মেঘলা মন-১০

0
791

মেঘলা মন-১০

দিশার মনে এতটুকু শক্তি নেই তাহমীদের সামনে যাওয়ার। কিন্তু বাবার আদেশ, যেতেই হলো। অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকে, তাহমীদ নিজেই শুরু করে,

• বিশ্বাস করো দিশা আমি চুরি করিনি। এটা একটা ভুল বোঝাবুঝি ,তাছাড়া দুবাইয়ের জেল তো এদেশের জেলের মতো না! তাছাড়া তেমন কেউ কিছু জানেনা। সবাই জানে আমি ছুটিতে এসেছি। আমার জমা টাকা গুলো দুবাইয়ে আছে। আমার নামে সব কেস খারিজ হলে আমার চাকরি ,টাকা সবকিছু ফেরত পাবো। মামা চেষ্টা করছেন। আমি মামার পরিচয়ে গেছি, আমি তার অসম্মান তো করতে পারিনা।
দিশা প্লিজ কিছু বলো? আমি দেশেই কিছু করবো, কিন্তু তুমি তো জানো, এদেশে কিছু করা কতটা কঠিন। আমার কাগজপত্র তো নাই, অভিজ্ঞতা ছাড়া চাকরি হয়? তাও আমি চেষ্টা করছি! কিন্তু তুমিই বলো, এই মুহুর্তে বিয়ে তো সম্ভব না। আমার মাথার উপর আমার পরিবার আছে। দিশা তুমি কি কিছুই বলবা না?

দিশা আপু কাঁপছে, আমি গিয়ে দিশা আপুকে ধরি।
তাহমীদ ভাইয়ের গলার স্বর চড়ে গেছে,
• আমারই ভুল, আমার ভুলেই এমন হলো, তোমার জায়গায় দিনা থাকলে আমাকে সাপোর্ট করত। দিনাকে বাদ দিয়ে আমি তোমার সৌন্দর্যে মজে গেলাম। দিনা অনেক ভালো মেয়ে।
তাহমীদ ভাইয়ের চিৎকার শুনে, বড় চাচা ছুটে এলেন,
• তিমির দিশাকে নিয়ে ঘরে যা। আর তাহমীদ, তোমাকে আমার মেয়ের সাথে আমি কথা বলার অনুমতি দিয়েছিলাম, ধমকানোর না। তুমি যেতে পার৷
• মামা আমার কথাটা…..
• তোমার কথা সবই শুনেছি। দিশার জায়গায় দিনা হলে, একটা চাকরি করে সামলে নিতে পারত। কিন্তু দিশার পড়া শেষ হয়নি, সে এখন কিভাবে সাপোর্ট করবে তোমাকে? আর দুবাই পাঠানোর খরচ দিয়েছিলাম আমি, আর দায়িত্ব নিয়েছিল আমার ভাই! আর কতটা সাপোর্ট করা যেতে পারে বলে তুমি মনে করো?
• মামা আমাকে একটু সময় দেন। আমি নির্দোষ প্রমাণিত হবো। আপনি দেখবেন।
• আচ্ছা, দেখা যাবে। আপাতত যাও।
দিশা আপুকে ঘরে নিয়ে শুইয়ে দিলাম। দাদী, চাচী দুজনেই বসে আছে মুখ শুকনো করে।

পরদিন সকালে,
আমরা নাস্তা করে মাছ ধরা দেখছি। দিনা আপু, ছোট চাচারা আসবে ঢাকা থেকে। চাচী আমাকে আর দিশা আপুকে মাছ ধরা দেখতে পাঠিয়েছেন। গ্রামের কিছু বাচ্চা ছেলেও উপস্থিত খালুই নিয়ে। তারা যা মাছ পাবে তাদের। কিন্তু বড় মাছ পেলে ওরা নেয় না, দিয়ে দেয়। চাচা ওদের খেলায় ব্যাঘাত ঘটান না। আমরাও মজা পাচ্ছি। লবণ আর ছাই নিয়ে হামিদা খালা আর তৈয়ব চাচা পুকুর পাড়েই বসেছে,। মাছ দ্রুত কেটে পুকুরের পানিতে প্রাথমিক ভাবে ধুয়ে ডিপ ফ্রিজে রাখবে৷ ভিতর থেকে ডাক এলো ।
দেখলাম তাহমীদ ভাইয়ের মা এসেছেন। উনাকে দিনা আপুর বিয়েতে একবার দেখেছি। সবকিছু তুলনা করছিলেন, তাহমীদ ভাই হলে আরো দামী বিয়ের শাড়ি, অলংকার আনতেন ইত্যাদি খাপছাড়া কথা। আজ মাথা নিচু করে বসে আছেন।
বড় চাচা বললেন, তোমার ফুপু তোমার সাথে কথা বলতে চায়। কথা বলো। তিমির তুইও থাক।
• এই মেয়ের সামনে কেন কথা বলবো ভাইজান?
• এই মেয়ে আমাদের বাড়ির মেয়ে। কথা বলতে হলে ওর সামনেই বলতে হবে।
• আপনার মেয়েরা নষ্ট হয়ে যাবে এই মেয়ের জন্য। এর মায়ের রঙ্গলীলা এলাকার সবাই জানে!
• হোক নষ্ট, অন্যের টাকায় বিদেশ গিয়ে নিজের নাক কাটিয়ে আসবে না অন্তত!
বড় চাচা চলে গেলেন।
ফুপু শুরু করলেন,
• মা দিশা, কাল তুমি আমার ছেলের সাথে একদম কথা বলোনি। ও খুব কষ্ট পেয়েছে।
• কষ্ট আমিও পেয়েছি ফুপু৷ এতদিনের স্বপ্ন নিমেষেই চুরমার। তাও আমি কিন্তু বিয়ে থেকে পিছু হটিনি, তাহমীদ এখন বিয়ে করতে রাজি না।
• ওর একটু সময় লাগবে বলেছে। একটা ব্যবস্থা যদি ভাইজান করে দিতেন। তাড়াতাড়ি বিয়ে দিব। আমি কথা দিচ্ছি।
• সেটা আব্বাকে বলেন। আমাকে বলে কি লাভ?
• তুমি যদি….
• না ফুপু। আমার আগেই অন্যায় হয়েছিল, দিনা আপুর সাথে ঠিক করা মানুষের বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হওয়া, তার উপর এখন আমি আর কিছু বলবো না। আব্বা যা ভালো মনে করেন করবেন।

দিশা আপু রুমে ফিরে গেল। আমিও পিছনে গেলাম। সে শুণ্য চোখে তাকিয়ে আছে। আমি চুপ করে বসে রইলাম।
• এমন কেন হলো, বলতে পারিস?
আপুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। আপু কাঁদছে।

দুপুরের পর,
দিনা আপু আর আর চাচারা চলে এসেছে। সোহেল ভাই আসেনি। তার নাকি শুক্রবারেও কাজ আছে। চাচা বলেন, এই বয়সেই তো কাজ করতে হবে, তবে সংসারের হাল ভবিষ্যতে ধরতে পারবে। আমি মাঝে মাঝে চিন্তা করি, আমাদের পরিবারের পুরুষদের কথা। তাদের অনেক উচ্চ আসন, আবার দায়িত্বও কম না। যদিও সবাই দায়িত্ব পালন করে না। আমার ব্ব যেমন পালিয়ে সুখ খুঁজে নিয়েছে, কিন্তু বড় চাচা, সে তো নিজের সন্তানের সাথে এখন ভাইয়ের সন্তানের দায়িত্ব বহন করে চলেছে। শরবত খেয়ে গ্লাসটা আমার হাতে দিল ছোট চাচা,
• জাদু আছে তোদের লেবু গাছে! এত সুগন্ধি লেবু আমি আর কোথাও পাইনি। বিদেশেও না।
• আরেক গ্লাস দেব?
• হ্যা হ্যা দে!
• আজ চাচীও অনেকটা সহজ আমার সাথে। যথারীতি গিফট এনেছেন। এবার আমাদের দুই বোনের জন্য । দিনা আপু নাকি কিছুতেই আর এসব নেবেন না। বিয়েতে অনেক নিয়েছেন। তার বক্তব্য। দুপুরের খাওয়া সেরে যে, যার ঘরে শরীর এলিয়ে দিয়ে গল্প চলছে, দিনা আপু ঘোষণা দিল, আজ রাতে তার ফুপু শাশুড়ির বাড়ি দাওয়াত। আমাকে দিশা আপুকে যেতেই হবে।
আমি কিভাবে যাব? আপু কেন কিছু বোঝেনা? রাকিন আছে ও বাড়িতে।

অনেক চেষ্টা করেও এড়িয়ে যেতে পারিনি। রাকিনের মেসেজ এলো।
• প্লিজ এসো কিন্তু। সেদিন আমার কথাই শুনলে না। আজ অন্তত কথাটা শুনবে প্লিজ!
আমি কোন জবাব দিলাম না। মনে পাথর বেধেছি। সেই পাথর আমি গলাতে দেব না।

রাতে রাকিনদের বাড়িতে,
আপুর জ্বালায় শাড়ি পরতে হয়েছে। আমি শাড়ি নিয়ে নাজেহাল, তিন বোনের একই শাড়ি। দিশা আপু ভাবলেশহীন। যা বলা হচ্ছে, করে যাচ্ছে। আমি কবে এমন হবো? রাকিনের মামাদের দোতলার ফ্ল্যাট খুব সুন্দর। আধুনিক সব সুবিধা আছে। মফস্বলে এত সুন্দর ফ্ল্যাট দেখা যায় না। সব রুম চমৎকার ভাবে সাজানো। ওদের নিচতলার অংশ দেখে, আমি ভাবতেও পারিনি এই বিল্ডিংয়ের দোতলা এত সুন্দর হতে পারে। আমাদের সাদরে আপ্যায়ন করা হচ্ছে। খুব আন্তরিক রাকিনের মামী।
রাকিন ঠিক এক ফাঁকে আমাকে ওদের নিচতলার ঘরে টেনে নিল,

• কেউ দেখলে কি রকম বদনাম হবে ভেবে দেখেছ? আমি চিৎকার করে বললাম।
• হুসস! আস্তে। কেউ এখন নামবে না। তাছাড়া আমি ভাবীর অনুমতি নিয়েই কাজটা করেছি।
• কি? দিনা আপু জানে?
• হুম! আমার কথা তো তুমি কিছুতেই শুনছ না। স্যারের কাছেও অন্য ব্যাচে পড়া শুরু করলে। সেদিন ক্যাফেতে দৌড়ে পালিয়ে গেলে। কি সমস্যা তোমার?
• সমস্যা ছিল। এখন মোটামুটি উত্তরণের পথে
• আমরা কি ভালো বন্ধু হতে পারিনা ?
আমার খুব খুব ইচ্ছে হলো বলি, হ্যা খুব পারি। তুমি আমাদের সম্পর্কের যে নাম দাও তবু তোমায় এক নজর দেখার বিনিময়ে, তোমার একটু হাসির বিনিময়ে আমি জীবন দিতে পারি । কিন্তু মুখে বললাম,
• কি লাভ?
• বন্ধুত্ব কি লাভ ক্ষতি বিচারে হয়?
• প্রতিটি সম্পর্কের ভিত্তি হলো প্রয়োজন, তোমার স্কুলের বেস্ট ফ্রেন্ড কয়জন? সবার সাথে কথা হয়?
• ছিল কয়েকজন। না সবার সাথে যোগাযোগ নেই।
• এটাই আমি বলতে চাইছি। এইচএসসির পর আমরা কে কোথায় যাব, তার তো ঠিক নেই!
• তাই বলে এখনই সব বন্ধুত্ব শেষ করতে হবে?
আমি কোন জবাব না দিয়ে উপরে চলে গেলাম। দেখি দিনা আপুরা আসর জমিয়ে ফেলেছে। ছোট চাচীর বিয়ের গল্প হচ্ছে। আচ্ছা! আমার কেন একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক, একটা ভালোবাসার মানুষ, একটা ঘর হতে পারে না? আমি কি এতই অধম?

( চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here