মেঘলা মন-৪,৫

0
632

মেঘলা মন-৪,৫
তারানা তাসনুভা
পার্ট:৪

সবকিছু স্বাভাবিক হতে প্রায় তিন মাস লেগে গেল, মাঝে কিছু ক্লাস টেস্ট ছিল। গ্রামের এইসব কলেজে ক্লাস টেস্ট হয় এটা বোধহয় সবার ধারণার বাইরে কিন্তু নতুন প্রিন্সিপাল আয়েশা ম্যাডাম আসার পর থেকে নাকি ঢাকার মতো করে পড়ানো শুরু হয়েছে, পার্সেন্টেজ ও নাকি হিসাব হবে। বড় চাচা এসে কথা বলে গেছেন তাই আমার কোন সমস্যা হলো না। আমি শুধু অংক কোচিং করতাম, বড় চাচা বাকি বিষয়গুলোও লাগলে করতে বলেছেন। আমি ঠিক করেছি রাকিনকে জিজ্ঞেস করবো সে আর কোথাও পড়ে কিনা। সে না পড়লে আমিও পড়ব না। আমি ঠিকই একটা ফ্রেম কিনে ফেলেছি৷ রোজ সেই ফ্রেম ব্যাগে করে কোচিং-এ যাই। কিন্তু দিতে পারিনা রাকিন কে। আজ আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, আজ আমি তার সাথে কথা বলবোই! কিন্তু আজ সে অনুপস্থিত! মেয়েরা বলছিল ওর নানী হাসপাতালে। আমার মনে হলো তখনই ছুটে যাই। কিন্তু সন্ধ্যা নেমেছে, এখন যাওয়া সম্ভব না। তাছাড়া রাকিনের ফোন নম্বর নেই আমার কাছে। সেটা আগে জোগাড় হবে। মেয়েদের বললে মেয়েতা রাষ্ট্র করবে, একমাত্র উপায় স্যারকেই বলা, উনি কাউকে বলবেন না, হাসাহাসিও করবেন না। ক্লাস শেষে আমি অপেক্ষা করছি, সবাই বেরিয়ে গেছে, স্যারের স্ত্রী মুগ পাকন হাতে রাকিনকে খুঁজতে এসেছে। ভালোই হলো, তার বিষয়েই কথা চলছে।

• আরে তিমির কিছু বলবা?
• স্যার রাকিনের ফোন নম্বরটা যদি দিতেন। ওর কিছু নোটস আমার কাছে রয়ে গেছে। অবলীলায় মিথ্যে বলার আর্ট কোথায় পেলাম! নিজেই অবাক।

আমার ধারণাই ঠিক। স্যার কোন চিন্তাভাবনা না করেই পকেট থেকে ফোন বের করে আমাকে নম্বর দিলেন। তার স্ত্রীর হাতের পিঠা আমাকে সাধলেন। আমি নিলাম। ম্যাডামের হাতের রান্না খুব চমৎকার। শুনেছি এই রান্না নিয়ে নাকি স্যারের মায়ের হাতে মার খেতেন উনি। এখন স্যারের মা পক্ষাঘাতগ্রস্ত। মারতে পারেন না।

আমি বাড়ির পথ ধরলাম। মনটা ভীষণ খুশি। নম্বর তো না, যেন রাকিনের হৃদয়ে স্থান পেয়ে গেছি!
কোথা থেকে জালাল উদ্দীন সাহেব হাজির বুঝলাম না। আমি চমকে উঠলেও স্বাভাবিক আচরণ করলাম। আমার ভীতি এই লোকের শক্তি। তাই ভয় পাওয়া যাবে না। আর সামান্য দূরত্ব পেরিয়ে আমার বাড়ি। এই লোক এখানে কিছুই করার সাহস পাবেনা।

• কেমন আছ তিমির? সেদিন তো।ভালো ভাবে কথা বলতেই পারলাম না। তোমার মায়ের বিষয়ে কিছু কথা ছিল।
• আমার মৃত মা সম্পর্কে আর কোন বাজে কথা শুনতে চাইনা।
• বেশ তা নাহয় শুনলে না। কিন্তু তোমার আমার কথা তো শুনতেই পার? দেখ আগেই বলেছি আমার একটা থাকার জায়গা দরকার।
• তো বাসা ভাড়া নিন। আমার কাছে কি?
• তোমার ঐ টিন শেডের ঘরে তুমি আমি জুটিতে থাকব। ভাড়া লাগবে না। তুমি রূপবতী না। তাও আমি কাজ চালিয়ে নেব । কিভাবে কাজ চালাবো জানো? ঘরের আলো নিভিয়ে দেব! ব্যাস নগ্ন শরীরে তখন তুমিই দেবী! হাহা!
আমি দ্রুত পা চালিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। চাচার এক কর্মচারী বিষয়টা দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলেন।
• আরে তিমির মা। তুমি কোচিং থেকে ফিরছ? তোমার চাচা কাছেই আছেন। সামনেই!
এটা বলা মাত্রই জালাল উদ্দীন ভোজবাজির মতো উধাও! বাকি রাস্তা চাচার কর্মচারী আমায় এগিয়ে দিলেন। আমি ধন্যবাদ জানিয়ে গেটের ভিতর চলে গেলাম। অজু করে বোনদের সাথে নামাজ পড়ে নিলাম। আজ পিয়াজু ভাজা হবে। দিনা আপু পিয়াজ, মরিচ কেটে মাখিয়ে দিল। দিশা আপুর ফোন এলো। আমি ভাজতে শুরু করি। চাচী এসে বললেন ,
• আরে তোরা ওকে দিলি কেন?
• চাচী আমি সব পারি।
• খুবই ভালো কথা মা। মেয়েদের সব পারতে হয়।
• কেন মা? দিশার তো কিছুই লাগেনা। দিনা আপু মুখ বাকিয়ে বললো।
• এই তোরা আবার শুরু করিস না। আমি যাই তোর দাদী ডাকে

আমি পিয়াজু ভেজে নিলাম। দিনা আপুর চা করা শেষ। সবাইকে দিয়ে নিজেরা ঘরে বসলাম। আমি আর দিনা আপু খাচ্ছি, দিশা আপু কথা বলছে ফোনে৷ দিনা আপু চুপচাপ খাচ্ছে।

• আপু আমাকে কি বলা যাবে?
• কি শুনবি?
• দিশা আপুর বাগদান কেন হলো?
• এই বাড়িতেই আছিস। জানতেই পারবি।
বলে সে চায়ে চুমুক দিয়ে আবার মুখ খুলল,
• কাজের লোকের মুখে শোনার চেয়ে আমার মুখেই শোন। তোর বাবার অফিসে কাজ করে, চাচাই নিয়ে গেছিলো, মানে যাওয়ায় সাহায্য করেছিল, আমি তখন মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছি। দুইটা বছর আমি জানতাম তাহমীদ ভাইয়ের সাথে আমার বিয়ে। তিনি আমাকে দেখেছেন। কথা বলতেন না অবশ্য। আমার মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ হলে ফুপু সহ সে আমাদের বাড়িতে এলো। একদম বিয়ের তারিখ ঠিক করতে। আব্বা কে তো জানিস সে আমাদের একা কথা বলতেও দেয়নি। আমাকে সামনে নেওয়া হলো। দিশা তখন কেবল এইচএসসিতে ভর্তি হয়েছে, ও সবাইকে নাস্তা পরিবেশন করলো। হেসে হেসে কথা বলছে। যেন ফুল পরী! ব্যাস! তাহমীদ ভাইয়ের মন ঘুরে গেলো। বিয়ে যদি করতেই হয় দিশাকেই করবে। আব্বা এক কথায় মানা করে দিল। তাহমীদ ভাই ধরলেন তোর বাবাকে মানে মেজ চাচাকে। চাচা বাবাকে ম্যানেজ করলেন বহু কষ্টে। তাও শর্ত হলো দিশার অনার্স-মাস্টার্স শেষে বিয়ে হবে। আকদ করাতে চাইলেন তাহমীদ ভাই। কিন্তু আব্বা রাজি হননি। আংটি পরিয়ে দুবাই ফেরত গেছে।
• খুবই দুঃখজনক।
• রূপবতী না হওয়া পাপ বুঝলি?
• রূপবতী না আপু মেয়ে হয়ে জন্মানোই পাপ!
• আরে তোমরা কি এত আলাপ করছ?
• তোর প্রেম করা শেষ হলে খেতে আয় সব ঠান্ডা হয়ে গেল।
• আরে কোন সমস্যা নেই। ও একা থাকে দুবাইয়ে। আমার তো একটু সময় দিতেই হয়।
দিনা আপু উঠে চলে গেল। আমিও বই নিয়ে বসলাম। রাকিনের নম্বরে একটা মেসেজ দিয়েছিলাম নম্বর সেভ করেই। কিন্তু কোন উত্তর এলোনা।

পড়া, নামাজ খাওয়া সেরে সবে দাদীর ঘরে গেছি ঘুমাতে, তখন রিপ্লাই এলো।
• নানী আগের চেয়ে ভালো আছেন। কে বলছেন?
• আমার জবাব তিমির
• ওহ তিমির! নম্বর পেলে কোথায়?
• দেখা হলে বলবো, কোচিং-এ কবে আসবে?
• দেখি কাল, পরশু
• কাল হাসপাতালে থাকছ?
• হ্যা আর কেউ তো নেই, আমিই আছি
• সকালে দেখতে যাব
• আচ্ছা শুভ রাত্রি

এই প্রথম টেক্সট বিনিময় করলাম। কোন বান্ধবীর সাথেও আমার কখনো বার্তা আদানপ্রদান হয়নি। কেউ বিশ্বাস করবে? মা হাতে ফোন দেখলেই গালাগালি করত। তাও এটা বাটন ফোন। স্মার্টফোন কেনার সামর্থ্য ছিল না।

পরদিন সকালে ,
একটা ক্লাস করে বের হলাম হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। এত বড় বিল্ডিং আমার তো মাথা ঘুরছে। ফোন করলাম রাকিনকে ও নেমে এলো।
• কেমন আছ খাদিজা?
• আলহামদুলিল্লাহ
• তিমির নামটা আমার পছন্দ না। আমি কি তোমাকে খাদিজা নামে ডাকতে পারি?
• হ্যা অবশ্যই পার। তোমার দেয়া কোন নামেও সমস্যা নেই।
• এত সুন্দর নাম থাকতে আমি নাম দেব কেন?
দিতে পার। প্রেয়সীকে মানুষ কত কিছু বলে ডাকে। কিন্তু আমি কি তোমার প্রেয়সী? রাকিন? পাশাপাশি হাটছি আর মনে মনে আওড়ে যাচ্ছি।

নানী ভীষণ খুশি। এই কয়দিনে তার কাছে তেমন কেউ আসেনি। বেড না পেয়ে মেঝেতে স্থান পেয়েছেন। কিন্তু এতে খুব একটা মনোকষ্ট আছে বলে মনে হচ্ছে না। কোমরে ব্যথা। টেস্ট হয়েছে। ডাক্তার বলেছে আর কয়টা দিন ভর্তি থাকতে। বললেন নানী।

আমাকে ডাকলো রাকিন। হাসপাতালের ক্যান্টিনে বসলাম আমরা। ও চা নাস্তা অর্ডার করলো।
• এসবের কি দরকার ছিল?
• তুমি আমার মেহমান। এটুকু করাই যায়।
• তুমি আমার জন্য অনেক করেছ।
• ঐ পরিস্থিতিতে যে কেউ এমন করত
• মানুষ যে কত খারাপ তুমি জানোনা
• হুম। একটা মেয়ের জন্য পৃথিবীটা বোধহয় বেশিই বৈরী।
• ও একমনে ধবধবে সাদা এ্যাপ্রোন পরা হাসিখুশি ছেলে মেয়ে গুলো দেখছে। ডাক্তারদের আলাদা বসার জায়গা। সেখানে ক্লান্ত কেউ শরীর এলিয়েছে। আবার ছাত্ররা হই হুল্লোড় করছে ।
• জানো আমার স্বপ্ন ডাক্তার হবো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে রাকিন।
• তুমি তো খুব ভালো ছাত্র। চেষ্টা করো।
• এত সহজ না।
• কঠিন বলে কি মানুষ চেষ্টা করেনা?
• তা করে। চল তোমায় এগিয়ে দেই।
• না তার দরকার হবেনা। আমি চলে যাব।
• আরে চল।
আরেকটু সময় পাশাপাশি হাটতে আমারও ভালো লাগছে। এভাবে সারাজীবন হাটা যায়না?

(চলবে)

মেঘলা মন
(৫)

আজ বড় চাচা খাবার টেবিলে ডেকেছেন মেয়েদের। আমরা সচরাচর খাবার গুছিয়ে দিয়ে দাদীর রুমে খাই। আজ সবাই এক সাথে বসেছি প্রথম বার। ঈদে এসে এই টেবিলে খাইনি কখনো। বিরাট সেগুন কাঠের টেবিল, চেয়ারগুলো এত ভারী যে টেনে বসা কঠিন, কাসার পাত্রে খাবার পরিবেশন করা হয়৷ আমরা অবশ্য মেলামাইন, সিরামিক ব্যবহার করি। প্রায় বিশজন বসার ব্যবস্থা আছে টেবিলে। কাজের লোক এখানে আসেনা, বাড়ির মেয়েরা খাবার পরিবেশন করে। আজ চাচী পরিবেশন করছেন। আমরা খাবার বেড়ে এনেছি, আমি দাঁড়িয়ে বললাম,
• আমি পরিবেশন করি, চাচী আপনি বসেন।

বড় চাচা বললেন,
• তুমিও করবে মা। আজ থাক। তোমার সাথে কথা আছে। আমি মেয়েদের ঘরে চট করে যাইনা। তাই এখানেই ডাকলাম। যে কথাটা আমি বলতে চাই, সরাসরি শুরু করি, তিমির মা, তুমি ঐ জালাল উদ্দীনের কথা আমাকে গোপন করে গেলে কেন? সফিক সাহেবের মুখে শুনলাম সে তোমাকে রাস্তায়, তাও আবার আমাদের বাড়ির সামনে তোমাকে উত্ত্যক্ত করেছে? কথা কি সত্য?
• জি চাচা সত্য
• তাহলে এই কথা আমি বাইরের মানুষের মুখে কেন শুনলাম?
• চাচা আমি খুবই দুঃখিত, এসব কথা আমি কখনো কাউকে বলিনি। বাবা রূপে আমার মাথায় কেউ হাত রাখেনি। মাকে এসব কথা বলতে গেলে বলতো, আমি নাকি নোংরা মেয়েমানুষ। তাই আমাকে ছেলেরা উত্ত্যক্ত করে। ভালো মেয়েদের ছেলেরা সম্মান করে! তাই আমি কথাটা কাউকে বলিনি।
• হুম। ঠিক আছে। আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু এই ভুল তুমি আর করবে না। বাকি মেয়েরাও না। নিজেকে উত্ত্যক্ত করার সুযোগ কাউকে দেবেনা। আর বেশি সমস্যা মনে করলে আমি কাউকে বলে দেব তোমাকে এগিয়ে দেবে, আবার নিয়ে আসবে।
• না চাচা আর সমস্যা হবেনা।
• না হলেই ভালো। খাওয়া শুরু করো। মা কিছু বলবেন?
• না বাবা তুমি ঠিক বলেছ। মেয়েরা কথা গোপন করে সংসারে অনেক বিপদ ডেকে আনে। সমস্যার কথা বাড়ির মুরুব্বিদের বলা উচিত। দাদী বললেন।

খাওয়া সেরে আমরা তিন বোন ছাদে। থালার মতো বড় চাঁদ উঠেছে আকাশে। দিশা আপু একটু দূরে ফোনে কথা বলছে। দিনা আপু গুনগুন করছে,

চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে,
উছলে পড়ে আলো।
ও রজনীগন্ধা, তোমার গন্ধসুধা ঢালো ॥
চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে ……
পাগল হাওয়া বুঝতে নারে
ডাক পড়েছে কোথায় তারে–
ফুলের বনে যার পাশে যায়
তারেই লাগে ভালো ॥
ও রজনীগন্ধা, তোমার গন্ধসুধা ঢালো,
চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে…….

• আপু তোমার কন্ঠ তো খুব মিষ্টি।
• কণ্ঠে কি আছেরে পাগল? রূপই আসল।
• এত হতাশ হবেন না আপু। আল্লাহ আপনার জন্য কাউকে লিখে রেখেছেন।
• সে তো আর তাহমীদ না!
• তা না! জানেন আপু আমাদের টিনের ঐ দুই কামরার ঘরে সবচেয়ে ভালো কি ছিল?
•চাঁদের আলোয় ভেসে যেত ঐ ছোট্ট উঠান। পেয়েরা, লিচু পাতার ছায়া পড়ত উঠানে। কি যে সুন্দর!
•তাহলে তো দেখতে যেতে হয়।
•পুলিশ অনুমতি দিলে যাবেন।

টুং করে ফোনে শব্দ হয় আমার, রাকিনের মেসেজ,

চাঁদের সাথে সখ্য গড়তে রাত জেগেছি বহু,দুরের চাঁদ দুরেই থাকে আপন হয়না কভু।
কৃষ্ণ পক্ষে ঘুমিয়ে থেকে শুক্লপক্ষে দেখি, নীল আকাশে বসে থাকে ঐচাঁদ একাকি।
বাংলিশে লেখা কবিতাটা যারই হোক । দারুণ লেখাটা৷ নাকি রাকিনের? এখন সে হাট্টিমাটিম পাঠালেও আমার কাছে অসম্ভব সুন্দর লাগবে! এটাকেই প্রথম প্রেম বলে কিনা এখনো জানিনা। আমি জবাব দিলাম না।

• তোরও আবার দিশার মতো মনের মানুষ হয়েছে বুঝি?
• কেন?
• ঐ যে মেসেজ পড়ে উদাস হয়ে গেলি?
• আরে না। অংক পরীক্ষা আছে কোচিং-এ কাল।
• ওহ! এতে উদাস হওয়ার কিছু নাই। আর কিছুক্ষণ চাঁদ পোহায়ে নিচে চল। আমি অংক দেখিয়ে দিচ্ছি।

ভালোই হলো। আমিও আপুর চাপে কয়টা অংক করবো। আর আপুর মনও বদল হবে। একটা মানুষকে নিয়ে কষ্ট পুষে রাখা কি সেটা আমি এখন একটু একটু বুঝি। আমারটা একরকম সুখের মতো কষ্ট! মানুষটা আমায় ভেবে চাঁদ দেখে, হাসপাতালে দাঁড়িয়ে। সে যদি কোনদিন ডাক্তার হয়। তখনও কি আমার কথা ভেবে চাঁদের আলোয় স্নান করবে? নাকি সুন্দর কোন ডাক্তার মেয়ের মনের রাজ্যের অধিপতি হবে?

পরদিন বিকালে,
যাকে নিয়ে এত ভাবনা, সে আজো তার মতো করে অংক করছে। অন্য বিষয় সে কোচিং করেনা। নিজেই পড়ে। চাইলে সে দেখিয়ে দেবে। যা কথা হচ্ছে মেসেজে। আমার দিকে তাকিয়ে দেখছে না। আমি এতেই অভিভূত। আমার দিন রাত এক হয়ে যাচ্ছে বারবার ঐ লাইনকটা পড়ে পড়ে, দিনা আপুর চোখ ফাঁকি দেওয়া সহজ কথা না।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়,
ছোট চাচা এলেন পরিবার সহ উনার স্ত্রী আর দুই ছেলে নিয়ে সংসার। ভীষণ ডানপিটে দুই ছেলে। এসেই বাড়ি মাথায় তুলেছে। একেবারে ঈদের আমেজ। দাদীও ওদের সাথে প্রাণ খুলে হাসছেন, খেলছেন। চাচী দুটো ঢাউস ব্যাগে করে দিনা আপু আর দিশা আপুর জন্য উপহার এনেছে। প্রসাধনী, চকলেট, পারফিউম আরো কত কি….. ওরা আড্ডা দিচ্ছে আমি আর বড় চাচী রান্নাঘরে। বড় চাচা দুপুরেই অনেক বাজার এনেছেন। পুকুর থেকে মাছ ধরা হয়েছে সকালেই। সেই মাছ কেটেকুটে সাফ করে ডিপ ফ্রিজে রেখেছেন বড় চাচী, এগুলো পাঠানো হবে। আজ রাতের জন্য দেশি মুরগির রোস্ট, পোলাও, চিংড়ির মালাইকারি, মাছের কোপ্তা তৈরি হচ্ছে। ছোট চাচী একবার উঁকি দিয়ে চলে গেলেন। দিনা আপু হাতে হাতে কাজ করছেন টুকটাক, দিশা আপু এমুখো হননি। চুলা ফাঁকা নেই, ইলেক্ট্রিক কেটলিতে চা বানিয়ে নিয়ে গেলাম। আমিই পরিবেশন করছি।

ছোট চাচা বলে উঠলেন,
• আরে তিমির যে! কাজ কর্ম কিছু জানো?
• আরে ও সব পারে, এসেই রান্নাঘরে মন দিয়েছে, বড় ভালো মেয়ে! বড় চাচী জবাব দিলেন
• ভালো হলেই ভালো। দিশা মায়ের বিয়ের খবর কি? এভাবে দেরি করা কি ঠিক হচ্ছে? তাহমীদ বাবা এভাবে একা একা বিদেশ বিভুইয়ে…..
আমি সরে এলাম। দেখি দিনা আপু কাঁপছে, আপুকে সরিয়ে নিলাম।
• ঠিক আছো আপু?
• হুম, কোনমতে অস্পষ্ট স্বর বের হল।
রুমে শুইয়ে দিলাম আপুকে। দিশা আপু ফোন কেটে এগিয়ে এলো,
• কি হয়েছে?
• ঐ যা গরম পড়েছে রান্নাঘরে!
• হ্যা খুব গরম, সব বাড়িতে এখন এসি লাগানো, কেবল আমাদের বাড়িতে নেই । নিদেনপক্ষে একটা এয়ার কুলারও নেই! আমার আর কি? কদিন পর দুবাই যাব। সেখানে সব পাবো। বলে বারান্দায় চলে গেল। আবার ফোন এসেছে। আমি আপুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।
চাচী ছুটে এলেন রান্নাঘর থেকে,
• কি হলো মা আমার?
• কিছু না আম্মা। মাথা ধরেছে।
• আমি সব বুঝিরে মা। তিমির তোমার বাবা সব নষ্টের গোড়া। আমরা বিয়েটা নাকচ করেছিলাম। সেই বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করালো। নিজে তো তোমাকে আর তোমার মাকে জলে ভাসালো, আর এখন আমার বড় মেয়ের কপালটা পুড়লো।
• আম্মা! চিৎকার করে ওঠে দিনা আপু। যেই বাবাকে ও চোখে দেখেনি সেই বাবা নিয়ে ওরে কথা শুনাইতেস কেন? ওর কি দোষ? যখন ফোন করে সরাসরি তাকে বলতে পারনা? আর যদি শুনি তুমি ওরে কিছু বলছ, আমি সরাসরি চাচাকে ফোন করে সবকিছু বলে দিব।
• আরে মেয়ের মেজাজ কি তিরিক্ষি! আমি রান্নাঘরেই যাই। তিমির বোনকে দেখিস মা।
চেচামেচি শুনে দিশা আপুও রান্নাঘরে চলে গেল। ওদিকের কাজ শেষ করে আমাদের খাবার নিয়ে ঘরে এলো দিশা আপু সাথে ছোট চাচী। আমরা এক সাথে খেলাম। কিন্তু চাচী আমার সাথে একটা কথাও বললেন না। আপু হাত ধুয়ে চাচীর সামনেই উপহারের ব্যাগটা আমার হাতে দিয়ে বললেন,
• নে এটা তোর
• আমি হতবাক, আস্তে করে বললাম, আমি কিভাবে নিব?
• চাচী, আমরা এখানে তিন বোন যদি কিছু আনেন, তিনটা করে আনবেন। না পারলে কিছুই আনার দরকার নাই। এই যে আরাম করে ডিমওয়ালা কইমাছের কোপ্তা খেলেন। এই বেচারির রান্না!
চাচী কিছু না বলে চলে গেলেন। আমি প্লেট,বাটি রান্নাঘরে দিয়ে এলাম। ছোট চাচা গ্রিন টি চাইছেন। হামিদা খালা সবে ভাত নিয়ে বসেছে। তাকে ডাকতে ইচ্ছে হলো না। আমিই বানিয়ে দিয়ে এলাম। চাচী পাশেই গোমড়া মুখে বসে আছেন। চাচা আমার হাত থেকে চা নিয়ে দাঁড়াতে বললেন, ওয়ালেট থেকে পাঁচশ টাকা বের করে দিয়ে বললেন,
• তোমার চাচী আসলে অনেক আগে শপিং করেছে। তখন তুমি এই বাড়িতে ছিলা না। নাও এটা দিয়ে কিছু কিনে নিও। হাতের রান্না চমৎকার তোমার।
• ধন্যবাদ চাচা, আমার টাকা লাগবে না। দোয়া করবেন আমার জন্য।
বলে চলে এলাম। টাকাটা তার হাতেই রয়ে গেল। চাচা বিষ্মিত চোখে আমার গমনপথে তাকিয়ে রইল।

আমি ঘরে গিয়ে ব্যাগ গুছালাম। পরদিন কলেজ নাই তাও ব্যাগ ঘাটাঘাটি করছি আপুর ঘুমিয়ে পড়ার অপেক্ষা! রাকিন মেসেজ দিয়েছে, কিন্তু আমি উত্তর দিতে পারছি না। উশখুশ করছি। দিনা আপু শুয়ে ছিল। কপালের উপর থেকে হাত সরিয়ে উঠে বসলো। বেডসাইড ড্রয়ার থেকে একটা কার্ড বের করে আমার হাতে দিল ।
• নে মোবাইলে টাকা নাই? ভরে নে। আর আসার পথে সোলেমান কাকার দোকানে কার্ড লাগলে নিবি। আব্বার সাথে উনার মাস চুক্তি। আমরা দুই বোন যাই কিনি, আব্বা মাস শেষে টাকা দেয়৷ তুইও এই সুবিধা নিবি।
আমি কি বলবো বুঝতে না পেরে চুপ করে অনেকক্ষণ বসে রইলাম। আমার জন্য কেউ লড়েনি কখনো। ছোটবেলায় ছেড়া জুতার জন্য স্কুলে খুব হাসাহাসি হয়েছিল পিটি ক্লাসে। কেউ আমার পক্ষে ছিল না। এমনকি যে শিক্ষিকার ক্লাস তিনিও হেসে বলেছিলেন, সরকারি স্কুল! ফকির মিসকিন দিয়ে ভরা ! ম্যাডামের নাম সেলিনা পারভীন। আমি তার বাড়ির ঠিকানা টুকে এনেছি অফিস থেকে, যদি কোনদিন বড় কিছু হই তার সাথে দেখা করবো আর বলবো ফকির মিসকিনরাও মানুষ!

( চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here