#মেঘবতী_মিথ্যে_বলেনি-০৯,১০,১১
#মৌলী_আখন্দ
০৯
আনানরা সেকেণ্ড ইয়ারে, সাধারণত এই জাতীয় ইভেন্টগুলো এরেঞ্জমেন্টের দায়িত্ব থাকে ফাইনাল ইয়ারের ওপরে, কিংবা তাদের এক্সাম থাকলে এক্সাম ব্যাচের আগের ব্যাচের ওপরে। এই সব অনুষ্ঠানের জন্য একটা বড় ফাণ্ডিং আসে ভিসি স্যারের কালচারাল ফাণ্ড থেকে, বাকিটুকু চাঁদা তুলে ম্যানেজ করা হয়।
এই বার একটা ঝামেলা হয়ে গেছে, সিনিয়র ভাইয়াদের দুই গ্রুপের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম দলাদলি চলেছে। এক দল চেয়েছিল ব্যাণ্ড শোতে কৃষ্ণপক্ষকে আনতে, আরেক দল ছিল ইনট্রোয়েটকে আনার পক্ষপাতী। যে গ্রুপ এইসব এরেঞ্জ করে, তারা সাধারণত কিছু টাকা নিজেদের জন্য সাইড করতে পারে, তাই দুই দলেরই আগ্রহ ছিল এরেঞ্জমেন্টে থাকবার।
যদিও এইটুকু টাকার জন্য এদের কারোরই কিছু আসে যায় না, তবুও এটাই একটা মজা। জনমত বেশি হওয়ায় শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণপক্ষ ব্যাণ্ড আসছে, কিন্তু হাকিম ভাইয়াদের গ্রুপটা থেকে কয়েকজন রেডি হয়ে এসেছে একটা গ্যাঞ্জাম বাধানোর জন্য।
অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখ মুখ শক্ত করে তাদের কয়েকজনকে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেল। সন্ধ্যা সাতটায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষ হয়ে মাগরিব নামাজের বিরতির সময়ে মঞ্চে যখন সব ইন্সট্রুমেন্ট সেট আপ করা হচ্ছিল তখনই তারা এক সাথে এক জায়গা থেকে দর্শক সারিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসল।
তাদের উদ্দেশ্য বুঝতে পারা গেল একটু পরে। গান শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই অডিয়েন্সের বিভিন্ন সাইড থেকে “ভুয়া”, “ভুয়া” বলে চিৎকার শোনা যেতে লাগল।
স্টেজের ওপরে যারা গান গাইছিল তারা কিছুটা বিভ্রান্ত হলেও গান থামাল না। দ্বিতীয় গানের সময়ও এই রকম চলতে থাকলে এরেঞ্জমেন্টে যারা ছিল তাদের গ্রুপের কেউ কেউ খেপে উঠে তাদের ওপরে চড়াও হলো, আর তারপরই লেগে গেল ধুন্ধুমার কাণ্ড।
চেয়ারগুলো ফিক্সড থাকলেও পেছনের দিকের সারিতে একটা চেয়ারের এক অংশ ছিল ভাঙা। হাকিম ভাইয়াদের গ্রুপের একজন সেই চেয়ারের ওপর লাথি বসাতেই আগে থেকেই আলগা হয়ে থাকা চেয়ারের ভাঙা অংশটা খুলে চলে এলো।
আরেকজন সেই ভাঙা অংশ ছুঁড়ে মারল মঞ্চের শিল্পীদের দিকে। এরপর আর গান করা চলে না।
মুহূর্তেই গান থেমে গেল। পারফর্মাররা প্রাণ ভয়ে ভীত।
দর্শক সারি থেকেও সবাই অস্থির হয়ে ছুটে বেরিয়ে যেতে লাগল। জিসানদের গ্রুপের সবাই অসম্ভব শার্প, তারা অনেক কিছুই আগে থেকেই আঁচ করতে পারে।
তারা বসেছিল দর্শক সারিতে মোটামুটি শেষের দিকে, যে কোনো কনসার্ট একটু পেছনের দিক থেকেই ভালো উপভোগ করা যায়। গোলমালের শুরুতেই তারা বেরিয়ে গিয়েছিল, এই চেয়ার ভাঙার ঘটনা ঘটার আগেই।
লিফটে করে নেমে গিয়েছিল নিচে। লিফট চালু হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে জিসান লিফট থেকে নেমে গিয়ে বলল, “তোরা যা, আমি একটা জিনিস ফেলে এসেছি!”
“কী জিনিস?”
“পরে বলব, এসে নিই! নাম তোরা!”
“সাবধানে…” বলতে বলতেই বন্ধ হয়ে গেল লিফট।
জিসান যখন অডিটোরিয়ামে ফিরে এলো ততক্ষণে চেয়ারের ভাঙা অংশ ছুঁড়ে মারা হয়েছে, সেটা শিল্পীদের কারো গায়ে না লাগলেও লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয়ে লেগেছে একদম সামনের সারিতে বসা আনানের গায়ে, জিসানের চোখের সামনেই। বেচারি এর আগে কখনো কনসার্ট দেখেনি, ভালো করে গান শুনবার আশায় বসেছিল একদম সামনের রোতে।
ভয়ে জমে গেছে মেয়েটা, তাকিয়ে আছে কেমন শূন্য দৃষ্টিতে, ব্যাথায় আর্তনাদ করতেও ভুলে গেছে যেন। জিসান গিয়ে ধরে তুলল তাকে, টেনে বের করল ছুটতে থাকা মানুষদের ভিড়ের মধ্যে দিয়ে।
লিফটে ওঠার অবস্থা নেই এখন, নামতে হবে সিঁড়ি দিয়ে। বেশ কিছুটা পেছনে পড়ে গেছে তারা, প্রথম চোটেই যারা বের হতে পারেনি তাদেরকে এখন এসে পথ আটকে ধরছে আওয়াল ভাইয়াদের গ্রুপের সাঙ্গোপাঙ্গরা।
“এই কই যাস তোরা? প্রোগ্রাম হবে এখন, শো চলবে দশটা পর্যন্ত, দেখি কে আটকায়! গান শুনতে আসছিস, শো শেষ করে তারপর যাবি!”
আনানের ভয়ার্ত মুখ আর ব্যথার জায়গাটা হাত দিয়ে চেপে রাখাটা কেমন ক্ষিপ্ত করে তুলল জিসানকে, সেও বলে বসল রাগের মাথায়, “কীসের প্রোগ্রাম? সিকিউরিটির ব্যবস্থা করতে পারেন না আবার প্রোগ্রাম করেন মিয়া?”
জিসানকে ঘিরে ধরল এক দল ক্ষিপ্ত যুবক, তার হাত থেকে আনানের হাত ছুটে গেছে কখন যেন, ওদের ধাক্কায় এক পাশে পড়ে গেছে আনান । জিসান কোন পক্ষের, প্রোগ্রাম বানচাল করায় আদৌ তার কোনো সম্পৃক্ততা আছে কি নেই এসব না জেনেই ওরা আক্রমণ করতে যাচ্ছে জিসানকে, স্পষ্টই বুঝতে পারল আনান।
কী যেন হয়ে গেল ওর, এতগুলো ছেলের মধ্যে যাওয়ার মত মেয়ে কোনো কালেই ছিল না সে। কিন্তু কখনোই যা করবে কিংবা করতে পারবে বলে ভাবেনি তাই করে বসল সে, ছুটে গিয়ে ঢুকল ছেলেগুলোর মধ্যে, সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল জিসানের, শক্ত করে হাত ধরল তার।
জিসান অনুভব করল তার হাতের মধ্যে থর থর করে কাঁপছে আনানের আঙুলগুলো, যেন সেও ফিরে পেল নিজের ওপরে নিয়ন্ত্রণ। গলা নিচে নামিয়ে বলল, “মেয়েটা ব্যথা পেয়েছে বস, ডাক্তারের কাছে নেওয়া লাগবে। পথ ছাড়েন। আর আমি কে, ব্যাকগ্রাউণ্ড চেক না করে লাগতে আইসেন না।“
ওর ব্যাকগ্রাউণ্ড যাই হোক না কেন, গলার স্বরে এমন কিছু একটা ছিল যে পথ ছেড়ে দিল তারা। সিঁড়ির পুরোটুকু আনানের হাত ছাড়ল না জিসান।
নিচে বাকিরা শঙ্কিত মুখে অপেক্ষা করছিল জিসানের, দুজনকে হাত ধরাধরি করে নেমে আসতে দেখে তাদের সবার মুখে ফুটে উঠল অনেকখানি বিস্ময় এবং কিছুটা বিরক্তি। শেষ পর্যন্ত এই!
একজন তো বলেই ফেলল নিজেকে সামলাতে না পেরে, “কী ফেলে আসছিলি তুই, জিসান?”
জিসান যদিও হাত ছেড়ে দিয়েছিল ওদেরকে দেখেই, তারপরও লজ্জা না পেয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বলল, “আরে শুধু নিজেদের কথা ভাবলেই চলবে, বাকি ক্লাসমেটরা সবাই আসতে পারল কিনা তাও তো দেখতে হবে! তোরা যা, মেয়েটা ব্যথা পেয়েছে, আমি দেখি এখানে ফার্মেসি ডিস্পেন্সারি কিছু পাওয়া যায় কিনা!”
বাকিরা চলে যাওয়ার পর আনান মৃদু স্বরে বলল, “তুই চলে যা, আমি একাই পারব!”
“কই, দেখি, কোথায় লেগেছে?”
“আরে কি আশ্চর্য! অল অন আ সাডেন তুই এত ব্যস্ত হচ্ছিস কেন আমার জন্য?”
“কারণ আমার গিলটি ফিলিং হচ্ছে! তুই আসতে চাস নাই, আমিই আসতে বলেছিলাম তোকে!”
আনানের প্রবল প্রতিবাদের মুখেও জিসানের চাপাচাপিতে জামার হাতা উঠিয়ে ব্যথার জায়গাটা দেখাতে বাধ্য হলো সে। জিনিসটা এসে লেগেছে তার ডান হাতের বাহুতে, কাঁধ আর কনুইয়ের ঠিক মাঝামাঝি জায়গায়।
ফুলে কালো হয়ে উঠেছে। জিসান সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঠোঁট কামড়ে বলল, “মনে হয় তেমন মারাত্মক কিছু না, কাটে টাটে তো নি, তবে ভোগাবে কয়েক দিন। বরফ দিতে হবে আর প্যারাসিটামল খেতে হবে ছয় ঘন্টা পর পর আর মুভ লাগাতে হবে। তারপরও একজন ডাক্তার দেখিয়ে নিলে ভালো হয়।“
আনানও তার কথার সুরে সুর মিলিয়ে বলল, “হ্যাঁ আমিও তাই বলছি, তেমন মারাত্মক কিছু না। আর তাছাড়া আমার অভ্যাস আছে।“
ঠিক বুঝল না জিসান কথাটা। “অভ্যাস আছে? অভ্যাস আছে মানে? কীসের অভ্যাস আছে তোর?”
ক্যাম্পাসে আজকে খুব সুন্দর লাইটিং করা হয়েছিল, চারিদিক আলোয় আলোকিত। সেই আলো এসে পড়েছে আনানের মুখের ওপরে।
আনান হাসলো। ঝলমলে আলোতেও ম্লান দেখাল হাসিটা।
তারপর স্পষ্ট গলায় বলল, “মার খাওয়ার। এই রকম মার খাওয়ার, ঠিক এই রকম মার আর ব্যথার জায়গায় বরফ দেওয়ার অভ্যাস আছে আমার।“
হতবুদ্ধি হয়ে গেল জিসান। “এই সব কী বলছিস তুই? এই কথার মানে কী হ্যাঁ?”
“আর তুই সবার সামনে আমার সাথে কথা বলিস না। আমাদের লেভেল মিলে না। যাই কেমন?’
হেঁটে হেঁটে গেট পেরিয়ে বের হয়ে গেল আনান, জিসান সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল স্থানুর মত। সে চেয়েছিল আনানকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যেতে, কিন্তু সে কথা বেমালুম ভুলে গেল সে।
যখন সম্বিত ফিরে এলো তখন ছুটে গেট পেরিয়ে বাইরে এলো সে। কিন্তু আনান সেখানে নেই আর।
হারিয়ে গেছে দৃষ্টি সীমার বাইরে।
চলবে
#মেঘবতী_মিথ্যে_বলেনি
।।১০।।
“ছেলেটা কে ছিল?”
“কোন ছেলেটা?”
“ওই যে তুমি গেট দিয়ে ঢুকতেই জ্যুস খেলে যার কাছ থেকে? যে তোমাকে প্রোগ্রাম শেষে হাত ধরে নামিয়ে নিয়ে আসলো?”
একটা শীতল স্রোত নেমে গেল আনানের মেরুদণ্ড বেয়ে। তাহলে কি জিসান আর এই “একলা আকাশ” দুই ভিন্ন ব্যক্তি?
সে তো আজকে সারা দিন ধরে এটাই ভেবে নিয়েছে যে “একলা আকাশ” জিসানেরই ফেইক আইডি, জামাটা জিসানেরই পাঠানো। যেহেতু এই তথ্যটা সে জিসানের সাথেই শেয়ার করেছিল যে পহেলা বৈশাখে পরবার মত ড্রেস নেই তার।
তাহলে এটা কী হলো এখন?
একটু সামলে নিয়ে লিখল আনান, “আপনি আমাকে তুমি করে বলছেন মানে?”
“মানে কিছু না। তুমি তো আমাকে একবারও খুঁজলে না?”
“আমার কি আপনাকে খোঁজার কথা ছিল? আপনিই না বলেছিলেন কল দেবেন?”
“দেখলাম তুমি বিজি, তাই আর দিলাম না কল!”
“কই আমি বিজি?”
“অবশ্য বিজি হতেই পারো, ফারুক আহমেদের ছেলে জিসান আহমেদকে পেলে কে আর অন্য দিকে তাকায়।“
আচমকা প্রচণ্ড রাগ উঠে গেল আনানের। ঝড়ের গতিতে টাইপ করল সে, “লিসেন। আমি জানি না আপনি কে। কিন্তু আপনি এইটুকু জেনে রাখুন, আমাকে ইনসাল্ট করার অধিকার আমি আপনাকে দেইনি। তুমি বলার অধিকারও না। আর যেহেতু আপনি এতদিনেও আপনার পরিচয় দেননি, আমি আপনাকে ব্লক করছি। আজই। এক্ষুণি।“
“আরে আরে শোনো শোনো দাঁড়াও দাঁড়াও পরিচয় দিচ্ছি।“
“জি দিলে ভালো হয়।“
“আমার নাম সায়ান। আমি আর তুমি একই ভার্সিটিতে পড়ি। কিন্তু আমি তোমাদের ফ্যাকাল্টির না। আমি সেকেণ্ড ইয়ারে। আমার সাবজেক্ট হলো ইকোনোমিক্স।“
“আচ্ছা।“
“তোমাকে আমি প্রথম দেখেছিলাম ওরিয়েন্টেশনের দিন।“
“ঠিক আছে।“
“কিন্তু তোমাকে অবজার্ভ করে যতটুকু বুঝলাম, তুমি মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটো। কারো দিকে তাকাও না, কারো সাথে কথা বল না। গ্রুপ স্টাডি কর না, ক্লাস শেষ করেই দৌড় দাও।“
“আমার টিউশ্যনি থাকে।“
“জানি, ফলো করেছি।“
“এত কিছু কেন করলেন?”
“কারণ তোমাকে আমার ভালো লেগেছিল!”
“ভালো লাগার মত কী আছে এমন আমার মধ্যে?”
“এই যে তুমি নিজের মত থাকো, তোমার পারসোনালিটি…”
“এত কিছু জানেন, তাহলে এটাও নিশ্চয়ই বুঝেছেন যে আমি এরকমই থাকতে পছন্দ করি।“
“শোনো মেঘবতী, তোমার সমস্যা কী আমি আসলে জানি না। কিন্তু তুমি আমার সাথে শেয়ার করতে পারো, হালকা লাগবে।“
“প্রয়োজন দেখছি না। আমার নিজের সমস্যা আমি নিজেই সমাধান করতে পারি। এতদিন তাই করে এসেছি। আর আমাকে মেঘবতী বলে ডাকবেন না প্লিজ। আমি খুব সাধারণ একটা মেয়ে, কোনো উপন্যাসের নায়িকা নই।“
“প্লিজ ডোন্ট বি সো রুড! আই লাভ ইউ, রিয়েলি! আমি তোমাকে প্রথম যেদিন ওরিয়েন্টেশনের দিন দেখেছিলাম সেদিন থেকেই ফলো করছি আর জেনেছি তুমি কত ডিসেন্ট একটা মেয়ে!”
“হাউ ডেয়ার ইউ? আমি ডিসেন্ট কিনা সেটা জানার জন্য আমাকে ফলো করেছেন আমার বিনা অনুমতিতে? ভেবেছেন এটা শুনলে আমি খুব খুশি হবো?”
“না না প্লিজ, ডোন্ট টেইক ইট আদারওয়াইজ…”
“লিসেন আমি আপনাদের মত কাপুরুষদের ঘৃণা করি যাদের সবার সামনে ভালোবাসার স্বীকৃতি দেওয়ার সাহস থাকে না। সত্যি সত্যি ভালোবাসলে আপনি সবার সামনেই আমাকে বলতে পারতেন, এভাবে ফেইক আইডি দিয়ে আমাকে নক করতেন না আর লুকিয়ে ফলোও করতেন না আমাকে!”
আইডিটাকে ব্লক করে দিয়ে প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ করে অফলাইন হলো আনান। কী যে মনে করে এরা?
হাতের ব্যথাটা টাটাচ্ছে। এই এক পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান ভালো ভোগাল তাকে।
এক জিসানের কাছে চাঁদার ঋণ, আরেক সায়ানের কাছে ড্রেসের টাকার ঋণ, আর এই হাতে ব্যথা পাওয়া। ব্যথা আবার পেয়েছে সেই ডান হাতেই।
আগামী সপ্তাহে ল্যাব রিপোর্ট জমা দিতে হবে, এখন এই ডান হাতের ব্যথা নিয়ে রিপোর্ট লিখবে কীভাবে? চরম বিরক্ত লাগছে আনানের।
পরদিন সকালে বুয়া এলো না বিনা নোটিশে, সপ্তাহে দুই এক দিন প্রায়ই এরকম করে সে। বাসায় নাস্তা খাওয়ার ঝামেলা না করে আনান তাই ক্লাস শুরুর কিছু ক্ষণ আগেই পৌঁছে গিয়ে ক্যান্টিনে বসে নাস্তা নিয়ে বসল।
জিসান এসে সামনের চেয়ার টেনে বসল তার টেবিলে।
“কই দেখি, হাতটার কী অবস্থা?”
আনান কঠিন গলায় বলল, “জিসান তোর কি মনে হয় না যে তুই একটু বেশি বাড়াবাড়ি করছিস?”
“না আমার সেরকম মনে হচ্ছে না। যেহেতু আমার রিকোয়েস্ট রাখার জন্যই তুই গতকাল প্রোগ্রামে এসেছিস, সো ইয়ে মেরা ডিউটি বানতা হ্যায়।“
“কোনো ডিউটি ফিউটি কিছু না, তুই আসলে আমাকে ইরিটেট করছিস!”
“আমি!” প্রচণ্ড আহত মনে হলো জিসানকে।
“আমি তোকে ইরিটেট করছি? কীভাবে? কী করলাম আমি?”
“শুধু তুই একা না, তোর পুরো গ্রুপ। যেদিন থেকে তুই এই ভার্সিটিতে পা দিয়েছিস সেদিন থেকে আমার লাইফ হেল করে ছেড়েছিস। সবাই মিলে আমার পিছনে লেগেছিস। বল, লাগিস নাই? অস্বীকার করতে পারবি? আমার ডেস্কে চিউয়িং গাম লাগিয়ে রেখেছিল কে?”
আত্মসমর্পণ করার ভঙ্গিতে দুই হাত ওপরে তুলল জিসান। “ওকে বাবা, আয়্যাম স্যরি। নাউ লেটস বি ফ্রেণ্ডস!”
হাত বাড়িয়ে দিল জিসান। আনান হাত রাখল না সেই বাড়িয়ে দেওয়া হাতে।
তাকিয়ে রইল তীক্ষ্ণ চোখে। জিসানের বাড়ানো হাতের ওপরে পাশ থেকে হাত রাখল রুবাবা।
আনান আর জিসান দুজনের কথোপকথনে এতই মগ্ন ছিল যে লক্ষ্যই করেনি কখন রুবাবা এসে দাঁড়িয়েছে তাদের টেবিলের পাশে। চমকে উঠল জিসান।
রুবাবা দাঁত বের করে হেসে বলল, “ফ্রেণ্ডস!”
জিসান যেন অকূলে কূল খুঁজে পেয়েছে এমন ভঙ্গি করে বলল, “থ্যাঙ্ক গড তুই আসছিস। এই দেখ এনি আমাদের সবার সাথে রাগ করে আছে। আমরা নাকি সবাই একসাথে ওর পেছনে লেগেছিলাম!”
যেন মুখের সামনে উড়তে থাকা মাছি তাড়াচ্ছে এমন ভঙ্গিতে হাত নেড়ে রুবাবা বলল, “তোকে আমি সেই কখন থেকে খুঁজে বেড়াচ্ছি আর তুই এখানে? চল ওঠ!”
“আরে দাঁড়া, এনির সাথে ফয়সালাটা শেষ করে নিই! ওরও তো বুঝতে হবে ও যদি আমাদের সাথে নাই মিশে তাহলে আমরা কী করব, আমাদের কী দোষ? ক্লাস শেষ হতেই দৌড় দিয়ে বেরিয়ে যায়, কোনো দিন গ্রুপ স্টাডিতে বসে আমাদের কারো সাথে? আর কতদিন নিজেকে এমন সেপারেট করে রাখবে ও?”
রুবাবা আনানের দিকে তাকিয়ে ঝকঝকে হাসি হেসে বলল, “আই থিংক দ্যাট উড বি বেটার ফর হার! একচুয়ালি পিপল লাভ টু মিক্স উইথ পিপল ফ্রম দেয়ার ওউন লেভেলস! এণ্ড এনি ডাজনট বিলং টু আস!”
“হোয়াট ডু ইউ মিন?” চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল জিসানের।
“খুব বেশি কঠিন কিছু বলিনি তো। বলেছি এটাই ভালো যে এনি নিজের লেভেল বুঝতে পেরে নিজেই নিজেকে সেপারেট করে রাখে। নিজের আউট অফ রেঞ্জ সার্কেলে মিশতে গিয়ে নিজেও বিপদে পড়ে না, অন্যদেরকেও বিপদে ফেলে না!”
“হোয়াট দ্যা হেল আর ইউ টকিং এবাউট রুবা? তুই জানিস এনির রেজাল্ট কত ভালো? তোর কোনো ধারণা আছে ওর মনটা কত সুন্দর!”
“আরে বাহ! আমরা সেই ওরিয়েন্টেশনের দিন থেকে শুরু করে এতদিন এক সাথে ক্লাস করেও টের পেলাম না, আর তুই এক সেমিস্টার পরে এসেও কীভাবে ওর সুন্দর মনের খোঁজ পেয়ে গেলি জিসান?”
“শাট আপ! জাস্ট শাট আপ!”
থমকে গেল দুজনই। চেয়ার পেছনে ধাক্কা দিয়ে টেবিল থেকে উঠে দাঁড়াল আনান।
“আমাকে ইনসাল্ট করার অধিকার আমি কাউকে দিইনি! এণ্ড ইউ…”
জিসানের দিকে আঙুল তুলল আনান। চিবিয়ে চিবিয়ে উচ্চারণ করল, “স্টপ ফলোয়িং মি, স্টপ রুইনিং মাই লাইফ! হ্যাঁ আই ডোন্ট বিলং টু ইওর ড্যাম হাই ক্লাস লেভেল, তাই আমার বিলাসিতাগুলোও খুব সামান্য। সকালের নাস্তা, সকালের চা খাওয়া সেগুলোর মধ্যে একটা। ইউ হ্যাভ অলরেডী রুইন্ড দ্যাট টুডে! জিসান আহমেদ, ইউ হ্যাভ রুইন্ড মাই ডে, জাস্ট ফর নাথিং!”
ঝটকা দিয়ে পেছনে ঘুরেই আনান দেখল ঠিক তার পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে একজন। চশমার আড়ালে দুই চোখে ব্যথিত দৃষ্টি।
“মেঘবতী, আমি সায়ান! তুমি আমাকে ব্লক করে দিয়েছ কেন?”
হার্টের একটা বিট মিস হলো আনানের। মেঘবতী!
এই তবে সায়ান?
“মেঘবতী, ক্ষমা কর প্লিজ! এবার তো পরিচয় পেলে, জানলে তো আমি ফেইক কেউ নই। আর আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি! আই লাভ ইউ, রিয়েলি!”
ওপাশ থেকে রুবাবা আর জিসান তাকিয়ে আছে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে। আনানের কী যেন হয়ে গেল আচমকা, সেও বলে ফেলল, “আই লাভ ইউ টু!”
রুবাবা আর কৌতূহল সংবরণ করতে পারল না। জিজ্ঞেস করেই ফেলল, “কে উনি?”
মুখ ফিরিয়ে উত্তর দিল আনান, “আমার বয়ফ্রেণ্ড!”
চলবে
#মেঘবতী_মিথ্যে_বলেনি
।।১১।।
এই প্রাইভেট ভার্সিটিতে রাজনীতি নিয়ে তেমন কোনো আগ্রহ কারো নেই, কিংবা থাকলেও ক্যাম্পাসে তার কোনো প্রভাব দেখা যায় না অন্তত। দেশাত্মবোধ কিংবা রাজনৈতিক চর্চা সমাজের উঁচু তলার মানুষদের তেমন একটা আকর্ষণ করে না, কিংবা এইসব পরিবারের ছেলেমেয়েদের তেমন কোনো অভাব থাকে না বলে তাদের কোনো প্রলোভন দিয়েও সুবিধা করা যায় না, সেটাই হয়ত কারণ।
পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে যে সমস্যাটা হলো, তার মূলে ছিল যে গ্রুপ এইসব এরেঞ্জ করে, তারা সাধারণত কিছু টাকা নিজেদের জন্য সাইড করতে পারে, এইটুকুই। কিন্তু এইবার সমস্যাটা রাজনৈতিক ফ্লেভার দেওয়া হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে, ভিসি স্যারের কাছে গিয়েছে অভিযোগ।
হাকিম ভাইয়া বিরোধী দলের সমর্থক, মূলত সেটাকেই পুঁজি করা হচ্ছে। কীভাবে কীভাবে যেন জিসানের নামটাও চলে আসলো হাকিম ভাইয়াদের সমর্থকদের গ্রুপে, যদিও এসবের বিন্দু বিসর্গ পর্যন্ত তার জানা নেই।
সেদিন ওর “আমি কে, ব্যাকগ্রাউণ্ড চেক না করে লাগতে আইসেন না।“ এই হুমকি দেওয়াটুকুই যেন কাল হয়ে উঠল ওর জন্য। এই কথাটুকুই গায়ে লেগেছিল আওয়াল ভাইয়াদের গ্রুপের কারো কারো, কথাটা যেন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়ার মত শুনিয়েছিল ওদের কানে।
আওয়ালদের গ্রুপের ছেলেরা সরকারী দলের সমর্থক, আর হাকিমদের দলটা বিরোধীদলীয়, এরকম দেখিয়ে একটা সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিরোধের গায়ে রাজনৈতিক রঙ চড়িয়ে দেওয়া হলো। ভিসি স্যার নির্বিরোধী মানুষ, কারো সাতে পাঁচে থাকতে চান না।
তাছাড়া অডিটোরিয়ামের একটা চেয়ার ভেঙেছে, এরকম কাণ্ড এই ক্যাম্পাসে এর আগে আর কখনোই হয়নি। সব মিলিয়ে ভিসি স্যারের পক্ষ থেকে চিঠি ইস্যু হলো পনের জনের নামে।
পরিকল্পিতভাবে ভার্সিটির সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাধা দান, ক্যাম্পাসের সম্পত্তি নষ্ট করা, সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ওপরে হামলা করার অভিযোগে এই পনের জন আগামী সেমিস্টার পরীক্ষায় বসতে পারবে না এই মর্মে চিঠি পাঠানো হলো ডিপার্টমেন্টগুলোতে এবং অভিভাবকদের কাছে। তবে এর মধ্যে সামান্য একটু ফাঁক রইল, কোনো অভিভাবক চাইলে এসে ভিসি স্যারের সাথে যোগাযোগ করে এরকম আর হবে না এই মর্মে মুচলেকা দিয়ে চিঠি প্রত্যাহার করিয়ে নিতে পারবেন।
মূলত প্রাইভেট ভার্সিটি, অনেক ক্ষমতাবানদের ছেলে মেয়েরা পড়ে, ওপর মহল থেকে ফোনে চাপ আসলে আটকে রাখবার ক্ষমতা তাঁর নেই, এটা তিনি ভালো করেই জানেন, তাই এই ফাঁকটুকু রেখে দিলেন। বাসার লেটার বক্সে আসা অন্যান্য চিঠির সাথে এই চিঠিটাও চেক করল জিসানই, কিন্তু দেখে তেমন কোনো অনুভূতি হলো না তার।
আসলে তার মনটা কেমন যেন অসাড় হয়ে আছে, কোনো আবেগ অনুভূতিই সেখানে আলোড়ন তুলতে পারছে না। মা নেই জিসানের, খুব ছোট বেলায় প্রেমিকের হাত ধরে চলে গিয়েছিল।
সৎ মা এলে জিসানের অযত্ন হবে এই কারণ দেখিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেনি জিসানের আব্বু। এই মুহূর্তে জিসানের আব্বু বিজনেস ট্যুরে দেশের বাইরে, তার গ্রুপ অফ ইণ্ডাস্ট্রিজের দায়িত্ব ম্যানেজাররা ভালোভাবেই সামলাচ্ছে।
প্রতি দিনের আপডেট জিসানের কাছে আসে, বাসায় আসা চিঠিপত্র চেক করা জিসানের দায়িত্ব। আগামী সাতদিনের মধ্যে ভিসি স্যারের সাথে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে, অফিসে গিয়ে দেখা করতে বলা হয়নি, লেখা আছে “যোগাযোগ”।
এটাও আসলে ভিসি স্যারের বুদ্ধিমত্তারই বহিঃপ্রকাশ, সাপও মরল আবার লাঠিও ভাঙল না। ভিসি স্যারের ভালো করেই জানা আছে যে এইসব বড়লোকের ছেলে মেয়েদের মা বাবার তার অফিসে আসার মত এতটা সময় নেই, তাদের অনেকেই ফোনে কথা বলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন।
জিসান চাইলেই আব্বুকে দিয়ে ফোন করাতে পারত ভিসি স্যারকে, কেন যেন ইচ্ছাই হলো না তার। বরং তার কেমন শান্তি শান্তি অনুভব হতে লাগল।
ইদানীং ক্যাম্পাসে গেলেই কেমন অশান্তি লাগতে শুরু করে, কেমন যেন খালি খালি লাগে। মরার কৃষ্ণচূড়া গাছটা ফুল ফুটিয়েই যাচ্ছে।
কখনো স্বপ্নে আবার কখনো জেগে জেগেও চোখ বন্ধ করলে বার বার চোখের সামনে ঘুরে ফিরে ফুটে ওঠে ওই একটাই দৃশ্য। মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে বৃষ্টির আঘাতে আহত কৃষ্ণচূড়া ফুল কুড়িয়ে তুলছে একটা সাধারণ, অতি সাধারণ মেয়ে।
যেন যুদ্ধক্ষেত্রে হাঁটু গেড়ে বসে যুদ্ধাহতদের মাঝে এখনো কেউ বেঁচে আছে কিনা হাতের পালস ধরে ধরে তাই চেক করে দেখছে এক অভিজ্ঞ নার্স। কি সাধারণ, অথচ কতই না অসাধারণ!
কত বাহুল্যবর্জিত অথচ কতই না জৌলুসে ভরা। ওই দুই চোখ কথা বলে, বেশিরভাগ সময়ই ওই দুই চোখে অব্যক্ত বিষাদ ফুটে থাকে বাঙময় হয়ে।
“লুক জিসান আহমেদ। মে বি ইউ আর বর্ন এণ্ড ব্রট আপ ইন গুলশান, তোমার নিজের বলতে কিন্তু কিছু নেই। আমি আনান আফরিন, অল দ্যাট আই হ্যাভ আর মেইড বাই মি। আমার যা কিছু আছে সব আমি নিজে করেছি। আর তুমি? বাবার গাড়িতে আসো, বাবার টাকায় খাও। তোমার নিজের কী আছে বল তো? বাবার টাকা না থাকলে তুমি এখানে ভর্তি হতে পারতে? বেটার ইউ ওয়াচ আউট আওয়ার লেভেলস!”
চিঠিটা রেখে দিয়ে মনে মনে উচ্চারণ করল জিসান। না, চিঠিটার কথা আব্বুকে বলবেই না সে।
যা হওয়ার হোক। আব্বুর সাহায্য আর নেবে না সে।
চলবে