মেঘবতী_মিথ্যে_বলেনি-১২,১৩

0
678

#মেঘবতী_মিথ্যে_বলেনি-১২,১৩
#মৌলী_আখন্দ
১২

আজকাল আনান আর সায়ানকে প্রায়ই এক সাথে দেখা যায়। ক্লাস শুরুর আগে ক্যান্টিনে নাস্তা করছে, দুই ক্লাসের ব্রেকে দেখা করছে, ক্লাস শেষ করে ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে যাওয়ার মধ্যেই বিদায় জানাচ্ছে।
আজকে সকালেও আনান আর সায়ান নাস্তা শেষ করে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে গল্প করছিল ক্যাফেটারিয়াতে বসে, ওদের টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল রুবাবা। শীতল গলায় বলল, “এনি তোর সাথে কি আমি দুই মিনিট কথা বলতে পারি?”
ভীষণ অবাক হয়ে আনান বলল, “হ্যাঁ বল, কী কথা?”
রুবাবা একবার আড় চোখে সায়ানের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি তোর সাথে একটু একা কথা বলতে চাচ্ছিলাম!”
সায়ান প্রায় সাথে সাথেই লম্বা একটা চুমুক দিয়ে কাপের বাকি চা টুকু শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে রুবাবার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি নাস্তা করেছ? তোমার জন্য চা বলে দিয়ে যাব?”
রুবাবা স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “লাগবে না ভাইয়া, ধন্যবাদ।“
চেয়ারের পেছনে ঝুলিয়ে রাখা ব্যাগটা তুলে নিয়ে সায়ান বেরিয়ে যেতেই রুবাবা গলা উঁচিয়ে ক্যান্টিন বয়কে ডেকে বলল, “এই একটা কফি দাও কড়া করে!”
আনান তার দিকে তাকিয়ে আছে উৎসুক দৃষ্টিতে। রুবাবাও তার দিকে তাকিয়ে আছে তীক্ষ্ণ চোখে, যেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিতে চাইছে আনানের চেহারার প্রতিটি ভাঁজ।
ভীষণ অস্বস্তি লাগছে আনানের, এই রকম দৃষ্টির সামনে মেয়েদের প্রায়ই পড়তে হয়, কিন্তু সেটা দ্বিতীয় কোনো নারীর পক্ষ থেকে নয়, সাধারণত আসা যাওয়া চলা ফেরার পথে কোনো অমার্জিত পুরুষের পক্ষ থেকে। এমন পর্যবেক্ষণী দৃষ্টির সামনে যে কোনো মানুষের অস্বস্তি বোধ করবার কথা।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করবার জন্য কথা শুরু করল আনানই, “কী দেখছিস?”
রুবাবা নড়ে চড়ে বসে বলল, “দেখছি, তোকেই দেখছি, কী এমন আছে তোর মধ্যে?”
বিরক্তির ভাঁজ পড়ল আনানের কপালে, এই গ্রুপের প্রত্যেকটা সদস্য তাকে এই রকম ছোট করে করে কথা বলে অভ্যস্ত। কিন্তু যথেষ্ট হয়েছে, আর সুযোগ দেবে না সে।
রুক্ষ গলায় বলল আনান, “তুই দুই মিনিটের কথা বলেছিলি।“
“ও হ্যাঁ, দুই মিনিট, তাই না? আসলে কোথা থেকে শুরু করব তাই ভাবছি!”
এবার বিরক্তিটুকু বিস্ময়ে পরিণত হলো আনানের। “কী এমন কথা বলবি যে এত কিছু ভেবে বলতে হচ্ছে?”
রুবাবা এবার সরাসরি চার্জ করল আনানকে, “তুই জিসানকে কী করেছিস এনি?”
আনান রীতিমত আকাশ থেকে পড়ল। “আমি? আমি!”
“ইয়েস, ইউ! হোয়াট দ্যা হেল হ্যাভ ইউ ডান টু হিম?”
“কেন কী হয়েছে জিসানের?”
“তুই কি জিসানকে এরকম কিছু বলেছিস যে ওর নিজের কোনো যোগ্যতা নেই, নিজের কোনো কোয়ালিফিকেশন নেই। আর অন দ্যা আদার হ্যাণ্ড তুই একজন সেলফ মেইড পারসন, সো তোর পাশে দাঁড়ানোর মত কোনো যোগ্যতাই ওর নেই! বলেছিস এই রকম কিছু?”
স্মৃতির ঝুলি হাতড়ে হাতড়ে বহু কষ্ট করে অনেক নিচে বিস্মৃতির অতল থেকে এই রকম একটা কিছু মনে করতে পারল আনান। “হ্যাঁ বলেছিলাম, কিন্তু সেটা তো বলেছিলাম সেলফ ডিফেন্সের পারপাজে। তোরা, তোদের গ্রুপের সবাই কন্টিনিউয়াসলি আমাকে ইনসাল্ট করে যাবি, করতেই থাকবি, আর আমি কখনোই কোনো রিপ্লাই দেব না, চুপচাপ শুধু শুনেই যাব, শুনতেই থাকব, এই রকম কি হয়, নাকি হওয়া উচিত, তুইই বল?”
রুবাবার কফি দিয়ে গেছে। কফির কাপে চুমুক দিয়ে সে বলল, “বাহ, অনেক কথা শিখে গেছিস তো! আগে তো এমন ছিলি না তুই? কে শিখিয়েছে, তোর ওই নতুন বয়ফ্রেণ্ড নাকি!”
“তুই কি আমাকে ইনসাল্ট করতেই থাকবি? নাকি কাজের কথাও কিছু আছে তোর!”
রুবাবা কফি খেতে খেতে আনমনে বলল, “আশ্চর্য!”
“কী আশ্চর্য?”
“তোর চেহারা তো এতটাও খারাপ না! আগে কেন লক্ষ্য করিনি?”
মেজাজ খারাপ হয়ে গেল আনানের। ঝটকা দিয়ে উঠে দাঁড়াল সে।
“আমি যাচ্ছি! তোর দুই মিনিট আরো অনেক আগেই শেষ!”
রুবাবা খপ করে ওর হাত ধরে ফেলে বলল, “কোথায় যাচ্ছিস? আগে জিসানের প্রবলেম সলভ করে দিয়ে তারপর তুই যাবি!”
“কেন আমি কি প্রবলেম সলভার নাকি যে দুনিয়ার সবার প্রবলেম সলভ করে বেড়াব? তাছাড়া ওর কী প্রবলেম হয়েছে সেটাই তো আমি জানি না!”
“তুই প্রবলেম সলভার না হলেও জিসানের প্রবলেম অবশ্যই সলভ করবি, কারণ এই প্রবলেমের সাথে তুই জড়িত!”
“মানে? কীভাবে?”
“সেটাই বলছি, বস, ঠাণ্ডা মাথায় শোন!”
“আমি বসছি, কিন্তু কথা বার্তা ঠিক মত বলবি!”
দ্বিতীয়বারের মত বসল আনান, রাগে থম থম করছে তার মুখ। রুবাবার কফি শেষ, সে শূন্য কাপ প্রায় আছাড় মেরে টেবিলে রাখল।
“তুই কি জানিস জিসানকে এক সেমিস্টারের জন্য সাসপেণ্ড করে দেওয়া হয়েছে?”
“মানে? আমি কীভাবে জানব! আমি কি জিসানের সব কিছু জানবার ইজারা নিয়েছি নাকি? আর তুই, তোরা, তোদের গ্রুপের কেউই তো আমাকে মানুষ বলেই কাউন্ট করিস না!”
“মানুষ বলেই কাউন্ট না করলে কি জিসান কি ওই দিন প্রোগ্রামে তোকে বের করে আনবার জন্য সেকেণ্ড টাইম অডিটোরিয়ামে যেত?”
থমকে গেল আনান। এটা তো সে চিন্তা করে দেখেনি!
“আমাদের গ্রুপের সবাই নেমে গিয়েছিলাম। জিসান একাই ফিরে গিয়েছিল শুধু তোর জন্য! ওনলি ফর ইউ, এনি!”
আনান ফিস ফিস করে বলল, “বাট হোয়াই?”
“দ্যাটস হোয়াট আই ওয়ান্না আস্ক ইউ টুডে! হোয়াই? হোয়াই ইউ? অফ অল পারসনস ইউ? কী এমন আছে তোর মধ্যে? জীবনেও তো তোদের দুজনকে এক সাথে কথাও পর্যন্ত বলতে দেখলাম না! আর শুধু তোকে সেইভ করবার জন্য এত বড় ঝামেলা ঘাড়ে পড়ল ওর?”
চমকে উঠল আনান। “কী ঝামেলা?”
রুবাবা অন্য দিকে তাকিয়ে বলল, “ভিসি স্যারের অফিস থেকে পনের জনের বাসায় চিঠি ইস্যু হয়েছে। সেই পনের জনের মধ্যে জিসানের নামও আছে।“
“মানে? কেন? কীভাবে?”
“সেটাই তো আমরা কেউই বুঝতে পারছি না! তোরা দুইজন বেরিয়ে আসার সময় কারো সাথে কোনো ঝামেলা হয়েছিল?”
আনান আবছা আবছা মনে করবার চেষ্টা করতে লাগল ঘটনাটা। “না ঠিক ঝামেলা না, হালকা কথা কাটাকাটি হয়েছিল। আমার আসলে অতটা মনেও নেই! আমি হাতে ব্যথা পেয়েছিলাম তো…”
উত্তেজিত হয়ে উঠল রুবাবা। “আরে তাই তো! তুইই তো ব্যথা পেয়েছিলি তাই না? তোকে সেইভ করতেই তো জিসান গিয়েছিল?”
“হ্যাঁ, সর্ট অফ! সো হোয়াট?”
“জিসানের এগেইন্সটে চার্জ আছে প্রোগ্রাম পণ্ড করার জন্য ক্যাম্পাসের প্রোপার্টি নষ্ট করবার, সাধারণ স্টুডেন্টদের ওপরে হামলা করবার!”
“হোয়াট?”
“এখন এই হামলা আক্রান্ত স্টুডেন্ট যে তুই সেটা তো আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম! তুই এখনই আমার সাথে যাবি। ভিসি স্যারের সেক্রেটারিকে গিয়ে বলবি যে সেই প্রোগ্রামে আহত ছাত্রী আসলে তুই। ব্যথা পেয়েছিলি তাই রেগুলার ক্লাসে আসতে পারিস নাই। এই জন্য এই সব নোটিশের খবর জানতি না। আজকে জানতে পেরেছিস। যা, গিয়ে বল। তুই যে ভিক্টিম, জিসান যে শুধু মাত্র তোকে বের করার জন্যই ওখানে গিয়েছিল, শুধু এই কথাটা তুই সাক্ষী দিলেই জিসানের ওপর থেকে চার্জটা সরে যাবে।“
মাথা নাড়ল আনান। ‘ঠিক আছে, সত্যি কথা বলতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু এই কথাটা সরাসরি বলতে তুই এত প্যাচাচ্ছিলি কেন প্রথমে?”
উঠে দাঁড়াল রুবাবা। উঠে দাঁড়াল আনানও।
“কী জানিস এনি, জিসানের আসলে এই সব ডিগ্রি হওয়া না হওয়া দিয়ে কিছু আসে যায় না। সেমিস্টার লস হলেও তেমন কিছু না। পড়াশোনা ওর জন্য তেমন ম্যাটার করে না। কিন্তু আমরা কেউই আসলে মেনে নিতে পারছিলাম না ব্যাপারটা যে জিসান আমাদের গ্রুপ থেকে পিছিয়ে যাবে, আলাদা হয়ে যাবে আমাদের কাছ থেকে। যে পনের জনের নামে চিঠি ইস্যু হয়েছিল, প্রত্যেকেই তাদের প্যারেন্টসকে দিয়ে ফোন করিয়ে চার্জটা উঠিয়ে নিয়েছে, এক মাত্র জিসান ছাড়া। তুই নতুন নতুন প্রেমে আছিস, বোধ হয় খেয়ালও করিস নাই যে ও আজ এক সপ্তাহ ধরে ক্যাম্পাসে আসে না। ব্যাপার কী জানতে আমি গতকাল বিকেলে ক্লাস শেষ করে ওর বাসায় গিয়েছিলাম। ও কী বলল জানিস?”
“কী?” আর কিছু বের হলো না আনানের মুখ দিয়ে।
রুবাবা ঝুঁকে এলো আনানের দিকে। গলা নামিয়ে বলল, “জিসান বলল, এনি আমাকে বলেছে, আমার নিজের কোনো যোগ্যতা নাই! আমি আমার বাবার টাকায় চলি, বাবার হোটেলে খাই! আমি আব্বুকে দিয়ে ফোন করাব না! ওর ওই কথা শুনে আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, তোদের বোধ হয় সিক্রেট এফেয়ার চলছে! তাই আর বেশি ঘাঁটালাম না। কিন্তু আজকে সকালে ভার্সিটিতে এসে দেখি, তুই মহানন্দে তোর নতুন আশিকের সাথে নাস্তা করছিস! দেখেই আমার মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিল জাস্ট। ওদিকে জিসানের মত একটা লাইভলি ছেলে যে জীবনে কোনো কিছুকে সিরিয়াসলি নেয় না কোনো দিন, সে তোর ওই এক কথাকেই এত সিরিয়াসলি আঁকড়ে ধরে নিয়ে বসে আছে! সেমিস্টার লস করতেও আপত্তি নাই, নিজের সার্কেল নিজের গ্রুপ থেকে সেপারেট হয়ে যেতেও আপত্তি নাই! তুই কী এমন করলি যে জিসান তোকে এতটা ইম্পর্ট্যান্স দিচ্ছে নিজের লাইফে?”
অসহায়ভাবে রুবাবার দিকে তাকিয়ে রইল আনান। “আমি জানি না রুবা! বিশ্বাস কর আমি সত্যি বলছি আমি সত্যিই কিছু জানি না!”

হয়েছে?”
ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলল আনান। “দেখ জিসান তোর জন্য হয়ত ডিগ্রিটা তেমন ইম্পর্ট্যান্ট কিছু না। কিন্তু আমার জন্য ইম্পর্ট্যান্ট। এই গ্রেডিং, সিজিপিএ সব কিছুই। বিকজ আমাকে এগুলো দিয়ে চাকরি পেতে হবে। ইন ফ্যাক্ট চাকরি খুঁজতে হবে। আমার বিকেলে টিউশ্যনি করতে যেতে হয়। বাসায় গিয়ে নিজের কিছু কাজ করতে হয়। লাইব্রেরিতে পড়ার প্রতিটা সেকেণ্ড আমার জন্য ইম্পর্ট্যান্ট।“
বিবর্ণ হয়ে গেল জিসানের মুখ। “আয়াম সো স্যরি এনি! আই ওয়াজ ডিস্টারবিং ইউ!”
আনান কিছু বুঝে ওঠার আগেই উঠে দাঁড়াল জিসান। আর লম্বা লম্বা পা ফেলে বেরিয়ে গেল লাইব্রেরি থেকে।
আনান দ্রুত বেরিয়ে এলো ওর পেছন পেছন। ওর আহত মুখ দেখে খারাপ লাগছিল তার।
আনান যখন বেরিয়ে এল লাইব্রেরির দরজার বাইরে, জিসান তখন পৌঁছে গেছে লিফটের সামনে। সেখান থেকেই চিৎকার করে ডাকল আনান, “এই জিসান!”
আচমকা আনানের বাহু ধরে টেনে সরিয়ে আনল কেউ। “কী হয়েছে মেঘ?”
ফিরে তাকাল আনান। সায়ান!
অন্য দিকে আনানের ডাক পৌঁছেছে জিসানের কানেও। ফিরে তাকাল সে।
দৃশ্যটা দেখে চোখ প্রায় পুড়ে গেল তার। আনানের বাহুতে ছুঁয়ে আছে সায়ান।
বুকের ভেতর পাতাল নদীর মত কুলু কুলু শব্দে বয়ে যেতে লাগল ঈর্ষার চোরা স্রোত। জিসান বলতে চাইল, “বলো না কো কথা ওই যুবকের সাথে…”
কিন্তু মানুষ হয়ে জন্মানোর অনেক ভালো ব্যাপারের সাথে সাথে একটা খারাপ ব্যাপারও আছে। মনের অনেক কথা মনেই মাটি চাপা দিয়ে দিতে হয়।
তাই লিফট এসে থামলে লিফটে উঠে নেমে গেল জিসান। শুধু চোখে লেগে রইল মিষ্টি কমলা রঙের জামা পরে আনান, হাত উঁচু করে তার চুল বাঁধা, সিরিয়াস মুখ করে নোটে পেন্সিল দিয়ে মার্ক করা, পড়ার ফাঁকে ফাঁকে আনমনে পেন্সিল কামড়ানো, আর, আর…
আর ওই…সায়ান! কী এমন হতো ওই শেষের দৃশ্যটার জন্ম না হলে?
কিংবা…কী এমন হতো ওই শেষের দৃশ্যটায় সায়ানের বদলে স্বয়ং জিসান থাকলে?

চলবে

#মেঘবতী_মিথ্যে_বলেনি
।।১৩।।
আনান ভিসি স্যারের সেক্রেটারির কাছে গিয়ে সেদিনের ঘটনা সব কিছু বলে আসবার পর আরো একটা ঘটনা ঘটল সেদিন। রুবাবা ওদের গ্রুপের সবাইকে প্রস্তাব দিল জিসানের বাসায় গিয়ে ওর সাথে দেখা করে আসা যাক।
আগের দিন সে যে একা একা গিয়ে জিসানের সাথে দেখা করে বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছে সে কথা বেমালুম চেপে গেল সে। অন্য বন্ধুরা খ্যাপাতে পারে।
জিসানের আগ বাড়িয়ে কথা বলবার অভ্যাস নেই, তা ছাড়া এখন আরো একটু বেশি চুপচাপ হয়ে গেছে সে। আশা করা যায় এক দিন আগেই রুবাবা একা আলাদা ওদের বাসায় যাওয়ার কথাটা উঠবে না।
গ্রুপের বাকিরা মোটামুটি আনন্দের সাথেই লুফে নিল জিসানের সাথে মিট করে ওকে চিয়ার আপ করবার প্রস্তাবটা। এমনিতে জিসানদের বাসাটা প্রাইম লোকেশনে, তাছাড়া তেমন কোনো ঝামেলাও নেই ওদের বাসায়।
ক্লাস শেষ করে তাই বড় একটা পিতজা আর কোল্ড ড্রিংক্স নিয়ে রওনা দিল ওরা। ওরা গেট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে দেখল জিসানের আব্বু বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
ওরা তাকে না ঘাঁটিয়ে সরাসরি উঠে গেল ওপরে। এমনিতেও জিসানের বন্ধুদের জন্য এ বাড়ির দ্বার সব সময়ই অবারিত।
আনানের ভিসি স্যারের অফিসে গিয়ে জবানবন্দি দিয়ে আসবার ঘটনা জিসানের মধ্যে তেমন কোনো আলোড়ন সৃষ্টি করল না। সে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল, “তো?”
রুবাবা খেপে উঠে বলল, “তো মানে? এখন তো আংকেলও দেশে ফিরে এসেছেন। এখন তো আর ফোনে এই সব বললে তিনি বিরক্ত হবেন এই রকম কোনো চান্স নাই!”
জিসান বাঁকা হাসি হেসে বলল, “তুই একটা কথা বললি এইটা? এই ইন্টারনেটের যুগে? দেশে আর বিদেশে পার্থক্য আছে নাকি এখন?”
রুবাবা আর কিছু না বলে তাকিয়ে রইল আহত দৃষ্টিতে। জিসান আর কিছু না বলে ইন্টারকমের ফোন তুলে নিচে ডায়াল করে ছুরি, প্লেট বাটি আর গ্লাস দিয়ে যেতে বলল।
একটু পরেই জিসানের বাসার খানসামা দিয়ে গেল সেগুলো। জিসান বলল, “চিয়ার আপ! একটা সেমিস্টার লস হলে এমন কিছু হয় না! এমনিতেও এক্সাম একদম নেক্সট উইকেই, আমি সিলেবাস কাভার করতে পারব না!”
এই কথার পরে আর বলবার কিছু থাকে না। ছুরি দিয়ে পিতজা কেটে ভাগ করে খেতে খেতে জিসান কৌশলে কথা ঘুরিয়ে দিল।
আব্বুকে দিয়ে ভিসি স্যারকে ফোন করানোর প্রসঙ্গ চাপা পড়ে গেল সেখানেই। ভুলল না শুধু রুবাবা।
ওরা উঠল সন্ধ্যা পার করে। সবাই চলে যাওয়ার পরেও আরো কিছুক্ষণ বসে রইল রুবাবা।
কোনো কথা নয় শুধুই চুপচাপ বসে থাকা। এক পর্যায়ে নীরবতা ভেঙে জিসানই বলল, “তুই কি আমাকে বিশেষ কিছু বলতে চাস?”
“হ্যাঁ, চাই”, বলে রুবাবা আচমকা ফট করে বলে ফেলল, “তোর সেই এনির কার সাথে এফেয়ার হয়েছে জানিস?”
“না, জানি না!” নিরাসক্ত ভঙ্গিতে বলল জিসান।
হতাশ হলো রুবাবা। সে যে রকম প্রতিক্রিয়া দেখবে বলে আশা করেছিল জিসানের মধ্যে সে রকম কিছুই দেখতে পেল না।
নিজে থেকেই আগ বাড়িয়ে বলল, “এক সিনিয়র ভাইয়ের সঙ্গে!”
“বেশ! তা তুই কবে থেকে ওকে ওয়াচ করা শুরু করলি?”
এ কথার উত্তরে কী বলবে ভেবে পেল না রুবাবা। জিসান হাসি মুখে বলল, “সামনে এক্সাম, পড়াশোনা কর! এফেয়ার একটা স্বাভাবিক চলমান বায়োলজিক্যাল প্রসেডিওর, বড় ক্যাম্পাসে প্রতি দিনই দুই একটা এফেয়ার হয়, হতেই পারে! এ নিয়ে আলাপ আলোচনার কী আছে? হোয়াট ইজ সো স্পেশ্যাল টু টক এবাউট? আর এনি তো আমাদের সার্কেলের কেউ না!”
“হ্যাঁ, তা তো বটেই!” দাঁত কিড়মিড় করে বলল রুবাবা। “ঠিক এই জন্যই তো ওকে সেইভ করতে গিয়ে তুই এই রকম একটা হ্যাসেলের মধ্যে পড়লি?”
“তাতেই বা তোর কী এমন অসুবিধা হচ্ছে? হোয়াটস পুটিং ইউ ইনটু ট্রাবল? আয়াম ক্যাপেবল এনাফ টু হ্যাণ্ডল মাই ওউন লাইফ এণ্ড ওউন হ্যাসেলস!”
“ইয়া রাইট, এবসোলিউটলি রাইট ইউ আর! নাউ ক্যান আই আস্ক ইউ ওয়ান কোয়েশ্চেন ইফ ইউ ডোন্ট মাইণ্ড? এনির জায়গায় সেদিন যদি আমি রুবাবা থাকতাম, তুই কি আমাকে সেইভ করতে যেতি?”
“কাম অন! আর ইউ জেলাস?’
“আই নিড টু নো দ্যা এন্সার জিসান!”
জিসান হাই তুলে বলল, “সত্যি কথাটা হচ্ছে, এনি ছাড়া আর কেউ হলেই আমি আসলে যেতাম না। বিকজ ইউ অল আর ক্যাপেবল এনাফ টু প্রোটেক্ট ইওরসেলফ! এনির প্রোটেকশন প্রয়োজন ছিল দেখেই আমি গিয়েছি। যে নিজেই নিজেকে প্রোটেক্ট করতে পারে, তার জন্য আমি শুধু শুধু নিজেকে রিস্কে ফেলব কেন? এম আই দ্যাট ফুল?”
রুবাবা উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাগ নিতে নিতে বলল, “চললাম! আই হ্যাভ গট মাই এন্সার!”
“গাড়ি নিয়ে আসছিস?”
উত্তর না দিয়ে নেমে গেল রুবাবা। গেটের সামনে দেখা হলো জিসানের আব্বুর সঙ্গে।
জিসানদের পোষা কুকুর ডলির সাথে ফ্রিসবি ছুঁড়ে ছুঁড়ে খেলা করছিলেন। চোখাচোখি হতে সালাম দিল রুবাবা।
আংকেল এগিয়ে এসে হাসি মুখে বললেন, “ওয়ালাইকুম সালাম! কী নাম তোমার মা?”
”আংকেল আমার নাম রুবাবা।“
“তুমি কি জিসানের সাথেই পড়ো?”
“জি আংকেল।“
“কখন এসেছিলে? খেয়েছ কিছু?”
“এসেছি বিকালেই। খেয়েছি আংকেল।“
“ঠিক আছে মা রাত হয়েছে যাও তাহলে। পরে কথা হবে আবার।“
আচমকা কী হলো রুবাবার, সে বলে বসল, “আংকেল আপনার সাথে কথা ছিল একটু, আপনার কি দুই মিনিট সময় হবে?”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here