মেঘবতীর_শহরে,পর্ব-৪৮,৪৯

0
643

#মেঘবতীর_শহরে,পর্ব-৪৮,৪৯
নাদিয়া ইসলাম সানজিদা
৪৮
,
,
বাইরে তীব্র বৃষ্টি হচ্ছে।খোলা জানালার পর্দাগুলো বাতাসে দুলছে।মুহতাসনিমের মুখের পানে নিষ্প্রভ তাকিয়ে আছে জাহিন।ঘুমন্ত মুহুর দিকে অপলক দৃষ্টি তার!মলিন মুখেও কতখানি মায়া এসে ভর করেছে!

খানিকক্ষণ আগে পারুল বেগমের সাথে এক দফা কথা কাটাকাটি হয় জাহিনের।মহিলা তার সাথে দিব্যি ভালো আচরণ করেছে।দোষ গুলো নিজের উপর নিয়ে নিয়েছে অনায়াসে।তবে জাহিনের রাগের কারণে কথা কাটাকাটি হয় অনেকটা।মহিলাটাকে বেশ রহস্য লাগে জাহিনের!

ভাবনা কাটিয়ে মুহতাসনিমের দিকে তাকায় জাহিন।আলতো করে হাত রাখে কপালে।থেমে থেমে সর্বমুখ ছুঁইয়ে দেয় একটুখানি।চোখ বুজে আছে মেয়েটা।খানিকক্ষণের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে।খেয়াল হতেই জাহিন দেখে সকালের সেই কাঁদা মাখা জামাটা এখনও গায়ে জড়িয়ে আছে!ভ্রুজোড়া কুঞ্চিত হয়ে আসে জাহিনের।সারাদিনে একবারও ফ্রেশ হবার সময় পায়নি মেয়েটা!

~~~

সারারাত তুখোড় বৃষ্টি হবার পর সকালটা কেমন ঝকঝকে হয়ে আছে!ভোরের নরম লালচে আলোয় মুখরিত আকাশ!জানালা গলে আধো আলো বিরাজ করছে রুম জুড়ে!ঘুম ছুটে গেছে মুহতানিমের।শক্ত কিছুর সাথে আটকানো মনে হচ্ছে শরীর টা!মাথাটা প্রচন্ড ভার লাগছে।কপাল কুচকে পাশে তাকাতেই বড়সড় ধাক্কা খায়!জাহিন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে শুয়ে আছে!আচমকাই মুহুর মনে হলো হাতপা দুটি শীতল হয়ে আসছে তার!সর্বাঙ্গ ছুঁয়ে দিচ্ছে এক অদ্ভুত শিহরণ!লোকটা কখন এসে এভাবে জড়িয়ে শুয়ে ছিল!পায়েল তলানি শিরশির করছে মুহুর।কোনোরকম জাহিনের হাতদুটো ছাড়িয়ে উঠে বসে মুহতাসনিম।

ততক্ষণে ঘুম ছুটে যায় জাহিনের।নির্বিকার ভঙ্গিতে কেবল তাকিয়ে থাকে সামনে থাকা মুহতাসনিমের পানে।তড়িৎ গতিতে উঠে বাইরে যাওয়ার জন্যে কয়েক পা এগুতেই চলন্ত পা জোড়া থেমে যায় মুহতাসনিমের!গায়ে তার অন্য জামা!পাশে মেঝেতে পরে আছে তার কালকের পরিহিতা জামা!বুক ধ্বক করে উঠে মুহতাসনিমের!কি হয়েছিল কাল?অজানা কারনে গণ্ডস্থল শুকিয়ে আসে!জাহিনের কন্ঠস্বর পেতেই ভয়ানক ভাবে চমকে উঠে মুহতাসনিম!

“মুহু আপনি ঠিক আছেন?

পেছন ঘুরে’ই দাঁড়িয়ে ছিল মুহতাসনিম।কোনো কথা তার কর্নপাত হচ্ছে না।কেবল কালকের চিন্তাটা কামড়ে ধরে আছে মস্তিষ্কে!চোখ বুজে বড় করে দম নেয় মুহতাসনিম।পরক্ষণে সোজাসাপটা বলে,

“আমার গায়ের জামাটা পাল্টে গেল কি করে ডাক্তার সাহেব?

জাহিন যেন এই প্রশ্নটার অপেক্ষাতেই ছিল।মুহু এতক্ষণ যাবৎ বিব্রতবোধ করছে কেবল এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই।তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলে জাহিন,

“আমি পাল্টে দিয়েছি মুহু।

ভয়ানক ভাবে শরীর কেঁপে উঠে মুহতাসনিমের।এই ভয়টাই তো গ্রাস করছিলো তাকে!চোয়াল শক্ত হয়ে আসে মুহুর।এভাবে একটা অচেতন মানুষের অসহায়ত্ব তে সুযোগ নেওয়া টা অন্যায়!

ফের বলে জাহিন,

” জামাটা নোংরা ছিল মুহু।ওপাশে আপনার বোনকে ডেকে আনার মতো মানসিক অবস্থায় ছিলাম না আমি।আপনার ব্যাগ থেকে জামা নিয়ে পাল্টে দিয়েছি।স্বামী হিসেবে এতটুকু করা বোধহয় আমার অন্যায় কিছু হয়নি।আপনি স্বাভাবিক হলে ভালো লাগতো আমার।

কাঠ কাঠ গলায় বলল মুহতাসনিম,

“আপনি অবশ্যই অন্যায় করেছেন ডাক্তার সাহেব।ঘোর অন্যায় করেছেন।

কপাল কুঁচকে আসে জাহিনের।এরুপ কেন বলছে মুহু?এখন অব্ধি কোনোকিছু তে জোড় করেনি মুহতাসনিম কে।অনুভূতি,ইচ্ছা তার’ও ছিল।দিনশেষে সে’ও একজন পুরুষ!এই পুরুষত্ব টাকে একপ্রকার জোর করেই দমে রেখেছে জাহিন।তবে মুহু কি করে বলল সে অন্যায় করেছে!নিজের কাছে খানিকটা লজ্জিত জাহিন।

চোখ বেয়ে অনর্গল পানি পরছে মুহতাসনিমের।চোখ মুছে বলল মুহতাসনিম,

” ভালোবাসা ছাড়া ছোঁয়া যায় না ডাক্তার সাহেব!আমাদের সম্পর্ক টা আর দশটা স্বাভাবিক সম্পর্কের মতো নয়!আমাদের পথ চলা এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকুক।

বলেই হনহন করে বেরিয়ে যায় মুহতাসনিম।পাথরের ন্যায় স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে জাহিন।মেরুদণ্ড বরাবর শীতল শ্রোত বয়ে যায়!কি বলে গেল তার মেঘবতী!সম্পর্ক এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ!না এ জীবনে মুহুকে ছাড়া তার চলবে কি করে?

~~~

মেয়ের জামাই এসেছে সে’ই সুবাদে সকাল সকাল নানা খাবারের আয়োজন করেছে পারুল।শত হোক মেয়ের জামাইয়ের টাকায় করা বাজারপাতি!ত্রুটি তো কোনোমতে রাখা যাবে না।ফ্রেশ হয়ে খাবার রুমে আসে মুহতাসনিম।মুনা ছুটে এসে বোনের কপাল,গালে হাত বুলিয়ে নেয়।চিন্তিত গলায় বলে,

“মুহুপু ঠিক আছিস তুই?

মলিন হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বলে মুহতাসনিম।পারুল বেগম খাবার বাড়তে বাড়তে বলেন,

” জামাই কি উঠে নাই এখনও?কালকে রাতে কি হইছে যে এমন মাথা ঘুইরা পইরা গেলি!জামাই বাবা যে রাগ হইছিল!ভয়ে তো শেষ আমি!

চুপচাপ খাচ্ছে মুহতাসনিম।পরক্ষণে মুনার উদ্দেশ্যে বলল,

“তোর ভাইয়া রুমে’ই আছে নাস্তাটা দিয়ে আয়।

বাধ্য মেয়ের মতো নাস্তা নিয়ে চলে যায় মুনা।পারুল বেগমও খেতে বসে মুহতাসনিমের উদ্দেশ্যে বললেন,

” টাকার ব্যাপারটা জামাই বাবারে বলছিলি?

মেঝেতে স্থির দৃষ্টি নিয়ে বলে মুহতাসনিম,

“টাকার কথা আমি কোনোদিন তাকে বলতে পারবো না মা।সব কিছু করতে বা বলতে একটা অধিকার থাকা দরকার।যাই হোক এর জন্যে বিকল্প উপায় আমি ভেবে রেখেছি।

চোখমুখ কুচকে বলে পারুল,

” টাকা ছাড়া তো আমার মুনারেই নিয়া চলে যাবে জুয়েল।তোরে এত কইরা বললাম কালকে!আসলেই সৎ তো সৎই থাকে আপন হয় না কোনোদিন।

নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে মুহতাসনিম,

“জুয়েল মির্জাকে আমি’ই বিয়ে করে নিবো মা।তোমার মুনার কিছু হবে না।

আচমকা বজ্রের মতে চমকে উঠে পারুল।কানে কি কিছু ভুল শুনলো?অমন উকিল জামাই রেখে অর্ধবয়সী জুয়েল কে কেন বিয়ে করতে চাইছে মুহু?সন্দিহান গলায় বলে পারুল,

” এটা কি তোর জামাই মানবো?নাকি বনিবনা নাই তোদের মাঝে?আমার তো কিছুই ভালা মনে হইতাছে না!

কোনো কথা তোয়াক্কা না করে বলে মুহতাসনিম,

“তুমি শুধু প্রস্তাব টা রাখো জুয়েল মির্জার কাছে।বাকিটা আমাকে জানিও।

” তুই তো বিবাহিতা এখন।জুয়েল যদি রাজি না হয় তোরে বিয়া করতে?

দৃষ্টিতে রাগ নিয়ে তাকায় মুহতাসনিম।তেজি কন্ঠে বলে,

“তার তো বড় একটা মেয়ে আছে।সে’ও বিবাহিত।এমন তো নয় যে জুয়েল অবিবাহিত ছেলে।বরং সে বিবাহিত অর্ধ বয়সী পুরুষ!

খাবার থালাটা নিয়ে পুনরায় ফিরে আসে মুনা।পাশে চমকে তাকায় মুহতাসনিম।খাবারের প্লেটে দৃষ্টি রেখে বলে,

” ডাক্তার খায়নি?

মুনা দু দিকে মাথা নেড়ে না বলে।পরকক্ষে বলে,

“অনেক জোড় করেছি বলল খাবে না।তোমাকে ডাকছে।

মুনার হাত থেকে খাবার প্লেট নিয়ে উপরের ঘরের দিকে এগোয় মুহতাসনিম।

~~~

জানালার বাইরে নিশ্চুপ তাকিয়ে আছে জাহিন।ভেতরটা আজ সত্যিই ভেঙ্গে চুরমার!এই কদিনে মুহতাসনিম তাকে একটুও বুঝলো না?

” নাস্তা খেলেন না কেন?

মুহতাসনিমের কথায় সম্বিৎ ফিরে তাকায় জাহিন।ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

“ক্ষিদে নেই!

খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলে মুহতাসনিম,

” ডেকেছিলেন আমায়?

ঘুরে মুহতাসনিমের চোখের দিকে তাকায় জাহিন।চোখ দুটো ঈষৎ লালচে হয়ে আছে জাহিনের।মলিন মুখখানি তে চোখ জোড়া নিষ্প্রভ হয়ে তাকিয়ে আছে!ও চোখে তাকাতে পারে না মুহতাসনিম।ভেতরে কেমন তোলপাড় বইয়ে দেয়!অভ্যক্ত কোনো কিছু কি লুকায়িত ওই চক্ষু জোড়ায়?আদৌ সে চোখের ভাষা বুঝতে চেষ্টা করেছে মুহতাসনিম?নিরবতা ভেঙে জাহিন বলে,

“সম্পর্ক সবসময় ভালো হয় না মুহু।শেষে আমার কথাটা মিলল না?নিজের কথায় নিজেই তো হেরে গেলেন মুহু।

চুপচাপ কেবল তাকিয়ে আছে মুহতাসনিম।খানিকক্ষণ আগে কত বড় সিদ্ধান্ত টা নিয়ে এসেছে।আদৌ ঠিক করেছে কিনা জানা নেই।একবার কি জাহিনের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন ছিল?যে লোক সম্পর্কের মূল্য দিতে জানে না ভালোবাসা বোঝে না তার থেকে দূরে চলে আসাটাই সমীচীন।

কন্ঠ ধরে এসেছে জাহিনের।কম্পিত কন্ঠ নিয়ে বলল,

” আমার জীবনের ছোট্ট একটা গল্প আছে মুহু।আপনি কি শুনবেন?

কতদিনের অজানা অনেক প্রশ্ন!তার উত্তর জানতে যেন মরিয়া হয়ে ওঠে মুহতাসনিম।তৎক্ষনাৎ বলে,

“হ্যাঁ বলুন।

শান্ত নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে জাহিন,

” খুব ছোট বেলায় বাবাকে হারিয়েছি।তবে আমার বাবা কিন্তু মারা যায়নি।মা মণির সাথে বাবার পরিচয় অনেক আগে থেকেই ছিল।ভালোবেসে বিয়ে বলতে পারেন।তবে সেটা ক্ষনিকের পরিচয় মাত্রও বলা চলে।বিয়ের কয়েক মাস হতে’ই বাবার ব্যস্ততা বাড়তে থাকে প্রচুর।আমার বাবা একজন নিষ্ঠাবান এবং দায়িত্বপরায়ণ ডাক্তার ছিলেন।উনি একজন নিউরোসার্জন।অধ্যক্ষ ডাক্তার জয় চৌধুরী।এখনও বেশ খ্যাতি আছে ভদ্রলোকের।বিয়ের এক বছরের মাথায় যখন আমার জন্ম হয় তখন বাবার ব্যস্ততা তখনও কাটেনি।সদ্য ভূমিষ্ট হওয়া সন্তানের মুখ তিনি দেখতে আসলেন না।আমার যখন ছয় মাস তখন বাবা প্রথম দেখতে আসে আমাকে।এবং সেদিনই আমার মাকে বলে,”আমার মনে হয় এ সম্পর্কে থাকাটা আমাদের উচিৎ নয়।তুমি স্বাভাবিক জীবন পাচ্ছো না নবনী।তার চেয়ে ভালো তুমি ভালো কাওকে দেখে বিয়ে করে নাও,আর আমার পরিচিত অনেক নিসন্তান দম্পতি আছে যে কাউকে বললেই জাহিন কে এডপ্ট করে নিবে।

স্তব্ধ হয়ে জাহিনের কথা শুনছে মুহতাসনিম।কি হয়েছিল ছোট্ট জাহিনের সাথে?চোখের কোণা চিকচিক করছে জাহিনের।চোখমুছে ফের বলে,

“মা মণি ভেবেছিল বাবা বুঝি অন্য কারো সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে গেছে।কিন্তু তেমন কিছুই ছিল না।ইতিহাস পড়েছেন মুহু?বহু মানুষ নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে অন্যের সেবায় বিলিয়ে দিয়েছে নিজেকে!কোনো পিছুটান তাদের আটকাতে পারেনি।তেমনি আমার বাবার লক্ষ্য ছিল এমন কিছুই।মাঝে আবেগে জড়িয়ে আমার মা মণির সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে যায়।তবুও থেকে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল মা মণি।বাবা একসময় পুরোপুরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।আমার যখন চারবছর তখন সব ছেড়ে ছুঁড়ে চলে আসে মা মণি।এর পর থেকে দ্বিতীয় বার আর কারো সাথে সম্পর্কে জড়ায়নি।আমাকে নিয়েই এতটা পথ চলেছে।

মুহতাসনিম ভাবছে পেশায় একজন ডাক্তার বলে পরিবার পরিজন দের সময় দেওয়া এতটাই দুষ্কর?কই দেশে তো বহু ডাক্তার আছে তাদের কি পরিবার,সংসার সন্ততি নেই?তবে জাহিনের বাবার ভাবনা টা এমন কেন ছিল?

ভাঙা কন্ঠে বলে জাহিন,

” ভালোবাসা নিঃস্বার্থ কে বলে মুহু?স্বার্থ ছাড়া কেউ ভালোবাসে না।মায়া বড্ড অদ্ভুত মুহু!মায়া ত্যাগ করা যায় না।এই যে আমার বাবার পেশাটার প্রতি এতই মায়া যে তিনি জগৎ সংসার সব ছেড়েছুড়ে চলে গেছেন।তবে সংসারের মায়া এবার বুঝি বেঁধে দিলো তাকে।শুনেছি বছর কয়েক আগে বিয়ে করেছেন ভদ্রলোক।তারপর আর জানি না।

মুহতাসনিম কিছু বলার আগেই জাহিন বলল,

“ভাববেন না আমি এমন মুহু।আপনার প্রতি আমার আকাশসম মায়া!যে মায়া এ জন্মে কাটবার নয়!আপনার সাথে আমার বিচ্ছেদ ঘটলে জগতের সবাই বলবে ছেলেটা পুরোপুরি বাবার মতোই হয়েছে অথচ ভেতরের গল্পটা শুধু আমরা জানবো।রবীন্দ্রনাথের একটা উক্তি শুনেছেন মুহু?

পাওয়া কাকে বলে যে মানুষ জানে না, সে ছোঁয়াকেই পাওয়া মনে করে।

____রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

” এ জন্মে আপনাকে আমার পাওয়া হয়ে গেছে মুহু।আপনি মুক্ত বিহঙ্গ!ধরে রাখবার মতো অধিকার আমার নেই!তবুও বলবো আপনাকে আমার সত্যিই পাওয়া হয়ে গেছে মুহু!

তিরতির চোখে তাকায় মুহতাসনিম।চোখ বুঝি তারও জলে ঠাসা!বক্ষস্থলে অজানা কম্পন!এতটা অবুঝ কি করে হলো মুহু?একটা মানুষকে এটুকু বুঝলো না?বেখেয়ালি হয়েই বলে মুহতাসনিম,

চ’লে যাওয়া মানেই প্রস্থান নয়- বিচ্ছেদ নয়,
চ’লে যাওয়া মানেই নয় বন্ধন ছিন্ন
করা আর্দ্র রজনী।
চ’লে গেলে আমারো অধিক কিছু
থেকে যাবে আমার না-থাকা জুড়ে।

— রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ

পরক্ষণে জাহিনের অক্ষিতে দৃষ্টি রাখে মুহতাসনিম।দু জোড়া চোখ জলে ভাসছে!জীবণ তাদের কোথায় নিয়ে দাড় করাবে জানা নেই!জীবণ বড্ড অদ্ভুত!বড্ড বিচিত্র!বড্ড রহস্য!

শুনশান নিরবতা বিচ্ছিন্ন করে বলে জাহিন,

“আমি আপনাকে একটুখানি শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে চাই মুহু!

মুহু খানিকক্ষণ চুপ থেকে ধীর পায়ে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে জাহিনকে!আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে জাহিন।এতখানিই শক্তপোক্ত করে জড়িয়ে নেয় এ জন্মে যেন মুহুকে হারালেও তার আফসোস থাকবে না!আজন্ম মুহুর গায়ের গন্ধ লেপ্টে থাকবে বক্ষস্থলে!কি অদ্ভুত অনুভূতি শিরা-উপশিরায়!

চলবে……

#মেঘবতীর_শহরে
পর্ব-৪৯
নাদিয়া ইসলাম সানজিদা
,
,
সকাল সকাল বাড়িতে এসে বসে আছে জুয়েল মির্জা।সাথে করে ঢের বাজারপাতি,ফলমূল কোনো কিছুই বাদ রাখেননি।ভয়ে জবুথবু হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে আছে পারুল।দূর থেকে সন্দিহান দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে মুনা।জুয়েল মির্জার আগমন মোটেও ভালো কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে না!তবে কি তার মা নতুন কোনো ফন্দি আঁটলো বোনকে শায়েস্তা করতে?ভাবতেই একরাশ ঘৃনা এসে ভর করলো মায়ের প্রতি।এই মুহূর্তে বোনের কাছেও যেতে পারছে না যে তাকে আগাম সতর্ক করে দিবে!

পারুল কিছুক্ষণ আগে মুনার থেকে জানতে পেরেছে মুহুর জামাই শহরের একজন বড় নামকরা ডাক্তার!এমন হীরার মতো স্বামী রেখে কেন জুয়েল মির্জাকে বিয়ে করতে চাচ্ছে মুহু?বড় লোকদের ব্যাপার স্যাপার অত কিছু বোঝে না পারুল।এটুকু বুঝতে পারছে স্বামীর সাথে বনিবনা নেই মুহুর!তবে যাই হোক মুহু যে চরম লেভেলের বোকা মেয়ে সেটা আরও একবার প্রমাণিত হয়ে গেল!ছোট থেকেই এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়ে এসেছে পারুল।তবে আজ এর ব্যতিক্রম হবে কেন?জুয়েল মির্জার কথায় ভাবনার রেশ কাটে পারুলের।

“কই ডাকেন আপনার ছোট মেয়েকে।একপলক দেখে যাই।শত হোক কয়দিন পর তো আমারই বউ হবে।

চুপ করে জুয়েল মির্জার কথা শুনছে পারুল।আজ যদি জুয়েল মির্জা বিবাহিত অর্ধ বয়সী পুরুষ না হতো তাহলে বিনা দ্বিধায় মুনাকে তার হাতে তুলে দিতো।প্রাচীন কালের জমিদার বংশ জুয়েলের।দশগ্রাম নামডাক!এমন ঘরে মেয়ে দেওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপারই বটে!পারুলের এই স্বপ্ন টা মুহুকে দিয়ে পূরণ করতে চেয়েছিল।ভাগ্যের জোরে সব ওলোটপালট হয়ে গেল!নিশ্চুপ পারুলের দিকে তাকিয়ে বলে জুয়েল মির্জা,

” চুপ ক্যান?এখন যদি আপনার মত পাল্টান তাহলে এই মহূর্তে আমার টাকা বাবদ ফিরিয়ে নিয়ে যাবো আমি।একটা কানাকড়িও রেখে যাবো না।

চট করেই বলল পারুল,

“আমি তোমার সব টাকা যদি এক্ষুনি শোধ কইরা দেই কথা দাও তুমি আমার মুনারে বিয়ে করতে চাইবা না?

খানিক নড়েচড়ে বসে জুয়েল।পারুল বেগম এমন কিছু বলবে ভাবতেও পারেনি।পরক্ষণে মনে হলো সে একটা চরম বোকামি করে ফেলেছে!পারুলের বড় মেয়ের শশুড় বাড়ি যে শহরে!নিশ্চয়ই অনেক টাকার মালিক হবে তারা!আর সেই দাপটে পারুল এত কথা বলছে!গলা ঝেড়ে কেশে বলে জুয়েল,

” টাকা পেলে আর তোমার মেয়েকে নিবো কেন?শর্ত হচ্ছে ঠিক একঘন্টার মধ্যে আমার সব টাকা চাই!

দূর থেকে মায়ের সাথে জুয়েল মির্জার কথোপকথন দেখছে মুনা।কি বলছে ঠাহর করতে পারছে না।তবে মাকে কেমন বিচলিত লাগছে!আর জুয়েল কে চিন্তিত লাগছে!কি কথা হচ্ছে তাদের মাঝে জানার জন্যে যেন মরিয়া হয়ে উঠে মুনার মন!হঠাৎ মুনা খেয়াল করে তার মা দ্রুত গতিতে সিড়ি ভেঙ্গে উপরে যাচ্ছে।পিছু ছোটে মুনাও।যাই হয়ে যাক আজ সে বোনের ব্যাপারে প্রতিবাদ করেই ছাড়বে!মায়ের অন্যায় যে আর সহ্য হচ্ছে না!

~~~

বারান্দায় দু মাথায় দুজন আড়াআড়ি ভাবে দাঁড়িয়ে আছে।মহুর অতীতটাও আজ সে সম্পূর্ণ মেলে ধরেছে জাহিনের কাছে।কতটা অবহেলা,কষ্ট নিয়ে সে এটুকু পথ এসেছে।আগের বার বিয়ের আসর ছেড়ে পালানোর ঘটনাটাও এখন পরিষ্কার জাহিনের কাছে!মায়েরা এত নিষ্ঠুর কি করে হয় জানা নেই জাহিনের।সে তো নিজের মাকে দেখে ভাবতো জগতের সব মায়েরা’ই কেবল ভালো হয়।নাহ!জাহিনের সে ধারণা সম্পূর্ণ ভুল প্রমানিত হলো!হোক অন্যের সন্তান!দিনশেষে সেও তো একজন মা!

দরজায় তীব্র কড়াগাত পেতেই দুজনে হকচকিয়ে উঠে!চোখ মুছে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয় মুহতাসনিম।অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে পারুল।ভিষণ উদ্বিগ্ন লাগছে তাকে!সোজা প্রশ্ন ছোড়ে পারুল,

“জামাই বাবা কই মুহু?

পেছনে ভ্রু কুঞ্চিত করে দাঁড়িয়ে আছে মুনা।কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না।মুহতাসনিম ছোট্ট করে কেবল বলল,

” ভেতরে বারান্দায় আছে।

মুহতাসনিম কে একপ্রকার ঠেলেঠুলে ভেতরে প্রবেশ করে পারুল।এরুপ আচরণে হতভম্ব মুহতাসনিম!জাহিনের সম্মুখে এসে কাকুতি মিনতির স্বরে বলে পারুল,

“বাবা লাখ খানেক টাকা লাগতো আমার।তোমার দেওয়ার স্বার্থ আছে আমি জানি।আমার মেয়ের জীবন এখন তুমিই বাঁচাইতে পারবা।

ততক্ষণে মুনা আর মুহতাসনিমও এসে দাঁড়ায়।শুরু থেকে কোনো কথা বোধগম্য হচ্ছে না মুনার।মুহতাসনিম কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছে।সকালে মাকে বলে দিয়েছিল জুয়েল কে সে বিয়ে করে নিবে।কোনোকিছু না ভেবেই অশান্ত মস্তিষ্কে বলে দিয়েছিল কথাটা!তবে তার মা টাকা চাচ্ছে কেন এখন?জাহিন অবাক দৃষ্টি নিয়ে কেবল তাকিয়ে আছে।কি বলা উচিত এখন তার?মস্তিষ্ক শূন্য মনে হচ্ছে!পারুল বেগম ফের মুহতাসনিমের দিকে তাকিয়ে কান্নারত কন্ঠে বলল,

” জুয়েল নিচে আছে।বলছে এই মুহূর্তে টাকার ব্যবস্থা করলে আমার মুনারে সে বিয়ে করবে না।

মায়ের কথায় সপ্তম আসমান থেকে যেন ধপ করে মাটিতে পরে মুনা!এসব কি শুনছে সে?তার বিয়ে এই জুয়েল মির্জার সাথে!তীব্র ঘৃনার দৃষ্টি নিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে মুনা।মুহতাসনিম ভাবছে জুয়েল মির্জা বোধহয় তাকে বিয়ে করতে রাজি হয়নি তাই মা তাকে সরাসরি টাকার কথা বলেছে!পারুল উদভ্রান্তের মতো বলে যাচ্ছে,

“সময় তো শ্যাষ হইয়া যাইতাছে!টাকার ব্যবস্থা করো বাবা।

শান্ত ভঙ্গিতে কেবল বলে জাহিন,

” পুরোটা কথা শেষ করুন আগে।সবটা জানতে হবে তো আমায়।

বিচলিত হয়ে বলে পারুল,

“জুয়েল মির্জার থেকে টাকা ধার নিছিলাম।মাইয়ার বাপে যখন অসুস্থ ছিল মেলা খরচ ছিল।খরচ মিটাইতে হিমশিম খাইতে হইতো।শেষে জুয়েল মির্জার কাছেই কর্জ নিতে যাই।এই টাকা শোধের ক্ষমতা আমার এ জন্মে নাই।সেটা জুয়েল মির্জাও জানতো।বলছি আমার ছোটো মেয়েরে তার কাছে বিয়ে দিবো।বিনিময়ে সেও রাজি হয়।এখন সে আসছে এই ব্যাপারে কথা বলতে।জুয়েল ভাবছে টাকা দিতে পারমু না,তাই টাকার কথা বলাতে কিছু না ভাইবা রাজি হইয়া গেছে।এহন সময় দিছে একঘন্টা!

বিস্ফোরিত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে জাহিন।মুনা সবে ছোট্ট মেয়ে!বয়স কত হবে তার!বড়জোর সতেরো!একজন অর্ধ বয়সী পুরুষ কি করে এমন কিশোরী মেয়ে কে বিয়ে করার ইচ্ছা পোষণ করে?বরাবরই রাগ উঠে জাহিনের।কাঠিন্যে দৃষ্টি নিয়ে সে বলে,

“আমি কথা বলছি তার সাথে।

মুনা পাথরের ন্যায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।পা দুটো মাটির সাথে যেন গেড়ে গেছে!পারুল,জাহিন আর মুহতাসনিম ছোটে নিচে।

~~~

আয়েসি ভঙ্গিতে বসে আছে জুয়েল।তার ধারণা এত টাকা একঘন্টায় দেওয়া সম্ভব নয়।মানুষ কি পকেটে টাকা নিয়ে ঘোরে নাকি?ভাবতেই ভেতরে পৈচাশিক হাসে!

” টাকাটা কি এক্ষুনি চাই?

একজন গম্ভীর শান্ত পুরুষালি কন্ঠস্বর কানে বেজে উঠে জুয়েলের।মুখ তুলে তাকাতেই দেখে যুবগ বয়সী এক ছেলে দাঁড়ানো!তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে আছে তার দিকে।বসা থেকে দাঁড়িয়ে বলল জুয়েল,

“এক্ষুণি টাকা চাই।সময় একঘন্টা!বিশ মিনিট চলে গেছে।নয়তো পূর্বের শর্ত বহাল থাকবে।পারুল বেগমের ছোট মেয়ে আমার হাতে তুলে দিবে।

চোয়াল শক্ত হয়ে আসে জাহিনের।

” টাকা টা অবশ্যই পাবেন।তবে আজ হবে না।কালকে অবশ্যই টাকাটা পরিশোধ হবে।একটা পয়সারও কমতি হবে না।

মুখ বাকিয়ে বলে জুয়েল,

“একটু আগে কি বললাম?তাহলে পূর্বের শর্তই থাক।নয়তো টাকার ব্যবস্থা করো।যত কথা বলবা সময় অতিবাহিত হবে।

বাঁকা হেসে বলে জাহিন,

” কিন্তু মুহতানিমের তো বিয়ে ঠিক।অন্যের বাগদত্তাকে আপনি কি করে বিয়ে করবেন?বড়জোর টাকাটা নিতে পারেন।

তিনজোড়া চোখ বিস্ফোরিত হয়ে জাহিনকে দেখছে।রেগে কটমট করে বলে জুয়েল মির্জা,

“তাহলে তো পারুল বেগম ঠকালো আমায়।লিখিত দলিল আছে আমার কাছে।টাকার পরিবর্তে মুহতানিম আমার বউ হবে।তবুও ছোটখাটো একটা শর্ত দিয়েছি ঘন্টায় টাকা শোধ হলে আমি এ দাবি ছেড়ে দিবো।

” কোথাও তো লিখা নেই এক ঘন্টায় টাকা শোধ করতে হবে।আর তা ছাড়া মেয়েটার অন্যত্র বিয়ে ঠিক!

“লিখিত আছে মেয়েটা আমার বউ হবে।টাকার হিসেব কোথাও নাই!এহন টাকা কি দিবা নাকি তর্কই করে যাইবা?সময় আর বিশমিনিট আছে।

জুয়েলের যুক্তির আছে হার মানে জাহিন।করার কিছুই যে নেই!কোনো রাস্তা খোলা রাখেনি জুয়েল!টাকা দেওয়াটাই মঙ্গলজনক!তবে এত সীমিত সময়ে কি করে দিবে জাহিন?এটা শহর নয় যে কয়েক মিনিটে টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে!শুকনো ঢোক গিলে বলে জাহিন,

” আমাকে আজকের দিনটা সময় দেওয়া হোক।

জুয়েল মির্জা তাতে নাখোশ করেন।এই সময়ের মধ্যেই তার টাকা চাই।কয়েক মিনিট চুপ থেকে বলে জাহিন,

“আপনি মুহতানিম কে কবে বিয়ে করবেন তার কোনো নির্দিষ্ট দিনক্ষণ উল্লেখ আছে দলিলে?

পারুল বেগম পাশ থেকে বললেন ” না”

কথা টেনে নিয়ে বলল জুয়েল,

“কিন্তু আমি তারে বলে গেছি সাইত্রিশ দিন পর তার মেয়ে আমি বউ করে তুলে নিয়ে যাবো।এতে দ্বিমত পোষণ করেনি পারুল।

তৎক্ষনাৎ জাহিন বলল,

” যদি এই সাইত্রিশ দিনের আগে মুহতানিমের বিয়ে হয়ে যায় তবে আপনি শুধু টাকা নিতেই বাধ্য থাকবেন।আর আঠারো হওয়ার আগে আপনি মুহতানিম কে বিয়ে করে ঘরেও তুলতে পারবেন না।আর যেখানে মুহতানিমের বিয়ে ঠিক,তারা কেবল আঠারো হলেই তাকে ঘরে তুলবে।

“কিন্তু দলিলে লেখা আছে মুহতানিম আমার বউ হবে।টাকার প্রসঙ্গ কেন আসছে?

” কারণ টাকার প্রসঙ্গ আপনি তুলেছেন।

জুয়েল বুঝতে পেরেছে যুক্তিতে পারবে না তাদের সাথে।মুহতানিমের বিয়ে অন্যত্র ঠিক করে ফেলবে তা আর বুঝতে বাকি নেই।কোনোমতেই ধরে রাখা সম্ভব নয়।নিশ্চুপ প্রস্থান করে জুয়েল।পরের টা পরের জন্যে ভেবে রাখে।

~~~

রাতের আকাশে মেঘের গর্জন!বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূর দৃষ্টি রাখে জাহিন।পারুল বেগম আজ তার কথায় বেশ চটেছেন।টাকাটা তৎক্ষনাৎ পরিশোধ করলে ঝামেলা মিটমাট হয়ে যেত।অনেক কথা বুঝিয়ে পারুল কে আশ্বাস দিয়েছে।জাহিন অন্য প্ল্যান কষেছে!আদৌ তাতে সফল হবে কিনা জানা নেই।

আচমকা তীব্র বজ্রপাত হতেই পেছন থেকে কোমল দুটি হাতে আবদ্ধ হয়ে যায় জাহিন।মৃদু চিৎকারের শব্দের সাথে কাচ ভাঙ্গার শব্দটাও কর্নকুহুরে ধাক্কা খায়!পাশে মেঝেতে কফি সমেত ভাঙ্গা মগের টুকরো গুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে!বজ্রপাতের কারণে যে মুহু খেই হারিয়ে ফেলেছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।ওষ্ঠকোণে এক চিলতে হাসি এসে ধরা দেয় জাহিনের।পরিবেশ স্বাভাবিক হতেই ছিটকে সরে দাঁড়ায় মুহতাসনিম।অপরাধীর মতো মুখ করে মেঝেতে তাকিয়ে বলে,

“আপনার কফি টা তো নষ্ট হয়ে গেল!আমি মাত্রই ডাকার জন্যে হাত বারিয়েছিলাম হুট করে বজ্রপাত হলো আর!আমি এক্ষুনি আরেক মগ কফি করে দিচ্ছি!

পেছন থেকেই মুহুর হাত চেপে ধরে সামনে তাকায় জাহিন।মুহতাসনিম আজ শাড়ি পরেছে দেখে এক দফা চমকে ওঠে!বিদ্যুতপিষ্টের আলোয় থেমে থেমে অন্ধকারে জ্বলে ওঠছে মুহুর মুখ খানি!দৃষ্টি বুঝি খানিক অন্যত্র সরে আসে জাহিনের!শুভ্র বর্নের কটিদেশে শাড়ির আঁচল গুঁজানো!মুহুর হাত টেনে আরও খানিকটা সামনে দাঁড় করায় জাহিন।আচমকা চোখমুখ খিচে উঠে মুহুর!অন্ধকারে এটুকু দৃশ্য জাহিনের দৃষ্টি গোচর হয়ে রয়!জড়ানো কন্ঠস্বর জাহিনের।আলতো হাতে মুহুর খোপা ছেড়ে আসা চুলগুলো কানের পেছন গুজে দিতে দিতে বলে,

“তোমার মুখ এত মায়াবী কেন মুহু?বহু আগে এমনই এক বৃষ্টিস্নাত রাতে কোনো মেঘবতীর মায়া মোহে ডুবেছিলাম!সেখান থেকে যে মন কে আর ফেরাতে পারিনি!বোকা মন বোঝেনি কতটা চাইতো তোমায়!যে চাওয়া আত্নায় আত্নায় মিশে এক সত্তার হয়ে যায়!

জাহিনের বলা তুমি সম্মোধনে বেশ অবাক হয় মুহতাসনিম!তারচেয়ে বেশি অবাক হয় এটা শুনে জাহিন সে রাতের পর থেকেই একটু একটু করে বুকে পুষেছে তাকে!তার মানে তাকে বিয়েটা কেবলি দয়া মায়া আর করুণা ছিল না!ভাবতেই সর্বাঙ্গ শীতল হয়ে আসে মুহতাসনিমের।বক্ষস্থলে সৃষ্টি হয় কম্পন!তুমুল বৃষ্টিপাতের শব্দে এই শব্দটা বিলীন হয়ে যায়!নয়তো নির্ঘাত আজ এই শব্দ জাহিনের কান অব্ধি পৌছে যেতো!মৃদু কাঁপছে মুহুর শরীর।পায়ে হঠাৎ জ্বালা অনুভূত হতেই খেয়াল হয় তখন একটুকরো কাচঁ ফুটেছিল পায়ে।হাটু অব্ধি ধরে মৃদু আর্তনাদ করে উঠে মুহতাসনিম।সর্ব অনুভূতি কে দূরে ঠেলে বিচলিত হয়ে মেঝেতে বসে জাহিন।ঘরে জ্বলছে হলদে রঙা আলো!সে আলোয় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে পা কেটে রক্তে মাখামাখি মেঝে!তৎক্ষনাৎ মুহুকে কোলে তুলে নেয় জাহিন।চিন্তিত স্বরে বলে,

” বেশি লেগেছে মুহু?

মুহতাসনিম কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে জাহিনের পানে।চিন্তিত মুখখানি কি স্নিগ্ধ লাগছে!ততক্ষণে মুহতাসনিম কে খাটে বসিয়ে দেয় জাহিন।ফাস্টএইড বক্স নিয়ে এসে দ্রুত পায়ের কাছে এসে ব্যান্ডেজ করে দিতে থাকে।বেশি ক্ষত হয়নি।পায়ের কোণা বরাবর লেগেছে খানিকটা!

নিভৃতে গালে হাত রেখে জাহিনের দিকে তাকিয়ে আছে মুহতাসনিম!দৃষ্টি তুলে একবার মুহতাসনিমের দিকে তাকায় জাহিন।তড়িৎ গতিতে দৃষ্টি সরিয়ে নেয় মুহতাসনিম।আচমকা মুহুর পায়ের ব্যান্ডেজ করা জায়গায় ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দেয় জাহিন!সর্বাঙ্গ কেঁপে,চমকে উঠে মুহতাসনিম!কিছু বলার আগেই জাহিন বলে,

“কিছু হবে না।ঠিক হয়ে যাবে একদম।

ফের মুহুতে দৃষ্টি রাখে জাহিন।ও দৃষ্টিতে তাকাতে পারে না মুহতাসনিম!এক বিষাক্ত অনুভূতি যেন ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছে তাকে!পা দুটি গুটিয়ে নিয়ে বসে থাকে মুহতাসনিম।কন্ঠস্বর যেন খাদে জাহিনের!ততক্ষণে অনেকটা কাছে চলে আসে মুহতাসনিমের।

“মায়াবিনীতে যে দৃষ্টি পোড়ায়!”

বাইরে এখনও তীব্র বর্ষণ!এ বর্ষণ কি আজ সাক্ষী থাকবে ভালোবাসার?জাহিনকে আজ ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্য নেই মুহুর!দুজনের পিনপতন নিরবতায় ভারী নিশ্বাসের তাপে থমথমে হয়ে আছে চারিপাশ।আচমকা উঠে হনহন করে বারান্দায় চলে যায় জাহিন।ছোট্ট করে কেবল বলে যায়,

” ঘুমিয়ে পরো মুহু।

জাহিনের আচরণ বরাবরের মতো অবাক হয় মুহতাসনিম।লোকটাকে সত্যিই তার রোবট মনে হয়!খাট থেকে নেমে পা খুড়িয়ে বেলকনিতে চলে আসে মুহতাসনিম।পকেটে হাত পুরে দাঁড়িয়ে আছে জাহিন।পেছন থেকে ডাকে মুহতাসনিম,

“ডাক্তার? আপনি ঘুমাবেন না?

চকিতে ফিরে তাকায় জাহিন।ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে,

” এখানে অনেক কাঁচের টুকরো আছে মুহু।অসাবধানতায় দূর্ঘটনা হবে!নেমে এলে কি করে?

“আগে আপনি রুমে চলুন।এখানে থেকে বৃষ্টির ছাট লেগে ঠান্ডা জ্বর বাঁধিয়ে ফেলবেন।

পূর্নদৃষ্টি মেলে তাকায় জাহিন।দু একপা করে এগিয়ে এসে ফের কোলে তুলে নেয় মুহতাসনিমকে।পরক্ষণে বলে,

” বড্ড জ্বালাতন করো মুহু।সবটা বুঝতে চাও না।ঘুম আসবে না আমার।তুমি চুপচাপ ঘুমিয়ে পরবে এখন।

দুহাতে জাহিনের গলা জড়িয়ে ধরে মুহতাসনিম।বুকের মধ্যিখানে মাথা রেখে বলে,

“তাহলে আমিও ঘুমাবো না!

মুহুর কথাবার্তা আর সম্মোহনী দৃষ্টি বুঝি অনেক কিছু বলে দিচ্ছে আজ!তবে কি মুহতাসনিমকে ভালোবাসার সময় এসেছে?মায়া থেকে যে ভালোবাসার সৃষ্টি হয় তা যে ভিষণ প্রগাঢ় হয়!শান্ত কন্ঠেই বলল জাহিন,

” দুজন যে একসাথে জেগে থাকা যাবে না মুহু!তাহলে এই বৃষ্টিস্নাত রাত আজ অনেক কিছুরই সাক্ষী হয়ে যাবে যে!

জাহিনের প্রতিটি কথাই যেন লোমহর্ষক!কি ভয়ানক অনুভূতি!জাহিনের উত্তপ্ত প্রগাঢ় নিশ্বাস যেন চোখেমুখে আছড়ে পরছে!মৃদু হেসে জাহিনের চোখে চোখ রেখে বলে মুহতাসনিম,

“যে কোনো কিছুর সাক্ষী থাকা ভালো!

বাকি আর কথা বাড়াতে পারেনি মুহতাসনিম।একজোড়া উত্তপ্ত ওষ্ঠ জোড়ায় আবদ্ধ পরে নিজের ওষ্ঠযুগল!মুহূর্তেই বিকট শব্দে বজ্রপাত হয়!চোখমুখ খিচে উঠে মুহতাসনিমের!ধীর পায়ে হেটে রুমের দিকে এগোয় জাহিন!অজানা ভালো লাগা আবেশে শীতল হয়ে উঠে সর্বাঙ্গ!

চলবে……….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here