মেঘলা মন-(১১)

0
1129

মেঘলা মন-(১১)

মায়ের মৃত্যু বার্ষিকী আজ। চাচা কিছু মাদ্রাসার ছাত্র ডেকে আল কোরআন তিলাওয়াতের ব্যবস্থা করেছেন। প্রতিবেশীরা মিলাদে এসেছে। এতদিন পরে আমার মা সামাজিক স্বীকৃতি পেল। হায়রে সমাজ! সবকিছু মিটিয়ে সন্ধ্যায় আমি পড়তে বসেছি৷ সামনে এইচএসসি পরীক্ষা। কি ফলাফল হবে, কোথায় চান্স পাবো, টেনশনে রাতে ঘুম হয়না। বড় চাচা এখানেই পড়াবেন ঢাকা পাঠাবেন না। আমিও বিরোধিতা করিনি। দিশা আপু বলছিল ঢাকায় দিনা আপুর কাছে গিয়ে কোচিংটা অন্তত করে আসতে দিতে৷ আমি চাচার মুখের উপর কিছু বলিনা।

দরজায় ফুলি দাঁড়ানো।
• কিরে কিছু বলবি?
• আফা পুলিশ বেডি আইছে। তোমারে ডাইকা দিতে কয়।
• বাহির ঘরে বসা। চা দিয়ে যাস। আমি একাই যাচ্ছি।
বড় চাচা ঢাকা গেছেন। দিনা আপুর চাকরি হয়েছে। কিছু কাগজপত্র দিয়ে আসবেন আর মেয়েকে দেখেও আসবেন।

আমি বাহির ঘরে এসে দেখি সেই মহিলা পুলিশ,
• আসসালামু আলাইকুম
• ওয়ালাইকুম আসসালাম, কেমন আছ?
• জি ভালো
• কেসটা ক্লোজ করার আগে ভাবলাম তোমার সাথে একবার আলাপ করি
• জি বলুন?
• পোস্ট মর্টেমের রিপোর্ট অনুযায়ী তোমার মায়ের মৃত্যু আত্মহত্যা। কিন্তু তিনি সেক্সুয়ালি একটিভ ছিলেন না। কিন্তু তার প্রাইভেট পার্টসে অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন, রেপ ভিক্টিমের যা যা থাকে আর কি….
• রেপ?
• হ্যা মৃত্যুর আগে তার রেপ হয়েছিল। কাজটা কার সেটাও আমরা জানি
• তো তাকে ধরুন, তাকে শাস্তি দিন
• সে পলাতক, তার ডিএনএ টেস্ট করতে পারিনি আমরা। শুধু সন্দেহের ভিত্তিতে তো কিছু করা যায় না। তবে ধরা সে পড়বেই আমি কথা দিলাম।
• লোকটা জালাল উদ্দীন?
• হুম
আমার মায়ের আর কত কষ্ট পেয়ে মরতে হয়েছে, মানসিক আঘাত তো ছিলই, সে শারীরিক আঘাতও পেয়েছে।

• তোমার মায়ের মৃত্যুর আগের রাতে তুমি কোথায় ছিলে?
• আমি বাসায় ছিলাম না?
• কোথায় গিয়েছিলে?
• আমি…. আমি….
• ভয়ের কিছু নাই, বলো
• আমি আমার এক সহপাঠীর বাসায় ছিলাম
• যতটুকু জানি তোমার কাছের কোন বন্ধু নেই, কার বাসায় ছিলে
• তার নাম বলতেই হবে?
• কেন বলতে সমস্যা কি?
• আমি চাইনা সে আমার কোন সমস্যায় জড়িয়ে যায়
• তাহলে সমস্যা আছে বলছ?
• ঐ রাতে বিকেল থেকে মুষলধারে বৃষ্টি। আমি কোচিং-এ আটকা পড়ি। তারপর এক সহপাঠী নাম রাকিন, আমাকে বাসায় এগিয়ে দেয়। মা দরজা খুলে আমাকে দেখে গালাগালি করে বের করে দেয়। আমাকে নিয়ে রাকিন তার বাসায় যায়। আমি রাতে সেখানেই থাকি ওর নানীর কাছে। তারপর সকালে মা আমাকে নিতে আসে। আমি বাড়ি ফিরে যাই।
• তোমার মা যদি অপ্রকৃতস্থ হতেন তাহলে ঐ ছেলেকে চিনে তার বাসায় যেতে পারতেন?
• না
• তাহলে ঐ রাতে তিনি ইচ্ছে করেই তোমাকে বাসায় ঢুকতে দেননি, তোমাকে বাঁচানোর জন্য। সম্ভবত রেপিস্ট বাসায় উপস্থিত ছিল।
• সকালে ফেরার পর, মা আজেবাজে কথা বলেছে অবশ্য সেই বিকেলেই আত্মহত্যা করে মা ।
• সেই বিকেলে তোমরা লাশ পেয়েছ, মারা গেছেন দুপুর বারোটার দিকে, পোস্ট মর্টেমের রিপোর্ট অনুযায়ী।
• তাহলে আমি কলেজের জন্য বের হতেই….. মুখে হাত চাপা দিয়ে কেঁদে উঠি আমি।
• হুম তাই হবে। আজ উঠি। আমার বদলি হয়ে গেছে। পরশু থেকে আমি আর এখানে ডিউটি করছিনা। আমার মোবাইল নম্বর রাখ। যদি কোন কাজে আসি জানিও। আর কেসটাতে আমি আমার যথাসাধ্য করেছি।

কেস রিওপেন চাচা করবেন না, আমার তাই ধারণা । দিশা আপুর বিয়ের চেষ্টা করা হচ্ছে। এর মাঝে এসব নিয়ে আর কেউ মাথা ঘামাবে না। আমার মায়ের উপর দিয়ে আরো কতো ঝড় বয়ে গেছে আল্লাহ জানেন। মা তো বুঝিয়ে বলতে পারত না। শুধু রাগ করতো। আমি কতক্ষণ বাহির ঘরে বসে আছি জানিনা।রাত হয়ে গেছে। ফুলি খেতে ডাকল। আমি আর দিশা আপু দাদীর ঘরে খাই। এটা আমি মনে করি খুব ভালো রীতি। বাড়ির বয়োবৃদ্ধরা নিজেকে অনাকাঙ্ক্ষিত মনে করেনা। দাদী তার আমলের টেংরা, পুটির স্বাদ নিয়ে কথা বলছিল। পাবদা মাছের দোপেয়াজা আর টেংরা দিয়ে ফুলকপির তরকারি হয়েছে। কড়া করে ভাজা পুটি কড়মড় করে খাচ্ছে দিশা আপু। আজ তার মন ভালো। দাদী জিজ্ঞেস করলেন,
• ঐ মহিলা পুলিশ কি চায়?
• তার বদলি কাল, দেখা করতে এসেছিল
• তোর সাথে কিসের জন্য? দিশা আপুর প্রশ্ন
• এমনি,

আমি কথা বাড়ালাম না। কি লাভ, বাড়ির পরিবেশ অনেকদিন পর শান্ত হয়েছে। দিশা আপু আর তাহমীদ ভাইয়ের বাগদান ওরাই ভেঙেছে, তাদের আশা ছিল চাচা কিছু টাকা দিয়ে একটা ব্যবসার সুযোগ করে দেবে, নাহয় পারিবারিক ব্যবসায় জায়গা দেবে, কিন্তু চাচা কোনটাই করেনি। তাই তাহমীদ ভাইয়ের মা এসে আংটি ফেরত দিয়ে গেছেন। বাবা অনেক দিন আর ফোন করেন না। কারণ জানা নেই ।

চাচা ফিরলেন অনেক রাতে,
আমরা খাওয়া সেরে বই নিয়ে বসেছি ,আমি পাঠ্য বই আর দিশা আপু গল্পের বই। আমার ডাক এলো খাবার ঘর থেকে। চাচী খাবার বেড়ে দিচ্ছেন চাচাকে৷ আমাকে বসতে বলা হলো। চাচার মুখ ভীষণ গম্ভীর।
• তোমার সাথে ভীষণ অন্যায় হয়েছে আমি জানি। তোমার মা আর তোমাকে যখন আমার ভাই ছুড়ে ফেলে চলে গেল, আমার উচিত ছিল তোমাদের আশ্র‍য় দেওয়া । একটা একা মেয়ে মানুষ, কোলের বাচ্চা নিয়ে কিভাবে দিন কাটাবে আমি ভাবিনি। ঐ এক চিলতে জমি দিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছি। তোমার মায়ের মানসিক অবস্থাটাও ভেবে দেখিনি আজ আমার মেয়ের মানসিক অবস্থা ভালো না। তোমার মাকে নিয়ে বলা বাজে কথার প্রতিবাদ করিনি, আজ তাহমীদ আমার মেয়েটাকে নিয়ে অসম্মানজনক
কথা বলে বেড়াচ্ছে। তুমি তো সবই জানো। আমি চাইনা আর কোন শাস্তি আসুক আল্লাহর তরফ থেকে। তাই তোমার জন্য আমি যথাসাধ্য করবো। তুমি কি চাও কেস রিওপেন করতে?

• চাচা আপনি এখন আমার অভিভাবক। আপনার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
• খুব ভালো লাগলো মা। তোমার কথা শুনে। তুমি এই পরিবারের অংশ, দেরিতে হলেও আমি তোমাকে তোমার প্রাপ্য বুঝিয়ে দেব। তোমার অধিকার কোনভাবেই ক্ষুন্ন করা হবেনা।
• জি চাচা
• তোমার বাবার সাথে কথা হয়েছে?
• না
• তার চাকরি চলে গেছে। দুবাইয়ে থাকার পারমিট হারিয়ে সেও দেশে ফিরে আসবে৷
আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লেও এত অবাক হতাম না। আমার হতবাক চেহারা দেখে চাচা বললেন,
• তোমার কোন ভয় নেই। তুমি এখন আমার মেয়ে। আমার মেয়েরা যা খাবে, যা পরবে তুমিও তাই পাবে। পরীক্ষার বেশিদিন নেই। প্রস্তুতি নাও।
• জি চাচা
আমার চা যেন দুই মণ। আমি হাটতে পারছি না। চাচী চাচাকে বললেন, এভাবে বলার কি দরকার ছিল? মেয়েটা নাহয় কদিন পরেই জানত। এলে তো দেখতেই পেত ।

আর কিছু কানে যায়নি আমার। কানে যেন তালা লেগে গেছে। টলতে টলতে ঘরে গিয়ে বিছানায় বসে পড়লাম। গল্পের বই ছেড়ে দিশা আপু ধরলেন আমায়। আমার চোখের বাধ ভাঙা জলে ভিজে গেল দিশা আপুর ওড়না।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here