মেঘলা মন-(১)
তারানা তাসনুভা বৃষ্টি
রাকিন মাথা নিচু করে আছে, আর মা তাকে যা তা বলে গালিগালাজ করছে। আমরা দুজনেই বৃষ্টিতে ভিজছি বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, মা আমাকে ঢুকতে দিচ্ছে না।
• যার সাথে নটীপনা করে এসেছিস তার ঘরে যা। এ বাড়িতে তোর কোন স্থান নেই।
বলে দরজা লাগিয়ে দিল। এই দরজা সহসা আর খুলবে না। আমি ভেবেছিলাম রাকিন আমাকে ফেলে বাসায় চলে যাবে কিন্তু না, সে কাধে ভেজা ব্যাগ এক হাতে ভাঙা ছাতা আর আরেক হাতে আমার হাত চেপে ধরে হাটা শুরু করলো।
রাকিনদের বাড়ি উল্টো পথে। কোচিং থেকে তার বাড়ি আর আমাদের বাড়ি দুইদিকে। সে বয়েজ কলেজে পড়ে। আমি গার্লস কলেজে। আমাদের পরিচয় কোচিং সেন্টারে। কিন্তু একটা কথাও হয়নি আমাদের মাঝে। মাগরিবের আজানের পর থেকে ঝুম বৃষ্টি শুরু, আজ বাংলাদেশ বনাম ভারতের ক্রিকেট ম্যাচ ছিল তাই ছাত্র ছাত্রী কম। আমার জানা ছিল না, জানলে আসতাম না। আমাদের বাসায় টিভি নেই। রাকিন অবশ্য ঠিকই আসতো। সে প্রথম সারির ছাত্র। কোনকিছুই তাকে আটকাতে পারেনা। ঝড় বাদলে একাই ক্লাস করে। স্যার নাকি মুড়ি মাখান সেদিন, রাকিনও খায় স্যারের সাথে। আজ স্যার তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিলেন। যে যার পথ ধরেছে। রাকিন একটা অংক বুঝে স্যারের বৌয়ের হাতের গরম গরম পিয়াজু খেতে খেতে বের হলো।
• আরে এতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে? ভেতরে এলে না কেন?
• ভেবেছি বৃষ্টি কমলেই বাড়ির পথ ধরব। কিন্তু বৃষ্টি কমছেই না। সাথে ছাতা নেই।
• আমারটা নিয়ে যাও
• তুমি ভিজে ভিজে যাবে? তাছাড়া একা একা ভয় করছে। এমন রাতে রাস্তা ফাকা থাকে
• বেশ তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আমি বাড়ি ফিরব নাহয়। পিয়াজু নেবে?
বলে সহজ ভঙ্গিতে তার হাতের পিয়াজু আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। আমিও নিলাম। তেলের গন্ধে জিভে জল আসছিল। ভদ্রতা করা সম্ভব ছিল না। তখন জানা ছিল না কি ভয়ংকর লজ্জার পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য ! আমি ভাবতেও পারিনি, দরজা খুলে মা এসব বলতে পারে!
আমরা রাকিনের বাসায় এলাম। রাকিনের মা বাবা কেউ নেই। থাকে নানাবাড়ি। ওর মামা মামী দোতলায়, নানী আর রাকিন নিচ তলায় কপাল ভালো ওর মামী দেখেননি আমাকে। ওর নানী স্বাদরে গ্রহণ করলেন আমাকে। ছোট্ট একটা মিথ্যে বললো রাকিন। আমি শহরের বাইরে থাকি! এই বৃষ্টিতে পানি জমে বাস বন্ধ। সকালেই আমাকে বাড়ি থেকে নিতে আসবে। শুধু এক রাতের ব্যাপার!
নানী খুশি মনে তার ঘরে স্থান দিলেন। মামাতো বোনের জামা ম্যানেজ করে দিল রাকিন, আমি বদলে নিয়ে খেতে বসলাম। আলু ঘাটি, পুইশাক, আর কড়া ঝাল দিয়ে রান্না তেলাপিয়া । কেন জানিনা খুব তৃপ্তি করে খেলাম। শুতে গিয়েই অস্বস্তি শুরু। নতুন বিছানা। বালিশে তেলের গন্ধ। নানীর শরীরে পান আর জর্দার তীব্র গন্ধ, তার উপর তিনি ফ্যান চালাবেন না। রাকিন আর এমুখো হলো না। এদিক দিয়ে স্বস্তিতে রইলাম। এক সময় ঘুম এসে গেল। ঘুম ভাঙল কলপাড়ে কথার আওয়াজে। মায়ের কণ্ঠ! বুক ধুকপুক করছে। মা তো সব সত্যি বলে দিবে এখন! কি হবে? রাকিনের মামী কি খুব বকাবকি করবেন? ভয়ে ভয়ে বের হলাম। কিন্তু মা তেমন কিছুই বললো না। রাকিনের নানীকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমাকে নিয়ে বাড়ির পথ ধরলো। আমি খুব অবাক। রাকিন যেন জানতই মা নিতে আসবে আমায়। রাস্তায় কোন কথা হলো না । বাসার তালা খুলে মা বললো,
• ছেলেটা এতিম হলেও দেখতে খারাপ না। ওর বাচ্চাও খারাপ হবেনা দেখতে! তুই ভেবে দেখতে পারিস! এ্যাবর্শন করানো শরীরের ঝুঁকি!
আমি জমে গেলাম। কোন কথা খুঁজে পেলাম না। মায়ের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। কিন্তু চিকিৎসা করানোর টাকা নেই আমার কাছে। আর যাবো কার কাছে? শহরে বড় ডাক্তার দেখাতে তো অনেক টাকা লাগবে। বাবার সাথে কথা হয় না। হলে হয়তো বাবাকে বলা যেত। আমার দাদাবাড়ী কাছেই। মা, বাবার তালাক হয়নি। কিন্তু মা, বাবার কোন সম্পর্ক নেই। দাদাবাড়ীতে ঈদে লুকিয়ে যাই। চাচীরাও ভালো মন্দ খেতে দেন। রাস্তায় চাচাদের সাথে দেখা হলে সালাম, কুশল বিনিময় হয়। এর বেশি কিছু না। মা এদের সহ্য করতে পারেনা। তার বক্তব্য একদিন তারা নাকি মাকে খুন করবে। এই টিন শেডের দুই কামরার ঘরের লোভে! যেখানে আমার দাদার তিনতলা বাড়ি আছে ! দাদীও আসতে পারেন না মায়ের পাগলামির জন্য! কিন্তু কেউ কখনো চিকিৎসার কথা ভাবেনি। আলাদা ঘর দিয়ে দায়িত্ব শেষ। বাবা বিদেশে চাকরি করতে গিয়ে সেখানেই বিয়ে থা করে স্থায়ী বাসিন্দা হলেন। দেশে বেড়াতেও আসেন না!
সকালের ক্লাসটা মিস হলো। এগারোটার ক্লাসের জন্য বের হলাম। আমার বারবার রাকিনের হাত ধরে এই রাস্তায় কাল রাতে হাটার দৃশ্য মনে পড়ছে, লজ্জা আর ভালোলাগা এক সাথে কাজ করছে। আবার মায়ের কথা গুলোও মনে পড়ছে, রাকিন যদি কোচিং-এ সবাইকে বলে দেয়। যদি বলে দেয়?
বিকালে সব চিন্তার অবসান হলো,
কোচিং-এ রাকিন যেন একদম স্বাভাবিক। আগেও কথা বলত না। আজও বললো না। পড়া শেষে যে যার মতো বেরিয়ে গেলাম। বাসায় ফিরে দেখি ভীড় জমে আছে আমাদের দরজায়! আমি হতবাক। আমার চাচাদের বাড়ি কাছেই। কিন্তু মায়ের সমস্যার জন্য আমরা মিশতে পারিনি। আমার দাদী আমাকে জড়িয়ে ধরলেন শক্ত করে। চাচীরাও পাশে এসে দাড়ালেন। পুলিশের সাথে কথা বলছেন বড় চাচা। আমি ঢুকতে যাচ্ছি, আমাকে বাধা দেওয়া হলো। বুঝতে পারছি না। একবারের জন্যও খারাপ কিছু মনে উঁকি দেয়নি। চমকে উঠলাম, পুলিশ লাশ বের করলো, এবার আমার পুরো পৃথিবী দুলে উঠল। দাদী, চাচীরা এসে ধরলেন আমাকে। পায়ের নিচে মাটি সরে গেছে আমার। কেউ রইলো না এই পৃথিবীতে আমার। মায়ের জন্য বাবার পক্ষের কারো সাথে দেখা সাক্ষাৎ হতো না। মায়ের কেউ ছিল না। মায়ের সবকিছু ধোঁয়াশা। আমি যেন এই সতের বছরেও কিছু জানতে পারিনি মায়ের সম্পর্কে । পুলিশ বাসা সিল করলো। চাচা আমাকে আস্বস্ত করলেন উনি খুব তাড়াতাড়ি বাড়ি মুক্ত করবেন। আমি এতকিছুর মধ্যে শুধু বললাম আমার বই? চাচী এসে বললেন, বই তিনি জোগাড় করে দিবেন। চাচীর সাথে দাদাবাড়ীতে গিয়ে উঠলাম। মা আত্মহত্যা করেছে, নাকি হত্যা পুলিশের তদন্ত শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত ঐ বাসা থেকে কিছু আনা নেওয়া করা যাবে না। আমার চোখ শুকনো। মা কে হারিয়ে আমি।ভীষণ একা । আমি শুধু নিজের কথাই ভাবছি।
মায়ের কথা ভাবছি না। তার জন্য কেউ কাঁদছে না। প্রথম বারের মতো আমি বাবার কণ্ঠস্বর শুনলাম, বুঝতে শেখার পর। তিনিও আছেন আমার পাশে। এটুকুই বললেন। তার তো কাঁদার কথাই না। একটা মানুষ চলে গেল পৃথিবীর বুক থেকে! কেউ কাঁদবে না? এটা ভেবেও আমার কান্না পাচ্ছে না। আমি ভাবছি আমার দাদীও তো পান খান, শরীরে তীব্র জর্দার গন্ধ । উনার বালিশেও কি তেলের গন্ধ? রাকিন কি কাল আসবে? আমাকে স্বান্তনা দিতে? কোন জামা পরব? আমি তো বাসা থেকে কিছুই আনতে পারিনি!
(চলবে)