মেঘমুখ,তৃতীয় পর্ব

0
588

#মেঘমুখ,তৃতীয় পর্ব
#লেখনীতে সবুজ আহম্মদ মুরসালিন

‘অভ্র, এই অভ্র, রাতে কি রান্না হবে? কিরে, এখনো ঘুম? সেই বিকালে ঘুমিয়েছিস। উঠবি না?’

আমি ঘুমঘুম চোখে রাকিবের দিকে তাকালাম।

‘আজ সারাদিন, কিছুই রান্না করিস নি? সকালে, দুপুরে কি খেয়েছিস? আমি অফিস থেকে এসে দেখি কিছুই রান্না করা নাই। তোর কি শরীর খারাপ? জ্বর এসেছে?’

নীলার সাথে দেখা করে বাসায় এসে শুয়ে ছিলাম। কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছি জানিনা।

ঘুমঘুম কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ক’টা বাজে?’
রাকিব জবার দিলো, ‘রাত ৮.১৮।’
‘এতো সময় ঘুমিয়েছি? সরি রে। কিছুই রান্না করতে পারিনি। সকালে তুই অফিসে যাওয়ার পর আমি চা বিস্কুট খেয়ে বেড়িয়েছিলাম। দুপুরে বাইরে খেয়েছি। সে জন্য আজকে সকালে রান্না করিনি। ভেবেছিলাম সন্ধ্যায় করবো। কিন্তু কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা। তুই কখন এসেছিস?’

প্রশ্ন শুনে চমকে গেলো রাকিব।
‘মনে নেই তোর? তুই-তো দরজা খুলে দিলি। দরজা খুলে কোনো কথা না বলে রুমে এসে শুয়ে পড়লি। ভাবলাম হয়তো শরীর ভাল না। তাই আর বিরক্ত করিনি।’
‘আচ্ছা, আমি হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আসছি। এসে একসাথে রান্না করবো।’
‘আচ্ছা৷’

রান্না শেষ করে, খেয়ে রাকিবের সাথে গল্প করার সময় হঠাৎ নীলার মেসেজ এলো।

‘কি করেন?
‘রাকিবের সাথে আড্ডা দেই। রাতে খেয়েছেন?’
‘হ্যাঁ, খেয়েছি। ব্যস্ত থাকলে পরে কথা বলি।’
‘না না, ব্যস্ত না। আপনি কি করেন?’
‘জানালা দিয়ে আকাশ দেখি। অন্ধকারে মধ্যে তারাগুলো মিটিমিটি করে জ্বলছে। সুন্দর লাগছে।’
‘চাঁদ আছে আকাশে?’
‘আছে, খুব সুন্দর। আজকের চাঁদটা খুব সুন্দর।’
‘আচ্ছা, চাঁদ কি আপনার থেকেও বেশি সুন্দর? নাকি একটু কম সুন্দর?’
‘আমি মোটেও সুন্দর না। আর চাঁদ আমার থেকে বেশি সুন্দর। জানালা খুলে নিজেই দেখুন। অনেক সুন্দর আজকের চাঁদ, মুগ্ধ হবেন দেখে।’
‘আমিও দেখছি। তবে আমার মনে হচ্ছে, চাঁদ ঠিক আপনার মত সুন্দর।’
‘আপনাকে বলেছে! চাঁদ বেশি সুন্দর। ‘

‘এই অভ্র, কার সাথে কথা বলিস। আবার একা একা হাসতাছিস? বিশেষ কেউ?’
রাকিবের কথা শুনে পিছন ফিরে তাকালাম। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, ‘না, তেমন কেউ না। এই এক বন্ধুর সাথে কথা বলছি’
‘ওহ, আচ্ছা ঠিক আছে বল। তাহলে আমি ঘুমাতে যাচ্ছি। সকালে আমার অফিস আছে।’
‘ঠিক আছে। তুই গিয়ে ঘুমা। কাল কথা হবে।’

‘ব্যস্ত বুঝি?’ নীলা প্রশ্ন করলো।
‘না এখন সম্পূর্ণ ফ্রি আছি।’
‘কি করবেন এখন?’
‘নদী দেখবো!’
‘এই ঢাকা শহরে, গিজগিজ করা বিল্ডিং, গাড়ি-রিক্সার মধ্যে নদী পাবেন কোথায়?’
‘নদী কি একমাত্র নদীর কাছে গিয়ে দেখা যায়? এই কোলাহল, ব্যস্ততার মধ্যেও নদী দেখা যায়।’
‘কীভাবে?’
‘জানালা দিয়ে কি দেখতে পাচ্ছেন?’
‘আকাশ, রাস্তা, গাড়ি, রিক্সা ইত্যাদি।’
‘এই যে রাস্তা, একে নদী মনে করুন। রিক্সা গুলোকে নৌকা মনে করুন, বাস গুলোকে লন্স মনে করুন। দেখবেন চোখের সামনে নদী ভেসে উঠবে।’
‘বাহ, দারুণ বুদ্ধি তো।’
‘আমার যখন একা লাগে, যখন মন খুব খারাপ থাকে তখন এই রাস্তা কে নদী মনে করে দেখি। আকাশ দেখি। নিমিষেই মন ভাল হয়ে যায়।’
‘জানেন, আপনি খুব সুন্দর করে কথা বলেন। তা এই পর্যন্ত কথা বলে কয়টা মেয়ে পটিয়েছেন?’
‘গুনে দেখতে হবে, ঠিক মনে নেই। হবে ১০/১২ টা।’

নীলা মেসেজ দেখেও রিপ্লাই দেয় না। হয়তো মন খারাপ করেছে। অনেকক্ষণ পর আমি আবার মেসেজ দিলাম।

‘কি হলো? কথা বলছেন না কেনো?’
‘একটু ব্যস্ত ছিলাম।’

বাহ, কত সহজে মানুষ অযুহাত দিতে পারে।

‘শুনুন, আমি আগে কাউকে পটায়নি, আর কেউ পটেও নি। আমার জীবনে আগে কেউ ছিলো না!’
‘সত্যি বলছেন? তবে এখন কি কেউ আছে?’
‘ভেবে দেখতে হবে।’
‘কি… কি বললেন? ভেবে দেখা লাগবে?’
‘রাগ করছেন কেনো?’
‘আমি রাগ করার কে, কেউ না৷ আমাদের সম্পর্ক তো এখনো আপনিতেই আছে। আমি তো আপনার তুমিই না৷ এখানে রাগ করার অধিকার নেই।’

‘যদি অধিকার দিতে চাই৷ রাগ করবেন? অভিমান করবেন? মাঝে মাঝে বকে দিবেন? অভিমান করে কথা না বলে থাকবেন? আবার কিছুক্ষণ পর অভিমান ভেঙে বলবেন, ভালোবাসি!

‘না, বয়ে গেছে আমার৷ শুধু শুধু রাগ করতে। বলবো না কিছুই?

‘আমি যে চাই। কেউ রাগ করুক, অভিমান করুন, বকে দিক, রাগ করে দেখা হলে মারুক, তবুও কেউ একজন থাকুক। খুব আপন কেউ একজন থাকুক। যাকে অকারণে ভালোবাসবো, না বলা কথাগুলো নিমিষেই বলে দিতে পারবো। যার কাছে কষ্টগুলো জমা রাখতে পারবো। সুন্দর মুহুর্ত গুলো, সুন্দর সময়গুলো ভাগ করতে পারবো। আপনি কি আমার তুমি হবেন? তুমি কি আমার সেই তুমি হবে?’

নীলা কিছু বলেনা। চুপ, চুপ, চুপ করে থাকে। মেসেজের উত্তর দেয় না। আমার খুব ইচ্ছে করে নীলার কন্ঠ শুনতে। আমি ফোন দেই। নীলা ফোন ধরে, ফোন ধরে চুপচাপ থাকে। কোনো কথা বলে না। তবুও আমি কিছু একটা শুনতে পাই৷ আমি শুনতে পাই এই নৈশব্দ মাঝে কেউ একজন বলছে, ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি৷ আমি শুনতে পাই, কেউ একজন বলছে, আমি তোমার তুমি হতে চাই। আমি আরো শুনতে পাই, আমি তোমার সেই মানুষটি হতে চাই। আমি বার বার এ কথাগুলো শুনতে পাই। কিন্তু কেউ কোনো কথা বলে না। কেউ কিছুই বলে না। তবুও আমি কেনো শুনতে পাই। কেনো?

অনেকক্ষণ পর নীলা বলে, ‘আজ রাখি। কাল কথা হবে। বাই, শুভ রাত্রি।’

এটা বলে ফোন কেটে দেয় নীলা। আমি কানে ফোন চেপে রাখি৷ ওপাশে কেউ নেই। তবুও আমি শুনতে পাই, কেউ একজন বলছে, ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি।

এভাবে কেটে যায় অনেকটা সময়। অবশেষে ফোন নামিয়ে রেখে জানালার দিকে তাকাই। একটা নদী দেখতে পাই। খুব ছোট একটা নদী। নদীর মধ্যে চাঁদের প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে। চাঁদটা আসলেই সুন্দর। অনেক সুন্দর। এভাবে আকাশ দেখি, নদী দেখি। আর মনে মনে ভাবি।

“আজকার ‘শুভ রাত্রি’ খুব অপ্রিয় বাক্য মনে হয়
শুভ রাত্রি বললে যে কথোপকথনের ইতি টানতে হয়”

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here