#মেঘমুখ,ষষ্ঠ পর্ব
#লেখনীতে সবুজ আহম্মদ মুরসালিন
দুপুর থেকে আকাশে ঘন কালো মেঘ। বৃষ্টি নামবে খুব জোরে। এই বৃষ্টি কয়েক ঘন্টা ধরে হবে। বৃষ্টিতে ভেজার জন্য এরকম বৃষ্টি পার্ফেক্ট। যে বৃষ্টি নেমে অল্প কিছু সময় পর থেমে যায় সে বৃষ্টিতে ভিজে মজা নেই। বৃষ্টি নামতে নামতে বিকাল। বিকালে বৃষ্টি শুরু হয়ে রাত পর্যন্ত একাধারে বৃষ্টি হবে। নীলাকে সকাল থেকে ফোন দিচ্ছি তবে সে ফোন রিসিভ করছে না।
নীলা ফোন রিসিভ করার সাথে সাথে বললাম।
‘এই যে, বৃষ্টিমেঘা।’
‘আজ হঠাৎ এই নামে ডাকছো?’
‘ভুলে গেছো। বলেছিলাম, যেদিন আকাশে মেঘ থাকবে, বৃষ্টি হবে সেদিন তোমায় বৃষ্টিমেঘা বলে ডাকবো। কি করো?’
‘চা-আইস্ক্রিম বানালাম!’
‘চা-আইস্ক্রিম? এটা আবার কি? তোমোর মুখে মাঝে মাঝে অদ্ভুত সব আইটেমের নাম শুনেই অবাক হয়ে যাই।’
‘খাবে? খুব মজা হবে হয়তো। কিছুক্ষণ হলো ফ্রিজে রেখেছি। বরফ হলে খাওয়া যাবে। খাবে?’
‘তোমার অদ্ভুত সব রান্না আমি কি কখনো খেয়েছি?
আচ্ছা, শুনি কি ভাবে চা-আইস্ক্রিম বানালে।’
‘খুব সহজ। প্রথমে এক চুলাই পানি আর অন্যটায় দুধ গরম করতে দিয়েছি, পানি গরম হয়ে গেলে পর্যাপ্ত পরিমানের চিনি, অল্প কিছু এলাচ, দুই তিনটা লবঙ্গ দিয়েছি। ৫ মিনিট পর চা পাতা দিয়ে সাথে সাথে নামিয়ে ফেলেছি। চা টা ভাল করে ছেকে, চা’য়ের মধ্যে দুধ, বাদাম, কিচমিচ দিয়ে কিছুক্ষণ ঘুটেছি। সবকিছু মিক্স হলে আইস্ক্রিমের কাপে ঢেলে তার উপর কিছুটা চকলেটের গুরো দিয়ে ফ্রিজে রেখেছি।’
‘বাহ! দারুন। তুই চাইলে একটা বই বের করতে পারো। বইয়ের নাম হবে অদ্ভুত সব রেসিপি। অনেক সেল হবে বইটা।’
‘তুমিও না। শুধু আজে বাজে কথা।’
‘সারাদিন কি চা-আইস্ক্রিমের পিছনে লেগে ছিলে? ফোন দিলাম ধরলে না। আচ্ছা শুনো, যে কারনে ফোন দিয়েছি’
‘হ্যাঁ, বলো।’
‘মেঘ হয়েছে আকাশে। বৃষ্টি হবে। খুব বৃষ্টি । কয়েক ঘন্টা ধরে এই বৃষ্টি হবে। চলো বৃষ্টির মধ্যে শহরের রাস্তা দিয়ে হাটি। কিছু বৃষ্টির ফোঁটায় আমাদের দু’জনের স্মৃতি জমা রাখি। জানো, পানিরও স্মৃতি আছে। এই সুন্দর স্মৃতি টুকু আমি তুমি আর বৃষ্টি মনে রাখি। ভিজবে আমার সাথে?’
ফোনের ওপাশ থেকে নীলা কিছুই বললো না। হয়তো ভাবছে। আমাকে অপেক্ষার কষ্টটুকু দিয়ে অবশেষে বলল, ‘তোমার বাসা থেকে আমাদের বাসায় আসতে অনেক সময় লাগবে। যা য্যাম।’
আমি বললাম, ‘তুমি কি ভিজবে আমার সাথে?’
‘ভিজতাম। তবে, তুমি এখন..! এখানে আসবে কি করে?’
‘আমি কিভাবে আসি সেটা বেপার না। তুমি কি ভিজবে আমার সাথে? হ্যাঁ কি না?’
‘হ্যাঁ ভিজবো।’
‘তাহলে শাড়ি পরে নিচে নামো।’
‘তুমি কি আমার বাসার নিচে?’
‘ না, তোমার বাসার নিচে না। তবে মেইন রাস্তায়। গলির মাথায়। সেই দুই ঘন্টা ধরে দাড়িয়ে আছি। আর দাঁড়িয়ে রেখোনা প্লিজ।’
‘কি? কি বললে? জানো, আমি ভাবিনি এখন তুমি আমার বাসার কাছে থাকবে। আমি সত্যি অবাক। তুমি এমন কেনো? আমাকে ১৫ মিনিট সময় দেও। আমি আসছি।’
‘১৫ মিনিট না, তোমাকে ২০ মিনিট দিলাম। তবে শাড়ি পড়ে আসবে। প্রথম দেখা হবার দিন আকাশি রঙের যে শাড়িটা পড়েছিলে সেটা পড়ে আসবে।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি আসছি।’
‘আচ্ছা, শুনো। একটা চাদর নিয়ে আসবে।’
‘আচ্ছা, একটু কষ্ট করে অপেক্ষা করো।’
নীলা অপেক্ষা করতে বলে ফোন কেটে দিলো। নীলার সাথে রিলেশনের প্রায় সাত মাস কেটে গেছে। যতদিন যাচ্ছে তত ভালোবাসা বাড়ছে। আমি সত্যি অবাক। আমি কখনো ভাবিনি একটা মানুষকে এতো ভালোবাসা যায়। আমি একটা মানুষকে এতো ভালোবাসতে পারবো।
মানুষ যেটা ভাবেনা, যা চিন্তা করেনা, মানুষের জীবনে সেটাই ঘটে বেশির ভাগ সময়।
মাঝে নীলার সাথে বার কয়েকবার ঝগড়া হয়েছে। নীলার অনার্স শেষ। নীলার বাসা থেকে বিয়ের জন্য বারবার বিরক্ত করছে। নীলা বার বার বলেছে, আমাদের কথা বাবা-মাকে বলতে। আমি মাকে সব বলেছি। মা রাজি। তবে বাবাকে ভয়ে বলতে পারিনি। কখনো পারবো কি না জানিনা। এটা নিয়ে সবচেয়ে বেশি ভয়ে আছি। টেনশনে আছি।
এখনো বেকার হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। চাকরি নিয়েও টেনশনে আছি। আর কত ইন্টারভিউ দিবো কে জানে। শেষমেশ বাবার কথায় এবার রাজি হতে হবে। চাকরিতে জয়েন্ট না করা পর্যন্ত নীলাও বাসায় আমার কথা বলতে পারছে না। তাই মনে মনে ঠিক করেছি বাবার কথায় এবার রাজি হয়ে ব্যাংকেই জয়েন্ট করবো।
বাবা এইমাসে ট্রান্সফার নিয়ে ঢাকায় চলে এসেছে। অলৌকিক ভাবে উত্তরার ব্রান্সে জয়েন্ট করেছে। ব্রান্সের হেড হিসাবে। আজকে উত্তরায় বাসা খোঁজা জন্য এসেছিলাম। এসে দেখি আকাশে মেঘ করেছে। হঠাৎ নীলার সাথে ভিজতে ইচ্ছা হলো। বাসা খোঁজা আর হলো না। এটা নিয়ে ভাবনা নাই। আমি আর বন্ধু যে বাসায় ছিলাম বাবা-মা আর বোন সে বাসায় উঠেছে। ফ্যামিলি বাসা তাই কারো কোনো সমস্যা হচ্ছে না। রাকিবের সাথে সামনের মাসে এক কলিক উঠবে। এই মাস আমারা এই বাসায় এক সাথে আছি। তাই তারাহুরো নেই। অন্যদিন বাসা খোঁজা যাবে কিন্তু অন্যদিন বৃষ্টিতে ভেজা যাবে না। নীলাকে এখনো বলিনি যে সামনের মাসে আমরা উত্তরায় চলে আসছি। নীলাকে সারপ্রাইজ দিবো ভেবে রেখেছি।
দূর থেকে নীলা হেটে আসছে। আমি যতবার এই মেঘের মত মুখ ‘মেঘমুখ’ দেখি ততবার নতুন করে প্রেমে পড়ি। মানুষটার মধ্যে এতো মায়া। এই মায়া সারাজীবনেও কাটিয়ে উঠা সম্ভব নয়। আমি চাই এই মায়া থাকুক, সারাজীবন থাকুক। এই মায়ার মধ্যে বাঁচতে চাই। আকাশি রঙের শাড়িটাই পড়ে এসেছে।
নীলা কাছে এসে মুচকি হাসি দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
‘কি? এভাবে কি দেখো?’
‘তোমাকে দেখি।’
‘আমাকে নতুন করে দেখার কি আছে?’
‘জানিনা, যত দেখি তত দেখতে ইচ্ছা হয়। দেখার ইচ্ছা এই একজনম দেখেও মিটবে না হয়তো। আমিও চাই না মিটুক।’
‘হয়েছে, হয়েছে, এবার চলো। কোথায় যাবো?’
‘যে দিকে দু’চোখ যায় চলে যাবো। আর ফিরবো না। যাবে?’
‘ইশ, কত সখ।’
‘তুমি শাড়ি পরেছো। আমি পুরনো একটা শার্ট পরা। পাঞ্জাবি পরলে দারুণ হত।’
‘এখন পাঞ্জাবি পাবে কোথায়।’
‘চলো, আগে একটা শো-রুম থেকে পাঞ্জাবি কিনি। তারপর যাবো।’
‘এখন পাঞ্জাবি কিনবে? দরকার নেই।’
‘না, আমি পাঞ্জাবি পরে তোমার সাথে ভিজবো। এই মুহুর্ত আর কখনো ফিরে আসবে না। একটু আয়োজন করেই বৃষ্টি’তে ভিজি৷’
সেই সময় পাঞ্জাবি কিনে, সেটা পরে নীলা আর আমি হাতিরঝিল চলে এলাম। হাতিরঝিল আসার সাথে সাথে বৃষ্টি নেমে দিলো। সবাই ছুটাছুটি করছে। বৃষ্টি দেখে সবাই পালাচ্ছে। কেউ কেউ বৃষ্টি পৌঁছাতে পারবে না এমন ছোট জায়গায় আশ্রয় নিচ্ছে। কেউ কেউ ছাতা বের করে দ্রুত হাটছে বাসার ফেরার জন্য। কয়েক মিনিট পর দেখা গেলো জায়গাটা ফাঁকা হয়ে গেছে। কিছু মানুষ অদ্ভুত ভাবে দূর থেকে আমাদের দেখছে৷ দেখছে, দু’টি মানব-মানবীর হেটে যাওয়া। দেখছে, যেখানে সবাই বৃষ্টি থেকে পালানোর চেষ্টা করছে সেখানে এই দুই জন আরো বৃষ্টি মধ্যে ডুবে যাচ্ছে।
ইটের পিচ থেকে একটা ঘ্রাণ বের হয়েছে। পুড়া ঘ্রাণ। অনেক দিন বৃষ্টির অপেক্ষা ছিলো রোদে পুড়া রাস্তা গুলো। বৃষ্টি আসতেই তাকে আলিঙ্গন করে নিয়েছে। বৃষ্টির একটা ঘ্রাণ আছে। বৃষ্টি যখন আকাশ থেকে ভূখন্ডে এসে পড়ে সেটার একটা ছন্দ আছে। বৃষ্টির প্রতিটি ফোটা ছন্দ মত নেমে আসে। সৃষ্টি কর্তার এক রহস্য সৃষ্টি, এই বৃষ্টি।
নীলা আর আমি বেশ কিছুক্ষণ সময় বৃষ্টি মধ্যে হাটলাম। হঠাৎ নীলা বলল, ‘চলো কোথাও বসি।’
আমি নীলাকে ব্রিজ দেখিয়ে বললাম, ‘চলো, ওই ব্রিজের উপর পা ঝুলিয়ে দিয়ে বসি। অন্য রকম লাগবে।’
নীলা ভাবেনি এরকম কিছু বলবো। তবে কিছুটা ইতস্ততা করে শেষমেশ বললো, ‘আজকে তুমি যা বলবে তাই হবে।’
নীলার সাথে ব্রিজে বসে বৃষ্টিতে ভিজছি। নীলা অন্য দিকে ফিরে ছিলো। আমি নীলার হাতটা ধরলাম। সাথে সাথে নীলা আমার দিক ফিরে বলল,
‘এভাবে হাত ধরে আছো কেনো?’
‘অকারণে হাত ধরতে পারি না।’
নীলা শুধু হাসলো। কিছু বলল না। আমি নীলার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। ভেজা চুল, মুখে জমা বিন্দু বিন্দু বৃষ্টির পানি। নতুন বৃষ্টি ফোঁটা এসে পুরনো বৃষ্টির ফোঁটাগুলোকে গাল বেয়ে নামিয়ে দিচ্ছে। জগতের এটাই কি নিয়ম? নতুন কিছু এসে পুরনো জিনিস গুলোকে বিদায় করে দেওয়া। মেঘমুখটা আজ বৃষ্টির পানিতে ভিজে আরো সুন্দর হয়ে উঠেছে। হঠাৎ নীলার ঠোঁটে জমা বৃষ্টির ফোঁটা দেখে বৃষ্টি উপর হিংসা হলো।
নীলা জিজ্ঞাসা করলো, ‘কি দেখো? আমাকে না দেখে বৃষ্টি দেখো। বৃষ্টি আরো সুন্দর।’
হঠাৎ করে বললাম, ‘আমি তোমার ঠোঁট ছাড়া কিছুই দেখছি না। অন্য কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। সত্যি। চোখের সামনে শুধু তোমার ঠোঁট।’
নীলা খুব লজ্জা পেলো। মেয়েরা লজ্জা পেলে মেয়েদের কান এবং চোখের নিচে লাল হয়ে যায়। ভাল করে লক্ষকরলে বোঝা যায় কতটা লজ্জা পেয়েছে। আমি আবার বললাম, ‘কিস করতে পারি?’
নীলা একটু রেগে অনেকটা লজ্জামাখা কন্ঠে বললো, ‘জিজ্ঞাসা করার কি আছে?’
কেউ কি দেখছে? দু’টি মানব-মানবী বৃষ্টির মধ্যে ডুবে আছে একজন আরেক জনের ভেতরে। কেউ দেখলে দেখুক। কেউ কিছু ভাবলে ভাবুক। কিছু লোক ভাববে, কিছু বলবে, তারা যা বলবে তা বলুক।
চলবে…….