মেঘমুখ,চতুর্থ পর্ব

0
356

#মেঘমুখ,চতুর্থ পর্ব
#লেখনীতে সবুজ আহম্মদ মুরসালিন

দু’দিন কেটে গেলো, নীলা একবারও কল রিসিভ করেনি। মেসেজের উত্তর দেয়নি৷ বার’কয়েক বার ফোন দিয়েছি, মেসেজ দিয়েছি। নীলার কোনো রেসপন্স পাইনি। প্রতিবার ফোনে কল যায় তবে ওপাশ থেকে কেউ রিসিভ করে না৷ ফোনে রিং যাবার সময় আমি অদ্ভুত সব শব্দ শুনতে পাই। তবে কিছুই বুঝতে পারি না। সব কিছু এলোমেলো। অদ্ভুত। ভূতুড়ে।

বৃষ্টি নেমেছে৷ খুব বৃষ্টি হচ্ছে। দুপুরে ইন্টারভিউ দিয়ে বাসায় ফেরার সময় আকাশ কালো মেঘে জমে ছিলো। এখন বিকাল। বিকালের মেঘ গুলো বৃষ্টি হয়ে নেমে আসছে নগরীতে। মন খুব খারাপ। এই নিয়ে ১৬’টা ইন্টারভিউ দিয়েছি। সব জায়গায় ব্যর্থ৷ ব্যর্থ!

কিছু মানুষের জীবনে সফলতার চেয়ে ব্যর্থতার পরিমাণ বেশি থাকে। তবে, সেই সব মানুষগুলোর জীবনে হঠাৎ করে অলৌকিক ভাবে খুব বড় সফলতা আসে। সেই সফলতা বাকিটা জীবন সুখে থাকার জন্য যথেষ্ট। আমিও অপেক্ষা আছি।

আমার জীবনে কি সফলতা আসবে? সফলতা’কে কি ছুঁয়ে দেখতে পারবো? এ সব ভাবতে ভাবতে ছাঁদে চলে এসেছি। আজ বরং ভিজি৷ এই বৃষ্টির পানিতে ভিজে সকল ব্যর্থতা ভুলে যাই৷ সকল কষ্ট, সকল খারাপ লাগার অনুভূতি বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে যেতে দেই। আজ বৃষ্টি হই। তুমুলঝড় হই। ঝড়ে সব এলোমেলো চিন্তাগুলোকে উড়িয়ে দেই। আজ আমি পাখি হই। আচ্ছা, পাখি’রা কি বৃষ্টি মধ্যে উড়ে?

সন্ধ্যা হয়ে গেছে। খুব মাথা ব্যথা করছে। রুমে এসে কোনো রকম মাথা মুছে, কাপড় চেঞ্জ করে শুয়ে পরলাম। রাকিব বার কয়েকবার রান্না করার জন্য ডাকতে এলো রুমে। আমার মাথা তুলার মত শক্তি নেই। কথা বলার মত শক্তি নেই। আবার ডাকতে এসে গায়ে হাত দিয়ে চমকে উঠে বলল, ‘অভ্র, তোর তো ভীষণ জ্বর। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো?’
খুব কষ্টে উত্তর দিলাম, ‘না, দরকার নাই। আমার ড্রয়ারে ঔষধ আছে। তুই আমাকে একটু পানি আর ড্রায়ার থেকে ওষুধ বের করে দে৷ আমি খেয়ে শুয়ে থাকি।’
‘আচ্ছা।’
‘তুই আজকে কিছু একটা রান্না করে খেয়ে নে। আমি রাতে খাবো না কিছু।’
‘আমাকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। তুই ওষুধ খেয়ে ঘুমা। আমি কি থাকবো আজকে তোর রুমে? যদি কিছু দরকার পরে।’
‘না দরকার নেই। সমস্যা হবে না। ওষুধ খেয়েছি, সুস্থ হয়ে যাবো সকালের মধ্যে।
‘তাহলে আমি মাঝে মাঝে এসে দেখে যাবো।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’

মধ্যরাত হবে হয়তো৷ প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে। চোখ বন্ধ করে থাকতে পারছি না আবার চোখ খোলা রাখতে পারছি না। মনে হচ্ছে কানের কাছে, খুব কাছে কেউ একজন চিল্লাচিল্লি করছে, সাথে বাইরে থেকে আসা গাড়ি চলার শব্দ, ফ্যান ঘোরার শব্দ সব এক সাথে কানে আসছে। এসব শব্দ গুলো কানের আসার সাথে সাথে সরাসরি মাথার মধ্যে চলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, মাথাটা ব্যথায় ফেটে যাবে এক্ষনি।

কয়টা বাজে? কত রাত হয়েছে? সকাল হতে কি অনেক দেরি? এসব প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে৷ ঘুম আসছে আবার ঘুম আসছে না। মনে হচ্ছে একটা বন্ধ রুমে আটকে পড়েছি। কিছুতেই বের হতে পারছি না। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে যাবে ভাব। আমি খাটের আশেপাশে হাত দিয়ে মোবাইল খুঁজতে লাগলাম। ক’টা বাজে জানতে না পারলে মাথা ব্যথা আরো দিগুণ হবে। এদিক ওদিক হাত দিয়ে তালাশ করতেই পেয়ে গেলাম ফোন। ফোনের লক বাটনে চাপ দিয়ে কিছুতেই লক খুলতে পারছি না। ফোন খুলছে না কেনো? মাথা ভো ভো করে ঘুরছে। প্রচন্ড চাপ অনুভব করছি। হঠাৎ পিপাসা পেয়ে গেলো। পানি খেতে হলে খাট থেকে নেমে টেবিলের কাছে যেতে হবে। খুব কষ্ট হচ্ছে নামতে। তবুও নামতে হবে, মনে হচ্ছে এখন পানি না খেলে আর কখনো পানি খেতে পারবো না। নেমে পানি খেয়ে আসার পথে হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম।

ঘুম ভেঙে দেখি সাদা রঙের বিছানায় শুয়ে আছি। পাশে একটা জানাল। জানালায় সাদা পর্দা টাঙানো। অদ্ভুত, এখানে প্রায় সব কিছুই সাদা। তবে জানালা বন্ধ। জানালাটা খুলে দিতে ইচ্ছা করছে। তবে এখন বিছানা থেকে নামতে ইচ্ছা করছে না। মানুষ খুব অদ্ভুত। কখন কি ইচ্ছা করে সে নিজেও জানে না। উলটো দিকে ঘুরে দেখে কিছুক্ষণ পর বুঝলাম আমি হাসপাতালের ব্রেডে শুয়ে আছি। কিছুক্ষণ পর দরজা দিয়ে কেউ একজনের ঢোকার শব্দ পেয়ে তাকাতেই চমকে গেলাম।

‘মা, তুমি এখানে? কখন এসেছো?’ মাকে এখানে দেখে আমি খুব অবাক হলাম। রীতিমতো চমকে গেলাম।
‘দুপুরে এসেছি। রাকিবের ফোন পেয়ে। কেমন আছিস এখন?
‘ভাল আছি। বাসার সবাই কেমন আছে? আনিকা, বাবা কেমন আছে? এখন কয়টা বাজে? এখন কি বিকাল?’
‘দেখতে পাচ্ছি, আমার ছেলেটা খুব ভাল আছে। এতো ভাল আছে যে এখন হাসপাতালে ব্রেডের পাশে বসে তার সাথে কথা বলতে হচ্ছে। তুই কাল রাতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলি। তোর বন্ধু ভোরে এম্বুল্যান্স ডেকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে আমাকে ফোন দিয়েছে। আমি ফোন পেয়ে সাথে সাথে চলে এসেছে। দুপুরে এসে পৌঁছেছি। এসে দেখি তুই ঘুমিয়ে আছিস। শুনলাম ডাক্তার তোকে কড়া ডোজের ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়েছে। আর বাসার সবাই ভাল আছে। আমি একা এসেছি। আনিকার পরীক্ষা ছিলো তাই ও আসতে পারেনি।’
‘তোমার আসতে কোনো সমস্যা হয়নি তো? আর আমি কি একদিনের মত ঘুমিয়ে আছি। এই সামান্য জ্বরের কারনে।’
‘আমার আসতে কোনো সমস্যা হয়নি। তোর সামান্য জ্বর! তুই জানিস কি পরিমান জ্বর ছিলো। এখন একটু কম। ডাক্তার বলেছে, অতিরিক্ত বৃষ্টিতে ভেজার কারনে জ্বর এসেছে, সাথে দুশ্চিন্তা, টেনশন, ঠিকমতো খাবার না খাওয়া, রাত জাগা সব কিছু মিলে তোর শরীর খুব দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। এই কয়দিনে একদম কাবু হয়ে গেছিস৷ তা এতো দুশ্চিন্তা, টেনশন কিসের জন্য। চাকরি? নাকি অন্য কিছু? তোর আব্বু কতবার বলেছে ব্যংকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিবে। এবার বললে আমি আর তোর হয়ে না বলতে পারবো না। বাবার ভয়ে বাবাকে সরাসরি কিছু বলিস না। সব আমার বলতে হয়। আর আমার কথা শুনতে হয়। এই বলে দিলাম, আমি আর তোর জন্য কনো কথা শুনতে পারবো না।’

‘মা, মা, মা!’
‘কি হলো, মা, মা, মা করছিস কেনো। আমি তোর কোনো কথায় রাজি হবো না৷’
‘মা, মা, মামনী৷ এতো টেনশন করো না৷ আমি সুস্থ হয়ে যাবো। তুমি কি জানো, তুমি যখন খুব টেনশন করো তখন একটার পর একটা কথা বলতে থাকো। বাচালের মত কথা বলেই যাও।’
‘হ্যাঁ, আমি তো এখন বাচাল। আমি তো ভাল না। তোরা বাপ-বেটাই শুধু ভাল। তোদের কথাই সব সময় ঠিক। মাঝখানে আমি শুধু কষ্ট পাই।’
– এই দেখো, আবার চোখে পানি। প্লিজ মা কান্না করবে না। তোমার চোখে পানি দেখলে আমার খুব কষ্ট হয়। এখন তুমি বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নেও। আমার মাথা ব্যথা করছে। আমি একটু ঘুমাবো।’
‘আচ্ছা, আমি রাতে আসবো খাবার নিয়ে। বল কি খাবি, কি রান্না করবো?’
‘আমার পছন্দের খাবার কোনটা সেটা কি আবার বলে দেওয়া লাগবে?’
‘না, লাগবে না। আমি জানি।’

মা চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর রাকিব রুমে ঢুকলো।
পাশে এসে বসে জিজ্ঞাসা করলো, ‘কিরে এখন কি অবস্থা? কেমন আছিস?’
‘এইতো কিছুটা ভাল লাগছে।’
‘আচ্ছা বিশ্রাম নে। আমি বাইরে আছি।’
‘শোন, আমার ফোন কোথায়?’
‘ফোন মনে হয় বাসায় আছে৷ কেনো, দরকার?’
‘হ্যাঁ, খুব দরকার। মনে হয় চার্জ শেষ। তুই এক কাজ কর। বাসায় গিয়ে ফোনে চার্জ দিয়ে নিয়ে আয়।’
‘তোকে এখানে একা রেখে যাব?’
‘আরে আমি ভাল আছি। আমার সমস্যা হবে না। তুই যা। রাতে মা যখন আসবে সাথে আসিস। আর মনে করে ফোন নিয়ে আসবি।’
‘আচ্ছা, নিয়ে আসবো। তুই বিশ্রাম কর।’

রাকিব চলে গেলো। ঘুম আসছে না। নীলার কথা খুব মনে পড়ছে৷ নীলা কি কোনো মেসেজ বা ফোন দিয়েছিলো? ফোন দিলে তো ফোন বন্ধ পেয়েছে নিশ্চয়। ফোন বন্ধ পেয়ে কি ভেবেছে কে জানে!

সময় মত মা আর রাকিব চলে এলো। রাতে খাবার খেয়ে মা সাথে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে মা চলে গেলে ফোন চালু করলাম। চালু করার পর সাথে সাথে কয়েকটা মেসেজ এলো। সিম কোম্পানির লোকদের খেয়েদেয়ে কাজকর্ম নাই। সারাদিন শুধু মেসেজ দিতেই থাকে। মেজাজটা খারাপ করে দেয়। হাঠাৎ নীলার মেসেজ চোখে পরলো। মেসেজে লিখেছে,

‘আপনার ফোন বন্ধ কেনো? আপনাকে অনেকবার ফোন দিয়েছি।’
‘রাগ করেছে? আপনার ফোন রিসিভ করিনি বলে কি রাগ করে ফোন বন্ধ করে রেখেছেন?’
এই মেসেজ দু’টি রাত ১ টায় এসেছে।

নীলা সকালেও মেসেজ পাঠিয়েছে।
‘শুভ সকাল! সকালে বারকয়েক ফোন দিয়েছি। রাতের মত বন্ধ। রাতে ভেবেছিলাম হয়তো ঘুমিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু যেহেতু এখনো ফোন বন্ধ করে রেখেছেন সেহেতু আমি নিশ্চিত আপনি খুব রাগ করেছেন আমার উপর। আমি সত্যি সরি বলছি।’

দুপুরে মেসেজ পাঠিয়েছে। লেখা,
‘শুনুন৷ আমিও আপনাকে খুব পছন্দ করি। তবে, সব মেয়ে একটু সময় চায় ভাল করে ভাবার জন্য। আপনি তো খুব অদ্ভুত। এমন ভাব করছেন কেনো। আর ফোন বন্ধ করে কি পুরুষত্ব দেখাচ্ছেন?’
এই মেসেজটা পড়ে মন ভালো হয়ে গেলো। ঠোঁটে হাসি চলে এলো।

‘আমাকে আর কখনো ফোন বা মেসেজ দিবেন না। আমি আপনার সাথে কথা বলতে চাই না। বাই।’

সবগুলো মেসেজ পড়ে আমি যতটা অবাক ঠিক ততটা খুশি। অনেকটা খুশি। আমি খুব ছোট একটা মেসেজ টাইপ করে কয়েক মিনিট ভেবে সেন্ড বাটনে ক্লিক করে পাঠিয়ে দিলাম।

অপেক্ষা করছি। এক ঘন্টা হয়ে যাবার পরও ওপাশ থেকে কনো রিপ্লাই আসে নি। এখন সত্যি মেজাজ খুব খারাপ হচ্ছে।

মেয়েরা আসলে অদ্ভুত। যখন কেউ মেসেজের উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে তখন মেসেজ দিবে না৷ আর যখন ঘুমিয়ে কিংবা অন্য কাজে বস্ত থাকবো কেমন করে বুঝে ঠিক তখনি গুরুত্বপূর্ণ মেসেজগুলোর রিপ্লাই দিবে।

অবশেষে ঠিক এক ঘন্টা, চল্লিশ মিনিট পর মেসেজ এলো শুধু হা হা রিয়েক্ট। নিচে লেখা, ‘এটা দিয়ে আমাকে মেসেজ দিতে বাধ্য করেছিলেন। তাই এটাই এখন আপনার প্রাপ্য।’

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here