মেঘশূন্য আকাশ,পর্ব-১,২

0
5724

মেঘশূন্য আকাশ,পর্ব-১,২
লেখাঃ আমিনুর রহমান
পর্ব-১

ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দরী,সবচেয়ে কাছের বান্ধবীটাকে যেদিন ক্লাসের সবার সামনে প্রেম নিবেদন করেছিলাম সেদিন আমার সবচাইতে কাছের বান্ধবীটাই আমাকে সবার সামনে দুইগালে দুইটা থাপ্পড় মেরে বলেছিলো,
“তোর সাহস কি করে হলো আমাকে এভাবে সবার সামনে প্রেম নিবেদন করার? তুই কি কখনোও আয়নাতে নিজের চেহারটা একবার দেখেছিস? তোর মতো ছেলেরা বন্ধুই হিসেবেই পারফেক্ট, বয়ফ্রেন্ড হিসেবে না। আমি বুঝলাম না কি মনে করে তুই ভাবলি আমি তোকে ভালোবাসতে যাবো? আচ্ছা তুই বল তোর এমন কি আছে যেটা দেখে তোকে আমি ভালোবাসতে যাবো। না আছে চেহারা,না আছে টাকা,না তুই ভালো স্টুডেন্ট। বন্ধুত্ব করেছি টাইম পাস করার জন্য,প্রেম করার জন্য নয়। তোকে দিয়ে আমি আমার কাজগুলো করিয়ে নিতাম এজন্য তোর সাথে একটু খাতির দিতাম,এর মানে এই নয় যে আমি তোকে ভালোবাসতে শুরু করেছি। আর তুই এতোগুলো মানুষের সামনে আমাকে ভালোবাসার কথা বললি সেজন্যই তোকে তোর যোগ্যতাটা চিনিয়ে দিলাম। ভবিষ্যতে তোর টাইপ কাউকে প্রোপোজ করবি তাহলে হয়তো পজেটিভ ফল আসবে।”

সাদিয়া যখন ক্লাসের প্রায় সত্তর জন ছাত্র ছাত্রীর সামনে কথা গুলো বলল সবাই তখন আমার দিকে কেমন করে যেনো তাকিয়ে ছিলো। আমিও অনেকটা অবাক হয়ে গিয়েছিলাম তাঁর এমন ব্যবহারে। দীর্ঘ তিনটা বছর ধরে তাঁর সাথে আমি অাছি। কখনো মনে হয়নি সে আমাকে পছন্দ করে না। যদি কখনো ক্লাসে না যেতাম সেদিন সাদিয়া ফোন দিতো কিংবা আমার মেসে চলে আসতো। ক্যাম্পাসের প্রায় সময়টাই সে আমার সাথে কাটাতো। আমার মনে হতো সে আমার সাথে কাটানো সময় গুলোতে অনেক মুগ্ধতা খুঁজে পায়,যেমনটা আমি পাই। কিন্ত আমার সব ধারণাই ভুল প্রমাণিত হয়েছে সেটা আমি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি।

আমি নিজেকে সবসময় স্মার্ট ভাবতাম। দেখতে শুনে ভালো না হলেও একেবারেই খারাপ না। কিন্তু সাদিয়া আমার আত্মবিশ্বাসটাকে আজ ভুল ধরিয়ে দিয়েছে। সুন্দরী মেয়েদের সামনে হয়তো শ্যাম বর্ণের মানুষও কালো হিসেবে বিবেচিত হয়। তারা তাদের চেয়ে কম সুন্দর কাউকে সুন্দর বলতে রাজী না। তারা যেমন দুধের মতো ধবধবে সাদা,তাদের প্রিয়জনটাকেও হয়তো তেমন হতে হবে। মা বেঁচে থাকতে সবসময় বলতো আমার চেহারায় কেমন যেনো একটা মায়া অাছে। যে দেখবে সেই আমার মায়ায় পড়ে যাবে। কিন্তু সেটাও কেনো জানি মিথ্যা মনে হচ্ছে। সবসময় ভাবতাম কালো কিংবা শ্যাম বর্ণের মানুষের চেহারাতে এক অদ্ভুত মায়া মেশানো থাকে যেটা সুন্দরী মেয়েদের মাঝে থাকে না। কিন্তু আজ বুঝতে পারলাম, এসব মায়া টায়া দিয়ে কাজ হয় না,কালারটাই আসল। সবাই সুন্দর খোঁজে। এটা চিরন্তন সত্য।

তবে আমি খুব দুঃখ পেয়েছি আজ। আমি খুব আশা নিয়ে সকল লজ্জা,অপমান পিছনে ফেলে সাদিয়াকে আমার ভালোবাসার কথাটা এভাবে সবার সামনে বলেছিলাম,ভেবেছিলাম সে সারপ্রাইজ হয়ে আমাকে নিজের করে নিবে। কিন্তু কখনো বুঝতে পারিনি এতোগুলো মানুষের সামনে আমাকেই সে সারপ্রাইজ করে দিবে। কেনো জানি মনে হচ্ছে এতোগুলো মানুষের সামনে তাকে আমার কথাটা বলা উচিত হয়নি। একলা একা কোনো নির্জন জায়গায় যদি তাকে বলতাম ভালোবাসি তাহলে হয়তো এতোটা রিঅ্যাক্ট সে করতো না, আমাকেও এতোটা অপমান সহ্য করতে হতে না। নিজের বাড়িতে অপমান সহ্য করেছি অনেক কিন্তু আজকের অপমানটা কেনো জানি আমি নিতে পারছি না। চোখ দিয়ে নিজের অজান্তেই দুফোটা জল গড়িয়ে পড়লো। আমি সবার সামনে কাঁদলাম,অথচ কেউ আমার কান্না থামানোর জন্য কিংবা সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসেনি।

রাত আটটা বাজে,রুমে শুয়ে আছি সকালের সেই ঘটনাটা কেনো জানি মনে হচ্ছে আমার ভিতরে গেঁথে গিয়েছে, চাইলেও আমি ভুলতে পারবো না তাই হয়তো বারবার ওটাই মনে হচ্ছে। আর চোখটা অঝড়ে ঝড়ে চলেছে। এমন সময় ভাইয়া আর ভাবীর ঝগড়া শুনতে পেলাম। হঠাৎ করেই বুঝলাম তারা আমাকে নিয়ে কিছু বলছে।

“তোমার বাবা মরার আগে একটা আপদ আমাদের কাছে রেখে গেছে। সে যদি মৃত্যুর সময় আপদটাকে নিয়ে মরতো তাহলে আর এতো সমস্যা হতো না। আমি আর পারছি না। তুমি তোমার ভাইকে অন্য কোথাও চলে যেতে বলো। ওকে দিয়ে তো আর কোনো উপকার হচ্ছে না আমাদের। বাজারটাও কাজের লোক দিয়ে করতে হয়,তোমার ভাই করতে পারবে না। আসলে সব দোষ তোমার বাবার। মরার আগে তোমার বাবা তোমার হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল আমিনুলকে সবসময় তোর কাছে রাখিস আর তুমি সেটাই করছো। যে মরে গেছে তাঁর শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করতে হবে এমন তো আর না। অনেক সহ্য করেছি আর না। এই বাড়িটা বাবা আমাদেরকে দিয়েছেন,আমাদের থাকার জন্য। অন্য কোনো মানুষ থাকার জন্য না। এটা তোমার কিংবা তোমার বাড়ি না। তুমি তোমার ভাইকে চলে যেতে বলো। সে তাঁর বাবার বাসায় থাকবে,এখানে থাকলে আমি বাবার কাছে চলে যাবো। ভেবো দেখে তুমি কি করবে।”

ভাবী যখন ভাইয়ার সামনেই কথা গুলো বলল তখন আমি নিজের চোখের পানিটাকে ধরে রাখতে পারিনি। আজ আমার জন্য কাঁদছি না আমি। কাঁদছি বাবার জন্য। যে মানুষটা মারা গেছে তাকে নিয়ে এসব কথা বলছে এটা ভাবতেই পারছি না আমি। ভাবী না হয় পরের রক্ত, ভাইয়া তো নিজের রক্ত। সে কিভাবে পারলো বাবাকে নিয়ে এতো বাজে কথা হজম করতে? তবে কি সে বিলাসিতার জীবন পেয়ে নিজের অতীতকে ভুলে গিয়েছে? ভুলে গিয়েছে বাবা তাকে কতোটা কষ্ট করে লেখাপড়া করিয়েছেন। কিন্তু আজ সুন্দরী বউয়ের আরাম আয়েশের জীবনের কাছে বাবা মায়ের কষ্টটা তুচ্ছে। তবে কি সারাজীবন যেটা শুনে এসেছি সেটাই সত্য। সুন্দরী বউ পেলে মানুষ নিজের বাবা মাকেও পর করতে দ্বিধাবোধ করে না। আর সেখানে আমি তো অনেক দূরে। আমি কারও বাবা মা না,শুধুমাত্র ভাই। সো আমি এটা ভেবেই নিতে পারি আমার আর এই বাড়িতে থাকা হচ্ছে না। আমার বাবা মা যেখানে আমাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন সেখানেই আমাকে চলে যেতে হবে।

আমি আর ভাইয়া ভাবীদের অপেক্ষা করলাম না। তারা না বলা সত্ত্বেও পরের দিন আমি বাসা থেকে সবকিছুই গোছগাছ করে চলে যাবো বলে ঠিক করলাম। সবচেয়ে বেশি অবাক হলাম যখন আমার চলে যাওয়া দেখে ভাইয়া ভাবি একটা কথাও বলল না,একবারও বলল না থেকে যা। যদিও আমি আর এখানে থাকবো না। তবুও ভাইয়ার কাছ থেকে আমি এমনটা আশা করেছিলাম কিন্তু আমি আশাহত হলাম। আমি যার কাছেই যা কিছু আশা করি না কেনো সেই আমাকে আমার অস্তিত্ব চিনিয়ে দেয়,বুঝিয়ে দেয় আমি তাঁর কাছে এটা আশা করতে পারি না। নিজের অজান্তেই চোখে পানি ঝড়ছে। দিন দিন চোখের পানিটাও যেনো কেমন সস্তা হয়ে যাচ্ছে,অল্পতেই ঝড়ে যায়। আজ সম্পর্কের সব বন্ধন ছিন্ন করে চলে গেলাম। আমি সবসময় ভাবতাম বাবা নেই তো কি হয়েছে? ভাইয়া তো বেঁচে অাছে। সে আমার দেখাশোনা করবে। ভাইয়া বেঁচে থাকতে আমাকে কখনো চিন্তা করতে হবে না। কিন্তু এই পৃথিবীতে বাবা মা ব্যতীত কেউ আপন হয় না হোক সেটা নিজের মায়ের পেটের ভাই কিংবা নিজের বোন এই চিরন্তন সত্যটা আমি আজ খুব করে অনুধাবন করছি। সময়ের ব্যবধানে সবাই স্বার্থপর হয়,শুধু বাবা মা হয় না।

আমি বাবার রেখে যাওয়ার বাড়িতে চলে গেলাম। গ্রামের ছোট্ট একটা বাড়ি। নিজের আপন বলতে এই বাড়িটাই আমার আছে। আমার আপন বলতে এই পৃথিবীতে কেউ নেই। আমাকে একাই বেঁচে থাকতে হবে। যে মানুষগুলোকে আমি আপন ভেবেছিলাম কিংবা ভাবতে চেয়েছিলাম সবাই আমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। কেউ আমাকে কাছে টেনে নেয়নি। সাদিয়ার কথাটা হয়তো কোনো একদিন আমি ভুলে যাবো কিন্তু আমার নিজের রক্ত,নিজের আপন ভাইয়ের কথাটা কিভাবে ভুলবো আমি? যে মানুষটা আমার বেঁচে থাকার শেষ ভরসা ছিলো সেই মানুষটাও আমাকে সব শেষে বুঝিয়ে দিয়েছে, এই পৃথিবীতে কেউ কারো আপন না। নিজের বেঁচে থাকার জন্য নিজেকেই সংগ্রাম করতে হবে,নিজেকেই নিজের জীবন যুদ্ধের মোকাবেলা করতে হবে।

আমি ভার্সিটিতে যাওয়া অনেকটা বন্ধ করে দিলাম। প্রয়োজন ব্যতীত যেতাম না। আমার বাসা থেকে ভার্সিটি অনেক দূর হয়ে যেতো।

বেঁচে থাকার জন্য টাকা দরকার। টাকার জন্য কাজ দরকার। আমি তেমন কোনো কাজ জানি না। মানুষ টিউশনি করে শখ করে,আর আমি টিউশনি শুরু করলাম বেঁচে থাকার জন্য। প্রথম দিন ছাত্রের বাসায় গিয়েই দেখলাম একটা সুন্দরী মেয়ে বারান্দায় বসে আসে। আমাকে এই বাড়িতেই পড়াতে হবে বলে খুব খারাপ লাগলো। কারণ এই সুন্দর মানুষদের কে আমার কেনো জানি সেদিনের পর থেকে ভালো লাগে না। এরা সুন্দর বলে, চারপাশের সবকিছু সুন্দরই আশা করে। কে জানে হয়তো বা এই মেয়েটাও সাদিয়ার মতোই সুন্দরের পুজারি হবে।

চলবে……………

মেঘশূন্য আকাশ
পর্ব-২
আমিনুর রহমান

আমাকে ক্লাস ফোরের ছাত্র পড়াতে হবে। ছাত্রের নাম অয়ন,প্রথমদিন পড়িয়েই বুঝতে পারলাম খুবই দুষ্ট। আমাকে অনেক কিছুই সহ্য করতে হবে। আমি কখনো ভাবিনি আমার জীবনে আমি কোনোদিন টিউশনি নামক অধ্যায়ের সাথে নিজেকে জড়াবো। কিন্তু পরিস্থিতি আজ আমাকে এটা করতে বাঁধ্য করেছে। সবচাইতে চিন্তামুক্ত জীবন মনে হয় তখনই যাপন করা যায় যখন বাবা মা নামক বটগাছটা মাথার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। কারণ তখন কোনো চিন্তা থাকে না,কোনো ভাবনা থাকে না,খাবারের জন্য চিন্তা করতে হয় না,থাকার জন্য চিন্তা করতে হয় না। সকাল হলেই ঘুম থেকে উঠবার আগেই খাবার প্রস্তুত থাকে,দুপুর হতেই মা অস্থির হয়ে যেতো খাবার না খেলে। কিন্তু নিজের ভরণপোষণ নিজেকেই যাদের করতে হয় তারাই কেবল বোঝে বাস্তবতা কতোটা নির্মম। আমারও নিজের ভরণপোষণটা নিজেকেই করতে হয়। আমি সবসময় চিন্তায় থাকি কালকে কি খাবো আমি? কালকে কে রান্না করেে দিবে আমাকে। সবসময় হোটেলে খাওয়া যায় না। হোটেলে খাওয়ার জন্য টাকা লাগে।

আমার এমন অবস্থা দেখে কেউ যে আমার পাশে দাঁড়াবে আমি ভাবিনি। অয়নকে পাঁচদিন পড়ানোর পর অয়নের মা একদিন আমাকে ডেকে নিয়ে বলল,
” আমি তোমার অবস্থা সম্পর্কে জেনেছি,তুমি একা বাসায় থাকো,তোমার সাথে কেউ থাকে না। তোমাকে রান্না করে দেওয়ার মতো কেউ নেই। তোমার খাওয়া দাওয়ার অনেক কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তুমি যদি চাও তো আমাদের বাসায় থাকতে পারো। এখানে তিনবেলা খাবে আর থাকবে। আর বাড়তি কোনো কাজ করতে হবে না। শুধু অয়নকে রাতে পড়াবে। তাহলেই হবে। আমি তোমাকে জোর করছি না। তবে এটা তোমার জন্য ভালোই হবে। ভেবে দেখে জানাবে আমাকে”

আমি রাজী হয়ে গেলাম। কারণ অয়নকে পড়ানোর বিনিময়ে আমি যে টাকা পাই তাঁর পরিবর্তে তিনবেলা খাওয়া,থাকার ব্যবস্থা করা এর থেকে বড় সুযোগ হয়তো আর পাবো না। অয়নকে ছাড়াও আমি আরো তিনটা টিউশনি করাতাম। সেগুলো দিয়ে আমার হাত খঁরচের টাকা হয়েও মাস শেষে কিছু বেচে থাকবে। তাই এই সুযোগটা আমি হাত ছাড়া করলাম না। আমি অয়নদের বাসায় লজিন মাস্টার হিসেবে থাকার জন্য রাজী হয়ে যাই।

প্রথম কিছুদিন ভালোই গেলো। অয়নকে পড়ানো বাদ দিয়ে আমাকে তেমন কোনো কিছু করতে হতো না। একদিন হঠাৎ করেই অয়নের মা বলল বাসায় মেহমান আসবে কিন্তু বাজার নেই,তুমি যদি একটু কষ্ট করে বাজারে যেতে তাহলে অনেক উপকার হতো। সেদিন আমি প্রথম বাজারে যাই,তারপর থেকে অয়নদের প্রতিদিনের বাজার আমিই করতাম। প্রথম প্রথম খারাপ লাগতো। কারণ বাবা বেঁচে থাকতে কোনোদিন নিজেদের বাজার করিনি,ভাইয়ার বাসায় থাকতেও করিনি। কিন্তু এখানে করতে হচ্ছে। তবে আমার ভালোই লাগে,খারাপ লাগে না। এই ছোট্ট জীবনে যতো বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া যায় ভবিষ্যতের জন্য ততোই ভালো। কারণ বাস্তবতা থেকে প্রতিটি মানুষের শেখার আছে,আমিও শিখছি প্রতিনিয়ত। অয়নদের বাসায় আমি প্রায় একমাস ধরে আছি। আশ্চর্যের বিষয় হলো তাঁর একটা বোন আছে তাঁর সাথে এ পর্যন্ত আমার কোনো কথা হয়নি। কারণ আমার অয়নদের বাসার ভিতরে যাওয়া নিষেধ। বারান্দায় অয়নের পড়ার জায়গা,সেখানেই আমি অয়নকে পড়িয়ে রাতে শোয়ার জন্য বাহিরে চলে আসি। কারণ আমার থাকার জায়গাটা বাহিরের ছোটোখাটো একটা ঘরে।

অয়নের মা যখন বলল,
“সামনে রাফিয়ার ইন্টার পরীক্ষা। দিনকালের যা অবস্থা মেয়ে মানুষকে তো রাস্তায় একা ছাড়তে অনেক ভয় হয়। তুমি যদি রাফিয়ার সাথে প্রতিদিন যেতে তাহলে একটু চিন্তামুক্ত থাকতে পারতাম।”

আমি এবারও কেনো জানি না করতে পারলাম না। আসলে যারা তিনবেলা খাবার দিচ্ছে,থাকতে দিচ্ছে তাদের কোনো কথাতেই না করা যায় না সেটা যতোই আপত্তিকর হোক না কেনো। একপ্রকার বাঁধ্য হয়েই তাদের আবদার গুলো রাখতে হয়। অথচ বাবা মা বেঁচে থাকতে তাদের কথা গুলো রাখার প্রয়োজন মনে করতাম না কিন্তু তারা কোনো কাজ ছাড়াই বিলাসিতার জীবন উপহার দিয়েছিলো। বলে রাখা ভালো অয়নের বোনের নাম হচ্ছে রাফিয়া।

আমি ভাবিনি রাফিয়া এতোটা মিশুক হবে। দুমাস তাদের বাড়িতে থাকার পর তাঁর সাথে আজ প্রথম কথা হলো।

আপনার এভাবে খারাপ লাগে না?
– কিভাবে?
– এই যে মা আপনাকে দিয়ে কতো কি করাচ্ছে। এখন আপনি আমার সাথে এক জায়গায় যাচ্ছেন এটাও তো মায়ের কথা মতোই করছেন।
– খারাপ লাগবে কেনো? কাজকাম নেই তো। তাই ভাবলাম আপনার সাথে একটু ঘুরে আসি।
– আমি এটা বলিনি। আপনি আমাদের বাড়িতে থাকছেন। বাহিরে একটা নরমাল ঘরে,অথচ আমরা ভিতরে থাকছি। বাজার করাচ্ছি আপনাকে দিয়ে।
– না,খারাপ লাগে না। অভ্যাস হয়ে গেছে। সবার জীবনেই তো বিলাসিতা জোটে না। তবে যেমন আছি খারাপ নেই। বেঁচে আছি তো? এটাই অনেক আমার কাছে।
– আসলে বাবা বাসায় থাকে না তো। তাই মা চায় না আপনি বাড়ির ভিতরে থাকুন।
– সমস্যা নেই আমি কিছু মনে করি না এটা নিয়ে।
– আপনার বাড়িতে কেউ নেই?
– বাবা মা বেঁচে নেই,তবে একটা ভাই আছে।
– ওনার কাছে থাকেন না কেনো? ওনিই বা কোথায় থাকে।
– থাকতে চেয়েছিলাম,কিছুদিন ছিলামও। কিন্তু ওখানে থাকা আমার ভাবির পছন্দ না। বাড়িটা যেহেতু ভাবির বাবার দেওয়া তাই ভাইয়াও চায়নি আমি ওখানে থাকি। তাই তারা বের করে দেওয়ার আগে নিজেই চলে এসেছি। কেউ ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়ার আগে নিজে থেকে চলে আসাই তো ভালো,না?
– টিসু পেপার লাগবে?
– না।
– আমি সরি,আপনাকে ইমোশনাল করে দিলাম।
– আপনি কেনো সরি বলবেন? প্রতিরাতেই আমি চোখের জল ফেলি। যখন এসব মনে হয় তখন ভিতরটা জ্বলে যায়। নিজের রক্ত আমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। আমার আপন ভাই বেঁচে থাকতেও আমার বাঁচতে কেনো জানি ভয় হয়। এই পৃথিবীতে একা বেঁচে থাকাটা অনেক কষ্টের। আশেপাশের এতো এতো মানুষ থাকার পরেও নিজেকে খুব একা মনে হয়,অসহায় মনে হয়। খুব খারাপ লাগে যখন মনে হয় আমার মৃত্যুতে কেউ কাঁদবে না,অথচ আমি এখনো কেঁদে চাই নিজের অজান্তেই। কার জন্য কাঁদি,কি জন্য কাঁদি আমি জানি না।
-আপনার বাবা মা সবসময় আপনার সাথেই থাকে এটা ভেবে ঘুমাতে যাবেন তাহলে হয়তো কিছুটা হলেও মনটা হালকা হবে।
-ধন্যবাদ।
-কেনো?
-এই যে আমাকে এতো সুন্দর একটা উপদেশ দিলেন তাই।

পৃৃথিবীর সব সুন্দরী মেয়েই যে অহংকারী হয় এমনটা ভাবা ভুল। কিছু মেয়ের ভিতরটাও অনেক সুন্দর হয়।

কিছুদিন পর,
একটা কাজে রাফিয়াকে নিয়ে আমি শহরে এসেছি। এটাও রাফিয়ার মায়ের অনুরোধে। অনেকদিন পর সেই চেনা পরিচিত শহরটাতে পা রাখলাম। অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে শহরটাতে। দীর্ঘ তিনটা বছর আমি ছিলাম এখানে। কতো বন্ধু বান্ধবী ছিলো আমার,সবার সাথেই ভালো সম্পর্ক ছিলো আমার। কিন্তু সেদিনের পর কারো সাথে যোগাযোগ হয়নি। তারাও কেউ কোনোদিন ফোন দেয়নি আমিও দেইনি। এভাবেই আমি নিজেকে একাকিত্বের রাজ্যে বিস্তার ঘটিয়েছি। একাকিত্ব জীবনটা অনেক বেদনার তবে শান্তি আছে এ জীবনে। কারো কোনো অপমান সহ্য করতে হয় না,কারো কোনো কটু কথা শুনতে হয় না। নিজের চোখের জল ফেলার জন্য কারো কাছে কোনো কৈফিয়ত দিতে হয় না।

দুনিয়াটা খুব ছোট। চলার পথে কার সাথে কখন দেখা হয়ে যাবে আমরা কেউ বলতে পারি না। তবে কিছু কিছু মানুষের সাথে বোধয় দেখা না হওয়াই ভালো। কারণ কিছু মানুষের সাথে দেখা হওয়া মানে নিজের ভিতরের দুঃখগুলোকে জাগ্রত করা। আমি আর রাফিয়া একটা শপিং মলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি রিকশার জন্য। রাফিয়ার সাথে কোনো একজনের খুব মিল আছে। রাফিয়া যেমন শপিং করতে খুব পছন্দ করে সেই মেয়েটাও শপিং করতে অনেক পছন্দ করে। হঠাৎ করেই দেখলাম আমার সামনে দুজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। একজনকে চিন্তে পারলেও অন্য জনকে চিনতে পারলাম না। এই মেয়েটার সাথে কখনো দেখা হবে আমি কোনোদিন ভাবিনি,কখনো চাইওনি তাঁর সাথে আবার কখনো রাস্তার মোড়ে কিংবা কোনো রেস্টুরেন্ট আচানক দেখা হয়ে যাক। কিন্তু হয়ে গেলো,রাস্তার মোড়েই আমার প্রথম এক তরফা ভালোবাসার মানুষে সাথে দেখা হয়ে যায়, যে মানুষটা আমাকে জীবনে সবচাইতে বাজে ভাবে অপমান করেছিলো তাকে ভালোবাসার কথা বলেছিলাম বলে।

কেমন আছো?
– ভালো।
– আসলে ওইদিনের জন্য আমি অনেক দুঃখিত। আমার ওতোটা রিঅ্যাক্ট করা উচিত হয়নি। আমি অন্য ভাবে না করেই দিলেই পারতাম কিন্তু সেটা না করে তোমার সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি।

আমি কিছু বলি না। কারণ সেদিন আমার চোখ দিয়ে জল বেরিয়েছিলো আজকে অনুতপ্ত হলেই আমার মুখে হাসি ফুটবে এমনটা নয়।

” কে এই মেয়েটা? গার্লফ্রেন্ড?”
“না,আমি আমার টাইপ কাউকে এখনো খুঁজে পাইনি।

কথাটা বলে আমি রাফিয়াকে নিয়ে চলে আসি।

চলবে………….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here