাবতেই কলিজা কেঁপে উঠল মুনার!শুকনো ঢোক গিলে বলল,
“তুই ডাক্তার কে খুঁজছিস কেন আপু?
চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ মুহতাসনিমের।এমনিতে তার মায়ের আচরণ ভালো ছিল না।সবার সামনে কত ছোট করে দিয়েছে তাকে।জাহিনের জন্যে মনটা আকুপাকু করে উঠে!পাছে আবার কি না শুনিয়ে দিলো তাকেও!ততক্ষণে মুনা আবারও বলছে,
” আপু তোর কি শরীর খারাপ করছে?
ফোঁস করে দম ছাড়ে মুহতাসনিম।পরক্ষণে বলে,
“ইয়ারকি ভালো লাগছে না মুনা।আমার মনটা এমনিতে প্রচন্ড খারাপ।তোর জিজু কোথায় সেটা বল।
মুনা কেবল হা করে বোনের কথা শুনছে।হঠাৎ ডাক্তার খুঁজছে তো আবার হঠাৎ জিজুকে খুঁজছে!মাথায় কি তালগোল পাকালো তার মুহুপুর?ভয় নিয়েই বলল মুনা,
” চলে গেছে।তোমার শাশুড়ী আর মিনা খালাও চলে গেছে।
মুনার কথায় অবাক হলো না মুহতাসনিম।নিশ্চয়ই তার মা তাদের সাথে খুব বাজে ব্যবহার করেছে!নয়তো যাওয়ার কোনো কারণ খুঁজে পেল না মুহতাসনিম।চোখ বুজে ছোট্ট শ্বাস ছাড়ে।লজ্জায় কান দিয়ে কেমন ধোঁয়া নিসৃত হচ্ছে!ধীর পায়ে খাটে এসে বসে মুহতাসনিম।হাত পা শক্তিশূন্য লাগছে।কাল থেকে যে ভালো মতো খাবারও পেটে পরেনি।সম্মুখে আসে মুনা।ইতস্ততভাব মুখে।জড়োসড়ো হাত দুটি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।পরক্ষণে বলে,
“তোর খুব খিদে পেয়েছে তাই না মুহুপু?
চোখ তুলে তাকায় মুহতাসনিম।বোন কিভাবে তার মনের কথাটা বুঝে ফেলল!ভরসা,ভালোবাসার এই একটা জায়গায়ই খুঁজে পেয়েছে!হোক দুজন ভিন্ন মায়েদের গর্ভে,একই বীর্যে তো জন্ম তাদের!পিতা তো দুজনেরই একটা!মুহতাসনিম কে অবাক করে দিয়ে বলল মুনা,
” অনেক চেষ্টা করেও তোর জন্যে একটুখানি খাবারের ব্যবস্থা করতে পারলাম না।মা দিলোই না।
ছোট থেকে তো এমনটাই হয়ে আসছে কখনও গরম গরম খাবার কপালে জোটেনি।বেঁচে যাওয়া খাবার খেয়েই দিন কাটতো!আজ এই দুর্দিনেও মায়ের মন একটুখানি গলল না।মা জাতটাকেই বুঝতে পারে না মুহতাসনিম।কখনও মনে হয় মমতাময়ী কখনও মনে হয় পাথর হৃদয়নী!মুহতাসনিম কেমন মা হবে জানে না।মায়ের সংস্পর্শ,মাতৃত্বের আদর কিছুই যে জোটেনি!পেটে ঘুটঘুট শব্দ হচ্ছে।খিদের মাত্রা বাড়ছে।মনের দহনের তাপে খিদে টা মিইয়ে গেল!মিনমিন গলায় বলল মুনা,
“আমিও খাইনি মুহুপু।তবুও মা একটুখানি খাবার দিলো না।
ছোট্ট বোনটার মুখের দিকে তাকাতে পারে না মুহতাসনিম।বড্ড কষ্ট হয়।তার দোষের সাজা বোন পাবে কেন?মলিন মুখে হাসি টানতে চাইলো মুহতাসনিম।বিষন্ন মুখে হাসি টা নিতান্তই বড্ড তুচ্ছ মনে হলো!
” তুই কেন অভুক্ত থাকবি?শরীর খারাপ করবে মুনা।তুই খেয়ে নে।
জেদ ধরে বলে মুনা,
“খাবো না মানে খাবই না।কষ্ট পেলে দু বোন একসাথে পাবো।
উঠে দাঁড়ায় মুহতাসনিম।বোনটাকে বুকে চেপে ধরে।কান্নারা আর বাধ মানেনি।পুরো শরীর কাঁপিয়ে অশ্রুপাত হয়।
~~~
রাত তিনটে!ঘন আধার কালো আকাশ!ঘুম নেই জাহিনের চোখে।হাসফাস লাগছে কেমন।তার মুহু কি করছে?ঘুম ভেঙ্গেছে তার?একটা কি ফোন করে দেখবে?চঞ্চল আনমনা হয়ে আছে মন টা।বাড়ি ফেরার এত তীব্র তাগিদ আগে কখনও অনুভব করেনি জাহিন।ভেতরের ছটফটানি তাকে দু দন্ড স্থির থাকতে দিচ্ছে না।এই যে কালকে মেয়েটাকে দিব্যি বুকের মাঝে নিয়ে সান্ত্বনা দিয়েছিল আজ সে বুক টাই কেমন ফাঁকা লাগছে!অবশ্য পারুল বেগমের জন্য ভয় টা দ্বিগুণ হয় জাহিনের।মহিলাটা কে বিন্দু পরিমাণ সুবিধার লাগেনি।
~~~
ঘড়ির কাটা সকাল আটটায়।ঘর ভর্তি বাজার দেখে চক্ষু চড়কগাছ পারুল বেগমের!এর আগে এত বাজার, সদাই-পাতি তার বাড়িতে প্রবেশ করেনি।হিসেব করলে দেখা যাবে দিব্যি ছয় মাস অনায়াসে পাড় করতে পারবে!এটা যে মুহুর শহুরে জামাইর কান্ড বুঝতে বাকি রইল না পারুলের!খুশিতে ভেতর খানা তার গদগদ করে উঠে!কাল রাতে চাল খানা ঠিক চেলেছে ভাবতেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে!নিশ্চিত মুহু তার জামাইকে কালকে ফোন করে বলেছে সে না খেয়ে আছে!সেই ফলস্বরূপ আজ এই সদাই-পাতি!
বাজারের সাথে একটা খাম’ও আসলো পারুলের কাছে।খামটা তড়িৎ গতিতে খুলে দেখে পারুল।যা ভেবেছিল তাই!টাকা দেখে মাথা ঘুরে পরে যাবার পরিক্রম!এতগুলো টাকা সে মোটেও আশা করেনি!এই টাকায় তার সামনের আরও ছয় মাস দিব্যি ভালো চলে যাবে!পরক্ষণে ভাবে এটা আবার মুহুর জন্য পাঠায়নি তো?!সে যাই হোক টাকা তো কখনই মুহুর হাতে হস্তান্তর করবে না পারুল।
এতদিনে মনের খায়েশ পূর্ণ হলো পারুলের।সোনার ডিম পারা হাঁস পেল বলে!লোকদিয়ে বাজার গুলো ভেতরে নেওয়ার ব্যবস্থা করলো।সদর দরজায় কর্কশ পুরুষালি কন্ঠে কেউ বলে উঠলো,
“কি পারুল বেগম!সংসার তো ভালোই সচ্ছল মনে হচ্ছে!
তৎক্ষনাৎ দরজায় তাকাতেই আৎকে উঠে পারুল বেগম!স্বগোতক্তি করে বলে,
” জুয়েল মির্জা!
চলবে…..
#মেঘবতীর_শহরে
পর্ব-৪৭
নাদিয়া ইসলাম সানজিদা
,
,
গমগম পরিবেশ মুহূর্তেই নিস্তব্ধ!আগের কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিল পারুল।এই জন্যই বলে বেশি খুশি হতে নেই পরে দুঃখের ছোঁয়া লাগে।শুকনো ঢোক গিলে পারুল বেগম।পরক্ষণে কান্না জড়ানো কন্ঠে বলে,
“কি সর্বনাশ টা হইলো আমার।মাথার উপরের ছাদ টাই চলে গেছে।সব শেষ আমার।
আস্বস্ত কন্ঠ জুয়েল মির্জার।
” এত চিন্তা কিসের?আমি তো আছি।
মুহূর্তেই ভয়ানক ভাবে কেঁপে উঠে পারুল।এই ভয়টাই যে পাচ্ছিলো!শেষে এই ভয়টাই কিনা চেপে ধরলো!পুনরায় বলে জুয়েল মির্জা,
“এবার আপনার কথা রাখবার সময় এসেছে।
মাথা ভঁনভঁন করে ঘুরছে পারুলের।দুঃসময়ে মাথা প্রায় অকেজো হয়ে গিয়েছিল তার।জোকের বশে ভুলভাল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো!এখন তা বুঝতে পারছে সে কতখানি ভুল করেছে!তার মাশুল তো এখন গুনতেই হবে!সবকিছুর জন্যে মুহতাসনিম দায়ী!এই মেয়েটাকে উচিৎ ছিল কবেই জ্যান্ত পুতে দেয়া নয়তো বিষপান করে মেরে ফেলা!জুয়েল মির্জা ফের বললেন,
” আমি সব বন্দোবস্ত করছি।৩৮ দিন পর আপনার মেয়ে মুহতানিম কে ঘরে তুলবো।
বুকের মধ্যিখান টা ছ্যাত করে উঠে পারুলের।নিজের চোখে এখন মেয়ের জীবন শেষ হতে দেখবে।মা হয়ে মেয়েকে আগুনে নিক্ষেপ করে দিলো!ভাবতেই কলিজা কেঁপে উঠে!মুহুর জন্যে আজ তার এই দিন দেখতে হচ্ছে!সবটাই দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতে হবে এখন।পেটের মেয়েকে বাঁচাতে যে মুখ বুজে থাকতে হবে।
~~~
দুপুর নাগাদ বেশ ভালো ভালো খাবারের আয়োজন হয়েছে।তাতে অবশ্য মুহতাসনিমও সামিল ছিল।মায়ের এমন আচরণে সে বরাবরেই অবাক হয়েছে!বেশ খাতির যত্ন করছে পারুল বেগম।যা মুহতাসনিম কল্পনায়ও আশা করেনি!মুনা বার কয়েক চোখের পলক ফেলে মায়ের কান্ড দেখছে,অবাকের রেশ বুঝি তাকেও ছুঁয়েছে!খাওয়া শেষে মুনা উঠে যেতেই তৎক্ষনাৎ মুহতাসনিমের সম্মুখে আসে পারুল।চেপে ধরে মুহতাসনিমের হাত।অবাক দৃষ্টি নিয়ে তাকায় মুহতাসনিম!পারুলের চোখদুটো কেমন করুণ লাগছে!মুখখানা ফ্যাকাসে!কোনো কি আবদার আছে তার?
জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মুহুর।তড়িঘড়ি করে শুধু এতটুকুই বলল পারুল,
“জরুরি কথা আছে মুহু।রাতে আমার সাথে সময় করে দেখা করবি।খবরদার মুনা যেন না জানে।
বলেই ফের নিজের কাজে ব্যস্ত হয় পারুল।ততক্ষণে হাত ধুয়ে চলে এসেছে মুনা।অজানা এক ভাবনার রাজ্যে ডুবে যায় মুহতাসনিম।তার মায়ের এমন কর্মকান্ডের সাথে পরিচিত নয়!হাত ধরা তো দূর থাক ভালো করে তাকিয়ে পর্যন্ত কখনও কথা বলেনি পারুল।সেই পারুল কিছু বলতে চাইছে!তার মানে ব্যাপারখানা সামান্য হবে বলে মনে হয় না।তবে বিষয়টা ঠাহর করতে পারলো না মুহতাসনিম।
~~~
শহরের জ্যাম ঠেলেঠুলে ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি চালাচ্ছে জাহিন।রাত্রি প্রহর এখন।তার যাত্রা উদ্দেশ্যে মুহতাসনিমের বাড়ি।হসপিটাল থেকে লম্বা ছুটি নিয়ে এসেছে জাহিন।জীবণ টাকে এভাবে হেলাফেলা করে ফেলে রাখার কোনো প্রশ্নই আসে না।ছুটির জন্যে অবশ্য তাকে কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে খুব।
~~~
হাটু তুলে জানালার ধারে বসে আছে মুহতাসনিম।পাশে মুনা বসে কতশত কথা বলে যাচ্ছে।বাবার ভাবনায় ডুবে আছে মুহতাসনিম।আকস্মিক এমন মৃত্যু টা যেন মন মানতে পারছে না।ভাবলেই বুকটা ভার হয়ে আসে।নিশ্বব্দে চোখের জল গরায় মুহতাসনিম।অন্ধকার রুম হওয়ায় তা সহজেই দৃষ্টি এড়িয়ে যায় মুনার।এখন কেবল মুনার ঘুমিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় মুহতাসনিম।তারপর চুপিচুপি মায়ের ঘরে যাবে।হঠাৎ শোয়া থেকে উঠে বসে মুনা।পরক্ষণে বলে,
” আপু তুই যে এই লোকটাকেই বিয়ে করেছিস আমাকে আগে বললি না কেন?জিজুর নাম তো জাহিন আর তুই আমাকে ফোনে বলেছিলি আতিক!কিছুই বুঝতে পারছি না!
কাল থেকে কথাটা জিগ্যেস করার ফাঁকফোকর খুঁজছিলো মুনা।বোনের মনের অবস্থা দেখে জিগ্যেস করার সাহস করো উঠতে পারছিলো না।
শান্ত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে মুহতাসনিম।কোথা থেকে বলা শুরু করবে?চোখ জোড়া তার টলমল করছে!শুরু থেকে শেষ অব্ধি সবটাই বলে মুনাকে।তবে আতিকের ব্যাক্তিগত পারিবারিক ব্যাপার টা চেপে যায়।আতিকের মৃত্যু এবং পরবর্তী তে জাহিনের সাথে তার বিয়ে অব্ধি বলে।সবটা শুনে স্তব্ধ হয়ে আছে মুনা।এই জন্যেই তো কোনোকিছু তে হিসেব টা কেমন মিলছিলো না!তবে এতদিন তার মুহুপু তাকে এই বিষয়টি বলেনি বিধায় খানিক রাগ।নাক টেনে কাঁদছে মুহতাসনিম।
পারুল বেগম অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে চলে আসেন।দেরি সহ্য হচ্ছিলো না তার।এখনও মুহু যায়নি বিধায় নিজেই চলে আসে।দু বোনকে কথা বলতে দেখে রাগে গাঁ ফেটে পরার উপক্রম!দরজায় দাঁড়িয়ে শক্ত কন্ঠে মুহুকে ডাকে পারুল বেগম,
“মুহু আমার রুমে আয় একটু।
অন্ধকারে মায়ের কন্ঠ চিনতে তার ভুল হয় না।তড়াৎ করে খাট থেকে নেমে মুনার উদ্দেশ্যে বলে,
” তুই ঘুমা মুনা।আমি আসছি।
মুহূর্তের মধ্যে সবটা ঘটে যায়।মায়ের হঠাৎ আগমনে অবাক হয় মুনা।তার মুহুপুর সাথেই বা কি বলবে মা?ব্যাপার খানা ভাববার মতোই!তড়িৎ গতিতে মায়ের রুমের সামনে যায় মুনা।ততক্ষণে ভেতর থেকে দরজা লক করা।ভয়ে সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠে মুনার।আড়ি পেতে দাঁড়িয়ে থাকে বেশ খানিক সময়।নাহ!ওপাশ থেকে কোনো সাড়াশব্দ নেই!পরক্ষণে হতাশ হয়ে নিঃশব্দে হেটে চলে আসে।
~~~
অন্ধকার রুম।গুমোট ভাব হয়ে আছে চারিপাশ।বাইরে দমকা হাওয়া বইছে।জানালা লাগিয়ে পর্দা টেনে দিয়েছে পারুল।ইচ্ছে করে এতক্ষণ যাবৎ চুপ করে ছিল।তিনি নিশ্চিত তার মেয়েটা কান পেতে আছে বাহিরে।নিরবতা ভেঙে বলল মুহতাসনিম,
“কখন থেকে চুপ করে আছো!কি বলবে মা?
ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পারুল।পরক্ষণে বলে,
“বাইরে মুনা দাঁড়ায় ছিল।এখন চলে গেছে।নিশ্চিন্তে সব বলা যাবে।
মায়ের দিকে মনোযোগী দৃষ্টি মুহতাসনিমের।মুখখানা করুণ করে বলতে শুরু করে পারুল,
” জুয়েল মির্জাকে তো চিনস!তোর সাথে যে বিয়ে ঠিক ছিল।পরে তুই পালায় যাওয়ার পর মুনারে চাইছিলো আমি দেইনি।তুই ঢাকা যাওয়ার পর সংসারের হাল একেবারে বেহাল দশা হয়ে গিয়েছিল।তার মধ্যে তোর বাবা অসুস্থ হয়ে যায়।রোজ রোজ মেলা টাকার ঔষধ পত্র লাগতো।এত খরচ বহনের সাধ্য যে আমাদের নাই খুব ভলো করে জানস তুই।মুনা জানতো তুই ঢাকায় কই থাকস।কতবার বলছি আমারে নিয়া যা নয়তো ফোন ধরাই দে তোর বাপের অবস্থা টা ছেমড়ি জানুক।কিন্তু মুনা তার কথায় অবিচল ছিল।মিথ্যা বলছে আমারে।তোর সিম নাকি হারায় গেছে।ফোনে পাওয়া যায় না।একদিন দরজা আটকায়া ইচ্ছামত মারছি। সেদিন আমারে বলছে তোর নাকি শহরের এক উকিলের সাথে বিয়ে হয়ে গেছে।এখন যদি বাড়ির এই অবস্থার কথা বলি তাহলে সব ছেড়ে ছুড়ে এসে পরবি তুই।
মাঝে দম নেয় পারুল বেগম।স্তব্ধ হয়ে মায়ের কথা শুনছে মুহতাসনিম।তার বোনটা কত কষ্ট সহ্য করেছে তার জন্যে!ফের বলতে শুরু করে পারুল,
“এর পরদিন গেলাম জুয়েল মির্জার কাছে।যে মেয়েরে পেটে ধরছিলাম সে মেয়ের মায়া ত্যাগ করে তারে বললাম আমার মুনার সাথেই বিয়ে হবে আপনার।বিনিময়ে নিলাম লাখ খানেক টাকা।এ জন্মে এ টাকা শোধ করার মতো সাধ্য আমার নাই।ঔষধদের যা ঋণ ছিলো মিটাইলাম।দিন দিন তোর বাপের অবস্থা খারাপই হতে থাকলো।অবস্থা যখন বেশি খারাপ তখন দেখি মুনা তোরে কল দিছে।মন টার মধ্যে অসহ্য কষ্ট অনুভব করলাম সেদিন।চিৎকার করে বলছি ‘খোদা তুমি যদি তারে নিয়া যাও তাহলে তাড়াতাড়ি নিয়া যাও।ওই মাইয়া যেন বাপের মরা মুখ খানি দেখতে না পারে’ শেষে লোকটা আর বাঁচলো না।তড়িঘড়ি করে দাফনের ব্যবস্থা করতে বললাম।একটা কথা কি জানস মুহু?মানুষ যখন উপরে উঠে তখন মাথা নিচু কইরা নিচের মানুষ জনদের দেখে না।বরং পারা দিয়া মিশাইয়া দেয় মাটির সাথে।যেমন টা তুই করলি।
ডুকরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে মুহতাসনিম।মায়ের কথা গুলো কান্নার বাধ মানলো না।তার কি উচিৎ ছিল না যেচে একবার বাবা,মায়ের সাথে কথা বলতে?সে পরিস্থিতি তে কি ছিল মুহু?তার জীবণ টা যে একটা ঝরে তছনছ হয়ে গিয়েছিল!
বোনটাও তো পরিবারের এই অবস্থা ঘুনাক্ষরেও তাকে বুঝতে দেয়নি।বোনের ভালো করতে গিয়ে অজান্তেই আরও কষ্টের সাগরে ভাসিয়ে দিলো!
কাঠ কাঠ গলায় বলল পারুল,
” তোর সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছা ছিল না আমার।দেয়ালে পিঠ ঠেকছে আমার।নয়তো তোর মুখ ও দর্শণ পাপ!
কথাগুলো পায়ের তলা থেকে মাটি কেড়ে নেওয়ার মতো!শক্ত হয়ে কেবল দাঁড়িয়ে আছে মুহতাসনিম।চারিদিক কেমন ঝাপসা লাগছে তার কাছে!এত কষ্টের ভার মস্তিষ্ক সইতে পারবে তো?
পারুল বেগম তার মতো করে বলে যাচ্ছে,
“জুয়েল মির্জা আজকে আসছে।তোর বোনের বিয়ের প্রস্তাব নিয়া।জোকের বশে যতই কিছু করি না ক্যা এখন তো বুঝতাছি কি ভুল করছি!আমার এমন ফুলের মতো মেয়েটারে অকালে শেষ কইরা দিমু আমি।
বলেই কান্নায় ভেঙে পরে পারুল।আচলে মুখ গুঁজে কাঁদে।ভাঙা কন্ঠে আওয়াজ তোলে মুহতাসনিম,
” তোমার একটা সিদ্ধান্তের কারণে জীবণ আজ এখানে মা।সেদিন যদি তুমি এই জুয়েলের সাথে আমার বিয়ে ঠিক না করতে,না আমি পালাই আর না মুনার আজ এই দশা!
তেতে উঠে বলে পারুল,
“তোর গতি তো ভালোই হইছে!বড়লোক উকিল জামাই পাইছস!কপাল তো খুলছে তোর।আর আমরা সবদিক দিয়া’ই শেষ।তার দায়’ও তোর!
মাথাটা এবার সত্যি ভঁনভঁন করছে মুহতাসনিমের।যে কোনো সময় মাটিতে লুটিয়ে পরবে।বন্ধ রুমে দমটাও আটকে আসতে চাইছে।এত অসহ্য অনুভূতি কেন?
চোখ মুছে বলল পারুল বেগম,
” জুয়েল মির্জার টাকা পরিশোধ তুই করবি।আমার মাইয়ার জীবণ আমি শেষ হইতে দিমু না।শেষ ভরসা এখন তুই।
হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ে মুনা।শব্দ করে বলে,
“মুহুপু দরজা খোল।জিজু এসেছে।
এলোপাতাড়ি পা ফেলে দরজার কাছে আসে মুহতাসনিম।চোখদুটো ঝাপসা হয়ে আছে।হাতটা ভিষণ রকম কাঁপছে!কোনোরকম দরজার ছিটকিনি টা খুলে দেয়।বিদ্ধস্ত মুহতাসনিম কে দেখে আৎকে উঠে জাহিন!কিছু বলার আগেই মাথা ঘুরে জাহিনের উপর পরে যায় মুহতাসনিম।দুহাতে সামলে ধরে দাঁড়ায় জাহিন!
চলবে……..