মেঘমুখ,সপ্তম পর্ব

0
632

#মেঘমুখ,সপ্তম পর্ব
#লেখনীতে সবুজ আহম্মদ মুরসালিন

‘অভ্র, শোন, তুমি যদি ৩০ মিনিটের মধ্যে আমার বাসায় না আসো তাহলে আমি ছাঁদ থেকে লাফ দিবো। আমার মৃত্যুর জন্য তুমি দায়ী থাকবে।’

এখন রাত ১০টা। আমি ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে নীলার মেসেজ দেখে চমকে গেলাম। যতটা চমকেছি তার থেকে বেশি ভয় পেয়েছি। নীলার সাথে চার দিন কোনো যোগাযোগ নেই। ঝগড়া হবার পর এই প্রথম মেসেজ দিয়েছে। আমি কম হলেও একশোবার ফোন দিয়েছি এই চার দিনে। ৫০ টার মত মেসেজ দিয়েছি। না, নীলা একটা মেসেজেরও উত্তর দেয় নি। একটা বার ফোন রিসিভ করেনি। ফোন ব্যাক করেনি। চারদিন পর মেসেজ দিলো, কিন্তু মেসেজে লিখা, আমি ৩০ মিনিটের মধ্যে না গেলে নীলা ছাঁদ থেকে লাফ দিবে। আমি মেসেজটা কয়েকবার পড়লাম। নীলা কি দুষ্টুমি করে মেসেজটা দিয়েছে? নাকি মজা করার জন্য? জানার জন্য সাথে সাথে নীলাকে ফোন দিলাম। নীলার ফোন বন্ধ। আবার ফোন দিলাম। বন্ধ। কয়েকবার ট্রাই করলাম। প্রতিবার বন্ধ। আমি মেসেজ আসার টাইম লক্ষ করলাম। পাঁচ মিনিট আগে এসেছে। তার মানে হাতে সময় আছে ২৫ মিনিট। এখন আমি কি করবো?

চারদিন আগে।
বিকালে নীলা ফোন দিয়ে বলল,
‘তোমার সাথে জরুরি কথা আছে।’
আমি বললাম, ‘বলো? আমি শুনছি।’
‘ফোনে বলা যাবে না। দেখা করো। আমাদের পছন্দের জায়গায় আসছি। তুমি যত দূত পারো চলে এসো।’
‘আমি এখন অফিসে। সন্ধ্যার পর দেখা করি।’
নীলা রেগে বলল, ‘না, এখনি দেখা করতে হবে। তুমি এখনি আসবে।’
নীলার মেজাজ হয়তো খুব খারাপ। এখন কথা বাড়ালে শুধু শুধু ঝগড়া হবে। তাই আমি বললাম,
‘আচ্ছা, আমি আসছি। তুমি অপেক্ষা করো।’
নীলা আচ্ছা বলে ফোন রেখে দিলো।

নীলা আগে কখনো এভাবে দেখা করার কথা বলেনি। কি হয়েছে? নীলার বাসায় কি কোনো সমস্যা হয়েছে? এ সব ভাবতে ভাবতে আফিস থেকে বের হলাম।

বাবার কথা মতো গতমাসে ব্যাংকে জয়েন্ট করেছি। উত্তরা ব্রান্সে। বাবার সাথে এক অফিসে কাজ করতে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। মাঝে মাঝে বাবা এসে দেখে যায় কি করি। খুবই বিরক্তিকর একটা বিষয়। বাবা বুঝেও না বোঝার মত কাজটা করে। বাবা কে প্রচন্ড ভয় পাই। সেই ছোট বেলা থেকে। যখন আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি তখন একদিন বাবা বলল, ‘অংক বইটা নিয়ে আয় তো?’

সবসময় আমি মায়ের কাছে পড়ালেখা করি। বাবা কাছে এর আগে কখনো পড়তে বসিনি। আর অংক, এই নাম শুনলেই ভয় লাগে। বাবার পরে একমাত্র অংককে এতোটা ভয় পাই। অংক যতটা কম পারি ততটা কম বুঝি। অংক বুঝতে অনেক সময় লাগে। এজন্য ছোটবেলায় মায়ের কাছে, স্যারদের কাছে অনেক বকা খেয়েছি। বাবার মুখে অংক বই নিয়ে আসার কথা শুনে ভয়ে কাপতে লাগলাম। তবে কিছু করার নাই। বাবা যখন বলেছে তখন বাবার কাছে আজ অংক করতে হবে। কাঁপতে কাঁপতে বাবার সামনে অংক বই নিয়ে দাড়ালাম। বাবা বলল, ‘খাতা কই?’

আমি এক দৌড়ে টেবিল থেকে খাতা আর কলম নিয়ে আবার বাবার কাছে ফিরে এলাম। বাবা আমাকে অংক বোঝাতে লাগলো। বাবা, বাবার মত করে অংক বোঝাচ্ছে। তবে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। বাবা যখন বলে, ‘বুঝেছিস?’ আমি শুধু হ্যাঁ বলি। অংক বোঝানো হলে বাবা বলল, ‘এবার ঠিক এই নিয়মের অন্য একটা অংক দিচ্ছি কর। যদি পারিস তাহলে বুঝবো বুঝেছিস।’

আমি অংক নিয়ে বিশ মিনিট বসে রইলাম। বাবা ফিরে এসে দেখলো আমি কিছুই করতে পারি নি। বাবা মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করে বলল, ‘যদি না বুঝতে পারিস বলতি বুঝিনি। আর কখনো না বুঝে, বুঝেছি বলবি না। ঠিক আছে?’ আমি এবার ও মাথা উপর নিচে করে বুঝালাম হ্যাঁ, ঠিক আছে।

সেই অংক বাবা আবার বোঝাতে লাগলো। যতবার বলছে বুঝেছিস? আমি ততবার মাথা ডানে বামে ঘুড়িয়ে বলে দিচ্ছি, বুঝিনি। আরো কয়েক বার বোঝানোর চেষ্টা করলো। আমি ভয়ের মধ্যে ছিলাম। তাই টেনশনে, ভয়ে ভাল করে মনোযোগ দিতে পারছিলাম না। তাই কিছুই বুঝতেও পারছিলাম না। বাবা শেষমেশ বোঝানো বন্ধ করে, রেগে খুব জোরে পিঠে থাপ্পর দিলো। রেগে বলল, ‘মাথার মধ্যে তো গোবরও নাই। গোবর থাকলে কিছুতো বুঝতে পারতি।’ আমি একাধারে কান্না করতে লাগলাম। মা এসে আমাকে নিয়ে গেলো। পিঠে পাঁচ আঙুলের দাগ বসে গেলো। সেই থেকে ভয় আরো বেড়েছে। কখনো কমেনি। বাবাকে আমি সরাসরি কখনো কিছু বলতে পারিনা। যা প্রয়োজন সেটা মাকে বলি, মা পরে বাবাকে বলে।

পৌঁছে দেখি নীলা বসে আছে। নীলার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,
‘সবকিছু ঠিক আছে? কোনো সমস্যা হয়নি তো?’

নীলার মুখ দেখে বুঝে গেলাম কিছু একটা হয়েছে। মেজাজ খারাপ। নীলা কথা বলছে না। আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কি হলো, কথা বলছো না কেনো?’
নীলা আরো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অবশেষে বলল, ‘ভালোবাসো? তুমি আমাকে ভালোবাসো?’
আমি অনেকটা অবাক হলাম। বললাম, হঠাৎ এই প্রশ্ন?’
‘সত্যি করে উত্তর দেও। আমাকে ভালোবাসো?’
আমি বললাম, ‘কোনো সন্ধেহ আছে?’
নীলা বলল, ‘আমাকে বিয়ে করবে?’
আমি কিছুটা রেগে বললাম, ‘তোমার কি মনে হয়? আমি তোমাকে কষ্ট দিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করবো? তুমি জানো, তোমাকে আমি কতটা ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করার কথা ভাবতে পারিনা।’

নীলার এখনো মেজাজ খারাপ। মন খারাপ। আমি আবার বললাম, ‘বাসায় কিছু হয়েছে? বিয়ে জন্য কি প্রেশার দিচ্ছে?’
নীলা খুব রাগি কন্ঠে বলল, ‘তুমি বাবাকে বলেছো আমার কথা? ‘
আমি বললাম, ‘মাকে বলেছি। মা আব্বুকে বলবে। আব্বুর কোনো কারনে কয়দিন ধরে মেজাজ খারাপ। তাই আম্মু বলতে সাহস পাচ্ছে না।’

‘তুমি বলতে পারো না? যাকে ভালোবাসো তার কথা সাহস করে নিজের বাবাকে বলতে পারোনা? তাহলে কি রকম ভালোবাসো?’ নীলা খুব জোরে কথাগুলো বলল। আশেপাশের মানুষ নীলার কথা শুনে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ।
আমি নীলাকে বুঝিয়ে বললাম, ‘তুমি জানো আমি বাবাকে প্রচন্ড ভয় পাই।’
নীলা বিদ্রুপ ভাবে বলল, ‘এতোই যখন ভয় পাও তাহলে নীজেকে পুরুষ ভাবতে লজ্জা করে না?’
‘নীলা বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে। শান্ত হও।’
‘না, আমি শান্ত হবো না। আজকে রাতের মধ্যে তোমার বাবাকে আমাদের কথা বলবে। যদি না বলো তাহলে আমাদের সম্পর্ক এখানে শেষ।’
এই বলে নীলা চলে গেলো। আমি একা একা যেখানে ছিলাম সেখানে কিছুক্ষণ বসে রইলাম।

রাত ১১ টা।
নীলার ফোন এলো। ফোন রিসিভ করার পর নীলার প্রথম কথা ছিলো, ‘বাবাকে আমাদের কথা বলেছো?’
আমি কিছুটা ভয়ে উত্তর দিলাম, ‘বাবার মেজাজ আজকে অনেক খারাপ ছিলো। তাই ভয়ে কিছুই বলিনি। বাবার মেজাজ ঠান্ডা হোক। তখন বলবো।’
নীলা চার পাঁচ মিনিট কিছুই বললো না। আমিও কিছু বললাম না।

‘তুমি আমাকে আর কখনো ফোন দিবে না। কোনো মেসেজ দিবে না।’

নীলা খুব শান্ত ভাবে কথাগুলো বললো। আমি কিছু বলার আগে নীলা ফোন কেটে দিলো। ফোন কেটে দেওয়ার পর আমি কয়েকবার ফোন দিয়েছি নীলাকে। নীলা ফোন রিসিভ করেনি। ভেবেছি সকালে রাগ কমে যাবে। সকালে আবার ফোন দিবো। কিন্তু গত তিন দিন ধরে আমার দেওয়া মেসেজের একটাও রিপ্লাই দেয়নি। একবারও ফোন রিসিভ করেনি। অবশেষে, প্রচন্ড রাগে নীলাকে মেসেজ বা ফোন দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। যখন রাগ কমবে নিজ থেকে ফোন দিবে এই আশায় অপেক্ষা করছি।

একটু আগে নীলার পাঠানো মেসেজটা আবার পড়লাম। আবার। ঘড়ির সাথে টাইম মিলিয়ে দেখলাম ৩০ মিনিট থেকে ১০ মিনিট চলে গেছে। হঠাৎ বুক কেপে উঠলো। নীলা যদি সত্যি সত্যি এমন কিছু করে তাহলে আমার কি হবে। কিছুই ভাবতে পারছি না। বাসায় এই মুহুর্তে কেউ নেই। সবাই সন্ধ্যায় একটা দাওয়াতে গিয়েছে। আমাকে অনেক করে বলেছে যেতে আমি যায়নি। কি করবো এখন? চিন্তা ভাবনা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। ঠান্ডা মাথায় কিছুই ভাবতে পারছি না।

দ্রুত একটা প্যান্ট আর একটা টি-শার্ট পরে দরজা খুলে বের হলাম। স্যান্ডেল পাচ্ছিলাম না তাই খুঁজতে গিয়ে সময় নষ্ট না করে বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় এলাম। রাস্তায় কোনো বাস, রিক্সা কিছু নেই। গুরুত্বপূর্ণ সময় কিছুই ঠিক মত পাওয়া যায় না। হিসাব করে দেখলাম এখান থেকে নীলাদের বাসায় হেটে গেলে ৫০ মিনিট লাগবে। যদি দৌঁড়ে যায় তাহলে ৩০ মিনিট। আমার হাতে সময় আছে ২০ মিনিট। বাস বা রিক্সার জন্য অপেক্ষা না করে দৌঁড়াতে লাগলাম। খালি পায়ে, রাস্তায় দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগলাম, নীলার যাতে কিছু না হয়। নীলা যাতে কনো পাগলামী না করে। হাঠাৎ কিছু একটাতে পা বেধে পড়ে গেলাম। হাটু কিছুটা কেটে গেলো। সামান্য ব্যথা অনুভব হলো তবে ব্যথাকে এতোটা গুরুত্ব দিলাম না। দৌঁড়াচ্ছি। দৌঁড়াচ্ছি। দৌঁড়াচ্ছি।

চলবে…………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here