মেঘমুখ,দ্বিতীয় পর্ব

0
529

#মেঘমুখ,দ্বিতীয় পর্ব
#লেখনীতে সবুজ আহম্মদ মুরসালিন

সকালে ঘুম থেকে উঠে তারাহুরো করে হাতের কাজগুলো শেষ করেছি। তারাহুরো করে চা বানাতে গিয়ে হাত কিছুটা পুড়ে গেছে। তবে, সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। গত এক মাস ধরে যাকে খুব পছন্দ করি তার সাথে আজ প্রথম দেখা হবার কথা। গতকাল প্রথম মেসেজে কথা হয়েছে। একটা মাস কোনো মেসেজ দিতে পারিনি দ্বিধায়। তবে বুদ্ধি করে হা হা রিয়েক্ট দেওয়া, এটা কাজে দিবে কিছুটা অনুমান করেছিলাম। কিন্তু সত্যি, সত্যি কাজ করেছে৷ স্বপ্ননীলা মেসেজ দিয়েছে। প্রথমে কিছুটা রাগ করেছিলো। তবে রাগ বেশিক্ষণ থাকেনি। কথা বলার শেষে নিজ থেকে আজ দুপুরে দেখা করার কথা জানিয়েছে।

মধ্যদুপুর, রোদে পুড়ে পুড়ে খাক হয়ে গেছে মাটি ও মানুষ। নিজের হাতে বানানো, এক কাপ চা’য়ের সাথে বিস্কুট ভিজিয়ে সকালের খাবার শেষ করেছি। যাত্রাবাড়ী থেকে রিক্সায় সরাসরি মৌঁচাক চলে এসেছি। স্বপ্ননীলার সাথে দেখা করার জন্য তার প্রিয় রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। স্বপ্ননীলা মেসেজে এই রেস্টুরেন্টের ঠিকানা দিয়ে বলেছে, ‘এই রেস্টুরেন্টের খাবার খুব ভাল।’ স্বপ্ননীলা মাঝে মাঝে এখানে খেতে আসে। তবে, অবাক করা বিষয়, এটা আমারও খুব প্রিয় রেস্টুরেন্ট। বাইরের গনগনে আগুনের উত্তাপ থেকে একটুকরো পৃথিবীর সৃষ্টি করা স্বর্গে প্রবেশ। কৃত্রিম ঠান্ডা বাতাসে পুড়ে যাওয়া শরীর ক্রমশ কাদামাটিতে রুপান্তর হতে লাগলো। লোকজন খুব কম। অর্ধেক টেবিল খালি পরে আছে। আকাশ দেখা যায় এরকম একটা টেবিলে গিয়ে বসলাম। বসতেই ওয়েটার খাবার অর্ডার নিতে চলে এলো। আমি বললাম, ‘একজনের জন্য অপেক্ষা করছি। সে এলে আপনাকে ডাকবো।’

আকাশ খুব পছন্দ করি। আকাশের সাথে একটা বিকাল নিমিষেই কাটিয়ে দিতে পারি আমি। তাই-তো আকাশ দেখা যায় এমন একটা টেবিলে বসেছি। টুকরো টুকরো মেঘ জমেছে আকাশে। আজ বিকালে বৃষ্টি হবে মনে হয়। শহরে যদি নিয়ম করে আকাশ দেখার জন্য একটা সময় সকল কাজ বন্ধ করে দেওয়া যেতো ভাল হত। এ-সব ভাবতে ভাবতে স্বপ্ননীলা দরজা দিয়ে প্রবেশ করলো।

স্বপ্ননীলা কেনো শাড়ি পড়ে এসেছে? নিজে নিজেকেই প্রশ্নটা করলাম। কী অদ্ভুত সুন্দর!

মেয়েরা কি কারো সাথে প্রথম দেখায় শাড়ি পরে আসে? হয়তো, সব মেয়ে চায়, প্রথম দেখায় সবাই তাদের প্রেমে পড়ুক। আর বিশেষ কেউ যদি হয়, তাহলে আরো সুন্দর করে সেজে আসে৷ যাতে ছেলেটা প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ুক। কিন্তু, সে কি জানে? তাকে সামনা সামনি না দেখার আগেই তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি আমি।
স্বপ্ননীলা আকাশি রঙের শাড়ি পরেছে। মেচিং করে চুরি, টিপ। চোখে কাজল দিয়েছে। মনে হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা এক টুকরো মেঘ থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জিনিস সৃষ্টি করেছে। আর মেঘের চোখে পরিয়ে দিয়েছে কাজল। এ কাজল ভরা চক্ষে ডুব দিতে ইচ্ছে করে। এখানে, একবেলা হারিয়ে গিয়ে ভাল থাকা যায়। স্বপ্ননীলা হেঁটে হেঁটে আমার দিকে আসছে। আমি উঠে দাঁড়িয়ে স্বপ্ননীলাকে বসার জন্য চেয়ার বের করে দিলাম। স্বপ্ননীলা বসার পর ফিরে এসে নিজের চেয়ারে বসলাম।

স্বপ্ননীলা বলল, ‘এই যে অভ্র, কেমন আছেন আপনি?’
আমি বললাম, ‘মেঘ মুখ দেখে কেউ কি কেউ খারাপ থাকতে পারে?’
‘মেঘমুখ?’
‘হ্যাঁ, মেঘমুখ। এই যে আমার সামনে এক টুকরো সাদা মেঘ বসে আছে। তবুও আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। আচ্ছা, আমায় একটু চিমটিকাটবেন?’

মেয়েটা হেসে দিলো। হাসির শব্দ জলতরঙ্গ শব্দের মত। মেয়েটার সব কিছুতেই আমি মুগ্ধ হচ্ছি কেনো? মানুষ যাকে ভালবাসে তার সব কিছুই কি প্রিয় মনে হয়। সব কিছুই কি পছন্দ হয়? হয়তো হয়। সেই জন্য আমার সামনে বসে থাকা মেয়েটার সব কিছু ভাল লাগছে আমার।

স্বপ্ননীলা বলল, ‘চিমটিকাটা লাগবে না। আমি সত্যি আপনার সামনে বসে আছি।’
‘সমস্যা নেই। একটু চিমটি দিয়েই দিন। যদি স্বপ্ন হয় তবে স্বপ্ন ভাঙার পর আমার থেকে বেশি কষ্ট আর কেউ পাবে না। আমার থেকে দুখি মানুষ কেউ হবে না।’

স্বপ্ননীলা হালকা করে হাসতে হাসতে আমার হাতে চিমটি কাটলো। বলল, ‘এবার খুশি।’
‘আমি বাস্তবেই আপনার সামনে বসে আছি। এখনো আমার বিশ্বাস হচ্ছে না!’
‘এবার কি আমাকে চিমটি কাটবেন?’
‘না না, তেমন কিছুই করবো না।’

‘আচ্ছা, আপনাকে বৃষ্টিমেঘা বলে ডাকি?’ কিছুটা সময় চুপ থেকে আমি আবার বললাম।
‘এই নামে তো কেউ ডাকে না আমায়। আমার বৃষ্টি খুব পছন্দ। তাই ফেসবুকে নিক নামের জায়গা বৃষ্টিমেঘা দিয়েছি।’
‘আচ্ছা, যখন বৃষ্টি হবে তখন বৃষ্টিমেঘা বলে ডাকবো। আর এখন নীলা বলে ডাকবো।’
‘আচ্ছা, সমস্যা নাই। আপনার যা ইচ্ছা ডাকতে পারেন।”
‘কি খাবেন?’
‘আপনার খুশি, যা অর্ডার দিবেন।’
‘ওকে, তাহলে আমার পছন্দ মত অর্ডার দিচ্ছি।’

ওয়েটার কে ডেকে খাবার অর্ডার দিয়ে দিলাম। নীলা সামনে বসে আছে। হঠাৎ কি ভেবে বললাম,
‘আপনাকে ভয়ংকর সুন্দর লাগছে।’
নীলা অবাক। চোখ দেখে যে কেউ বলে দিতে পারবে কতটা অবাক হয়েছে সামনে বসা মানুষটা। অবাক চোখে জিজ্ঞাসাসুরে সে বলল, ‘ভয়ংকর সুন্দর মানে?’
আমি বললাম, ‘এতো সুন্দর যে দেখলে বুক কেপে উঠে। হঠাৎ কাউকে দেখে যদি বুক কেপে উঠে তবে একেই ভয়ংকর সুন্দর বলে। আপনাকে প্রথম দেখে বুক কেপে উঠেছিলো। এক মুহূর্ত মনে হয়েছে এই বুঝি হৃদয়টা ফেটে যাবে।’

নীলা আবার হেসে দিলো। ইশ! এতো সুন্দর কেনো হাসিটা? নীলা বলল, ‘আপনি খুব সুন্দর করে কথা বলেন।’

কথা বলার মাঝে খাবার চলে এলো। খবার খাওয়া সময় নীলা আমার হাতের দিক লক্ষ করে জিজ্ঞাসা করলো, ‘এখানে কি হয়েছে?’
আমি বললাম, ‘পুড়ে গেছে।’
‘কীভাবে?’
‘সকালে তারাহুরো করে চা বানাতে গিয়ে।’
‘এতো তারাহুরো করে কেউ? তা আপনি চা বানাতে পারেন?’
‘কেনো পারবো না। চা থেকে শুরু করে রান্না করা সবই পারি।’
‘শিখলেন কি ভাবে।’
‘ব্যাচেলার মানুষ। রান্না করতে করতে শিখেছি।’
‘আপনি একা থাকেন? আপনার ফ্যামেলি?’
‘ঢাকায় আমি একা থাকি। ফ্যামিলির বাকি সবাই সিলেট থাকে।’
‘সিলেট কেনো?’
‘বাবার চাকরির জন্য। বাবা ব্যাংকে চাকরি করে। চার বছর হয়েছে প্রমোশন পেয়ে সিলেটে শাখায় ট্রান্সফার হয়ে চলে গেছে।’
‘এখানে আপনি একা থাকেন?’
‘না, আমার রুমমেট আর আমি।’
‘এখন থেকে সাবধানে কাজ করবেন। এতো তারাহুরো করার দরকার নেই। হাতে মলম লাগিয়েছেন?’
‘হ্যাঁ, আসার আগে মলম লাগিয়ে এসেছি। সমস্যা নেই। সেরে যাবে। টেনশনের কিছুই নেই।’
‘তবুও, বাসায় গিয়ে ভাল করে সেভলন দিয়ে পরিষ্কার করে মলম লাগিয়ে নিবেন আবার।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। আপনি যেটা বলবেন সেটাই।’

দু’জনের খাওয়া শেষ। নীলা বলল,
‘আচ্ছা, চলুন উঠি আজ।’
‘চলুন, আপনাকে পৌঁছে দেই।’
‘না না, আমি একা যেতে পারবো। আপনার কাজ থাকতে পারে। আপনি চলে যান। আমার জন্য উল্টো পথে আসা দরকার নেই। আমি একটা রিক্সা নিয়ে চলে যাবো।’
‘তাহলে রিক্সা ঠিক করে দেই।’

এই ভর দুপুরে রিক্সা পাওয়া মুশকিল। এই সময়ে রিক্সা চালক রাস্তার পাশে গাছের ছায়ায় রিক্সার মধ্যে জম্পেষ্ট একটা ঘুম দেয়। দু’জনে বাইরে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর একটা রিক্সা এলো।

‘এই যে মামা, যাবেন?’
‘কোথায় যাবেন?’
নীলার দিকে ঘুরে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কোথায় থাকেন? সেটা জানা হলো না।’
‘উত্তর বাড্ডা।’
‘মামা ওকে উত্তর বাড্ডা পৌঁছে দিবেন।’

নীলা রিক্সায় উঠে বসলো। বলল, ‘চলি, আপনি সাবধানে যাবেন।’
‘আপনিও সাবধানে যাবেন।’

রিক্সা চলা শুরু করলো। কিছুটা দূরে চলে যাবার পর আমি দৌড়ে রিক্সার কাছে এসে বললাম, ‘আবার মেঘমুখ দেখার অসুখ হলে কি করবো?’

নীলা কিছু বললো না। হেসে দিলো। রিক্সা চলছে। আমি হাপিয়ে দাঁড়িয়ে পরলাম। হঠাৎ নীলা রিক্সা থেকে মুখ বের করে পেছন ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে নীলা বলল, ‘কিছু রহস্য থাকা ভাল। আবার দেখা হওয়াটা না হয় রহস্যের মত অজানাই থাকুক।’

রিক্সা অনেক দূর চলে গেলো। আমি উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করলাম। যাত্রাবাড়ী একটা বাসে উঠে জানালার সিটে এসে বসলাম।

মেয়েরা সবসময় তার চারপাশে রহস্যময় করে রাখরে পছন্দ করে। গোলকধাঁধার মধ্যে থাকতে পছন্দ করে।

মেয়েরা এমন কেনো? কেনো রহস্যময় একটা হাসি দিয়ে রহস্য রেখে চলে যায়। আবার কবে দেখা হবে বৃষ্টিমেঘার সাথে? কবে? এখনি আবার দেখতে ইচ্ছে করছে। খুব ইচ্ছে করছে।

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here