মেঘবতী_মিথ্যে_বলেনি,২৮,২৯,৩০

0
731

#মেঘবতী_মিথ্যে_বলেনি,২৮,২৯,৩০

।।২৮।।
এত দিন পর আচমকা মালিহা আপুর বাসা কোথা থেকে আসলো, মালিহা আপু এত দিন সেই বাসার কথা বলেনি কী কারণে, গাড়িতে উঠে সে কথা জিজ্ঞেস করবে কি করবে না, ভাবতে ভাবতেই সারা দিনের ক্লান্তিতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল আনান। ঘুমের মধ্যে আজব সব ছেঁড়া ছেঁড়া দুঃস্বপ্ন দেখছিল।
তার ঘুম ভাঙল মালিহা আপুর জোর ঝাঁকুনিতে। ঘুম থেকে উঠে প্রথম কিছু ক্ষণ কিছুই বুঝতে পারছিল না আনান।
এটা কোন জায়গা?
মালিহা আপু তার স্বভাবের একেবারেই বিপরীত নরম গলায় বলল, “আনু, চলো, নামো আমরা চলে এসেছি বাসায়!”
উবারের ড্রাইভার আর দারোয়ান দুজন মিলে ততক্ষণে আনানের জিনিসপত্র তুলে দিয়ে গেছে লিফটের ভেতরে। মালিহা আপুর আম্মু বোধ হয় জেগেই ছিলেন, এক বার কলিং বেল বাজলেই দরজা খুলে গেল।
বাসায় ঢুকে মালিহা আপু খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, “আম্মু ও আনান, আমার রুমমেট। আমরা এক সপ্তাহ আমার রুমটায় থাকব।“
সালাম দিল আনান। মালিহা আপুর আম্মু আপুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “খেয়ে এসেছ তোমরা?”
“বাসায় খাবার আছে কিনা তা তো জানতাম না। আমি রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে বিরিয়ানি কিনে এনেছি। তোমাদের ঝামেলা করতে হবে না। তুমি শুধু আমাদের দুইটা প্লেট পাঠিয়ে দাও আমার রুমে।“
ব্যাগ থেকে চাবির গোছা বের করে একটা ঘরের তালা খুলে ভেতরে ঢুকে মালিহা আপু বলল, “এসো আনু। এটা আমার ঘর।“
আনান ট্রাংক নিয়ে ঘরে ঢুকে বিভ্রান্ত হয়ে বলল, “আপনার ঘর? আপনার ঘর তো আপনি এখানে থাকেন না কেন?”
মালিহা আপু প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, “বলব পরে। তুমি ফ্রেশ হয়ে কাপড় বদলে খাও। খিদে পেয়েছে আমার। খেতে হবে। বারোটা বেজে গেছে সেই খেয়াল আছে?”
ট্রাংক খুলে কাপড় বের করে নিয়ে রুমের সাথে এটাচড বাথরুমে ফ্রেশ হতে গেল আনান। কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না সে।
সব কেমন ঘোরের মত লাগছে। বের হয়ে দেখল মালিহা আপু দুটো প্লেট এনে রেখেছে।
“আসো। সবাই মনে হয় শুয়ে পড়েছে, ডাইনিং রুমে আর না যাই। এখানে বসেই খেয়ে নিই।“
বিছানায় বসে খেতে খেতে মালিহা আপুই কথা শুরু করল প্রথমে, “এটা আমারই বাসা, কিন্তু কিছু সমস্যার কারণে আমি এখন আর এখানে থাকি না। আমার বিয়ে হয়েছিল, ডিভোর্স হয়ে এই বাসায় ফিরে আসবার পরে ভাইয়ের বউয়ের সাথে টুকটাক ঝামেলা লেগেই থাকত। আমি এই জন্য চাকরি পাওয়ার পর রুমটা তালা লাগিয়ে রেখে বাইরে চলে গিয়েছিলাম থাকতে। এই রুমটা আমার। ভাগ্যিস রুমটা ছাড়িনি, না হয় এই এত রাতে তোমাকে নিয়ে কোথায় উঠতাম?”
হাসল মালিহা আপু। আনান কী বলবে ভেবে পেল না।
“এখন তোমার কথা বল। এ রকম কীভাবে হলো?”
“আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না, আপু!”
খাওয়া শেষ করে প্লেট নিয়ে গিয়ে রেখে এলো মালিহা আপু। এই ঘরের আলমারি আর ওয়ার্ডরোবে এখনও তার জামা কাপড় রাখা, বোঝা যাচ্ছে।
ওয়ার্ড রোব থেকে বাসায় পরবার কাপড় নিয়ে জামা বদলে শুয়ে পড়ল মালিহা আপু।
“আচ্ছা আমার স্কুল আছে সকালে, আমি ঘুমাই আনু। বাকি কথা পরে হবে।“
সেমি ডাবল খাটের ভেতরের দিকে দেয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে প্রায় সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়ল মালিহা আপু। এত ক্ষণ ঘুমে দুই চোখ ভেঙে আসছিল আনানের, কিন্তু শোবার সাথে সাথেই ঘুম উড়ে গেল চোখের পাতা থেকে।
কী থেকে কী হয়ে গেল, কোনো হিসাবই মেলাতে পারছিল না সে।
রাতে কখন ঘুমিয়েছে, বলতে পারবে না আনান। সকালে ঘুম ভাঙল মালিহা আপুর এলার্মের শব্দে।
আপু বলল, “তোমার ক্লাস কখন আজকে? ভার্সিটি তো দূর এখান থেকে, একটু আগেই রওনা দিও!”
এ কথায় আনানের মনে পড়ে গেল গত কাল নোটিশ জারি হয়েছে পরবর্তী নোটিশ না পাওয়া পর্যন্ত তার ক্লাসে যাওয়া নিষেধ। গত কাল এত কিছুর মধ্যে আর এটা বলাই হয়নি মালিহা আপুকে।
এখনো বলতে ইচ্ছে হলো না। শুধু গলার মধ্যে দলা পাকিয়ে উঠছে কেমন একটা কষ্ট।
আচমকা কেনই বা সব এক সাথে এ রকম এলোমেলো হয়ে যেতে হবে? চিন্তারা কেমন মাকড়সার জালের মত জড়িয়ে পেঁচিয়ে ধরছে তাকে চারিদিক থেকে।
“আচ্ছা আনু আমি গেলাম, আম্মুকে বলে দিয়ে গেছি তোমাকে নাস্তা রেডি করে রেখে দেবে, তুমি যখন ওঠো উঠে খেয়ে নিও। আমার স্কুল দূরে এই বাসা থেকে, আমার আর সময় নাই।“
ছোটাছুটি করে বেরিয়ে গেল মালিহা আপু, আনান চেয়ে চেয়ে দেখল শুধু। যেন বিছানা ছেড়ে উঠবার শক্তিটাও হারিয়ে ফেলেছে সে।
সারা শরীর জুড়ে আশ্চর্য এক অবসাদ ভর করেছে। গত কালকের ঘটনা মনে পড়ে এক এক বার শিউরে শিউরে উঠছে সমস্ত শরীর।
কী হতে যাচ্ছিল এবং কী হতে পারত ঠিক সময় মত বাড়িওয়ালা আন্টি চলে না আসলে, ভাবতেও চায় না আনান।
কিন্তু কথা হচ্ছে, তার ব্যাগে কনডম রাখল কে? আর কেনই বা তার ফোন থেকে সেই লোককে ফোন করা হলো?
কে এবং কেন তার ফোন থেকে মালিহা আপুর নাম্বার ব্লক করেছিল যাতে মালিহা আপু তাকে ফোন করে নিশ্চিত না হতে পারে যে সে আসলেই এক্সিডেন্ট করেছে কিনা? মালিহা আপু তো বলল দরজা বাইরে থেকে তালা আটকেই বেরিয়েছিল সে।
তাদের বাসার চাবি ওই লোকটা কোথায় পেল? এত গুছিয়ে ষড়যন্ত্র কে করল?
কেন করল?
রাশি রাশি প্রশ্নেরা যখন ঝাঁকে ঝাঁকে ভিড় করছিল আনানের মনে, সেই সময় বেজে উঠল তার ফোনটা। স্ক্রিনের ওপরে ভেসে উঠেছে জিসানের নাম।
জিসান!
কাজী অফিসের সেই ঘটনার পর জিসানের চোখে চোখে তাকাতে পারত না আনান। কেমন একটা অদ্ভুত লজ্জায় ছেয়ে যেত মনটা।
যেন ছোট হয়ে গেছে সে জিসানের চোখে। কোনো দোষ না করেও হয়ে গেছে দোষী।
যেন সেই লজ্জাটুকু বুঝতে পেরেই লজ্জার ওপরে আরো লজ্জা না দেওয়ার জন্যই জিসান নিজেও আর তাকাত না তার দিকে। এইটুকু খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারত আনান।
আর মনে মনে কৃতজ্ঞ বোধ করত জিসানের প্রতি। সত্যি বলতে, জিসানের সাথে গল্প করবার কিংবা আড্ডা দেওয়ার কোনো স্মৃতি না থাকলেও এই রকম হিতৈষী বন্ধু ক্যাম্পাসে এখন পর্যন্ত তার আর এক জনও নেই।
বেজে বেজে কেটে গেল ফোনটা। আবার দ্বিতীয় বার ফোন করল জিসান।
এবার ফোনটা রিসিভ করল জিসান। “হ্যালো” বলবার সাথে সাথেই প্রায় চিৎকার করে বলল, “এনি! কোথায় তুই?”
কী যে হলো, কান্নায় ভেঙে পড়ল আনান।
“কাঁদছিস কেন গাধার মত?”
“নোটিশ দেখিস নাই তুই?”
“হ্যাঁ দেখেছি! কিন্তু তাতে কী? এই ক্যাম্পাসের ছাগলটাও জানে যে এক্সামে আনফেয়ার মিনস করবার মত স্টুডেন্ট তুই না!”
এত কষ্টের মধ্যেও হেসে ফেলল আনান। “ক্যাম্পাসে কোনো ছাগল নাই ইয়ার!”
“ছাগল না থাকলে কি আর এই রকম নোটিশ লিখতে পারে? তুই আয় তো! আমি দেখছি ব্যাপারটা!”
“সত্যি তুই দেখবি?”
“অবশ্যই আমি দেখব? ফাজলামি নাকি? থাপড়ায়ে দাঁত ফেলে দেব না সব কয়টার? শালারা কার রোল লিখতে গিয়ে কার রোল লিখে নোটিশ বের করে কে জানে! তুই আয় ক্যাম্পাসে আগে!”
আনান কিছুটা দ্বিধা করে বলল, “জিসান, আমি আসলে একটু প্রবলেমে আছি!”
“কী প্রবলেম? শেয়ার কর! টাকা লাগবে? লোন দেব?”
“না না সে রকম কিছু না!” আনান নিচের ঠোঁট কামড়ে বলল, “একটু লং স্টোরি!”
“কীসের লং স্টোরি! তোর সেই ফ্লপ হিরো আবার কোনো ঝামেলা করেছে?”
“আরে না না সে রকম কিছু না!”
“তাহলে?”
দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে জিসানকে ধীরে ধীরে সব কিছু খুলে বলল আনান। জিসানের অনেক ক্ষমতা, এটা মোটামুটি সবাই জানে।
হয়ত সেই পারবে তাকে সাহায্য করতে। সব শুনে গম্ভীর হয়ে গেল জিসান।
“তুই কোনো চিন্তা করিস না, এনি! আয়্যাম গন্না হ্যাণ্ডল দিস!”

#মেঘবতী_মিথ্যে_বলেনি
।।২৯।।
জিসানের ফোন রেখে আবার ঘুমিয়ে গেল আনান। সেই ঘুম ভাঙল বিকেল চারটায়।
এই অসময়ে কার কাছে খাবার চাইবে, কে আবার কী মনে করবে ভেবে বের হলো না রুম থেকে। ওর ট্রাংকে লুকিয়ে রাখা বিস্কিটের বোয়াম বের করে বিস্কিট খেয়ে রুমেই বসে রইল গুম হয়ে।
মালিহা আপু ফিরে এলো সন্ধ্যায় দু হাত ভর্তি শপিং ব্যাগ নিয়ে। ড্রয়িং রুমে সবাইকে ডেকে নিজের মা বাবা, ভাই ভাবী, ভাইয়ের বাচ্চা সবার প্যাকেট বুঝিয়ে দিয়ে আনানের দিকেও যখন একটা প্যাকেট বাড়িয়ে দিল আনান প্রতিবাদ করে বলল, “আমার জন্য কী দরকার ছিল আপু?”
মালিহা আপু রুমের দিকে যেতে যেতে আনানকে কঠিন ধমক দিয়ে বলল, “সব সময় ইগো প্রবলেমে ভুগে সব কিছু নিয়ে একটা না একটা ঝামেলা করো না তো আনু! দরকার ছিল কি ছিল না আমি তো বুঝেই এনেছি!”
আনান প্যাকেট খুলে দেখল তার জন্য নতুন টুথ ব্রাশ, একটা সাবান, ফেস ওয়াশ, আনান যে ব্র্যাণ্ড ব্যবহার করে সেই ব্র্যাণ্ডের এক পাতা মিনি প্যাক শ্যাম্পু, ক্রিমের কৌটা আরো আনুষঙ্গিক টুকিটাকি। এগুলো হচ্ছে সেই জিনিস যেগুলো গুছিয়ে আনতে পারেনি আনান, বাড়িওয়ালা আন্টি আর দারোয়ান দুজন মিলে রাস্তায় ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল তার সাইড থেকে।
মালিহা আপু তার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলল, “ধর! তোমার এত ইনফেরিয়রিটি কমপ্লেক্সের কিছু নাই! আমি তোমাকে কোনো দয়া দেখাচ্ছি না। লোন হিসাবে দিচ্ছি! এই যে বিল। পরে তোমার সময় সুযোগ মত টিউশ্যনির বেতন পেয়ে দিয়ে দিলেই হবে!”
আনানের চোখে পানি এসে গেল আচমকা। টাকার ঋণ তো শোধ করা যায় চাইলেই কিন্তু এই যে প্রয়োজন বুঝে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো ঠিক সময়ে এনে দেওয়া, এটা কজন পারে? কজন বোঝে?
আনানের ইচ্ছে হলো মালিহা আপুকে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু পারল না। আপুর সাথে সে রকম সম্পর্ক নয় তার।
আজ সারা দিন মেঘলা মেঘলা কেটেছে, ঝির ঝির বৃষ্টি পড়ছে এখন। ফ্রেশ হয়ে দু কাপ চা বানিয়ে বারান্দায় বসে মালিহা আপু বলল, “এবার বল তো আনু, তোমার এমন শত্রু কে হতে পারে?”
আনান অসহায়ভাবে বলল, “জানি না তো আপু!”
মালিহা আপু চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, “তোমার সেই বয়ফ্রেণ্ডের কী খবর?”
“আমাদের ব্রেক আপ হয়ে গেছে তো আপু!”
“ব্রেক আপ! কেন?”
রাস্তায় ল্যাম্প পোস্টের ঠিক নিচে বৃষ্টির ফোঁটাগুলোকে মনে হচ্ছে যেন আলোর ঝরনা। যেন তরল আলো ঝরে পড়ছে ফোঁটায় ফোঁটায়।
আনান সেই দিকে চোখ রেখে বলল, “ওর মা আমাকে পছন্দ করেননি আপু!”
মালিহা আপু কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল, “তোমাকে তো আমি স্ট্রং আর প্র্যাকটিক্যাল মেয়ে ভেবেছিলাম! কিন্তু তুমি কাজটা করলে কী? তোমাকে আমি এফেয়ার করতে বলেছিলাম, এই রকম ডুবে যেতে বলি নাই! এফেয়ার করলে ভালো কথা, একটু গা বাঁচিয়ে চলতে পারলে না? এত তাড়াতাড়ি ওদের বাসায় চলে গেলে?”
চুপ করে রইল আনান। আনান শুধু যে ওদের বাসায় গিয়েছে তাই নয়, কাজী অফিসে পর্যন্ত গিয়েছিল বিয়ে করতে, সেটা মালিহা আপুকে বলা হয়নি। সেটা বললে মনে হয় বকা খেতে খেতেই মরে যেতে হবে আনানের।
“এখন তো তোমার পড়াশোনাও হ্যাম্পার হবে! তুমি ওকে কতটুকু ভালোবাসো? মিস কর ওকে?”
আনান ভাবল কিছু ক্ষণ। তারপর মাথা নাড়ল খুব ধীরে ধীরে।
“মিস কর না? একটুও মিস কর না! এটা কীভাবে সম্ভব? ভালোবাসো না ওকে?”
“আমি ঠিক জানি না, আপু!”
“মানে?”
“মানে, যখন আমরা এক সাথে ঘুরতাম, কথা বলতাম, খেতাম তখন খুব ভালো লাগত! হ্যাঁ ডেফিনিটলি আমি সেই সুন্দর সময়গুলো মিস করি! কিন্তু যতটা ফাঁকা ফাঁকা লাগার কথা ছিল ঠিক ততটা লাগে না, কেন জানি না!”
“দ্যাট মিনস তুমি কখনো ওকে ভালোই বাসোনি!”
বৃষ্টির বেগ বেড়েছে, নিচে রাস্তায় সারি সারি গাড়ি বাস রিকশা মোটর সাইকেল আর সি এন জি আটকে আছে সিগন্যাল ছাড়বার অপেক্ষায়। আনান সেদিকে চোখ রেখে বলল, “হতে পারে।“
“হতে পারে মানে? এত দিন এক সাথে ঘুরলে কেন তাহলে?”
সিগন্যাল ছেড়ে দিয়েছে, যন্ত্র আর মানব চালিত যানবাহনগুলো মুহূর্তেই ফিরে পেল প্রাণ চাঞ্চল্য। আনান সেদিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “আসলে আপু, আমাদের ক্যাম্পাসে একটা আপু আছে খুব গসিপ বানাতে পছন্দ করে। আমি আর জিসান এক দিন উনার সামনে পড়ে গিয়েছিলাম। তো উনি যাতে গসিপ না বানায়, সেই জন্য জিসান আগ বাড়িয়ে অনেকগুলো কথা বলেছিল। আমার স্ট্যাটাস নাই, লেভেল নাই এই টাইপের কথা। আর এরপর ক্যান্টিনে যখন রুবাবাও একই কথা বলল, ঠিক সেই সময়ে সায়ান গিয়ে আই লাভ ইউ বলল, আমার কাছে মনে হয়েছিল আমিও জিসানকে, আর সবাইকে দেখিয়ে দিই আমারও কিছু কম নাই! আমারও বয়ফ্রেণ্ড থাকতে পারে, আমিও তাকে নিয়ে ঘুরতে পারি সবার সামনে, খেতে পারি ক্যান্টিনে, আমার বয়ফ্রেণ্ড নিয়ে আমিও নিউ কাপলদের মত ট্রিট দিতে পারি ফ্রেণ্ডদের…আর সায়ানও আসলে এত কেয়ারিং ছিল… এত কিছু যে হয়ে যাবে, আমি বুঝতে পারি নাই আপু!”
গলা ধরে এলো আনানের। মালিহা আপু কী বলবে ভেবে পেল না।
অনেক ক্ষণ পর বলল, “বী স্ট্রং আনু। নিশ্চয়ই সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু, আমি ভাবছি…”
চিন্তিত মুখে নিচের ঠোঁট কামড়াল মালিহা আপু। “তোমার এত বড় শত্রু কে থাকতে পারে এমন? এত গুছিয়ে কনস্পিরেসি করল? এত সুন্দর প্ল্যান! এত সুন্দর এক্সিকিউশন!”
“আমি জানি না আপু! জানা মতে কখনোই কারো কোনো ক্ষতি করিনি আমি।“
চা শেষ হয়ে গেছে অনেক ক্ষণ, আনান বলল, “আপু আপনার কথা বলেন!”
চমকে উঠল মালিহা আপু। “আমার? আমার আবার কী কথা!”
“আপনার কোনো কথা নাই বলার মত? এই যেমন, বাসা থাকতেও আপনি কেন বাসায় আসেন না?”
“এ তো বললাম আগেই! আমার ডিভোর্সের পর আমার ভাবী চেয়েছিল ভাইয়ার এক বিজনেস পার্টনারের সাথে আমার বিয়ে দিতে। আমার তাকে পছন্দ হয় নাই। আর ডিভোর্স তো বোঝোই, একটা ট্রমার মত। সারা ক্ষণ খোঁচাতে থাকলে কি আমি একটু নিজের মত নিরিবিলিভাবে থাকতে পারতাম?”
“তা তো ঠিকই”, মাথা নাড়ল আনান। এই জন্যই মালিহা আপুর মেজাজ খারাপ থাকে বেশির ভাগ সময়ই।
“আর আমার ছেলেটাকেও রেখে দিল ওর বাবা…”
“ছেলের বয়স কত ছিল আপু?”
“চার বছর, দিল না আমাকে!”
চুপ করে গেল মালিহা আপু। একটা অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে এলো বারান্দা জুড়ে।
বৃষ্টির ছন্দময় শব্দটা আরেকটু প্রবল হলো বুঝি।
“তুমি কি আরেকটু থাকবে আনু? থাকো তাহলে, আমি কাপগুলো নিয়ে যাই!”
আনান কিছু বলল না। সে জানে কাপগুলো রেখে ঘরে ফিরে এসে মালিহা আপু একটু কাঁদবে।
হয়ত নিজের জন্য কিংবা ছেলের জন্য। আনানের এখন ঘরে না যাওয়াই উচিত হবে।
শক্তিশালী মানুষগুলো নিজের চোখের জল কাউকে দেখাতে পছন্দ করে না, পছন্দ করে না নিজের কথা বলতেও। এই জন্যই নিজের চারপাশে তুলে রাখে কাঁটাতারের বেড়া।
আনান আজ নিজের অজান্তেই সেই বেড়া পার করে ফেলেছে, জেনে ফেলেছে মালিহা আপুর দুর্বলতা। তাই সম্ভাবনা প্রবল মালিহা আপু তাকে কিছুক্ষণ পরই কঠিন ঝাড়ি দেবে যে কোনো কারণে।
কিন্তু আনান আজ কিছু মনে করবে না তাতে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আবার রাস্তায় তাকাল সে।
একই ঘটনা শুধু অবস্থানের ভিন্নতার কারণে কতই না ভিন্ন হয়ে যায়। আজ এই বারান্দায় বসে এক কাপ চায়ের সাথে বৃষ্টি কতই না সুন্দর, কতই না উপভোগ্য ছিল।
কিন্তু যে মানুষটি সারা দিন অফিস করে বৃষ্টির মধ্যে জ্যাম ঠেলে বাসায় ফিরে যাচ্ছে কিংবা বৃষ্টির কারণে ডাক্তারের কাছে যেতে অনাকাঙ্খিত দেরি হয়ে যাচ্ছে যে রোগীটার, তার জন্য কতই না বিরক্তিকর!

#মেঘবতী_মিথ্যে_বলেনি
।।৩০।।
ফারুক আহমেদের ইচ্ছা করেই চেয়ারটা ঘুরিয়ে রেখেছেন অন্য দিকে। ছেলের চেহারাটাও দেখতে মন চাইছে না, এমনই বিরক্তি লাগছে তার দিকে।
জেসমিন চলে যাওয়ার সময় এই ঝামেলাটাকেও সাথে করে নিয়ে গেলে আজ আর এই দিন দেখতে হতো না।
জিসান কাঁচের টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, “আই ওয়ান্ট এন এন্সার আব্বু!”
ফারুক আহমেদ শীতল গলায় বললেন, “টেবিলটা কাঁচের, জিসান!”
“ইউ জাস্ট গো টু হেল উইথ ইওর টেবল! হোয়াট হ্যাভ ইউ ডান উইথ হার?”
“নাথিং মাচ। আই জাস্ট কেপ্ট মাই প্রমিস।“
জিসান সরোষে তাকিয়ে রইল তার দিকে পিঠ ফিরিয়ে সামনে বসে থাকা লোকটার দিকে। এই কুচক্রী লোকটা তার বাবা?
ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে তার।
“পেপার ওয়েটটা হাত থেকে নামিয়ে রাখো জিসান, এটা আমার অফিস! রাগের মাথায় আমার দিকে ছুঁড়ে টুড়ে মারলে সিকিউরিটির লোকজন এসে ধরে নিয়ে যাবে তোমাকে! তখন এক্সপ্ল্যানেশন হিসেবে এটা বলতেও আমার লজ্জা লাগবে যে ইউ হ্যাভ এটাকড মি ফর আ লোয়ার ক্লাস গার্ল! বলতে হবে তুমি আমার বিজনেস এম্পায়ার দখল করবার জন্য কাজটা করেছ! মিডিয়া আর নিউজপেপারগুলো খুব ভালো একটা হেডলাইন পাবে কাভার করবার জন্য!”
“ইউ…” কঠিন একটা গালি দিতে গিয়েও থমকে গেল জিসান।
আব্বু তার দিকে পেছন ফিরিয়ে বসা, তাহলে কীভাবে বুঝতে পারল সে নিজের অজান্তেই হাতে তুলে নিয়েছে স্টিলের ভারি শোপিস কাম পেপারওয়েটটা?
ফারুক আহমেদ হাসলেন। তার সামনে জানালার কাচে যে জিসানের প্রতিবিম্ব এবং বাকি সব ঘটনাই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, সেই রহস্য খোলাসা করলেন না।
“তুমি কি জানো না যে আমার পেছন দিকেও দুটো চোখ আছে?”
পেপারওয়েটটা নামিয়ে রাখল জিসান। অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করে বলল, “এই সব কিছুর পেছনে তোমার হাত আছে তাই না?”
কাঁধ ঝাঁকালেন ফারুক আহমেদ। “থাকতেই হবে! আমার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদের দিকে যে হাত বাড়াবে, সেই হাত আমি ভেঙে দেব সেটাই তো স্বাভাবিক, তাই নয় কি?”
“কোনটা তোমার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ? আমি! ওহ আব্বু! এনি আমার দিকে কোনো হাত টাত বাড়ায় নাই! ইন ফ্যাক্ট কিছু দিন আগেই ওর বয়ফ্রেণ্ড ছিল! সে কিছুই জানে না আমার ফিলিংসের ব্যাপারে! শি ডাজন্ট হ্যাভ স্লাইটেস্ট আইডিয়া এবাউট ইট! আমি ওকে বলিও নাই যে আই লাইক হার, আই ওয়ান্ট টু লিভ মাই লাইফ উইথ হার!”
“বলনি, এবং বলবেও না আর! ইটস এন অর্ডার!”
জিসান এবার কাতর গলায় বলল, “আব্বু প্লিজ! ইউ হ্যাভ টার্নড এভ্রিথিং ইনটু আ মেস! প্লিজ আব্বু তুমি আবার সব কিছু ঠিক করে দাও! আবার সব আগের মত করে দাও! আই বেগ ইউ!”
“ইন এক্সচেঞ্জ অফ হোয়াট?”
“কী চাও তুমি আমার কাছ থেকে?”
“আমি চাই যে তুমি ওই মেয়ের সাথে আর কোনো সম্পর্ক রাখবে না। মন থেকে ওর কথা একেবারে মুছে ফেলবে।“
“সম্পর্ক না হয় নাই বা রাখলাম কিন্তু মন থেকে মুছে ফেলা কি এতই সহজ?”
“সহজ। তোমার কাজটা সহজ করে দেওয়ার জন্যই তোমার সাথে আরেকটা চমৎকার মেয়ের এনগেজমেন্ট করে ফেলতে চাই আমি।“
“কে সে?”
“তুমি চেনো তাকে। সারা দিন তার সাথেই থাকো। আফসোস যে তুমি তাকে চিনতে পারলে না। শি ইজ আ রিয়েল জেম!”
একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলল জিসান। “রুবাবা?”
ফারুক আহমেদ চেয়ার ঘুরিয়ে তাকালেন জিসানের দিকে। হেসে বললেন, “আই হোপ ওর কম্প্যানি তোমাকে ওই দুই পয়সার রাস্তার মেয়েকে ভুলিয়ে দেবে।“
জিসান দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, “এনি দুই পয়সার রাস্তার মেয়ে না আব্বু!”
ফারুক আহমেদ শ্রাগ করে বললেন, “ওকে। দেন লেট হার সারভাইভ অন হার ওউন। তোমার কিংবা আমার সাহায্যের প্রয়োজন হচ্ছে কেন তার?”
জিসান এবার পুরোপুরি ভেঙে পড়া মানুষের মত বলল, “তুমি তাহলে এনিকে ছাড়বে না?”
“ইট টোটালি ডিপেন্ডস অন ইউ! তুমি এনগেজমেন্টের জন্য ইয়েস বলে দিলেই আবার সব আগের মত হয়ে যাবে!”
“ঠিক আছে বললাম ইয়েস। কিন্তু আমার আরো একটা শর্ত আছে!”
“বলে ফেলো।“
“এনিকে একটা জব খুঁজে দিতে হবে। এমন একটা জব যেটা ও স্টুডেন্ট থাকা অবস্থায় পার্ট টাইম করতে পারবে। আমি জানি তুমি চাইলেই পারবে। আর এই জব পাওয়ার পেছনে যে আমার কোনো হাত আছে সেটা যেন এনি জানতে না পারে।“
“ওকে, ইয়াসিরের সাথে কন্ট্যাক্ট কর, আমি বলে দিচ্ছি ওকে। এনিথিং এলস?”
“ইউ হ্যাভ টু প্রমিস মি, এভ্রিথিং উইল বি অলরাইট!”
“ইটস আ প্রমিস, এভ্রিথিং উইল বি এজ বিফোর, ইভেন বেটার দ্যান বিফোর! বাট আমি যদি এমন কোনো রিপোর্ট পাই যে তুমি আবার ওই মেয়ের সাথে…”
জিসান দুই হাত তুলে বলল, “সে রকম কিছু হবে না, ইটস অলসো আ প্রমিস! লেটস মেইক আ ডিল বিটুইন টু জেন্টলমেন।“
“ওকে। কন্সিডার দ্যা ডিল ইজ ডান।“
“থ্যাঙ্ক ইউ!”
বাবার রুম থেকে বের হয়ে বুক ভরে শ্বাস নিল জিসান। তারপর ফোন করল আনানের নাম্বারে।
এক বার রিং বাজতেই রিসিভ করল আনান।
“জিসান! তোর কথাই ভাবছিলাম জানিস?”
“আমার কথা!” বুকের ভেতরে কোথায় যেন একটা চিন চিন করে ব্যথা করতে লাগল জিসানের।
“কেন রে?”
হাসল আনান। “তুই ছাড়া আর কেউ তো খোঁজ নেয় না আমার, এই জন্য!”
“কেন, তোর আম্মু আব্বু?”
“আমি তাদের কাছে মৃত, জিসান! আয়্যাম ডেড টু দেম!”
কিছুটা সময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল জিসান। তারপর ফিস ফিস করে বলল, “কেন এনি? তুই নিজের পছন্দে বিয়ে করেছিলি, তাই?”
“শুধু তাই না, বাসা থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ের পর জানতে পেরেছিলাম সে একজন এসকর্ট সাপ্লায়ার।“
“হোয়াট দ্যা হেল…”
কথা বন্ধ হয়ে গেল জিসানের।
“আমাকে সেই লোকটা ক্লায়েন্টের কাছে পাঠাত, জিসান! সেই ক্লায়েন্টগুলো আমাকে…”
জিসান আর সহ্য করতে পারল না। “আমি এসব শুনতে চাইছি না, এনি!”
“তারপর আমি যখন এক দিন এক ক্লায়েন্টের কাছে যাওয়ার পথে কীভাবে যেন পালিয়ে চলে গেলাম আমাদের বাসায়, কেউ দরজা খুলল না! বলল আমি নাকি মরে গেছি তাদের কাছে!”
“এনি, প্লিজ! প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ! আই বেগ ইউ! আমাকে এই সব বলিস না! আমি আর সহ্য করতে পারছি না! আই ক্যান্ট টলারেট এনি মোর!”
“চুরি করে নিয়ে আসা টাকাগুলো নিয়ে ঢাকা শহরে আসলাম। কাউকে চিনি না। আমার এক বান্ধবীর বড় বোনের বাসায় উঠলাম। তার বুদ্ধিতেই ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিলাম। সেখানে থেকেই খবর পেলাম আমি যে ফ্ল্যাটটায় থাকি সেটার। তখন পাবলিক ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার সময় শেষ হয়ে গিয়েছিল, আর ওয়েভারের অফার ছিল তাই ভর্তি হলাম তোদের ভার্সিটিতে। তখন কি আর জানতাম যে আমার সাথে তোদের সাথে আমার লেভেল মিলে না?”
“এনি! তুই চুপ করবি? কেন আমাকে এই ভাবে কষ্ট দিচ্ছিস?”
“তাহলে আমি আর কাকে বলব জিসান, কাকে বলব তুই বল, সায়ান তো শুনল না…” আকুল হয়ে কাঁদতে লাগল আনান।
দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়াল জিসান। “ঠিক আছে, বল। আমি শুনছি…”
“নাহ, আর কিছু বলব না। হয়ত ফোনে বললাম বলেই বলে ফেলতে পারলাম এত কিছু…”
“আর কিছু বলবি না? ঠিক তো? তাহলে এবার আমি বলি?”
“বল, আমি শুনছি…”
“ইউ ডেজার্ভ আ বেটার লাইফ, এনি! তোর সামনের দিনগুলো অনেক সুন্দর হবে! অনেক অনেক সুন্দর! বিশ্বাস কর! দেখে নিস! আই প্রমিস ইউ!”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here