মেঘবতী_মিথ্যে_বলেনি-১৪,১৫

0
703

#মেঘবতী_মিথ্যে_বলেনি-১৪,১৫

১৪

রাগে আগুন হয়ে আছে জিসান। তার বিনা অনুমতিতেই রুবাবা আব্বুকে সব কিছু জানিয়ে ভিসি স্যারকে ফোন করিয়েছে।
চিঠি উইথড্র করে নিয়েছেন ভিসি স্যার। এদিকে সামনের সপ্তাহেই পরীক্ষা।
জিসানের প্রিপারেশন একদম জিরো লেভেলে। এসাইনমেন্ট, ল্যাব ওয়ার্ক কিছুই করা হয়নি।
মাঝখানে মন মেজাজ খারাপ ছিল আর পরীক্ষা দেবে না বলে মেসেঞ্জার গ্রুপ, হোয়াটস এপ গ্রুপ, ফেসবুক গ্রুপ সব জায়গা থেকে লীভ নিয়েছিল সে। রুবাবা আবার সব জায়গায় তাকে এড করে দিয়েছে।
জোর গ্রুপ ডিসকাশন চলছে। ওরা এসাইনমেন্টও পাঠিয়ে দিয়েছে মেইলে।
সামান্য চেঞ্জ করে প্রিন্ট করে নিয়ে সাবমিট করে দিলেই হয়ে যায়। কিন্তু সেজন্য জিসানকে ক্যাম্পাসে যেতে হবে ফিজিক্যালি।
যদিও জমা দেওয়ার লাস্ট ডেট পেরিয়ে গেছে আগেই, তারপরও সেটাও বড় কোনো সমস্যা না। দিলেই হলো।
পরদিন সকালে এসাইনমেন্ট প্রিন্ট বাইণ্ডিং করে সাবমিট করে জিসান যখন বেরিয়ে আসছে ডিপার্টমেন্ট থেকে তখন প্রায় মুখোমুখি ধাক্কা লাগতে গেল আনানের সঙ্গে। একটুর জন্য লাগল না।
জিসান প্রাণপণ চেষ্টা করে মুখে সহজভাবে হাসি ফুটিয়ে বলল, “আরে এনি যে! কংগ্র্যাচুলেশন্স! তা খাওয়াবি কবে?”
আনানও নিজেকে সামলে নিতে নিতে বলল, “কীসের খাওয়া?”
“ওমা, তোর নতুন এফেয়ারের, আবার কীসের?”
“ওহ”, সুন্দর করে হাসল আনান, “খাওয়াব, খাওয়াব! কিন্তু আজকে তো পরীক্ষার জন্য আমাদের ব্যাচের ক্লাস নেই, প্রায় কেউই আসেনি আমাদের ব্যাচের!”
“পরীক্ষা দিয়ে?”
“ওক্কে ডান!”
সহজেই রাজি হয়ে গেল আনান। একটু অবাক হলো জিসান।
“কী ব্যাপার কঞ্জুস, নতুন টিউশ্যানি পাইছিস নাকি? একবারেই রাজি হয়ে গেলি যে?”
ঠোঁট ওল্টাল আনান। “আরে আমি কি আর খাওয়াব নাকি? তোদের ভাইয়াকে বলব! এফেয়ার হলে তো জি এফ এর ফ্রেণ্ডদের একবার খাওয়াতেই পারে, হক বানতা হ্যায়!”
“বাবা এনি, স্মার্ট হয়ে গেছিস দেখি!”
উত্তরে কিছু না বলে হি হি করে হাসল আনান। ঝকঝকে হাসি দেখে বোঝা যায় কেটে গেছে ওর মনের কোনো গভীর কোণায় লুকিয়ে থাকা বিষণ্ণতা।
কিন্তু সেই সুন্দর হাসি দেখেও কেন জানা নেই ঈর্ষার একটা সূক্ষ্ম খোঁচা অনুভব করল জিসান। উদাস ভঙ্গিতে বলল, “নাহ, থাক, ট্রিট দেওয়া লাগবে না!”
“ওমা, লাগবে না কেন? অবশ্যই লাগবে!”
আচমকা প্রসঙ্গ পালটে বলল জিসান, “এনি আমার যে কোনো প্রিপারেশন নাই, কী হবে আমার?”
আনান আবারও ঠোঁট উলটে বলল, “তোর প্রিপারেশন লাগে নাকি? তোর খাতায় এমনিই টিচাররা ঢেলে নাম্বার দিবে! ফারুক আহমেদের ছেলে জিসান আহমেদের খাতা বলে কথা!”
আনানের কথায় সামান্য হলেও সত্যতা আছে, এর আগে জিসান সাদা খাতা জমা দিয়ে এসেও ফেল করেনি। টিচাররা ওকে ডেকে নিয়ে এন্সার বলে দিয়েছিলেন, পাস মার্কস পাওয়ার মত লিখিয়ে ছেড়েছিলেন।
যদিও এই সব গ্রেডিং দিয়ে কিছু যায় আসে না জিসানের, কোনো রকম একটা সার্টিফিকেট হলেই হলো। কিন্তু আনানের কথাটা খোঁচার মত লাগল জিসানের।
কিছু না বলে চুপ করে রইল সে। আনান বলল, “ওকে ইয়ার আমি গেলাম! লাইব্রেরিতে যেতে হবে!”
তাকিয়ে রইল জিসান। কিছু একটা বদলে গেছে আনানের।
কিন্তু কী সেটা? তাকিয়ে থাকতে থাকতে বুঝতে পারল, চুল বাঁধবার স্টাইল পাল্টেছে আনান।
এখন আর মাঝে সিঁথি করা নেই, এক পাশে সিঁথি করা। কপালের এক পাশে ছোট করে কেটে রাখা চুল পড়ে আছে লুটিয়ে।
সব সময়ের মত কালো, সাদা, ধূসর কিংবা ছাই রঙের কাপড় না পরে মিষ্টি কমলা রঙের একটা ড্রেস পরেছে আনান, ড্রেসের রঙটা আভা ফেলেছে তার মুখেও। আর সব চেয়ে বড় ব্যাপার, আনানের মধ্যে সেই ভীতু ভীতু জবুথবু ভাবটা আর নেই।
ঠিক হচ্ছে না জেনেও আরো কিছুটা সময় আনানের পাশে থাকবার লোভে বলে ফেলল জিসান, “আমি আসি তোর সাথে? আমাকে একটু পড়িয়ে দিবি? মানে দাগিয়ে দিবি?”
যেন পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য দেখছে এমন ভঙ্গিতে কিছু ক্ষণ চোখ গোল গোল করে বলল আনান, “জিসান আহমেদ আর লাইব্রেরি? নো ওয়ে!”
“কেন, নো ওয়ে কেন?”
“জীবনে গেছিস তুই লাইব্রেরিতে?”
“না হয় গেলাম এবার, তোর কী তাতে? লাইব্রেরি কি তোর একার সম্পত্তি নাকি?”
“না তা হতে যাবে কেন? লাইব্রেরিতে কিন্তু ফোন সাইলেন্ট করে রাখতে হয় আর কোনো কথা বলা যায় না, জানিস তো?”
এ কথায় যথেষ্ট অপমানিত বোধ করল জিসান। আনান তত ক্ষণে হাঁটা ধরেছে লিফটের দিকে।
“আমাকে কী মনে হয় তোর? আমি কি প্লে গ্রুপের বাচ্চা?”
লিফট চলে এসেছে, আনান আর জিসানের সাথে লিফটে উঠল আরো একজন অপরিচিত। তার সামনে আর কিছু বলল না আনান, শুধু মুখ টিপে হাসল, হাসির ভঙ্গিটা বুঝিয়ে দিচ্ছে সে জিসানকে আসলে তাই মনে করে।
জিসান মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে আনানকে, চুলগুলো খোলা। হাতে একটা রাবার ব্যাণ্ড পেঁচিয়ে রাখা।
লাইব্রেরিতে ঢোকার আগ মুহূর্তে রাবারটা খুলে নিয়ে চুলগুলো বেঁধে নিল আনান, জিসানের মুগ্ধ চোখে চোখ পড়ে যেতেই লজ্জা পেয়ে বলল, “সকালে গোসল করে এসেছি, চুলগুলো ভেজা ছিল। তাই খুলে রেখেছিলাম।“
এখন আর আগের মত তেল চুপচুপে মাথায় ভার্সিটিতে আসে না সে, প্রতিদিন রাতে বাসায় ফিরে মাথায় তেল দেয় আর সকালে শ্যাম্পু করে ক্যাম্পাসে আসে। কিন্তু সে কথা জিসানকে বলার প্রয়োজন বোধ করল না।
গ্রুপ স্টাডির জন্য লাইব্রেরির পাশে আলাদা রুম আছে একটা, এখানে গ্রুপ স্টাডির অনুমতি আছে বলেই গলা নামিয়ে দুই একটা কথা বলা যায়। জিসান এর আগে কখনো লাইব্রেরিতে পড়তে আসেনি বলেই আনান তাকে নিয়ে মূল লাইব্রেরিতে ঢোকার ঝুঁকি নিল না, গিয়ে সরাসরি ঢুকল সেই রুমে।
এই রুমে ছোট ছোট কয়েকটা গোল টেবিল, আর প্রতিটি টেবিল ঘিরে ছয়টা চেয়ার রাখা। সাধারণত এসাইনমেন্টের গ্রুপগুলোতে ছয়জনের বেশি সদস্য থাকে না বলেই চেয়ারের সংখ্যা ছয়টা।
জিসান বসবার পর আনান নিজের লাইব্রেরি কার্ড দিয়ে বই তুলে আনল। এই টেক্সট বইগুলোর জন্যই ওর আসতে হয় লাইব্রেরিতে।
ওর ক্লাসের অন্যান্যরা সাধারণত পিডিএফ থেকে প্রিন্ট করিয়ে নেয়। আনান পিডিএফ পড়তে পারে না, আবার ওর নিজস্ব প্রিন্টার নেই বলে দোকান থেকে প্রিন্ট করে নেওয়াও অনেক খরচ।
নিজের মত করে লেকচার আর টেক্সট বুক মিলিয়ে সব চ্যাপ্টারের নোট করে নেয় আনান। জিসান যে পড়ার মত তেমন কিছুই আনেনি, সেটা ওর ব্যাগ দেখেই বুঝতে পেরেছিল।
তাই সে জিসানকে টেক্সট বুকের একটা চার্ট বের করে বসিয়ে দিল। “এইটা মাস্ট আসবেই, এইটা মুখস্থ কর। আমি পড়া নিচ্ছি একটু পরে।“
নিজের ব্যাগ থেকে নোট খাতা আর শিট বের করে পড়ায় ডুবে গেল আনান। অন্য দিকে বিপদে পড়ে গেল জিসান।
সে এই ভাবে পড়ে অভ্যস্ত না। কোনো দিনও পড়েনি।
গ্রুপে সবার সাথে হাসি ঠাট্টা করে একটু পড়া একটু খাওয়া দাওয়া, কেউ একজন পড়ে বাকিদের পড়িয়ে দিলে একটু শুনে নেওয়া, পরীক্ষার হলে গিয়ে বাকিটুকু শুনে নিয়ে কিছুটা আন্দাজ অনুমান করে লিখে ফেলা, না পারলে না লিখেই খাতা জমা দেওয়া এইভাবেই চালিয়ে এসেছে সে এত দিন। রিডিং রুমের সিরিয়াস পরিবেশ, লাইব্রেরির পিন পতন নিস্তব্ধতা আর আনানের গম্ভীর মনোযোগী মুখ সব মিলিয়ে সে পড়ল গভীর আতান্তরে।
চোখ তুলে আশে পাশে তাকিয়ে দেখল সবাই পড়ছে কিংবা পড়া নিয়ে আলোচনা করছে। আনানের দিকে তাকিয়ে দেখল সে গভীর মনোযোগে পড়তে পড়তে কামড়ে ধরেছে নিচের ঠোঁট।
হাতে একটা পেন্সিল, সেই পেন্সিল দিয়ে প্রতিটা বাক্যের কী ওয়ার্ডগুলোর নিচে দাগ দিচ্ছে আনান। মাঝে মাঝে কামড়ে ধরছে পেন্সিলের মাথা।
আচমকা চোখ তুলে তাকাল আনান, আর ধরা পড়ে গেল জিসান। আনান থমথমে মুখে বলল, “কী ব্যাপার?”
“আমি কিছুই বুঝতে পারছি না!” অসহায় মুখ করে বলল জিসান।
“কোন জায়গাটা বুঝতে পারছিস না, বল আমাকে!”
আসলে জিসান একটা অক্ষরও পড়েনি। সেই কথা কীভাবে বলবে?
আনানের হাত থেকে পেন্সিল নিয়ে নিল সে। “একটা ম্যাজিক দেখবি?”
কৌতূহলী হলো আনান। “কী ম্যাজিক?”
“এই দেখ”, আনানের নোটের একদম পেছনের পাতাটা সাদা ছিল।
সেই পাতায় গিয়ে চারটা ছোট ছোট মাছ আঁকল জিসান। “কী এগুলো?”
আনান দেখল উঁকি দিয়ে। “কী আবার? মাছ!”
এবার সেই মাছের সামনে ঠোঁট আর নিচে পা এঁকে দিল জিসান। “এবার কী? বল তো!”
আনান ভ্রু কুঁচকে বলল, “বুঝতে পারছি না!”
সেগুলোর সামনে একটা মোরগ আর মুরগি আঁকল জিসান। তারপর বলল, “এবার বল!”
আনান আরেকবার ভালো করে দেখে নিয়ে বলল, “মুরগির বাচ্চা?”
“এই তো পেরে গেছিস!” চওড়া হাসি হাসল জিসান।
হাসির উত্তরে হাসল না আনান। বরং কঠিন মুখে তাকিয়ে রইল জিসানের দিকে।
জিসান ভয় পাওয়া গলায় বলল, “কী হয়েছে?”
ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলল আনান। “দেখ জিসান তোর জন্য হয়ত ডিগ্রিটা তেমন ইম্পর্ট্যান্ট কিছু না। কিন্তু আমার জন্য ইম্পর্ট্যান্ট। এই গ্রেডিং, সিজিপিএ সব কিছুই। বিকজ আমাকে এগুলো দিয়ে চাকরি পেতে হবে। ইন ফ্যাক্ট চাকরি খুঁজতে হবে। আমার বিকেলে টিউশ্যনি করতে যেতে হয়। বাসায় গিয়ে নিজের কিছু কাজ করতে হয়। লাইব্রেরিতে পড়ার প্রতিটা সেকেণ্ড আমার জন্য ইম্পর্ট্যান্ট।“
বিবর্ণ হয়ে গেল জিসানের মুখ। “আয়াম সো স্যরি এনি! আই ওয়াজ ডিস্টারবিং ইউ!”
আনান কিছু বুঝে ওঠার আগেই উঠে দাঁড়াল জিসান। আর লম্বা লম্বা পা ফেলে বেরিয়ে গেল লাইব্রেরি থেকে।
আনান দ্রুত বেরিয়ে এলো ওর পেছন পেছন। ওর আহত মুখ দেখে খারাপ লাগছিল তার।
আনান যখন বেরিয়ে এল লাইব্রেরির দরজার বাইরে, জিসান তখন পৌঁছে গেছে লিফটের সামনে। সেখান থেকেই চিৎকার করে ডাকল আনান, “এই জিসান!”
আচমকা আনানের বাহু ধরে টেনে সরিয়ে আনল কেউ। “কী হয়েছে মেঘ?”
ফিরে তাকাল আনান। সায়ান!
অন্য দিকে আনানের ডাক পৌঁছেছে জিসানের কানেও। ফিরে তাকাল সে।
দৃশ্যটা দেখে চোখ প্রায় পুড়ে গেল তার। আনানের বাহুতে ছুঁয়ে আছে সায়ান।
বুকের ভেতর পাতাল নদীর মত কুলু কুলু শব্দে বয়ে যেতে লাগল ঈর্ষার চোরা স্রোত। জিসান বলতে চাইল, “বলো না কো কথা ওই যুবকের সাথে…”
কিন্তু মানুষ হয়ে জন্মানোর অনেক ভালো ব্যাপারের সাথে সাথে একটা খারাপ ব্যাপারও আছে। মনের অনেক কথা মনেই মাটি চাপা দিয়ে দিতে হয়।
তাই লিফট এসে থামলে লিফটে উঠে নেমে গেল জিসান। শুধু চোখে লেগে রইল মিষ্টি কমলা রঙের জামা পরে আনান, হাত উঁচু করে তার চুল বাঁধা, সিরিয়াস মুখ করে নোটে পেন্সিল দিয়ে মার্ক করা, পড়ার ফাঁকে ফাঁকে আনমনে পেন্সিল কামড়ানো, আর, আর…
আর ওই…সায়ান! কী এমন হতো ওই শেষের দৃশ্যটার জন্ম না হলে?
কিংবা…কী এমন হতো ওই শেষের দৃশ্যটায় সায়ানের বদলে স্বয়ং জিসান থাকলে?

চলবে

#মেঘবতী_মিথ্যে_বলেনি
।।১৫।।
“মেঘ, জিসানের সাথে কি তোমার কিছু ছিল?”
সায়ানের এমন প্রশ্নে কিছুটা অবাক হলো আনান। “কী থাকবে?’
বিরক্ত হলো সায়ান। “ইস, কী থাকবে! ভাব দেখে মনে হয় এই মাত্র জন্ম হলো উনার!”
হি হি করে হাসল আনান। “তোমার না মাথা খারাপ হয়ে গেছে!”
“আহা বলো না! তোমাদের কি এফেয়ার ট্যাফেয়ার ছিল?”
“আরে না! জিসানের সাথে তো রুবাবার এফেয়ার! কিংবা এখন না হলেও হয়ে যাবে কয়েক দিন পরে। দুজনে সারা দিন এক সাথেই থাকে তো! রুবাবা খুব টেক কেয়ার করে জিসানের। আমার সাথে এফেয়ার ছিল না, ট্যাফেয়ার ছিল! ওদের গ্রুপের সবাই মিলে লাইফ হেল করে দিত আমার! একবার কী হলো শোনো, আমার পেছনের সিটে বসে ব্লেড দিয়ে আমার ব্যাগ কেটে রেখেছিল! সেদিন আবার আমার ব্যাগ ভর্তি শিট ছিল। আমি ক্লাস শেষ করে উঠে দাঁড়াতেই সব শিট মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে এলোমেলো হয়ে গেল! আরেকবার…”
কল কল করে কথা বলে যাচ্ছে আনান, আসলে এত দিন কথা বলার মত কাউকে পায়নি বলে রাজ্যের কথা জমে ছিল ওর। কিন্তু সায়ানের মুখ গম্ভীর।
কথা থামিয়ে দিল আনান।
“কি হয়েছে?’
“তুমি যা বলছ, আর আমি যা দেখছি, দুটার মধ্যে কোনো মিল নাই তো!”
“মিল থাকবে কীভাবে? ইদানিং খুব ভালো ব্যবহার করে যে! এক সিনিয়র আপুর সামনে আমাকে ইনসাল্ট করতে এসেছিল। কী, আমার নাকি লেভেল নাই। আমিও দিলাম এক ডোজ। বাবার যোগ্যতা ছাড়া নিজের কিছু আছে নাকি ওর? তারপর থেকেই দেখছি ওদের গ্রুপের সবার এটিচ্যুড চেঞ্জড হয়ে গেছে, এখন আর অত পেছনে লাগে না আমার।“
কথা বলতে বলতে ওরা দুজন একটু সরে এসেছে লাইব্রেরির সামনে থেকে। আনান হাত ধরল সায়ানের।
সায়ান প্রসঙ্গ পালটে বলল, “কখন বের হবে?”
“আমি তো ভাবলাম চারটা পর্যন্ত পড়ে পড়াটা একটু এগিয়ে রেখে বের হই। তোমার যদি অন্য কোনো প্ল্যান থাকে তাহলে…”
“না ঠিক আছে তাহলে, পড়ো।“
ঘড়ি দেখল আনান। “লাঞ্চ করে আসা যায় অবশ্য!”
“বাইরে কোথাও যেতে চাও?”
“না এখন সময় নেই। ক্যান্টিনেই বসি?”
“চলো যাই তাহলে।“
ক্যান্টিনে বসে সায়ান জিজ্ঞেস করল, “কী খাবে?’
“তুমি যা খাবে তাই!”
খিচুড়ির অর্ডার দিয়ে দিল সায়ান। অর্ডার নিয়ে ছেলেটা চলে গেলে কথাটা তুলল আনান।
পরীক্ষা শেষ করে ওদের একদিন খাওয়াতে হবে।
“কাদের?”
“ওই, আমার ব্যাচের কয়েকজনকে।“
“ফ্রেণ্ড তোমার?”
“ব্যাচমেট যেহেতু, ফ্রেণ্ডই তো বলা যায়!”
“না, মানে, তোমার পাশে তো কখনো কাউকে দেখিনি কোনো দিন! অন্তত আমি যখন তোমাকে ফলো করতাম তখন তো দেখেছি তুমি একা একাই ঘুরতে।”
“না, জিসান বলল আজকে। এর আগে যাদের এফেয়ার হয়েছে তারা খাইয়েছে তো!”
“সেই খাওয়ানোর প্রোগ্রামগুলোতে কি তাদের কেউ কখনো তোমাকে ইনভাইট করেছে?”
চুপ করে গেল আনান। খিচুড়ি নিয়ে এসেছে ক্যান্টিনের ছেলেটা।
প্লেট নামিয়ে রেখে চলে গেলে চোখ নাচাল সায়ান। “কী বলো, করেছে দাওয়াত?”
“না তা করেনি, কিন্তু…”
“সেটাই মেঘ।“ খেতে শুরু করল সায়ান। “আমার ওদের ট্রিট দিতে কোনো আপত্তি নাই কিন্তু তুমি ওদের এখনকার ভালো ব্যবহারে অতীতটাকে ভুলে যেও না! কেউ যেন ভালো বিহেভ করে তোমাকে বোকা না বানায়। এখন জাস্ট এখন তোমার সময় ভালো যাচ্ছে দেখে তোমার আশেপাশে এসে জুটেছে। এরা কেউই তোমার সত্যিকারের বন্ধু না, কখনো ছিল না।”
অন্য মনস্ক ভঙ্গিতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল আনান। এখান থেকে কৃষ্ণচূড়া গাছটা কাছ থেকে দেখা যায়।
তার একবার বলতে ইচ্ছে হলো যে জিসান হয়ত সত্যি সত্যিই বদলে গিয়েছে, না হয় তার জন্য রিস্ক নিয়ে ওই গণ্ডগোলের ভেতরে যেত না সেই প্রোগ্রামের দিন। কিন্তু এ কথায় আবার সায়ান অন্য রকম কিছু ভেবে বসে কি না, তাই কিছু না বলে চুপ করে রইল।
বাকি খাবারটুকু দুজনেই শেষ করল চুপচাপ। হাত নেড়ে ছেলেটাকে ডাকল সায়ান।
দুটো কোল্ড ড্রিংক্সের অর্ডার দিল। সায়ানের জন্য কোক, আনানের ফান্টা, যেমন ওর পছন্দ।
ছেলেটা চলে গেলে বলল, “পরীক্ষা শেষ করে একবার আমাদের বাসায় যেতে হবে তোমাকে!”
প্রায় রক্তশূন্য হয়ে গেল আনানের মুখ। “কেন?”
“আম্মু দেখতে চেয়েছে তোমাকে!”
“আমি এখনো প্রিপেয়ারড না!”
“কীসের জন্য প্রিপেয়ারড না?”
“আমার কোনো মেন্টাল প্রিপারেশন নাই!”
মুখের সামনে উড়তে থাকা মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে সায়ান হাত দিয়ে উড়িয়ে দিল কথাটা। “কীসের মেন্টাল প্রিপারেশন? আম্মু কি তোমার পড়া ধরবে? নাকি কী কী রাঁধতে পারো জিজ্ঞেস করবে? আমাদের বাসায় রান্নার জন্য আলাদা লোক থাকে, রান্না করতে হবে না তোমাকে!”
আনান কাতর গলায় বলল, “তার আগে তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিল!”
ড্রিংক্স রেখে গেছে ছেলেটা। সায়ান কোকের বোতলে চুমুক দিয়ে বলল, “কী কথা, এখন বল!”
“আমার একটু সময় দরকার!”
“আচ্ছা, তাহলে আজকে রাতে বল!”
“এসব কথা মেসেজ লিখে হয় না!”
“আচ্ছা তাহলে ফোন করেই বল!”
“পরীক্ষার পর এক দিন বসতে হবে তোমার সাথে! তুমি কিছুই জানো না আমার সম্পর্কে!’
“কী জানি না?”
“আমার অনেক বড় একটা প্রবলেম আছে!’
সায়ান ঝুঁকে এসে গলা নামিয়ে বলল, “কী প্রবলেম? তুমি আসলে জেনেটিক্যালি ফিমেইল না, মেইল? কিন্তু ফিজিক্যাল এপিয়ারেন্স মেয়েদের মত?”
“ধ্যাত!”
“দেন, লেট মি থিংক!” চিন্তিত ভঙ্গিতে ঠোঁটে আঙুল রেখে কিছু ক্ষণ চিন্তা করল সায়ান। “আর ইউ লেসবিয়ান?”
“সায়ান!”
“তাহলে কি তোমার ইউটেরাসে কোনো টিউমার কিংবা ওভারিতে সিস্ট বা ওই রকম কিছু, ওই যে সিনেমায় বলে যে আমি কখনো মা হতে পারব না? সেক্ষেত্রে আমরা বেবি এডোপ্ট করতে পারি…”
আনান রেগে মেগে অস্থির হয়ে উঠে দাঁড়াতে গেল। সায়ান ওর হাত ধরে বসিয়ে দিল আবার।
“বসো, ফান্টা খাও!”
“তোমার এই সব গল্প উপন্যাস সিনেমার প্রবলেম ছাড়াও মানুষের লাইফে প্রবলেম থাকে সায়ান!”
“থাকে, আমি জানি! কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসি মেঘ, তোমার কোনো প্রবলেমেই আমার কোনো প্রবলেম নাই!”
ঠোঁট ওল্টাল আনান। “না শুনেই?”
“শোনাও তাহলে! শোনাচ্ছও তো না!”
সায়ানের হাতটা আনানের হাতের ওপরেই রাখা ছিল আলগোছে। এবার হাতটা আঁকড়ে ধরল আনান।
“ভয় হয়, শোনার পর তুমি যদি আমাকে ছেড়ে চলে যাও?”
“এত ভয়! বিশ্বাস নাই আমার ওপরে?”
বাইরে তাকিয়ে ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলল আনান। “তোমার ওপরে আছে কিন্তু পৃথিবীর ওপরে নাই।“
“এ কথার মানে কী মেঘ?”
“মানে কিছু না।“
বিলের টাকাটা বের করে তার ওপরে খালি কাপ দিয়ে চাপা দিয়ে রেখে উঠে দাঁড়াল সায়ান।
“আর তোমার ফ্রেণ্ডদের কবে কোথায় খাওয়াতে চাও আগের দিন বলো, বান্দা হাজির হয়ে যাবে!”
সাথে সাথে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল আনান। তার ব্যাচমেটদের খাওয়ানোর বিলটা সে নিজেই দেবে।
সায়ানকে দিতে দেবে না। কিন্তু এখন আর সে কথা বলল না তাকে।
শুধু মাথা ঝাঁকাল নীরবে। দুজন পাশাপাশি হেঁটে সিঁড়ি বেয়ে এক ফ্লোর নিচে নামল।
লাইব্রেরির দরজায় দাঁড়িয়ে বিদায় জানিয়ে লাইব্রেরির ভেতরে ঢুকে গেল আনান। আজকে অনেকটা সময় নষ্ট হয়েছে।
রিডিং রুমে ঢুকে ওর রেখে যাওয়া বই খাতা বের করে আবার বসল আনান। শিট খুলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল জিসানের আঁকা মুরগির বাচ্চাগুলোর দিকে।
ফিক করে হেসে ফেলল নিজের অজান্তেই। একবার ভাবল মুছে ফেলবে রাবার ঘষে।
কী মনে করে রাবার হাতে নিয়েও রেখে দিল আবার। আনানের শিটের মধ্যে জিসানের এঁকে রেখে যাওয়া মোরগ মুরগি পরিবার ছবিতে ঘুরে বেড়াতে লাগল বহাল তবিয়তে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here