মেঘলা মন-(১৩ শেষ)

0
2625

মেঘলা মন-(১৩ শেষ)
তারানা তাসনুভা

মেঘে মেঘে বেলা গড়িয়েছে, বহু বসন্ত কেটে গেল আমার মনের বনে আর পলাশ ফোটেনি। দাদী অবশেষে ছুটি পেয়েছেন জাগতিক সব দায়িত্বের বেড়াজাল থেকে। দাদাজানের বুকে হয়তো সুখেই আছেন। বড় চাচা চোখে কম দেখেন আমি স্কুল শেষে চাচার হিসাবপত্র নিয়ে বসি। আমাদের পারিবারিক ব্যবসার ভাগ বাটোয়ারা শেষে বড় চাচা এই বাড়ি, পুকুর আর শহরের দোকানটা পেয়েছেন। সারাটা জীবন যে ব্যবসা আগলে এতদূর এগিয়েছেন সেটা বাবার ভাগে পড়েছে, বাবার ইচ্ছে ছিল এই বাড়ি ডেভেলপার দিয়ে বিরাট হাউজিং সোসাইটি বানানোর। এই বাড়ি বাঁচাতে গিয়েই চাচার এই অবস্থা। সহায় সম্পত্তি আর কিছু পেলেন না। তার অনুপস্থিতিতে কি হবে বলা মুশকিল। মাস্টার্স করা হয়নি আমার। অনার্স শেষ করে আমার মায়ের স্কুলে চাকরি পেয়েছি। মাঝে বহু সম্বন্ধ এসেছে। কিন্তু কারো মনঃপুত হয়নি। বাবার যেহেতু আরেক সংসার, জামাইয়ের সুযোগ সুবিধা কে দেখবে , জামাই আদর আদৌ পাবে কিনা, নাহয় যৌতুকের বিশাল ফর্দ, আমি চাচাকে আল্লাহর কসম কেটে বলেছিলাম এক টাকা যৌতুক হলেও সেই বিয়ে আমি করবো না। চাচার শরীর ভালো না। মাঝে মাঝেই হাসপাতালে দৌড়াতে হয়। এমন এক বিকেলে প্রায় সাত বছর পর রাকিনের সাথে দেখা,
আমি চাচার রিপোর্ট নিতে
ডায়গনস্টিক সেন্টারে বসে আছি, রাকিন এখানে রোগী দেখে। আমার জানা ছিল না, সে এখানে বসে। খুব অনুরোধ করে তার রুমে ডাকল। আমি গেলাম, ছোট হলেও বেশ সাজানো রুমটা,
• কেমন আছ?
• এইত বেশ
• এখানে কি কাজ?
• চাচার টেস্টের রিপোর্ট নিতে এসেছি
• আমি বলে দিচ্ছি, এরপর থেকে মেইল পাবে
• সমস্যা নেই। এতটুকু রাস্তা। আমি এসে নিয়ে যাব।
• চা খাবে
• রোগী নেই?
• শেষ, সিরিয়ালের কিছু রোগী অনুপস্থিত
• আচ্ছা, তবে খাওয়া যায়
• কি করছ এখন?
• মায়ের স্কুলে আমিও চাকরি পেয়েছি, ঘরের ব্যস্ততা
• আচ্ছা! খুব ব্যস্ত তাহলে? এত গুলো বছর, একটা কল নাই, একটা মেসেজ নাই, খুব বেশিই ব্যস্ত?
• করেছিলাম কল, চিনতে পারনি
• ফোন হারিয়ে তোমার নম্বর হারিয়ে গিয়েছিল
• চাইলে খুঁজে নেওয়া যেত, আমি এখানেই ছিলাম
• লুকাবো না, আমি আসলে…..
• অন্য একজনকে ভালোবাসতে, তুমি খুব দায়িত্বশীল মানুষ, একজনকে ভালোবেসে আরেকজনকে হাতে রাখার মতো স্বার্থপর নও
• আমি জানি না তুমি হেয়ালি করে বলছ কিনা৷ কিন্তু কথাটা সত্য।
• বিয়ের খবর তো পেলাম না
• বিয়ে হয়নি
• কেন?
• সুমনা বিদেশে পড়তে গেল, মাস কয়েক যোগাযোগ ছিল, তারপর যা হয়….
• হুম
• তুমি?
• আমি আছি আমার মতো
• বিয়ে?
• হয়নি, প্রচুর দেখাদেখি হয়েছিল, আমি খুব ক্লান্ত আর নিতে পারিনি, চাচাকে মানা করে দিয়েছি
• আর বিয়েই করবে না?
• জানিনা, আল্লাহ যা রেখেছেন নসীবে। আজ উঠি, সাতটা বাজে, রিপোর্ট চলে আসার কথা।
• আচ্ছা, আমি কি তোমাকে কল করতে পারি
• আমি কখনোই নিষেধ করিনি

উঠে চলে এলাম। রিপোর্ট নিয়ে রিকশা করে বাড়ির পথ ধরলাম। কাল ডাক্তার দেখাতে হবে । চাচা আবার দাদীর ঘরে বসে আছে। দাদী চলে যাওয়ার পর চাচার শরীর যেন নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। আমি গিয়ে তাকে ঘরে দিয়ে এলাম। চাচী ঢাকায় দিনা আপুর দ্বিতীয় বাচ্চা হয়েছে। দেখতে গেছেন। মাস খানেক থেকে আসবেন। আমি চাচার দেখভাল করছি যথাসাধ্য৷

পরদিন সকালে,
রিপোর্ট দেখে ডাক্তার ভর্তি লিখে দিলেন৷ কেবিন খালি ছিল না। ওয়ার্ডে ভর্তি করালাম। একা মানুষ সবকিছু সামলানো খুব কঠিন। এদিকে দিনা আপুর রক্তচাপ বেশি, আমি চাচী, দিনা আপুকে কিছুই জানাতে পারছি না। দুপুরে বাড়ি গেলাম, গোসল খাওয়া কোনমতে সেরে স্যুপ বানিয়ে নিয়ে গেলাম। দেখি চাচা কেবিন পেয়েছেন। ভালো হলো, রাতে বারান্দায় থাকা লাগবে না। সিস্টার জানালো, রাকিন স্যারের আত্মীয় জানালে আগেই পেতাম কেবিন। ভিআইপি কেবিন। টিভি, এসি, লাগোয়া ব্যালকনি, পরিচ্ছন্ন ওয়াসরুম। রাকিন এলো বিকেলে,
রিপোর্ট দেখলো,
• আরো কয়েকটা দিন থাকা দরকার। তুমি একা কিভাবে সামলাবে? অন্তত কাউকে খবর দাও, দিনা ভাবি জানে?
• না জানাইনি।
• জানানো উচিত।
• কেন খারাপ কিছু?
• না তা না, এই বয়সে…. আর এসব ব্যাপারে একা সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত না।
• বেশ জানাবো। আর ধন্যবাদ কেবিনের জন্য।
• শুকনো ধন্যবাদ দিলে তো হবে না!
আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম,সে হেসে তার সাথে যেতে ইশারা করলো।
• চাচা একা থাকবেন?
• সমস্যা নেই। এখানকার সিস্টার খুবই যত্নশীল।
আমরা হাসপাতালের বিপরীতের একটা কফি শপে বসলাম,
• এখনো কফি অপছন্দ?
• না কফি তো খাই
• সেদিনের কথা ভুলে গেলে?
• পুরনো কথা মনে রেখে লাভ কি? শুধু ব্যথা বাড়ায়৷

আমরা কফি খেয়ে ফিরলাম। রাকিন তার চেম্বারে গেল, আমি কেবিনের সোফায় শরীর এলিয়ে দিলাম। কখন ঘুমিয়েছি জানিনা। ঘুম ভাঙল দিনা আপুর ফোনে,

• আসসালামু আলাইকুম আপু
• ওয়ালাইকুম আসসালাম, বাবার কি অবস্থা?
• আলহামদুলিল্লাহ এখন ভালো
• তুই এসব গোপন করতে গেলি কেন?
• তোমার শরীর অসুস্থ তাই….
• দিশা জানে?
• দিশা আপু আসবে বললো
• আচ্ছা, ও গেলে তোর চাপ কমবে, সবকিছু মিটে গেলে ভাগনিকে দেখে যা
• হুম, ওর জন্য অনেক গিফট আছে
• তোর আসাটাই ওর সবচেয়ে বড় গিফট ,রাখছি, খেয়াল রাখিস
• আল্লাহ হাফেজ

পাঁচ দিন পর,
হাসপাতালের সব ফর্মালিটি সেরে আমরা চাচাকে বাসায় এনেছি। রাকিন এসে এসে দেখে যায়। আমি ঢাকায় গিয়ে দেখে এলাম দিনা আপুর ফুটফুটে মেয়েটাকে। ও কে কোলে নিয়ে নিজের মধ্যে এক অদ্ভুত হাহাকার, আমার কোল কি পূর্ণ হবে কোনদিন?

বাড়ি ফিরে শুনি, রাকিনের মামা, মামী আসবেন। হামিদা খালা অসুস্থ তার ভাতিজি কাজ করে সন্ধ্যা পর্যন্ত । বাকিটা আমি সামলে নেই। আজ থাকতে বললাম। নাস্তা রেডি করে নিয়ে গেলাম। রাকিনের মামী বসালেন,
• বসো মা। তোমাকে নতুন করে দেখার কিছু নেই। চোখের সামনেই তো বড় হলে।
আমাকে দেখার কি আছে, জিজ্ঞেস করা হলো না। শুধু হাসলাম। মামী আমাকে পাশে বসালেন, ব্যাগ থেকে দুটো পাতলা সোনার চুড়ি বের করে আমাকে পরালেন। আমি হতবাক।
• এটা রাকিনের মায়ের চুড়ি। মৃত্যুর সময় এটা রাকিনের বৌয়ের জন্য দিয়ে গেছেন। আমি আমার দায়িত্ব পালন করলাম। আমি আনুষ্ঠানিকতা চাইনি। আমরা আমরাই, তাই তোমার চাচী আসার অপেক্ষা করলাম না। তাছাড়া ভাই সাহেব অনুরোধ করলেন, উনি আর দেরি করতে চান না, আমিও আর কালক্ষেপন করলাম না।
আমি মাথা নিচু করে বসে আছি। আমার পরনে গোলাপি সুতির সালওয়ার কামিজ। শাড়িও পরিনি। অথচ দিনা, দিশা আপুর বাগদান কত ধুমধাম করে হয়েছিল। সবই পরিস্থিতি। আমি খুশি হবো, নাকি মন খারাপ করবো বুঝতে পারছি না। আমার স্বপ্ন পুরুষ আমার জীবন সঙ্গী হতে যাচ্ছে। আবার এটাও সত্যি সে অন্য একজনকে ভালোবেসে, তাকে না পেয়ে আমার কাছে ফিরেছে।

সবাই চলে গেলে চাচা আমায় ডাকলেন,
• মারে তোর বুড়ো বাপকে আজ দায়মুক্ত করলি। তোকে কিভাবে ধধন্যবাদ জানাবো, বুঝতে পারছি না।
• কি বলেন চাচা, আপনার আদেশ শিরধার্য।
• আমি জানতাম তুই অমত করবি না। ছোটবেলা থেকেই রাকিন তোর বন্ধু ছিল, দিনা বলছিল ঘরোয়া ভাবেই সবকিছু মিটিয়ে ফেলতে চায়৷ ওরা ওদের ছুটি মিলিয়ে তারিখ দেবে। আমি আর বুড়ো শরীরে ও বাড়িতে না যাই। তোরা ফোনেই তারিখ ঠিক করে নিস
• সমস্যা নেই, আপনি এত দুশ্চিন্তা করবেন না। সবকিছু ভালো ভাবেই হবে।
চাচার ঘর থেকে বের হয়ে সোজা ছাদে উঠে গেলাম। আকাশে এক ফালি চাঁদ রহস্যময় আলো ছড়াচ্ছে৷ আমার মেঘলা মনেও আজ মেঘ সরে এক ফালি চাঁদ উঁকি দিচ্ছে!

(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here